#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০২
#Writer_Fatema_Khan
“কি করছো এখান একা একা?”
আয়াতের ডাকে চোখ খুলে তাকায় মেহের। নিজের পাশে আয়াত দাঁড়িয়ে আছে আর সে এতক্ষণ বুঝতেই পারে নি। মাহের হালকা হেসে বললো,
“এমনিতেই ভালো লাগছিলো না তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তা তুই কখন এলি আমিতো টেরও পাই নি!”
“তুমি কিছু ভাবছিলে মেহের তাই হয়তো বুঝতে পারো নি। তা কি ভাবছিলে?”
মেহের একটা মুছকি হাসি দিলো আয়াতের দিকে তাকিয়ে তবে তার কথার বিপরীতে কোনো উত্তর দেয় নি। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তবে এবার চোখ খুলে। আর জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। আয়াত মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত বললো,
“কফি খাবে মেহের?”
“হু খাওয়া যায়। তুই একটু অপেক্ষা কর আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
“লাগবে না তুমি আমার সাথেই দাড়াও।”
“আরে তুই শুধু পাঁচ মিনিট দাড়া আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”
মেহের ছাদ থেকে নিচে চলে এলো। কিছুক্ষণ পর এক মগ কফি আর এক কাপ চা হাতে করে মেহের ছাদে উঠে এলো। মেহের বরাবরই চা প্রেমী তাই সে নিজের জন্য চা এনেছে আর আয়াতের জন্য কফি। আয়াতের হাতে কফির মগ দিয়ে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিলো মেহের। আর সাথে সাথে চোখ বুজে নিলো৷ এ দেখে আয়াত একটু শব্দ করেই হেসে দিলো।
“তুমি একটুও বদলাও নি মেহের। ঠিক আগের মতোই আছো। আগের মতোই নিজের প্রতি উদাসীন। এখন অন্তত পক্ষে নিজেরটা একটু ভাবো।”
“কই আমি নিজের ব্যাপারে উদাসীন! আমি নিজেকে নিয়েই ভাবি সবসময়।”
“আমাকে আর বুঝাতে হবে না।”
আয়াত নিজের মগে চুমুক দিলো। প্রায় দুইজনেই দশ মিনিটের মতো নিশ্চুপ। তারপর মেহের বলে উঠলো,
“তুই এত বছর দেশে আসলি না কেনো? জানিস চাচী কত কষ্ট পেতো। তোর তো দুই বছর পর আসার কথা ছিলো কিন্তু আসলি না আর না এসেছিস আমার বিয়েতে।”
আয়াত মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“যদি বলি অনেক কারণ ছিলো দেশে না আসার।”
“কি কারণ!”
“যদি বলি কারণটা……
” ওহহো! তোমরা দুইজন এখানে গল্প করছো আর আমি তোমাদের দুইজনকে পুরো বাড়ি খুঁজে এলাম।”
কাসফির ডাকে দুইজনেই পেছনে ফিরে দেখে কাসফি কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাসফি এগিয়ে গিয়ে আয়াতের পাশে দাড়ালো আর বললো,
“আমাকে ডাকো নি কেনো আয়াত ভাইয়া? আমি কত খুজলাম তোমায়।”
“এতটা কেনো খুজতে গেলি, আমিতো এমনিতেই একটু পর নিচে আসতাম।”
“আমি তোমাকে এত খুজলাম আর তুমি বলো কেনো খুজতে গেলাম।”
“আচ্ছা পিচ্চি আয় এদিকে। ভাইকে বুঝি খুব মিস করেছিলি যখন আমি ছিলাম না?”
কাসফি মনে মনে ভাবলো,
“ভাই হবে কেনো আমার তো তোমাকে খুব ভালো লাগে আর অনেক অনেক মিস করেছি।”
“কিরে চুপ করে গেলি যে মিস করিস নি!”
“অনেক মিস করেছি ভাইয়া।”
“আসলে কি বলতো কাসফি একমাত্র তুই ই আমি আসাতে খুশি হয়েছিস আর কেউ কিন্তু হয় নি।”
“ঠিক আমি অনেক খুশি হয়েছি তুমি আসাতে। জানো আমি তোমার জন্য কত অপেক্ষায় ছিলাম আর তুমি কিনা আজ আসলে।”
মেহের কিছুটা ভ্রু কুচকে বললো,
“তোদের অপেক্ষার পালা শেষ হলে নিচে যাওয়া যাক।”
“না আপু তুমি নিচে যাও আমি আর আয়াত ভাইয়া কিছুক্ষণ থাকি না।”
“ঠিক আছে।”
মেহের কাসফি আর আয়াতকে রেখে নিচে চলে গেলো। কাসফি আয়াতের কিছুটা কাছে এসে দাড়ালো তারপর তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়াত কাসফির দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিরে পিচ্চি কিছু কি বলবি?”
“তুমি খুব সুন্দর ভাইয়া।”
খুব জোরে আয়াত হেসে উঠলো আর বললো,
“জানি আমি অনেক সুন্দর কিন্তু কি বলতো সবাই এটা বুঝে না শুধু তুই বুঝলি। আরেকটা কথা জানিস?”
“কি কথা?”
“তুই খুব পেকে গেছিস।”
মুখটা কালো করে কাসফি বললো,
“তোমাকে সুন্দর বলাতে আমি পেকে গেছি বুঝি!”
“তুই তো বাচ্চা তাই তোর সব ধরনের কাজ বা কথার ধরণ আমি বুঝি। এমন একটা আমার জীবনেও ছিলো যখন আমার কথাগুলো কারও বুঝার দরকার ছিলো কিন্তু সে এতটাই অবুঝ আজ অবদি বুঝলো না।”
“কে সে!”
“চল নিচে তোদের গিফট গুলো খুলি গিয়ে।”
এক মুহূর্তে কাসফির মন ভালো হয়ে গেলো।
“হুম ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলো।”
আয়াতকে রেখেই কাসফি একছুটে নিচে চলে গেলো। আর সবাইকে ডাকতে লাগলো।
“কিরে এভাবে চেছাচ্ছিস কেনো?”
রুম থেকে বের হতে হতে আমেনা বেগম বলে উঠলেন।
“চাচী ভাইয়া বলেছে সবার জন্য গিফট এনেছে ওইগুলো এখন দিবে।”
“ওহ। তা তোর ভাইয়া কই?”
“ভাইয়া আসছে ছাদ থেকে।”
“মেহেরকে দেখেছিস?”
“মেহের আপু তো নিচেই। হয়তো নিজের ঘরে আছে।”
তাদের কথার মাঝেই বাকি সবাই সবার রুমে হাজির হলো। আয়াতও ছাদ থেকে নেমে এসেছে। আয়াত নিজের রুমে সবাইকে আসতে বললো। সবাই আয়াতের রুমের দিকে গেলো আর কাসফি আয়াতের হাত ধরে যাচ্ছে। আয়াত রুমে এসেই নিজের ব্যাগ থেকে সবার জন্য আনা জিনিসগুলো বের করে দিচ্ছিলো। মা আর চাচীর জন্য দুইটা স্মার্ট ফোন এনেছে।
“এখন থেকে তোমাদের আর বাবা চাচার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। যখন মন চায় যার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হবে কথা বলতে পারবে।”
বাবা আর চাচার জন্য দুইটা হাত ঘড়ি এনেছে আর বডি স্প্রে। মাহির জন্য একটা পুতুল আর একটা গাড়ি। এদিকে কাসফি গাল ফুলে বসে আছে তার জন্য কি এনেছে এখনো বের করেনি তাই। সবশেষে কাসফির জন্য খুব সুন্দর একটা গাউন এনেছে। এটা বের করেই কাসফি খুশিতে সবার সামনেই নাচা শুরু করলো। কাসফি খেয়াল করলো আয়াত সবার জন্য কিছু না কিছু আনলেও মেহেরের জন্য কিছুই আনে নি। তাই কাসফি বললো,
“ভাইয়া আপুর জন্য কিছু আনো নি?”
“আসলে আমি ভুলে গেছি মেহেরের কথা।”
“মেহের আপু তুমি কি মন খারাপ করছো তোমার জন্য কিছু আনে নি বলে!”
“দূর পাগলি আমি মন খারাপ করব কেনো? আয়াত দেশে এসেছে এটাই অনেক। চাচী তো রোজ আয়াতের জন্য কেঁদে ভাসাতো। এখন সে ফিরে এসেছে আর কি চাই আমাদের।”
মেহেরের দিকে আয়াত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে জানে তার জন্য কিছু না আনলেও সে মন খারাপ বা কষ্ট পাবে না। কারণ জীবন যা কষ্ট দেওয়ার তাকে তো দিয়েই দিয়েছে৷ সবাই নিজেদের জিনিস নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেলো। কাসফিও খুশিতে নিজের গাউন নিয়ে চলে গেলো। মেহের মাহিকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হবে এমন সময় আবার পিছু ফিরে আয়াতের কাছে এসে বললো,
“আয়াত তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ বা দেশে এসে তুই কি খুশি না?”
“এমনটা মনে হওয়ার কারণ জানতে পারি।”
“আমি তোকে খুব ভালো করেই চিনি, তোর কিছু তো মনে চলছে সেটা কি?”
“কিছু না। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো মেহের। যাও মাহিকে নিয়ে নিজের ঘরে যাও।”
মেহের আর কথা বাড়ালো না নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। আয়াত নিজে নিজে ভাবতে লাগলো,
” মিথ্যা মেহের তুমি কখনোই আমাকে বুঝতে পারো না।”
রাতে খাওয়া শেষে আয়াতের বাবা আফজাল সাহেব বললেন,
“আয়াত তোমার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।”
সোফায় বসতে বসতে আয়াত বললো,
“বলো বাবা কি বলবে।”
“দেখো তুমি তো নিজের পড়া শেষ করেই দেশে এসেছো। আজ বাদে কাল আমাদের ব্যবসায় জয়েন দিবে। তাই আমরা সবাই চাই তুমি এবার নিজের বিয়ের ব্যাপারে ভাবো।”
কাসফি যেনো আয়াতের বিয়ের কথা শুনে থমকে গেলো। আয়াত কিছু একটা ভেবে বললো,
“আমি একজনকে পছন্দ করি তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমি তাকেই বিয়ে করতে চাই। আর মেয়েটি কে তা না হয় পরে বলব। এখন খুব ঘুম পাচ্ছে আমি উঠি।”
আয়াত আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। আয়াতের মুখে কাউকে পছন্দ করে শুনে কাসফির মনে খুব আঘাত পেলো। সে আর না খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। তারপর বিছানায় শুয়ে কাদতে লাগলো।
“আমিতো ভাইয়াকে খুব ভালোবাসি তবে কেনো ভাইয়া অন্য কাউকে ভালোবাসবে। আমি কি কম সুন্দর নাকি যে ভাইয় অন্য কাউকে ভালোবাসে।”
দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে কাসফি তাড়াতাড়ি উঠে বসে। আর দেখতে পায় তার সামনে….
চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৩
#Writer_Fatema_Khan
দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে কাসফি তাড়াতাড়ি উঠে বসে। আর দেখতে পায় তার সামনে আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। আয়াতকে দেখে কাসফি কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। আয়াত দরজা থেকে কাসফির কাছে এসে খাটের উপর বসে পরে।
“ভাইয়া আসলে তেমন কিছু না তুমি যেটা ভাবছো।”
“কাসফি আজ বিকেলে আমি তোকে কি বলেছিলাম যে, আমি বুঝি তোর কথার ধরণ। তাই বড় ভাই হিসেবে কিছু কথা বলি এগুলো সবসময় মনে রাখবি।”
“কি কথা?”
“তুই এখন যে সময়টা দিয়ে যাচ্ছিস এই সময়টা সব মানুষ পার করে আসে। এই সময় কাউকে ভালো লাগলে আমরা ভাবি হয়তো আমরা তাকে ভালোবাসি। আসলে কিন্তু তেমনটা না।”
“তাহলে কেমন?”
“এগুলো হলো আবেগ। আবেগ মানে যা কখনো সত্যি হওয়ার নয় কিন্তু আমরা এটাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। ভাবি এটা না পেলে মরে যাব। ঠিক এমন। এই যে একটু আগে তুই কাঁদছিলি কেনো, তুই মনে করছিলি আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি তারমানে তোকে ভালোবাসি না।”
“তাহলে কি তুমি আমাকে ভালোবাসো!”
“হুম বাসিতো কিন্তু শুধু বোনের মতো। তোর এখন হয়তো খারাপ লাগছে কিন্তু যখন তুই বড় হবি এসব ভেবেই হাসি পাবে। কত ছেলেরা তোকে বিয়ে করার জন্য বাড়ির সামনে বসে থাকবে আর তুই কিনা আমার মতো বুড়োর জন্য কাঁদছিস।”
“কিন্তু তুমি তো বুড়ো না?”
“এখন বুড়ো না, কিন্তু তুই যখন বড় হবি তখন তো আমিও বুড়ো হয়ে যাব।”
“তা তো আমি ভেবেই দেখি নি। তখন আমাদের বিয়ে হলে তো সবাই হাসাহাসি করবে তাই না?”
“ঠিক, আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে। এখন তুই লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পর এক্ষুনি মেহের এসে পরবে আমি যাই।”
“ভাইয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম বল।”
“তুমিও যাকে ভালোবেসছো সে কি তোমায় ভালোবাসে?”
“সে তো আজও বুঝতেই পারে নি আমি তাকে ভালোবাসি। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়।”
“কি বলো! তাহলে কি বুড়ি সে!”
“বুড়ি হবে কেনো, আমার থেকে দুই বছরের বড় এই আর কি।”
“তুমি তাকে বলে দিও তুমি তাকে ভালোবাসো ঠিক আছে।”
“আচ্ছা। মাহি ঘুমাচ্ছে এখন পিচ্চি তুইও ঘুমা। আমিও ঘুমাতে যাই।”
আয়াত রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রুমে এসে বিছানায় শুয়ে মোবাইলে স্ক্রল করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আয়াত নিজের ফোন রেখে শুয়ে পরলো।
সকালে কাসফির ডাকে আয়াত আড়মোড়া দিয়ে উঠলো।
“এই ভাইয়া উঠো না, ভাইয়া, এই ভাইয়া উঠো।”
“উফ! এই সকাল বেলা কেউ এভাবে ডেকে তুলে? কি হয়েছে বল?”
“ভাইয়া কয়টা বাজে দেখো। ৯ঃ৩০ বাজে এখান আমি স্কুলে না গেলে খুব লেইট হয়ে যাবে। চলো ভাইয়া।”
“প্রতিদিন তোকে কে স্কুলে নিয়ে যায়?”
“কেনো মেহের আপু।”
“তাহলে আজ তোর মেহের আপু কই?”
“মেহের আপু তো আজ খুব তাড়াতাড়ি অফিস চলে গেছে। আর বাবা আর চাচাও তার সাথেই গেছে তাদের নাকি মিটিং আছে। তাই আমাকে বলে গেছে তোমার সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য।”
“আসতে না আসতে ডিউটি। আচ্ছা তুই নিচে গিয়ে বস আমি রেডি হয়ে আসছি।”
“ঠিক আছে ভাইয়া।”
রেডি হয়ে আয়াত নিচে এসে কাসফিকে বলে,
“কিরে পিচ্চি চল স্কুলে।”
এদিকে রান্নাঘর থেকে আয়াতের মা এসে বললো,
“কিছু না খেয়ে যাবি? দাড়া আমি এক্ষুনি খাবার দিচ্ছে।”
“না মা আমি বাইরে খেয়ে নিব।”
তারপর কাসফিকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। বাইরে এসে আয়াত লক্ষ করলো বাড়ির বাইরে তাদের দুইটা গাড়ির একটা গাড়িও নেই। আয়াত মাথা চুলকে কাসফিকে বললো,
“তোর স্কুলে কি খুব কাছে নাকি একটা গাড়িও তো নেই।”
“হুম কাছেই চলো আমি তোমাকে নিয়ে যাই।”
তারপর আয়াত কাসফির সাথে বাড়ির গেইটের বাইরে চলে গেলো। কাসফি একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পরে আর আয়াতকেও উঠতে বলে। আয়াত কাসফির সাথে রিকশায় উঠে পরে। প্রায় দশ মিনিট পর কাসফির স্কুলের সামনে এসে রিকশা থামলো। কাসফি নেমে আয়াতকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত স্কুলে চলে গেলো৷ আয়াত যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো৷
“এই কাসফি এত কথা কি করে বলে! এই দশ মিনিটে সে তার স্কুলের সব কাহিনি বলে দিয়েছে আমাকে।”
আয়াত রিকশার ভাড়া মিটিয়ে একটা বাসে উঠে পরলো। কিছুক্ষণ পর বাস থেকে নেমে তাদের অফিসের উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো। অফিসে পৌঁছে আয়াত সরাসরি মেহের কোন কেবিনে আছে তার খবর নিলো। তারপর সোজা মেহেরের কেবিনে চলে গেলো। বিনা অনুমতি মতে ঢুকে পরায় মেহের আয়াতকে খেয়াল করে নি। মেহের আজকের মিটিংয়ের সব ফাইল চেক করছিলো। হঠাৎ কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে মেহের সামনের দিকে তাকালো। আয়াতকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
“আরে আয়াত তুই এখানে!”
আয়াত চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
“আমাকে তোমার ওই বাচাল বোন কাসফির কাছে রেখে এখন বলছো আমি এখানে কেনো।?
একটু হেসে মেহের বললো,
” কাসফি একটু দুষ্ট আর চঞ্চল বুঝলি তাই আর কি।”
“সে আমি বুঝে গেছি। এখন কথা হলো আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
“তুই সকালে নাস্তা করিস নি? এক মিনিট আমি এক্ষুনি খাবার আনছি তোর জন্য।”
“হুম সেটাই ভালো। আচ্ছা চাচা আর বাবা কোথায়?”
“তারা মিটিং শেষ করে কোথাও একটা গেছে। বললো কিছুক্ষণ পর ফিরে আসবে।”
পাঁচ মিনিটের মাঝে খাবার এসে হাজির হলো। আর আয়াত সব খাবার খেয়ে নিলো। তারপর মেহেরকে বললো,
“আজ কি কাজের খুব চাপ?”
“না তেমন না। একটা মিটিং ছিলো ওইটা শেষ। আজ আর আমার তেমন কাজ নেই।”
“তাহলে চলো আমার সাথে।”
“কোথায়?”
“গেলেই দেখতে পাবে।”
আয়াত মেহেরকে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো। মেহের বারবার জিজ্ঞেস করার পরও বললো না আয়াত। অফিসের বাইরে থেকে একটা রিকশায় উঠে পরলো দুইজনে। রিকশা এসে থামলো একটা লেকের পাশে। লেকের চারপাশে অনেক মানুষ আছে। যে যার মতো ব্যস্ত। কেউ নিজের সাথে আসা ব্যক্তিটির সাথে কেউবা নিজের কাজ নিয়ে। আয়াত মেহেরকে নিয়ে লেকের সাইডে গিয়ে বসলো। মেহের নিজের পায়ের জুতা খুলে লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো। আয়াত পাশে থাকা বাদামওয়ালা থেকে বাদাম কিনল। আয়াত বাদাম ছুলে মেহেরকে দিচ্ছিলো আর মেহের আয়াতের হাত থেকে বাদাম নিয়ে খাচ্ছিলো। আর দুইজনে অনেক অনেক কথা বলছিলো। আয়াত মাঝে মাঝে কিছু মজার কথা বলছিলো যা শুনে মেহের হেসে কুটিকুটি হচ্ছিলো। কখনো বা বিদেশের বন্ধুদের কথা বলছিলো। এক সময় একটু দূরে একটা ফুচকার ঠেলা দেখে মেহের বলে উঠলো,
“এই আয়াত চল ফুচকা খাব।”
“আচ্ছা চলো।”
তারা দুইজনে ফুচকার ঠেলার সামনে যায় আর এক প্লেট ফুচকা নেয় আয়াত।
“কিরে এক প্লেট কেনো তুই খাবি না?”
“না আমার এসব ভালো লাগে না।”
“কি বলছিস তুই, আর আগে তো তুই সবার সাথে কম্পিটিশন দিতি কে বেশি ফুচকা খেতে পারে। আর এখন কিনা ভালো লাগে না।”
“আসলে মেহের কি বলতো অনেক কিছুই তো আমাদের জীবনে পরিবর্তন হয় তাই না৷ ধরো আমার জীবনের মধ্যে এটাও একটা পরিবর্তন।”
মেহের হঠাৎ করেই মন খারাপ করে ফেললো। কাল থেকে মেহেরের মুখে ভালো করে হাসি দেখে নি আয়াত। আজ একটু খুশি ছিলো সে আর তার কথায় তা আবার অন্ধকারে ঢেকে গেলো। আয়াত বলে উঠলো,
“তবে মাঝে মাঝে আমাদের উচিত পুরোনো অভ্যাস গুলোকে জাগিয়ে তোলা। তাহলে আজ হয়ে যাক ফুচকা কম্পিটিশন?”
আয়াতের কম্পিটিশনের কথা শুনে মেহের আবার হেসে উঠলো আর বললো,
“হয়ে যাক।”
আয়াত আরেক প্লেট ফুচকা দিতে বললো। ফুচকা আসতেই দুইজনে গপাগপ ফুচকা খাওয়া শুরু করে। দুইজনের দুই প্লেট খাওয়া প্রায় শেষ। মেহেরের চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে তবুও তার থামার নাম নেই। হঠাৎ পরিচিত কারো গলার শব্দে থমকে গেলো মেহের।
“আরে মেহের তুমি এখানে!”
মেহের আর কোনো কিছু না ভেবেই পেছনে তাকালো আর ঠিক যাকে ভেবেছিলো সেই তার সামনে দাঁড়িয়ে।
চলবে,,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৪
#Writer_Fatema_Khan
“আরে মেহের তুমি এখানে?”
নিজের সামনে নিজের প্রাক্তন স্বামী আবিরকে দেখে থমকে গেলো মেহের। প্রায় বছরখানেক পর আবিরকে দেখছে মেহের। অবশ্য আবির একা নয় তার সাথে তার বর্তমান স্ত্রীও রয়েছে।
“কেমন আছো মেহের?”
“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আর আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও বেশ আছি৷ তোমাকে অনেক দিন পর দেখে ভালো লাগলো। আর তোমার সাথে কে? নতুন জীবন শুরু করছো বুঝি!”
“আমারও আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো। আর আপনি হয়তো ভুলে গেছেন ও আমার কাজিন আয়াত।”
“ওহ হ্যাঁ, মনে পরেছে আয়াত। তা কেমন আছো আয়াত? তোমার সাথে কখনো আলাপ হয়নি, আজ সরাসরি দেখে ভালো লাগলো।”
আয়াতের দিকে হাত বাড়িয়ে। আয়াতও হাত বাড়িয়ে হাত মিলালো আবিরের সাথে। তারপর দুইজনে কিছুক্ষণ কথা বললো।
“মেহের মাহি কেমন আছে?”
আবির আরও কিছু সময় কথা বলতে চেয়েও পারলো না মেহেরের জন্য। মেহের আবিরের কথার জবাব না দিয়ে আয়াতকে তাড়া দিয়ে বললো,
“আয়াত আমার ভিষণ মাথা ব্যাথা করছে আমরা এক্ষুনি বাসায় যাব।”
“বেশি খারাপ লাগছে নাকি?”
“হুম তাড়া চল, আমার একমুহূর্তও ভালো লাগছে না এখানে।”
আয়াত আবিরের কাছে বিদায় নিয়ে একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পরলো। রিকশার চাকা ঘুরা শুরু হলো। আবির রিকশা যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো।
“মেহের তোমার কি সত্যি খারাপ লাগছে নাকি অন্য কোন ব্যাপার? আর এই লোকটাই বা কে?”
মেহের কোনো জবাব দিলো না। তার চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। বাসার সামনে আসতেই মেহের রিকশা থেকে নেমে সোজা বাসার ভেতর চলে গেলো। আয়াত অনেকটাই অবাক হলো মেহেরের আচরণে। ভাড়া মিটিয়ে সে বাসায় চলে গেলো। সারাদিনে আর কেউ মেহেরকে নিজের ঘর থেকে বের হতে দেখে নি। এমনকি কিছু খায় নি পর্যন্ত। আয়াত বুঝতেই পারলো না মেহেরের কি হলো। মাহিকে মেহেরের মা খাইয়ে দিয়েছেন মেহেরের মন খারাপ বলে। রাতে কাসফি বসে পড়ছিলো ঠিক সেই সময় আয়াত এসে রুমে হাজির হলো। কাসফিকে আয়াত বললো,
“কিরে পিচ্চি কি পড়ছিস?”
“ভাইয়া কাল তো আমার ক্লাসে পরীক্ষা আছে তাই পরীক্ষার পড়া পড়ছি। তুমি বলো কিছু বলবে?”
“এই পিচ্চি এটা কি তোর রুম নাকি?”
“হুম আমার রুম খুব সুন্দর না, আমি নিজে সাজিয়েছি।”
“পুরাই বাচ্চাদের রুমের মতো লাগছে।”
“উফ ভাইয়া তুমিও বললে এটা বাচ্চাদের রুমের মতো।”
“আচ্ছা খুব সুন্দর। আর তুই মেহেরের রুমে থাকিস কেনো এত সুন্দর রুম থাকতে?”
“আসলে আমার একা ঘুমাতে ভয় লাগে তাই আপুর সাথে ঘুমাই। কিন্তু আজ তো আপুর মন খারাপ তাই আমার রুমে চলে এলাম। মন ভালো হলে চলে যাব।”
” ওহ বুঝলাম। আচ্ছা পিচ্চি বলতো এই আবির কে?”
কিছুটা অবাক হয়েই কাসফি বললো,
“কেনো তুমি আবির ভাইয়াকে চেনো না!”
“আসলে ঠিক মনে করতে পারছি না কখনো দেখেছি কিনা। তবে নামটা কেমন শুনেছি শুনেছি মনে হয়।”
“আবির ভাইয়া হলো মেহের আপুর যার সাথে বিয়ে হয়েছিলো সেই ভাইয়াটা।”
“মেহের আপু আর আবির ভাইয়ার কি যেনো হয়েছিলো তারপর আপু মাহিকে নিয়ে চলে আসে। সেদিন আপু অনেক কান্না করেছিলো কিন্তু আপু আর আবির ভাইয়ার বাড়ি যায় নি।”
“ওহ!”
“কিন্তু তুমি চেনো না কেনো তোমাকে তো আপুর বিয়ের সব ছবি দেওয়া হয়েছিলো?”
আয়াত মনে মনে ভাবলো,
“আমিতো ছবিই দেখি নি, তার আগেই সব ডিলেট করে দিয়েছি। আসলে দেখার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না তাই মোবাইলে রাখার প্রয়োজনও ছিলো না।”
কিন্তু কথা কাটাতে আয়াত বললো,
“কাল তোর পরীক্ষা না মন দিয়ে পড়, কালকেও আমিই স্কুলে নিয়ে যাব।”
কাসফি মন খারাপ করে আবার পড়তে লাগলো। কাসফির কাছে পড়া আর পরীক্ষা এই দুইটা শব্দ সবচেয়ে বিরক্তিকর। আর এদিক ওদিক না ভেবে কাসফি পড়ায় মনোযোগ দিলো। আয়াত কাসফির কাছ থেকে চলে এলো। আয়াত নিচে নেমে দেখে মেহের মা আর চাচীর সাথে টুকটাক কাজ করছে। আয়াত এগিয়ে গিয়ে তার মাকে বলে,
“মা তোমাদের হয়েছে, আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।”
“এই তো হয়ে গেছে বস তুই। তোর বাবা আর চাচা এক্ষুনি চলে আসবে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির বাকি সবাই খাবার টেবিলে হাজির হলো৷ আর রাতের খাবার শেষ করলো। রাতের খাবার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেলো।
রুমে আসার কিছুক্ষণ পর আয়াত রুম থেকে বের হলো। তার ঘুম আসছে না। সত্যি বলতে মেহেরের কথা ভেবেই আয়াতের ঘুম আসছে না। তাই সে বের হলো রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যাওয়ার সময় দেখতে পেলো মেহেরের রুমের লাইট জ্বলছে। তা দেখে আয়াত মেহেরের রুমের দিকে এগিয়ে দেখে মেহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আর মাহি ঘুমাচ্ছে। আজ কাসফি মেহেরের রুমে নেই। আয়াত কিছু না বলেই নিচে রান্নাঘরে চলে গেলো। নিজের জন্য এক মগ কফি বানিয়ে মেহেরের জন্য এক কাপ চা বানালো৷ তারপর মেহেরের রুমে গিয়ে মেহেরের পেছনে দাড়ালো। মেহেরের পাশে গিয়ে দাড়াতেই দেখে মেহের রাতের অন্ধকারে আকাশে থাকা গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরের সামনে চায়ের কাপ ধরতেই মেহের চমকে পাশে তাকায়। পাশে আয়াতকে দেখে হালকা হাসে। তারপর বলে,
“এত রাতে তুই এখানে!”
“ঘুম আসছিলো না, তাই ভাবলাম কফি খেলে হয়তো ভালো লাগবে। তারপর দেখি তুমি জেগে আছো তাই তোমার জন্য চা নিয়ে এলাম।”
“এত কষ্ট করার কি ছিলো। আমি এমনিতেই ঠিক ছিলাম।”
“তুমি ঠিক নেই মেহের তা আমি জানি।”
মেহের নিজের দৃষ্টি আয়াতের দিকে রেখে বললো,
“ঠিক আছি আমি। তুই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পর।”
“চা টা খাও। কত কষ্ট করে এত রাতে বানালাম।”
“ঠিক আছে দে।”
আয়াতের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দিলো মেহের। আয়াতও নিজের কফিতে মনোযোগ দিলো। দুজনেই নিশ্চুপ। দুইজনেই বারান্দার গ্রিল দিয়ে আকাশের ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিরবতার মাঝেই আয়াত বলে উঠলো,
“অনেক ভালোবাসতে বুঝি তাকে?”
বিষ্মিত নয়নে আয়াতের দিকে চেয়ে রইলো মেহের।
“এখন আর বাসি না। ভালোবাসা সেদিনই ফুরিয়ে গেছে যেদিন আমার সাথে সাথে সে তার নিজের মেয়েকেও ছেড়ে দিয়েছিলো। আমাদের সংসার তো খুব ভালো যাচ্ছিলো। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম দুইজনে। বিয়ের ছ’মাসের মাথায় জানতে পারলাম আমি মা হতে চলছি। সে বাবা হবে জানতে পেরে কত খুশি। অফিসের সবাইকে ট্রিট দিয়েছিলো সে বাবা হবে তাই। এমন কোনো চাওয়া নেই যা সে পূরণ করে নি আমার। আমি যখন যা বলতাম তাই হাজির করতো আমার জন্য। প্রেগ্ন্যাসির সাত মাস অবদি সব ঠিক ছিলো। তারপর আমাদের ভালোবাসায় কারো নজর লেগে গেলো হয়তো। সে লেইট করে বাসায় আসা শুরু করে। আসার পর আমার সাথে তেমন কথাও বলতো না। আমার একবারও মনে হয় নি সে বদলে গেছে। ভাবতে লাগলাম কয়দিন পর তো আমার ডেলিভারি তাই সে টেনশনে আছে। প্রচন্ড খারাপ লাগতো তার অবহেলা তবুও নিজেকে বুঝাতাম সবকিছু আগের মতোই আছে। কিন্তু আগের মতো কিছুই ছিলো না, তা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগে গেলো। আমার ডেলিভারির দিন সবাই আমার কাছে থাকলেও যার থাকা সবচেয়ে জরুরি ছিলো সে ই ছিলো না আমার কাছে। মাহি হওয়ার পর আমি তিনদিন হসপিটালে ছিলাম আর সে মাত্র একবার এসে দেখা করে গেছে। তার নাকি অফিসে অনেক কাজ তাই সে আসতে পারছে না। তখন কিছুটা খটকা লাগলেও আমার কি করার ছিলো। মাহির বয়স তখন তিন মাস। একদিন আবির এসে আমাকে বললো তার নাকি আমার সাথে থাকা আর পসিবল না, তাই সে ডিভোর্স চায়। আমার মাথায় সেদিন আকাশ ভেঙে পরেছিলো। তাকে প্রতি উত্তরে কি বলা দরকার ছিলো তখন আমার জানা ছিলো না। তাই চুপচাপ ব্যাগ গুছিয়ে এখানে চলে আসি মাহিকে নিয়ে। তার কিছুদিন পর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমার কাছে। কিছুই না ভেবে সাইন করে দেই। তার এক সপ্তাহ পরেই শুনলাম আবির তার এক কলিগকে বিয়ে করেছে। আর আজ তাকে দেখার সৌভাগ্যও হয়ে গেলো। এতদিন পরে দেখা হয়েও তার চোখে কোনো অনুশোচনা নেই। আমার জন্য না হোম ওই ছোট্ট মেয়েটার জন্যও নেই। যে মেয়েটা তার নিজের।”
কান্নায় ভেঙে পরলো মেহের আর আয়াত মেহেরের অশ্রুসিক্ত নয়নের দিকে চেয়ে আছে। দুইজনের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। দুইজনেই বারান্দার ফ্লোরে বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। হঠাৎ আয়াতের কাধের উপর ভারি কিছু পরতেই আয়াত চেয়ে দেখে মেহের তার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। আয়াত নিজের হাত দিয়ে মেহেরের মুখের উপর আসা চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো। আর ভাবতে লাগলো,
“এত নিষ্পাপ, এত স্নিগ্ধ, এত পবিত্র একটা মেয়েকে কি করে কেউ এভাবে ঠকিয়ে কষ্ট দিতে পারে!” মেহেরকে ভালো করে ধরে আয়াত বারান্দায় বসে রইলো। দেখতে দেখতে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই একটা জিনিস আয়াত খুব মিস করতো দেশের বাইরে। আজ অনেক বছর পর শুনতে পেলো। আয়াত মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে কেদে কেদে চোখ দুইটা ফুলে গেছে। পাজাকোলে তুলে মেহেরকে রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আয়াত রুমের দরজা চাপিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
চলবে,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৫
#Writer_Fatema_Khan
বসার ঘরে আয়াতের বাবা আর মেহেরের বাবা সোফায় বসে আছে মুখ ভার করে। আর তাদের পেছনেই আয়াতের আর মেহেরের মা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বরাবর সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে আয়াত। মেহের আর কাসফি মেহেরের মায়ের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছে সবার কথা। সবার মুখ থমথমে।
আজ সকাল বেলায় আয়াত বাসা থেকে বের হয়ে সারাদিনে ঘরমুখো হয় নি। অনেক বার সবাই কল দেওয়ার পরেও কারো কল রিসিভ করে নি আয়াত। সন্ধ্যার দিকে বাসায় এসেই নিজের রুমে চলে যায় সে। আয়াতের মা আর চাচী কয়েকবার খাবার জন্য ডেকে গেলেও আয়াত মানা করে দিয়েছে। তবে রাতে তার বাবা আর চাচা বাসায় আসার পর আয়াত সবাইকে বসার ঘরে ডাকলো কথা বলতে। সবাই উপস্থিত হলেও সবার মুখে ছিলো দুশ্চিন্তা। কারণ সকাল থেকেই আয়াতের মনের মধ্যে কি চলছে কেউ বুঝতে পারছে না। আয়াতের বাবা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার মা বললো তুমি নাকি সারাদিন বাসায় ছিলে না আর সন্ধ্যায় এসেও রুমে দরজা লাগিয়ে বসে ছিলে কোনো সমস্যা তোমার? যদি কোনো সমস্যা হয় আমাদের জানাতে পারো আমরা তোমার পাশেই আছি।”
আয়াত তার বাবার দিকে চেয়ে আছে তবে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তাই মেহেরের বাবা বললেন,
“কোনো ঝামেলা হয়েছে আয়াত, তুই টেনশন করিস না আমাদের বল কি হয়েছে।”
আয়াত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোমরা ওইদিন আমাকে বিয়ের কথা বলছিলে না, আমি এখন বিয়ে করতে চাই।”
সবাই খুশি হয়ে গেলো আয়াতের কথা শুনে।
“এটা তো ভালো কথা। কিন্তু তুমি বলেছিলে কাউকে পছন্দ করো তা সে কে?”
“বাবা আমি কোনো হেয়ালি না করেই বলতে চাই কথাটা। আমি মেহেরকে বিয়ে করতে চাই।”
বাসার সবার মাথায় যেনো বাজ পরলো আয়াতের কথা শুনে। মেহেরের বাবা বলে উঠলেন,
“আয়াত দেখ বাবা মেহেরের তো বিয়ে হয়ে গেছে আর বাচ্চাও আছে আর তুই তো জানিস বছরখানেক আগেই ওর ডিভোর্স হয়েছে৷ মেহের আমার মেয়ে হলেও আমি তোকেও নিজের ছেলের মতোই দেখি। তাই আমি চাই না তুই আবেগে পরে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দে।”
“আমি আবেগে নয় আমি সত্যি মেহেরকে পছন্দ করি আর বিয়ে করতে চাই।”
আয়াতের বাবা রেগে বললেন,
“ছেলে খেলা পেয়েছো তুমি মেহেরের জীবনটাকে? ও এমনিতেই অনেক কষ্টে থাকে তার উপর এসব বলে কি বুঝাতে চাচ্ছো তুমি মেহেরের উপর খুব দয়া করছো।”
“বাবা তুমি ভুল বুঝতেছো আমাকে। আমি মেহেরকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করি। যার জন্য বাইরে যাওয়ার দুই বছর পর একবার আসার কথা থাকলেও মেহেরের বিয়ের কথা শুনে আমি আর দেশেই আসি নি৷ এখনো আসতাম না যদি না আমার পড়া শেষ না হতো। আর এখন যখন এসেই গেছি আর মেহেরের সাথেও একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে তাই আমি চাই আমরা নিজেদের আরেকবার সুযোগ দেই।”
আয়াতের বাবা এবার চুপ করে গেলেন। তবে চারপাশের মানুষের কথা আত্মীয় স্বজনরা কি ভাববে তার চিন্তা তার মাথায় জায়গা করে নিয়েছে। আয়াতের বাবা আবার বললেন,
“যখন মেহেরের বিয়ে ঠিক হলো তখন তুমি কিছু বলো নি কেনো?”
“মেহের নিজে থেকে আবিরকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে সেই জায়গায় আমি কি করে বলি?”
“মেহের যে তোমার থেকে দুই বছরের বড় সেই খেয়াল কি তোমার আছে? সমাজ কিভাবে দেখবে এই সম্পর্ককে, এর উত্তর তোমার কাছে আছে?”
“বাবা আমি কখনোই মেহেরকে নিজের বড় বোনের চোখে দেখি নি, তাই এখনও এসব নিয়ে ভাবছি না। কে কি বললো এসব নিয়ে ভাবলে চলা যায় না। আর তোমরা তো আজ না হয় কাল মেহেরকে কোথাও না কোথাও বিয়ে দিবেই তাহলে আমি কেনো নই?”
ছেলের কথার কোনো জবাব দিতে পারলেন না আফজাল সাহেব। সোফা ছেড়ে উঠে চলে গেলেন নিজের রুমে। মেহেরের বাবা সোফায় স্থির হয়ে বসে আছেন। আয়াত বললো,
“আমার যা বলার ছিলো তা বলা হয়ে গেছে। আশা করছি এই বিষয় নিয়ে সবাই একটু ভেবে দেখবে। আর যদি তোমাদের এই বিয়েতে অমত থাকে তাহলে আমাকে কখনো বিয়ের কথা বলতে এসো না।”
বলেই আয়াত সিড়ি দিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে গেলো। কাসফির চোখের কোণে পানি জমে আছে, তা মেহের দেখার আগেই মুছে ফেললো কাসফি। মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখের পানি ফেলছে। সেই সময় মেহেরের মা ঘরে ঢুকলেন আর দুই মেয়েকে দেখেই বুঝলেন ওরা সব শুনেছে। মেহেরের মা মেহেরকে বললেন,
“মেহের রাত অনেক হয়েছে যা গিয়ে মাহিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দে আর তোরাও খেয়ে নিস। আমার খিদে নেই আমাকে ডাকিস না। আর কাসফি তোর পরীক্ষা চলছে না, খেয়ে পড়তে বসবি।”
তারপর তিনি বিছানার এক পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন। মেহের আর কাসফি মেয়ের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। কাসফি আজ নিজে থেকেই নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো। আর মেহের রান্নাঘরে গেলো মাহির জন্য খাবার আনতে। ছোট বাচ্চাটাকে
তো আর না খাইয়ে রাখা যায় না। মেহের রান্নাঘরের দিকে যেতেই দেখে তার বাবা এখনো সোফায় বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে আর তার চাচীও আছে সেখানে। মেহের এগিয়ে গিয়ে বাবাকে বললো,
“বাবা খাবার টেবিলে দিয়ে দিব?”
মাথা তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন মেহেরের বাবা। দাঁড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“খেতে মন চাইছে না মা। তোরা খেয়ে ঘুমিয়ে পর।”
মেহেরের বাবাও রুমে চলে গেলেন। চাচী উঠে মেহেরের কাছে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি জানি আমার আয়াত কখনো ভুল হতে পারে না।”
তারপর সেও নিজের ঘরে চলে গেলেন। মেহের আর কিছু না ভেবে মাহির জন্য খাবার নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে মেহের আরেকটা ধাক্কা খায়। খাটের উপর আয়াত মাহিকে নিয়ে খেলছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মেহের কোনোভাবেই আয়াতের সামনে আসতে চায় নি, তবু্ও নিয়তি তাকে আয়াতের সামনে এনেই দাড় করায়। আয়াত মেহেরকে দেখে মাহিকে খাটে বসিয়ে নিজেও ঠিক করে বসে। মেহের আয়াতের সাথে কোনো কথা না বলে মাহিকে কোলে তুলে খাওয়ানো শুরু করে। আয়াত খুব ভালো করেই জানে মেহের এখন কোনো কথাই বলতে চায় না আয়াতের সাথে। তাই সে আয়াতকে না দেখার মতো নিজের কাজ করে যাচ্ছে।
বিছানার উপর শুয়ে অনেক্ষণ কান্না করার ফলে কাসফির মাথা ব্যাথা করছে। তাই সে ভাবলো মেহেরের কাছে গিয়ে ঘুমাবে। তাই সে মেহেরের রুমে যেতেই দেখে ওইখানে আগে থেকেই আয়াত বসে আছে৷ কাসফি তাড়াতাড়ি নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো।
“তাহলে আয়াত ভাইয়া ওইদিন আপুর কথা বলছিলো। সে মেহের আপুকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেনো? ভাইয়া তো বলেছিলো আমার এই বয়সে সবার সাথেই এমনটা হয়। আর তা হলো আবেগ। কিন্তু আবেগের বসে কি মানুষের এত কষ্ট হয়, হয় হয়তো। কিন্তু আমি চাই মেহের আপু খুব ভালো থাকুক আর আয়াত ভাইয়াও। তারা দুইজন যদি একসাথে থাকলে ভালো থাকে তাহলে তো আমারও খুব ভালো লাগবে। তাই আমি এখন থেকে এসব ভাববো না, আয়াত ভাইয়া আমার বড় ভাইয়ের মতো আর কিছুই না। দরকার হলে আপুকে ইমপ্রেস করতে আয়াত ভাইয়াকে আমি সাহায্য করব।”
মেহের মাহিকে খাইয়ে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে মাহিকে ঘুম পাড়াতে লাগলো। আয়াত এখনো বিছানার একপাশে বসে আছে। আয়াত বললো,
“মেহের আমার কিছু কথা বলার ছিলো তোমার সাথে।”
চলবে,,,,