#তুমি_আমার
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত
হসপিটালের বেডে অবচেতন অবস্থায় পরে আছে সিরাত।তাঁর সামনে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে আবেশ।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত সিরাতকে সে।চেহারাটায় আগের মত উজ্জ্বলতা নেই কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পরে গেছে।হয়তো এই ক’দিন ঘুমায়ও নি ঠিকমত।খাওয়া দাওয়া সবকিছুতে অনিয়ম।এই সব কিছুর জন্য দায়ী একমাএ সে নিজেই।নিজের কাছেই নিজে অপরাধী হয়ে গেলো।সেদিন যদি চারদিক দেখে শুনে ঘুমুতে যেত তাহলে এই নিষ্পাপ মেয়েটাকে এতবড় কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ঘুরতে হতো না।পুরো একটা ফ্যামিলিকে চুপ হয়ে যেতে দেখতে হতো না।এভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হতো না।মাথার সেলাই কাটতে হসপিটালে আসার পথে রাস্তায় লোকের ভিড় দেখে গাড়ি থামিয়ে কি হয়েছে দেখার জন্য গাড়ি থেকে নামে আবেশ কিন্তু সেখানে গিয়ে সিরাতকে দেখবে এটা কল্পনাও করে নি সে।তৎক্ষণাৎ ওকে পাজাঁকোল করে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে আসে।রাদিফ চেক আপ করে স্যালাইন দিচ্ছে।মাএাতিরিক্ত টেনশন আর খাওয়া দাওয়া না করায় শরীর দুর্বল তাই সেন্সলেস হয়ে গেছে।এই সবগুলোর কারণ আবেশ জানে তাই চুপচাপ বসে আছে।এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।এবার এর একটা হেস্ত নেস্ত করা প্রয়োজন। ওর জন্য মেয়েটা নিজেকে শেষ করে দিবে এটা মানবে না আবেশ।
🍁🍁🍁
একা একা হাঁটছে আরু।মাথায় তাঁর একটাই চিন্তা সিরাত।কাউকে কিছু না বলে মেয়েটা কোথায় গেলো।বাসায় গিয়েই ওর সাথে কথা বলতে হবে।মেয়েটার জীবনটা বোধহয় এলোমেলো হয়ে গেলো এবার।তাঁর জন্য সে নিজেকেই দায়ী ভাবে।সেদিন যদি ওকে ওদের বাসায় না নিয়ে যেতো তাহলে কিছুই হতো না।এখন ঠিক দুপুর।সূর্যি মামা মাথার উপর কিরণ দিচ্ছে।ঘেমে পুরো একাকার।হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর শুনে থমকে গেলো সে।এটা তাঁর মনের ভুল নাকি সত্যি।ঘুরে তাকানোর আগেই লোকটা সামনে চলে এলো তাঁর।তাহলে সত্যি লোকটা এখানে এসেছে কিন্তু কেন?এমনিতেই এড়িয়ে চলতে চায় সে কারণ ওকে দেখলে নিজের মধ্যে থাকে না।হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়।অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়।এই অনুভূতি যে ডেঞ্জারাস সেটা খুব ভালোভাবেই জানে সে।আজও ভয়ঙ্কর রকম সুন্দর লাগছে তাঁকে।আরু একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।রাদিফ মৃদু হেসে বললো,
-‘আজ একা পুরো ঘ্যাং কোথায়?ওদের দেখছি না’?
-‘সবাই বাসায় চলে গেছে।আমি আর সিরাতের বাসা সবার পরে।কিন্তু আজকে সিরাত দুটো ক্লাস করে বেড়িয়ে গেছে।যাগগে আপনি এখানে’?আরুর কথা শোনে সিরাতের কথাটা বলবে বলবে বলেও বললো না সে।বললো হয়তো দেখা যাবে রাস্তার মধ্যেই কান্না জুড়ে দিয়েছে।
-‘একটু প্রয়োজন ছিলো তাই।আচ্ছা চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেই’।আরুর উড়ো মন একবার ভাবলো যাবে আরেকবার ভাবলো এভাবে উনার সাথে টাইম স্পেন্ড করলে উনার প্রতি দুর্বলতা বাড়বে যদি প্রকাশ করে ফেলে তখন।তখন কি হবে।তাই বললো,
-‘না না ঠিক আছে।আপনি আসতে পারেন আমি চলে যেতে পারবো’।
-‘একমাএ বিয়াইন আপনাকেএভাবে ফেলে গেলে আমার ঘোর অন্যায় হবে।তাছাড়া তিথি যদি জানতে আমি তার ননদকে রাস্তায় পেয়েও লিফট দেতে কিপ্টামি করেছি তাহলে আমার কান মলে দেবে তাই প্লিজ চলুন’।আরু আর কথা বাড়ালো না চুপচাপ রাদিফের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো।রাদিফ মৃদু হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে সিরাতের।আবেশ এখনও বসে আছে ওর সামনে।আস্তে আস্তে চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে অবাক হলো সিরাত।মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বসে আছে আবেশ।ফোনে কিছু একটা দেখছে সে।সিরাত ওর দেখে এক মনে তাকিয়ে রইলো।এই ছেলেটাকে খুব খুব ভালবাসে সে।খুব করে চাইতো লোকটা তার হোক,পুরোপুরি হোক।হলোও কিন্তু সময়টা ভিন্ন।আজকে মানুষটাকে নিজের করে পেয়ে কোনো সুখ আনন্দ উচ্ছ্বাস নেই তাঁর মাঝে।বরং রাগ লাগছে কোথায়ও শান্তি নেই এতটুকু শান্তি নেই জীবনে।নড়েচড়ে উঠে বসতেই আবেশ ভ্রু কুঁচকে ব্যস্ত হয়ে বললো,
-‘কি করছো স্যালাইন এখনও শেষ হয়নি।আরেকটু শুয়ে থাকো’।
-‘আমি শুয়ে থাকবো না।আমি এক্ষুণি বাসায় যাবো’।
-‘জেদ করো না।যেটা বলছি সেটা করো।এতে নিজেরই লাভ হবে’।তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে দাঁত কটমট করে বললো,
-‘লাভ ক্ষতি আমি বুঝি না।আমি যাবো মানে যাবোই’।
-‘প্লিজ সিরাত আমার কথাটা একটিবার শোনো।এভাবে নিজের ক্ষতি করো না।নিজের কি হাল করেছো দেখেছো।প্লিজ নিজের খেয়াল রাখো।একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে সিরাত।শুধু ক’টা দিন অপেক্ষা করো তারপর আমি সব ঠিক করে দেবো।তুমি তোমার সেই আগের মত বাঁচতে পারবে।জোর করে কোনো বন্ধনে তোমাকে জড়িয়ে রাখবো না’।
শেষের কথাটা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো লাগলো সিরাতের।কি ছেড়ে দেবে ওকে।কি পেয়েছে কি এই লোকটা।রাগে রিরি করে উঠলো সারা শরীর।হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হাতেট সালাইন একটানে খুলে ফেললে।হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে এখন।সিরাতের পাগলামি দেখে হতভম্ব আবেশ।এবার রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না সে।থাপ্পড় মারার জন্য হাত উঠিয়েও কি ভেবে যেন নামিয়ে নিলো।হাত দিয়ে দেয়ালে ঘুষি মেরে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে রক্তাক্ত করলো।আবেশের হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে দেখে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো সিরাতের।কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-‘ররক্ত! আপনার হাত থেকে রক্ত ঝরছে’।মৃদু হাসলো আবেশ হেসে বললো,
-‘ঝরতে দাও।আমার মতো লোকের রক্ত ঝরলে বা মরে গেলেও কিচ্ছু হবে না।আমাকে কারোর প্রয়োজন নেই কিন্তু তোমাকে সবার খুব প্রয়োজন’।একজন সিস্টার কে ডেকে এনে সিরাতের হাত ব্যান্ডেজ করিয়ে দিলো আবেশ।কিন্তু নিজের হাত থেকে এখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছে।সিরাতের এখন কান্না পাচ্ছে।মরে যাবে কথাটা শুনে ধক করে উঠলো।লোকএা মরে গেলে তাঁর কি হবে।কীভাবে বাঁচবে সে।এভাবে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে আছে।।সিরাত উঠে দাঁড়ালো এবার যেতে হবে তাঁদের।আবেশ তাগদা দিচ্ছে। ফোনে সিয়ামকে সবটা জানিয়েছে।এখন ওকে নেওয়ার জন্য সিয়াম আসছে ততক্ষণ সিরাতের সাথে আবেশ থাকবে কারণ বলা তো যায় না কখন আবার কি ঘটিয়ে ফেলে।সিরাত একদম আবেশের মুখোমুখি দাঁড়ালো।কাঁপা হাতে আবেশের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।আবেশ তাকিয়ে হাত সরিয়ে নেওয়ার জন্য টান দিলো কিন্তু সিরাত ছাড়লো না।বিরক্তি নিয়ে আবেশ বললো,
-‘ছাড়ো হাতে কিচ্ছু হয়নি।ওটা এমনি সেরে যাবে’।কোনোকথা বললো না সিরাত।চোখের পানিটুকু মুছে ওর হাতে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।আবেশ অবাক দৃষ্টিতে সবটা দেখে গেলো শুধু। মেয়েটাকে একটুও বুঝতে পারে না সে।কখন কি করে হয়তো নিজেই জানে না সে।এতক্ষণ কি কান্ডটাই না ঘটালো আর এখন পুরো নীরব মুখে কোনোকথা নেই চুপচাপ।
🍁🍁🍁
রিয়ার বাসায় গেছে মিনার।কয়েকটি নোটস আনতে হবে তাঁকে।টেস্ট পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকী নেই।পড়াশোনা লাটে উঠেছে।রীতিমত ক্লাসে মন বসে না আজকাল।কোনোকিছুতেই ফোকাস করতে পারছে না।এই কদিন কলেজ খামাই হয়েছে বেশ।সেগুলোর নোটস কালেক্ট করার জন্য সোজা বাসায় গেছে সে।সোফায় বসে রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে তখনই একটি পিচ্চি টাইপ মেয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে হেলেদুলে সোফায় এসে বসলো।দৃষ্টি তার ফোনেই নিবদ্ধ।সেখান থেকে চোখ সরছেই না সামনে যে একটি লোক চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে তাঁকে সেদিকে কোনো নজরই নেই তাঁর।রিয়া এসে রাম ধমক দেওয়ায় হুশ ফিরলো তাঁর।সামনে বসে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে দৌড়ে জায়গা ত্যাগ করলো।তিহানা সম্পর্কে সকল ডিটেলস নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরলো মিনার।কারণ তার ভালোবাসার সেই কাঙ্গিত মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছে সে আর কোথাও হারাতে দেবে না তাঁকে।
কেটে গেছে পনেরো দিন।এখন সিরাত অনেকটাই স্বাভাবিক।বন্ধমহলের সবাই জানে আবেশকে ভালোবাসে সিরাত।সেটা তাঁর ডায়েরি পরে আরু জেনেছিল তারপর পুরো টিম।এখন ওদের এক করার জন্য পুরো টিম উঠে পরে লেগেছে।সেদিনের ঘটনার পেছনে কার হাত আছে সব খুঁজে বার করবে।তবে এখনও আবেশের বাসায় যায় নি সিরাত।আবেশও ছাড় দিচ্ছে।কোনো জোরাজুরি নেই।ক্লাসে এসে ক্লাস নেয় সিরাতের সাথে কোনোকথা হয় না।জীবনের নিয়মে জীবন চলে যাচ্ছে।কিন্তু সিরাত আবেশের এই ইগনোর যেন সহ্য করতে পারছে না।শত হোক বিয়ে যখন মানেন তখন সে অনুযায়ী তার ওয়াইফ সে।আর ওয়াইফের প্রতি এমন উদাসীনতা কিছুতেই মানতে পারছে না।বক্ষস্থলে ব্যাথা করে।তাছাড়া কলেজে নতুন একজন ম্যাম এসেছেন কাঁজল নাম তার সাথেই সারাক্ষণ দেখা যায় আবেশকে।হেসে হেসে কথা বলে একসাথে খাবার খায়।এগুলো তাঁদের ডেইলি রুটিন।যার কারণে আরো বেশি মন খারাপ হয় সিরাতের।যদি মেয়েটা তার কাছ থেকে কেড়ে নেয় আবেশকে তখন কি করবে সে।
হোটেলে বসে আছে বন্ধু বান্ধব সবাই।আজকে দুপুরে লাঞ্চ করবে এখানে তাঁরা।আর ট্রিট দিচ্ছে মিনার।কারণ তিহানাকে মনের কথা বলে দিয়েছে সে।তিহানা তাঁকে একসেপ্টও করে নিয়েছে এই পুরো ব্যাপারটায় রিয়া তাঁকে হেল্প করেছে।আজকে ওদের সাথে তিহানাও আছে।মেয়েটা লজ্জায় মাথানিচু করে বসে আছে।সিরাত নিজের ভাবনায় মগ্ন।আজও দুজনকে একসাথে দেখে এসেছে।মেয়েটা মারাত্মক সুন্দরী সিরাতের সাথে কোনো রকমের তুলনা হয় না।সেটা তাঁর নিজেরই দাবী।রুপে গুণে অন্যন্যা।তবে কি এভাবেই চোখের সামনে ওর থেকে পর হয়ে যাবে আবেশ।ওর ভাবনার মাঝেই আয়ান বললো,
-‘সিরাত দোস্ত তুই এই সন্ন্যাসী বেশভূষা নিয়ে থাক আর ওদিকে কাঁজল ম্যাম তোর বরকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে নিল।এরপর তুই কি সতীন নিয়ে সংসার করতে চাস’?
আয়ানের কথায় উপস্থিত সকলে হতভম্ব।আয়ানের কথার মানে কারেরই বোধগম্য নয়।আরু বললো,
-‘কি বলতে চাইছিস ক্লিয়ার করে বল’!
-‘সামনে তাকিয়ে দেখ’।সামনে তাকিয়ে সকলে হতবাক।কাঁজল শাড়ি চুড়ি পরে সেজেগুজে বসে আছে তাঁদের দু টেবিল পরে।কালো জর্জেট শাড়ি ফর্সা শাড়িতে দারুন মানিয়েছে।মুখে হাসি যেন সরছেই না।বার বার হাত ঘড়িতে টাইম দেখতে ব্যস্ত সে।বুঝাই যাচ্ছে কারোর অপেক্ষায় আছে।আয়ান বললো,
-‘কি হট লাগছে আজকে যদি ম্যাম না হত তাহলে আমিই প্রপোজ করতাম সেখানে আবেশ স্যার তো….বলেই সিরাতের দিকে তাকালো।সিরাত একটা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো তাঁকে।মিনার বললো,
-‘যা বলেছিস।আচ্ছা কার জন্য অপেক্ষা করছে বল তো নিশ্চয় আবেশ স্যার’।পাশ থেকে তিহানা চোখ গরম করে তাকাতেই বললো,’না মানে মজা করছিলাম’।সিরাত বললো,
-‘এমনি হয়তো বয়ফ্রেন্ডের হবে।আবেশ স্যার এখানে এখন আসবেন না’।
-‘যদি আসেন’?
-‘আসবেন না’।আয়েশা বললো,’তুই সিওর’।সিরাত বললো, ‘হুমম’।পাশ থেকে আরু বললো, ‘আজ যদি ভাইয়া এখানে আসে তাহলে তুই কথা দে আমরা যা বলবো তুই তাই করবি।ভাইয়ার লাইফে এন্ট্রি নিবি।এভাবে সম্পর্কটাকে ফেলে না রেখে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবি।আর যদি না আসে তাহলে তোর ইচ্ছে’।সিরাতের মনে অগাধ বিশ্বাস আবেশ আসবে না।কিছুতেই আসবে না।তাই সকলের কথায় রাজি হয়ে যায় সে।কিন্তু নিজের বিশ্বাস এভাবে কাঁচের মতো ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে ভাবে নি সে।আবেশ কাঁজলের শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কালো শার্ট আর প্যান্ট পরে এসেছে।দেখতে অসাধারণ লাগছে তাঁকে।সেও হেসে হেসে ফুল হাতে নিয়ে কাঁজলের কাছে যাচ্ছে।আবেশের হাতে ফুল দেখে সিরাত রীতিমত কাঁপছে তাহলে কি সত্যি সব শেষ হয়ে গেলো।শেষ পর্যন্ত মেয়েটা কেড়ে নিলো তার কাছ থেকে তার আবেশ কে।
#তুমি_আমার
#বোনাস_পার্ট
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত
আবেশ আর কাঁজল বসে আছে মুখোমুখি দুটি চেয়ারে।আবেশের হাতে থাকা ফুলগুলো দেখে মেয়েটার চোখগুলো দ্বিগুণ চিকচিক করছে।সিরাত সেদিকে তাকিয়ে কয়েক ফোঁটা জল ফেললো।শেষমেশ বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও লোকটাকে নিজের করে রাখতে পারলো না। হারিয়ে গেলো সুন্দরীর কাছে।সকলের মুখে বিষণ্ণতার চাপ।কেউ কোনো আন্দাজ করতে পারছে না।আবার ফুলগুলোও মেয়েটাকে দিচ্ছে না।তবে কি ফিল্মি স্টাইলে প্রপোজ করবে তাঁকে।এবার মুখ খুললো আরু,
-‘কি বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে।কষ্ট হচ্ছে নিজেকে এলোমেলো লাগছে তো।মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন।যেখানে প্রিয় মানুষ টাই কাছে নেই পাশে নেই সেখানে বেঁচে থেকে লাভ নেই।সিরাত নিজের অধিকার নিজের ভালোবাসা নিজেকে বেঁধে রাখতে হবে অন্য কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না।একজন স্ত্রী হয়েও তোর স্বামী বাইরে একটা মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তুই একেবারে নিশ্চুপ কিচ্ছু বলছিস না হতে দিচ্ছিস।মেনে নিচ্ছিস আজব’!আয়েশা বললো,
-‘সিরাত যোকোনো পরিস্থিতিতে হোক বিয়েটা হয়ে গেছে ।আর বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়।তাছাড়া তুই তো ভাইয়াকে ভালোবাসিস তাহলে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়’?রিয়া বললো,
-‘মানিয়ে নিয়ে স্যারকে নিয়ে জীবনটা সুন্দর করে সাজা।দেখবি তোর সুখের অভাব হবে না।স্যার তোকে খুব সুখে আর ভালো রাখবে।এখন থেকে হাল ধর হাল ছাড়িস না।নইলে পরে তোকে পস্তাতে হবে’।আয়ান বললো,
-‘একবার তো নিজেকে সুযোগ দে।লোকে জানাজানি হওয়ার আগ পর্যন্ত চেষ্টা কর।যদি মানতে না পারিস বা উনি না মানতে পারেন তখন না হয় অন্য পথ দেখবি’।
চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায় সিরাত।তোরা ঠিক বলেছিস এবার থেকে নিজের অধিকার অর্জন করে নেবো আমি।ওই আরু দেখি তোর ভাই এখানে পিরিতির আলাপ কি করে করে’।নিজেকে সামলে আবেশের সামনে দাঁড়ায় সিরাত।ওকে দেখে দুজনে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।কিন্তু সিরাত সেদিকে পাওা না দিয়ে একটি চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পরে।ওর এহেন আচরণে হতভম্ব সকলে।কাঁজল হা হয়ে আবেশের দিকে তাকালো আবেশ বললো,
-‘কি হলো সিরাত তুমি এখানে’?কাজঁল সেইম প্রশ্ন করলো তাঁকে।সিরাত হেসে হেসে জবাব দিলো,
-‘এখানে বন্ধুদের সাথে খেতে এসেছি কিন্তু এখন ওদের সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই আপনাদের টেবিলে চলে আসলাম।স্যার ম্যাম আপনারা কি ডিস্টার্বড’।আবেশের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পরলো কিন্তু কিছু বললো না।সিরাতের মটিভ বুঝার চেষ্টায় রয়েছে সে।কাজঁল হাসকা হেসে না জানালো।ওখান থেকে আরু উঠে এসে বললো,
-‘ভাইয়া ফুলগুলো খুব সুন্দর তো।কার জন্য আমার ভাবীর জন্য এনেছো বুঝি’?আবেশের দিকে দুষ্টু হেসে কথাগুলো বেশ সাহস সঞ্চয় করে বললো আরু।ভাবী ডাকটা যে সিরাতকে উদ্দেশ্য করেই বলা তা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি তাকে।কাঁজল কাঁদোকাঁদো ফেইস নিয়ে বললো, ‘ভাবী মানে’?সিরাত গুতা দিয়ে আরুকে সত্যিটা বলতে নিষেধ করলো।কারণ চায়না পাবলিকলি এভাবে সিনক্রেইট করতে।আরু কথা ঘুরিয়ে বললো,
-‘ম্যাম বুঝলেন না তো।আরে বাবা ভাবী মানে আমার ভাইয়ার বউ।মানে ফিউচারে যে হবে তাঁর জন্য নাকি মানে প্রপোজও তো করতে পারে নাকি’।এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ফেললো কাঁজল।ততক্ষণে পুরো ঘ্যাং হানা দিয়েছে এই টেবিলে।বাকীরা পাশের টেবিলে।আবেশ সিরাতের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললো,
-‘আমি ওসব পারবো না।ফুল দিয়ে প্রপোজ করে হাতে দামী আংটি পরিয়ে বার বার ভালবাসি বলে কানের কাছে প্যান প্যান করতে আমি পারব না।ওসব আমার কাছে জাস্ট ইম্পসিবল।আমি আমার স্টাইলে ভালোবাসি তাঁকে।যদি এসব ছাড়া আমার ভালোবাসা ধরতে পারে বুঝতে পারে তাহলে সে পূর্ণ আর নইলে শূন্য’। আবেশের কথার মর্মান্ত কিছুই বুঝলো না কেউ।ফুলগুলো কাঁজলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো আবেশ,
-‘শুভ জন্মদিন কাঁজল!দোয়া করি আগামী জীবন সুখের কাটুক।সবসময় এভাবে হাসিখুশী থাকো।নিজের স্বপ্নের উচ্চ শিখরে পৌছাও’।সকলের হ্যাবলার ন্যায় একে অপরের দিকে তাকালো।তারপর একে একে সবাই উইশ করলো।তাঁরা কি ভেবেছিল আর হলো কি।উফফ!এটা আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো এটা আয়ান বা মিনার নয় এটা হলো আবেশ মিঃ আবরার আবেশ।
🍁🍁🍁
মাঝেমধ্যেই ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে আরু।ঘুমের মধ্যে কারো স্পর্শ অনুভূত হয় তাঁর।প্রথম প্রথম দুঃস্বপ্ন ভাবলেও এখন এটা সত্যি ধরে নিয়েছে সে।খুব বাজেভাবে স্পর্শ করে এমন নয়
আলতো হাতে গালে স্পর্শ করে নয়তো কপালে একটি চুমো দিয়ে চলে যায়।কিন্তু চোখ খুলে আশেপাশে কাউকে দেখতে পায় না।আজও ঠিক একইভাবে স্পর্শ করেছে তাঁকে কিন্তু চোখ খুলে কাউকে দেখে নি।এবার রুমের লাইট জ্বালিয়ে বসে আছে আরু আজ দেখতেই হবে কে আসে তাঁর রুমে।প্রায় দেড় ঘন্টা ওয়েট করার পরও কেউ এলো না।ঘুম পেয়েছে ওর বারবার হামি দিচ্ছে একসময় ঘুমিয়ে গেলো।হঠাৎ কারো মিহি সুরের ডাক কানে পৌঁছাতেই লাফিয়ে উঠলো আরু।হ্যাঁ একটি ছেলে বসে আছে তাঁর সামনে।ছেলেটির মুখে মাস্ক পড়া শুধু চোখ গুলো দেখা যাচ্ছে তাঁর।আরুর টেডিবিয়ার টা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে সে।আরু কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-‘কে আপনি? এভাবে রাত বিরাতে আমার ঘরে এসেছেন কেন’?
-‘তুমি আমার জন্য ওয়েট করছো তাই তোমাকে দেখতে এসেছি’।
-‘হোয়াট’?
-‘হুম!তুমি এতক্ষণ না ঘুমিয়ে আমার পথ চেয়ে ছিলে তাই সামনে না এসে পারলাম না।এবার দেখা হয়েছে যাই’।
-‘আপনি এসব কেন করছেন?কে আপনি’?
-‘আমার পরিচয় খুব শীঘ্রই পাবে।আর আমি!আমি হলাম তোমার ভালোবাসা’।লোকটার জথায় চটে গেলো আরু।বললো,
-‘আপনি আমার ভালোবাসা নন।আপনি অত্যন্ত অভদ্র অসভ্য একটি লোক।নইলে এই রাতের আধাঁরে আপনি একটি মেয়ের ঘরে ঢুকে তাকে বাজেভাবে স্পর্শ করতেন না।কেন এভাবে আমাকে মেন্টালি ট্রমার মধ্যে দিয়ে রাখছেন কি দোষ করেছি আমি’।
-‘তোমার কোনো দোষ নেই।সবটাই আমার দোষ।তোমাকে দেখার পর থেকে ঘুমাতে পারি না।তোমাকে এক দন্ড না দেখলে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করি নিজেকে আটকে রাখতে কিন্তু পারি না।জানি এসব ঠিক না কিন্তু কি করবো বলো।নিজের অনুভূতির কাছে আজ নিজেই অসহায়’।
-‘ঠিক ভুল জাজ করতে জানেন অথচ ভুল পথ বিসর্জন দিয়ে সঠিক পথে আসতে পারছেন না।এটা কোনোকথা হলো।আমাকে এভাবে আর ডিস্টার্ব করবেন না। আমি একজনকে ভালোবাসি।আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না।তাই শুধু শুধু কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয় না’।আরু অন্য কাউকে ভালোবাসে কথাটা শুনেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাঁর।নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
-‘কাকে ভালোবাসো নাম কি তাঁর’?সন্দিহান চোখে তাকালো আরু।
-‘কেন মারবেন তাঁকে’?
-‘নাহ শুধু ভাগ্যবান ব্যাক্তিটি কে একবার জানতে চাই।যদি দেখি ওর সাথে তুমি ভালো আছো তাহলে কখনও তোমার লাইফে আসবো না।আর যদি দেখি তুমি ওর সাথে হ্যাপী নও তাহলে আসবো।একবার নয় বার বার আসবো’।
খাবার টেবিলে বসে আছে খান বাড়ির সবাই।সেখানে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে উঠে এসেছে সিরাত। মেয়েটা এখন আর এই বাড়িতে আসে না।আগে যাও আরুর সাথে আসা যাওয়া করতো কিন্তু এখন ভুলেও এ পথে পা মাড়ায় না।ফুপি বিদায় নিয়েছে পরশু।এতদিন তাঁর জন্যই সিরাত সম্পর্কে কোনো কথা তুলেনি তাঁরা।এখন গেছে তাই শান্তিতে কথা বলছে।আবার আসবে বলে গেছে সে।তিথিও ওর কথাই বলছিলো সকলের কথার মাঝেই খাবার টেবিলে আবেশ উপস্থিত হলো।আবেশকে দেখে সবাই চুপসে গেলো।আবেশ ভ্রু কুঁচকে সকলের দিকে একবার তাকালো আবার খাওয়ায় মনযোগী হয়ে উঠলো।মিঃ খান বললেন,
-‘আবেশ তোমার মনে হয় না তুমি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছো’?বাবার কথায় আবেশ মুখ তুলে তাকালো।কোন দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলো আবেশ।চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-‘কোন দায়িত্ব বাবা’?
-‘ছেলে ভাই হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারলেও একজন স্বামী হিসেবে ব্যর্থ তুমি।তোমার বউ এতদিন ধরে বাপের বাড়ি পরে আছে আর তুমি এখনও তাঁকে নিয়ে এলে না।ফোন করে ভালো মন্দ খবর পর্যন্ত নিলে না।তুমি তো এমন ইরেস্পপন্সিবল ছিলে না তাহলে শুধু সিরাতের বেলায় কেন’?
-‘বাবা বিয়েটা স্বাভাবিক কিছু তো ছিল না।তুমি তো সবটাই জানো তারপরও।আমি সিরাতকে নিজের মতো বাঁচতে দিচ্ছি প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে দিচ্ছি যাতে এটা মনে না হয় বিয়ে হতে না হতেই ওকে খাঁচায় বন্দি করে রাখছি।উড়তে চাইছে উড়তে দাও কতদিন উড়বে’।
-‘স্বাভাবিক ছিল না বলে সারাজীবন এই অস্বাভাবিক জীবন বয়ে বেড়াবে এটা তো হয় না।এবার নিজেদের সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করো।আর শোনো বিকালে ও বাড়ি যাচ্ছি আমরা সবাই আবেশ তুমিও তৈরী থেকো।তাছাড়া আমরা আগেই চেয়েছিলাম সিরাত এই বাড়ির ছোট বউ হোক শুধু সময়ের অপেক্ষা মাএ।কিন্তু মাঝপথে এমন হবে ভাবতে পারিনি’।আবেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো তার বাবার দিকে,
-‘বাবার কথায় চমকে উঠলো আবেশ।আগে থেকেই এই ইচ্ছে ছিলো।তা ও বাড়ি হঠাৎ কিসের জন্য বাবা’?
-‘আমার বৌমা আনতে’!
#চলবে
#চলবে