#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩০
তাসলিমা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। অতঃপর মৌনতা ভেঙে বললেন,
” হাঁ। এটা সত্যি যে তোকে আমি অনেক আগে থেকেই পুত্রবধূ হিসেবে ভেবে রেখেছিলাম। তাই সাজ্জাদ ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আর উনি? রাজি হয়েছিলেন। ”
বেশ অবাক হলো দুয়া! ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শাশুড়ি মায়ের দিকে। আনমনে প্রশ্ন করে বসলো,
” হঠাৎ আমাকে পুত্রবধূ হিসেবে চাইলে কেন? ”
” আমার ছেলেটার জন্য। ও যে তুই বিহীন অন্য কাউকে সঙ্গিনী হিসেবে চায় না দুয়া। শুধু তোকে চায়। ”
হতবিহ্বল হলো দুয়া! আস্তে ধীরে মামণির কোল ত্যাগ করে উঠে বসলো। মুখোমুখি দু’জনে।
” ত্ তুমি এসব কি বলছো মামণি? ”
তাসলিমা ওর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন। মমতাময়ী স্বরে বললেন,
” কিছু বলবো। মন দিয়ে শুনবি কেমন? আশা করি তোর প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও পেয়ে যাবি। বাকিটা নাহয় আমার দুষ্টু ছেলেই বলবে। ”
দুয়া মায়াবী চোখে তাকিয়ে। সবটা শুনতে উদগ্রীব। তাসলিমা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,
” তুই তো জানিস ই মা। আমি তূর্ণ’র বিয়ের জন্য কতটা আগ্রহী ছিলাম। সব মায়ের মতো আমিও চাইতাম আমার ছেলেটা বিয়ে করে সংসারী হোক। ওর একটা লাল টুকটুকে বউ হোক। এজন্য কম পাত্রী তো দেখলাম না। তুইও তো সাথে যেতিস। দেখেছিস তো সবটা। তূর্ণ কেমন করে সামান্য থেকে সামান্য খুঁত দেখিয়ে প্রতিটা পাত্রী রিজেক্ট করে দিতো। ”
দুয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
” ছেলেটা আমার ওমন বাচ্চামো করতো কারণ ওর হৃদয়ে যে অন্য কারোর বাস। ”
অন্য কারোর বাস! তিনটে মাত্র শব্দ। ছ্যাত করে উঠলো মেয়েটির কোমল হৃদয়। ছু*রিকাঘাতে ক্ষ*তবিক্ষত হলো হৃৎপিণ্ড! উত্তপ্ত হয়ে উঠলো কর্ণ গহ্বর। অজান্তেই নোনাজলে পূর্ণ হলো মায়াবী লোচন।
” আমি ওকে কত করে বলতাম বিয়ে করে নে। করে নে। কিন্তু ওর একটাই কথা। ”
____
” আমার সোনা বাবু। বিয়ে করবে না? মায়ের জন্য লাল টুকটুকে বউ আনবে না? ”
না বোধক মাথা নাড়ালো তূর্ণ। তাসলিমা দমে গেলেন। প্রশ্ন করলেন,
” কেন? ”
” আমি তো বাবু। তোমার সোনা বাবু। বাবুরা কি বিয়ে করে? ”
বাচ্চা ফেস করে জবাব দিলো তূর্ণ। ক্ষে পে গেলেন তাসলিমা। ছেলের উরুতে চাপড় মে রে বললেন,
” দুষ্টু ছেলে! মায়ের কথায় মাকেই নাস্তানাবুদ? ”
দাঁত কেলিয়ে হাসলো তূর্ণ। এবার প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন তাসলিমা।
” তুই কি সত্যিই কখনো বিয়ে করবি না? ”
” আপাতত না। ”
তাসলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হঠাৎ উনি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলেন। আকস্মিক বো*মা ফা*টালেন কক্ষে।
” দুয়াকেও না? ”
তূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সহসা কর্ণ কুহরে পৌঁছালো মায়ের সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন। অবাক চাহনিতে মায়ের দিকে তাকালো।
” কি বাবুসোনা? দুয়াকেও বিয়ে করবে না? রিজেক্ট করবে? ”
বিস্ময়ে অভিভূত তূর্ণ কিছু বলতে চাইছে। খুব করে মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছে। কিন্তু অবরুদ্ধ কণ্ঠনালী। শব্দমালা বের হচ্ছেই না। বরং আঁটকে পড়েছে পুরোদমে। বারকয়েক শুকনো ঢোক গিললো মানুষটি। তাসলিমা ছেলের অবস্থা আন্দাজ করতে পারলেন। খুশির আভা ছড়িয়ে পড়লো ওনার মুখশ্রীতে। মনে মনে ভাবলেন উনি ভুল নয়। একদম সঠিক। তূর্ণ’র হৃদয়ে বাস দুয়া’র। তাই তো এত ছলাকলা! তাসলিমা মুচকি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
” আমি সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে কথা বলছি। ওনার পুতুল মেয়েকে চাইবো। আমার এই বাবু সোনার জন্য। ”
খুশিতে ভরে উঠল তনুমন। তূর্ণ কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। নীরবে আঁকড়ে ধরলো মা’কে। বিপরীতে তাসলিমাও আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলেন ছেলেকে। টের পেলেন ওনার কাঁধে তপ্ত জলের অস্তিত্ব। মায়ের অধর কোণ প্রসারিত হলো। আলতো করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। স্নেহাতুর স্বরে বলে উঠলেন,
” আমার আব্বা। ”
_____
পুরনো কথা মনে পড়ায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন তাসলিমা। চোখে পানি অধর কোণে হাসি।
” সেদিন আমার ছেলেটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল! আমি ভাবতেও পারিনি তূর্ণর হৃদয়ে তুই এতটা গাঢ় ভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিস। আমি এমনই এক মা কখনো অনুধাবন করতেই পারিনি আমার ছেলেটার হৃদয়ে তোকে নিয়ে লুকানো অনুভূতি আছে। যখন জানতে পারলাম তখন ইতিমধ্যে অনেকটাই দেরী হয়ে। তাই তো আমি আর দেরি করলাম না। দ্রুত সাজ্জাদ ভাইয়ের কাছে তোর হাত চাইলাম। প্রস্তাব বিবেচনা করে উনিও রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের ভাবনা ছিল তুই তৃতীয় বর্ষে উঠলে কিংবা অনার্স শেষ হওয়ার আগে আগে বিয়েটা হবে। তোর পড়াশোনায় যাতে কোনোরূপ ব্যাঘাত না ঘটে। কিন্তু তার আগেই তো… ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাসলিমা তাকালেন দুয়া’র পানে। মেয়েটার চোখেমুখে এখনো বিস্ময়ের ছাপ। নেত্র গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু অশ্রু। উনি মুচকি হেসে মেয়েটাকে বুকে টেনে নিলেন। ললাটে চুমু এঁকে মিহি স্বরে বললেন,
” আমার তূর্ণ’র পুতুল বউ। ”
নেত্রপল্লব বদ্ধ হলো মেয়েটির। চোখেমুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির আভা। র’ক্তিম হলো কপোলদ্বয়। কানে ভেসে আসছে ‘ তূর্ণর পুতুল বউ ‘ বাক্যটি। আহা! সে কি সুমধুর সম্বোধন! হৃদয়ে গেঁথে গেল বুঝি!
•
নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত রজনী। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে দুয়া। নিমীলিত তার আঁখি পল্লব। ভাবনায় মশগুল হৃদয়। মস্তিষ্কে এখনো ভাসমান মামণির কথাগুলো। ওর কোমল হৃদয়ে ওই কথোপকথন যে কতটা প্রভাব ফেলেছে সে বোঝাতে ব্যর্থ। বারবার নেত্র পর্দায় হাজির হচ্ছে দুষ্টু লোকটি। অধরে তার বক্র হাসির রেখা। চক্ষু দিয়েই যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে তনুমন। লাজে রাঙা মেয়েটির ভাবনায় হঠাৎ ছেদ পড়লো। এক প্রকার আঁতকে উঠলো মেয়েটি। চক্ষু মেলে তাকাতেই দেখা মিললো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষটি ঠাঁই নিয়েছে ওর কোলে। শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দু হাতে আবদ্ধ কটিদেশ। মুখ গুঁজে রাখা উদরের কোমল আবরণে। মেয়েটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে তরঙ্গ বয়ে গেল। কিছু বলতে উদ্যত হতেই শোনা গেল পুরুষালি মিনতি মাখা ভরাট স্বর,
” খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মাইরা। একটু হাত বুলিয়ে দেবে? ”
এমন মিনতি মাখা স্বর মেয়েটির হৃদয় অবধি ছুঁয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় হাতটি বাড়িয়ে দিলো। লালচে মসৃণ চুলের ভাঁজে গলিয়ে দিলো চিকন আঙ্গুলগুলো। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চুলের ফাঁকে ফাঁকে মাথার তালু স্পর্শ করছিল আঙ্গুল। আরাম পেয়ে মানুষটি আরেকটু ঘনিষ্ট হলো। উদরের কেন্দ্রস্থলে মুখ লুকিয়ে চক্ষু মুদিত করলো। শিউরে উঠলো মেয়েটির কায়া। হাতটি থেমে গেল ক্ষণিকের জন্য। পরক্ষণেই চালনা করতে লাগলো আঙ্গুল। মানুষটি যে তার একান্ত আপনজন। তার সমস্ত সুখদুঃখ হাসি কান্নায় সে-ও যে সম ভাগীদার। দু’জনে তো একে অপরের পরিপূরক। একের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে অন্যজন। সে থেমে গেলে চলবে কি করে? মানুষটি যে মানসিক স্বস্তির জন্য ওরই সান্নিধ্য আশা করছে। সে কি করে ফিরিয়ে দেবে? এ যে তার জন্য অসম্ভব, অকল্পনীয়! খানিক বাদে দুয়া অনুভব করতে পারলো ঘন শ্বাস প্রশ্বাস। আরাম পেয়ে মানুষটি ঘুমিয়ে পড়েছে। মুচকি হাসলো দুয়া। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মাথাটা একটুখানি ঝুঁকিয়ে নিলো। অধর ঠেকালো অর্ধাঙ্গের কর্ণ কুহরে। ফিসফিসিয়ে শুধালো,
” সত্যিই কি তোমার হৃদয়ে লুকানো প্রেম আমি? ”
জবাব এলো না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষ জবাব দেবে কি করে? জবাব মিললো না। তবুও তুষ্ট মেয়েটি। আলতো করে স্বামীর চুলের ভাঁজে চুমু এঁকে দিলো। চোখেমুখে ফুটে উঠলো লজ্জালু আভা।
•
আদিত্যর কিরণে উজ্জ্বল বসুধা। লিভিং রুমে উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। সকালের চা নাস্তা সেরে নিচ্ছে। নিজাম সাহেব চায়ের কাপে চুমুক বসালেন। ছেলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ডেকে উঠলেন,
” তূর্ণ? ”
কফির মগে সিপ বসিয়ে তূর্ণ তাকালো বাবার দিকে। হাতে তার ম্যাগাজিন।
” বলো আব্বু। ”
” বিয়ের কতদিন হলো তোমাদের বাবা? ”
অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে তূর্ণ দুয়া সহ সবাই একটু অবাক হলো বটে। তূর্ণ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” মানে? ”
” মানে মানে ছাড়ো। বলো যে বিয়ের কতদিন হয়েছে? ”
” এই কিছুদিন আগে ছয়মাস হলো। ”
নিজাম সাহেব মাথা নাড়লেন।
” হুম। ছয় মাস। তা বিয়ের পর বউকে নিয়ে এখন অবধি কোথাও গেছো? ”
তূর্ণ যারপরানাই অবাক হচ্ছে বাবার প্রশ্নের ধরন দেখে। তৃষা ফট করে বলে বসলো,
” আব্বু ওরা কোথাও যায়নি এখন অবধি। শুধু খালামণির বাসায় মাঝেমধ্যে গেছে। ”
নিজাম সাহেব অসন্তোষ প্রকাশ করলেন।
” সে-ই তো। মাস্টার মশাই। রষকষহীন। নতুন নতুন বিয়ের পর কি কি করণীয় কিছু জানে কি? ”
খুকখুক করে কাশতে লাগলো তূর্ণ। হাতে থাকা ম্যাগাজিন পড়ে গেল কোলে। পাশে বসে থাকা দুয়া বিস্ময় কাটিয়ে স্বামীর পিঠে হাত বুলাতে লাগলো। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো তূর্ণ। নিজাম সাহেব চোখ কুঁচকে বিড়বিড় করে উঠলেন,
” অপদার্থ। ”
তূর্ণ কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বললো,
” আমি রষকষহীন? ”
” তা নয়তো কি? বিয়ের ছয়মাস পাড় হয়ে গেছে। ক’দিন পর বছর হয়ে যাবে। ছেলে আমার এখন অবধি হানিমুনের ‘ হ ‘ অবধি গেল না। ”
এবার কাশতে লাগলো দুয়া। তূর্ণ ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
” তুমি কি আমাদের ইনডাইরেক্টলি হানিমুন যেতে বলছো? ”
আনোয়ারা বেগম এবং নাজমুল সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তাসলিমা তো গরম চোখে স্বামী সন্তানের দিকে তাকিয়ে।
” ইনডিরেক্টলি না বাছা। ডিরেক্টলি বলছি। এখনো ইনডাইরেক্টলি বললে বছর পেরিয়ে যাবে। তোমার হানিমুন আর যাওয়া লাগবে না। ”
তূর্ণ দুয়ার পিঠ হতে হাত সরিয়ে নিলো। তাসলিমা স্বামীকে কড়া কণ্ঠে বললেন,
” তোমরা থামবে? সবার সামনে এসব কি বলছো? ”
” আম্মু আমাদের বলতে দাও। আমরা কি ব্যাংক ডা*কাতির প্লান করছি যে চুপিচুপি বলতে হবে? ”
বাবার দিকে তাকিয়ে,
” হাঁ আব্বু তুমি বলো। সকাল সকাল কি চাইছো তুমি? ”
” তোমাদের হানিমুন পাঠাতে চাইছি। ”
নিজাম সাহেবের সরল স্বীকারোক্তি। তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালো তূর্ণ।
” সম্ভব নয়। ভার্সিটিতে ক্লাস আছে। ”
তৃষা ফোঁড়ন কেটে বললো,
” আগামী সপ্তাহ থেকে বন্ধ আছে তো। দুই সপ্তাহ। ”
নিজাম সাহেব গদগদ কন্ঠে বললেন,
” সেটাই কাজে লাগাও। আমি টিকেট বুক করে ফেলেছি। আগামী সপ্তাহে ফ্লাইট। গুছগাছ শুরু করে দাও। এক সপ্তাহ ঘুরেফিরে তারপর ফিরবে। এর আগে নয়। ”
দুয়া অবাক চাহনিতে তাকিয়ে একটাই প্রশ্ন করলো,
” কোথায় যাবো বাবা? ”
নিশি উৎফুল্ল হয়ে শুধালো,
” হাঁ চাচু বলো না। ভাইয়া দুয়া ওরা কোথায় যাবে? ”
নিজাম সাহেব ভাব নিয়ে বললেন,
” ওয়েলকাম টু সুইজারল্যান্ড। ”
চরম আশ্চর্যান্বিত হলো সকলে! তৃষা খুশিতে আত্মহারা হলো।
” ওয়াও! সুইজারল্যান্ড! অসাম আব্বু। একদম ফাটাফাটি জায়গা চুজ করেছো। ইশ্! ওদের হানিমুন না হলে আমিও সাথে যেতাম। আহা রে! ”
সবার মাঝে টেকা দায় হয়ে পড়লো দুয়া’র। লাজুক মেয়েটি তড়িঘড়ি করে সেথা হতে প্রস্থান করলো। সেদিকে তাকিয়ে নিশি হেসে উঠলো।
” দুয়া ভাবি লজ্জা পেয়েছে। ”
তাসলিমা বললেন,
” পাবে না? ও কি শ্বশুর-জামাইয়ের মতো নির্লজ্জ? ”
নিজাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন,
” আমি নির্লজ্জ? ”
” নাহলে কি? এখানে মা আছে। তোমার ভাই আছে। সবার সামনে কিভাবে….! ইশ্। ”
তূর্ণ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। কফির মগে শেষ সিপ বসিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
” আব্বু কিন্তু সত্যিই নির্লজ্জ আম্মু। আমরা দুই ভাইবোন তার সর্বোত্তম উদাহরণ। ”
তাসলিমা হতবিহ্বল! নিজাম সাহেব দাঁত কেলিয়ে হাসলেন। ছেলের দিকে তাকাতেই উনি অবাক! তূর্ণ চোখ টিপে দিলো বাবাকে। ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বললো,
” থ্যাংক ইউ। ”
প্রস্থান করলো তূর্ণ। নিজাম সাহেব বিড়বিড় করতে লাগলেন,
” বদ ছেলে! হানিমুন যাবে না বলে ভাব নিচ্ছিল। অথচ তলে তলে ঠিকই মনে লাড্ডু ফুটেছে। বাপকে আবার চুপিচুপি থ্যাংকস জানাচ্ছে! ”
•
” কি রে পুতলা? হানিমুন যাওয়ার খুশিতে মনে লাড্ডু ফুটেছে? এখনই ‘লেটস্ নাচো’ শুরু করে দিয়েছিস? ”
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩১
” কি রে পুতলা? হানিমুন যাওয়ার খুশিতে মনে লাড্ডু ফুটেছে? এখনই লেটস্ নাচো শুরু করে দিয়েছিস?”
তূর্ণ’র কণ্ঠে হাস্যরসাত্মক ভাব। মুহুর্তের মধ্যেই খুশিতে আত্মহারা মেয়েটি লাজুকলতার ন্যায় মিইয়ে গেল।
.
লিভিংরুম হতে ছুটে কক্ষে প্রবেশ করলো দুয়া। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে।
” ইশ্ কি লজ্জা! বাবা ছেলে দু’জনে মিলে আমায় লাজেই মে রে দেবে! ”
লাজুক হাসলো মেয়েটি। খুশি খুশি বসলো টাফটেড বেঞ্চে। মুখখানি দু হাতের আঁজলায় ভরে একাকী বিড়বিড় করতে লাগলো,
” সুইজারল্যান্ড! সত্যিই আমরা সুইজারল্যান্ড যাবো? আল্লাহ্! আমি তো ভাবতেই পারছি না। গা শিরশির করে উঠছে। জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ তা-ও ওই মানুষটির সঙ্গে। ”
তপ্ত হলো কপোল। লাজুক হেসে উঠে দাঁড়ালো দুয়া।
” উম্! হাতে মাত্র এক সপ্তাহ আছে। কত গুছগাছ করতে হবে। সবার আগে শপিংয়ে যাওয়া দরকার। গরম পোশাক কিনতে হবে কতগুলো। হুম। ”
মেয়েটি নিজস্ব ভাবনায় মশগুল। একাকী হাঁটতে হাঁটতে হাত নাড়িয়ে কত কি বলে চলেছে। কক্ষের দ্বারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। বুকের কাছে ভাঁজ করা দু’টো হাত। চোখেমুখে তৃপ্তিময় ঝলক। বিমোহিত দৃষ্টি নিবদ্ধ তার মাইরা’তে! আস্তে করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ধীরপায়ে অগ্রসর হতে লাগলো দুয়া’র পানে। দুয়া তো টেরও পায়নি পেছনে কার অবস্থান! তূর্ণ এসে দাঁড়ালো পেছনে। খুব সন্নিকটে। কর্ণ কুহরে অধর ঠেকিয়ে দুষ্টু কিন্তু হাস্কি কণ্ঠে বলে উঠলো,
” কি রে পুতলা? হানিমুন যাওয়ার খুশিতে মনে লাড্ডু ফুটেছে? এখনই লেটস্ নাচো শুরু করে দিয়েছিস?”
কর্ণ কুহরে তপ্ত শ্বাসের বহর। সঙ্গে একান্ত মানুষটির কণ্ঠস্বর। মুহুর্তের মধ্যেই খুশিতে আত্মহারা মেয়েটি লাজুকলতার ন্যায় মিইয়ে গেল। অবনত হলো মুখশ্রী। লালাভ আভা ছড়িয়ে পড়া মুখপানে তাকিয়ে মুগ্ধ হলো তূর্ণ। আরেকটু সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
” হানিমুনে যাচ্ছি বিবিজান। ওখানে শুধু ঘোরাঘুরি নয়। এইটিন প্লাস অনেক কিছুই ঘটতে পারে। সো বি প্রিপেয়ার্ড। হুম? ”
কর্ণ পাতায় অধরের ছোঁয়া অনুভূত হতেই আবেশে মেয়েটার আঁখি যুগল মুদিত হলো। বক্র হেসে সরে গেল তূর্ণ। তার অনুপস্থিতি অনুভব করেই মেয়েটি ধীরে ধীরে নেত্রপল্লব মেলে তাকালো। র’ক্তিমা রূপে লাগছে অপরূপা! দু হাতের অন্তরালে লাজুক মুখখানি লুকিয়ে ফেললো দুয়া। ইশ্! বেলাজ পুরুষ!
•
সুইজারল্যান্ড ট্রিপের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। শপিংয়ে ব্যস্ত দুয়া। সঙ্গ দিচ্ছে তানজিনা, তৃষা এবং নিশি। বোনের জন্য সেরা পোশাক নির্বাচনে ব্যস্ত তানজিনা। কতগুলো গরম পোশাক কিনে দিলো। সুইজারল্যান্ডের আবহাওয়া বড় শীতল কিনা! ওদিকে তূর্ণ একদিন সময় করে শপিংয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল নিশাদ এবং রাজীব। দুই বন্ধু ওকে কম জ্বালাতন করেনি। দুষ্টু দুষ্টু কথায় জর্জরিত করে ফেলেছিল। আর তূর্ণ? সে-ও কম নয়। দুষ্টু এক বাক্যেই বন্ধুদের বোল্ড আউট! এভাবেই গুছগাছ করতে করতে সময় ঘনিয়ে এলো।
সকাল থেকেই ব্যস্ত ‘ ছায়াবিথী ‘. আজ রাত নয়টা বেজে পনেরো মিনিটে তূর্ণ দুয়া’র ফ্লাইট। কাতার এয়ারওয়ে এর মাধ্যমে ওরা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। দুয়া’র পরিবারের সদস্যরা দুপুর হতে না হতেই এ বাড়িতে চলে এসেছে। যদিওবা সাজ্জাদ সাহেব অনুপস্থিত। নিজ কর্মে ব্যস্ত। দুই মা মিলে দুয়া’কে কত কি পরামর্শ দিলো! প্রথমবার বিদেশ সফর কিনা? তূর্ণ তো ইতোপূর্বে কয়েকবার গিয়েছে। তাই ওকে নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু এই পুঁচকে চঞ্চল মেয়েকে নিয়েই যত রাজ্যের চিন্তা দুই মায়ের। তাই তো দু’জনে মিলেমিশে বলে চলেছে,
” ওখানে শীত বেশি। বাইরে গেলে অবশ্যই গরম কাপড় পড়বি। ”
” তূর্ণ’কে ছাড়া একা একা বাইরে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাববে না। সবসময় ওর সাথে সাথে থাকবে। ”
” বাহিরের খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবি।”
” রাতের বেলা ওখানে নাকি খুব শীত পড়ে। তাই রাতে তেমন একটা বের হবে না। ”
” ওখানে পৌঁছেই আমাদের কল করবি। কল করলে যেন সাথে সাথে পাই। নাহলে দুশ্চিন্তা হবে। মনে থাকবে তো? ”
আরো কত কি পরামর্শ। দুয়া হেসে উঠলো। দুই মা’কে আলিঙ্গন করে আশ্বস্ত করলো। অবশেষে তারা শান্ত হলো।
.
তমসায় আচ্ছাদিত রজনী। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তূর্ণ এবং দুয়া। পরিবারের সদস্যরা বিদায় জানালো ওদেরকে। তাসলিমা পুত্র এবং পুত্রবধূর ললাটে চুমু এঁকে দিলেন। দোয়া করলেন ওদের সুস্থতা এবং নিরাপত্তার জন্য। দুয়া মা বাবার কাছে গেল। তাদের আলিঙ্গন করে বিদায় নিলো। সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তূর্ণ ও দুয়া ধীরে ধীরে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলো। তৃষা, নিশি এবং ছোট্ট জাহিন ওদের আলিঙ্গন করলো। এবার বিদায়ের পালা। ধীরে ধীরে সকলের চোখের আড়াল হলো তূর্ণ, দুয়া। ছোট্ট জাহিন হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রিয় ছোটাপু আর তূর্ণ ভাইয়া’কে।
.
বিমানবন্দরে সকল ফর্মালিটিজ সমাপ্ত করে দু’জনে পা বাড়ালো বিমানের দিকে। নিজস্ব ফ্লাইট অনুযায়ী ওরা প্রবেশ করলো প্লেনে। দুয়া কৌতুহলী নজরে সবটা অবলোকন করে চলেছে। গেঁথে রাখছে স্মৃতির পাতায়।
পাশাপাশি সিট তূর্ণ, দুয়া’র। দুয়া বসলো জানালার পাশে। তূর্ণ মোবাইল হাতে নিয়ে বাবাকে কল করলো। জানিয়ে দিলো ওরা প্লেনে উঠে পড়েছে। অতঃপর সালাম দিয়ে কল কেটে দিলো। বন্ধ করে ফেললো মোবাইল।
দুয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে রাতের শহরে। আঁধারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও সে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ বাদেই উড্ডয়ন করবে বিমান। প্রথমবারের মতো আকাশপথে ভ্রমণ। ভাবতেই শিহরিত হচ্ছে হৃদয়। তূর্ণ বাম পাশে বসে থাকা সঙ্গিনীর দিকে তাকালো।
” আর ইউ ওকে? ”
দুয়া জানালা হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তূর্ণ’র পানে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। তাতেই জবাব খুঁজে পেল তূর্ণ। ওর হাতে হাত রেখে বললো,
” ডোন্ট বি নার্ভাস। ওকে? প্রথমবার তো। একটু অস্বস্তি হতে পারে। তবে আমি আছি তো। ভয় পেয়ো না। ”
দুয়া বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে স্বামীর হাতে হাত রাখলো। চোখের ইশারায় সম্মতি পোষণ করলো। বিনিময়ে মৃদু হাসলো তূর্ণ। খানিক বাদে বিমানবালা এলো। উপস্থিত সকল যাত্রীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ সকল নির্দেশনা পেশ করলো। মনোযোগ সহকারে তা শুনতে লাগলো দুয়া। সে-ই ফাঁকে তূর্ণ নিজেকে সিটবেল্ট বন্দি করে নিলো। অতঃপর বন্দিনী করলো তার মাইরা’কে। হঠাৎ ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটার। নিজের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো তূর্ণ সিটবেল্ট বেঁধে দিয়েছে।
” থ্যাংকস। ”
থ্যাংকস গ্রহণ করলো না তূর্ণ। বরং ওর দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে গেল। ফিসফিসিয়ে বললো,
” আমার যে থ্যাংকস চাই না। ”
” মানে? ”
” অন্য কিছু চাই। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কিসের থ্যাংকস? হবে শুধু লেনাদেনা। ”
দুয়া ঠিক বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে। বক্র হাসলো তূর্ণ। নিম্ন অধর কা’মড়ে হাস্কি স্বরে বললো,
” কিসের লেনদেন বুঝলে না তো? বিদেশের মাটিতে হাতেকলমে বুঝিয়ে দেবো। হ্যাভ প্যাশেন্স। ওকে? ”
তূর্ণ চোখ টিপে দিতেই হকচকিয়ে গেল মেয়েটি। তড়িৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নিঃশব্দে হাসলো তূর্ণ।
নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। নির্ধারিত সময়ে উড্ডয়ন করলো কাতার এয়ারওয়ে এর বিমানটি। প্রথমবারের মতো ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ভীত মেয়েটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো অর্ধাঙ্গের হাতটি। আঁখি পল্লব বন্ধ করে স্মরণ করতে লাগলো মহান স্রষ্টাকে। তূর্ণ ওর হাতের ওপর হাতটি রেখে ভরসা জোগালো। বুঝিয়ে দিলো পাশে রয়েছে সে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো দুয়া। এবার নিজস্ব কৌতুহল মেটাতে লাগলো। উপভোগ করতে লাগলো বিমান যাত্রা।
•
দিবাকরের আলোয় আলোকিত ধরিত্রী। ঘড়িতে তখন বাংলাদেশের সময় সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট। জুরিখ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো বিমানটি। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে টার্মিনালে উপস্থিত হলো তূর্ণ, দুয়া। তূর্ণ’র বাঁ হাতে ভারী লাগেজ। ডান হাতের মুঠোয় বন্দি সঙ্গিনীর কোমল হাতটি। দুয়া’র হাতে ছোট একটি লাগেজ। পড়নে তাদের শীতের পোশাক। বিমানবন্দরে সমস্ত ফর্মালিটিজ পূরণ করে দুজনে বেরিয়ে এলো। সুইজারল্যান্ডের মাটিতে দেহে মাখলো মিঠি রৌদ্র।
বিমানবন্দরের বাহিরে উপস্থিত বেশকিছু ট্যাক্সি। তূর্ণ একটি ট্যাক্সি বুক করলো। চালক এবং সে মিলে ট্যাক্সিতে লাগেজ তুললো। অতঃপর বললো রেলস্টেশনে যেতে। চালু হলো ট্যাক্সি। বিমানবন্দর এলাকা ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো ট্যাক্সিটি। দুয়া উপভোগ করতে লাগলো জুরিখের সৌন্দর্য। জুরিখ বিমানবন্দর থেকে ট্রেন স্টেশন যেতে মাত্র দশ মিনিট সময় লাগে। ক্ষণিকের যাত্রা শেষে তূর্ণ এবং দুয়া পৌঁছে গেল ট্রেন স্টেশনে। বৃহৎ জায়গা নিয়ে অবস্থিত স্টেশনটি। সংলগ্নে রয়েছে শপিংমল। রেস্টুরেন্ট। তূর্ণ দুয়া আপাতত কিছু খেলো না। একবারে রিসোর্টে পৌঁছে তবেই খাবে।
সেন্ট্রাল স্টেশনের ট্রেনগুলো আরামদায়ক এবং যাত্রীদের লাগেজ রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা আছে। তারা সকাল পাঁচ টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতি পাঁচ থেকে দশ মিনিটে চলে। জুরিখ সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রেনগুলি সকাল চারটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হতে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে।
জুরিখ সেন্ট্রাল স্টেশনের একমুখী টিকিটের দাম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাত ইউরো। যদি আগে থেকে জুরিখ কার্ড বা সুইস ট্র্যাভেল পাস কেনা থাকে, তাহলে জুরিখ বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে কোনো খরচ ছাড়াই শহরে যাওয়া যাবে। তূর্ণ’র কাছে সুইস ট্রাভেল পাস রয়েছে। তাই ওরা বিনামূল্যে রেল ভ্রমণ করতে পারলো।
.
জুরিখ সিটি সেন্টার থেকে ৩.৮ কিমি ( 2.2 মাইল ) দূরে অবস্থিত, ফাইভ জুরিখ হলো একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট- উইডিকন জেলা, শহরের সীমানায়। এটি তাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা যারা ব্যবসা এবং অবকাশ মিশ্রিত করতে চান। কারণ এটিতে দুটি সুইমিং পুল (একটি আউটডোর), একটি ফিটনেস সেন্টার, পাশাপাশি একটি হট টব এবং অন্যান্য ব্যবস্থা রয়েছে৷ এটি বিনামূল্যে বাইকও অফার করে।
রিসোর্টের একটি আধুনিক এবং ট্রেন্ডি সাজসজ্জা আছে। কক্ষগুলো প্রশস্ত এবং খুব আড়ম্বরপূর্ণ। বিশালাকার রিসোর্টটি একটি সবুজাভ এলাকা দ্বারা বেষ্টিত। বিশাল জায়গা নিয়ে অবস্থিত ফাইভ জুরিখ হোটেল। হোটেলের সামনে অবস্থিত নীলাভ জলের বিশাল সম্ভার। একটি লম্বা আকৃতির বড় সুইমিংপুল। সুইমিংপুলের এক পাশে হোটেল অবস্থিত। অপর পাশে সবুজ গাছপালার বিশাল সমারোহ। অভূতপূর্ব সে দৃশ্য!
তূর্ণ রিসিপশনের সমস্ত ফর্মালিটিজ সমাপ্ত করে নিলো। অতঃপর দুয়া’র হাত ধরে অগ্রসর হলো তাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষের পানে।
কক্ষের দ্বার উন্মুক্ত করে ভেতরে প্রবেশ করলো তূর্ণ। পিছু পিছু দুয়া। একজন হোটেল বয় এসে ওদের লাগেজ পৌঁছে দিলো। বিলাসবহুল কক্ষটি দেখে মুগ্ধ হলো দুয়া! ছোট লাগেজটি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করালো। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো তাদের কক্ষটি।
কক্ষের মাঝ বরাবর দেয়াল ঘেঁষে মাস্টার বেড। বেডের দুই পাশে সরু ড্রেসিং টেবিল। ডান পাশে কিঞ্চিৎ দূরত্বে অবস্থিত বিশালাকার কাবার্ড। বাম পাশে প্রশস্ত স্লাইডিং ডোর। ডোরের অপর প্রান্তে উন্মুক্ত বেলকনি। সেথা হতে দৃশ্যমান পাহাড়ি দৃশ্য। রিসোর্টের আকর্ষণীয় দৃশ্য বিশেষ। স্লাইডিং ডোরের ডান পাশে লম্বা সোফাসেট। নীলাভ তার গাত্র। সামনে ছোট্ট গোলাকার কাঁচের টি টেবিল। এছাড়াও রয়েছে আধুনিক সকল ব্যবস্থা। কক্ষটি দুয়া’র খুব পছন্দ হলো। সে পড়নে থাকা শীতের পোশাক খুলে ফেললো। সোফার ওপরে পোশাকটি রেখে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে গেল বেলকনিতে। স্লাইডিং ডোর খুলতেই উন্মোচিত হলো বেলকনি। দুয়া খুশি খুশি এগিয়ে গেল। কোমর অবধি অবস্থিত রেলিংয়ে হাত রেখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো পাহাড়ি সৌন্দর্যে। বিমোহিত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো অগণিত সময়। দেহে মেখে নিলো ভিনদেশী পবন।
তূর্ণ বিছানায় বসে মোবাইলের পাওয়ার অন করলো। ডাটা চালু করে প্রবেশ করলো হোয়াটসঅ্যাপ। বাবা অনলাইনে রয়েছে। সে কল করলো। খানিকের মধ্যেই কল রিসিভ করলেন নিজাম সাহেব।
” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম আব্বু। তূর্ণ বলছি। ”
” হাঁ তূর্ণ। তোরা পৌঁছে গেছিস বাবা? ” নিজাম সাহেব উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন।
তূর্ণ তাকে আশ্বস্ত করতে বললো, ” হাঁ আব্বু। এই কিছুক্ষণ আগে রিসোর্টে চেক ইন করলাম। ”
নিজাম সাহেব শুকরিয়া আদায় করলেন।
” আলহামদুলিল্লাহ্। পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ”
” না আব্বু। আমরা আল্লাহ্’র রহমতে ঠিক ভাবেই পৌঁছেছি। কোনো অসুবিধা হয়নি। ”
” যাক বাবা। তোর মা তো চিন্তায় চিন্তায় দিশেহারা। ”
” আম্মু কোথায়? ”
” কিচেনে। ডেকে দেবো? ”
” না থাক। ফ্রেশ হয়ে পরে কথা বলবো। ”
” আচ্ছা। তা আমার দুয়া মামণি কোথায়? ”
বেলকনিতে থাকা বিমুগ্ধ রমণীর পানে তাকিয়ে তূর্ণ মুচকি হাসলো।
” সে বেলকনিতে। সুইসের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। ”
নিজাম সাহেব হাসলেন।
” আচ্ছা ঠিক আছে। তোরা তাহলে ফ্রেশ হয়ে নে। একটু ঘুম দে। বেটার লাগবে। আমরা পরে যোগাযোগ করবো। ”
” ঠিক আছে। আল্লাহ্’র রহমতে ভালো থেকো আব্বু। আম্মুকে বলো আমরা পৌঁছে গেছি। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা যেন না করে। ”
” ঠিক আছে আমার বাপ। তোরাও ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস। ”
” হুম। আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো দুই প্রান্তের। বড় শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো তূর্ণ। মোবাইল পড়ে রয়েছে বিছানায়। লাগেজ এনে তা উন্মুক্ত করলো। নিজের জন্য পোশাক এবং তোয়ালে বের করলো। লাগেজ লাগাতে লাগাতে উঁচু স্বরে দুয়া’কে বললো,
” আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি দুয়া। ”
দুয়া শুনলো কি? সে তো ব্যস্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
চলবে.#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩২
উন্মুক্ত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দুয়া। গাত্রে ছুঁয়ে যাচ্ছে শীতল পবন। ঠাণ্ডায় হিম হয়ে আসছে সারা কায়া। তবুও মেয়েটি নড়লো না। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সম্মুখে। পাহাড়ের কোলে। দূর হতে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের অবয়ব। নীলাভ সে অবয়বের নিম্ন দিকে সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে জনপদ। অসংখ্য ঘরবাড়ি। এত কাছ থেকে পাহাড় দেখতে পেয়ে বিমোহিত দুয়া! চক্ষু ফেরাতে ব্যর্থ। হঠাৎ তার মুগ্ধতায় ব্যাঘাত ঘটলো। কাঁধে পেল শীতলতম পুরুষালি স্পর্শ। এতক্ষণে বুঝি শীতের প্রকোপ অনুভূত হলো। শিরশির করে উঠলো দেহ। তড়িৎ পিছু ঘুরে তাকালো সে। তূর্ণ দাঁড়িয়ে। গোসল সেরে এখানে হাজির। সদ্য স্নাত একান্ত মানুষটির নৈকট্যে নাসিকা গ্ৰন্থিতে প্রবেশ করছে মা`তাল করা সুবাস! পড়নে তার হালকা সবুজাভ ফুল স্লিভ গ্ৰাফিক প্রিন্ট সোয়েট শার্ট। ভেজা চুলে চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। গৌর মুখশ্রী দেখাচ্ছে আরো শুভ্র-সতেজ! স্নিগ্ধতা বিরাজমান রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের ওপর কাবু হারিয়ে ফেলছে মেয়েটি। নিভু নিভু করছে মায়াময় আঁখি জোড়া। ক্রমবর্ধমান ধুকপুকানি শ্রবণ হচ্ছে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে। হঠাৎ ছ’লকে উঠলো হৃৎপিণ্ড। ওর বাঁ কপোলে শীতল হাতটি রেখেছে তূর্ণ। নয়নে নয়ন মিলিয়ে শুধালো,
” ভালো লাগছে? ”
মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় হাঁ সূচক মাথা নাড়ল মেয়েটি। তূর্ণ মুচকি হেসে এগিয়ে এলো সন্নিকটে। অধরের ছোঁয়া অঙ্কন করলো দু ভ্রুয়ের সন্ধিস্থলে। আবেশ মুদিত হলো মেয়েটির নেত্রজোড়া। তূর্ণ মৃদু স্বরে বললো,
” ফ্রেশ হয়ে নাও। এতটা পথ জার্নি করে এসেছো। গা চিটচিট করবে। যাও। ”
চোখ মেলে তাকালো দুয়া। লজ্জা মিশ্রিত হেসে তূর্ণ’র সান্নিধ্য হতে বেরিয়ে এলো। পা বাড়ালো কক্ষের দিকে।
•
নিজস্ব কক্ষে মুখোমুখি বসে নিজাম সাহেব এবং তাসলিমা। তাসলিমা সরু চোখে তাকিয়ে স্বামীর পানে।
” তূর্ণ ফোন করেছিল। আমার সাথে কথা বলালে না কেন? ”
নিজাম সাহেব বোকা হেসে বললেন,
” ও-ই…! তূর্ণ বলেছে। ও বলেছে আম্মু যখন কাজ করছে। ডিস্টার্ব করো না। ও পরে ফোন করবে। ”
তাসলিমা অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
” ছেলেটা আমার চৌদ্দ ঘন্টার বেশি জার্নি করে ভিনদেশে গেল। এরপর কল করলো আরো কতক্ষন পরে। মা’কে খুঁজলো। অথচ তুমি দিলে না? তুমি জানতে না আমি ওর সাথে কথা বলার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে আছি? ”
নিজাম সাহেব স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বললেন,
” রাগ করো না লিমা। ওরা বোধহয় এখন রেস্ট করছে। তাই কল রিসিভ করছে না। তূর্ণ বলেছে তো। ও ঠিক তোমায় কল করবে। দেখে নিও। ”
তাসলিমা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। উদাস বদনে বিছানা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন। নিজাম সাহেব একাকী বিড়বিড় করতে লাগলেন,
” মমতাময়ী মা তো। সবটাই বেশি বেশি। রাগ, অভিমান, ভালোবাসা। তূর্ণ বাপ আমার। আব্বুকে বাঁচা। ”
•
মধ্যাহ্ন প্রহর। তাসলিমা এবং তাহমিদা’র সঙ্গে ফোনালাপ সেরে তূর্ণ এসে বসলো বিছানায়। দুয়া তখনো সোফায় বসে কথা বলে চলেছে। ফোনের অপর প্রান্তে দুই মা।
” হাঁ আম্মু। তুমি চিন্তা করো না। ”
তাহমিদা বললেন, ” চিন্তা কি আর সাধে করি? তোমাকে নিয়েই তো যত রাজ্যের চিন্তা। ”
দুয়া গাল ফুলালো।
” উফ্ আম্মু। আমি কি ছোট বাচ্চা? আমি এখন ভার্সিটি পড়ুয়া। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। কিন্তু তুমি এখনো আমাকে সে-ই প্রাইমারী পড়ুয়া দুয়া’র মতো ট্রিট করো। আমি শিশু নই। ”
তূর্ণ বিছানায় বসে হাসলো। তাসলিমা ফোনের অপর প্রান্ত হতে বললেন,
” ছেলেমেয়ে যত বড়ই হোক না কেন দুয়া। মায়ের কাছে ছেলেমেয়েরা সবসময় ছোটই থাকে। ”
” হুঁ। যেমন তোমার বিগ সাইজ সোনাবাবু। ওপস্। বাবু সোনা।”
বলেই ফিক করে হেসে উঠলো দুয়া। তূর্ণ তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো। তাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে? তাহমিদা হেসে বললেন,
” এই মেয়ে। আমার জামাই বাবাজিকে নিয়ে দুষ্টুমি করবে না।”
” ঠিক আছে। তুমিও আর আমার মামণির মেয়েকে বাচ্চা বলে বিদ্রুপ করবে না। ওকে? ”
দুই বোন একসাথে হেসে উঠলো। তাহমিদা বললেন,
” ঠিক আছে মা। এখন তাহলে রাখছি। আল্লাহ্’র রহমতে ভালো থেকো। সাবধানে থেকো। ”
তাসলিমা পাশ থেকে বললেন,
” যা যা বললাম মনে থাকে যেন। ঠিক আছে? ”
দুয়া মুচকি হেসে বললো, ” ঠিক আছে। রাখছি। আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। দুয়া গোলাকার ছোট্ট টি টেবিলের ওপর মোবাইল রেখে উঠে দাঁড়ালো। পড়নে তার ধূসর বর্ণের লেডিস ফুল স্লিভ সোয়েটার এবং শুভ্র রঙা লেগিংস। অগ্রসর হলো বেডের পানে। তূর্ণ ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। দুয়া রুম হিটার সঠিকভাবে সেট করে বিছানায় শয্যা গ্রহণ করলো। তূর্ণ’র কাছ হতে ব্ল্যাংকেট নিয়ে দেহে জড়ালো। তৎক্ষণাৎ আ`ক্রমণ করে বসলো তূর্ণ। ব্ল্যাংকেটের অভ্যন্তরে তূর্ণ’র আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দিনী হলো দুয়া। ছটফট করে উঠলো মেয়েটা।
” উঁহু হুঁ। কি করছো? দম বন্ধ করে মে রে ফেলবে নাকি? ছাড়ো বলছি। ”
” নাহ্! তোকে তো আমি আষ্টেপৃষ্ঠে পি`ষেই ক্ষ্যা ন্ত হবো। আমাকে নিয়ে মজা করা? আমি বাবুসোনা? ”
সশব্দে হেসে উঠলো দুয়া। অর্ধাঙ্গের ডান বাহুতে মাথা রেখে আরাম করে শুলো। হাসিমুখে বললো,
” ইয়েস। মামণির বিগ সাইজ বাবুসোনা। ”
” আচ্ছা? তাহলে তো প্রমাণ করতেই হচ্ছে আমি বাবুসোনা কি না? ”
ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না। দুয়া তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালো।
” এই না না। একদম না। আমি প্রমাণ চেয়েছি নাকি? ”
তূর্ণ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। বললো,
” কিন্তু আমি যে প্রমাণে বিশ্বাসী। তাহলে প্রমাণ দেয়া যাক? ”
নিভু নিভু মেয়েটির নেত্রপল্লব। মাথা নাড়িয়ে আপত্তি পোষণ করে চলেছে। কিন্তু তা শুনলো কি মানুষটি? মোটেও নয়। মেয়েটিকে চরমভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে আকস্মিক পাল্টি খেলো। সুড়সুড়িতে জর্জরিত করে তুললো কোমল কায়া। খিলখিল করে হেসে উঠলো দুয়া। উদরে পুরুষালি হাতের দুষ্টু ছোঁয়ায় অবর্ণনীয় সুড়সুড়ি অনুভূত হচ্ছে। দু হাতে বারবার বাঁধা প্রদান করার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ব্যর্থ সে। তূর্ণ থেমে নেই। মেয়েটিকে সুড়সুড়িতে অতিষ্ঠ করে তুললো। দুয়া যতবার তার বাহুবন্ধন হতে মুক্ত হতে চাইলো। ততবার ই আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো। শেষমেষ থামলো মানুষটি। হাসতে হাসতে দুয়া’র চোখে নোনাজল। কেঁপে কেঁপে উঠছে কায়া। তূর্ণ নিজেও হাঁপাতে হাঁপাতে হেসে চলেছে। হাসতে হাসতে তাকালো তার বাহুতে শায়িত একান্ত সঙ্গিনীর পানে। নয়নে মিলিত হলো মায়াবী নয়ন। হলো কত অব্যক্ত আলাপণ! অতিবাহিত হলো কত প্রহর। কপোলের কোমল আবরণে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো তূর্ণ। মিহি স্বরে বললো,
” ঘুমিয়ে পড়ো। ”
•
অপরাহ্ণ প্রহর। অসংখ্য পুষ্প সমারোহের সান্নিধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তূর্ণ, দুয়া। হলদে রঙা ফুলগুলো যেন অতি মোহনীয় ভঙ্গিতে কাছে ডাকছে। একটুখানি ছুঁয়ে দেয়ার জন্য, স্বল্প পুলকিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব মন। আর তর সইলো না মেয়েটির। ধীরগতিতে ঝুঁকে বসলো। হাতের কোমল আবরণে ছুঁয়ে গেল হলদে রঙা ফুলটি। ফুলেল সান্নিধ্যে আবেশিত হলে তনুমন। মুদিত হলো নেত্রপল্লব। আরেকটুখানি ঝুঁকে গেল দুয়া। নাসিকা গ্ৰন্থিতে শুষে নিলো ফুলেল সুবাস। অফুরন্ত ভালবাসা আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো। সে মোহনীয় মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করতে ভুললো না তূর্ণ। ফটাফট মোবাইলে বন্দি করে নিলো মুহুর্তটুকু। মেয়েটির অধর কোণে মাধুর্যময় হাসির রেখা। তূর্ণ সেথায় বিমোহিত হলো!
নীলচে জলের এক প্রান্তে পথ। সেথায় পথের ধারে অগণিত ফুলের সমারোহ। আরেক প্রান্তে দেখা মিলছে ক্যাসেল এর। তূর্ণ, দুয়া এই মূহুর্তে উপভোগ করে চলেছে লেক জেনেভা এর সৌন্দর্য।
লেক জেনেভা; আল্পসের উত্তর দিকে একটি গভীর হ্রদ। যা সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে ভাগ করা হয়েছে। এটি পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম হ্রদগুলির মধ্যে একটি এবং রোনের পথে বৃহত্তম। হ্রদের ষাট শতাংশ ( ৩৪৫.৩১ কিমি বা ১৩৩.৩২ বর্গ মাইল) সুইজারল্যান্ড এর ( ভাউড, জেনেভা এবং ভ্যালাইসের ক্যান্টন ) এবং চল্লিশ শতাংশ ( ২৩৪.৭১ কিমি বা ৯০.৬২ বর্গ মাইল ) ফ্রান্সের ( হাউট-সাভোই বিভাগ )।
গোধূলি লগ্নের মিঠি আবহাওয়ায় পুলকিত হৃদয়। পুরুষালি হাতের মুঠোয় বন্দী কোমল হাতটি। পাশাপাশি হেঁটে চলেছে দু’জনে। উপভোগ করছে লেক জেনেভা অপার সৌন্দর্য! কখনো কখনো তূর্ণ হাতের ইশারায় কিছু দেখিয়ে দিচ্ছে। মুগ্ধ নয়নে তা অবলোকন করছে দুয়া। এমন নয়ানাভিরাম সৌন্দর্যের মাঝে এক জোড়া কপোত-কপোতী। একান্ত মানুষটির সান্নিধ্য, সঙ্গে ভিনদেশী সৌন্দর্য। এ যেন এক অবর্ণনীয় সুখময় মুহূর্ত!
•
রবির কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি। চালকের পাশের সিট শূন্য। পেছনে বসে তিন বান্ধবী। তৃষা, পুষ্পি এবং বিন্দু। সিনেপ্লেক্স হতে ফিরছে তারা।
” দোস্ত মুভিটা কিন্তু জোশ ছিল। ” প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিন্দু।
পুষ্পি বিমোহিত কণ্ঠ বলে উঠলো,
” হিরোটা যা ছিল না! উফ্। খাতারনাক্! হৃদয় কেড়ে নিলো আমার। ”
তৃষা ও বিন্দু মিটমিট করে হাসছে। তৃষা প্রশ্ন করে বসলো,
” তা বান্দুপি! সে তোমার হৃদয় কয় নম্বরে গিয়ে কেড়ে নিলো? ”
পুষ্পি ঘোরের মধ্যে বললো, ” একশো সত্তর। ”
তৃষা ও বিন্দুর চোখ কপালে। একশো সত্তর! লাইক সিরিয়াসলি! বিন্দু ওর বাহুতে চাপর মে রে বললো,
” লু চি মাইয়া! এত ক্রাশ খাস। খাইতে খাইতে তোর হৃদয় তো ভরাট। শেষমেষ জামাইরে কই জায়গা দিবি? হৃদয়ের বাইরে? ”
ফিক করে হেসে উঠলো তৃষা। তাতে ঘোর কেটে গেল পুষ্পির।
” কি বললি তুই? ” পুষ্পি সরু চোখে তাকিয়ে।
তৃষা হাসতে হাসতে বললো,
” তোর জামাইয়ের দুর্দশার কথা কইছে। অভাগা দুলাভাই আমগো। তোর হৃদয়ে জায়গা না পাইয়া শেষমেষ না কিডনিতে চলে যায়। ”
সশব্দে হেসে উঠলো বিন্দু। পুষ্পি রাগে গজগজ করে দু’জনকে মা|রতে লাগলো। হঠাৎ ব্রেক কষলো চালক। হকচকিয়ে গেল তিনজন।
” আংকেল! কি হয়েছে? ” প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে তৃষা।
” মা। সামনে বোধহয় এক্সিডেন্ট হয়েছে। ”
” এক্সিডেন্ট! ”
বিচলিত হলো তিনজন। তৃষা শুকনো ঢোক গিলে সাহস সঞ্চয় করলো। গাড়ির দ্বার খুলে বেরিয়ে এলো। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো অযাচিত স্থানে। আত্মা কেঁপে উঠলো। গাছের সঙ্গে বি*ধ্বস্ত একটি গাড়ি। সম্মুখের কাঁচ ভে ঙ্গে গেছে। ভেতরে থাকা মানুষটি দৃষ্টিসীমার বাহিরে। মেয়েটির কোমল হৃদয় ভীত হলো। সামনে যে এগোবে। সাহায্যের হাত বাড়াবে। সেটুকু বোধ অবধি হারিয়েছে। হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলো। ভাবনাচ্যূত হলো।
” কি হলো? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল গিয়ে দেখি। হয়তো আমাদের সাহায্যের দরকার। ”
বিন্দুর কথায় সম্মতি পোষণ করলো পুষ্পি। দুই বান্ধবী তাড়া দেয়ায় তৃষা ছোট ছোট কদম ফেলে অগ্রসর হতে লাগলো। যত এগোচ্ছে বুকের মধ্যিখানে ঢিপঢিপ করছে। কেমন একটা অনুভূত হচ্ছে। কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে তৃষা দু|র্ঘটনার শিকার গাড়ির কাছে গেল। পৌঁছালো চালকের স্থানে থাকা মানুষটির জানালার ধারে। গাড়ির কাঁচ অর্ধনমিত। তাতে সুবিধাই হলো। একটু ঝুঁকে ভেতরে তাকালো তৃষা। স্টিয়ারিংয়ে ঠেকে আহত মানুষটির মাথা। মুখখানা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কেমন চেনা চেনা লাগছে। তৃষা অতকিছু না ভেবে স্রষ্টার নাম স্মরণ করলো। অর্ধনমিত জানালা দিয়ে গলিয়ে দিলো হাতটি। গাড়ির লক খুলতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়ালো দুই সখী। তৃষা তাদের ড্রাইভারকে ডাকলো। পুরুষ মানুষ তো। হাত লাগাতে কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। তাই ড্রাইভার এলো। আহত মানুষটির মুখ স্টিয়ারিং হতে সরিয়ে সিটে এলিয়ে দিলো। তখন দৃশ্যমান হলো মুখখানা। হতভম্ব হলো তৃষা। কণ্ঠনালী হতে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,
” নিশাদ ভাইয়া! ”
চলবে.
[