তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_২০
লেখনীতে-আফনান লারা
.
আসিফ রিনিকে সাথে নিয়ে তার নিজের বাড়িতে চলে এসেছে।রিনিদের বাড়ি থেকে আসিফের বাড়ি বেশ একটা দূরে না।পায়ে হেঁটে আসা যায়।
আসিফের বাড়ির উঠানে পাটি বিছিয়ে বসে ছিল ওর দাদু।বসে বসে পান বানিয়ে খাচ্ছিলেন।চশমার যত পাওয়ারই থাকুক ইদানিং সব ঝাপসা মনে হয় তার কাছে।লিচু গাছে কতটা লিচু ধরেছে তা নিজের চোখে দেখতে পারেননা।দূর থেকে মনে হয় গোলাপি রঙের শাড়ী বিছানো পুরা গাছে।এখন দূর থেকে আসিফ আর রিনিকে আসতে দেখে তার বিশ্বাস হলোনা।কারণ এর আগে ওদের দুজনকে একসাথে তিনি দেখেননি।এখন দেখে নিজের ঝাপসা চোখের দোষ দিয়ে চুপ করে রইলেন।ভেতর থেকে সেসময় আসিফের বাবা বের হয় আর তখনই ওদের একসাথে দেখে এক গাল হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।রিনি সালাম দিলো তাকে।উনি আসিফের মাথায় হাত রেখে বললেন,’যাক!বউয়ের কদর বুঝলি তাহলে!’
আসিফ কিছু বললোনা।দাদুকে দেখে তার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে পাটিতে ধপ করে বসে গেলো।আসিফ এসেছে শুনে ওর মা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলেন।এতগুলা মাস পর ছেলেকে দেখে তিনি আবেগী হয়ে পড়েছেন।রিনি আসিফকে অন্যমনস্ক দেখে আসিফের বাবার সামনে ভ্যাঁত করে কেঁদে দিলো।উনি ওকে কাঁদতে দেখে বিচলিত হয়ে জানতে চাইলেন কান্নার কারণ কি।রিনি কান্নার কারণে কথাই বলতে পারছেনা।বাবা ওকে শান্ত করে বললেন বিষয়টা খুলে বলতে।
‘আন্নের হোলা আঁরে থুই ঢাকা চলি যাইবো কইছে।আঁই এতদিন হত্তে হত্তে থাইকছি আর হাইত্তাম ন।আন্নের হোলা বুঝতোই চা না’
[আপনার ছেলে আমাকে রেখে ঢাকা চলে যাবে বলেছে।আমি এতদিন একা একা থেকেছি আর পারবোনা।আপনার ছেলে বুঝতেই চায়না]
আসিফের বাবা এবার ওর মুখের দিকে তাকালেন।আসিফ এখনও এইসব কিছু শুনে নাই।সে তার দাদুর সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।
‘কিরে আসিফ?’
‘কি বাবা?কিছু বলবা?’
‘তুই নাকি রিনিরে ঢাকা নিতি চাস না?’
‘হ্যাঁ।ওখানে গিয়ে কি করবে?আমি থাকি আরেকজনের বাসায়,তার মধ্যে ওকে নিয়ে থাকলে ওনারা কি ভাববে?আর আমি কি চাকরি পেয়েছি এখনও?কথা কি এটা ছিল?’
‘সে যাই হোক!শর্ত দেওয়াই হয় ভাঙ্গার জন্য।মেয়েটা অনেক তো অপেক্ষা করেছে।আর কত কষ্ট পাবে?’
‘না বাবা আমি ওরে নিতে পারবোনা। ‘
——–
বাপ্পি শীতের মধ্যে গোসল করে কাঁপতে কাঁপতে আবার খেতে আসলো।তটিনি খেয়ে দেয়ে বাগানে ঘুরঘুর করছিল।বাপ্পি একা একা নাস্তা করছে সেসময় বকুল আপু তটিনিকে বাগান থেকে ডেকে এনে বললেন,’স্বামী ভাত খাওয়ার সময় তার পাশে বসে থাকলে দুজনের ভালবাসা বৃদ্ধি পায়’
তটিনি মাথা নাড়িয়ে চেয়ার টেনে বসে থাকলো।আপু চলে যাবার পর বাপ্পি ওর দিকে তাকিয়ে বললো,’তুমি ইচ্ছে করে আমাকে দিয়ে গোসল করাইছো তাই না?নিজে করসিলা গোসল?’
‘করসি তো।এই দেখেন চুল ভিজা’
‘আমাকে ফাঁসানোর কি দরকার ছিল?কি ক্ষতি করেছিলাম তোমার?’
‘কিছুই করেন নাই তবে আপনাকে একটু ফাঁসাতে মন চাইলো।কি করবো,বোর হচ্ছিলাম’
‘এটার শাস্তি তুমি পাইবা! ‘
তটিনি যেন একটুও ভয় পেলোনা।মুখ বাঁকিয়ে চেয়ারে বসে পা দুলাতে থাকলো।বকুল আপু সব গুছিয়ে নিয়েছে
এরপর তৃষাকে নিয়ে দুলাভাইয়ের সাথে চলে গেছে সবাইকে বলে।
বাসাটা মূহুর্তেই কেমন শীতল হয়ে গেল।তৃষা আর বকুল আপু মিলে বাসাটাকে মাথায় তুলে রাখতো। এখন তারা চলে যাওয়ায় সব নিরব হয়ে গেছে।
তটিনি কোমড়ে হাত রেখে সবাইকে চলে যেতে দেখেছে বেশ অনেকক্ষণ ধরে।এরপর দেখা শেষে পেছনে ফিরতেই দেখলো বাপ্পি ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘কি?’
‘কি?কি দেখো এতো?বকুল আপুকে মিস করতেছো?তোমাকে না সকালবিকাল ঝাড়ি দিতো?’
‘তাও অনেক আদর করতো।ঝাড়ি দেয়া মানুষ অপছন্দের হবে কেন?ঝাড়ি দেয়া মানুষরা সে পরিমাণ আদর ও করে’
‘আচ্ছা চলো ঘুরে আসি’
তটিনি ব্রু কুঁচকে বলে,’কেন?আমরা কি প্রেম করে বিয়ে করছিলাম?’
‘ওমা!এরেঞ্জড হলে ঘুরতে যাওয়া যায়না?’
‘যায়,কিন্তু আমি যাব না কারণ আপনাকে আমি পছন্দ করিনা।আই হেট ইউ’
এই বলে তটিনি মহাআনন্দে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া ধরতেই বাপ্পির বাবার সামনে পড়লো।তটিনির বলা এর আগের কিছু না শুনলেও আই হেট ইউ ক্লিয়ারলি শুনেছেন।
তটিনি ওনাকে দেখে মাথার ঘোমটা টেনে নিলো।
‘তুমি আমার ছেলেকে ঘৃনা করো?’
‘ননননা তো।’
‘আমি মাত্র শুনলাম আই হেট ইউ বলছো’
‘নাহ নাহ।আমি বলছি আই লাভ ইউ।সত্যি বিশ্বাস করেন’
‘তুমি তো বাপ্পিকে পছন্দ করতেনা তাহলে বিয়ের দুইদিনেই আই লাভ ইউ?আমি নিশ্চিত তুমি হেট ইউ বলছো’
তটিনির কপালে ঘাম উঠে গেছে।এটা শ্বশুর নাকি অন্য কিছু।এমন জোঁকের মতন ধরছে কেন।সে কোনো কিছু বলেই পার পাচ্ছেনা।
শেষে বাপ্পি এসে বললো,’আরেহ বাবা তটিনি আমায় আই লাভ ইউ বলছিল।’
‘ওহ!তাহলে ঠিক আছে’
এই বলে বাবা চলে গেলেন।তটিনি ফিসফিস করে বললো,’আবারও আই হেট ইউ হুহ!’
এটা বলে সে চলে গেছে।
——
আসিফ শীতের ভাপা পিঠা খেয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা হয়ে গেছে।রিনিকে বাই বলেনি কারণ বলতে গেলেই সে আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে।
সে চুপিচুপি বাসস্টপে এসে বাস একটাতে উঠেও গেছে।
একটা সিট পেলো ৩য় নাম্বারে সেখানে একটা মেয়ে বসা ছিল।
আসিফ ওখানে বসতে যাবে তখনই পেছন থেকে ব্যাগ নিয়ে রিনি এসে বললো,’এই আন্টি হরেন তো।হরেন!!একুলে আঁই বইয়াম।আন্নে আঁর আন্টি অইলে আঁর জামাই আন্নের মাইয়ার জামাই।বুইজ্জেন্নি😌🐸?’
[এই আন্টি সরেন তো সরেন!এখানে আমি বসবো।আপনি আমার আন্টি হলে আমার জামাই আপনার মেয়ের জামাই।বুঝছেন?]
রিনির কথা শুনে আসিফ চোখ কপালে তুলে তাকালো।
‘তুই এখানে কি করিস?কি করে আসলি!’
ঐদিকে সিটে বসা মেয়েটা আন্টি ডাক শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে।
‘কি বললে তুমি!আমাকে তোমার আন্টি মনে হয়?’
‘থুক্কু জেডির মতন লাগে।জেডিরে মাইনসে তো আন্টিই কয়’
‘আবার জেডি বলতেছো!বেয়াদব!’
‘কিহ!আঁই বেয়াদব? ?তুই বেয়াদব!তোর চৌদ্দ গুষ্টি বেয়াদব।’
আসিফ রিনির মুখ চেপে ধরে ঐ মেয়েকে সরি বলতে বলতে পাশের সিটে নিয়ে আসলো।তারপর জানতে চাইলো সে এখানে কিভাবে আসছে।রিনি দাঁত কেলিয়ে বললো,’আঁই কইছিনা আঁই আন্নেরে ছাড়া থাইকতাম হাইরতাম ন।আঁরে কারিমে আনি দিছে একুলে।’
আসিফ রিনিকে নামিয়ে দিতে যাবে তখনই বাস ছেড়ে দিলো।
———
বাপ্পি হাতে টিকেট নিয়ে রুমে ফিরছিল।টিকেট গুলা বাবা দিয়েছে।কক্সবাজারের টিকেট।
তটিনি সেসময় বাপ্পির আলমারি থেকে পাওয়া ওর ছোটবেলার কিছু ছবি দেখছিল।বাপ্পি টিকেট ওর সামনে ধরে বললো,’জলদি প্রস্তুতি নাও।কাল রাতে রওনা হবো’
‘হোটেলে দুটো বেড নিবেন ‘
‘বাবা যে হোটেল বুক করেছে তাতে দুটো বেড নেই।সব একটা একটা’
‘আপনার এত হাসি আসছে কেন?আপনার বাবা এক খাট ওয়ালা রুম বুক করেছে তো কি হয়েছে?আমরা সেখানে গিয়ে দুই খাটের রুম বুক করবো’
‘আচ্ছা ফাইন!’
বাপ্পি নিজের ব্যাগটা বের করে জামাকাপড় গোছানো শুরু করে দিছে।তটিনি ভেতরে ভেতরে কক্সবাজারের পাগলা, ভক্ত এখন সেখানে যাবার কথা শুনে ইচ্ছা থাকার সত্ত্বেও লাফাতে পারছেনা।বাপ্পি ভাববে ও হানিমুন নিয়ে এক্সাইটেড। তাকে বুঝতে দেয়া যাবেনা।সে তো আর জানেনা ওর খুশি সব ঘুরাঘুরি নিয়ে।
———
রিনি বাসের জানালা দিয়ে বাহিরের গাছপালা দেখছে আর গাপুসগুপুস করে চিপস খাচ্ছে।আসিফ বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তার সাথে বিরক্ত হয়ে আছে পাশের সিটে বসা সেই মেয়েটি।এরকম অসভ্য মেয়ে সে তার জীবনে দেখেনি,তার তো আফসোস হয় এই মেয়েটির হাসবেন্ড নিয়ে।ছেলেটার জীবন শেষ একেবারে।
রিনি চিপস চাবাতে চাবাতে বললো,’খাইবেন্নি আন্টি?’
‘শাট আপ!আমি তোমার আন্টি না’
‘ওকে খালাম্মা’
মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আসিফ আবারও সরি বলে তাকে থামিয়ে দিলো এরপর রিনিকে ধমকে বললো যেন চুপ করে থাকে।
‘আরেক বেডির সামনে নিজের বউরে ধমকান,কেমন বেডা আন্নে!’
‘তো তুই কি ভাল বিহেভ করতেছস!!বাসে ওঠার পর থেকে ঐ মেয়ের পিছনে লাগছস’
‘আঁই কিত্তাম।আই আন্টি কইলেই বেডি ইগা চ্যাঁত করি উডে।এডা কি আঁর দোষ!’
——–
তটিনি খাটে বসে কলা খেয়ে কলার খোসা সবসময় নিচে ফেলে দেয়।এটা তার ছোটকালের বাজে অভ্যাস।এখনও তাই করেছে।বাপ্পি জামাকাপড় গুছাতে গুছাতে ছোটাছুটি করছিল।তখনই কলার খোসায় পা রাখতেই পিছলে সে গিয়ে পড়লো তটিনির গায়ের উপর।তটিনি যদি এটা আগে থেকে জানতো তাহলে তার বহু পুরোনো এই অভ্যাস ঠিক করে নিতো।
বাপ্পির মতন ভাল স্বাস্থ্য দেহের অধিকারি একটা পুরুষ এভাবে পড়লো গায়ে।তটিনির সেটা সমস্যা ছিল না কিন্তু তার সমস্যা টাই হলো বাপ্পিকে নিয়ে।সে রাগের চোটে কিছু বলতেও পারছেনা। এ বাড়িতে বাপ্পির খেলাপে কিছু বলা যাবেনা,করা যাবেনা।এদিকে বাপ্পির পা খাটের স্ট্যান্ডের সাথে লেগে আটকে গেছে।সে পা ঘুরিয়ে নিজ থেকে উঠার শক্তি উপায় কিছুই পাচ্ছেনা।
চলবে♥তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_২১
লেখনীতে-আফনান লারা
.
তটিনির চেষ্টায় বাপ্পি উঠতে পারলো তাও অনেক কষ্টে।পা খাটের সাথে না আটকালে উঠতে আরও সহজ হতো।তটিনি কাঁধে ব্যাথা পেয়েছে।সত্তর একাত্তর ওজনের একটা মানুষ গায়ের উপর ধুম করে পড়া কি মুখের কথা??
কাঁধে হাত দিয়ে তটিনি উঃ করে বললো,’ইচ্ছে করে পড়ছেন তাই না!’
‘কলার খোসা ইচ্ছে করে তুমি এখানে ফেলেছিলে যাতে আমি গিয়ে তোমার গায়ে পড়ি।তাই না?’
তটিনি বিড়বিড় করে কিসব বললো যার কোনোটাই বাপ্পি বুঝলোনা।সে নিজেও ব্যাথা পেয়েছে পায়ে।খাটে বসে পা ধরে তাই দেখছিল, তটিনি কাঁধ ধরে নিচে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে মলম তুলে কাঁধে লাগিয়ে নিচ্ছে সসেসময় রুমে আসলো বাপ্পির মা।তিনি বাপ্পিকে পা ধরে চোখ মুখ খিঁচাতে দেখে আন্দাজ করে নিলেন নিশ্চয় বাপ্পি ব্যাথা পেয়েছে।তাই ছুটে এসে জানতে চাইলেন কোথায় ব্যাথা পেয়েছে।বাপ্পি কথাটা চেপে যেতে চাইলেও মায়ের কাছে ধরা খেলো একটা কারণে।আর সেটা হলো ওর পায়ে লাল দাগ বসে গেছে।মা তটিনির হাত থেকে মলম নিয়ে এসে ওর পায়ে লাগাচ্ছেন এখন।তটিনি কাছে এসে ধীর গলায় বললো,’আন্টি আমিও ব্যাথা পেয়েছি।এই দেখেন কাঁধে’
‘ও কিছুনা।কিন্তু বাপ্পির পা দেখো তুমি,, লাল হয়ে দাগ বসে গেছে।মনে হয় রক্ত জমে গেছে।তুমি কি দেখোনি ও কিভাবে ব্যাথা পেলো?’
তটিনি ব্রু কুঁচকে ওখান থেকে সরে গেছে।বাপ্পি প্রথমদিন তাহলে ঠিক কথাই বলেছিল।
আসলেই সে ঠিক বলেছে, এ বাড়িতে ওকে সবাই অনেক বেশি আদর করে।
জানালার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তটিনি ওকে হিংসা করছে।বাপ্পির মা মলম লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছেন গরম দুধ আনতে।
বাপ্পি তখন পেছনে ফিরে তটিনির দিকে তাকালো।তটিনি ওমনি বললো,’কোলে নিয়ে হাঁটবো একটু?এই টুকু ব্যাথায় এত ব্যস্ত হলে আরও বড় আঘাতে কি ঘটে কে জানে!’
আাপ্পি হাসলো তারপর পা নামিয়ে মলম নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে তটিনির কাছে এসে দাঁড়ালো।তটিনিকে অবাক করে দিয়ে মলম নিয়ে সে ওর কাঁধে লাগিয়ে দিতে লাগলো এবার।
তটিনি এটা আসলেই ভাবতে পারেনি বাপ্পি কাছে এসে যে এমনটা করবে।
বাপ্পি মনযোগ দিয়ে মলমটা ভালমতন লাগিয়ে ফু দিয়ে বললো,’এই বাড়ির সবার কাছে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমার কাছে তুমি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
এই বলে বাপ্পি আবার গিয়ে আগের জায়গায় বসলো।মা তখনই দুধের গ্লাস নিয়ে আসলেন।
‘কিরে বাপ্পি তুই বুঝি উঠেছিলি?’
‘না তো’
‘তাহলে তোর জুতায় মলম লাগা কেন?কেন উঠেছিল?তটিনিকে বললেই হতো’
‘না আমি উঠি নাই।তুমি এত টেনসন করিওনা’
‘করবোনা টেনসন?কাল তোদের কক্সবাজার যাবার কথা ছিল আর এখন তুই এই ঘটনা ঘটাই রাখলি’
এই বলে বাপ্পির মা নিচে তাকিয়ে কলার খোসাকে মেঝেতে আটকে থাকতে দেখে সেটা তুলে বললেন,’এটাতে পিছলে পড়েছিস তাই তো?কলার খোসা মেঝেতে ফেলার অভ্যাস তো তোর না।এটা নিশ্চয় তটিনি করেছে?
তটিনি?এটা কেমন স্বভাব?তোমার এই বাজে অভ্যাসের জন্য বাপ্পির আজ এই অবস্থা হলো।আর কখনও এইসব করবানা।বাপ্পি খুব পরিষ্কার স্বভাবের ছেলে।তোমাকেও সেরকম হতে হবে।’
মা রাগী চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেলেন।তটিনি গাল ফুলিয়ে তার ট্রলি ব্যাগ টেনে নিজের সব জামাকাপড় গুছানো শুরু করে দিলো।বাপ্পি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।তটিনি সব গুছিয়ে নিতেই বাপ্পি বললো,’মায়ের বকার জন্য আমি সরি বলছি।এভাবে রাগ করলে হবে?গুরুজনরা তো একটু আকটু বলেই।গায়ে নেয়ার কি আছে?’
‘আসার পর থেকে এটা করোনা,ওটা করো।ওটা করোনা এটা করে শুনতে শুনতে কান পেকে গেছে আমার।আপনারা এইসব আগে জানিয়ে বিয়ে করবেন না??আরেক পরিবেশের আরেক ঘরের একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনে নিজেদের মনমত নিয়ম তার উপর চাপিয়ে দিলে হবে??’
‘তটিনি প্লিজ যেও না।আচ্ছা আমি সবাইকে বুঝিয়ে বলবো যাতে তোমার সাথে ভাল ব্যবহার করে’
তটিনি তাও হাঁটা ধরেছে।বাপ্পি বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে নেমে ওকে আটকাতে যেতেই পায়ে ব্যাথা পেয়ে আবারও গিয়ে তটিনির গায়ের উপরই পড়েছে।তটিনি দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে।বাপ্পি মাথা তুলে হাত দরজাতে রেখে বললো,’সরি।ব্যালেন্স করতে পারিনি।পায়ে ব্যাথা অনেক।প্লিজ যেও না,মচকে গেছে মনে হয়।আমি কথা দিচ্ছি কেউ আর তোমাকে বকবেনা’
তটিনি গাল ফুলিয়ে বাপ্পির সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানায় উঠে বসে থাকলো।বাপ্পি ড্রয়ার খুলে বিসকুটের প্যাকেট এনে দুধের গ্লাসটা তটিনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,’এই বিসকুটটা দুধ দিয়ে খেতে অনেক মজা।নাও খাও’
———-
রিনি আসিফের হাত শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে আছে।আসিফ এতক্ষণ ওকে ছাড়ানোর সব চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়ে এখন আর সরানোর চেষ্টা করছেনা। রিনি যেভাবে আছে সেভাবেই ওকে ছেড়ে দিয়েছে।রিনিকে হয়ত আর কোনোদিন ফেরানো যাবেনা।
‘যত যাই বলি না কেন দিনশেষে সে তো আমার বিয়ে করা বউ।না আমি অস্বীকার করতে পারবো আর না রিনি আমায় অস্বীকার করতে দিবে।’
আসিফ গম্ভীর হয়ে বসে আছে।রিনির গালের নরম ছোঁয়া ওর হাতে বারবার করে লাগছে বাসের ধাক্কায়।বুকের ভেতর ধরফর করছে অনবরত।রিনিকে সরিয়ে দিলেই যেন মনে শান্তি লাগতো। কিন্তু সরানো সম্ভব না বলে এটাই সয়ে যেতে হবে।
রিনি পাকাপোক্ত ভাবে ধরে আছে যেন আসিফ তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে সে ভয়ে।
আসিফের ও একই ধারণা হলো।মানুষ এই ভাবনা নিয়ে কখন কাউকে শক্ত করে ধরে?
মানুষটা হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয় থাকলেই কেবল শক্ত করে ধরি আমরা।আসিফ সেটা বুঝতে পেরে রিনিকে দূরে সরিয়ে দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
কুমিল্লাতে বাস বিরতিতে থামলো আসরের নামাজ আদায় করার জন্য।
আসিফ রিনিকে রেখে উঠে চলে গেছে।
কয়েক মিনিট পরেই রিনির ঘুম ভেঙ্গে গেলো আর পাশে আসিফকে না দেখে সে ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।আসিফের নাম ধরে কয়েকবার ডাকাডাকি ও করলো তাও কেনো সাড়া পেলোনা।
পাশের সিটে বসা মেয়েটা আসিফকে নামাজ পড়তে যেতে দেখেছে কিন্তু সে রিনিকে ভয় দেখানোর জন্য বললো,’তোমার জামাই তো তোমায় ফেলে চলে গেছে’
রিনি মেয়েটার মুখে হাসি দেখেই বুঝেছে মেয়েটা মিথ্যা বলছে তাই সে বললো,’আরঁ জামাই কি আন্নের জামাইর মতন নি যে বউ থুই দাই যাইবো?আঁই জানি আঁর জামাই কোনো কামে বাহির হইছে।হেতেন অনেক দায়িত্ববান মানুষ।আঁরে থুই জানের মতন মানুষ না’
[আমার জামাই কি আপনার জামাইর মতন যে বউ রেখে চলে যাবে?আমি জানি আমার জামাই কোনো কাজে বের হইছে।উনি অনেক দায়িত্ববান মানুষ। আমাকে রেখে যাবার মতন না’]
এই বলে রিনি মুখ বাঁকিয়ে বসে পড়লো আবার।
———-
‘তটিনি রান্নাঘরে এসে একটা টোটকা বানাচ্ছে বাপ্পির মায়ের আদেশে।তিনি চান বাপ্পিকে কালকের মধ্যেই সুস্থ করে ফেলতে তাই তটিনিকে কাজে লাগিয়ে দিছেন
তটিনি আগে এইসব কাজ করেনি।ওদের বাড়িতে বুয়া আছে।বুয়া সব করতো,তটিনিকে রান্নাঘরে দেখা যেতো না,অনেক আদরের মেয়ে ছিল।আদরের হলেও বিয়েতে তার মত নেয়া হয়নি বলে সে আগের সব আদর ভুলে বাবা মায়ের উপর প্রচণ্ড রকম রেগে ছিল।ওকে যেমন আদর করতো তেমনই মার দিতো বাবা মা দুজনেই।মার দিয়ে আবার আদর করতো।মাঝে মাঝে তটিনি মনে করতো সে ভুল করে ভুল পরিবারে জন্ম নিয়ে ফেলেছে।
বাবার কথা ভাবতে গিয়ে টোটকার গ্লাসে জুস ভেবে সে গিলে খেয়ে নিয়েছে।
সেটা দেখে বাপ্পির মা দিলেন এক চিৎকার। ভয় পেয়ে তটিনি গ্লাস রেখে বললো,’সরি আন্টি।আমি এক্ষুনি আরেকটা বানিয়ে দিচ্ছি’
‘সেটা সমস্যা না। সমস্যা হলো তুমি যে এটা খেলে এখন তো তোমার শরীর খারাপ করবে’
‘কেন?এটা তো উনি ও খাইতেন।তাহলে আমি খেলে কি সমস্যা হতো?’
‘এটা পায়ের ব্যাথা ভাল করার ঔষুধ।যারা সুস্থ মানুষ তারা এটা খেলে হিতের বিপরীত হয়’
‘তার মানে কি হবে আমার এখন?’
‘বমি পাচ্ছে?’
‘না তো।তবে তেতো লাগছে মুখে’
‘আচ্ছা তুমি বরং গিয়ে শুয়ে থাকো।টোটকাটা আমি বুয়াকে দিয়ে বানিয়ে নিচ্ছি ‘
এই বলে বাপ্পির মা তটিনিকে পাঠিয়ে দিলেন।বাপ্পি শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল।তটিনিকে দেখে ফোন রেখে বললো,’চিৎকার শোনা গেলো।কি হয়েছে ওখানে?’
তটিনি মুখে হাত দিয়ে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।বাপ্পি কিছুই বুঝলোনা কি হচ্ছে ওখানে।ওমনি সেখানে বুনি এসে বলে,’ভাবী মনে হয় প্রেগন্যান্ট ”
‘চুপ কর বোকা মেয়ে কোথাকার!এত জলদি প্রেগন্যান্ট হয় নাকি!’
‘কিন্তু ভাইয়া আমি তো জানি বিয়ে করলেই সাথে সাথে প্রেগন্যান্ট হয়।’
চলবে♥