দহন পর্ব ৫

#দহন
#পর্ব_৫
#লেখা_মিম

শিমুল অনিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
-” তোমার কি ধারনা এত সহজে তোমার পিছু আমি ছাড়বো? উহুম….. আমি যদি মরেও যাই ভূত হয়ে তোমার সাথে সাথে ঘুরবো।”
-” মরার কথা বলো কেন? এসব কথা বলবা না। আমি কষ্ট পাই।”
-” আচ্ছা হয়েছে। অনেক কান্নাকাটি করেছো। এখন থামো। অনেকবেলা হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে আসো। এরপর একসাথে নাস্তা করবো।”
শিমুল তার এফবি প্রোফাইল পিকচার আপলোড দিচ্ছে। অনিম আর তার মালা বদল হচ্ছে সে ছবিটা আপলোড করলো সে। ক্যাপশন লিখেছে, “একই সুতোয় বাঁধা তুমি আর আমি।” ছবি আপলোড দেয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মুহিবের কমেন্ট আসলো,
-” সুতো তো টান লাগলেই ছিঁড়ে যায়।”
শিমুল রিপ্লাই দিলো,
-” কাপড়ের সুতা টান লাগলে ছিঁড়ে কিন্তু মনের সুতা হাজার টানলেও ছিঁড়ে না।”
-” ছিঁড়ে…..ছিঁড়ে….. কৌশলে টানতে জানলে সব সুতাই ছিঁড়ে।”
শিমুল পাল্টা উত্তর দিতে যাবে ঠিক সে সময় অনিম শিমুলকে ডাকলো,
-” শিমুল খাবারের প্লেট বেডরুমেই নিয়ে আসো। এখানে বসেই খাবো।”
শিমুল আর এক মুহূর্ত দেরী না করে খাবার নিয়ে অনিমের সামনে উপস্থিত হলো। উত্তরটা আর মুহিবকে শিমুলের দেয়া হলো না।
-” শিমুল আমাকে খাইয়ে দিবা?”
-” হা করো।”
শিমুল অনিমকেও খাওয়াচ্ছে নিজেও খাচ্ছে। মুহিবের ফোন আসলো অনিমের মোবাইলে।
-” কি রে ব্যাটা শিমুলকে পেয়ে তো আমাকে ভুলেই গেছিস। আগে তো সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে ফোন করতি। আর আজকে একটা ফোনও দিস নি।”
-” ঘুম থেকে আজকে উঠতেই দেরী হয়েছে।”
-” যাই হোক, আমি তোর সাথে একটু দুষ্টামি করলাম। গতকাল তোর বিয়ে হয়েছে আজকে দেরী করে ঘুম থেকে উঠবি এটাই স্বাভাবিক। তারপর….. তোদের কি অবস্থা বল? শিমুল কেমন আছে? কি করছিস তোরা?”
-” নাস্তা করি। শিমুল আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর আমি খাচ্ছি।”
-” বেশ ভালোই তো আদর যত্ন পাচ্ছিস। তোর সুখ দেখলে আমার গা জ্বলে রে অনিম। হা হা হা।”
-” এই কথা আমি কখনোই বিশ্বাস করবো না যে আমার সুখ দেখলে তোর হিংসা হয়। তুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আমার ভাইয়ের মতো তুই। আমি জানি তুই সবসময়ই আমার সুখ চাস।”
-” আচ্ছা শোন….. বিকেলে শিমুলকে নিয়ে চল বেড়াতে যাই। পুরো বিকেল ঘুরবো। এরপর রাতে আমি তোদের খাওয়াবো।”
-” নাহ্ তুই কেনো খাওয়াবি? এক কাজ কর তোরা সব বন্ধুরা রাতে আমার বাসায় আয়। শিমুল তোদের রান্না করে খাওয়াবে।”
-” না, ও নতুন বউ। ওকে এখনই এত ঝামেলার মধ্যে ফেলে দিস না তো। আরো কিছুদিন যাক এরপর আমরা সবাই আসবো। আজকে আমি তোদের খাওয়াবো। এটাই ফাইনাল। আর কোনোকথা হবে না।”
-” আচ্ছা যা…. তোর কথাই রইলো।”
ফোনটা কাটার সাথে সাথেই শিমুল অনিমকে জিজ্ঞেস করলো,
-” কিসের খাওয়ার কথা বলছিলে তুমি?”
-” মুহিব ফোন দিয়ে বললো তোমাকে নিয়ে বিকেলে বের হতে। পুরো বিকেল ঘুরবো। এরপর রাতে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে তারপর বাসায় ফিরবো। আজ মুহিব আমাদের ট্রিট দিবে।”
-” মুহিব ভাই ট্রিট দিবে? কেন?”
-” এমনিই।”
-” এটা কেমন কথা অনিম? আমাদের গতকালই মাত্র বিয়ে হয়েছে। আমরা বাইরে ঘুরতে যাবো ঠিকাছে। কিন্তু মুহিব ভাইয়ের সাথে কেন যাবো? যাবো শুধু তুমি আর আমি। এটা তো উনার বুঝা উচিত। আর তুমিও কি না উনাকে হ্যাঁ বলে দিয়েছো!”
-” আহ্, শিমুল তুমি ব্যাপারটা এভাবে নিচ্ছো কেন? আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড। ও একটু শখ করেছে আমাদের নিয়ে বেড়াতে যাবে। এই ছোট একটা ব্যাপারে তোমার চেহারার নকশা কেন পাল্টে যাচ্ছে?”
-” তুমি না কিচ্ছু বুঝো না অনিম। আমি আজ তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। তোমাকে ডিনার ডেটে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান আজ আমার। রেস্টুরেন্টের টেবিলও বুক করে ফেলেছি। অথচ তুমি কি না মুহিব ভাইকে হ্যাঁ বলে দিয়েছো আমাকে না জিজ্ঞেস করেই। এখন তোমার জন্য আমার প্ল্যান cancel করতে হবে।”
কথাগুলো শিমুল বেশ রাগ দেখিয়েই অনিমকে বললো। অনিমের ভেতরেও কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করছে। ঠিকই তো, তার তো উচিত ছিলো শিমুলকে একবার জিজ্ঞেস করে নেয়া শিমুল বিকেলে যেতে ইচ্ছুক কিনা। শিমুলের নিজেরও তো কোনো প্ল্যানিং থাকতে পারে বিকাল অথবা রাতের জন্য। শিমুল প্ল্যান করছে তাকে নিয়ে একান্তে কিছু সময় কাটানোর আর সে কি না বউ কে নিয়ে বন্ধুর সাথে ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান করছে। নিজের মাথা নিজেরই দেয়ালে ঠুকাতে ইচ্ছে তার। সে নিজের মনেই প্রশ্ন করছে,
-” এতবড় গাধা কেন আমি?”
সে শিমুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ স্যরি বউ ভুল হয়ে গেছে। তুমি তো জানোই আমি একটা গাধা। এবারের মতো এই গাধাটাকে মাফ করে দাও। এরপর থেকে আর হবে না আমি এখনই মুহিবকে না করে দিচ্ছি। তুমি আজকে শুধুমাত্র তোমার এই গাধাটার সাথেই একান্তে সময় কাটাবে।”
অনিমের কথা শুনে হেসে ফেললো শিমুল। অনিম হাতে পায়েই লম্বা হয়েছে যা। ওর আচরন এখনও ছোট বাচ্চাদের মতই রয়ে গেছে। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে শিমুল। অনিম শুধুমাত্র শিমুলের সাথেই এমন বাচ্চাদের মতো আচরন করে কিন্তু আর সব মানুষের সাথে সে একদম স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে। হতে পারে অনিম শিমুলের সাথে এমন বাচ্চাদের মত আচরন করে কারন সে চায় শিমুল সবসময় তাকে আগলে রাখুক।

দুপুরে খাওয়া শেষে শিমুল শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে রেখেছে কিন্তু ঘুমায়নি। অনিম ফোনে কথা বলছে বিগত পনেরো মিনিট যাবৎ। ফোনে অনিম রাজনৈতিক আলাপ করছে নাকি ব্যবসায়িক সেটা শিমুলের জানা নেই। অবশ্য শিমুলের জানার কোনো আগ্রহও নেই। তার মতে স্বামীর সব ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করার কোনো মানে হয়না। প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব কিছু ব্যাক্তিগত ব্যাপার আছে যেটা সবার সাথে ভাগাভাগি করা যায় না। অনিম যদি তার সাথে নিজ থেকে তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো জানাতে চায় তবেই শিমুল সেটা আগ্রহ নিয়ে শুনবে। অনিমের কথা শেষ করে শিমুলের পাশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। শিমুলের কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
-” তুমি তো কখনো দুপুর বেলা শোও না। আজ হঠাৎ শুয়ে আছো যে?”
-” মাথাটা ঝিমঝিম করছে।”
-” কি বলো? কখন থেকে?”
-” আধাঘন্টা যাবৎ।”
-” তোমার আধাঘন্টা যাবৎ মাথা ঝিমঝিম করছে অথচ তুমি আমাকে একবারও বললে না।”
-” এত সামান্য একটা বিষয় এটা বলার কি আছে?”
অনিম মুখ কালো করে শিমুলের দিকে তাকিয়ে আছে। শিমুলের এসব কথাবার্তা অনিমের মোটেই পছন্দ না। এমন কেন শিমুল? সব ব্যাপারেই তার এত খাম খেয়ালীপনা কেন? সে শিমুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-” তোমার কাছে তো সব বিষয়ই সামান্য মনে হয়। কিন্তু আমার কাছে তোমার সামান্য বিষয়ও অনেক বড় মনে হয়।”
-” ……………….”
-” তোমার মাথায় খুব বেশি যন্ত্রনা হচ্ছে?”
-” না।”
-” চলো তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই।”
-” উফফ, সামান্য মাথা ঝিমঝিম করছে এতে ডক্টরের কাছে দৌঁড়ানোর কি হলো অনিম?”
-” বিরক্ত হচ্ছো কেন? যদি যন্ত্রনাটা আরও বেড়ে যায়?”
শিমুল অনিমের কাছে যেয়ে তার বুকে নাক মুখ ঘঁষে তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
-” এই যে তুমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছো এতেই অনেকখানি যন্ত্রনা কমে গেছে। এত অস্থির হওয়ার দরকার নেই। কিছুক্ষন পর ঠিক হয়ে যাবে।”
-” তোমাকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয় শিমুল।”
-” এত কিসের ভয় পাও তুমি আমাকে নিয়ে বলোতো?”
-” যদি তোমার কোনো ক্ষতি হয়! যদি তুমি আমার থেকে দূরে চলে যাও!”
-” এগুলো বাজে চিন্তা করো তুমি। তোমাকে আমি সকালে কি বলেছি ভুলে গেছো? মরে গেলেও তোমার পিছু ছাড়বো না। তুমি আমাকে যেভাবে আগলে রাখো, আমার ক্ষতিটা হবে কিভাবে বলো তো? আর নামাজের বিছানায় বসে তো সব দোয়া আমার জন্যই করো। তোমার দোয়ার জোরেই আল্লাহ আমাকে হেফাজত করবে।”
-” তবুও ভয় লাগে শিমুল।”
-” তুমি যত বেশি ভয় পাবে, ভয় তোমাকে ততবেশি গ্রাস করবে। আসলে এটা হচ্ছে তোমার একটা মানসিক রোগ।”
-” আমার ভালোবাসাকে তুমি মানসিক রোগ বলছো?”
-” আমি কথাটা সেভাবে mean করিনি।”
-” তুমি আমার ভালোবাসাকে যদি মানসিক রোগ বলো তো বলতে পারো। ভালোবাসার মানুষটার জন্য মানসিক রোগীও হতে পারবো। এই পাগলটার হাত কখনো ছেড়ে দিও না শিমুল। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব না।”
শিমুল অনিমের লোমশ বুকে চুমু খেয়ে বললো,
-” এতো ভালোবাসো কেন তুমি আমাকে?”
-” তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় তাই ভালোবাসি। তোমাকে যতই ভালোবাসি না কেন তবুও মনে হয় ভালোবাসায় কমতি রয়েই গেছে। এরচেয়ে আরও অনেক বেশি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য তুমি। তোমার সামনে যদি কলিজাটা কেটে রেখে দেই তবু মনে হবে ভালোবাসায় এখনও কমতি থেকে গেছে।”
শিমুলের চোখে পানি ছলছল করছে। কোনো কারন ছাড়াই অনিম কিভাবে ওকে এতটা ভালোবাসতে পারে? সে তো অনিমের জন্য তেমন কিছুই করেনি। তবুও কেন অনিম ওকে এত ভালোবাসে? আদৌ কি সে এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?
-” অনিম, কোনো কারন ছাড়াই এতটা ভালোবাসো কেন?”
-” কে বলেছে কারন ছাড়া ভালোবাসি? তোমাকে আমার পাগলের মতো ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। এই কারনটা কি তোমার যথেষ্ট মনে হচ্ছে না?”
-” আমি তো তোমাকে তোমার মতন করে এত ভালোবাসতে পারিনা। তোমার রাগ আসে না আমার প্রতি?”
-” আমরা দুজন দুজনকেভালোবাসি এটাই আমার কাছে বড় বিষয়। কে কাকে বেশি ভালোবাসি সেসব নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আমি তোমাকে আজীবন ভালোবাসতে চাই, কারনে অকারনে তোমার মাথাটা আমার বুকে চেপে ধরতে চাই, রাস্তায় চলার পথে সবসময় তোমার হাত ধরে হাঁটতে চাই, সময়ে অসময়ে চুমু খেতে চাই, ঘুম থেকে উঠেই তোমার মুখটা সবার আগে দেখতে চাই, দিনশেষে ঘরে ফিরে তোমার হাতে খেতে চাই, রাতে ঘুমানোর আগে তোমার সাথে সারাদিনের গল্পগুলো বলতে চাই, মারা যাওয়ার আগে তোমার মুখ দেখে তোমার হাতটা ধরে মরতে চাই।”
শিমুলের দুচোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে। ওর মতো ভাগ্যবান কয়জন আছে? এত ভালোবাসা কি সবার কপালে থাকে? কোন পূন্যের বিনিময়ে আল্লাহ অনিমকে তার জীবনে পাঠিয়েছেন সেটা আল্লাহই জানেন। অনিম শিমুলের চোখ মুছে দিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
-” সকালে তো বলছিলে আমাকে নাকি কোনো কথা বলে শান্তি নেই। সব কথাতেই সিরিয়াস হয়ে যাই। এখন তো দেখছি তুমিও সিরিয়াস হয়ে গেছো।”
শিমুল কান্না থামিয়ে বললো,
-” বেশি কথা বলো তুমি। তুমি না আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলে? থামলে কেন? হাত বুলাও। আমি ঘুমাবো।”
-“, বাব্বাহ, আমাকে দিয়ে তো ভালোই সেবা-যত্ন করাচ্ছো।”
-” হুম করাবোই তো। বিয়ে করেছি না তোমাকে আমি! এটা আমার অধিকার।”
-” বিয়ে তো আমিও করেছি। তাহলে আমার সেবা যত্ন কে করবে?”
-” আমিই করবো।”
-” কবে?”
-” সময় হোক, এরপর ঠিকই করবো।”
অনিমের বুকে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে হাসছে শিমুল। অনিম টের পাচ্ছে শিমুলটা যে মুখ লুকিয়ে হাসছে। সে শক্ত করে তার বুকের মধ্যে শিমুলকে জড়িয়ে ধরলো।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here