#দ্বিতীয়_বসন্ত-১২
লেখা:Zannatul Eva
চারদিকে যখন সন্ধ্যে নেমে এলো তখন সবাই রুহিকে খুঁজতে শুরু করলো। ওদিকে রুহি পা মুচকে পরে আছে। মাহির এসে রুহিকে ধরে উঠাতে চাইলে রুহি বলল, একদম এডভান্টেজ নেবেন না৷ আমি নিজে নিজেই উঠতে পারবো। ধরতে হবে না আমাকে।
রুহি বারন করায় মাহির আর তাকে ধরলো না। রুহি নিজে নিজেই উঠার চেষ্টা করলো। তৃতীয় বারের মতো আবারও পরে গেল সে।
রুহি মাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, সব দোষ আপনার। আপনার সাথে দেখা না হলে দেরিও হতো না আর আমি পরে গিয়ে ব্যথাও পেতাম না। আপনি যেখানেই যাবেন সেখানেই কিছু না কিছু গন্ডগোল বাঁধবে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এরপর তো আরও অন্ধকার হয়ে যাবে৷ তখন আমি একা একা এই পা নিয়ে কী করে বাড়ি যাবো! হায় রুহি এখন তোর কী হবে?
মাহির গম্ভীর গলায় বলল, বেশি কথা না বলে আমার হাত ধরো। আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।
ওমনি না! এখন আমার আপনার হাত ধরতে হবে! ইম্পসিবল। এর থেকে ভালো আমি সারা রাত এখানেই পরে থাকি। কিন্তু এখানে একা একা কিভাবে থাকবো আমি! যদি ভূত আসে! হায় রুহি এই ছিল তোর কপালে! পা টা এখনি মচকাতে হলো। আজকে দাদিজান তোকে মেরেই ফেলবে৷
মাহির রুহির কোনো কথা পাত্তা না দিয়ে সোজা রুহিকে কোলে তুলে নিলো।
রুহি একদম থ মেরে আছে। এটা কী হলো তার সাথে! মাহির এটা কী করলো! জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বলল, নামান আমাকে। কী করছেন টা কী আপনি!! প্লিজ আমাকে নামান।
মাহির একটা ধমক দিয়ে বলল, নামিয়ে দিলে ভাঙ্গা পা নিয়ে তোমাকে এখানেই পরে থাকতে হবে সারারাত। তারপর রাতে তেনারা আসবে তোমার সাথে দেখা করতে। তেনাদের সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে? তাহলে নামিয়ে দিচ্ছি।
এই না আমি ভূতে অনেক ভয় পাই। কিন্তু তা বলে আপনি আমাকে কোলে তুলে নেবেন! সাধেই কি আমি আপনাকে গুন্ডা বলি? আপনি অসভ্যও বটে।
মাহির বলল, আমি তো প্রথমে হাত বাড়িয়েছিলাম। তুমিই তো বকবক শুরু করলে। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। আমাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে নাকি! তোমাকে একা ফেলে তো চলে যেতে পারি না। করলাম উপকার আর উপাধি পেলাম অসভ্য। কী কপাল আমার!
কিছুদূর যাওয়ার পর কয়েকজন মুরব্বিদের সামনে পরলো মাহির আর রুহি। মাহিরের কোলে রুহি! গ্রামের মুরব্বিরা এমন দৃশ্য দেখে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর নাউজুবিল্লাহ বলে উঠলেন।
রহি মাহিরকে বলল, তাকে নামিয়ে দিতে। কিন্তু মাহির কিছুতেই তার কথা শুনলো না।
মুরব্বিরা বললেন, কারা তোমরা? আর এমনে রাস্তা দিয়া হাঁটতাছো ছিঃ ছিঃ।
মাহির বলল, একচুয়েলি ওর পায়ে চোট লেগেছে৷ মনে হয় মচকে গেছে। হাঁটতে পারছে না একদম।
ইনি কী তোমার বউ?
রুহি ভীষণ লজ্জা পেল। মাহির উঁচু স্বরে বলল, না।
মুরব্বিরা বললেন, তাইলে এই মাইয়া তোমার কী হয়?
মাহির বলল, দেখুন আমরা পরিচিত। আমাদের এখন যেতে হবে৷
ইতোমধ্যেই গ্রামের কয়েকজন ছেলেপেলে এসে মাহির এবং রুহিকে ঘিরে দাঁড়ালো। মাহির খেয়াল করলো, এই ছেলে গুলোই সেদিন বিয়ে বাড়িতে রুহিকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করেছিল।
ছেলে গুলো বিচ্ছিরি নজরে তাকিয়ে বলল, কী মামা! সেদিন তো খুব বড় বড় কথা বলছিলি এখন তো দেখতেছি তুই নিজেই লাল পরী নিয়া ঘুইরা বেড়াচ্ছিস। তাও আবার সোজা কোলে নিয়া!!
একথা বলেই ছেলে গুলো পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠলো।
রুহি মাহিরকে বলল, প্লিজ আমাকে নামান নয়তো ওরা আরও আজেবাজে কথা বলবে।
মাহির বলল, তুমি একদম চুপ করে থাকো।
ছেলে গুলো বলল, কী মামা ক্লিয়ার করো কী সব চলতেছে তোমাদের মধ্যে? গ্রামের নির্জন জায়গায় পরী নিয়া কী করতে ছিলা? এসব তো আমাদের এখানে চলবো না। এইটা তোমার ঢাকা শহর না যে প্রেমিকা নিয়া যা খুশি কইরা বেড়াইবা৷ এইখানে পরপুরুষের সাথে মেয়ে দেখা গেল মানে……
মাহির ভারী গলায় বলল, মানে?
মানেটা চাচারাই বোঝাক। কী চাচারা! বুঝাইয়া বলেন এদের।
মুরব্বিরা বললেন, কথা ঠিক কিন্তু এরা কোন বাড়ির পোলা মাইয়া তাও তো জানা দরকার।
মাহির বলল, হোয়াট ইজ দিছ! কী করেছি আমরা? সেদিন ছেড়ে দিয়েছি বলে ভাবিস না আজও ছেড়ে দেবো। হাত উঠার আগে আমাদের যেতে দে। আর আংকেল আপনাদের কী কী জানার আছে কাইন্ডলি জিজ্ঞেস করুন। এরপর আমাদের যেতে দিন।
তোমাগো দুইজনের বাপের নাম কও।
মাহির বলল, আমার বাবার নাম তামজিদ আহমেদ।
ও আইচ্ছা আইচ্ছা তুমি তামজিদের পোলা? ঢাকা থেইকা আইছো?
জ্বী।
তা তোমার বাপের নাম কী মা।
রুহি বলল, আমি বড় খান বাড়ির মেয়ে। আমার বাবার নাম আশরাফ খান।
মুরব্বিরা বললেন, আইচ্ছা তোমরা আমগো লগে একটু এদিকে আসো।
রুহি বলল, কোথায় যাবো? আমাদের তো বাড়িতে ফিরতে হবে।
ফিরবা ফিরবা। অবশ্যই বাড়িতে ফিরবা। তার আগে তোমাগো বাড়ির নাম্বার দেও। কথা বলি তারপর ওনাদের আসতে বলি। তারপর না হয় বাড়ি যাইয়ো। এইভাবে কেমনে ছাড়ি তোমাদের!
রুহি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। এই জন্যই বোধহয় রুম্পা তখন বলেছিলো এই দিকের লোকজন ভালো না। আল্লাহ জানে আজ কপালে কী আছে। এই মাহিরটা কিছু করছে না কেনো? এমনিতে তো সবসময় হাত পা চলতে থাকে।
এই যে শুনছেন। রুহি বলল।
হ্যাঁ বলো।
আমাকে নিয়ে একটা দৌড় দিলেও তো পারেন। এখানে এদের সাথে বসে কী করবো আমরা! বাড়ি যাবো কখন?
মাহির কপাল কুঁচকে বলল, পালাবো কেনো আমরা? আমরা কী চোর নাকি! তুমি একটু এখানে বসো। আমি দেখছি এরা কী করতে চাইছে।
কই কই তোমাগো বাড়ির নাম্বার দেও তারাতারি।
মাহির নিজের ফোন থেকে তামজিদ আহমেদকে কল করলো। তারপর এক মুরব্বিকে ফোনটা দিলো কথা বলার জন্য।
মুরব্বি একটু দূরে গিয়ে কী সব যেনো বলে আবার চলে আসলো।
মাহির বলল, আপনি দূরে গেলেন কেনো? এখানে কথা বলতে প্রবলেম কী!
মুরব্বি সাইডে ফিরে পানের পিক ফেলে বললেন, তোমার বাবা আসলেই বুঝবা কী সমস্যা হইছে। এহন এইহানে চুপচাপ বইসা থাকো দুইজনে। ও মাইয়া তোমার বাপের নাম্বার দেও।
রুহি বলল, আমার ফোনটা সুইচড অফ হয়ে গেছে।
কোনো সমস্যা নাই আমাগো লগে ফোন আছে। নাম্বারটা দেও দেহি।
মাহির বলল, আপনারা কী করতে চাইছেন বলুন তো? আমাদের এভাবে আটকে রেখেছেন কেনো?
মুরব্বি আবারও একটু দূরে গিয়ে রুহির বাবার সাথে কথা বলে এলো।
ছেলে গুলো নিজেদের মধ্যে কি সব যেনো বলাবলি করছিল। কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
প্রায় অনেকক্ষন পর মাহির এবং রুহির বাবা একসাথে চলে এলেন।
রুহির বাবা আশরাফ খান উতলা কন্ঠে মেয়েকে বললেন, কোথায় গিয়েছিলি তুই? সারা বাড়ি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সবাই। আর তোর ফোন বন্ধ কেনো?
মুরব্বিরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছেন যা ভাবছি তাই।
তামজিদ আহমেদ বললেন, কী ব্যপার মাহির? কী হয়েছে? সবটা খুলে বলো তো আমাকে।
মাহির তার বাবাকে সবটা খুলে বলল। কিন্তু এখানের মুরব্বিরা আর ছেলে গুলো মাহিরের কোনো কথাই বিশ্বাস করছে না। তারা উল্টো বলতে শুরু করলো, এই পোলা রাত বিরাইতে এই মাইয়া নিয়া পালাইতেছিল। এহন ধরা পইরা গল্প বানাইতেছে।
মাহির প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল, হোয়াট দ্যা হেল! কী সব বলছেন আপনারা!!
রুহির বাবা আশরাফ খান কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পরলেন। এর আগে মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এখনও ধামাচাপা পরেনি৷ আর তার মধ্যে এখন আবার এই ঘটনা।
রুহি কান্না করছে। মাহির রুহিকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই রুহির কান্না থামছে না।
তামজিদ আহমেদ বললেন, আপনারা আমাকে খুব ভালো করেই চেনেন। আমার ছেলে এমন কাজ কিছুতেই করতে পারে না৷ ওরা দুজনেই ঘুরতে বেরিয়েছিল। আর র্দুভাগ্যবশত ফেরার সময় রুহির পা মচকে যায়। মাহির রুহিকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলো। আপনারা ওদেরকে ভুল বুঝছেন।
বখাটে ছেলে গুলো চেচিয়ে চেচিয়ে বলল, ধরা পরলে সবাই এমনই বলে। ছেলেমেয়ে কী সব করে বেড়াচ্ছে আর আপনারা আসছেন সাফাই গাইতে। কিন্তু আমরা তো এইভাবে ছাইড়া দিম না৷ এই মাইয়ার গায়ে যেই বদনাম লাগছে তার কী হইবো?
ছেলে গুলো মাহিরের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, খুব তো সেদিন হিরো সাজছিলি। আজ দেখবো তোর হিরো গিরি। ধর্ষিতা মেয়ের জন্য দরদ একদম উথলে পরছিল। এখন দেখবো বড় বড় কথা কোথায় যায়।
আশরাফ খান মাহিরের বাবার হাত ধরে বলল, এসব কী হয়ে গেল তামজিদ! এই ঘটনা সারা গ্রাম ছড়িয়ে পরলে আমার মেয়েটার যে অনেক বড় বদনাম হয়ে যাবে। তুই তো সব জানিস। এর আগেও……….
কথা গুলো বলেই আশরাফ খান কেঁদে উঠলেন।
মুরব্বিরা বললেন, সমাধান একটা আছে।
চলবে……