না চাইলেও তুই আমার পর্ব ১৫+১৬

#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ১৫

গভীর রাত! এখন ঠিক কয়টা বাজে তা মিরার অজানা। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ছাদে রেলিংয়ে উপর উঠে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসে আছে মিরা। ছাদের হালকা আলোতে মিরার অনামিকা আঙ্গুলে আংটি টা ঝল ঝল করছে। কিন্তু মিরা ওদিকে না তাকিয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। সামনের রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যে দুই একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। বাড়ির গার্ডরা আধাঘণ্টা পর পর এসে বাড়ির চারপাশে দেখে যাচ্ছে। মিরা ছদে বসে ভালো ভাবে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। দক্ষিণ দিকে থেকে হালকা হালকা বাতাস বইছে। বাগানের বড় আম গাছটার সাথে বাঁধা দোলনা বাতাসে একা একা দুলছে। মিরার ফুপি না কী তার ছোটবেলায় আম গাছটার সাথে দোলনা বেঁধে দেওয়ার জন্য খুব কান্না করছিলো পরে তার কান্না থামাতে গাছের সাথে দোলনা বেঁধে দেওয়ার হয় তাকে, এসব কিছু মিরা ওর দাদির কাছ থেকে শুনেছে। এই দোলনাটা মিরাও বহুবার চড়েছে। চাঁদ বিহীন আকাশের দিকে মাঝে মধ্যে তাকাচ্ছে মিরা। আকাশে চাঁদ না থাকালেও তারার ক্ষুদ্র আলো মিরার কাছে বেশ লাগছে। অন্ধকার জঙ্গলে হঠাৎ করে হাজারো জোনাকি পোকা দেখা মিললে যেমন অনুভূতি হয় মিরার কাছে চাঁদ বিহীন আকাশ তেমন লাগে। মিরার মনে হয় আকাশ এক অন্ধকার জঙ্গল আর তারাগুলো হলো জোনাকি পোকা। অদ্ভুত মিরার চিন্তা। সন্ধ্যার পর থেকে মিরার মেজাস খারাপ হয়ে আছে। মিরার মেজাস খারাপ হওয়ার একমাত্র কারণ হলো মিহান। দুইদিন হলো মিরার নানাবাড়ি থেকে খান বাড়িতে এসেছে। নিঝুম বিকালে থেকে বায়না ধরেছিলো আজ ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে, অগত্যা তিন বোন মিলে ঘুরতে বের হয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটার বেশি বেজে যায়। বাড়ি ফিরে হল রুমে মিহান কে দেখে মিরা বেশ ভালো ভাবে চমকায়। মিহান সাথে ওর বাবা মা এসেছিলো। মিহান ওদের সাথে মিরার পরিচয় করিয়ে দেয়। মিরা নরমালি ওদের সাথে কথা বলেছে। হঠাৎ করে মিহানের মা মিরাকে একটা আংটি পরিয়ে দেয় মিরা তখনো কিছু বুঝতে পারেনি। মিহানরা যাবার পর যখন শুনলো ওরা মিরাকে দেখতে এসেছিলো আর মিরার পাপাও মিহানকে পছন্দ হয়েছে তখন থেকে মিরা খুব রেগে আছে। মিরা কখনো মিহানকে বন্ধু ছাড়া অন্য কোনো নজরে দেখেনি সেখানে ওকে লাইফ পার্টনার হিসেবে কী করে মেনে নিবে? মিহান তো একবার এই ব্যাপারে মিরার সাথে কথা বলতে পারতো! কিন্তু না মিহান সোজা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে ওর বাড়িতে। মিরা কী করবে নিজেই ভেবে পাচ্ছে না যেখানে ওর পাপার মিহানকে পছন্দ হয়েছে! মিরা ঠিক করে কাল সকালে ওর পাপার সাথে কথা বলে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নিবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরা নিজের রুমে যায়। চোখ বন্ধ করে আজকে সারাদিনের কথা চিন্তা করছে মিরা হঠাৎ ফোনের শব্দে চোখ খুলে তাকায়। হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে দেখে আয়ান ফোন করছে। আয়ান হলো প্রিয়ার ভাই। কিন্তু হঠাৎ করে আয়ান কেনো ফোন করলো? মিরা আর সাত পাঁচ না ভেবে ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে আয়ান বললো,

—” আপু তোমাকে আমি কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি, তুমি ফোন রিসিভ করছিলে না কেনো? ওহ সরি সরি তোমাদের ওখানে তো গভীর রাত।”

—” আয়ান শান্ত হয়। কী হয়েছে? তুই এমন করছিস কেনো?”

আয়ান ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলে,

—” পাপা না আপুর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে।”

মিরা অবাক হয়ে বলে,

—” What?”

—” হ্যা আপু। আপুকে রনিত নামে একটা ছেলে প্রপোজ করছিলো না তারপর তুমি আর আপু মিলে তাকে মারছিলে। তার সাথে পাপা আপুর বিয়ে ঠিক করছে।”

মিরা অবাক কন্ঠে বলে,

—” কী? প্রিয়া আর প্রেম দুজন দুজনকে ভালোবাসে তা তো আঙ্কেলে জানে তাহলে?”

—” ঐ রনিত পাপা কে প্রেম ভাইয়ার নামে ভুল বুঝিয়েছে। ভাইয়ার না কী আরো অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। আপুকে ভাইয়া ভালোবাসে না পাপার প্রপার্টির জন্য ইউস করছে। শুধু তাই নয় ভাইয়া না কী অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। এসব শুনে পাপা আপু আর প্রেম ভাইয়া দেখা করা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়।”

মিরা রেগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

—” ঐ রনিতের এত বড় সাহস। ওকে আমি ছাড়বো না। এখন প্রেমের কী অবস্থা আয়ান?”

আয়ান ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

—” জানো আপু? প্রেম ভাইয়া সাহস করে তার পাপা কে আপুর কথা বলে। আঙ্কেল খুশি হয় আপুর কথা শুনে। আঙ্কেল পাপার সাথে কথা বলে বিয়ের ব্যাপারে। কিন্তু পাপা তাকে না করে দেয়। প্রেম ভাইয়া ভালো নেই আপুকে ছাড়া। আমি আপুকে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছিলাম কিন্তু আপু বলে তুমি তোমার ফ্যামিলির সাথে বিজি আছো, ওদের এমন অবস্থা দেখে ওদের না জানিয়ে তোমাকে ফোন করেছি। প্লিজ তুমি কিছু করো আপু।”

—” তুই চিন্তা করিস না। আমি দেখছি কী করা যায়।”

মিরা ফোন রেখে ভাবনার পড়ে যায় প্রেম আর প্রিয়া কে নিয়ে।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে মিরার দেরি হয়ে গেছে। অবশ্য বেশি দেরি হয়নি সবে নয়টা বাজে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে শোনে ওর পাপা আর দাদা কী কাজে সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে সাথে ডেনিকেও নিয়ে গেছে। মিরা আর কিছু না ভেবে উপরে গিয়ে জামাকাপড় প্যাক করতে শুরু করে। মিরা অনলাইনে ফ্লাইটের টিকিট কেটে, রেডি হয়ে সবকিছু চেক করে। সবকিছু ঠিক থাকলেও মিরার পাসপোর্ট খুঁজে পাচ্ছে না। পাসপোর্ট না পেয়ে মিরা ওর মাম্মা কে ডাকে।

—” কী হলো এত ডাকছিস কেনো? আর তুই রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”

—” আজকেই আমার লন্ডন বেক করতে হবে মাম্মা। ইটস আর্জেন্ট। কিন্তু আমার পাসপোর্ট খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি নিয়েছো আমার পাসপোর্ট?”

—” হঠাৎ করে তোর কী এমন হলো যে আজকেই তোকে লন্ডন যেতে হবে?”

—” মাম্মা এতকিছু বলার সময় নেই। তুমি বলো পাসপোর্ট কোথায়?”

—” তোর পাপার কাছে?”

মিরা অবাক হয়ে বলে,

—” what? পাপার কাছে কীভাবে গেলো পাসপোর্ট? পাসপোর্ট তো আমার কাবাডে ছিলো?”

মিরা মাম্মা আমতা আমতা করে বলে,

—” আসলে কালকে মিহান বলছিলো তুই বিয়েতে রাজি না হলে আবার তুই লন্ডন চলে যাবি। তাই মিহান তোর পাসপোর্ট লুকিয়ে ফেলতে বলেছিলো। তার জন্য তোর পাপা,,,

মিরা আর নিজেকে শান্ত রাখতে না পেরে রেগে চিৎকার করে বলে,

—” তাই তো কী হে? আমার পাসপোর্ট আমাকে না বলে নিয়ে গেছে। তোমাদের কাছে কে বড় ঐ মিহান না আমি? কতটুকু চেনো তোমরা ওকে? মাত্র একদিনের আলাপে তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললে তার সাথে? সে বললো আমার পাসপোর্ট নিয়ে যেতে আর তোমরাও তার কথামত পাসপোর্ট নিয়ে নিলে। It’s a ridiculous thing, isn’t it? আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করছিলে আমি এই বিয়েতে রাজি কী না? না! নিজেদের মত করে আমারটাও ভাবতে শুরু করলে। তাহলে থাকো তোমরা তোমাদের মিহানকে নিয়ে আমাকে তোমাদের আর কোনো দরকার নেই তাই না?”

মিরা ওর মাম্মার উত্তরের অপেক্ষা না করে কোনো রকম ট্রলি টা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মিরা মাম্মা এতক্ষন মিরার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মিরা আর যার সাথে রাগারাগি করুক না কেনো কখনো ওর পাপা আর মাম্মার সাথে রাগারাগি করে না কিন্তু আজ? আর কিছু ভাবতে পারছে না তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে মিরার পিছন পিছন যায়।

—” মিরা আমার কথাটা শোন মা। তুই যেমন টা চাইবি সবকিছু তেমন হবে। শোন আমার কথাটা।”

কে শুনে কার কথা? মিরা রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এদিকে মিরার মাম্মা চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। ডেনিকে আজ নিলয় তার সাথে নিয়ে গেছে এখন কী করবে? মিরা মাম্মা তাড়াতাড়ি করে মিরার দাদি আর ফুপির কাছে যায়।

__________________________________________

রাত এগারোটা বাজে। মিরা Airport দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে লন্ডন থেকে আসা ফ্লাইট লেন্ড করেছে। চারদিকে মানুষের কোলাহল। সবকিছু মিরার কাছে বিষাদের মত লাগছে। এই প্রথম মিরা ওর মাম্মার সাথে রেগে, চিৎকার করে কথা বলছে। নিজের কাছে খারাপ লাগছে মিরার। মিরা জানে ওর কথায় ওর মাম্মা খুব কষ্ট পেয়েছে কিন্তু তখন মিহানে উপরে রাগ আর প্রেম আর প্রিয়া এদের চিন্তায় মিরার মাথা ঠিক ছিলো না। একা একা দাঁড়িয়ে মিরা এসব ভাবছিলো তখন প্রিয়া এসে মিরাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। প্রিয়ার পিছনে প্রেম দাঁড়িয়ে আছে। মিরা প্রিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

—” কান্না করছিস কেনো? দেখবি আমি আর আঙ্কেল মানে প্রেমের পাপা মিলে সব কিছু ঠিক করে দেবো। একদম চিন্তা করিস না। এবার কান্না থামা।”

প্রিয়া চোখ মুছে বলে,

—” হুম।”

প্রেম কাঁপা কাঁপা গলায় মিরাকে বলে,

—” এতকিছু কখন করলি মিরা?”

—” চল গাড়িতে গিয়ে বলছি!”

সবাই গাড়িতে উঠে বসলে প্রিয়া মিরার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” এবার বল, এতকিছু করলি কখন?

মিরা জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

—” কাল রাতে আয়ান আমাকে ফোন করে সবকিছু বলছে। আমি দুপুরের ফ্লাইটে লন্ডন বেক করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার পাসপোর্টের সমস্যার কারণে আর যেতে পারিনি। তখন আঙ্কেলকে মানে প্রেমের পাপা কে ফোন করে সবকিছু বলি আর তোদের এখানে পাঠিয়ে দিতে বলি। আঙ্কেলও তাড়াতাড়ি করে ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলে আর আয়ানের সাহায্যে প্রিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে আনে। আঙ্কেল আর আয়ান মিলে তোদের airport পর্যন্ত দিয়ে যায় আর যাওয়ার সময় তোদের ফোন দুটো নিয়ে যায়। এবার বুঝলি সব?”

প্রিয়া মিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

—” জানিস আমি মনে করেছিলাম আমি আর কখনো বোধহয় প্রেমকে পাবো না কিন্তু তোর জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাবো।”

মিরা হালকা হেসে বলে,

—” হইছে আর দেবদাস মার্কা কথা বলতে হবে না। আমি আছি তো না কী?”

প্রেম শান্ত গলায় বলে,

—” কিন্তু মিরা আমরা ভাড়ার গাড়িতে যাচ্ছি কেনো? তোর গাড়ি কোথায়?”

—” আমি গাড়ি airport এর সামনে আছে।”

—” মানে?”

—” আমি চাই না আমাদেরকে কেউ সহজে খুঁজে পাক। তাই গাড়ি ওখানে ইচ্ছে করে ফেলে এসেছি। আর এখন কিছু জিজ্ঞাসা করিস না আমি পরে সবকিছু তোদের বুঝিয়ে বলবো।”

মিরার কথা শুনে দুজনেই চুপ হয়ে যায়, কারন জানে‌ এখন হাজার বললেও মিরা তাদের কিছু বলবে না।

চলবে…..
#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ১৬

সকাল সাড়ে সাতটার দিকে মিরারা বান্দরবান পৌঁছায়। প্রেম আর প্রিয়া গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। চারদিকে বড় বড় পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মিরা আরো একবার বান্দরবান এসেছিলো। মিরা ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়া কালিন স্কুলে গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলো, তখন মিরা ওর পাপার কাছে আবদার করেছিলো ওকে আর ওর মাম্মা কে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবার জন্য। মিরার পাপাও মিরার কথা রাখতে বান্দরবান ঘুরতে নিয়ে এসেছিলো। খুব আনন্দ করেছিলো তিনজনে মিলে। এইসব ভাবতেই মিরার ঠোঁটের কোণে হাঁসি রেখে ফুটে ওঠে। মিরা গাড়ি থেকে দুটো ট্রলি বের করে একটা প্রিয়ার হাতে দিয়ে বলে,

—” তুই তো বাড়ি থেকে কিছু আনতে পারিস নি। তাই আমি তোর জন্য আগে থেকে শপিং করে রেখেছিলাম। এই ট্রলিতে তোর প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে।”

প্রেম কটাক্ষ করে করে বলে,

—” বাহ! বাহ! শুধু প্রিয়ার জন্য? আর আমার জন্য কিছু না?”

প্রেমের কথা শুনে প্রিয়া ভেংচি কাটে। মিরা ঠোঁটের কোণে হাঁসি এনে বলে,

—” আরে তুই তো সবকিছু আনার সময় পেয়েছিস। ইভেন তোকে তোর ফ্যামিলির সবাই হেল্পও করেছে আর প্রিয়া ওতো এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাই ওর জন্য হবে না কী তোর জন্য হবে?”

—” আচ্ছা ছাড় এসব কথা। এখন বল আমরা বান্দরবান এসেছি কেনো?”

মিরা নিজের চুলগুলো ঠিক করতে করতে ভাব নিয়ে বলে,

—” সেটা এখন না জানলেও চলবে তোর।”

—” হইছে মা তোর আর অভিনয় করা লাগবে না। এখন চল না হলে হোটেলে একটা রুমও পাবো না।”

—” এতো চিন্তা করিস কেনো আমি তো আছি।‌ কাল দুপুরে অনলাইনে দুটো রুম বুক করে নিয়েছি। একটায় আমি আর প্রিয়া থাকবো আর একটায় তুই। চল রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে নেই।”

প্রিয়া মিরার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” হ্যা, তাড়াতাড়ি চল। আমার ভিশন টায়ার্ড লাগছে। গাড়িতে ভালো করে ঘুম হয়নি আমার।”

প্রেম হাঁটতে হাঁটতে বলে,

—” মিরা ব্রেকফাস্ট টা যার যার রুমে দিতে বলি। তোরাও ব্রেকফাস্ট করে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়।”

—” ঠিক আছে। তাই কর।”

__________________________________________

মিহান খান বাড়ির হল রুমে বসে আছে। মিহানের সামনে মিরার দাদা, পাপা আর ফুপা বসে আছে। মিহানকে ফোন করে ডাকা হয়েছে খান বাড়িতে। মিরা বিয়েতে যে রাজি না এইসব কিছু খুলে বলে মিরার পাপা মিহানকে। কাল এর জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে মিরা এটাও মিহানকে বলে। সব শুনে মিহান মাথা নিচু করে আছে। মিরার পাপা মিহানের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,

—” মিহান আমি জানি তুমি আমার মেয়েকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসো। ওর জন্য আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের দিকে ঘুরেও তাকাওনি। মিরা বলেছিলো বলে তুমি ডাক্তার হয়েছো। তোমার মা বাবা আমাকে সবকিছু বলেছে। আরো কী কী করেছো সে সব আমার অজানা। আমিও চাই মিরা লাইফ পার্টনার হিসেবে তোমাকে বেছে নিক। ওর ইচ্ছায় বেছে নিক। আমি ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবো না মিহান। আমি কখনো ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করিনি আর করবো না। ডেনি মিরাকে খোঁজার চেষ্টা করছে। আমি জানি সন্ধ্যার আগেই জানতে পারবো ও কোথায় আছে কিন্তু কাল মিরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর ওর মাম্মা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। আমি বাড়ি ফিরে ওকে শান্ত করি। এখন ঘুমের মেডিসিন খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি হয়তো একটু পর উঠে যাবে।”

মিরার পাপা এইটুকু বলে থেকে আবার বলতে শুরু করে,

—” মিরার মনে তোমার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করার জন্য আমি তোমাকে তিন মাস সময় দেবো মিহান। এরমধ্যে মিরা যদি তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারে তাহলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না। আর যদি এই তিনমাসে মিরা তোমাকে মেনে নিতে না পারে তাহলে আমার কিছু করার নেই মিহান। আমি আমার মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবো না।”

মিহান সবকিছু শুনে ভাবনায় পড়ে যায় কী করবে মিহান? এই তিন মাসে মিরা যদি রাজি না হয় তাহলে? মিহানের ভালোবাসা তো আর ঠুনকো নয়? মিহানকে পারতে হবে। ভালোবাসা জন্য মানুষ কী না করে আর মিহান এইটুকু পারবে না? ভেবে চিন্তে মিহান হাঁসি মুখে মিরার পাপার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” আঙ্কেল আমি রাজি আপনার শর্তে। কিন্তু আঙ্কেল আপনাকে আমার কিছু হেল্প করতে হবে।”

মিরা হালকা হেসে বলে,

—” তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার পাশে আছি।”

মিহান দাঁড়ি গিয়ে বলে,

—” আঙ্কেল আজ তাহলে উঠি। আমাকে একবার হসপিটালেও যেতে হবে। ডেনি মিরার কোনো খবর পেলে আমাকে জানাবেন প্লিজ আর আমিও খোঁজার চেষ্টা করছি।”

—” তুমি চিন্তা করো না। মিরার খবর পেলে তোমাকে জানাবো।”

মিহান মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মিরার দাদা মিরার পাপার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” আমি তোর এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি নিলয়। আমার মনে হয় মিহান দাদুভাই পারবে মিরাকে সামলে রাখতে।”

—” হ্যা বাবা কাল রাতে অনেক ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। আমি মিহানের ব্যপারে খোঁজ নিয়েছি। মিরার জন্য মিহান বেস্ট চয়েজ।”

মিরার ফুপা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” কিন্তু মিরা কী রাজি হবে?”

মিরার পাপা ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটিয়ে তুলে বলে,

—” সে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। এদিকটা আমি সামলে নিতে পারবো।”

__________________________________________

পড়ন্ত দুপুর। সূর্য তার নিজের উত্তাপ ছড়াতে ব্যস্ত। মিরা শাওয়ার নিয়ে বারান্দায় সূর্যের উত্তাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। মিরা অনেকক্ষণ ধরে রোদ্দুরময় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে দুই একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে মিরার, কিন্তু এই ভালো লাগার মধ্যেও কোথাও খারাপ লাগছে মিরার। মিরার মনে অজানা আশঙ্কা হচ্ছে। কিন্তু কেনো? তা হয়তো মিরা জানে। হ্যা! ওর মাম্মার জন্য ভালো নেই মিরা। কাল শুধু শুধু মাম্মার সাথে রাগারাগি করছে মিরা। ওর মাম্মার ই কী বা দোষ? সব বাবা মা চায় তাদের সন্তানে যেনো ভালো থাকে। এসব ভেবে মিরার খারাপ লাগছে। আচ্ছা ওর মাম্মা ভালো আছে তো? না কি ওর উপর অভিমান করে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে?

মিরা আর না ভেবে ব্যস্ত পায়ে রুমে এসে দেখে প্রিয়া এখনো ঘুমাচ্ছে ওর দিকে না তাকিয়ে ফোন ওপেন করে মিরা। মিরা ওর মাম্মা কে ফোন করে। মিরার মাম্মা ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। মিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

—” Sorry, Mama I am extremely sorry. তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না। তাই না বুঝে তোমার সাথে রাগারাগি করছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও মাম্মা।”

মিরার মাম্মা মৃদু কন্ঠে বলে,

—” তুই সরি কেনো বলছিস? আমাদেরও উচিত ছিলো তোর সাথে কথা বলার কিন্তু তখন মিহানকে আমাদের এত ভালো লাগে তাই তোর সাথে এই ব্যপারে কথা বলা হয়নি। তোর পাপা আমাকে বলেছিলো সে সন্ধ্যায় বাড়ি এসে তোর সাথে এই ব্যপারে কথা বলবে কিন্তু তার আগেই তুই!”

—” না মাম্মা আমি আগে থেকেই খুব ডিস্টার্ব ছিলাম। তার উপরে কাল সকালে পাসপোর্ট খুঁজে না পেয়ে আরো মাথা খারাপ হয়ে যায়। এতে তোমাদের কোনো দোষ নেই।”

মাম্মা অবাক কন্ঠে বলে,

—” আর কী করেন?”

মিরা ওর মাম্মা কে প্রেম আর প্রিয়ার ব্যপারটা সব খুলে বলে। সবকিছু শুনে মিরার মাম্মা বলে,

—” সরি সোনা আমি একদম বুঝতে পারিনি তুই এতো টেনশনের মধ্যে ছিলি।”

—” মাম্মা তুমি সরি বলছো কেনো? এখানে তোমার তো কোনো দোষ নেই।”

মিরার মাম্মা আসতে করে বলে,

—” হুম।”

—” আচ্ছা মাম্মা আমি এখন ফোন রাখি। আর তুমি পাপা কে বুঝিয়ে বলো।‌ ঠিক আছে।”

—” আচ্ছা। তুই সাবধানে থাকবি। এক এক কোথাও যাবি না বিশেষ করে পাহাড়। মনে থাকবে?

মিরা ওর মাম্মার কথা শুনে হালকা হেসে বলে,

—” হ্যা! মনে থাকবে।”

ফোন কেটে মিরার মাম্মার ঠোঁটে আনমনে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

মিরা ফোন টা বেডের পাশে রেখে ঘুরতে না ঘুরতেই দরজায় কেউ নক করে। মিরা ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে প্রেম এসেছে। মিরা প্রেমকে যাওয়ার জায়গা দিয়ে বলে,

—” কখন ঘুম থেকে উঠছিস?”

—” ঘন্টা দুয়েক হবে হয়তো!”

মিরা দরজা চাপিয়ে দিয়ে বলে,

—” তো এতক্ষন কী করলি?”

প্রেম সোফায় বসে বলে,

—” আশেপাশটা ঘুরে দেখছিলাম।”

—” দুপুরে খেয়েছিস কিছু?”

—” না! সেজন্য তো তোদের ডাকতে এলাম। প্রিয়াকে তুল ঘুম থেকে। আর কত ঘুমাবে?”

—” ক্লান্ত ছিলো তো তাই। তুই বস আমি ওকে ডাকছি।”

—” দেখ উঠে কী না!”

মিরা ডাকাডাকি করে প্রিয়াকে ঘুম থেকে তুলে। প্রিয়া ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,

—” কী হয়েছে এতো ডাকাডাকি করছিস কেনো?”

—” ডাকছি কী আর সাধে। উঠ উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর লাঞ্চ করে ঘুরতে যাবো।”

প্রিয়া ছোট ছোট চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” কোথায় ঘুরবি এখন?”

প্রেম বলে,

—” আমি একটু আগে বের হয়ে ছিলাম না তখন লোকমুখে নীলাচল নীলাচল শুনে একজনকে জিজ্ঞাসা করি সে বলে, বান্দরবানের সবথেকে সুন্দর জায়গা না কী নীলাচল। যাবি তোরা?”

প্রিয়া কপাল ভাঁজ করে বলে,

—” নীলাচল এটা আবার কেমন নাম? না জানি দেখতে কেমন হবে? দরকার নেই যাওয়ার।”

প্রিয়ার কথা শুনে মিরা শব্দ করে হাসে। প্রেম অবাক হয়ে বলে,

—” কী হলো তুই আবার পাগলের মত হাসছিস কেনো?”

মিরা হাঁসি থামিয়ে বলে,

—” প্রিয়ার কথা শুনে হাসছি। তুই যেমন ভাবছিস তেমন না। নীলাচলকে বাংলার দার্জিলিং বললে বোঝা যায় এর সৌন্দর্য। ২০০৬ সালের পহেলা জানুয়ারি এই প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। এ প্রকল্পে রয়েছে “শুভ্রনীলা”, “ঝুলন্ত নীলা”, “নীহারিকা”, এবং “ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট” নামে পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় বিশ্রামাগার। কমপ্লেক্সের মাঝে বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা এবং বসার ব্যবস্থা রয়েছে। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাজানো হয়েছে এ জায়গাগুলো। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সামনের পাহাড়ের দৃশ্যও ভিন্ন ভিন্ন রকম। একটি থেকে আরেকটি একেবারেই আলাদা, স্বতন্ত্র। এই জায়গায় বর্ষা, শরৎ কি হেমন্ত— তিন ঋতুতে ছোঁয়া যায় মেঘ। নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উচ্চতায় টাইগার পাড়ায় পাহাড়ের উপর অবস্থিত। নীলাচলে রয়েছে আকাশ, পাহাড় আর মেঘের অপূর্ব মিতালী আর তুলনাহীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। সকালে মেঘের ভেলার খেলা আর বিকেলের সূর্যাস্ত এই দুইটি সময়ই নীলাচল তার পূর্ণ রূপ ধারণ করে। নীলাচল থেকে পুরো বান্দরবান শহরকে দেখা যায় আবার মেঘমুক্ত আকাশ থাকলে দূরের কক্সবাজার সাগর সৈকত হাতছানী দেয় পর্যটকদের। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা সমানভাবে বিমোহিত করে পর্যটকদের। নীলাচলের একেক স্থান থেকে একেক রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আগত পর্যটকদের নীলাচলের রূপ অবলোকন করার সুবিধার জন্য এখানে রয়েছে কয়েকটি বিশ্রামাগার ও রিসোর্ট। নীলাচলে পর্যটকরা সাধারণত সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে পারেন। পরবর্তীতে শুধুমাত্র যারা রিসোর্টে রাত্রি যাপন করেন তাদেরই থাকার অনুমতি মিলে। যদি মেঘের দেখা পেতে চাস তো তবে খুব সকালে যেতে হবে নীলাচল। নীলাচল থেকে সমগ্র বান্দরবান শহর একনজরে দেখা যায়। মেঘমুক্ত আকাশে কক্সবাজারর সমুদ্রসৈকতের অপুর্ব দৃশ্য নীলাচল থেকে পর্যটকেরা উপভোগ করতে পারেন। নীলাচলে বাড়তি আকর্ষণ হল এখানকার নীল রং এর রিসোর্ট। নাম নীলাচল স্কেপ রিসোর্ট।

প্রেম হতবাক হয়ে যায় মিরার বর্ণনা শুনে। শুকনো ঢোক গিলে বলে,

—” তুই এতকিছু জানলি কী করে? বাহ! বাহ! নীলাচলের উপর পুরো রচনা তৈরি করে দিলি।”

মিরা মৃদু কন্ঠে বলে,

—” আমি যখন ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি তখন আমাদের স্কুলে গানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় আর আমি ঐ প্রতিযোগিতায় প্রথম হই। তখন পাপার আছে আবদার করেছিলাম আমাকে আর মাম্মাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবার জন্য। দেন পাপা আমাদের বান্দরবানে নিয়ে এসে এখানকার সবকিছু ঘুরিয়ে দেখায়। তাই আমি জানি।”

প্রিয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,

—” সত্যি এই সবকিছু আছে নীলাচলে?”

মিরা প্রিয়ার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,

—” হ্যা রে বাবা এইসব কিছু আছে। এবার যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয়। আর প্রেম তুইও গিয়ে রেডি হয়ে নেয়।”

প্রেম হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে যায়।এদিকে মিরা আর প্রিয়াও রেডি হয় নীচে আসে
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here