ডায়েরি পর্ব ১৪

#ডায়েরি_পর্ব_১৪

জান্নাতুল জান্নাত

পুলিশের ফোন পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ অঞ্জনা মারা গেছে? কিন্তু কিভাবে? ওতো শ্যুটিংএ ছিলো৷ গাড়ি নিয়ে ছুটে গেলাম স্পটে৷ আহ্ আমার সোনার প্রতিমা শুয়ে আছে মাটিতে৷ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম৷ পুলিশ টাচ করতে নিষেধ করলো৷ আমার মাও আরেকটা গাড়ি নিয়ে আসলো৷ মিডিয়া এসে ভীড় জমালো৷ নায়িকার অকাল মৃত্যুতে তারাও শোকাহত৷ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো৷

পুলিশ যখন লাশ গাড়িতে উঠাতে যাবে তখন একজন ছুটে এসে অঞ্জনাকে ধরে ফেললো
-অঞ্জু এ কি হয়েছে তোমার? কি করে হলো? আমার অঞ্জু এভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না৷

এগিয়ে গিয়ে কলার ধরে বললাম
-তোর আস্কারাতেই তো অঞ্জনা আমাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলো৷ নিশ্চয়ই শেষ মূহুর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলো তাই তুই অঞ্জনাকে খুন করেছিস৷

-কি? আমার অঞ্জুকে আমি খুন করবো? আরে সেই কলেজ লাইফ থেকে ওকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি৷ আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে বলে আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম৷ সময়ের গোলকধাধায় আবার আমরা মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু আমাদের মধ্যে সেরকম কোন সম্পর্ক নেই৷ আপনার সাথে অঞ্জু সুখী ছিলো না বলেই ডিভোর্স চেয়েছে৷ সেখানে আমার কোন ভূমিকা ছিলো না৷ আজই তো আপনাদের আদালতের তারিখ ছিলো৷

-হ্যাঁ ছিলো৷ কিন্তু এসবের জন্য তুই দায়ী৷ দিনের পর দিন আমাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ তৈরি করেছিস৷ অফিসার প্রায় চার বছর আগে এই তপু তনিমা নামের এক মেয়েকে ঢুকিয়েছে আমাদের সংসারে৷ ঐ মেয়ে এসে আমার ছেলে মেয়েকে হাত করেছে৷ পূর্ব প্রেমিকের মেয়ে বলে অঞ্জনা ওকে বেশি আদর দিতো৷

-হ্যাঁ অফিসার সাহেব আমি নিজে বহুবার বলেছিলাম বৌমাকে বাইরের মানুষকে এতো লাই দিও না৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমার মনে হয় এই মেয়ের মাধ্যমেই পুরোনো প্রেম ঝালাই করেছে এরা৷
-আমাদের সন্তানরা বাঁধা হতে পারে ভেবে আগেই ওদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ সাথে ঐ মেয়েকেও পাঠিয়েছে৷ এভাবে ওরা ওদের পথ পরিস্কার করেছে৷

-বেশ স্ট্রং মোটিভ দেখছি৷
-আরে অফিসার আমি অঞ্জুর এ বিষয়ে কিচ্ছু জানিনা৷
-অফিসার উনি জানেন না মানে? সামনেই উনার বাড়ি৷ উনার বাড়ির কাছেই অঞ্জনার লাশ পেয়েছেন আপনারা৷ এরপর আর বুঝানোর কি আছে?

-দেখুন তপু সাহেব জানিনা বললে তো হবে না৷ আপনার বাড়ি কাছাকাছি৷ লাশ এখানে, গাড়িটাও এখানে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, স্ট্রং মোটিভও আছে৷ সব প্রমাণ আপনার বিরুদ্ধে৷
-হায় ঈশ্বর৷ ওকে খুন করে আমার লাভ কি?
-লাভ কি সেটা তো রিমান্ডেই বের হয়ে যাবে৷
-স্যার ওখান থেকে এই ফোনটা পেয়েছি৷

ফোনটা হাতে নিয়ে সুব্রতর কাছে গিয়ে অফিসার বললেন
-দেখুন তো স্যার এটা ম্যাডামের ফোন কিনা?

চোখ মুছে কোনভাবে তাকিয়ে বললাম
-হ্যাঁ এটাই আমার অঞ্জনার ফোন৷ কিন্তু এটা দিয়ে এখন কি হবে? আমার অঞ্জনা কি আবার ফিরে আসবে?
-স্যার এভাবে আবেগপ্রবণ হবেন না৷ আমরা কথা দিচ্ছি ম্যাডামের আসল খুনীকে আমরা খুঁজে বের করবোই৷ আমাদের সবার প্রিয় নায়িকার এ অকাল মৃত্যু আমরা কিছুতেই মানতে পারবো না৷

-ঐ তপুই আসল খুনী৷ আপনারা ওকে এরেস্ট করুন৷
-স্যার এরকম সন্দেহের বশে কাউকে এরেস্ট করা যায় না৷ আগে পোস্টমর্টেম হোক তারপর ধরা যাবে৷ আর যেহেতু ফোনটাও আমাদের হাতে এসেছে আমরা নিশ্চয়ই এর থেকে অনেক তথ্য পাবো৷ স্যার এবার আমরা যাই তাহলে৷ লোকের ভীড় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে পরে আর ঠেকানো যাবে না৷
-আচ্ছা যান সাবধানে কাটাকুটি কইরেন৷
পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেলো৷ তপু আর সুব্রত দু’জনেই দু’জনের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন৷

অঞ্জন দত্ত গেলেন পুলিশ স্টেশনে৷ অফিসারের সাথে কথা বলছেন
-অঞ্জনা রায় চৌধুরীকে তো শেষ জীবিত আপনার শ্যুটিং স্পটেই দেখা গিয়েছিলো৷
-হ্যাঁ৷
-তিনি তো ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতেন৷ তো ড্রাইভারকে তো পেলাম না৷

-কাল ড্রাইভারকে অঞ্জনাই ছুটি দিয়েছিলো৷ ও নিজেই ড্রাইভ করে যাবে বলছিলো৷
-ও৷ উনি কি ড্রাইভিং পারতেন?
-হ্যাঁ, বেশ ভালো৷
-আপনারও কি তপুকে সন্দেহ হয়?

-হ্যাঁ৷ আসলে অঞ্জনা প্রায় একবছর যাবৎ মানে ছেলে মেয়েকে বিদেশ পাঠানোর পর থেকে প্রায়ই তপুর সাথে রাত্রিবাস করতো৷ আর তখন ড্রাইভারকে ছুটি দিতো৷ গতকাল যেহেতু ছুটি দিয়েছিলো তাই ভেবেছি তপুর ওখানেই যাবে৷ হয়তো গিয়েওছিলো বাকিটা তো আপনারাই জানেন৷

-গোলমেলেই লাগছে৷ ফোনেও মেসেজ পেলাম শেষ মেসেজ তপুকেই করেছে “তপু আমি আসছি”৷ আমরা ভাবছি ম্যাডামকে খুন করে তপুর লাভটা কি হলো? জেলেই তো পঁচতে হবে৷
-লাভ কি আপনারা বের করুন৷ লস তো আমাদের হলো৷ কয়েকটা ছবি মাঝপথে থেমে গেলো৷ এখন নতুন নায়িকা তৈরি করতে হবে৷ তবে আপনাকে একটা কথা বলার আছে৷ কিছুটা সিক্রেট কাউকে বলবেন না যেনো৷

অফিসার ভ্রু কুচকে বললেন
-হ্যাঁ বলুন৷
-আরে এমপি তালেব সরকার আছে না?
-হ্যাঁ৷

-তার তো আবার একটু সুন্দরীদের নেশা আছে৷ তাই
মাঝে সাঝে আমার কাছে আসে৷ আর এই অঞ্জনারও তো ঐ পেশাটাও কম যায় না৷ সেদিন দু’জন সময় কাটাচ্ছে হঠাৎ ঐ রুমে গিয়ে এই তপু হাজির৷ বোঝেন কেমন অবস্থা৷ সেই অবস্থায় দু’জনকে দেখেছে তপু৷ পরে অঞ্জনাই তপুর জন্য রুম রাখলো৷ শুনেছি সন্ধ্যার পর ঘন্টাখানিক ওরা একসাথে একরুমে ছিলো৷

-কি বলছেন? অঞ্জনা ম্যাডাম এসবও করতেন? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷
-আসলে টাকার লোভ মানুষকে একবার পেলে আর ছাড়ে না৷ অঞ্জনারও তাই হয়েছিলো৷ টাকার জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত ছিলো৷ ছবিতে তো শর্ট ড্রেস পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতো৷ কি আর বলবো চুক্তিবদ্ধ ছিলাম বলে ঠেকা ছিলাম৷ নয়তো কবেই বাদ দিতাম ছবি থেকে৷

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অফিসার বললেন
-আপনার কথা শেষ হয়েছে? আমার একটু কাজ আছে৷
-আচ্ছা ঠিক আছে৷ আমি তবে আসছি৷ আমাকে কিন্তু আপডেট জানাবেন৷

মিডিয়ার মাধ্যমে তনিমারা খবর পেলো কিন্তু আসার উপায় নেই৷ মামনিকে কথা দিয়েছিলাম আমরা মামনির মনের মতো হয়ে ফিরবো৷ তাই ফেরা সম্ভব না৷ ওখানে ফিরলে ঐ লোকটার হাতে পড়বো৷ তখন আর অনিতাদের বাঁচাতে পারবো না৷ আমাকে এখানেই থাকতে হবে৷

দু’দিন পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বেরুলো৷ তথ্য প্রমাণ সব তপুর দিকেই নির্দেশ করে৷ পুলিশও তপুকেই সাসপেক্ট করে এরেস্ট করলো৷ তপুও অবাক হচ্ছে কেন অঞ্জনা এভাবে ঝিলের পাড়ে পড়ে ছিলো৷ কে ওকে খুন করলো? ওর স্বামী? নাকি অঞ্জন দত্ত? কিন্তু আমাকে তাহলে মেসেজটা কে করেছিলো? অঞ্জুই করেছিলো নাকি অন্যকেউ? আমি তো কল ব্যাক করেছিলাম৷ তখন তো কেউ ফোন ধরলো না৷ এমন তো হতে পারে অঞ্জুর ফোন দিয়েই অন্য কেউ মেসেজ করেছে? মনে হতেই হাবিলদারকে ডেকে বললো
-অফিসারের সাথে আমার জরুরী কথা আছে৷

অফিসার ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছেন
“তপুকে কেন যেনো সন্দেহ করতে পারছি না৷ কোথাও যেনো মনে হচ্ছে তপুকে কেউ দোষী সাজাচ্ছে৷ কিন্তু আমিও তো কিছু করতে পারছি না৷”

-হ্যাঁ, বলুন তপু সাহেব৷
-খুব সাধারণ একজন উকিল নিয়োগ করেছি৷ আমার তো তেমন টাকা নেই আর সুব্রত ও অঞ্জন দত্তের সাথে পারাটা সম্ভব নয়৷ আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে৷ খুন তো আমি করিনি৷ যতটুকু আমার সন্দেহ অঞ্জুর স্বামী সুব্রত করেছে৷ সেদিনই ওদের ডিভোর্সের তারিখ ছিলো৷ যাই হোক আপনারা মোবাইলের ফিঙ্গার প্রিন্ট দেখুন৷

-তপু সাহেব কোথাও কোন ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই৷ শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে৷ তার আগে নেশাজাতীয় দ্রব্য খেয়েছিলেন ম্যাডাম আর সেটা আপনার ঘরেই পাওয়া গেছে৷ আসলে আপনাকে বাঁচানোর উপায় আমাদের নেই৷ আপনি বাজেভাবে ফেসে গেছেন৷

-কিন্তু আমি খুনটা করিনি৷
-প্রমাণ তো সে কথা বলছে না৷
-ঈশ্বর জানেন আমি অঞ্জুকে ভালোবাসতাম আর এখনো বাসি৷ ওকে খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷
-ঈশ্বরকেই ডাকুন৷ আগামী সপ্তাহে শুনানী৷

এক সপ্তাহ্ পর কেস আদালতে উঠলো৷ জেলে বসে খুন করিনি বললেও আদালতে আর সেটা বললাম না৷ জানি লাভ হবে না৷ আদালত আমাকে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দিলো কিন্তু পোস্টমর্টেমে এসেছে তিনজন খুনী ছিলো৷ বাকি দু’জনের সন্ধান এখনও আদালত করে যাচ্ছে৷ আমি বন্দী হলাম কারাগারে৷

-সুব্রত আজকের আয়োজনটা বেশ ভালো ছিলো৷
-উফফ শেষ পর্যন্ত তপুর জেল হলো যদি না হতো তাহলে তো আমরাই বিপদে পড়তাম৷
-এখনও কিন্তু বিপদ যায়নি৷ বাকি দু’জনকে আদালত খুঁজছে৷
-বাদ দে৷ আদালত আর কয়দিন খুঁজবে৷ ওসব ভুলে যাবে দু’মাসেই৷

-এতো বড় একটা ঘটনা ঘটলো তোর ছেলে মেয়েরা আসলো না যে?
-কি জানি৷ আমার ভেবে লাভ কি? ইচ্ছে হলে আসবে৷ মরা দেখতে এসেই বা কি করবে৷ অঞ্জনার খুব শখ ছিলো তপুর সাথে ঘর করার৷ দিয়েছি শখ মিটিয়ে৷
-যাই বলো বেশ ইনকাম হতো৷ পথটা বন্ধ হয়ে গেলো৷
-এমনিতেও চুক্তির পর ও কাজ করতো মনে হয়?
-তাহলে?
-বাদ দাও৷

-মাকে তোমার বাবা মেরে ফেললো দিদি?
-বাবা মামনিকে মারতে পারে না৷ কেউ বাবাকে ফাসিয়েছে৷ বাবা তো মামনিকে….
-মামনিকে কি দিদি?
-মামনির খুব ভালো বন্ধু৷ এরা মিথ্যে কেসে আমার বাবাকে শাস্তি দিচ্ছে৷

-দিদি চলো আমরা দেশে যাই৷
-দেশে গিয়ে লাভ নেই৷ মামনিকে কথা দিয়েছি মানুষ হয়ে ফিরবো৷ মামনি নেই মামনিকে দেয়া কথা রাখতে হবে৷ তোরা বস আমি বাসায় একটা ফোন করছি৷ রিং বাজতেই সুব্রত ধরলো
-হ্যালো৷
-তনিমা বলছি৷
-ফোন করেছো কেন?
-আপনারা যা খুশি করেন কিন্তু মামনির স্ট্যাডি রুমে হাত দিবেন না৷ ওটা আমি এসে খুলবো৷ আর কেউ নয়৷

উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলো সুব্রত৷ তনিমার চোখ গেলো অনিতার লকেটের দিকে৷
‘এমন একটা অদ্ভুত লকেট মামনি কেন উপহার দিলো?’
-অনিতা লকেটটা একটু দে তো৷

অনিতা লকেটটা খুলে তনিমার হাতে দিলো৷ হাতে নিয়ে দেখছে আর ভাবছে
‘সোনার নৌকো! সোনার নৌকো!! আরে নোকার আরেক নাম তো তরী!! মানে সোনার তরী৷ তার মানে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী বইটা যেখানে আছে…৷

আচ্ছা লকেটটা খোলা যায়? চেষ্টা করতেই খুলে গেলো৷ তার মানে সোনার তরীর মধ্যে ফাঁপা৷ আর ওখানে কোনো একটা সূত্র আছে৷ ফিরতে হবে দেশে৷ বাবাকে মুক্ত করতে হবে৷ আসল দোষীকে আইনের সামনে আনতে হবে৷
চলবে……

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here