#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_ষোলো
আরশানের কাঁধে মাথা রেখে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে হাটছে অয়ন্তি। পেছনেই ফারহান কাউকে ফোন করছে অনবরত। ওরা তিনজন আজ ঘুরতে বেরিয়েছে। মূলত ফারহানের মন ভালো করতে বেরিয়েছে। কিন্তু বিবাহিত নতুন দম্পতি বিয়ের এই সময় অন্যকারোর মন ভালো করায় কতটুকু মনোযোগী থাকে? হাটতে হাটতে ওরা খেয়ালই করল না পেছনের মানুষটা গায়েব হয়ে গেছে। আরশানের দৃষ্টি নদীর মাঝ বরাবর থাকা মাছের ছোট নৌকাটার দিকে। হিম শীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ঠান্ডার আমেজে মনটা অতি প্রসন্ন। হঠাৎ ফারহানের কথা মনে পড়তেই আরশান পেছনে ফিরল,
-ফালাক কোথায়?
অয়ন্তি ত্বরিত গতিতে পেছনে ফেরে। এরপর আনমনেই বলল,
-পেছনে ছিল না? রোজের মত নিঁখোজ হয়ে গেলো নাকি?
-ধুর, না। নিঁখোজ হবে কেন? কোথাও গেছে হয়তো। কিন্তু না জানিয়ে যাওয়া ব্যাড ম্যানারস। বেয়াদবটাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না ভেবেই তো সঙ্গে আনলাম।
-তাই তো!
-ফালাকের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ছে কুসুম। অভিনয় জগৎ ছাড়া ও বাঁচতে পারেনা। বেবি সেটাই কেড়ে নিতে চাচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু চলে গেল কেন? ফালাকের কাছে থেকেই ওকে অভিনয়ের থেকে দূরে রাখতো। এভাবে তো ফালাকের জীবনটাও নষ্ট হচ্ছে। পাঁচটা বছর যে অনেক সময় তা কি বুঝতে পারছে না বেবি?
তখনই আরশানের ফোনে ম্যাসেজ আসল,
-দাদাই তোমরা ঘুরতে থাকো।আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসছি।
আরশান মুখ খিচে ফেলল। অয়ন্তি আরশানের প্রতিক্রিয়া দেখে হাসছে। আরশান রাগে দাঁতে দাঁত ঘসে বলে,
-দুটোকে টানিয়ে পেটানো উচিত। টেনশন ছাড়া কিছু দেয়না।
-ঠিক হয়েছে।
-তাই নাকি?
-হু।
-ওকে, তোমার আজ রাতে ঘুমানো বন্ধ। নিজের স্বামীর দুঃখ হেসে উড়িয়ে দেওয়ার শাস্তিস্বরূপ।
-গতকালও ঘুমাইনি। (দুঃখি মুখ করে)
-আজও ঘুম হবে না। (বাঁকা হেসে)
-এটা ঠিক না।
আরশান হাসলো। অয়ন্তির হাত শক্ত করে চেপে ধরে সামনে তাকালো।
-এখন কথা বলার সময় না। এঞ্জয় দ্য বিউটি মাই লাভ।
_____________
-তোমার বাবার মিশন সম্পর্কে শুধুমাত্র সে জানতো মা। আমরা কেউ ইনভলভ ছিলাম না। তিনি আমাদের কিছু বলেননি। টেরোরিস্ট’রা এখনও তোমার খোঁজ কেন করেছে বুঝতে পারছি না।তোমার বাবাও তোমাকে নিয়ে প্রচন্ড ভয়ে ছিলেন। কেন ছিলেন? তুমি কি কিছু জানো? মনে পড়ছে, বাবা কিছু বলেছেন কিনা? কোনো ক্লু! কোনো কোড, ডিজিট? তোমার কাছে নিশ্চই কিছু আছে, যা ওই টেরোরিস্ট’রা চায়। যা তোমাকে তোমার বাবা দিয়ে গেছে।
রোজ মুখটা ছোট করে বলে,
-না, স্যার। বাবা কিছু বলেনি আমাকে। আর বাবা তো সর্বদা আমাকে দূরে রাখতো এসবের থেকে।আপনারা সবটাই জানেন।
অতিরিক্ত ডি.আই.জি সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।রোজ সত্য বলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রোজের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক নিশ্চল হওয়া এখন সর্বনাশা হয়ে দাড়িয়েছে। মেয়েটার মনে কি চলছে বোঝা মুশকিল। রোজ হাতের ফোনটা নেড়ে চেড়ে বলল,
-আমি কি যাবো স্যার? কলেজের সময় হয়ে গেছে।
স্যার মাথা নেড়ে যেতে বলতেই রোজ ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বের হতেই রোজের চেহারায় ফুটে উঠল রাগের আভা। কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠল মুহূর্তেই। হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হেসে বলে,
-পৃথিবিতে হত্যাকারীর থেকেও বড় ঘাতক আছে। আর তা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক। হত্যাকারীকেও মাঝে মধ্যে মাফ করা যায়। তবে বিশ্বাসঘাতককে! কখনও না।
নতুন বাইক কিনেছে রোজ। আগের স্কুটার তো ফেলে এসেছিল। যাতায়াত কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে সে বাইকই কিনলো। স্কুটার ঠেলে মাঝে মাঝে সমস্যা হচ্ছে তাছাড়া হেলমেট আর স্টাইলেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাইকে উঠে রোজ জিন্সের পকেট থেকে আরেকটি ফোন বের করল। ফোনটা কানে নিতেই রোজ শুনতে পেল,
-ওকে ফলো করো। কোথায় কখন যায় সব নজরে রাখবে।
রোজ ফোনটা পকেটে ভরে নিল আবার। এরপর ফুল স্পীডে বাইক চালিয়ে উধাও হয়ে গেল ইউনিটের সামনে থেকে। আনসারীর মেয়ে সে, এত কাঁচা কাজ সে নিশ্চই করবে না এটা বোঝা উচিত ছিল তাঁর। রোজের ঠোঁটে চওড়া হাসি।বাবার কথা মনে পড়ছে তাঁর। মায়ের হাতের রান্না খায়নি কতগুলো বছর কেটে গেল। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর কখনও রোজকে ওর মা আদর করবে না, বাবা খাইয়ে দেবে না। ঘুরতে নিয়ে যাবে না। কিন্তু যার জন্য ওর বাবা-মা মা’রা গেল সেই কারনটার পেছনের উদ্দেশ্য রোজ পূরণ করবে। নরকের কীটগুলোকে তাদের স্বর্গীয় স্থান নরকে পাঠাতে হবে। হেলমেট দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে ফেলল রোজ।পথে নেমে ড্রেসও পাল্টে নিল।ব্যাগে থাকা নম্বরপ্লেট দিয়ে বাইকের নম্বরপ্লেট বদলে নিল। ছেলেদের মত পোশাকে পড়ে সে বাইকে উঠে রওনা দিল সিলেটের বর্ডারের উদ্দেশ্যে। রাইড করেই যাবে সে। ম্যাপ তো আছেই, দুটো ফোনেই চার্জ আছে। এক্সট্রা একসেট জামা আছে। আপাতত এটুকুই প্রয়োজন। ঢাকা পার হতেই রোজ হেলমেট খুলে ফেলল। মেইন রোডের সিগন্যাল হয়ে যাওয়া যাবেনা। শর্টকাট রাস্তা ধরে গোপনে যেতে হবে নাহলে ওকে ধরে ফেলবে ওরা।
_______________
সিয়াম ভয়ে ভয়ে বলল,
-স্যার, ম্যামের খোঁজ পাওয়া যায়নি।ম্যামের মত কিছুটা দেখতে ছিলেন উনি। কিন্তু ম্যাম ছিলেন না।
-মাথামোটা। (বিরক্তমুখে)
-জি স্যার?
-তোমার মনে হয় আমার তোমার ম্যামের কথা শুনে এখানে এসেছি? ডাফার।
-তো কেন এসেছেন? আমি তো ভেবেছি ম্যামের জন্যই এসেছেন।
-সিরিয়াল কিলার মেহমেদকে চেনো?
-না স্যার, শুনেছি নাম। কিন্তু চিনি না। কেন স্যার? (আপনাকে দেখেই তো কূল পাচ্ছি না আবার নতুন কিলার।)
-মেহমেদ আসছে এখানে। ওকে আমি এ্যাপোয়েন্ট করেছি।
-কেন স্যার?
-তোমাকে মা’রতে।
সিয়াম এক লাফ দিয়ে দরজার কোনায় দাঁড়ালো। ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। প্রায় কেঁদে ফেলার মত চেহারা নিয়ে বলল,
-আমি কি করেছি স্যার?
-প্রশ্ন করে করে আমার মাথা খেয়ে ফেলছো। বাবার জন্য তোমাকে সঙ্গে রাখছি, নাহলে কবেই বাড়ির বাইরে ছুড়ে ফেলে দিতাম।
-আপনি এমন বলতে পারেন না। আমি না আপনার ছোট ভাইয়ের মত?
ল্যাপটপে চোখ রেখেই ফারহান জবাব দিল,
-ভাইয়ের মত। বাট ভাই না।
সিয়াম শুকনো ঢোক গিলল। সিয়াম তো রাগ হওয়ার মত কিছু বলেনি। ফারহানের চাঁদকে নিয়েও তো ভালো কথাই বলল। ম্যাম বলে ডাকলো। শুধুমাত্র দুটো কথা বেশি বলেছে বলে স্যার লোক ভাড়া করে ওকে মা’রবে? সিয়াম আবারও মিনমিনে কন্ঠে বলল,
-স্যার!
-কি?
-সত্যিই কি মেহমেদ আসবেন?
-বিরক্ত করবে না সিয়াম। যাও গিয়ে কফি বানাও। তুমি এককাপ নিবে আর আমার জন্য আনবে। যাও।
-জি স্যার। (খুশি হয়ে)
-মেহমেদ আসলে দরজা খুলে দেবে।
-কি(অবাক হয়ে) আপনি তো আমাকে মারবেন না। তাহলে উনি কেন আসবে। প্লিজ স্যার। ভুল করে কিছু বললে মাফ করে দেন। প্লিজ। প্লিজ!
-উফ! সিয়াম। বললাম তো বিরক্ত করো না। মেহমেদ অন্যকাজের জন্য আসবে।
-কি কাজ স্যার?
-গেট লস্ট সিয়াম, এ্যান্ড ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। ড্যাম!
মেহমেদ আসার পর থেকে ফারহানের ঘর থেকে কোনো শব্দ আসছে না। সিয়াম বার কয়েক কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ভেতরের কথা। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। হাল ছেড়ে সিয়াম বসার ঘরে গিয়ে টিভি ছেড়ে দিল। ফারহান ল্যাপটপে সিয়ামের কান্ডগুলো দেখে সামনে তাকালো। মেহমেদ কফি পান করছে আর বন্দুকে গুলি লোড করছে। ফারহান নিজেও কফিমগে চুঁমুক দিয়ে বলে,
-চাঁদের পেছনে তোর কি কাজ?
মেহমেদ ফিচেল হাসে। ফারহান ল্যাপটপে নজর রেখে বলল,
-কোথায় ও?
-খুজে দেখ। আমি কেন বলবো? তোর ক্ষমতা কম নাকি যে অন্য লোকের কাছে শুনতে হচ্ছে।
-ওসব ছেড়ে দিয়েছি আমি।
-বাহ, চমৎকার। একজন ছাড়ছে তো একজন ধরছে।
-মানে?চাঁদ কোথায় মেহমেদ?কি করছে ও? চুপ থাকিস না। তোর শত্রুতা আমার সাথে। দয়া করে চাঁদকে এর মধ্যে টানিস না।
-আমি টানছি না। ও নিজেই ওর প্রয়োজনের টানে চলে এসেছে। আর আমার কাছে যতটুকু খবর আছে তাতে ওর জীবন যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওর বিপরীতে যে খেলোয়ার আছে তারা পাঁকাপোক্ত। রোজকে ছাড়বে না তারা।
-কারা?
-সাফোয়ান আনসারীর খু’নিরা। লাস্ট রংপুরে দেখেছি রোজকে।তাও মাস তিনেক আগে। এখন কোথায় আছে জানি না। আর তোর সঙ্গে আমার শত্রুতা ছিল, এখন নেই।
-চাঁদের খোঁজ দিতে পারলে তোকে পাঁচলাখ টাকা দেবো আমি।
-তোর চাঁদকে আমিও খুজছি। টাকা লাগবে না। ওর কাছে আমার বাবার খবর আছে। সেটা দরকার আমার।
-মানে?
-মানে আনসারী সাহেবের গুপ্তচর ছিল আমার বাবা। আনসারী সাহেব মা’রা যাওয়ার আগে রোজকে কিছু তথ্য ও কোড দিয়ে গেছে। আমার বাবা সেসব রক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। বাবা আমাকে পছন্দ করতেন না। আমার গুন্ডামির জন্য, তাই সেসব তথ্য টাকা নিয়ে উনি আমাকে না জানিয়েই অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে আছেন হয়তো। আর এসবের খবর তোর চাঁদ জানে। সেটা বলার জন্যই তোকে সকালে ফোন দিয়ে এখানে আসতে বললাম।
-কি তথ্য? কত টাকা?
-কালো টাকা, চোরাচালানজনিত তথ্য, ইউনিটের কিছু বিশ্বাসঘাতকের তথ্য, যারা দেশের সামনে দেশের রক্ষক, আর পেছনে ভক্ষক। তাই তোকে বলতে এসেছি তোর চাঁদকে খুজে বের কর। একা খেলাটা জিততে পারবে না ও। আমরা অবধি এখনও কিছু করতে পারি নি। আনসারী সাহেব কিছু করতে পারেননি। ওই বাচ্চা মেয়ে কি করবে?
-আমার গ্যাং নেই। বছর তিনেক আগে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলাম অভিনয়ের জন্য। তাই একা কিছু করা সম্ভব না।
-আমি হেল্প করতে রাজি কিন্তু বিনিময়ে আমার টাকা চাই।
-এই মাত্র না বললি তোর বাপ চাই?
-কালোটাকার একটা শেয়ারও চাই। যেটা তোর চাঁদ দেবে না। টাকাটা তুই দিবি।
-জাতে মাতাল, তালে ঠিক। ব্ল্যাং চেক এটা। কত লাগবে লিখে নিস। (চেকটা এগিয়ে দিয়ে)
-লাগবে না। দেখছিলাম চাঁদ তোর জীবনে কতটা গুরুত্ব রাখে। কার জন্য নিজের সবকিছু ছাড়ছিস। তা ও তোর বউ নাকি প্রেমিকা?(চেক ফেরত দিয়ে)
-দুটোই।
-তো ভাবির খোঁজ জানিস না কেন?
-অভিমান করে চলে গেছে। যাক, শুরু থেকে শুরু কর। চাঁদ কোথায় ছিল, কি করছিল, সবটা বল।
__________
হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অন্ধকার ঘরটির মেঝেতে পড়ে আছে এক ব্যক্তি। কাঠের তৈরি বাড়িটির ভিত প্রচন্ড নড়বড়ে। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। রোজ উঠে ধীরে সুস্থে লোকটার বাঁধন খুলে তাকে তুলে বাইরে এনে বসালো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল খুলে তাকে পানি খাইয়ে বলল,
-ঠিক আছেন?
-কে তুমি? আমার খোঁজ পেলে কি করে? কার হয়ে কাজ করো?
-আমি সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে কাকু। আমাকে কি চিনতে পারছেন না? আপনার সঙ্গে মিলে বাবাকে রাগাতাম আমরা। মনে নেই? আমি সেই রোজ।
-রোজ,,, তুমি এখানে কিভাবে আসলে? মা।
-পরে বলবো। এখন দ্রুত চলুন। ওরা এসে পড়বে। ব্যাথা আছে নাকি অনেক? ডাক্তারের কাছে যাবেন আগে?
-না, লাগবে না। এটুকুতে কি হবে? তুমি তোমার কথা বলো। আমি এখানে আছি জানলে কি করে?
-আসলে বাবা আমাকে একটা ডায়েরি দিয়েছিল। সেই ডায়েরিতে সব লেখা ছিল।
-ডায়েরিটা পেয়েছ তুমি? (অবাক হয়ে)ওরা সেটা হাতে পায়নি জেনেছিলাম। ভেবেছিলাম রেণু ভাবি লুকিয়ে ফেলেছে। পরে রেণু ভাবির মৃ’ত্যুর খবর শুনে সব আশা ধুলিশাত্ হয়ে গিয়েছিল।
-না, বাবা ওটা আমাদের ফার্মহাউজে রেখেছিল। বাড়ি ডায়েরি রাখার মত ভুল করেনি।
-আনসারী সাহেব মানুষটাই এমন! উনি জেনে গিয়েছিলেন ইউনিটের মানুষ ওনার সঙ্গে প্রতারণা করে ওনাকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করবে তবুও নিজের কথা ভাবেননি।
-ওই সব প্রতারককে তাদের প্রতারণার ফল পেতে হবে কাকু। আমি কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না।
-তুমি মেয়ে, তারওপর ওদের ছলচাতুরী বুঝবে না মা। এসবের মধ্যে ঢুকো না। ওরা ভয়ঙ্কর মানুষ। আনসারী সাহেব অবধি ওদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি।
-কারন বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। আমি ওতটাও ভালো নই কাকু। প্রতিটা কেউটেকে আমি গর্ত থেকে বের করে ওদের বিষদাঁত ভেঙে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করবো।
-পারবে না, ওরা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। ওদের কোনো দূর্বলতা নেই। ওরা একবার যদি জানে তোমার দূর্বলতা আছে,তাহলে তোমাকে শেষ করতে ওদের এক সেকেন্ডও লাগবে না। তোমার আঙ্কেলরা, আঙ্কেলদের পরিবার।
-ওরা জানবে না। কারন আঙ্কেলদের আমি কষ্ট দিয়ে চলে এসেছি। ফালাক ভাইয়ার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি তাতে সবাই বুঝবে আমি ফালাক ভাইয়াকে ভালো বাসতাম। এখন বাসি না। আর ওদের প্রতি আমার দূর্বলতাও নেই।
-ওরা তোমার ওপর কখন থেকে নজর রেখেছে?
-আমি দেশে ফেরার পর থেকেই দেখছি কিছু মানুষ আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে। প্রথমদিকে বুঝিনি পরে ডায়েরি পড়ে টের পেয়েছি। তখন থেকেই নানুবাড়িতে থেকেছি। নানু মা’রা গেলে ঢাকায় ফিরে সব খোজখবর রাখতে শুরু করি। আপনার ছেলে মেহমেদও অনেকটা ভালো হয়ে গেছে কাকু। এখন আর খু’নোখু’নি করেনা। আপনি ফিরে যান তাঁর কাছে। এই মিশনটা আবার বাবার। আমি চাইনা, এই মিশন কমপ্লিট করতে গিয়ে আমার মত আর কেউ বাবা মা’কে হারাক। আপনার ফেরার টিকিট কেটে রেখেছি। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবেন। আপনার সঙ্গে এখানকার একটা দলও যাবে। ওদের সঙ্গে মিশে কোনোরকমে ঢাকায় পৌঁছালে মেহমেদ ভাই আপনাকে নিয়ে যাবে। টেক্সট করে দিয়েছি আমি। বাবার পরে এই মিশনটা শুধু আমার কাকু। জানিনা আমার পরিণতি বাবার মত হবে কিনা। কিন্তু বাবার মত ভুল করবো না আমি। দেশের সম্পদ ও আবর্জনার সব প্রমাণ ঠিক পৌঁছে যাবে, সেটা আমি বেঁচে থাকি অথবা না থাকি।
রোজ হাটতে হাটতে কিছুদূর যেতেই ওর চোখ পড়ল রাস্তার ধারের শিমুল গাছটার ওপর। শেষ যেবার রোজ এসেছিল সিলেটে, বাবার সঙ্গে। সেদিন এই গাছে সে উঠেছিল। গাছের ডালে বসেছিল। অনেক আবদারের পর বাবা উঠিয়ে দিয়েছিল। রোজের চোখ বেয়ে পানি পড়ল।রোজ চোখ বুজতেই ডায়েরির লেখাগুলো চোখে ভেসে উঠলো। ডায়েরিতে আনসারী সাহেব রোজকে লিখেছিলেন,
জীবন একটা জটিল সমীকরণ রোজ। তোমাকে এই সমীকরণের সমাধান নিজেকেই খুজে বের করতে হবে। তোমার প্রয়োজন তুমি নিজে বুঝবে। অন্যকেউ বুঝবে না। যেমন, তোমার তৃষ্ণা পেলে তুমি বুঝতে পারবে। বাকিরা ততক্ষণ বুঝবে না যতক্ষণ না তুমি বুঝতে দাও। কখনও হার মানবে না, রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে। কারন ক্রোধ হচ্ছে ধ্বংস। রেগে গেলে তুমি যেকোনো কাজে হেরে যাবে। রাগ মানুষের মস্তিষ্ক অনলে জ্বালিয়ে দেয়, আর তাতে নিয়ন্ত্রণ না রাখলে দেখবে পরিস্থিতি সেই অনলে ঘি ঢালছে। সর্বদা মনে রাখবে তুমি পারবে। তুমি মেয়ে, কিন্তু দূর্বল নও। আমি না থাকলেও তুমি থাকবে, আমি জানি আমার মেয়ে একদম তাঁর বাবার মত। কখনও নিজেকে ছোট করে দেখবে না, অসহায় ভাববে না, ভালোবাসবে সবাইকে। আমি জানি তুমি বয়সের তুলনায় একটু বেশি ম্যাচিউর তাই বলছি। ফালাক তোমাকে চায়, ওকে কষ্ট দেবে না। আমি থাকছি না, আমার দায়িত্ব থাকছে। সে দায়িত্ব তুমি পালন করবে। জীবনে নানা বিপর্যয় আসবে, ভয় পাবে না। ভয়কে জয় করে সামনে এগিয়ে যাবে। তুমি ভাবতে পারো, তোমার জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি তাই ফালাকের থেকে দূরে যাবে। কিন্তু এটা সঠিক সিদ্ধান্ত না মা। আমিও তো অনেক রিস্কি কাজ করি। তবুও তোমার মা’কে ভালোবেসে বিয়ে করেছি।সংসার করেছি তাহলে তুমি কেন একা থাকার কথা ভাববে? তুমি ওকে চাও সেটাও জানি আমি। তোমাদের বন্ধুত্বের রূপ এমন থাকবে না। তাই সময়ের সঙ্গে আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। সর্বদা মাথায় রাখবে, তোমার জন্য যেন অন্যকেউ কষ্ট না পায়,অন্যকেউ বিপদে না পড়ে। মা’কে দেখে রাখবে। তুমি ছাড়া রেণুর কেউ থাকবে না। মায়ের অবলম্বন হবে। রেণু অল্পতে অনেক কষ্ট পায়, কাঁদে। আমার চলে যাওয়া ও মেনে নিতে পারবে না। তাই তুমি ওকে সামলাবে। আমি জানি আমার মেয়ে সেটা পারবে। তোমার বাবা তাঁর একমাত্র রাজকন্যাকে অনেক ভালোবাসে প্রিন্সেস। নিজের রেখাল রাখবে। আমাকে মনে করে কাঁদবে না, আমি কষ্ট পাবো তাহলে। ভালোবাসি আমার কলিজার টুকরা, আমার মেয়ে, আমার রাজকন্যা সাইরাহ্ আনসারী রোজা! ওহ স্যরি তোমার নাম তো কে’টে রোজ করা হয়েছে। আবারও বলছি রেণুর পাশাপাশি যে তোমার নাম কে’টেছে তাকে ভালোবাসবে।সবার সঙ্গে সাবধানে থাকবে। আমি জানি ফালাক তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। তাই এখন নিশ্চিন্তে ম’রতেও পারবো।
তোমার বাবা….. সাফোয়ান আনসারী।
#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_সতেরো
“আমি ফালাক ভাইয়াকে ভালোবাসি বাবা। সত্যিই খুব বেশি ভালোবাসি সেজন্যই তো তাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি। তাকে ছেড়ে যেতে চাইনি আমি। সবসময় তাঁর কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। জানো তখন প্রচন্ড অভিমান হয়েছিল আমার। পাঁচবছর যোগাযোগ করিনি। ভেবেছি সে যোগাযোগ করলেই তাকে বলে দেবো আমিও তাকে তাঁর চাঁদও তাকে ততটাই ভালোবাসে যতটা সে তাঁর চাঁদকে ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে আমি কি জেনেছি জানো? ফালাক ভাইয়া একজন খু’নি। মেহমেদ ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর শত্রুতা আছে। দুটো দলের মধ্যে যে ঝামেলা চলছে তার সমাধান একটা দলের ধ্বংস। আমি জানি ফালাক ভাইয়া অভিনয় করতে ভালোবাসে। তাঁর থেকেও বেশি আমি ভালোবাসি তাঁর অভিনয় দেখতে। মনে মনে কত সান্ত্বনা দিয়েছি নিজেকে, যে সেদিন যেটা হয়েছে সেটা ফালাক ভাইয়ার অভিনয়। নিজেকে সামলেও নিয়েছি। কিন্তু সে প্রচন্ড রাগি। তাঁর রাগ, জেদ অনেক। সে বড় হতে চায়, ঠিক আছে কিন্তু অহংকারিও হয়ে গেছে সেই বিকেলের পর থেকে। আমি তো তাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাইনি। সে আমার চরিত্র তুলে আমার আদর্শ তুলে কথা বলেছিল বলেই তো তাকে ওভাবে বলেছি। আমাকে সবাই ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের মত করে তো শুধু ফালাক ভাইয়া ভালোবাসতো।সে যদি আমাকে কষ্ট দেয়,আমি কি সহ্য করতে পারি? এরপর যখন জেনেছি ওরা আমার ওপর নজর রাখে, আমার প্রতিটা শক্তি ও দূর্বলতার খোঁজ রাখে তখন কিভাবে সবাইকে জানাতাম আমার মনের কথা? ফালাক ভাইয়া নিজের গ্যাং বাদ দিয়েছে অভিনয়ের জন্য। তাঁর কাছে অভিনয় জিনিসটা এতটা মূল্যবান জানার পরও তাকে আমি অভিনয় ছাড়তে বলেছি। আমার কি খারাপ লাগেনি? সবাই ভাবছে আমি নিজের জন্য সব করছি, করেছি। কিন্তু তোমরা তো জানো আমি নিজের জন্য কিছু করিনি। আমার নিজের আছে’টা কি? যে নিজের জন্য করবো। নিজের বলতে তো শুধু ওই মানুষগুলো। কুসুম নতুন মানুষ, আমার প্রিয়জনের তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে আমি ওদের কাছে থাকলে ওরও তো ক্ষতি হতে পারে। দাদাই ওকে কত ভালোবাসে, ওর কিছু হলে কি দাদাই বাঁচবে? দাদাইয়ের কিছু হলে কি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো? যে মানুষগুলো আমাকে এতটা আপন ভেবেছে, ভালোবেসেছে তাদের কষ্ট দিতে পারি না আমি।
ভালোবাসা, সেটা তো নিঃস্বার্থ হয়, কারনবিহীন হয়। অথচ দেখ সেই ভালোবাসার মামলাতেও আমি কত শত শর্ত জুড়ে দিলাম যেন ফালাক ভাইয়া আমার ওপর আবার রাগ করে। আর সে রাগ করলেই আমি অযুহাত দেখিয়ে চলে আসবো মিশনে। কিন্তু সে অভিনয়টাই ছেড়ে দিয়েছে।সবাই বলে ফালাক ভাইয়া আমার সব কথা শোনে, আমার সব শর্ত মানে। কিন্তু কেউ একবার ভাবে না আমি তাঁর জন্য কি করি? আমি যে তাঁর জন্য আজ অবধি কোনো ছেলেকে গুরুত্ব দেইনি, বন্ধু বানাইনি,কারোর সঙ্গে হেসে কথা বলিনি। এগুলো কেউ বোঝেনা।সবাই ভাবে আমি অস্বাভাবিক, প্রতিক্রিয়াহীন এটা তো সত্য নয়। তুমি তো জানো মামনি। আমারও মন চায় ছোটবেলার মত সবার আদরে থাকতে। মামনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তোমরা কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? আমাকে সাথে নিলে না।
তোমাদের থেকেই তো ত্যাগ করা শিখেছি। শিখেছি কি ভাবে অন্যের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিতে হয়। তবুও সব সময় সব অপবাদ আমার গায়ে কেন লাগে? আমার কাজগুলো কি বড্ড খারাপ? আমি চাইনি ফালাক ভাইয়া পুনরায় নিজের হিং’স্র রূপে ফিরে আসুক। এটা কি খারাপ? তবুও কুসুম, দাদাই ভাবছে ফালাক ভাইয়ার জীবন আমি নষ্ট করছি। তাকে বদলে দিয়ে তাঁর ওপর বাজে প্রভাব ফেলছি। কষ্ট দিচ্ছি। কিন্তু কেউ বুঝতে চাচ্ছে না, আঠারো বছর বয়সে আমি ঠিক কতটা স্ট্রাগেল করেছি। কিভাবে থেকেছি, কিভাবে চলেছি। সবাই ভাবছে ফালাক ভাইয়াকে আমি মাফ করে দিচ্ছি না, সুযোগ দিচ্ছি না। কিন্তু একটাবারও ভাবে না, তেরো বছর বয়সে, ওই অল্প একটু বয়সে আমি কি কি ফেস করেছি।তখন কতটুকুই বা বুঝতাম? শুধু জানতাম ফালাক ভাইয়া আমার বন্ধু আর আমি তাকে ভালোবাসি। এই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপান্তর হচ্ছে সেটা আমাকে কেউ বলেছে? বলেনি। দাদাইয়ের প্রেমের কথা শুনে বুঝেছি। তাহলে আমার দোষটা কোথায়? কেন সব খানে শুধু রোজের দোষ হয়? রোজ খারাপ হয়? রোজকে অপবাদ দেওয়া হয় জীবন নষ্টের। আমার কি সুন্দর জীবন আছে? আমি পেয়েছি সেটা? আমার কি কেউ সত্যিই ছিল? অভিমান আমি কেন করবো না? যখন ফালাক ভাইয়াকে আমার প্রয়োজন ছিল, একটা কাছের মানুষ, যে আমার ব্যক্তিগত মানুষ হবে তাঁর প্রয়োজন ছিল তখন ফালাক ভাইয়া কোথায় ছিল? সে তাঁর জেদ নিয়ে পড়ে থাকেনি?পাঁচটি বছর নষ্ট করেনি? কিন্তু না, এটা কারোর চোখে পড়বে না। সে মাফ চাইলো আর সবাই গলে পড়লো। সবার মনে হতে শুরু করল ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেলেই মিলন সম্ভব। কিন্তু মনের ভেতর রাগ, অভিমান, কষ্ট জমা থাকলে মিলন হলেও সেটা তেমনই থাকে।এটা কেন বোঝে না? সেদিন দাদাই কুসুমকে বলল, আমি নাকি পাঁচবছর পর ফিরে আসতে চেয়ে অনেক সময় নিয়েছি। যদি মিশনে গিয়ে আর ফিরে না আসি তখন? ফালাক ভাইয়াকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কেন রাখবো? সে জানুক আমি ফিরবো। যদি নাও ফিরি তাহলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক তো হবে, রাগ মিটে গেলে সে নিজের মনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আর বাকি সবাই তো আছে ওকে সামলে রাখার জন্য। দেড়বছর হয়ে গেল। জার্নালিজমে আমি আরও একটি কারনে পড়ছি, সেটা তো জানো তোমরা। কুসুমকে সুস্থ করতে হবে, দাদাইয়ের কাছে পরিপূর্ন কুসুমকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সবাই ভাবে দাদাইয়ের ওপর আমার ঝোঁক আছে। কেন ভাবে? কারন আমি দাদাইকে অনেক ভালোবাসি। কেন বাসি সেটা কেন কেউ জানতে চায়না? বুঝতে চায়না? কলকাতায় যখন ফালাক ভাইয়া আমাকে নানা কথা শোনাচ্ছিল তখন কে আমাকে আগলে রেখেছিল? কে আমার পাশে ছিল? মানছি দাদাই আর আমার কথাগুলো ফালাক ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল কিন্তু ফালাক ভাইয়া কি শুনেছিল? সেদিন চাইলেই তো দাদাই সবটা বলতে পারতো। বলেনি আমার কথা ভেবে, আমার ভালো চেয়ে। ফালাক ভাইয়ার বিপক্ষে গিয়ে আমার হয়ে যে মানুষটা লড়েছিল তাকে ভাই হিসেবে ভালোবাসা সম্মান করা কি ভুল? সে ভেবেছিল ফালাকের কাছে আমি নিরাপদ নই, যেখানে সে ফালাককে এতগুলো বছর ধরে চেনে। সে যদি আমার জন্য সবার সঙ্গে লড়াই করতে পারে তাঁর হয়ে কিছু কথা বলা কি অন্যায়?
কুসুমের পরিস্থিতি, কষ্ট বুঝি আমি। চোখের সামনে যদি সহসা কোনো দূর্ঘটনা ঘটে তা থেকে বের হওয়া কঠিন। আমি তো তোমাদের সাহসী মেয়ে তাই সবটা ওভার কাম করতে পেরেছি। কিন্তু কুসুম তো ভীতু, নরম মনের আহ্লাদি মেয়ে। ও পারেনি। ওর পরিস্থিতি ঠিক করা কি আমার কর্তব্য নয়? ও তো আমারই নতুন পরিবারের নতুন সদস্য।
আমি তবুও ফিরবো না বাবা, মামনি। ফিরে গিয়ে ওদের সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই।তাই আমি এখানে থাকবো। যে কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা করবো। যে দায়িত্ব বাবা আমার ওপর অর্পণ করেছে তা পালন করে যাবো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। কিন্তু ফালাক ভাইয়ার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে তাকে যে কষ্ট দিচ্ছি তাঁর বদদোয়া আমার লাগবে না? স্বার্থপরের মত কাজ করছি? তাঁর কি এই কথা জানার অধিকার নেই যে আমি তাকে ভালোবাসি। যদি জানিয়ে দেই, উনি তো দুনিয়া ওলোট পালোট করে দেবে। তখন যদি টেরোটিস্টরা ওনার ক্ষতি করে? কি করবো আমি? তোমরাই বলো! ওনাকে কি বলে দেবো অভিনয় করার কথা? লিস্ট থেকে রাগ বাদে সব শর্ত কে’টে ফেলার কথা? এটাই ভালো হবে। ”
আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে ফারহানের নাম্বারে কল করল রোজ। দু বার বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। হয়তো আননোন নাম্বার বলে কল রিসিভ হচ্ছে না।
বারংবার কল আসায় প্রচন্ড বিরক্ত ফারহান। মুগ্ধতা ভেবে সে ফোনটা বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে। সকাল বিকাল ছ্যাছড়া হিরোইনটার প্যারা আর ভালো লাগছে না।হিপোক্রেট একটা।কিন্তু একটানা কয়েকবার ফোন বাজতেই ফারহান ফোন রিসিভ করেই দিল এক ঝারি,
-কি সমস্যা?স্লাট হতে চাইলে অন্যকোনো খোদ্দের খোজ, তোর মত বে’শ্যা আমার বিছানার আশেপাশে থাকারও যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। বালডা বিরক্ত করেই চলেছে। আর ফোন দিবি না।
এমন বাক্য শুনে রোজের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। হাত কেঁপে উঠল মুহূর্তেই। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-ফালাক ভাইয়া!
ওপর পাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। রোজ বলল,
-কেমন আছো? আমি রোজ। কন্ঠ চিনতে পারছো না? কথা বলছো না কেন?
ওপাশ থেকে কিছু পড়ার শব্দ পেল রোজ। আতঙ্কিত কন্ঠে রোজ আবার বলে,
-বিরক্ত হচ্ছো? ফোন রেখে দেবো?
ফারহানের গলা ধরে আসলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু বলার মত শক্তিও যেন পাচ্ছে না সে। রোজ ফোন করেছে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। ফারহানের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আভাসে রোজ টলে উঠলো। পা দুলছে। ফালাক কাঁদছে এটা ভাবলেও রোজের দুনিয়া আঁধারে ঘনিয়ে আসে। সেখানে আজ ফালাকের কান্নার স্বর শুনছে। রোজ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে,
-শুনেছি পুরুষ মানুষরা নাকি কাঁদে না। তাদের কাঁদতে নেই। তারা কঠিন, আর কঠোরতায় তাদের বেশি মানায়।
-ফিরে আয় চাঁদ। আমি তোকে একটুও কষ্ট দেবো না। তোর সব কথা শুনছি, ভবিষ্যতেও শুনবো।
রোজেরও কান্না পেয়ে গেল ফারহানের কান্নাভেজা কোমল কন্ঠে। মানুষটার রাগ মিটে গেছে? আজ সে রোজকে একদম ধমক দেয়নি। বরং মিষ্টি করে কথা বলছে। তাঁর কন্ঠ জানান দিচ্ছে তাঁর তীব্র যন্ত্রণা। রোজ নাক টেনে বলে,
-ফিরবো তো। কিন্তু এখনও তোমার কষ্ট পাওয়া হয়নি। শোনো, অভিনয় জগতে তুমি ফিরে যাও। শুধু রাগটা বাদ দিলেই হবে।
-ভালোবাসি চাঁদ। তোকে কখনও বলা হয়নি। আঠারো বছর হলো তোকে ভালোবাসি আর আজ বলছি। তুই প্লিজ আমার কাছে আয়। ছোটবেলার মত আমার গলা জড়িয়ে ধরে অভিমান দেখা, তোর পা ধরে আমি স্যরি বলবো। তবুও ফিরে আয়।
রোজ এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ফারহানও কাঁদছে। দুজনের কথার সমাপ্তি ঘটে ক্রন্দনের প্রারাম্ভ ঘটেছে। কিন্তু রোজ তো এখন ফিরতে পারবে না। এটা সে কি করেরে বোঝাবে ফারহানকে? ফারহান আবার বলল,
-আসবি না?
-এই মুহূর্তে আসাটা কি জরুরি? যদি তোমার ভাগ্যে আমি থাকি। যদি তোমার হওয়া’টা আমার ভাগ্যে থাকে আমি নিশ্চই তোমার হবো ফালাক ভাইয়া। পৃথিবির দ্বিতীয় কোনো পুরুষ তোমার চাঁদকে পাবে না। তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে, এই দূরত্বের পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার সুমিষ্ট ফলের প্রতীক্ষা করতে পারবে না? চাঁদকে পেতে হলে একুটু করা সামান্য বিষয়।
-আমার ম’রার পর আসবি? লাশ দেখতে আসবি? তবুও আসিস। আমার কবরে যেন তোর হাতের মাটি পড়ে।
-সৃষ্টিকর্তার কাছে বাবা আর মামনির জন্য দোয়া করার পর আমি নিজের জন্য সবসময় একটা জিনিস চাই। সেটা কি জানো? সেটা হচ্ছে আমার ফালাক ভাইয়ার সুখ, সমৃদ্ধি। আর তাঁর আগে আমার মৃ’ত্যু। বোঝার পর থেকে এই একটা চাওয়াই চেয়ে এসেছি। আর আমি মনে করি বিধাতা আমাকে নিরাশ করবেন না। যদি করে তাহলে জেনে রেখো তুমি, ফালাক বিহীন চাঁদ এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রাণবায়ু গ্রহণ করবে না।
-ঠাটিয়ে মা’রবো এক চর। খুব কথা শিখেছিস তাইনা? সামনে পেলে তোকে মে’রেই ফেলতাম এমন কথা বলার দুঃসাহস পেলি কোথ থেকে?
-অপেক্ষা করো।পরীক্ষা দাও,যেদিন উত্তীর্ণ হবে, দেখবে তোমার চাঁদ তোমার সামনে দাড়িয়ে। আমাকে এবার দূরে ঠেলে দেবে না তো?
-একবার এসে দেখ।
-এভাবে বলবে না তুমি। তাহলে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না। তোমার ওপর যত অভিমান আছে সব পুষে রাখছি। সামনে এলে তোমার ওপর ঝারবো।
-ভালোবাসিস আমায়?একবার বল চাঁদ! আঠারো বছর ধরে তোকে দেখছি, আমাকে বাদ দিয়ে তুই সবাইকে সম্মুখে ভালোবাসার কথা বলেছিস। প্রাণ থাকতে এক বার তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। একবার বলবি?
-সবার সামনেই বলবো।
-এখন একবার বল না চাঁদ। প্লিজ চাঁদ।
-আমি তোমাকে ভা
-ভা? পুরোটুকু বল। আমি শুনতে চাই।
-লজ্জা লাগছে।
-তোকে মিস করছি চাঁদ। এবার আসলে তোকে আমি ছাড়বো না। কোথাও একা যেতে দেবো না, একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেবো না তোকে।
-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না এমন নিষেধাজ্ঞা তোমার ওপর থেকে তুলে নিলাম। অভিনয় করার, ও অসাধারণ থাকার নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিলাম ফালাক ভাইয়া। জলদি রোম্যান্টিক একটা মুভি করে ফেলো। আমি ফিরে আসার আগে হলে তোমার মুভি দেখতে চাই।
-আমার হতে চাস না কেন?
-চাই তো।
-তাহলে নিষেধাজ্ঞা কেন তুলছিস? তোর মনে হয় তুই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আমি অন্য নারীকে নিয়ে সামান্য একটা চিন্তাও মাথায় আনবো? আমি শুধু তোকে আর তোকেই ভালোবাসি চাঁদ। যেদিন প্রথম তোকে কোলে নিয়েছিলাম। বারো বছরের বাচ্চা ছিলাম আমি আর তুই দুধের শিশু। বোন পাওয়ার জেদ করেছিলাম বলে মা তোকে আমার কোলে দিয়েছিলো। কিন্তু তোকে প্রথম দেখার পর থেকে বোনের স্বপ্ন বাদ দিয়ে দিয়েছি। বন্ধুর স্বপ্ন দেখেছি আর তা মাত্র চারবছরে বদলে গেল। বুঝতে পারছিস কি বলতে চাচ্ছি? কৈশরে আমি এক দুধের শিশুকে বউরূপে দেখতাম। এটা কতটা জঘণ্য ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল। তুই যতবার আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতিস আমার বুকের ভেতরটা ততবার চিরে যেত। তবুও সব হাসিমুখে সহ্য করেছিলাম কারন তুই আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতিস না। জীবনের আঠারোটা বছর তোর জন্য আমি কারোর রূপে, গুণে মুগ্ধ হইনি। এমনকি আকর্ষনবোধও করিনি। আর এই আঠারো বছর পর তোর মনে হচ্ছে আমি কোনো হিরোইনের চক্করে পড়লেও পড়তে পারি? তোর মনে হয় কারোর রূপে আমি আটকাবো? বিছানায় তো অনেকে আসতে পারে চাঁদ কিন্তু মনে? তোকে ছাড়া মন নামক আমার বিষাক্ত দেহাংশে আর কারোর ঠাই নেই। কারোর না।
-আমি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার আদৌ যোগ্য তো ফালাক ভাইয়া?
-যোগ্যতার হিসেব আমি করতে চাইনা। আমি শুধু জানি আমি তোকে চাই, আর তুই শুধু আমার হবি। ব্যাস।
-কয়েকটা মাস লেগে যেতে পারে। একটু ধৈর্য ধরো। আমি ফিরে আসবো।
-আমার থেকেও তোর মিশন বড় চাঁদ?
-তুমি জানো?
-মেহমেদ বলেছে। তুই ফিরে আয় চাঁদ। কি দরকার এই ঝুঁকি নেওয়ার? আমার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে পারবি না? ওসবে কি পাবি? যন্ত্রণা ছাড়া।
-বাবা আমার ওপর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। যা পালন করা আমার কর্তব্য।
-ইশতিয়াক ইরফান ভালো না চাঁদ। তোকে ও বাঁচতে দেবে না। কোথায় আছিস তুই? আমাকে বল। আমি নিজে তোকে নিয়ে আসবো। তারপর দেখবি আমরা একসাথে থাকবো, আমাদের ছোট একটা সংসার হবে। তুই আমি আমাদের বাচ্চা…
-ডি.আই.জি স্যারের খেলাটা শেষ করে তবেই ফিরবো। উনি আমার বাবাকে মে’রেছেন, আমার মামনিকে মে’রেছেন। ওদেরকে আমি এত সহজে ছেড়ে দিতে পারবো না। কিছুতেই না। তোমার সঙ্গেও যোগাযোগ করবো না। কারন তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যেতে বলছো। এটা তুমি বলতে পারো না, ফালাক ভাইয়া। বাবা-মামনির শেষ ইচ্ছে ছিল এটা।
-আমি আমার সব ইচ্ছে বাদ দিচ্ছি, আমার পুরো জীবন তোর হাতে তুলে দিচ্ছি। তুই তার বদলে এটুকু করতে পারবি না?
-না। (কিছুটা থেমে) তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এমন অনুরোধ করবে না। আমার কসম ভাইয়া, তুমি অপেক্ষা করবে। আমাকে খুজতে আসবে না। পৃথিবির সামনে ততদিন কিছু বলবে না যতদিন না ইরফান মা’রা যায়। রাখছি।
ফোন রেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো রোজ। মেজাজ আবারও খারাপ হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই ঠোঁটের অদৃশ্য হাসি চওড়া হলো। কেন হাসলো রোজ? আর নিজের ভালোবাসার কথা স্বীকারই বা করলো কেন? সে তো এগুলো বলতে ফোন দেয়নি। তবুও ফারহানের কান্না দেখে গলে গিয়ে সব বলে দিলো? ভালোবাসা তো এমনই হয়! কিন্তু ফারহান? পাঁচবছর ধরে রোজের কান্না দেখার পর গলেনি। ভালোবাসার নতুন কোনো অধ্যায় ছিল নাকি ওটা? নাকি ভয়ের ছাঁপ? লুকানোর চেষ্টা অত্যন্ত গোপনীয় কিছু! রেলিঙ-য়ের পাশেই লম্বা রডটা বেরিয়ে আছে। রডের পাশে কিছু লম্বা লোহা। রোজ রেগে সেটা চেপে ধরতেই তালুর মধ্যে ঢুকে গেল লোহা। রোজ চোখ বুজে হাত টেনে নেয়। লালরঙা এই তরল পদার্থ অতিমূল্যবান জানা সত্ত্বেও তা দেহ থেকে বের করার মাঝে এক নিঃস্বার্থ সুখ খুজে পায় রোজ। মনে পড়ে প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা, ঘাতকদের প্রতিটা আঘাত, অতিতের কষ্ট, বাবার ভালো মানুষ হওয়ার ভুল, তাঁর ঠকে যাওয়ার কথা, অতি আপনজনদের ভালোবেসে, বিশ্বাস করে মৃ’ত্যুকে বরণ করে নেওয়ার কথা। রোজ সে ভুল করবে না। রোজ মনে করে ভালো খারাপও একটি মুদ্রার দুটো পিঠ। কেউ সম্পূর্ণ ভালো হতে পারে না, আবার খারাপও হতে পারে না।রোজও তার ব্যতিক্রম নয়। রোজ ভালো হলে যতটা ভালো, খারাপ হলে তার থেকে শত গুন বেশি খারাপ। এটা সবাইকে বোঝানোর সময় দ্রুতই আসবে। রোজ শুধু সে সময়টুকুর অপেক্ষা করছে।
চলবে?