#দখিনা_হাওয়া
#মারিয়া_আক্তার
[০৮]
বিন্দুর পুরো দুনিয়া এখন ওলোটপালট লাগছে। নিজেকে কেমন যেন অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে নিজের কাছে। এমন একটা মুহূর্তও যে বিন্দুর জীবনে আসবে, তা তার কল্পনাতীত ছিল। বিন্দু নির্জীব দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বিন্দুর এখন কি বলা উচিৎ তা বিন্দু জানে না।
– কিরে মা, কোনো কথা বলছিস না কেন? কিছুতো বল।
কবির শেখের প্রশ্নে বিন্দু নড়েচড়ে বসে। ভোঁতা ভাবনাগুলোকে একমুহূর্তের জন্য দূরে ফেলে দেয়। বাবার ধরে রাখা হাতটার ওপর নিজের ডান হাতটা রেখে মলিন হেসে বলে,
– তুমি এসব কেন বলছো বাবা? এখন এ অবস্থায় বিয়ে নিয়ে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই বাবা। তুমি আগে সুস্থ হয়ে নাও, তারপর এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।
– না মা, এখনই এসব নিয়ে কথা বলার সময়। তুমিতো জানো আমার রিটায়ারমেন্টের আর বাকি একমাস। তারপর আমাদের গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আমার চাকরীটা থাকা অবস্থায় আমি তোমার বিয়েটা দিয়ে যেতে চাই মা।
– তোমার রিটায়ারমেন্টের একমাস বাকি তো কি হয়েছে? আমরা তারপর সবাই গ্রামে ফিরে যাবো।
– নারে মা। আমি একটা ভালো ঘরে তোর বিয়ে দিতে চাই। পরে হয়তো সেটা সম্ভব না। আর আমার শরীরের যা অবস্থা, কদিন বাঁচি তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে।
– বাবা! এসব কি বলছো তুমি? আমাদের ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না। সবসময় আমাদের সাথেই থাকবে তুমি।
বিন্দু জোরে বলে ওঠে। কবির শেখ হেসে ফেলেন।
– পাগলী মেয়ে আমার। এই পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী নয়। একদিন সবাইকে মরতে হবে। তুমি রাজি হয়ে যাও না বিন্দু। আমি তোমায় কখনো কোনো কিছুতে জোর করি নি। তোমার ইচ্ছাকে সর্বদা প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। সর্বাবস্থায় তোমার মতামতকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। আজও দিচ্ছি তবে আমি এটাও চাইছি তুমি হ্যাঁ বলো। তোমার এটা মনে হতে পারে, বাবা তোমার মতামতও চাইছে আবার তুমি কি বলবে সেটাও ঠিক করে দিচ্ছে তাহলে বলবো হ্যাঁ আজ তোমার বাবা তোমার অনুরোধ করছে। আমি আজ চাইছি তুমি আমার মতামতকে মূল্য দাও।
বিন্দু কোনো উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ বসে আছে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার। উত্তর মিলাতে পারছে না সে।
– বিন্দু মা, উত্তর দিচ্ছো না যে? আমি তোমার ভালো চাই মা। তোমায় সুপাত্রের হাতে তুলে দিয়ে যেতে চাই আমি। আরাধ ছেলেটাকে আমার খুব ভালো লাগে। ছেলেটা খুব দায়িত্ববান। এমন একটা ছেলের হাতে তোমায় তুলে দিয়ে মরতে পারলেও আমার শান্তি।
– বাবা, বারবার এসব কেন বলছো তুমি?
– আচ্ছা আর বলবো না। তুমি বলো তুমি বিয়েতে রাজি।
– আরাধ মির্জা কি রাজি এই বিয়েতে?
একমুহূর্তের জন্য বিন্দু ভুলে গিয়েছিল আরাধের সেদিনের বলা কথাগুলো। আরাধতো বলেছিল সে বিয়েতে রাজি নয়। এখন বাবা সেসব জানলেই হলো। আর বিয়েটা করতে হবে না। বিন্দুযে চায় বাবাকে সাহায্য করতে। বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে। বোনটার ভালো ঘরে বিয়ে দিতে। এখন যদি তার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে এসব কিছুই করতে পারবে না।
– আরাধ রাজি এই বিয়েতে। তোমায় সেসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
বিন্দুর অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরাধতো বলেছিল সে এই বিয়েতে রাজি নয়। তাহলে?
– তুমি নিশ্চিত জানো বাবা? আরাধ মির্জা নিজে তোমায় বলেছিলতো?
কবির শেখ মুচকি হেসে বলেন,
– হুম। আরাধ নিজেই তার বাবাকে বলেছে বিয়েতে সে রাজি।
বিন্দুর মস্তিষ্ক কাজ করা যেন বন্ধ করে দিয়েছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। বিন্দু বাবার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কবির শেখকে একটু আসছি বলে বাহিরে চলে যায়। বাহিরে গিয়ে অনবরত আরানকে ফোন করে। আরাধের নাম্বার নেই। একদিন আরাধ কল দিয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নাম্বারটা ডিলিট হয়ে গেছে। তাই আরানকেই কল করছে যাতে আরাধের সাথে কথা বলতে পারে। কিন্তু আরাধ ফোন রিসিভই করছে না। বিন্দু ধৈর্যহারা ফোনটা পাশের চেয়ারের ওপর শব্দ করে রেখে দেয়। সাথেসাথে বিন্দুর মোবাইলের রিংটোন বেঝে উঠে। বিন্দু সাথেসাথে রিসিভ করে, কেননা ফোনটা আরান করেছে।
– হ্যালো আরান, আমাকে তোর..।
– বিন্দু মা।
বিন্দু পিছনে ফিরে তাকায়। বিন্দুর পিছনে আলী আকবর মির্জা আর নয়না বেগম দাঁড়িয়ে আছে। ওনারা নিশ্চয়ই বিন্দুর বাবাকে দেখতে এসেছেন। বিন্দু আরানকে একটু পরে কল করছি বলে কলটা কেঁটে দেয়। বিন্দু আলী আকবর মির্জার সামনে গিয়ে ওনাদের সালাম দিয়ে বাবার কেবিনের দিকে নিয়ে যায়। বাবাকে একটু পরই বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার বারেবারে বলেছে ওনাকে যাতে সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত রাখা হয়। কোনো কারণে যেন উনি মনোকষ্ট না অনুভব করেন।
– আপনাকে তো তাড়াতাড়ি ফিট হতে হবে ভাই। সামনে মেয়ের বিয়ে আপনার। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুনতো। তারপর দুই বেয়াই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিবো।
অনেকক্ষণ খোশগল্প করার পর আলী আকবর মির্জা কথাটা বলে উঠেন কবির শেখকে। কবির শেখও মুচকি হাসেন।
– ভাই বলছিলাম কি, আরাধের সাথে কথা বলেছিলেন এই নিয়ে? সে মত দিয়েছেতো বিয়েতে?
বিন্দুও উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে আলী আকবর মির্জার দিকে। বাবার মত সেও জানতে চায় উত্তর।
– হ্যাঁ ভাই, আমার ছেলে হ্যাঁ বলেছে বিয়েতে। ওর তরফ থেকে কোনো সমস্যা নেই। বিন্দু মা..।
উনি কথাটা বলে বিন্দুর দিকে তাকান। বিন্দু খানিকটা বিব্রতবোধ করে এতে। সে সাথেসাথে মাথাটা নুইয়ে ফেলে। কবির শেখ মুচকি হেসে বলেন,
– আমার মেয়ের তরফ থেকে কোনো না নেই। ও শুধু জানতে চেয়েছে আরাধ রাজি কিনা। এখন যেহেতু আরাধ রাজি তাহলে আমার মেয়েরও আর কোনো সমস্যা নেই। তাই না বিন্দু?
বিন্দু বাবার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায়। বাবার চোখে আজ খুশি দেখতে পাচ্ছে বিন্দু। বাবা খুব খুশি এই বিয়েতে। তাহলে আমি কি করে না করবো এই বিয়েতে? এমনটা ভেবে বিন্দু মাথা নাড়ায় অর্থাৎ তার কোনো সমস্যা নেই। আলী আকবর মির্জা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন।
– তাহলে ভাই, বিয়ের তোরজোর শুরু করে দিই। শুভ কাজে দেরি করতে নেই। কি বলেন?
কবির শেখও হাসতে হাসতে বলেন,
– অবশ্যই।
বিন্দু দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সবাই ভাবে বিন্দু লজ্জা পেয়েছে।
______________
– কিরে তখন এতবার কল দিলি। তারপর আমি যখন কল দিলাম তখন কেঁটে দিলি বলবি পরে কল করবি। আর এখন কথাই বলছিস না কি হয়েছে? আঙ্কেলের অবস্থা এখন কেমনরে? আমিতো একটু আসতেও পারছি না। ভাইয়া আর আমি কালকে চট্রগ্রাম আসছিলাম একটু দরকারে। তাই আঙ্কেলকে একটু দেখতে যেতেও পারছি না। আর আজই ঢাকায় ফিরবো। একটু পরই রওয়ানা হবো। কিরে তখন থেকে আমিই শুধু কথা বলছি তুই কোনো কথা বলছিস না কেন?
বিন্দু চোখের পানিটুকু মুছে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
– বাবা এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। বাসায় নিয়ে এসেছি বাবাকে। আর তখন এমনিই কল দিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি তোর সাথে পরে কথা বলবো আরান। আমায় বাবার কাছে যেতে হবে।
– আচ্ছা। এখন যা তাহলে। আমি ঢাকায় পৌঁছেই আগে তোদের বাসায় আসবো।
– আরান আমার ফোনটা কোথায়?
বিন্দু মোবাইলটা রেখে দিতে নিচ্ছিলো কিন্তু ফোনের ওপাশের আরাধের কন্ঠ পেয়ে মোবাইলটা কানেই ধরে রাখে। আরাধের কণ্ঠস্বরটা বিন্দুর খুব পছন্দের। আরাধের সামনে কথা বলতে গেলে বিন্দুর নিজেরই লজ্জা লাগে। এমনটা নয় যে বিন্দু গলার স্বর মোটা। তারপরও বিন্দুর চাইতে আরাধের কণ্ঠস্বর সুন্দর। বিন্দু আরাধের কন্ঠস্বরের প্রেমে পড়েছে যেদিন আরাধের কন্ঠ প্রথম শুনেছে। বিন্দু নিজে নিজেই হাসে। সবাই মানুষের প্রেমে পড়ে। কিন্তু বিন্দু উল্টো। বিন্দু মানুষটার কন্ঠের প্রেমে পড়েছে। বিন্দু এই মানুষটার প্রেমে পড়তেও পারবে না। কারণ মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসে। যে অন্য একটা মানুষকে ভালোবাসে, তাকে বিন্দুর বিয়ে করতে হবে। কি আজব দুনিয়া! বিন্দু এতক্ষণ আরাধের কথা ভাবছিল। আচ্ছা আরাধ কেন রাজি হলো বিয়েতে? তাহলে সে কি তানিয়াকে খুঁজে পায়নি। বিন্দু আর কিছু ভাবতে পারছে না। মোবাইলটা রেখে এবার ঠিকঠাক হয়ে বসে। কঠিন কিছুর জন্য নিজেকে তৈরি করে বিন্দু।
____________
– নতুন বউ কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে? তাড়াতাড়ি আম্মুকে আসতে বলো মামি।
আরানের মামিকে কথাটা বলে আরান বিন্দুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নয়না বেগম মুচকি হেসে সদর দরজার সামনে আসেন। ওনাদের আগের যুগের যত রিচুয়্যালস আছে সব পূরণ করে বিন্দুকে ঘরে প্রবেশ করান। বিন্দু গুটিঁগুঁটি পায়ে মির্জাবাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। আজ থেকে সে এই মির্জাবাড়ির বড় বৌ।
চলবে…