#তীব্র_প্রেমের_নেশা (২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____________
সকাল থেকেই পুরো বাড়িতে হৈ চৈ। আজ বউভাত। একের পর এক আত্মীয় স্বজন আসছে আর হৈ চৈ বাড়ছে৷ এতো আওয়াজে মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। বিয়েটা যেমন আমেজে হয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ বেশি আমেজ বউভাত নিয়ে। হবে না! আজাদ শেখের ছেলে তাশজীদ শেখ তীব্রর বিয়ের বউভাত বলে কথা! বিয়েটা যেমনই হোক বউভাত হতে হবে বিরাট আয়োজনে নয়তো ইমেজের ১২ টা বেজে যাবে। আয়নার সামনে বসে কানের দুল পড়তে পড়তে কথা গুলো ভাবছিলাম আর হাসছিলাম। মানুষ নিজের ইমেজ নিয়ে কতটা সতর্ক হলে নিজের ছেলের এতো বড় কু’কর্ম টাকার জোড়ে দাবিয়ে রাখে! তীব্র কত বড় অ’পরাধী তা ভাইরাল হতে দেয়নি আজাদ শেখ। ঘটনাটা ১ রাতেই চাপা পড়ে গেছে টাকার কাছে। এই ঘটনা কেবল আমরা কয়েকজনই জানি। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এরমধ্যেই তিহা ‘ভাবী’ বলে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে আসলো। আমি ওর দিকে তাকাতেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
‘ভাইয়াকে দেখেছো ভাবী? পুরো বাড়িতে কোথাও খুঁজে পেলাম না।’
তীব্রর কথা উঠতেই আমার ভোর রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। তখন ওই কথাটা শোনার পর চট করে চোখ মেলতেই আশে পাশে কাউকে দেখিনি৷ অথচ আমার স্পষ্ট মনে হয়েছিলো কেউ কানের কাছে বলেছিলো কথাগুলো। রুমে উঁকি দিয়েও দেখেছি কিন্তু তীব্র সেখানে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিলো। আমি কনফিউজড হয়ে বসেছিলাম কতক্ষণ। তিহার ডাকে আমার ধ্যান ভাঙে,
‘কি ভাবো? বলো না!’
‘হ্যাঁ? নাহ দেখিনি তোমার ভাইয়াকে।’
বলেই নিজের কাজে মন দিলাম। বেচারীর মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো। আমি আড়চোখে তা দেখেও এড়িয়ে গেলাম। এর মধ্যেই আরো ২ জন রুমে আসে। আমি তাদের দিকে তাকাতেই তারা তিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তিহা প্রানেশাকে নিচে নিয়ে যেতে বলেছে মামি। ওকে নিয়ে আয়। আমাদের অনেক কাজ আছে আমরা গেলাম।’
কথাগুলো এতো দ্রুত বললো যেনো তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছে। ঝড়ের বেগে এসে আবার তুফানের বেগে চলে গেলেন। আমি সেদিকে একবার তাকিয়ে তিহার দিকে তাকালাম। তিহা মন খারাপ করে বলে,
‘নিচে চলো ভাবী!’
আমি মাথা নাড়ালাম। চুপচাপ মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে তিহার হাত ধরে নিচে নামলাম। আন্টি আমাকে সহ্য করতে না পারলেও এতো লোকজনের সামনে মুখ গোমড়া করে থাকলেন না। হাসিমুখে কাছে এসে কয়েকজনের মধ্যে বসিয়ে দিলেন। মহিলাগুলো শুরু করলেন খুঁত খুঁজতে। বিরক্তিতে মাথা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কাউকে কিছু বললাম না৷ তারা যখন খুঁত ধরতে ব্যস্ত তখনই ভেসে আসে এক গম্ভীর কন্ঠ,
‘এখানে এতো ভীড় কিসের?’
সবাই সেদিকে তাকায়। আমিও তাকালাম। তীব্র দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখ একরাশ বিরক্তি, গম্ভীরতা আর রাগ। চুলগুলো এলোমেলো, চোখটা খানিকটা লাল, শার্টের ওপরের দু বাটন খোলা, এক হাত পকেটে গুজে রাখা। পাশ থেকে এক মেয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘তীব্র এতো জোস কেন ভাই? যেমন হ্যান্ডসাম তেমনই হ*ট। ভাইরে ভাই দেখলেই মনে হয় চকলেটের মতো করে খে’য়ে ফেলি। ইশশ তীব্র যে কেন বিয়ে করলো!’
কথাগুলো কানে আসতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম মেয়েটার দিকে। কি অদ্ভুত আর বে’য়াদব মেয়ে। তীব্রর বউ বসে আছে দেখেও তার সামনেই তীব্রকে এসব বলে যাচ্ছে! মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়। সাথে সাথেই নিজেকে আড়াল করে। এরমধ্যেই তীব্র ফের গম্ভীর স্বরে বলে,
‘প্রানেশা রুমে আসো। তিহা!’
তিহাকে কিছু ঈশারা করতেই তিহা মাথা নাড়ায়। তীব্র গটগট করে সিড়ি ডিঙিয়ে উপরে চলে যায়। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তিহা কাছে এসে আমাকে ধরে রুম পর্যন্ত দিয়ে চলে যায়। আমি দরজা ঠেলে রুমের ভেতর ঢুকলাম৷ তীব্র বিছানায় শুয়ে আছে। একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে ছাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু না বলে মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে একগ্লাস পানি খেলাম। এতক্ষণ রুমে শুধু আমার হাতের চুড়ির শব্দ আর নিঃশ্বাসের শব্দটুকুই চলছিলো। একপর্যায়ে তীব্রই বলে,
‘আমি না থাকলে ওইসব মহিলাদের মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আম্মু ডাকলেও যাবে না।’
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ত্যাড়া জবাব দিলাম, ‘কেনো যাবো না? আপনার কথা শুনতে হবে আমার? বিয়ে হয়েছে বলে কি এখন অধিকার খাটানো শুরু করবেন! মিষ্টার তাশজিদ শেখ তীব্র আমি কোনো রে’পি’ষ্টের কথামতো চলতে বাধ্য নই।’
কথা শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ডও হয়নি। তীব্র ঝড়ের বেগে এসে আমাকে চেপে ধরে৷ এক হাতে কোমড় টেনে কাছে এনে আরেক হাতে ঘাড় চেপে ধরে পেঁচিয়ে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব। অবাকতার রেশ তখনো কাটেনি আমার। তীব্র মুখটা মুখোমুখি এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘কথায় কথায় রে’পি’ষ্ট রে’পি’ষ্ট করবে না। আমি একবার চুপ ছিলাম মানে সবসময় চুপ থাকবো এমন না। তুমি আমার বউ৷ আমি তো আমার অধিকার দেখাবোই! প্রথমে নিজেকে চিনো, নিজের আপন মানুষ চিনো তারপর এসো আমাকে রে’পি’ষ্ট বলতে। প্রুফ ছাড়া আর একবার আমাকে এসব বললে তোমাকে আমি!’
চুপ করে গেলেন৷ আমি তখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। উনি আমাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে এক হাত পেছনে মুড়িয়ে ধরলেন। ব্যাথায় আর্তনাদ করতেই বাঁকা হেঁসে বললেন,
‘তোমাকে আমি পু’ড়াবো প্রাণ। তীব্রের প্রেমের নেশায় এতোটাই তৃষ্ণার্থ করবো তোমাকে যে তুমি বার বার বহুবার শুধু তীব্রর কাছে ফিরতে বাধ্য হবে। বার বার তীব্রতে বিলীন হয়ে নিজেকে তৃষ্ণা মুক্ত করবে। সেদিনগুলো বেশি দেড়ি নেই। হয়তো কয়েক দিন, কয়েক মাস নয়তো কয়েক বছর। ততদিন শান্তিতে বাঁচো বউ।’
এরপর ছেড়ে দিলেন। আমি হাতটা আগলে নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উনার সব কথা কয়েকবার আওড়ানোর পরও মাথায় কিছুই এলো না৷ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলাম। উনার প্রথম কথা গুলো বুঝলেও পরের কথাগুলোর কোনো মানে খুঁজে পেলাম না৷ চারদিক হাতড়েও যখন কিছু পেলাম না তখন নিজের মাথা নিজের ফা’টাতে ইচ্ছে করলো। বেশি ভাবলে বরাবরই আমার মাথার সব তালগোল পাকিয়ে ঘেটে ‘ঘ’ হয়ে যায়। আমার ভাবনার মাঝেই খেয়াল করলাম তীব্র আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেন। এরপর চুলে হাত চালিয়ে গালের খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি গুলো একটু চুলকে মুখটা ‘চ’ এর মতো করে বললেন,
‘হাইটে ঠিকঠাক মতো আমার বুক সমানও না অথচ কথা বলে এমন ইচ্ছে করে থা’প’ড়ে সত্যিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই। লি’লি’পু’ট।’
উনার মুখে লি’লি’পু’ট শুনে জ্বলে উঠলাম। দাঁতে দাঁত চেপে উনাকে কিছু বলতে নিলেই উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পকেটে হাত গুঁজে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেলেন। রাগে, দুঃখে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বসে রইলাম বিছানায়। উনার শেষের কথাগুলোতে প্রথমের কথাগুলো বেমালুম ভুলে বসলাম। মনে মনে উনাকে বকা দিয়ে গো’ষ্ঠী উদ্ধার করা শুরু করলাম। এর মধ্যেই কয়েকজন মেয়েকে সাথে নিয়ে তিহা রুমে আসে। একেই তো রাগে জ্বলে ছিলাম তার মধ্যে পার্লারের মেয়েগুলোরে দেখে আরো রাগ লাগলো। তিহা আমার নাকের ডগা লাল দেখে কাছে টেনে ফিসফিস করে বলে,
‘ভাবী তোমার নাকের ডগা এমন লাল হয়ে আছে কেনো? রাগে নাকি লজ্জায়?’
_____
বাড়ি ভর্তি মেহমান তারওপর আবার ভারী লেহেঙ্গা, ভারী সাজ। আমার অবস্থা নাজেহাল হয়ে গেছে। ভীষণ হাসফাস লাগছিলো। পাশেই তীব্র হাসি হাসি মুখে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আমার অবস্থা দেখেও কিছু বললেন না। উল্টো মুখটা গম্ভীর করে বসে রইলেন। কিছুটা সময় পরই হাজির হলেন তীব্রর ফ্রেন্ড সার্কেল। আমি গুণে গুণে দেখলাম প্রায় ৪ জন ছেলে আর ৩ জন মেয়ে। মেয়েগুলোর হাজবেন্ডও আছে সাথে। নিজেদের কুশল বিনিময় হয়ে গেলে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। তীব্র আমার কাছে এসে মুখটা গম্ভীর করে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘প্রানেশা।’
আমি সালাম দিলাম। ছেলেগুলো আমাকে দেখে বোধহয় খানিকটা অবাকই হলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিছু বলতে নিলে তীব্রর চোখ রাঙানো দেখে আর কিছু বললো না। হাসার চেষ্টা করে সালাম নিলেন। টুকটাক কথাতেই জানলাম সবার নাম। ইমন, শিপন, সায়েম আর রিফাত। সবাইকে স্বাভাবিক ভাবে নিলেও রিফাতের চোখে মুখে গম্ভীরতা দেখে খানিকটা চমকে গেলাম। শুধু শুধু কেউ এমন গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালে তো চমকাবোই। নিজেকে সামলে নিলাম। উনারা নিজেদের মতো ফাজলামি করতে থাকলেন। ইমন ভাই তীব্রর পিঠে চা’পড় মে’রে শ’য়তানী হাসি হেঁসে বলে,
‘শেষ মেশ তাহলে বিয়েটা সেড়ে ফেললি দোস্ত। এখন হানিমুনের কি প্ল্যান?’
উনার প্রশ্নে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মুহুর্তেই কাশি উঠে গেলো। তীব্র বাকা হেঁসে আমাকে ধরে। ইমন ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
‘ব্যাপার কি ভাবি? হানিমুনের কথা শুনে হঠাৎ এতো কাশি কেন?’
আমি জবাব দিলাম না। আমার কাশির জন্য তিহা পানি হাতে ছুটে এসেছিলো ওটা খেয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। তীব্র ইমন ভাইদের কিছু বলে আমার পাশে এসে বসলেন। আস্তে করে বললেন,
‘ঠিক আছো?’
আমি মাথা নাড়ালাম। উনি ঘড়ি ঠিক করতে করতে ফের বললেন, ‘বিয়েটাই করেছে চাপে পড়ে এখন নাকি আবার হানিমুন! ইশশ বউটা আমার হানিমুনের কথা শুনেই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে।’
বলেই ঠোঁট চেপে হাসতে থাকলেন। আমি রাগী চোখে তাকালাম। এতগুলো মানুষের মধ্যে কিছু বলতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে পড়লো ফুপি, ফুপা, পলি আর পলি দাদুবাড়ির সবাই। পলি আমাকে দেখেই দৌড়ে আসে। জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তোমাকে তো একদম পুতুলের মতো লাগছে আপুই। তীব্র ভাইয়ের পাশে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে।’
বলেই হাসে। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। তীব্র সৌজন্যমূলক হেঁসে কথা বলে। লোকটা মনে হয় ঠিকঠাক মতো হাসতে পারে না নয়তো হাসতে চায় না মুখটা সব সময় গম্ভীর করে রাখে। ফুপি, ফুপা, পলির কাকা, কাকি, সবাই এগিয়ে আসলো। টুকটাক কথা বললো। এতো ভারী লেহেঙ্গা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেই শরীরের অর্ধেক শক্তি চলে যাচ্ছে। বাপরে! পলি আমাকে টেনে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,
‘ফার্স্ট নাইট কেমন কাটলো আপুই? এমন চকলেট মার্কা একটা জামাই পাইছো মনে তো হয় অনেক ভালো কাটছে তাই না!’
মুখ চেপে হাসতে থাকে পলি। আমি চোখে মুখে গম্ভীরতার ছাপ এনে ওকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘আমি তোর বড় পলি আর এসব কি ধরনের কথাবার্তা! তুই জানিস না? এরপরও এসব বলছিস কেনো?’
পলি হাসা থামিয়ে দীর্ঘশ্বাস নেয়। আমার বাহুতে হাত রেখে বলে, ‘কাম অন আপুই। তুমি এখনো ১ বছর আগের ঘটনাটা নিয়ে আছো! তীব্র ভাই যে কাজটা করেছে এটা তো এখনো প্রুফ হয়নি আর তিহা সারাদিন আমাকে বলে, ‘তীব্র ভাইয়া ওমন করতেই পারে না’।’
আমি ওর কথায় পাত্তা দিলাম না। কোনো বোনই মনে করে না তার ভাই অ’পরাধী হতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তীব্র এসে পলির সাথে গল্প জমিয়ে দিলো। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে সামনে তাকালাম। এক আগন্তুককে দেখে আঁতকে উঠলাম। তার একজোড়া চোখ আমার দিকেই নিবদ্ধ। ভয়ে পাশে থাকা তীব্রর হাত চেপে ধরলাম। কয়েক বার শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে তীব্রর পিছনে আড়াল করে নিলাম। অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
‘ ফারদিন ভাই!’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)