তোমার পরিনীতা পর্ব ৩৫+৩৬

তোমার পরিনীতা -৩৫

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

দরকারী ফাইলগুলো গাড়িতে রাখতে বলে রামনাথের ঘরে এসে ঢুকলো শ্রাবণ৷ দুই ঘন্টা ধরে এক ভ্যাজালের কেস নিয়ে মিটিং হচ্ছিলো ওদের অফিসে, ম্যানেজার এসে জানালো রামনাথ আধা ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

আধাঘন্টা বাবা ওর জন্য অপেক্ষা করছে মানে! এতো রেড অ্যালার্ম। কনফারেন্স রুম থেকে প্রায় দৌড়ে বের হয়ে এলো শ্রাবন।

বাবার রুমের ভিতরে পা দেবার আগেই গলার টাই আর মাথার চুল ব্রাশ করে ঠিক করে নিলো আঙ্গুল দিয়ে,তারপর আস্তে করে দরজাটা চাপ দিয়ে খুললো, জানে এলোমেলো গেটআপ রামনাথের একদমই পছন্দ না।

“শ্রাবণ….. ।”

বাবার মুখে এমন স্বরে নিজের নামটা বহুদিন শোনেনি শ্রাবণ। মন আনচান করে উঠলো ওর।

ছোটবেলায় বেশ বাপ নেওটা ছিলো শ্রাবন, বদ্দার চাইতেও বেশি। বাবা বাইরে বের হওয়ার জন্য কাপড় পরলেই কান্না জুড়ে দিতো ও। সেই কান্না সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত রামনাথ বাধ্য হয়েই গাড়িতে চড়িয়ে মূল ফটক পর্যন্ত নিয়ে যেতেন ওকে, তারপর বহুদিনের চাকর ফটিককে দিয়ে ফের বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। এতোদিন বাদে বাবার কন্ঠের সেই নরম সুর শ্রাবণকে ছোটবেলা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো এক পলকের মধ্যে।

“আমায় ডাকছিলে বাবা? ”

“হ্যাঁ, এখানে এসে বসো।”

সোফায় বাবার পাশে বসতে বসতে, শ্রাবন বোকার মতো হাসলো। বাবা হঠাত ওকে কেন ডেকেছেন, তাও আবার এতো মোলায়েম সুরে। বাবা সাধারনত ওকে দেখলেই একটু ক্ষেপেই থাকেন, বাবার লক্ষীমন্ত ছেলে না বলে। আসলে শান্তুনুর মতো লক্ষী বাধ্য হওয়াটা ওর ঠিক ধাতে নেই।

এরপর মনে হলো, নতুন কোন জমি কেনার ব্যাপার থাকতে পারে। ওদের বাড়ির জমিজমার সব দলিল এখন শ্রাবণ দেখে। বদ্দার ব্যবসার আইনি ঝামেলাটাও ওই দেখে… সে জন্যই হয়তো খুঁজছে।

“একটা কথা বলতে চাই শ্রাবন, সেজন্য তোকে এতোটা কষ্ট দেয়া।”

“কষ্ট! কিসের কষ্ট? ”

রামনাথের কথাগুলে শ্রাবণের মাথার উপর দিয়ে গেলো। বাবা ওকে কিসের কষ্টের কথা বলছে!

” শ্রাবন, বাবা দেখ আমার বয়স হয়ে গিয়েছে।”

শ্রাবন বিনাবাক্যে মাথা নাড়ল। কথা সত্যি, বাবার বয়স হয়েছে।

” তা না হলে তোকে এখন দেশের বাইরে যেতে বলতাম না। ”

” দেশের বাইরে! বাইরে কোথায় বাবা? ”

” তোকে একটু জাপানে যেতে হবে। তোর রানী পিসি একটা কাজ নিয়ে আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন। ওর মেয়েটা ওখানে একা পেরে উঠছে না। তুই গিয়ে যদি ওদের সমস্যাটা দেখতে পারিস, অন্তত ওদের কি করা উচিত সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে পারিস তা হলে আর আমার যাওয়া লাগেনা।”

রানী পিসি! রানী পিসিটা আবার কে? শ্রাবন তাকে চিনতেই পারলো না। জীবনে নাম শুনেছে কি না সন্দেহ।

“বাবা, রানী পিসি.. আমিতো উনাকে ঠিক…”

” চিনতে পারছিস না… তাই তো? ”

” হমম ”

” সে আমার দূর সম্পর্কের বোন হয়, কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা রানীদের পরিবারের সাথে এক সময় আমাদের পরিবারের অনেক উঠা বসা ছিল। কিন্তু বিয়ের পর ও স্বামীর সাথে দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় যোগাযোগ ফিকে হয়ে আসে। রানীর আবার ওই একটাই মেয়ে… মোহনা, এবার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে আর রানী ওখানে একটা রেস্টুরেন্ট চালায়, রানীর স্বামী পঙ্কজদা বছর দুই হলো মারা গিয়েছেন। এখন আমি তোর মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোর মা তো যেতে রাজী হচ্ছে না। ”

” মা! মা কি করে যাবে, মাত্রই তো বাইরে থেকে ঘুরে আসলো আর ডাক্তার মাকে খুব বেশি কাজ করতে নিষেধ করেছে। ”

” সেটাই। তাই বলছি আমরা না গিয়ে বরং তুই গিয়ে সপ্তাহ দুই থেকে আয়, তুইতো এর আগেও জাপানে গিয়েছিলি, মোটামুটি চিনিসও… আমাদের চেয়ে তোর যাওয়াটাই ঠিক হবে।”

রামনাথ আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলেন। ছেলেকে বোধহয় তিনি রাজী করাতে পেরেছেন।

” কিন্তু বাবা আমার ভিসা এক্সপায়ার হয়ে গেছে অনেকদিন।”

” আমি রিনিউ করতে দিয়ে দিয়েছি… ওটা নিয়ে তোমার চিন্তার দরকার নেই, তুমি ব্যাগ গোছাও।”

শ্রাবণ বাবার কথায় মন খারাপ করে তাকিয়ে রইলো। বাবা আজ ওকে তুমি করে বলছেন। তারমানে বাবার মেজাজ আজ ভালো। কিন্তু
এখন ওর বাসা থেকে নড়ার কোন পরিকল্পনাই ছিলোনা আর বাবা ওকে জাপানে যেতে বলছে! একদম দূরদেশে…. সবাই এতো পাষান কেন?

“তাহলে সময় নষ্ট না করে তুমি কাপড় গোছাও। ভিসা হলেই রওনা হবে। ”

” হমম, ” বলে থম মেরে রইলো শ্রাবন। এখন ঝামেলা না থাকলে ও সুমোকে সাথে নিতে পারতো। অবশ্য সুমোরও ভিসা নেই, করতে হতো। তবে সেটা শ্রাবন ম্যানেজও করে ফেলতে পারতো যদি মহারানী ভিক্টোরিয়া ওর সাথে ওরকম না করতো।

রামনাথের ঘর থেকে বের হওয়ার পরও মেজাজ খিচড়ে থাকলো শ্রাবণের।

সুমোর সাথে ওর দেখা হয়না প্রায় দশদিন। ডাইনী মেয়ে একটা.. একটাবার ওর খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনা, এই বলে আবার ওর বউ! রাগে হাতের পেপার ওয়েটটা ছুড়ে দেয়ালে মারে শ্রাবণ।

” বেশ তেজ হয়েছে, যা থাক ওই আদিত্যর লেজে লেজে, দেখি কেমন তোর গুষ্টির ফরমায়েস রক্ষা করে সে। আজ এ বেলা চকলেট তো রাত দুপুরে আইসক্রিম গেলাও। আবার একটা না দুটো পিজা নেই শ্রাবনদা? প্রীতু আর ডাব্বু বড্ডো ভালোবাসে খেতে। আর এখন আদিত্যকে দেখে সেগুলো বেমালুম ভুলে গেছে। বেঈমান কোথাকার।”

শ্রাবনও জিদ ধরে থাকে, সুমো ওকে এড়িয়ে এরকম দূরে দূরে থাকলে ওউ সুমোকে না বলেই জাপানে উড়াল দিবে।

সুমন দরজার গায়ে আড়ি পেতে দাদু আর আদিত্যর সব কথা শুনছিলো। এটা এখন ওর প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাড়িয়েছে। আদিত্য এলেই আদিত্যর কাছে সুমনের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে থাকে দাদু… পারলে আজই ওকে বিদেয় করে এ বাড়ি থেকে।

সুমন মোবাইলের স্ক্রীনে শ্রাবণের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্রাবনকে কি ও একবার ফোন দিবে? কিন্তু একবার আসতে বললেও যে কথা ভাঙ্গা হবে। তখন?

সুমন ভেবেছিলো ও কথা না বললে শ্রাবন ঠিক চিৎকার করতে করতে ওকে নিতে চলে আসবে। হাত ধরে টানতে টানতে নিজের বাড়ি নিয়ে যাবে, মন্দিরে যেমন নিয়ে গিয়েছিলো। কয়দিন আর তার সুমোর উপর রাগ করে থাকবে? কিন্তু ওমা… সে তো দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,অফিসেও আসছে যাচ্ছে। সুমন যে ও বাড়ি যাচ্ছে না, শ্রাবণের সাথে যোগাযোগ করছে না, তা নিয়ে ভদ্রলোকের কোন হেলদোলই নেই।

সুমনের শ্রাবণের উপর তো বটেই, নিজের উপরও এখন রাগ হতে লাগলো। কি দরকার ছিলো সেদিন শ্বশুরের সামনে বুক ফুলিয়ে আত্মসম্মানের বড়াই করতে যাওয়ার। আসলে শ্রাবনদার মাথাটা যে একটা তরমুজ মার্কা মাথা সেটাই সুমনের মনে ছিলো না। আর তার খেসারতই এখন ওকে দিতে হবে। কিন্তু যদি বাড়ির সবাই মিলে আদিত্যর সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলে! সেদিন মনোরমা মাসি মামীর ঘরে ঢুকে কি যেন ফিসফিস করে বলছিলো, সুমন ভালো শুনতে পারেনি। তবে আদিত্য, সুমন এমন কিছু শব্দ বলছিলো। সুমনের তাই বাকিটা বুঝতে তেমন বেগ পেতে হয়নি, দরজার পাশে দাড়িয়ে মোবাইলে শ্রাবণের নামটার দিকে ওর বৃদ্ধাঙ্গুলিটা ছুঁয়ে যাচ্ছিলো বারেবার।

“তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়ে ছিল,
দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ।”

………………………..

আদিত্য বেশ আন্তরিক ভাবে বীরেন বাবুর কথা শোনে প্রতিদিন আর মনে মনে পরিকল্পনা করে, সুমনকে সে এক ফোঁটা দুঃখ পেতে দিবেনা কোনদিন। মেয়েটা এমনিতে অনাথ তার উপর মামা- মামীর সংসারে আশ্রিতা। আশেপাশের বাড়ির লোকগুলোই যে সুমনের প্রকৃত আত্মীয় সেটা এতোদিনে বুঝে গেছে সে।

“বুঝলে আদিত্য আমার সুমনের মতো মেয়ে লাখে একটা মেলে কিন্তু মেয়েটার কপাল খারাপ, তাই রাজরানী না হয়ে এই গরীবের ঘর আলো করতে চলে এসেছে। ”

” জ্বী দাদু… আমি জানি, আপনি শুধু শুধু আর চিন্তা করবেন না। আপনার সুমন একদিন রাজরানীর মতো সংসার করবে,আপনি শুধু ওর জন্য আশীর্বাদ করুন।”

” তাই যেনো হয়, তাই যেনো হয় ”

আদিত্যর আশ্বাস পেয়ে বীরেন বাবুর চোখের জল গড়িয়ে বালিশে পড়তে থাকে, সুমনকে সুখে সংসার করতে দেখে যেতে পারলে মেয়ের কাছে তার মুখটা থাকতো। তা না হলে সারাজীবন মেয়েটাতো শুধু মঞ্জুর কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যই পেল।

মনোরমার ফোন পেয়ে মঞ্জুর মুখটা আনন্দে জ্বল জ্বল করে উঠলো। ওরা আদিত্যর জন্য সুমনকে চায়। এ বাড়ির কারোরই এতে আপত্তি নাই, এমনকি যে শ্বশুরের সাথে মঞ্জুর দফায় দফায় বাজে তারও কোন আপত্তি নেই। মঞ্জু এই সুযোগে অনুজ আর ওর বউকে বাসায় ঢোকানোর ফন্দি আটতে থাকে।

একটা বার একটু ঘুরে দেখে যাবো? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে শ্রাবন। কিন্তু ও গেলেতো ম্যাডামের ওজন আরো বাড়বে, সুমো ওর বাড়ি আজকাল একেবারেই আসে না, ওর ঘরে আর কি আসবে? কিন্তু তারপরও আজ মন উচাটন। এলোমেলো পায়ে প্রীতিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে শ্রাবন।

শব্দ শুনতেই প্রীতি এসে দরজা খোলে।

“ও শ্রাবনদা তুমি… এসো এসো। ”

“প্রীতি সুমো কইরে? আজকাল মনে হয় তার আর অবসর হয়না। ”

না চাইতেও কথাটা বলতে গিয়ে স্বরটা খানিক বিকৃত হয়ে আসে শ্রাবনের। ওকে এতো কষ্ট দিয়ে কি মজা পায় সুমো কে জানে? কিন্তু তারপরও দশদিন পরে আজ সুমোকে দেখবে সেই আনন্দে, বুকের ভিতর বুনো বাদ্য বাজতে থাকে ওর।

“সুমন দিদি তো মায়ের সাথে মার্কেট গেলো।”

“মার্কেট.. সব্জি বাজার?”

“আরে না, না… আসলে, আদিত্যদার সাথে সুমনদির বিয়ের কথা হচ্ছে শ্রাবনদা। আমাদের বাড়িতে সবাই রাজি, কিন্তু ও বাড়ির মনোরমা মাসি বললো বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে নিজেরা একটু কথা বলা ভালো। তাই মা সুমনদিকে সঙ্গে করে মার্কেট নিয়ে গেলো। ”

কথাটা এতোটাই ভয়নক আর নোংরা লাগলো শ্রাবণের কাছে যে, শ্রাবন উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় রইলো না। কানের উপর বোমা পড়লেও বোধহয় ও এতো অবাক হতো না।

সুমো, আদিত্যর সাথে বিয়েতে রাজি! ওর বউ হয়ে সে আরেক পুরুষের সাথে সংসার করতেও রাজি, টাকা পয়সা তবে সুমোর কাছে এতো দামী! শ্রাবণ কি করে নিজের বাড়ি ফিরলো ও জানেনা। এলোমেলো পায়ে যখন ও ঘরে ঢুকলো সমস্ত পৃথিবী তখন ওর ঘেন্নায় ছেয়ে গেছে। ভালোবাসা বলে তাহলে কিচ্ছু নেই… চোখের সামনে বড় হওয়া মানুষকেও বিশ্বাস করতে নেই, হায় সেলুকাস।

“প্রেমে পড়া বারণ,
কারণে অকারণ,
ওই মায়া চোখে চোখ রাখলেও ফিরে তাকানো বারণ।

প্রেমে পড়া বারণ…………………………..”
তোমার পরিনীতা -৩৬

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

শ্রাবণ এসেছিলো শুনে সুমনের মনের মধ্যে মাদল বাজতে লাগলো। গা ঝিমঝিম করে ওঠে , শ্বাস আটকে আসতে চায়… এসেছিলো তবে নিষ্ঠুরটা অবশেষে।

প্রতিদিনই শ্রাবণ এখন সেই সকাল করে কাজের জন্য বের হয় আর সেই সন্ধ্যে করে বাড়ি ফেরে। সুমন তক্কে তক্কে থাকে, বাবু নেমে এলেই টুক করে গলা বাড়িয়ে একবার জানালা দিয়ে দেখে নেয় গাড়িতে ওঠার আগেই, এতে সুমনের স্বস্তি হয় কিন্তু জ্বালা কমেনা, চোখের জলও বাঁধা মানেনা।

কিন্তু আজ যে সে নিজে থেকে এসেছিলো ওকে খুঁজতে, নতুন চাঁদের মতো একফালি সরু হাসি ঝিকমিক করে উঠে সুমনের ঠোঁটের কোণে।অনেক করে নিজেকে বোঝায় যে ফোন করবেনা, করা মানা … কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের লোভের কাছে হার মানে। বেহায়া মন আস্তে করে নিজের পক্ষ হয়ে ওকালতি করে, “তুই কোথায় যাচ্ছিস সুমো… সেই তো এসেছিলো রাগ ভেঙ্গে। আজ না বললে কিন্তু ভারী অন্যায় হবে বেচারার সাথে।”

সুমনের বুকের মধ্যে আনন্দের একটা হালকা ঢেউ উঠে কিন্তু তারপরই আবার সেই থাপ্পরটা কানে বাজে।

” কিন্তু সেদিনো তো সে নিজে থেকেই এসেছিলো? ” মন চোখ রাঙ্গায়।

” ও… ও সেদিন আমার মাথার ঠিক ছিলোনা আর অমন রাক্ষসের মতো করছিলো সে, আমার হাত আতকা উঠে গিয়েছিলো,” মিনমিন করে বলে সুমন। জানে ধোপে টিকবেনা এই যুক্তি, শ্রাবন বরাবরই অমন বুনো ছিলো।

” তা হলে আরকি… কর্মফল ভোগো, ” মন ভেঙচি কাটে।

” ভুগছি নাতো কি… কবে থেকে মুখটা ভালো করে দেখিনা, কথাও শুনিনা। সারারাত ঘুমের মধ্যে ছটফট করি আর কাঁদি। আরও কত শাস্তি পাওনা আছে বলতো?” সুমন এবার সত্যি রেগে ওঠে। এক থাপ্পর দিলোই না হয়, ও সারাজীবন কম থাপ্পর খেয়েছে যে একটাতেই এতো রাগ হতে হবে?

” তা হলে আর কি শর্ত ভাঙ্গো।” কেউ উত্তরটা দিয়েই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

সুমন আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করেনা, হাত গুলো ফড়িং এর মতো নাচতে থাকে পরিচিতো নামটা জুড়ে। ছুঁয়ে দিয়ে তবে শান্তি, অনেকদিন পর ফোনটা কানে চেপে ধরে মনে হয়, হাত বাড়ালেই প্রিয় মানুষটার গায়ের ঘ্রান পাওয়া যাবে।

আধো ঘুমে শ্রাবনের একবার দুবার মনে হলো ফোনটা ওর বালিশের নিচে বাজছে কিন্তু এখন ওর প্রচুর ঘুম দরকার। আর পারছে না এই যন্ত্রনা সহ্য করতে, ঘরে ফিরেই তাই আগে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছে।

ফোন দিয়ে মনটা খারাপ হওয়া ছাড়া আর কিছুই হলোনা সুমনের। দশ বারের পর জেদ চাপলো, আরও দশবার টানা কল করলো কিন্তু ফলাফল শূন্য। মনটা এবার সত্যি ভার হয়ে এলো, আজ যে ওর শ্রাবণের সাথে কথা বলা সত্যি জরুরি ছিল।

.

.

.

মঞ্জু আজ ভারী ব্যাস্ত, আদিত্য কি করে, কোন জাদুবলে যে তার অমন জাঁদরেল শ্বশুরটাকে পটালো, কে জানে? তবে যেভাবেই হোক এতে অনুজ তার বউ নিয়ে আজ বাড়ি আসার অনুমতি পেয়েছে, মঞ্জু এতেই অনেক খুশি। সাথে মনোদিদি যা বললো সেটা হলে বাড়ির সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে, ব্যাস্তসমস্ত হয়ে মঞ্জু দ্রুত রান্নাঘরে যেয়ে ঢোকে।

আজ আর কোন কিছুর তোয়াক্কা করেনা সুমন। প্রয়োজন আজ ওর মাথার উপর দিয়ে উঠে যাচ্ছে, পারলে এক ছুটে শ্রাবণের সামনে গিয়ে দাড়ায় সুমন।

সুমনকে এরকম হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসতে দেখে থামতে বাধ্য হয় শ্রাবণ। আদিত্যর সাথে বিয়ের খবরটা সুমন এখনি দিবে নাকি ওকে?

” কি ব্যাপার? ”

সুমনের শ্বাস টানতে রীতিমতো কষ্ট হয়। আজকাল প্রায়ই এমন হচ্ছে।

” একটা কথা ছিলো ” সুমনের বুকটা মুচড়ে ওঠে, কতদিন পর সামনে থেকে দেখলো মানুষটাকে। এত্তো রাগ, ওর কপালে যে কি আছে কে জানে?

সুমনের কথায় গা গুলিয়ে আসে শ্রাবণের। মেয়ে মানুষ এতো নির্লজ্জ হয়!

” বল, কি বলবি।”

“এখানে না তুমি বাড়িতে চলো।”

সুমন আজ নারকেলের তক্তি বানিয়েছে মামীর সাথে বসে, অনুজদার বৌ লিলিয়ান আজ বাড়ি আসবে বলে। সুমন সেখান থেকে নিজের নাম করে তিনটে সরিয়ে রেখেছে শ্রাবণের জন্যে।

” এখন আমার সময় হবেনা সুমন, বাড়ি ফিরি তখন কথা হবে।”

সুমন নামটা কেমন পেরেক পোতার মতো কানে এসে লাগলো সুমনের। শ্রাবণতো তাহলে এখনও ওর উপরে রেগে আছে! কিন্তু প্রীতিযে বললো ওকে খুঁজতে এসেছিলো সে।

“আর কিছু? আমার লেইট হচ্ছে। ” শ্রাবন হাত উল্টে নিজের ঘড়ি দেখে।

শ্রাবণের রুক্ষ স্বরে আরও খানিকটা টালমাটাল হয় সুমন। কিন্তু আজ যে ওর কথা বলা সত্যি বড় প্রয়োজন। মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করে সুমন,” একটা জরুরি কথা শোনারো সময় হবে না ? ”

” জরুরি! আমার সাথে আবার কি এতো জরুরি ? ”

” বারে তাহলে কার সাথে থাকবে?”

” কেন আদিত্যর নাম ভুলে গেছিস নাকি, আজকাল তো তোদের চলা ফেরা, খাওয়া -দাওয়া, ঘোরাঘুরি সব একসাথেই হয়। জরুরি কথাগুলোও সেখানে বলাই ভালো।”

সুমন বুঝতে পারে কাল বাইরে গিয়েছিলো আদিত্যর সাথে, সেটা শুনেই ক্ষেপেছে। কিন্তু ওর যে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার আছে শ্রাবনকে।

“আমি কাল ইচ্ছে করে যাইনি, মামী নিয়ে গিয়েছিলো সাথে করে।”

” ওফফ… সরি সরি, সেজন্যই বুঝি আজকাল আমার বাড়িতে যাবার পথটা মাড়ানোও হয়না? ”

শ্রাবনের উত্তপ্ত মস্তিষ্কে আজ সুন্দর স্বাভাবিক কথাগুলোও বিবর্ন আর কুৎসিত লাগছে, সুমনের কৈফিয়ত তাই শ্রাবনের কাছে একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। একটানে গাড়ির দরজাটা খুলে সোজা গাড়িতে উঠে বসে সে সুমনকে কোন রকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে , তারপর সোজা অফিসের দিকে রওনা হয়।

“সুমন! ”

সমীরের ডাক শুনে দ্রুত চোখের পানিটা মুছে নেয় সুমন। ওর কষ্টের ভার আসলে কেউ বইতে চায় না, শ্রাবনও না। ভীষন একদলা অভিমান পাকিয়ে উঠে সুমনের বুকের মধ্যে। এক ফোঁটা বিশ্বাস করেনা ওকে বর্বর, পাষন্ড ডাকাতটা।

“এখানে পথের মাঝে দাড়িয়ে কি করছিসরে মা ?”

” কিছু না, শ্রাবনদাকে বলছিলাম বড়মাকে একটু বাসায় নিয়ে আসতে।”

” ওহ… আচ্ছা আচ্ছা। তা ভালো করে বলেছিস তো? বৌদি না এলে তো অনুষ্ঠানই সম্পূর্ণ হবে না।”

” হমম.. বলেছি।”

” আচ্ছা, আমি অফিস থেকে আসার সময় আর একবার দেখা করার চেষ্টা করবো। এই অনুজটার জন্য তো মান সম্মান আর কিছুই বাকী রইলো না, পরিচিতো মানুষদের সাথে কথা বলতেও আজকাল লজ্জা লাগে।”

সুমন নিরুত্তর হয়ে দাড়িয়ে থাকে। অনুজদার কারন, কি অন্য কিছু কিন্তু ওর জীবনের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা স্পষ্ট দেখতে পায় সুমন।

নিজের কেবিনে এসে বসার পরেও শ্রাবণের মেজাজ ঠান্ডা হলো না। সুমনের এতো বড় সাহস… নিজের মুখে এসেছে আদিত্যর সাথে ওর বিয়ের খবর শ্রাবনকে শোনাতে। শ্রাবণের ইচ্ছে হচ্ছিলো জায়গাতেই গলা টিপে সুমনকে মেরে ফেলে কিন্তু পরে মনে হয়েছে, কোন একজন বেঈমানের জন্য ও কেন নিজের সুন্দর জীবনটা নষ্ট করবে? সুমনের যদি আদিত্যতে এতোই মুগ্ধতা কাজ করে তাহলে যাক, করুক তাকে বিয়ে। শ্রাবনও ওর জন্য আর বসে থেকে নিজের জীবন নষ্ট করবে না। আজই ও বাবার কথামতো জাপানে যাওয়ার প্লেনের টিকিট কাটবে।

…………………………………..

“সুমনদি শুনেছো? ”

“কিরে? ”

“তোমার শাশুড়ি আসছে আজ তোমায় দেখতে। ”

গায়ে দেয়ার কাঁথাটা ভাজ করছিলো সুমন। প্রীতির কথা শুনে সেটা হাত থেকে খসে সোজা নিচে গিয়ে পড়ে।

“প্রীতি তুই কার কাছে শুনলি একথা? ” সুমন কাঁদো কাঁদো সুরে জানতে চায়।

” মনোরমা মাসি এসেছেন, ঠাকুরদার ঘরে তোমার আর আদিত্যদার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে, কত লোক নেমতন্ন করবে, মেনুতে কি থাকবে সব। ”

” প্রীতি তুই বিছানাটা একটু গোছাবি আমি একটু ও বাড়ি থেকে আসছি।”

“ও বাড়ি যাবে! কাকাবাবু যদি কিছু বলে,আজকাল ও বাড়ির দিকে তাকাতেও আমার ভয় করে।”

প্রীতির কথায় সুমনের বুকটাও যে কেঁপে উঠলো না তা নয়, কিন্তু এখন তো যে কোন ভাবে শ্রাবণের সাথে ওর কথা বলতে হবে। মান সম্মান ওর এখন এমনিতেই শিকেয় উঠছে, বাইরের লোকের চাইতে না হয় ঘরের লোকের কাছেই অপমানিতো হলো।

” তবুও একবার যাবো…. বড়মা, শ্রাবনদা তো সবটা জানেনা,” গলা বুঁজে আসে সুমনের। কি কপাল ওর।

“হ্যাঁ বড়মাকে তো বাবা- মায়ের যেয়ে বলা উচিত। ”

“সে উচিত কিন্তু আমি আগে যেয়ে বলে আসি। না হলে বড়মা আমার সাথে কথাই বলবে না কোনদিন আর শ্রাবনদার যে রাগ, বাব্বা।”

” আচ্ছা আচ্ছা তাহলে যাও কিন্তু শ্রাবনদাকে মনে হয় পাবেনা।”

” পাবনা….কেন! … এতক্ষণে তো বাড়ি চলে আসার কথা।”

” বাড়ি এসে আবার এয়ারপোর্টে চলে যেতে দেখলাম যে।”

” এয়ারপোর্টে মানে? ”

” জার্মান না জাপান কোথায় যেন গেলো শ্রাবনদা,বড়মা দেখলাম অনেক কিছু বলে দিলো যাবার সময়। দুটো বড়ো বড়ো সুটকেস নিলো সাথে,অনেকদিন থাকবে বোধহয় সেখনে শ্রাবনদা,” প্রীতি বললো।

সুমনের আর এক পাও এগুতে ইচ্ছে হলোনা। ওর আর কোথাও যাওয়ার নেই, মানুষের যদি ইচ্ছেমৃত্যু হতো তবে আজ ওর সেটা হয়ে গেলো। এরপর বোধহয় দেহটাকে শুধু শুধু বয়ে বেড়াতে হবে ওকে অনন্তকাল।

আকাশের সীমানাটা যখন চোখের দেখার বাইরেও কেবল বাড়তে থাকে, শ্রাবন তখন একমনে পাশের দৃশ্যগুলো দেখছিলো। জানালার একদম পাশের সিটটা ওর বলে সূর্যের আলোর তীব্রতা হঠাত হঠাত খুব বেড়ে যাচ্ছিলো আবার কমছিলে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে চোখ বন্ধ করলেই কেন যেন সুমোর মুখটা ভেসে উঠছে বার বার । তাতে সুমোর চোখের কাজলটা একটুখানি লেপ্টে আছে, বেনীগুলো দুমড়ে মুচড়ে গোল হয়ে উঠেছে , চোখদুটো জলে ভরা কেবল সিথির কাছের সেই লাল ফোটা সিঁদুরটুকু অমনি আছে। শ্রাবণ অজান্তেই ঢোক গিললো, এখনতো সুমোর হাসি হাসি মুখটা ওর দেখার কথা, তার বদলে এমন মলিন চেহারাটাই কেন ওর বার বার মনে আসছে?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here