#তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
“সামনে থাকলে থা-প্প-ড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলতাম তোমার।”
ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল জিয়ান। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে সে। বিতৃষ্ণায় মুখ তেতো হয়ে আছে। মাহিরা কিন্তু দমল না। সে খিলখিল করে হেসে বলল,
“রাগ করেছ?”
“তোমার সমস্যা কী? কেন বিরক্ত করছ আমায়?”
“বিরক্ত করছি নাকি? আগে তো খুব পাগল ছিলে আমার কণ্ঠ শোনার জন্য। আর এখন বিরক্ত লাগে?”
“হ্যাঁ, লাগে। কারণ আগের সময় আর আগের জিয়ান কোনোটাই এখন আর নেই। সব নতুন।”
মাহিরা শ্লেষেরসুরে বলল,
“ঠিকই বলেছ। সবই নতুন। বউও নতুন। তাই পুরাতন আমিকে আর ভালো লাগে না।”
“তোমাকে কেন ভালো লাগবে আমার? তুমি আমার কে হও? কেউ না।”
“আমি তোমার কেউ হই না?”
“না।”
“এত তাড়াতাড়ি সব ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেল?”
“তাড়াতাড়ি? তিনটা বছর পার হয়ে গেছে মাহিরা। তিনটা বছর কিন্তু কম সময় নয়। এখন যখন আমি অন্য কারও সাথে ভালো আছি তখন কেন এমন করছ? কেন বারবার আমার সুখ কেড়ে নিতে চাইছ বলো?”
“তোমার জীবন থেকে চলে গিয়ে সুখ কেড়ে নিয়েছিলাম। এজন্য আমি দোষী। আমি তো চেয়েছিলাম দ্বিতীয়বারও তুমি আমার সাথেই সুখী হও।”
“যাতে করে আবার চলে গিয়ে সুখ কেড়ে নিতে পারো?”
“না জিয়ান! আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।”
“হাহ্! তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি।” তাচ্ছিল্য করে বলল জিয়ান।
মাহিরা বলল,
“দেখো জিয়ান তুমি হয়তো আমায় ভুল বুঝতেছ। আমার ওপর রেগে আছো। কিন্তু আমি কী করব? তোমাকে আমি অন্য কারও সাথে সহ্য করতে পারছি না। আর পারবও না।”
“তোমার কথা বলা শেষ? মাথা ধরে আছে আমার। নিতুকে খুঁজে পাচ্ছি না। দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। তার ওপর তোমার এসব ন্যাকামো আমি একদম নিতে পারছি না। তুমি দয়া করে আমাকে কল দিও না প্লিজ!”
“জিয়ান, আমার কথাটা…”
কথা সম্পূর্ণ করতে দিল না জিয়ান। তার পূর্বেই কল কেটে দিল। ভীষণ অসহায়বোধ করছে সে। নিতুর কষ্টে তার বুকে প্রবল ঝড় শুরু হয়েছে। কোথায় আছে নিতু?
.
.
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়িতে এসেছে নিতু। তার পরনের শাড়ি অগোছালো, চুল এলোমেলো। শুকনো মুখ। হাতে লাগেজ। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে মমতা বেগম আঁৎকে উঠলেন। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“নিতু! তোর এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে?”
নিতু কোনো প্রত্যুত্তর করল না। সরাসরি নিজের রুমে চলে গেল। মমতা বেগমও সঙ্গে গেলেন। তিনি উদ্বেগপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছেন,
“কথা বলছিস না কেন? জিয়ানের সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?”
রাগ, জেদ, ক্ষোভ, অভিমান সব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নিতুর। বাবা-মায়ের ভুলের জন্য আজ তাকে পস্তাতে হচ্ছে। প্রচণ্ড অভিমানে এসব কথা বাবা-মা কাউকেই তার বলতে ইচ্ছে করছে না। সে ঠিক করেছে বলবেও না। সময় থাকতে যখন খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, এখন আর জেনেই বা কী করবে? কোনো প্রয়োজন নেই তাদের জানার। সে শীতলকণ্ঠে শুধু বলল,
“কিছু হয়নি। আমায় একটু একা থাকতে দাও।”
“একা থাকবি মানে কী? হয়েছে কী সেটা তো আমায় বল।”
“বলব। আমি তো আর কোথাও চলে যাচ্ছি না। আছি তো এখানে! আগে ফ্রেশ হই? একটু রেস্ট নিই? তারপর বলি? তাছাড়া আহামরিও কিছু ঘটেনি।”
“সত্যি তো?”
“হ্যাঁ?”
“ঐ বাড়িতে সব ঠিকঠাক?”
“হুম।”
“ওহ। তাহলে জিয়ানের সাথেই ঝগড়া করে এসেছিস। বিয়ে হয়েছে আজ চারদিন হলো। এর মধ্যেই ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিস?”
নিতু কোনো উত্তর দিল না। ওয়াশরুমে চলে গেল। মমতা বেগম দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন,
“নিতু, ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে আসিস। আমি তোর নাস্তা দিচ্ছি।”
নিতু এবারও কোনো উত্তর দিল না। গতকাল সে জিয়ানদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফেসবুকে পরিচিত এক ক্লোজ বান্ধবী সম্পার বাড়িতে উঠেছিল। জিয়ানের আগের বিয়ের ব্যাপারে সম্পাকে কিছু জানায়নি। সামান্য কথা কা’টা’কা’টি হয়েছে বলেই জানিয়েছিল। ফোন বন্ধ করে সারা রাত ভেবেছে সে কী করবে। কী করা উচিত। ভোর রাতের দিকে সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভয়াবহ রকমের কঠিন সিদ্ধান্ত। হোক ভুল! ভুল, ঠিকের হিসাব করার মতো মানসিকতা এখন তার নেই। সে উ’ন্মা’দ হয়ে গেছে। জিয়ানের প্র’তা’রণা কিছুতেই মানতে পারছে না। সে তো সত্যিই মানুষটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। তাহলে কেন ঠকাল এভাবে?
চাপা স্বভাবের অভিমানী নিতু এতটুকু বুঝেছিল তার সিদ্ধান্ত এখানে বাস্তবায়ন করতে গেলে সম্পাসহ তার বাকি রুমমেটরা ফেঁসে যাবে। তার জন্য অন্যদের ক্ষতি হোক এটা সে চায় না। তাই সকাল হতেই নিজের বাড়িতে চলে এসেছে। যা করার সে এখানেই করবে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সে ব্যাগ সে ধা’রা’ল দুটো ব্লে’ড বের করে। এগুলো সে আসার সময় কিনে নিয়ে এসেছে। ব্লে’ড দুটো নিয়ে সে ফ্লোরে বসে পড়ল। খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রুমের ভেতর তখন পিনপতন নিরবতা। তাই ফ্যানের ভনভন শব্দও কানে লাগছে খুব। সে আর কিছুই ভাবার সময় নিল না। দুটো ব্লে’ড একত্রে করে বাঁ হাতের র’গে’র ওপর ক্রমাগতভাবে আঁ-চ-ড় দেওয়া শুরু করে। ক্ষ-ত-স্থা-ন থেকে গলগল করে র’ক্ত বের হচ্ছে। র’ক্তে তার হাত, ব্লেড, পরনে বাসন্তী রঙের শাড়িটি ভিজে জপজপে হয়ে গেছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে তার। ধীরে ধীরে শরীর হালকা হতে শুরু করে। চেতনা হারিয়ে শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দেয়। কাৎ হয়ে পড়ে থাকে র’ক্তে ভেসে যাওয়া সাদা টাইলসের ওপর।
__________
সারাটা রাত ছটফট করেছে জিয়ান। কোথায় না খুঁজেছে? কিন্তু কোত্থাও নিতুর কোনো খবর পায়নি। চোখের পাতায় ঘুমও নেই এক ফোঁটা। সারা রাত কেটেছে তার সিগারেট খেতে খেতে। কিন্তু ঘুম আসেনি একটুও। সকালে একটু তন্দ্রাভাব আসলেও ঘুমটা গাঢ় হয়নি। বারবার স্বপ্নে সে নিতুকে দেখছিল। আর সত্যি ভেবে ঘুমটাও ভেঙে যাচ্ছিল। সে ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ৮:১০ মিনিট। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। পিপাসা মেটানোর জন্য পানি প্রয়োজন। কিন্তু এ ঘরে পানি নেই। ডাইনিং রুমে যেতে হবে। সে শোয়া থেকে উঠে বসে তখন তার ফোনটা বেজে ওঠে। নিতুর বাবা নূর-আমিন আহমেদ ফোন করেছেন। তিনি হঠাৎ এত সকালে কল দিচ্ছেন! তাহলে কি ঐ বাসায়ও জেনে গেছে নিতু যে নেই? দোনামোনা হয়ে ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করল জিয়ান। ওপাশ থেকে অনেকের একসাথে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ভয়ে তটস্থ হয়ে যায় জিয়ান। তার বুক কাঁপছে।
নূর-আমিন আহমেদ ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,
“নিতু সু-ই-সা-ই-ড করার চেষ্টা করেছে জিয়ান। হাত কে-টে-ছে। ব্লি’ডিং হয়েছে অনেক। আমরা ওকে নিয়ে এখন হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি তানহা হাসপাতালে চলে আসো।”
জিয়ান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তার কণ্ঠ কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। এমন কোনো খবর শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। নূর-আমিন আহমেদ কল কেটে দিয়েছেন। তৎক্ষণাৎ জিয়ান গায়ে শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। তার দু’চোখে বেয়ে পানি পড়ছে। ছেলে হয়েও সে কান্না আটকে রাখতে পারছে না। নিতুর এখন কী অবস্থা? ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে জিয়ান নিজেকে কী করে ক্ষমা করবে। একটা মিথ্যা কি এভাবে নিতুকে তার জীবন থেকে কেড়ে নেবে?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
বিঃদ্রঃ যেদিন তুমি এসেছিলে-২ রাত ৯-১০টায় পাবেন।]