#তুই_হৃদহরণী
#Sabriha_Sadi (সাদিয়া)
পর্ব : ৮
“জীবন নদী কখনো এক ভাবে চলে না। কত বাঁধ, প্রতিঘাত, ঝড় পুহিয়ে তাকে নিজের গতি তে চলতে হয়। জীবন নদীর স্রোত বহমান। কখন খরস্রোতা তো আবার কখনো শান্ত। আমাদের জীবন নদীও তার নিজ গতিতে কখনো প্রবল স্রোতে তো কখনো শান্ত রূপের কলকল গতি তে চলে।”
তুরফার মন টা আজ কেমন যেন লাগছে। অস্থির লাগছে। ঠিক থাকতে পারছে না। কাজেও মন বসাতে পারছে না। অদ্ভুত অস্থিরতা তাকে অশান্ত করে তুলেছে। আজ তাড়াতাড়ি চলে যাবে বলে ফিরাতের কেবিনে গেল সে। ফিরাত তখন কাজে ব্যস্ত।
“আসব ভাইয়া?”
“তুরফা? আসো।”
তুরফা ছোটছোট পায়ে এগিয়ে গেল ফিরাতের কাছে। বলল,
“ভাইয়া আমার একটু দরকার ছিল মানে ভালো লাগছে না। আমি বাসায় চলে যেতে পারি?”
“কেন কি হয়েছে? শরীর খারাপ?”
“এমনি কিছু। ভালো লাগছে না আমার। আমি কাল এসে সব ফাইল দেখে দিব। প্লিজ ভাইয়া।”
“আরে ওভাবে বলতে হবে না। চলো তোমার শরীর খারাপ লাগলে আমি ড্রপ করে দেই।”
“না ভাইয়া লাগবে না। আমি কিছু করে চলে যাবো।”
“বুঝেছি চলো। আমারও একটু দরকার আছে।”
তুরফা আর কিছু বলল না।
গাড়ি চালাচ্ছে ফিরাত। পেছনের সিটের বসে আছে তুরফা। নিজের অস্বস্তির জন্যেই সামনে বসে নি। ফিরাত তেমন কিছুই বলেনি। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ফিরাত প্রশ্ন ছুড়ল,
“বাসায় কে কে আছে তুরফা?”
তুরফার আত্মা ক্যাঁচ করে উঠল। মন টা আরো হু হু করে উঠল। কি বলবে? তার তো কেউ নেই দুনিয়াতে। মা জন্মের সময় মারা গেল। ১০ বছর বয়সে বাবা কে হারাল। তার মর্মান্তিক জীবন কাহিনী কাউ কে বলতেও কষ্টে তার বুকে চিড় ধরে। ভেতর টা কষ্টের নোনা পানি তে হাবুডুবু খায়। তুরফা চুপ করে মাথা নিচ দিকে দিয়ে বসে আছে। মুখে কিছু বলছে না। তাকে এভাবে থাকতে দেখে ফিরাত আবার জিজ্ঞেস করল,
“কি হলো তুরফা? কি হয়েছে?”
“….
“তুরফা।”
“আমার কেউ নেই ভাইয়া।”
এটা শুনে ফিরাত ঘ্যাঁচ করে গাড়ি কষেছে। কৌতূহল তার মুখের কোণায় কোণায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে তাকিয়েই আছে তুরফা দিকে। কিন্তু কিছু বলতে পারল না।
“জ্বি ভাইয়া।”
“নেই মানে?”
“আমি খুব ছোট বেলায় আম্মু আব্বু কে হারিয়েছি। উনারা আমায় অনেক বছর আগে একা ফেলে চলে গিয়েছেন।”
কথাটা বলার সময় তুরফার গলা লেগে আসছিল। দলা পাকা কান্নার জন্যে গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তুরফার প্রতি মায়া, টান দ্বিগুণ বেরে গেল ফিরাতের। মায়া ও স্নেহের হাত রাখল তুরফার মাথায়।
“চিন্তা নেই। তোমার বড় ভাই আছে আজ থেকে।”
তুরফা বিস্ময়কর চোখে তাকাল ফিরাতের মুখের দিকে। ফিরাত একটু হাসল। তুরফা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
“ছোট থেকে মানুষ আমি আমার মামা, মামুনির কাছে।”
“থাকো কি উনাদের কাছেই?”
“না। উনাদের থেকে আলাদা আছি দুই বছর হবে।”
ভ্রু কুঁচকে ফিরাত প্রশ্ন করল,
“কেন?”
“লেখাপড়ার জন্যে ২ বছর আগে আসতে হয় এখানে। তারপর এক বছর ভার্সিটি তে চলে গেল। আরেক বছর টিউশনি তে। এখন তো জবেই আছি।”
কথাটা শেষ করে তুরফা নাক টান দিল।
“তাহলে এখন কোথায় আছো?”
“একটা ফ্রেন্ডের সাথে।”
ফিরাত আবার সামনের দিকে ফিরে গাড়ি স্টার্ট দিল। চালাতে চালাতে বলল,
“ভালো। তবে সমস্যা হলে এই ভাই কে বলবে ইনশাল্লাহ চেষ্টা করব কিছু করার।”
তুরফা শান্তির হাসি দিল।
“শুনেছ তো?”
“জ্বি ভাইয়া।”
যেতে যেতে একটা স্কুলের সামনে আসতেই আবার দাঁড় করাল গাড়ি।
“তুরফা তোমার বাসা কি এখান থেকেও দূরে?”
“কেন ভাইয়া?”
“না আসলে,,”
“কি?”
“স্কুলে একটু দরকার ছিল আমার।”
“আপনার কেউ পড়ে এখানে?”
“না মানে!”
“….
“আসলে আমার পরিচিত এক জন এখানে পড়ায়। ওর সাথে একটু দেখা করার দরকার ছিল।”
তুরফা ঘড়ি দেখল। ৩.৪২ বাজে তখন। বলল,
“আমার বান্ধবীও এখানে পড়ায়। বাসা এখান থেকে বেশি দূর নয়। পাঁচ মিনিট লাগবে। চলুন স্কুলে যাই। আপনার পরিচিত মানুষটার সাথেও দেখা করে নিবেন আর আমিও আমার বান্ধবী কে নিয়ে বাসায় যাবো।”
“গুড আইডিয়া। চলো।”
“হুম চলুন।”
ফিরাত আর তুরফা গাড়ি থেকে নেমে স্কুলের দিকে এগিয়ে গেল। মাঠের কাছে যেতেই তুরফা তার বান্ধবী কে দেখল। হাসি মুখে এগিয়ে গেল তার দিকে। ফিরাত অন্যদিকে বেখেয়ালি ভাবে তাকিয়ে ছিল। আশপাশে তার পরিচিত মুখ টা খুঁজচ্ছিল। তুরফা গিয়ে তার বান্ধবী কে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিল। ফিরাত তাকিয়ে দেখে চমকিয়ে গেল। বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইল তুরফার বান্ধবীর দিকে। কারণ এটা মোনতাহ্। তার মুন, চাঁদ। হা হয়ে দেখছে তাকে। ধ্যানজ্ঞান সব বিলুপ্ত প্রায়। চোখের পলক পরছে না। তুরফা ফিরাতের দিকে গেল। এভাবে তাকিয়ে থাকা তে তুরফাও অবাক হলো।
“ভাইয়া।”
“…
“ভাইয়া।”
তুরফার জোরে কথা বলাতে ফিরাত নিজের মাঝে ফিরল। এখনো অবাক হয়ে দেখছে তার চাঁদ কে। ফিরাত মোনতাহ্ কে চাঁদ বলেই ভাবে। মোনতাহ্ ফিরাত কে দেখে কপাল কুঁচকে নিল। অনেক টা রাগ নিয়ে তুরফার দিকে তাকাল।
“মোন উনি আমাদের কোম্পানির ম্যানেজার। আর আমার ভাইয়া।”
বলেই হাসি দিল। মোনতাহ্ কে রাগি ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুরফা অবাক হলো। কিছুই বুঝল না দুজনের হাবভাব দেখে। একবার মোনের দিকে তাকায়। তো আবার ফিরাতের দিকে।
ফিরাত হঠাৎ বলে উঠল,
“মোনতাহ্।”
তুরফা অবাক হলো। কিন্তু মোনতাহ্ নয়। মুখ হা করে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া আপনি চিনেন ওকে?”
“….
“তুই এখানে উনাকে নিয়ে এলি কেন তুরি?”
“উনার পরিচিত একজন কে দেখতে এসেছে উনি। তাই না ভাইয়া?”
“…..
মোনতাহ্ দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল,
“চল বাসায় চল।”
“আরে..”
মোনতাহ্ টানতে টানতে নিয়ে গেল তুরফা কে। যেতে যেতে মোনতাহ্ একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফিরাত কে। তখনো সে অবাক আর মুগ্ধ দৃষ্টি তে দেখছিল চাঁদ কে।
ফিরাত বাসায় গিয়ে দেখল আহরার দেওয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। ঘুমাচ্ছে হয়তো নেশায়। চারদিক কাঁচের টুকরো ও মদ পরে আছে। আহরারের অবস্থা নাজেহাল। ঘরে মদের ভেসভেসা গন্ধ। ফিরাত মুখ উল্টে দিল বাজে গন্ধে। আহরারের কাছে গিয়ে তার গালে মৃদু চর দিতে লাগল।
“আহরার। কিরে।”
“….
“আহরার রে। আহরার, ভাই আহরার।”
“….
আহরার মদ খেয়ে নেশায় বদ হয়ে আছে। সে নিজের মাঝে নেই, মদের ঘোরে বেহুশ হয়ে আছে। ফিরাত খুব কষ্টে আহরার কে তুলে বিছানায় নিয়ে শুয়িয়ে দিল। একজন সার্ভেন্ট কে ডেকে রুম টা পরিষ্কার করিয়ে নিল।
মোনতাহ্ ফ্রেশ হয়ে এলো। তুরফা সেই কখন থেকে তার পিছনে ঘুরঘুর করছে। ফিরাত তাকে কিভাবে চিনে। এই সেই অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছে। উত্তর না দিয়ে মোনতাহ্ এড়িয়ে গেছে।
“তুরি তুই কি একটু চুপ থাকবি?”
“না না আগে বল, বল না।”
“কি বলব?”
“ফিরাত ভাইয়ে কে তুই আর উনি তোকে কিভাবে চিনে? বল না মোন বল।”
“জানি না। সর তো রান্না করতে দে।”
“না। আগে বল। না হলে কিন্তু আজ আর খাবো না।”
“তুরি তুই কিন্তু এখন বেশি বেশি করছিস।”
“ওকে যা। কথা বলব না আর তোর সাথে। বিরক্তও করব না যা।”
“তুরি।”
তুরফা মুখ ফুলিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে পরল।
“তুরি এখন বেশি হচ্ছে না তুই বল?”
“না হচ্ছে না।”
“তুরি তুই না আমার লক্ষ্মী বোন।”
“….
“আরে উনাকে আমি তেমন চিনি না তো।”
“তাহলে উনি তোকে কি করে চিনে?”
“…
“কি রে বল।”
“আসলে।”
“হ্যাঁ কি বল?”
“উনি হয়তো আমায় পছন্দ করে।”
তুরফা আকাশ থেকে পরল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
“ক কি?”
“হুম।”
“….
“উনি অনেক দিন থেকে আমার পিছু ঘুরে, আমায় ফলো করে। স্কুলে এসে এটা ওটা বলে। কিন্তু আমি না। আমি উনাকে এড়িয়ে চলি।”
“আমাকে আগে বলিস নি তো।”
মুখ গোমরা করে বলল অভিমানী স্বরে।
“আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে এমন আর হবে না।”
“সত্যি তো?”
“হুম সত্যি।”
তুরফা মোনতাহ্ কে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“ফিরাত ভাইয়া আমার দুলাভাই হলে কতই না ভালো হবে।”
“তুরি তুই..”
তুরফা মন খুলে হাসল।
খুব দেরি করে আহরার অফিসে গেল। মুখ তার গম্ভীর। যাওয়ার সময় ডানে বামে, কারো দিকে তাকাল না। তুরফার দিকেও নয়। অন্য দিন তুরফার দিকে তাকাত তুরফা সরাসরি না তাকিয়ে দেখলেও আড়চোখে ঠিকি খেয়াল করত। আজ অন্যদিনের চেয়ে ব্যতিক্রম। গটগট পায়ে নিজের কেবিনে চলে গেল। তুরফা বিষয় টা নিয়ে এত মাথা ঘামাল না। ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজের কাজে মন দিল।
আহরার নিজের বিশাল চেয়ারে বসে কলম ধরে রেখেছে দুই হাতে। অনেক কিছু চিন্তা করছে। বিড়বিড় করছে।
“হৃদহরণী আপনি আমায় চেনেন না প্রয়োজনে আমি কি কি করতে পারি আর কত টা কঠোর হতে পারি। এক মাত্র আপনাকে এত করে চেয়েও আপনার সাথে কোনো জোরজবরদস্তি করছি না। আমার লাইফে আপনি সেই মেয়ে যার জন্যে কি না সব মেয়েদের সঙ্গ বিছানা ছেড়ে দিয়েছি আমি। আপনি তুরফা আহরার ব্যতীত অন্য কারো নন। আপনার সামনে আমি আমার আগের রূপ টা ফিরিয়ে আনতে চাইছি না। সেটা ভালোও হবে না আপনার জন্য। এই আহরার এত দিন মেয়ে ছাড়া একা থেকেছে শুধুমাত্র আপনার জন্যে। হঠাৎ আকস্মিক ভাবেই আমার লাইফে ঢুকে গিয়েছেন আপনি। আমার হৃদয় চুড়ি করেছেন। আপনায় তো আমি সর্বদাই চাইব দেখে নিবেন। আপনি আমার নূর হৃদহরণী।”
চলবে….
(কপি করা থেকে বিরত থাকুন)