তার বিকল্পে পর্ব -০৩ ও শেষ

#তার_বিকল্পে (০৩)

‘ আচ্ছা তোমার বিয়ে হয়েছে?

মেহুল একটু নড়েচড়ে বললো,
‘ না আন্টি। আসলে..

মেহুল বিস্তারিত বলতে যাবে তখনি শোভনের মা বললো,
‘ শোনো মা তোমাকে একটা কথা বলি, আজকাল মানুষকে বিশ্বাস করাটা ভীষণ কঠিন। হারাম সম্পর্কে ডুবে থেকে তার থেকে সেরাটা আশা করা যায়না। সে কেবল কষ্টই দিবে, তার চেয়ে ভালো বিয়ে করে নাও।

মেহুল বুঝতে পারছেনা তারা মা ছেলে তার সম্পর্কে নিজেরাই কেন নিজেদের মতো বলছে! ব্যপারগুলো তো একদমই এমন নয়। কিন্তু বেয়াদবি হবে ভেবে প্রসঙ্গ থেকে বের হতে চাইলোনা, থাক বলুক৷ অন্য সময় হলে মেহুল এভাবে নিজের সম্পর্কে ভুলভাল কথাকে গ্রহণ করতোনা, পাল্টা জবাব কিছু একটা দিয়েই সরে যেতো। কিন্তু এখানে সে পারছেনা। মহিলাটা তার মায়ের চেয়েও বৃদ্ধ, কতো সরল! সে সুইসাইড করতে যাচ্ছিলো ভেবে এতকিছু বুঝানোর চেষ্টা করছে। শোভনের মা খাবারের প্যাকেট খুলতে খুলতে বললো,
‘ আচ্ছা তোমার নাম কি মা? কে কে আছে পরিবারে?

‘ মেহুল সুলতানা। আমার পরিবারে আমার মা-বাবা আর ছয়বোন ছিলো, যাদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে কেবল মা-বাবা আছেন।

‘ তোমার স্বপ্ন কি? কি করতে চাও জীবনে?

মেহুল একটু ভাবলো। কাল পর্যন্তও তো তার স্বপ্ন ছিলো বিয়ে করা। সে তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ ইউনিভার্সিটি শেষ হলেই দেশের বাইরে চলে যাওয়া।

‘ তোমার দেশে থাকার ইচ্ছে নেই কি বলো?

‘ না না আন্টি, ইচ্ছে আছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে প্রফেশনের উপর ভিত্তি করে যেখানে থাকার থাকবো আরকি!

‘ না না দেশের বাইরে যাওয়ারই দরকার নেই। দেশেই ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা আছে। এখানেই পড়ালেখা শেষ করো, প্রয়োজনে বিয়ে করে ফেলো। এরপর পড়াশোনা সংসার দুটোই করো।

মেহুল ইতস্তত হলো। কোনো জবাব দিলোনা আর। এর মধ্যে শোভন দরজা খুলে বললো,
‘ মা আমি বাইরে একটা সীট ম্যনেজ করেছি। তোমরা থাকো, আমি আছি। প্রয়োজনে ফোন দিও।

‘ সেকি শোভন তুমি বাইরে থাকবে কেন? মেহুলের কোনো সমস্যা হবেনা, বসো এখানেই। সামনের এতো বড় সীট খালি আছে। আসো ভেতরে আসো।

মেহুল সাথে সাথে বললো,
‘ হ্যাঁ আমার কোনো সমস্যা নাই।

শোভন থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
‘ তাহলে আমি টিটিইকে বলে দিয়ে আসি।

শোভনের মা মেহুলকে খেতে বলে নিজের ফোনের এলবাম খুললো,তারপর খেতে খেতে মেহুলকে দেখাতে লাগলো,
‘ দেখো এটা আমার ছোট ভাই ভাবি, আর এটা হলো তার বড় ছেলে। কয়েকমাস আগে আমরা সবাই তার বিয়েতে গিয়েছিলাম। সেখানে এই মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিলো।

বলে একটা গ্রুপ ছবির অনেক পেছনে একটা ছবি জুম করে মেহুলকে দেখালো। মেহুল দেখলো মেয়েটা বেশ সুন্দরী। তারপর শোভনের মা বলতে লাগলো,
‘ আমি আমার ছেলেকে দেখিয়েছি, বলেছি মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লেগেছে দেখ তোর কেমন লাগে! শোভন আমাকে পাত্তাই দেয়নি। কিছুদিন পরে বুঝলাম পাত্তা না দেওয়ার কারণ। মেয়েটা ফেইসবুকে প্রেম করে এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেলো। সেই ছেলে নাকি তাকে বরিশাল নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে এক জায়গা বসিয়ে রেখে উধাও হয়ে গেছে। মেয়ের মোবাইল ব্যাগ,টাকাপয়সাও সব নিয়ে গেছে৷ পরে সেই মেয়ে নাকি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো, এলাকার লোকজন ধরে খোঁজ খবর নিয়ে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। জানো দুই সপ্তাহ আগে মেয়েটার বিয়েও হয়েছে। তার জামাই তাকে নিয়ে নাকি ফ্রান্স চলে যাবে। এখন জামাইয়ের সাথে মেয়েটা কি যে খুশি! এই দেখো তাদের বিয়ের পরের ছবি। বুঝলে কিছু খারাপ সময় ধৈর্য নিয়ে পার করলেই সুখ দল বেঁধে আসে।

মেহুল উঁকি দিয়ে ছবিগুলো দেখার মধ্যেই শোভন প্রবেশ করে বললো,
‘ মা তুমি কি রাজ্যের কথা একেবারে শেষ করে ফেলছো নাকি?

‘ আরেনা, আমি সোনিয়ার ছবি দেখাচ্ছিলাম। সোনিয়াও তো আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো, মেয়েটা কি এখন ভালো আছেনা বল?

‘ হ্যাঁ আছে, কারণ তার ভালো একজনের সাথে বিয়ে হয়েছে।

তখনি শোভনের মা বলে উঠলো,
‘ এই মেহুল তুমি বিয়ে করবে? আমার ছোট ভাইয়ের মেঝো ছেলেটা খুব লক্ষী। তারা বড় ভাইয়ের পরে মেঝোটার জন্যও বউ খুঁজছে!

মেহুলের মাথা ভনভন করছে। তার বলতে ইচ্ছে করছে,
‘ আপনারা অহেতুক কথা থামান! আমি বিয়েসাদী করবোনা, এই শব্দটাই ভালো লাগছেনা!

কিন্তু তার কিছু বলার আগেই আবার শোভনের মা বললো,
‘ মেহুল কিন্তু দেখতে ভারী মিষ্টি। সাইদ পছন্দ করবে নিশ্চিত।

শোভন মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে বললো,
‘ আমিও করেছি।

কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেও শোভনের মা ছেলের কথা শুনে থেমে গেলো। মেহুলের দিকে সাথে সাথে নজর করে দেখলো মেহুলের প্রতিক্রিয়া শূন্য। সাথে সাথে মেহুলকে ঝাঁকিয়ে বললো,
‘ মেহুল শুনেছো শোভন কি বলেছে? তোমাকে ওর ভালো লেগেছে। আমার ছেলে কতো বছর আগে এক সুস্মিতাকে ভালোবেসেছিলো, এখনো পর্যন্ত তাকে আর কোনো মেয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়াতে পারিনি। আমার ছেলে তোমাকে পছন্দ করলে আমি তোমাকেই….

‘ আন্টি কাল আমার বিয়ের তারিখ।

মেহুলের এই সহজ উত্তরটা শোভনের মার চেহেরাটাকে মূহুর্তেই বিমর্ষ করে দিলো। অসমাপ্ত কথাটা আর সমাপ্ত হওয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। শোভনও মেহুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহুল ইচ্ছে করেই বলেছে! কাল বিয়ের তারিখ বলে তাদেরকে সেখানেই থামাতে চাচ্ছে, কিন্তু মেহুল এই মূহুর্তে কোনোভাবেই বিয়ে করবেনা। শুধু সবাইকে থামানোর যুদ্ধ করতে হবে। শোভনের মা ধীরে ধীরে মেহুলের মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ মা আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। দেখো নিজের অমতে কিছু করা উচিত নয়। তুমি আরেকটু ভাবো মা।

মেহুল ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো,
‘ আসলে আমার মা-বাবা আমার অনিচ্ছায় বিয়ে ঠিক করেনি। দোয়া করবেন আমার জন্য, আমি এখানে নেমে যাবো।

একটা অচেনা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে মিনিটখানেক হলো। মেহুল দ্রুত পায়ে বের হওয়ার সময় পেছনে পেছনে শোভনও উঠে এলো। মেহুল নেমে যাওয়ার জন্য দরজায় কাছে পৌঁছাতেই উদয় তার সামনে পড়ে গেলো, তাকে দেখেই বললো,
‘ রাত বাজে সাড়ে বারোটা। অচেনা স্টেশনে একটা পুরুষ মানুষও নেমে যাওয়ার সাহস করতোনা। আপনি সত্যিই যে কি আল্লাহ মালুম!

মেহুল একদম কিছুতে কর্ণপাত করলোনা। তাড়াহুড়ো করে নেমে এক দৌঁড়ে স্টেশনের ভেতরে চলে গেলো। দুই মিনিট পর ট্রেন ছেড়ে দিলো, ছেড়ে দেওয়ার সময় মেহুল আড়াল থেকে ট্রেনের চলে যাওয়াকে লক্ষ্য করতে লাগলো। তারপর যখন বুঝলো গোটা একটা ট্রেনের সাথে তার সব অস্বস্তির বিদায় হয়েছে তখন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর মেহুল ট্রেনের সময়সূচীতে নজর দিলো, দেখলো ফিরে যাওয়ার জন্য একটা ট্রেন আছে, যেটা ভোর চারটায়৷ অন্যভাবে যেতেও তার চার-পাঁচ ঘন্টা লাগবে, যা আবার একটু রিস্কি। তাই সে ভেবে উঠতে পারছেনা কি করবে!

স্টেশনের আশেপাশে এখনো অনেক মানুষ। বসার জায়গায় অনেকেই ঘুমিয়ে আছে, মেঝেতেও অনেক পথশিশু কিংবা বাসস্থানহীন মানুষরা ঘুমুচ্ছে।
মেহুল ধীরে ধীরে তাদেরই কাছে গেলো। দেখলো মশার কামড়ে তারা অনেক নড়াচড়া করছে। মেহুল ব্যাগটা রেখে বসলো, এখানে তিন ঘন্টার মতো সময় তো না ঘুমিয়ে অনায়েসে কাটাতে পারবে।

তার বসাকে খেয়াল করে শুয়ে থাকা একজন মাথা তুলে বললো,
‘ আফা আফনে এইহানে থাকতে ফারবেন? হোটেলে যানগা।

মেহুল হেসে বললো,
‘ তোমরা সবসময় পারো, আমি কেন একদিন পারবোনা?

মহিলাটা নিজের বাচ্চাদের দিকে নজর দিয়ে আবার শুতে শুতে বললো,
‘ আইচ্ছা ফারলে থাহেন।

মেহুল ব্যাগটা কোলে তুলে দুই হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো সেই দুইটা মানুষ তার আচরণে কষ্ট পায়নি তো? তারা তো সর্বস্বটা দিয়ে তার পাশে থাকতে চেয়েছিলো। মানুষ যা চায় তা নাহয় পায়না, কিন্তু যা পায় তাকে অবহেলা করাটাও তো উচিত নয়। তার সারা জীবনে কেউই তো তাকে এভাবে সুন্দর বলে অমায়িকতার সাথে অভিহিত করেনি। হয়তো কখনো তার সৌন্দর্যটা কারো চোখে পড়েনি!
তারা কি সত্যিই মেহুলের জন্য মঙ্গল ছিলো? আল্লাহর ইচ্ছেতেই কিনা এই আকস্মিক পরিচয়? তারপর আবারও নিজের এই ভাবনাটা পাল্টালো, নাহ এসব ভেবে কি লাভ? সে তো এই মূহুর্তে জীবনকে আর পরিবর্তন করার কথা ভাব্বেনা! এভাবেই চালিয়ে নিবে যতদূর পারে। বিয়ে জিনিসটা তার জন্য নয়!

হঠাৎ তার মাথায় কেউ হাত রাখলো। মেহুল সাথে সাথে মাথা তুলে দেখলো তার সামনে সেই মহিলা বসে আছে, পেছনে তার ছেলে। সে থতমত করে বললো,
‘ আ’আ’আপনি,আপনারা?

মাথায় দেওয়া হাতটা মেহুলের এলোমেলো চুলগুলোকে পেছনে সরাতে ব্যস্ত। মেহুল দেখলো বৃদ্ধ মানুষটার চোখে পানি। মেহুল বুঝে উঠতে পারছেনা তারা কখন, কেন এভাবে নেমে গেলো! দুইজনের কেউ কিছু বলছেনা বলে মেহুল আবার বললো,
‘ আপনাদের তো এখানে নামার কথা ছিলোনা।

থরথরে কাঁপা গলায় শোভনের মা বলতে লাগলো,
‘ তোমার পেছন পেছন দরজার সামনে আমি আসার পর ওখানে একটা ছেলে হাসতে হাসতে শোভনকে বলছিলো, ভাই জানেন আমার বাবা মা আস্ত একটা বেডার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলো, রাতবেরাতে যেভাবে চলাফেরা করে, মনে হয়না আশেপাশের কোনো মেয়েছেলের সাথে শোয়া বাদ আছে। তার উপর আজকে আমার কপাল খারাপ, বারবার এরেই সামনে দেখতেছি। দেখেন মধ্যরাতে কীভাবে নেমে গেলো আবার!
আরো কি কি যেন বলছিলো, আর কিছু না শুনে তখনি আমার ছেলেকে বললাম আমি নেমে যাচ্ছি তুই ব্যাগ দুইটা নিয়ে তাড়াতাড়ি নাম৷

বলেই শোভনের মা মেহুলের চোখবেয়ে আসা পানিকে ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে আঁচল দিয়ে মুছে দিলো।
মেহুল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘ এসব শুনেও তাহলে কেন নামলেন?

‘ কারণ আমি এই বেডা সম্বোধিত মানুষটাকে নিজ হাতে আমার মেয়ে বানাবো! ওখাবে আমি এতকিছু বললাম,তুমি একবারও আমার কথাকে আটকালেনা, বললেনা যে আমি সঠিক আন্দাজ করিনি। তার উপর শেষ পর্যন্ত বলে এলে তোমার কাল বিয়ে! আরে মা বিয়ে কীভাবে হবে? বর-ই তো নেই! কেন জেদ করো? আমার ছেলে খুব ভালো বিশ্বাস করো! যে তার মাকে ছাড়া তার একটা সিঙ্গেল ছুটি কাটায়না, সে তার বউকে কেমন রাখবে বুঝতে পারো? সে তোমাকে অনেক পছন্দ করেছে। তুমি যদি রাজী হও আমরা দুজন তোমার সাথে তোমার বাড়ি যাচ্ছি, কালকে তোমার বিয়ের তারিখেই বিয়ে হবে। কিন্তু সেটা আমার ছেলের সাথে হবে!

মেহুল কেবল কাঁদছে! অন্তত এই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তার নাই।
আল্লাহ উত্তম কিছু পাইয়ে দিতে বহু উছিলা করেন, যা আশা করা যায়না, ভাবা যায়না, কল্পনায়ও আসেনা। দুনিয়ার সব ভুল কিছুরই বিকল্প থাকে। এই যে, যা ভুল হওয়ার ছিলো তা পাল্টে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার বিকল্পে সঠিকটার উপস্থিতি! মেহুল কিংবা শোভন দুজনের কেউ কি তা আগে ভাবতে পেরেছিলো?!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here