#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৮
শার্টের বোতাম গুলো একে একে সব খুলে এগিয়ে এলো, পিছাতে পিছাতে আমার পিঠ গিয়ে ঠেকলো একটা পাথরে, ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম
কিছুক্ষণ পর নিজের শরীরে কিছু একটার উপস্তিতি অনুভব করতেই চোখ খুলে তাকালাম।
লোকটা আবার আগের জায়গায় চলে গেছে, বরাবরের মতোই ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে।
নিজের দিকে তাকাতেই দেখি উনার শার্ট টা খুলে আমার গায়ের উপর দিয়েছেন।
-লাল রঙের পরেছো ভালো কথা তা বলে এভাবে বের করে প্রলোভন দেখাতে চাও?
উনার কথায় আমার কান মুখ থেকে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে, খোদা আমারে আর কতো লজ্জায় ফেলবেন জানা নেই, আর কতো অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে পরবো আমি জানি নাহ। আর সব বার এই লোকটার সামনেই আমার ইজ্জতের দফারফা হয় কেনো, গায়ের হালকা রঙের পাতলা জামাটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে যার ফলে ভেতরের অন্তর্বাস টাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আর আমি কি না এতোক্ষণ খেয়াল ই করিনি।
ভেতর টাই কেমন এক প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো, এতোক্ষণ লজ্জা লাগলেও সাথে এক রাশ ভালো লাগা ঘিরে ধরেছে, লোকটা একটু রাগী হলেও খুব ভালো। আজকাল তো ছেলেরা চেয়ে থাকে কোন ফাঁকে মেয়েদের শরীরের ভাজ গোণা যায়, সেখানে উনার এহেন কাজ আমার ভেতরে উনার জন্য সম্মান টা বাড়িয়ে দিলো। অজান্তেই ঠোঁট ফুটে এক ফালি হাসি ছড়িয়ে গেলো।
নিজের গায়ে ভীষণ পছন্দের ঘ্রাণ টা পাচ্ছি৷ অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে গেলো মন মস্তিষ্কে। গায়ের শার্ট টা আরও সযত্নে মিশিয়ে নিলাম। উনার দিকে
তাকিয়ে দেখি দৃষ্টি সামনের পাহাড় গুলোর দিকে স্থীর। শুভ্র রঙের টি-শার্ট টা ভিজে লেপ্টে আছে শরীরে, বলিষ্ঠ শরীরের প্রতিটি ভাজ বিদ্যমান, আধভেজা চুলগুলো থেকে টপটপ করে পরা পানির ফোটার মুখশ্রী স্নিগ্ধ। অদ্ভুত ইচ্ছেরা ভেতরে জিদ ধরে বসছে, ভেজা চুলগুলোতে হাত গলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছে করছে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে একবার হাত টা ঘষে নিতে ইচ্ছে করছে। পলক ফেলার ও নূন্যতম ইচ্ছে টুকু করছে নাহ
-আমি জানি আমি হ্যান্ডসাম,তা বলে এভাবে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে তো আমারও লজ্জা লাগে নাকি।
আমার অপলক চেয়ে থাকার মাঝেই ফট করে এমন বিব্রত করা কথাটা বলে বসলেন। জানি তো আমি, মেঘালয় চৌধুরী আমার সামনে থাকবেন আর আমায় বিব্রত হতে হবে না তা তো হয় না। তবুও আজকে উনার কথা টাই লজ্জা পেলেও অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে,ফিক করে হেসে ফেললাম।
আমার হাসির শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন, বেশ অবাক হয়েছেন হয়তো, উনি সবসময় আমার অপ্রিতিকর পরিস্থিতির অঅভিব্যক্তি তেই অভ্যস্ত, এভাবে হেসে ফেলায় হয়তো বেশ অবাক হয়েছেন, তবুও আমি গাল প্রসারিত করে হেসে দিলাম। উনি আমার দিকে চেয়ে থাকা অবস্থায় ই উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৌড় লাগালাম উনি পেছন থেকে খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেললেন আমি ঘুরে তাকাতেই হালকা হেসে বললেন।
-কোথায় যাও?
আমি আঙুল উচিয়ে সামনের ঝরনাটা দেখিয়ে বললাম
-ওইখানে যাবো
আমার কথায় এক গাল হেসে দিলেন মেঘ।
-আরে পাগলী ওটা অনেক দূর ওখানে যাওয়া যায়না
আচ্ছা উনাকে কি কেও বলেনি হাসলে উনাকে মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন দেখায়, হাসলে যে উনার চোখের দু পাশে ভাজ পরে তাতে যে হারিয়ে যাওয়া যায় তা কি উনি জানেন নাহ? কেনো বারবার দূর্বল করে দেয় আমায়,এই যে হাতটা ধরে রেখেছে এ স্পর্শ তো আমি হাজার চেয়েও মুছতে পারবো নাহ, এই যে আমার দিকে উনার হাসি হাসি চোখ চেয়ে আছে এতে যে কতোটা আদর আদর লাগে তা কি উনি জানেন নাহ?
আমার এভাবে চেয়ে থাকার মাঝেই উনি হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে এলেন, দূরত্ব ঘুচিয়ে একদম পেছন ঘেঁষে দাঁড়ালেন, আমার পিঠ টা একদম উনার বুকে গিয়ে ঠেকছে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন
-যাবে নূর?
আমিও উনার মতো ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলাম
-কোথায়?
উনি দু হাতে আমার হাত ধরে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরলেন, ঘাড়ের উপর থুতনিটা রেখে বললেন
“যে দেশে কোনো চেনা জানা মানুষ নেই,সেখানে।
মনের ভেতরে জমে থাকা হাজারো কথাকলি যেখানে বাধাহীন ভাবে বলা যাবে সেখানে,,
সুবিশাল আকাশের নিচে একটাই বাড়ি থাকবে যেখানে সেখানে।যার জানালা টা দিয়ে রূপার মোড়ানো চাঁদটাকে যেনো দু হাতের দূরত্ব মনে হবে সেখানে
যেখানে প্রিয় মানুষের হাসি কলকলানি ধ্বনিতে আকাশ বাতাশে নুপুর বাজবে সেখানে
কৃষ্ণচূড়ায় ভরা লাল আঙিনায় শুভ্র পরীকে একান্তে চোখ জুড়িয়ে দেখা যাবে সেখানে,
রোশনাই তে যেখানে আলাদা রকমের নূর থাকবে সেখানে, যেখানে ভালোবাসারা বাধ ভাঙবে সেখানে”
একদমেই কবিতার মতো বলে গেলেন লাইন গুলো। আমি কি করে বুঝাবো আমার ভেতরে কি শুরু হয়েছে, কাধে রাখা থুতনির খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ঘষা, কথার সাথে আছড়ে পরা তপ্ত শ্বাস আমার ঘাড় থেকে বুক অব্দি ছড়িয়ে পরছে। বুকের ভেতরে যে অস্বাভাবিক টর্নেডো শুরু হয়েছে তার শব্দ কি সে অব্দি পৌঁছাতে পারছে? পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি টুকুও যে নিবৃত্ত। পেছন থেকে আসা শব্দগুলো যতোটা না আবেদনময়ী লাগছে তার দ্বিগুণ চড়াঘাত হচ্ছে আমার বক্ষপিঞ্জরে। কি করে বুঝাই আমার কেমন লাগছে, প্রিয় কণ্ঠভূষণে প্রেমানন্দোলন তোলা শব্দগুচ্ছ বুকের ভেতর যুগ সমার তোলপাড় করছে৷ অস্বাভাবিক ভাবে কম্পিত হচ্ছে সারা শরীর। ভেতরের তান্ডব যেনো নদীর ঢেও পর্যন্ত পৌঁছে গেলো, শান্ত হয়ে থাকা হাটু সমান পানিও এখন তুমুল ঢেউ তুলেছে।
মেঘালয় এখনো পেছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে আমায়, হাত দু’টো আমার হাতের উপর রেখে ধরলেও তার স্পর্শ যেনো আমার হাত ভেদ করে শরীরের মাঝে গেঁথে যাচ্ছে।
মেঘ নিশ্চুপ মুখ ডুবিয়ে আছে পালকের ঘাড়ে,ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে তার কলিজা,এ কেমন সর্ব’নাশ, যাতে তলিয়ে যাচ্ছে মন, ক্ষ’ত বি’ক্ষত হচ্ছে হৃদয়। বাধাহীন বেপরোয়া ছুটছে একটাই মানবীর দিকে, কেমন অন্তর্জালে জড়ালো সে, সে তো বলতে চাইনি, প্রকাশ করতে চাইনি তবুও কি করে এতোটা নিয়ন্ত্রণহীন হলো নিজের উপর,, বরাবরই মেয়েদের প্রতি ছেলেদের আবেগ,নেশা কাজ করে, যা একসময় ফুরিয়ে যায়। কিন্তু মেঘ স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার প্রাপ্তবয়স্ক মনটা আবেগ বা নেশায় নয় প্রচন্ড ব্যকুলতা আর ভালোবাসা অনুভব করছে।দুদিনের চেনা মেয়েটার শূন্যতায় যেনো তার হৃদস্পন্দন থেমে যায়,বুকটা হাহাকার করে ওঠে,, ভালোবাসায় ডুবে আলিঙ্গন করার অগাধ আকুলতা আসে।
মেঘের এরূপ কথায় পালক কি বলবে জানে,নাহ। সে স্বাভাবিক থাকতে পারছে নাহ,কিছুতেই নাহ। ফট করে পেছন ঘুরে ঝাপটে ধরলো মেঘালয় কে,দু’হাতে খামচে ধরলো মেঘের টি-শার্ট। নিজের মধ্যে নেই পালক,, অনুভূতিরা ছুটাছুটি করছে। দুঃসাহসিক একটা কাজ করে বসলো পালক। শার্টের ফাকে ভেজা বুকটাই তপ্ত অধর ছুয়ে দিলো। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হলো মেঘের,গলা শুকিয়ে গেলো, হাত দু’টো আসার হয়ে এলো, স্তব্ধতা ঘিরে ধরলো মেঘকে, দু চোখ টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে, দু হাতে ঝাপটে মিশিয়ে নিলো পালককে বুকের মাঝখানটাই,যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে, প্রচন্ড আবেশে মিশিয়ে নিলো ছোট্ট শরীর টাকে নিজের মাঝে।।
চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে পালকের। এ কেমন ভালো লাগা,কেমন অনুভূতি? এ অভিজ্ঞতা তার জীবনের প্রথম। হৃদয়ে অদ্ভুত ব্যাথা অনুভব করলো। আরও জোরে খামচে ধরলো, পালকের নখ বসে রক্ত বেরিয়ে এলো মেঘের বুক থেকে তার বদলে মেঘ আরও গাঢ় ভাবে জড়িয়ে নিলো। পারছে নাহ নিজের শরীরে মিশিয়ে নিতে, একচুল দূরত্ব সহ্য হচ্ছে নাহ।
~
ওড়নাটার আঁচলের সাথে রঙ বেরঙের অসংখ্য পাথর গুলো বেধেছে শিমু, এই পাথর গুলো তার ভীষণ মনে ধরেছে,এক এক করে সব রঙের ই নিয়েছে,সেগুলো নিয়ে সে ঘরে সাজিয়ে রাখবে, ভারি আঁচলটা ধরে হাটছে,হুট করে একটা পাথরে বেধে ধপ করে পরে গেলো, আঁচল ছড়িয়ে পাথর গুলো ছিটিয়ে পরলো, তাড়াহুড়ো করে উঠে এক এক করে মাটি থেকে পাথর গুলো তুলতে লাগলো শিমু, শিমুকে পরে যেতে দেখেই ধ্রুব ছুটে আসে,কিন্তু তার আগেই ও উঠে পাথর গুলো কুড়াতে শুরু করে, ধ্রুব ছুটে এসে বলে
-আপনি ঠিক আছেন? লাগেনি তো?
শিমু বিচলিত হয়ে উত্তর দেয়
-আমি একদম ঠিক আছি,কিন্তু আমার পাথর গুলো
বলেই মুখটা ছোট করে ফেলে।
ধ্রুব এমন ছেলামানুষি দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে নিজেও পাথর উঠাতে শুরু করে ওর সাথে। শিমু ধ্রুবর হাসি দেখে হা করে চেয়ে আছে, লোকটার হাসিটা এতো ভাল্লাগছে তার, হাসি হাসি মুখ করেই ধ্রুব জিগাস্যা করলো
-পাথর খুব পছন্দ?
-হ্যাঁ মানে এই রঙিন পাথর গুলো আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।
বলেই আবারও একে একে কুড়াতে লাগলো, শিমুর সাথে ধ্রুব ও তুলে ওর আঁচল ভরে দিলো। পাথর নেওয়া হতেই থ্যাংকস বলেই এক দৌড় শিমুর। ধ্রুব পেছন থেকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে,
-এটা কি হলো? পালালো কেনো?
-ভাইরে তুই থাম বইন এবার ছবি তুলা থামা, আরও মানুষে আসে তোর মতো ফকিন্নি দুইটা নাই।
নিবিড়ের কথায় আরশি ত্যানত্যান করে উঠলো
-ভাই নাহয় বইন যেকোনো একটা বল,আর তোর কি আমি ছবি তুলি আর অন্যকিছু তোর কোনো সমস্যা?
-আমারতো একটাই সমস্যা খোদা তোরে তুইল্লা নেয়না ক্যান,এমন আপদ ডারে হুদাই রাখছে দুনিয়ায়
নিবিড়ের কথায় সায় দিয়ে আদ্রিশ তাল মিলিয়ে বললো
-ধারতি কা বোঝ
-এই একদম বলেছিস,
বলেই হাহা করা শুরু করলো। এরা সবসময়ই এমন করে, ভাল্লাগেনা বলেই গাল ফুলিয়ে গিয়ে পাশের বেঞ্চিতে থপ করে বসলো আরশি। ওদের সাথে আর একটাও কথা বলবো নাহ, ভারি ব’জ্জাত সব গুলো
-মন খারাপ?
পুরুষালি কণ্ঠে পিছে তাকালো আরশি। বেঞ্চের উপর দু’হাত রেখে ভর দিয়ে ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে আরাব।
-না কিছুই নাহ।
-বললেই হবে কিছুই নাহ, এইতো কি সুন্দর হাসি হাসি ছিলে,মুখ টা এইটুখানি কেনো হলো।
বলতে বলতে আরশির পাশে এসে বসলো আরাব। আরশি হুট করেই একটা প্রশ্ন করে বসলো
-আচ্ছা আরাব ভাই, আপনি কি কারো প্রেমে পরেছেন কখনো?
আরশির এহেন প্রশ্নে আরাব কিছুকাল চুপ থেকে বললো।
-আমিও জানি নাহ
আরশি কপাল কুচকে বললো
-এটা আবার কেমন কথা হলো, আপনিও জানেন নাহ?
আরাব এক হাতে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে বললো
-বুঝলে আরশি প্রেমে পরা মানে এক্সাক্টলি কাওকে দেখলাম চেহারা ভাল্লাগলো পছন্দ হয়ে গেলো, এমনটা নয়। প্রেম তো অন্যরকম অনুভুতি। যা দুটি মানুষের মাঝে নাম না জানা সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যা মানুষের অজান্তেই হয়ে যায়, তার অজান্তেই স্বভাব পছন্দ কাজ গুলো বদলে যায়,সবকিছু নির্দিষ্ট একটা মানুষকে ঘিরে শুরু হয়। আর এমন অনুভূতি টা দুইজনে হলেই তা ভালোবাসা হয়, আর আমি ভালোবাসতে চাই। তাই যেদিন যানবো অপর মানুষটাও আমার জন্য একইরকম অনুভব করে সেদিন প্রেমে পরবো
আরাবের কথা গুলোয় আরশির মনে আনমনেই গেঁথে গেলো। সুপুষের মানসিকতা টাও এতো সুন্দর? লোকটার প্রেমে যে সে প্রতিনিয়ত হত হয়ে যাচ্ছে, এই দায়ভার কে নিবে? এই যে ঝংকার তুলা কথায় তার মনের প্রগাঢ়তা আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো তার কি হবে?
~
সকাল পেরিয়ে প্রায় দুপুর পার হয়েছে, এখন সবার রিসোর্টে ফেরার পালা, অর্ধেক বেলা এভাবে ঘুরে ঘুরে সবাই ক্লান্ত ক্ষুধা ও লেগেছে, খানিক দূরেই একটা হোটেল দেখা যাচ্ছে, দুপুরের খাবারটা সবাই সেখানেই খাবে। সবাই একসাথে নদীর পার থেকে এগোতেই ডান পাশের ভেতরের দিকটা থেকে মেঘালয় হেটে আসলো আর তার পেছন পেছন পালক। শিমু প্রথমেই আরশির কানের কাছে গিয়ে বললো
-এই আরশি, আমি এটা কি দেখছি৷ ইয়া আল্লাহ লজ্জায় মরে যাবো আমি
আরশিও ফিসফিস করে বলে
-এতো ঢঙ না করে ঝেড়ে কাঁস
শিমু চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখালো পালককে।
-পালক মেঘালয় ভাইয়ের শার্ট কেনো পরেছে আরশি?
শিমু প্রচন্ড আতংকিত একটা চেহারা করে বলে,আরশি পালকের দিকে চেয়েই বলে
-সেটা তো আমিও ভাবছি। পাখির মুখটাও তো টকটক করছে,লজ্জা একেবারে নাকের ডগায়।কিছুতো একটা ঠিক হয়েছে, চল শুনি
বলেই ছুটে গেলো দুজন,গিয়ে দুজন পালকের দুই পাশ থেকে চেপে ধরলো,পালক এমন হঠাৎ আক্র’মণে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে
-আরে আরে,কি হয়েছে, এমন ঝাপাঝাপি করছিস কেনো দুটো
-কি হয়েছে সেটা তো তুমি কইবা চান্দু, নায়িকার গায়ে নায়কের পোশাক, এ তো রাতের সিন,তোরা দিন দুপুরেই কোনো সর্ব’নাশ করলি না তো।
আরশির কথায় পালকের লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে, এই মেয়ে যা মুখে আসে বলে ফেলে,ছিহ কথার কি ধরন।
-দেখ আরু একদম ফালতু বকিস নাহ,এসব জঘন্য চিন্তা মাথায় আসে ও কি করে। তোরা যা ভাবছিস এমন টা নাহ
-তাইলে কেমন তুই ই বল আমরা শুনি
পালক বেশ গাই গুই করছে, কি দিয়ে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে নাহ, সে নিজেই তো ঠিক নেই। ঝোকের বসে জড়িয়ে তো ধরেছিলো, কিন্তু হুস আসতেই সে বুঝতে পারে কতো বড়ো সর্ব’নাশ টা সে করেছে, এক ঝটকায় সরে এসে পালিয়েছে, দৌড় এসেছে,লোকটার দিকে তাকাতেও তো তার জান যাবে এখন
এসব ভাবনার মাঝেই মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো, পালকের এমন লজ্জায় টসটসে হওয়া চেহারা টা দেখতে বেশ ভাল্লাগছে তার, পালক চোখে চোখ পরতেই তৎক্ষনাৎ মাথা নামিয়ে নিলো, নীলাভ চোখ জোড়ায় এমন ভাবে চাইলে তো সে পাগল হয়ে যাবে
.
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৯
তেজীয়ান সূর্য টা ঠিক মাথার একদম উপরে। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এসে আবহাওয়ার এই বৈরী রূপটা খুবই বিরক্তিকর। কোনো দিন গুমট ধরে মেঘ জমে থাকবে তো কোনো দিনে কড়া রোদে রাস্তা ঘাট পুড়াবে, দূর্ভাগ্যবশত আজকের দিনটাও একদম কাঠ ফাটা রোদে তপ্ত। দুপুরের রোদে ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরছি, মানে চৌধুরী ভিলায়।
সিলেট থেকে ফিরেছি দুদিন হয়েছে, মালনিছড়া চা বাগান, রাতারগুল, বিছানাকান্দি আরও আশেপাশের কিছু জায়গা ঘুরে পুরো পাঁচ দিন পর ঢাকা শহরে ফিরেছি। এসেই আবার শুরু হয়েছে যানযটে ভরা যান্ত্রিক জীবন, রোজকার পড়াশোনা আর ছুটাছুটি। এসে দুদিন সব গোছানো আর রেস্ট নিতেই কেটেছে। তিনদিনের দিন এসেছে ভার্সিটিতে। বিছানাকান্দির পানিতে ভিজে শিমুর ঠান্ডা লেগেছে তিনদিন হলো সারার নাম নেই। অসুস্থতার দরুন ভার্সিটি তে আসেনি। অলরেডি এক সপ্তাহে অনেক লেকচার মিস গেছে, ওগুলো কভার করতেই জান যাবে, তার উপর মাহফুইজ্জা তো আছেই প্যারা দেওয়ার জন্য, তাই আমি একাই এসেছি। আরশি এসে দুটো ক্লাস করেই ফিরে গেছে, ওর নাকি মন ভালো নেই। রাফাত নিবিড় আদ্রিশ খেলতে গেছে, এক সপ্তাহ ধরে ঘুরাঘুরি করলেও ওদের খেলা মিস যাওয়ায় ওদের ভীষণ আফসোস হয়েছে তাই আজকে ভার্সিটি এসেই আবার খেলতে গেছে।
তাই আসার সময় রাফাতের সাথে আসলেও একাই ফিরতে হচ্ছে। সবুজ রঙের সুতি ওড়না টাই কপালের ঘাম মুছে দ্রুত পায়ে হাটঁছি। আমার হাটাঁর মাঝেই পেছন থেকে পরিচিত একটা স্বর কর্ণগোচর হলো
-পালক?
পুরুষালি কণ্ঠে পিছে ফিরে তাকালাম। হাস্যজ্বল চেহারায় এগিয়ে এলো কালো রঙের শার্ট পরিহিত সুপুরুষ।
-কেমন আছো মিস, দুদিন পর আসার সময় হলো?
-এই আরকি,রেস্ট নিতেই দুদিন কেটে গেছে
আরাব ভাইয়ের কথায় হালকা হেসে বললাম। আরাব ভাই ভীষণ মিশুক আর ভালো মনের মানুষ তা এইকইদিনেই বুঝেছি। এখন আর উনার সাথে কথা বলতে ইতস্তত লাগে নাহ।
-শিমু আর আরশি কে তো দেখছি নাহ
-শিমুর ঠান্ডা এখনো কমেনি,আর আরশি এসেছিলো দুটো ক্লাস করেই চলে গেছে
-বেচারি, তোমার তাহলে একা ফিরতে হচ্ছে
-এই আরকি
-আমিও একাই ফিরছি, চলো একসাথেই ফেরা যাক আমার বাড়ি যেতে চৌধুরী ম্যানশন পার করাই লাগে তোমাকেও ছেড়ে দিয়ে যাবো
প্রথমে মানা করলেও আরাব ভাইয়ের জোরাজোরিতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই উঠলাম গাড়িতে। গাড়িতে রেডিও ৮৯.৬ এফএম চলছে।
-আপনারও রেডিও শোনার অভ্যাস আছে নাকি?
গাড়ি চালাতে চালাতেই উত্তর দিলো
-খুব একটা না তবে ড্রাইভিং এর সময় একটু আকটু শোনা হয়
-আমিও শুনতাম আগে রোজ। এখন আর শোনা হয়না
-তাই?
-হ্যাঁ
-বেশ মিলে কিন্তু দুজনের
বলেই হাহা করে হাসলো।উনার এমন উদ্ভট হাসিতে আমিও হেসেই দিলাম।
হাসি থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে উনি বললেন
-পালক?
হুট করে এমন ডাকে বেশ বিব্রত হলাম, বেশ কৌতূহল নিয়ে বললাম
-জ্বী?
-হোটেলে থাকতে তোমায় কিছু বলতে চেয়েছিলাম, বেশ কয়েকবার ই চেয়েছিলাম। সময় আর পরিস্থিতিতে বলে ওঠা হয়নি, তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই
উনার এমন কথায় আমারও মনে পরলো আমার উনি বেশ কয়েকবার করেই আমায় বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শোনা হয়নি।আমি মৃদু হেসে বললাম
-হ্যাঁ বলুন ভাইয়া
-তবে আমাকে প্রমিস করো, এ কথা তুমি আর আমি ছাড়া কেও জানতে পারবে নাহ
~
কালো রঙের মার্সিডিজ টা ধুলো উড়িয়ে গেইটের সামনে এসে দাড়ালো, গাড়িটা দেখা মাত্রই পান খাওয়া ফোকলা দাঁতে হেসে সালাম দিলো রামিজ আলী, কাল বিলম্ব না করেই খুলে দিলো লোহার বড়ো গেইট৷ আবারও ঝড়ের বেগে বাড়ির ফটকে ঢুকিয়ে নিলো গাড়িটা, গ্যারাজে পার্ক করেই চাবি হাতে বেরিয়ে এলো মেঘালয়। ঘাড় আর কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম, সকাল আট টার আগেই বেরিয়েছে সে বাড়ি থেকে, টানা এক সপ্তাহ শহরের বাইরে থাকার ফলে অনেক গুলো প্রজেক্ট পেন্ডিং এ পরে গেছে। সেসব একা হাতে সামলাতেই তার সময় টা কাটছে ভীষণ ব্যাস্ততায়।। দ্রুত পায়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় গেইটের দিকে চোখ যেতেই পা দুটো থামিয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু কুচকে এলো।
ধূসর বর্নের টয়োটা গাড়িটা থেকে পালক নামছে। মুখে লাগানো এক ফালি হাসি৷ গাড়ি থেকে নামতেই জানালার কাচটা নামিয়ে দিলো ভেতর থেকে, হাস্যজ্বল চেহারায় হাত উঠিয়ে বিদায় জানালো পালক। গাড়ির ভেতরের চেহারা টাও হাসি মুখে হাত দেখিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। মেঘের গায়ে যেনো কেও গরম পানি ঢেলে দিলো। মেজাজ টা কতো সেন্টিমিটার হাই হলো জানা নেই। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, মাথার রগ গুলো ফুলে উঠলো। মেয়েটাকে সে নিষেধ করা সত্ত্বেও একটা ছেলের সাথে এতো কথা,আর শুধু কি কথা একসাথে তারই গাড়িতে ফিরলো। হাসি হাসি মুখে বিদায় জানালো। সবটা দেখে মেঘের এখন রাগ টা নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাচ্ছে। দুটো দিন মেয়েটাকে সে দেখতে পারেনি কাজের চাপে,আজকের দেখা টাও এভাবেই মিললো?
ওড়না টা মাথায় ভালো করে রেখে কাধের ব্যাগ তা হাতে ধরে, দ্রুতপদে ভেতরে আসার সময় সামনে তাকিয়ে থেমে গেলাম । লোকটা গম্ভীর মুখ খানায় একটু বেশিই কাঠিন্য ছড়িয়ে রাখা। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকলাম,
লোকটা এমন ভয়ং”কর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কেনো। দুদিন পরে দেখলাম তবুও এমন করে চেয়ে আছে? উনি কি একটু ভালো করে তাকাতেও পারে না আজব। এই লোকের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যাবে নাহ,যেইরকম লুক দিছে গু’লি করে দিবে কি না সন্দেহ।
বার দুয়েক ঢক গিলে এক পা এক পা করে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো পালক। পেছনের দিকটাই সিড়ির দিকে এসে দৌড় দিতে নিলেই পেছন থেকে খপ করে হাতটা ধরে ফেললো, ভয়ার্ত চেহারায় পেছনে ফেরার সাথে সাথেই হাত টা শক্ত করে ধরে এক টান দিয়ে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে নিলো। হাতটা দেওয়ালে চেপে ধরায় আমার শখের কাচের চুড়ি গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে হাতের মধ্যে গেঁথে গেলো, যন্ত্রণায় মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো। হাত থেকে অঝোরে রক্তপাত হচ্ছে, কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই নিষ্ঠু’রতম মানুষ টার। এক হাতে আমার ডান হাতটা চেপে ধরে আরেক হাতে আমার গলা চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো
-ওই ছেলের সাথে কি হ্যাঁ, কি ওই ছেলের সাথে?
কতোবার নিষেধ করেছি, কোনো ছেলের আশে পাশেও যেনো না দেখি
জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কথা গুলো বললেন, ব্যাথায় আমার চোখ দু’টো বুজে পানি বেরিয়ে এলো। কোনো রকম তাকিয়ে দেখি নীল চোখ জোড়া টকটক করছে, রাগ দমাতে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে। এমন ভয়ংকর রাগ আমি কখনো দেখিনি কখনো নাহ,আমি ভাবতেও পারিনি সামান্য কারো সাথে বাড়ি ফেরায় উনি এতোটা রেগে যাবেন। হাতের সাথে বুকের ভেতর টাই ও রক্তক্ষরণ শুরু হলো।
আমার ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাড়ালো, ঘাড়ের পেছনে হাত টা রেখে এদিক ওদিক ঘুড়িয়ে, আবারও চিৎকার করে পাশে রাখা গাছের টব টা এক লাত্থি দিয়ে ফেলে দিলো।
ভয়ে কান দুটো চেপে ধরে রেখেছি আমি, হাত থেকে রক্ত বয়ে কনুই দিয়ে নিচে টপকে পরে আমার সবুজ রঙের জামায় কালচে ছাপ দিচ্ছে। এবার আমার উনাকে মানষিক ভারসাম্যহীন লাগছে। এতোটা রাগ? শুধু মাত্র ছোট্ট একটা ঘটনা নিয়ে এতোটা রাগ?
উনি আবারও তেড়ে এলেন আমার দিকে কানে রাখা দুহাত ছাড়িয়ে আবারও দেওয়ালে চেপে ধরলেন, যন্ত্রণায় আমার মাথা দপদপ করছে, আর্তনাদ করার শক্তি টুকুও ব্যায়হীনা।
-তুমি যানো নাহ? যানো না তুমি আমি তোমায় অন্য কারো পাশে সহ্য করতে পারিনাহ,কিছুতেই পারিনাহ। তবুও সেই কাজটাই করলে, নেক্সট টাইম আমি যদি তোমায় কারো পাশে দেখেছি, আমি কি করবো জানি নাহ
বলেই গটগট করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। দুহাতে মুখ ধরে চাপা স্বরে কেঁদে উঠলাম। উনার এমন ব্যাবহারে হাত থেকে বুকের ভেতর ব্যাথা টা বেশি হচ্ছে, কষ্ট, অভিযোগ, অভিমান সব কিছু মিলিয়ে নোনাপানিতে কপোল ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে, হাঁটু ভে’ঙে বসে পরলাম। আমার এতো কষ্ট কেনো লাগছে, যন্ত্রণা পেয়েছি বলেই কি এতোটা লাগছে নাকি যন্ত্রণা টা খুব কাছের মানুষটা দিয়েছে বলে?
কোনো রকম চোখ মুখ মুছে ওড়না টা হাতে চেপে উঠে গেলাম উপরে, হাতের যন্ত্রণা আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। উনি কি করে পারলেন এমন ব্যবহার করতে,,এতো রাগ? আমায় নিজেকে বুঝানোর একটা সুযোগ ও দিলো নাহ। বুকের ভেতর কষ্টেরা পাহাড়সম আকার ধারণ করেছে, হাজারো প্রচেষ্টায় ও দুচোখের বহমান ধারা নিবৃত্ত করতে আমি ব্যার্থ
~
ফোনের এলার্মের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বড়ো কাটা টার স্থান দশের ঘরে, ধপ করে উঠে দাড়ালো। সে এতোক্ষণ কি করে ঘুমালো? গুণে গুণে টানা পাঁচ ঘন্টা ঘুমিয়েছে মেঘ। তখন ওভাবে ছুটে ঘরে এসেই হাতের জিনিস এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে টানা এক ঘন্টা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো, বের হতেই মাথাটা কেমন ভার হয়ে আসছিলো। খাওয়া বাদেই বিছানার উপর সটান হয়ে শুয়ে পরেছিলো প্রায় বিকেলের সময় টাতে। এখন রাত দশটা, এতোক্ষণ কি করে ঘুমালো। মাথা ব্যাথা টা ছেড়ে গেলেও ভেতর টা কেমন গুমোট ধরে আছে, অশান্তি কাজ করছে। দুপুরের ঘটনা মাথায় স্পষ্ট ভেসে আছে। হুট করেই মেঘের ভীষণ খারাপ লাগা কাজ করলো, তখন ওভাবে মেয়েটার সাথে ব্যবহার করা একদম উচিত হয়নি। কিন্তু কি করবে সে নিজেকেও ঠিক রাখতে পারেনি। মেঘ নিজের একান্তই আপন জিনিস টাকে প্রিয় জিনিসটাকে কখনও অন্য কারো সাথে দেখতে পারেনা কিছুতেই নাহ।
টলমল পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। তাকে দেখেই নিলাশা চৌধুরী বললো
-এতোক্ষণে তোর ঘুম ভাঙলো মেঘ, সারা টা দিন পেটে কিছুই পরেনি, বস শিগগির। তোরা ছেলে মেয়েরা কি যে করিস একটুও নিজের খেয়াল রাখতে পারিস নাহ। একটার পর একটা ফারা লেগেই আছে
মায়ের কথায় মেঘ ভ্রু কুচকে জিগাসা করলো,
-কার কথা বলছো আম্মু?
-আরে আফুর কথা বলছি, এই তো সিলেট যাওয়ার কয়েক দিন আগেই সুস্থ হলো, আজ আবার সিড়ি বেয়ে উঠতে সমউ পরে গিয়ে হাতের চুড়ি গুলো ভেঙে কব্জি টা কে’টে একেবারে খারাপ অবস্থা। রক্তে জামাটা ভরে গেছিলো মেয়েটার।আহারে ব্যাথার মুখটা শুকিয়ে এইটুখানি হয়ে গেছে বেচারির। এতোক্ষণ ওর কাছেই তো ছিলাম।
মায়ের কথায় যেনো ভেতর টাতে বিস্ফোরণ হলো মেঘের, তড়াৎ তার দুপুরের ঘটনা মনে পরলো। রাগের চোটে তো সে মেয়েটার ক্ষ’ত টাও খেয়াল করেনি। এতোটা নি’ষ্ঠুর,পাষা’ণ কি করে হলো সে। নিজের রাগ দেখাতে গিয়ে প্রিয়তমার এতোটা আঘাতের কারণ হলো সে!
-আমি একটু পরে আসছি আম্মু,কাজ আছে
বলেই এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে গেলো চারতালার দিকে। সিড়ি বেয়ে নেমে দাঁড়ালো পালকের ঘরের সামনে। বুকের ভেতরের দ্রিমদ্রিম শব্দ আজ তাকে অপা’র্থিব যন্ত্র’ণা দিচ্ছে, ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো।
~
আকাশে টিমটিমে তারা গুলোও মেঘে ঢেকে গেছে, চাঁদ টা তো সেই কবেই মুখ লুকিয়েছে আকাশের বুকে। গুমোট একটা আবহাওয়ায় পরিবেশ টা বুদ হয়ে আছে, কোনো চঞ্চলতা নেই, প্রফুল্লতা নেই। কেমন বিষন্ন ঠেকছে চারপাশ। এইরকম পরিবেশে অন্ধকার ছাদটার রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পালক। এই গুমোট পরিবেশ টাই ভাল্লাগছে তার,যেনো তারই ভেতরের প্রতিচ্ছবিটা পরিবেশ ধারণ করেছে। ব্যাথার চোটে হাতটা টনটন করছে। পাতলা কাপড়ের আবরণে ঢাকা ক্ষ’ত টা। তার চেয়েও বড়ো ক্ষ’ত হয়েছে বুকের ভেতরে। প্রিয় মানুষের দেওয়া এক বিন্দু আঘাত ও এক আকাশ সমান পীড়া দেই আমাদের মনে,সেখানে মেঘ ওকে এতোটা কষ্ট দিলো? কোনো কিছুতেই মন টিকছিলো নাহ, তাই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে শিমুর হাজার বারণ সত্ত্বেও। কিছুটা মন খারাপে একান্ত সময় চাই, কিছু ব্যাথা মুখ চি’ড়ে বাহিরে না এসে ভেতরেই গুম’ড়ে মর’তে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে, পালকের মনের অবস্থা টাও ঠিক তেমনি।
-নূর?
এমন বিষন্ন পরিবেশে ঝংকার তোলা ডাক টা শুনে পালকের ভেতর তরঙ্গ খেলে গেলো। ডাক দেওয়া কণ্ঠস্বরের মালিক কে চিনতে তার একটুও সময় লাগেনি, তবুও ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সামনের দিকে।
আস্তে আস্তে মেঘ এগিয়ে গেলো পালকের দিকে। একদম সামনে গিয়ে দাড়িয়ে দু হাতে গালটা আগলে ধরলো। নির্জীব, বিধ্বস্ত চেহারা টা দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। শব্দগুচ্ছ গলায় আটকে গেলো, কোনো রকম ঠেলে বললো
-অভিমান টা কি অনেক বেশিই হয়েছে? ক্ষমা করা যায় না এই অধম টাকে?
মুখটা ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরালাম। প্রচন্ড বেহায়াপনা করছে মনটা,এই যে আঘাত দেওয়া লোকটার প্রতি পাহাড় সমান অভিমান হয়েছে তা এক কণ্ঠস্বরে দুম’ড়ে মুচ’ড়ে যাচ্ছে। আমি চাইনা, চাইনা ভে’ঙে যাক। আঘাত করেছেন উনি আমায়,যতোটা না বাহিরে,তার দ্বিগুণ ভেতরে কিছুতেই শুনবো নাহ আমি
-একটা বার তাকাও নূর, তোমার চাঁদ মুখ খানায় এমন বিষন্নতা আমার পু’ড়িয়ে মা’রছে। একটা বার ফিরে তাকাও। আমার ভুলের কি একটু ক্ষমা হয়না? তোমার ফিরিয়ে নেওয়া মুখ দেখার মতো এতো বড়ো শাস্তি দিও নাহ,তার বদলে হাজারো আঘাতে ক্ষ’ত বি’ক্ষত করে দাও আমি যে তোমাতে আটকে গেছি,থেমে গেছে আমার দুনিয়া। তোমার মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মতো এতো বড়ো শাস্তি দিও না তুমি আমায়
এমন ব্যকুলতা ভরা আবেদনে যতোটা না আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, তার চেয়েও বেশি আঘাত করছে আমার বক্ষপিঞ্জরে। আমায় আঘাত দেওয়া লোকটার মুখের কয়েকটা শব্দ আমার এতোক্ষণের আঘাত মিলিয়ে দিয়ে অদ্ভুত বেদনা দিচ্ছে, কেনো সেই মুখ থেকে এমন ব্যাকুলতা আমায় পুড়াচ্ছে। আমি তো ভীষণ রাগ করেছি, শুনবো নাহ কথা,দেখবো নাহ আর ওই মুখ। হাত ছাড়িয়ে সরে গেলাম। তবুও চোখ দু’টো বেইমানি করে দিলো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ দু’টো বাধ ভেঙে দিলো,বারিধারায় ভরিয়ে দিলো গাল।
মেঘ আবারও সামনে এসে দু হাতে পালকের চোখ মুছিয়ে বললো
-হুসস,, আর কাদে নাহ। আমার ভুলের শাস্তি এভাবে দিও নাহ। আমি পারিনি ঠিক রাখতে নিজেকে, তুমি আমার একান্ত সুখ নূর, আমার ভীষণ গোপন আদরে যন্তে রাখা অনুভূতি, আমার ফুল। তোমার আমি অন্য কারো পাশে দেখতে পারিনি, পারবোও নাহ। তার বদলে আমার শত’ঘাত করো তুমি। তোমার এই সুশ্রী মুখটা শুধু আমার বুকেই আবদ্ধ রাখতে চাই। ওই মিষ্টি হাসির প্রতিটি কারণ শুধু আমিই হতে চাই। খুব কি অন্যায় হবে তাতে? যদি তাই হয় তবে হবো আমি আ’সামি, করবো অন্যা’য়। তবুও চাই। এক আকাশ সমান চাই তোমাকে।
মেঘের এরূপ কথায় পালকের অব্যক্ত অনুভূতি, অভিমান,আবেগ সব বাধ ভেঙে দিলো।সমস্ত কায়া নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাচ্ছে,ছুটে যেতে লাগলেই মেঘ পেছন থেকে হাত টা চেপে ধরলো, গলা ভেঙে কেঁদে উঠলো, চোখের বর্ষনে গলা বুক ভিজিয়ে দিলো।
মেঘ দু’হাতে ঝাপটে ধরলো পালক কে, অশ্রুমাখা মুখ খানা বুকে চেপে ভিজিয়ে নিলো নিজের বক্ষস্থল প্রিয়তমার নোনাজলে।
“যেওনা নূর, একটা বার থেকে যাও কথা দিচ্ছি একটুও আঘাত পেতে দেবো নাহ,আমার ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবো তোমায়,
বলেই দুহাতে আরও চেপে মিশিয়ে নিলো বুকে। পালকের মাথায় গাঢ় একটা চুম্বন মেখে দিয়ে বললো
“ভালোবাসি নূর, অন্ধকার যেমন ভালোবাসে উজ্জ্বল নূর কে, তার চেয়েও বেশি বাসি”
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ