#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১৭
.
অন্ধকারাচ্ছন্ন আখি পল্লবে একদল আলোর প্রতিবিম্ব উপলব্ধি হয়তেই সামান্য নড়েচড়ে উঠলো রূপা, পাশ কেটে উষ্ণতা অনুভব হতেই আবারও স্থির হয়ে ঘুমিয়ে গেল যেন। বন্ধ চোখের স্থির মুখখানায় নিশ্বাসের আনাগোনার আসে ওঠানামা করছে। সেই মুখপানেই পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাসফি।
রূপার সামনে কখনোই এভাবে তাকিয়ে থাকে না তাসফি, থাকলেও বুঝতে দিতে চায় না মেয়েটাকে। কেন জানি এভাবে লুকিয়ে দেখে ভীষণ মজা পায় সে, অদ্ভুত এক স্বস্তি পায়। ভেবেই মুচকি হাসলো তাসফি। হঠাৎই মাথায় নাড়া দিলো একটা গান। গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,
‘তোকে একার দেখার লুকিয়ে কি মজা,
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না।
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা নয় তো সোজা,
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না।’
ধীর গলায় গাইতে চাইলেও কিছুটা জোরেই গেয়ে ফেললো তাসফি। আবারও নড়েচড়ে উঠলো রূপা। চোখে আলো’টা বেশ ভালোভাবেই ধরা দিলো এবার, মুহুর্তেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতে চাইলো। আরেকটু নড়েচড়ে চোখ মেলে তাকালো রূপা, ভেসে উঠলো অতি নিকটে তাসফির চেহারা’টা। তার দিকেই তাকিয়ে আছে তাসফি, এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলো রূপা। ঘুমের রেশ কিছুটা কেটে গেল। ঘুমঘুম কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ঘুমান নি?”
চোখ সরালো তাসফি, এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারও রূপার দিকে তাকিয়ে ছোট করে জবার দিলো, “হু! এই তো ঘুমাবো।”
ঘুমটা ছুটে গেল রূপা। ঘরে আলো জ্বলতে দেখে তাসফি কে বলে উঠলো, “এখনো কাজ শেষ হয় নি আপনার?”
“নিজের কাজ’টাই তো করছিলাম।”
“কইই? আপনি তো এখানে বসে আছেন।”
রূপার কথায় মুচকি হাসলো তাসফি। মনে মনে বলে উঠলো —এখানেই তো আমার কাজ। এই যে তোমায় দেখছিলাম, এই মুহুর্তে এটাই তো আমার মুখ্য কাজ। তবে মুখে বলে উঠলো,
“সেটা তো তোমার এই ছোট্ট মাথায় ঢুকবে না।”
কপাল কুঁচকে ফেললো রূপা। ছোট ছোট চোখ করে তাসফি’র দিকে তাকিয়ে, “কয়টা বাজে এখন? এতক্ষণেও আপনার কাজ শেষ হলো না?”
বলেই হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে নিজের মোবাইল’টা নিলো রূপা। সময় দেখলো, প্রায় একটা বাজতে চললো। এত রাতেও তাসফি’র কাজ শেষ হলো না, সেটা ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ ভার করে তাকালো তাসফির দিকে। বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে এতক্ষণে, টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপে কিছু করছে। মুখটা গম্ভীর করেই তাসফি কে বলে উঠলো,
“ওই ল্যাপটপ’কেই বিয়ে করে ফেলেন। আমার আর কি, আমাকে তো প্রয়োজন নেই আপনার।”
“একটা’কেই সামলাতে হিমসিম খাচ্ছি, এটাকে আর সামলাবো কখন?”
তাসফির কথায় কটমট চোখে তাকালো রূপা, সামান্য উঠে বসলো বিছানায়। বলে উঠলো,
“ওটাকে নিয়েই তো পড়ে আছেন দিনরাত, আমাকে আর সময় দিচ্ছেন কখন? সারাদিন পর রাতে একটু পাই আপনাকে, আর সেটাও…..”
এতক্ষণে ল্যাপটপ বন্ধ করে, বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তাসফি। রূপার কথার ফিরতি প্রশ্ন করে উঠলো,
“সেটাও তোমাকে দিচ্ছি না, তাই তো?”
“দিচ্ছেন না-ই তো। এই যে এতটা দূরে দূরে থাকছেন। সারাদিন বাসায় থাকেন না, আর রাতেও এভাবে…. ”
সহসায় কিছু বললো না তাসফি। কিছুটা সময় নিয়ে বলে মুচকি হেঁসে, “লাইট অফ করে দিবো?”
বলতেই ব্যাপক বিরক্ত হলো রূপা। বেশ জোরেই ‘জানি না’ বলে শুয়ে পড়লো। তাসফি আবারও হেঁসে উঠলো। লাইট’টা অফ করে নিজেও শুয়ে পড়লো, পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রূপা’কে। ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও তাসফি’র শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে কোন লাভ হলো না। রূপাকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে। জানালা ও বারান্দা দিয়ে আসা আলোয় বেশ স্পষ্ট’ই দেখতে পেল রূপার চেহারা। বলে উঠলো,
“ইস্! এভাবে রেখে গেছো কেন রুপু?”
“তো? রাগবো না বলছেন? কিন্তু কেন? সারাটাদিন বাসায় নেই, সন্ধ্যার পর আসলেন তারপর’ই ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন, আর আমায় বলছেন ‘রাগছো কেন’?”
“আচ্ছা বাবা সরি! আর এমনটা হবে না।”
“যখন থাকবো না তখন আর এই ‘সরি!’ টাও বলতে পারবেন না। হু!”
বলেই তাসফির বুকে মুখ লুকানো রূপা, এক হাতে টি-শার্ট’টা খামচে ধরলো। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আপনাতে যে আমি একটু বেশিই আসক্ত হয়ে পড়েছি, এভাবেই কি আমাকে কি একটু বেশিইই সময় দেওয়া যায় না?”
জবাব দিলো না তাসফি। শুধু আগের তুলনায় অধিক জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে।
.
“এতটা ভালোবেসে ফেললে কিভাবে?”
বেশ কিছু মুহুর্ত সেভাবেই কে’টে গেল তাদের মাঝে। নীরবতা ভেঙে তাসফি’ই জিজ্ঞেস করলো রূপাকে। তাসফি’র কথায় মোটেও ভরকালো না রূপা, আর না কিছু ভাবলো। চট করেই জবাব দিলো,
“ভালোবাসা! সেটা না-কি হঠাৎ করেই হয়। অনেকের থেকে শোনার পরও মানতাম না, কিন্তু এখন বিশ্বাস করি।”
“মানতে না বলছো? তাইলে হঠাৎ বিশ্বাস করার কারণ?”
“এই যে, প্রতিনিয়ত আপনাকে অনুভব করি। আপনার দূরত্বে বিষন্নতা, কাছে আসলে স্বস্তি পাই। এগুলো কে কি বলবো?”
“ভালোবাসা?”
বলেই মুচকি হাসলো তাসফি, রূপাও হেঁসে ফেললো। তবে কোন রকম জবাব দিলো না। একটু সময় নিয়ে তাসফি,
“সত্যিই এতটা ভালোবেসে ফেলেছো আমাকে?”
বলতেই আবারও চট করে জবাব দিলো রূপা। বলে উঠলো,
“জানি না।”
“জানো না, না কি বলতে চাইছো না?”
“দু’টোই।”
বলতেই খানিকটা শব্দ করেই হেঁসে ফেললো তাসফি। তাদের কথার মাঝে মাঝেই ঘুরেফিরে এই একই বাক্যগুলো চলে আসে। সে জানতো, রূপা’র উত্তর’টা ঠিক এটাই হবে। তবুও সে বলেছে। তবে প্রতিবারের মতো তাসফি তাকে হুট করে কিছু একটা বলে ভরকে দিলো না। প্রতিত্তোরেও কিছু বললো না।
খানিকটা সময় নিয়ে রূপা বলে উঠলো,
“আমি যে আপনাকে হঠাৎ ভালোবেসে ফেলবো, তা কখনোই কল্পনা করতে পারি নি।”
“কিন্তুউউ এখন তো কল্পনা করো রুপু।”
“আর আপনি?”
“আমি কিইই?”
“আপনি আমাকে কিভাবে ভালোবেসে ফেললেন?”
জবাব দিতে পারলো না তাসফি। কি-ই বা বলবে সে, ভালোবাসে? কিন্তু এটা তো সত্যি নয়। রূপা’কে তো সে ভালোবাসে না, ভালোবাসা নামক শব্দ’টা নিয়ে এই মেয়ে’টাকে কখনো অনুভবও করে নি। কিন্তু দিনশেষে তাকেই চায় তাসফি, ঘামেমাখা ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে এই মেয়েটার চেহারা’ই সবার আগে দেখতে চায়। এরা যদি ভালোবাসা না হয়, তাহলে নাম কি এর?
তাসফির করা ভাবনার মাঝেই আবারও জিজ্ঞেস করলো রূপা। কিছুটা সময় নিয়ে তাসফি বলে উঠলো,
“ভালোবাসা শব্দটা তোমার জন্য অনেক কম হয়ে যায়?”
“তাহলে?”
সহসায় জবাব দিলো না তাসফি। সময় না নিয়ে রূপা আবারও বলে উঠলো,
“এক শব্দে আমাকে বর্ণনা করতে পারবেন?”
“আমার!”
এবার আর সময় নিলো না তাসফি, আর না কিছু ভাবলো। চট করেই বলে ফেললো কথাটা। তাসফির কথায় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো রূপা। তার টি-শার্ট ‘টা অধিকতর ভাবে খামচে ধরলো। বলে উঠলো,
“ভালোবাসি মি. তাসফি।”
.
.
সময়ের ব্যাবধানে সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে, পাল্টে গেছে অনেক কিছু। সাথে মজবুত হয়েছে তাসফি রূপার সম্পর্কটা। রাগ, অভিমান, ভালোবাসা সবটাই যেন বহুগুণে বেড়েছে। রাগ, অভিমান দু’জনের মাঝে থাকলেও ভালোবাসা’টা শুধুই রূপার মাঝে ছিলো। তাসফি আজও বুঝতে পারে নি রূপার প্রতি তার ভালোবাসা’টা, কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও এড়িয়ে যায় নি মেয়েটাকে। বরং রূপার চেয়ে অধিকতর বুঝিয়ে তাসফির আদর, যত্ন, কেয়ার ও দ্বায়িত্ব দিয়ে। তাসফির মুখে ভালোবাসার কথা শুনতে চেয়েও বারংবার বার্থ রূপা। যতবারই শুনতে চেয়েছে ঠিক ততবারই তাসফি এড়িয়ে গেছে তাকে, অন্য কথা বলে কথা কাটিয়েছে। সেটা নিয়েও অনেক রাগ করেছে রূপা, অভিমান করে তাসফির থেকে দূরে রেখেছে নিজেকে। তবে দিন শেষে ঠিকই রূপাকে মানিয়ে নিয়েছে তাসফি, আদরে ভুলিয়ে দিয়েছে তার অভিমান গুলো।
বিগত তিন মাস অতিক্রম করা সময় গুলো নিয়েই ভাবছিলো রূপা, আর রুমের এটা ওটা গোছাচ্ছিলো। কেমন কেমন ভাবে জানি সময়গুলো চলে গেল তাদের জীবন থেকে। তবে এতে আফসোস নাই তার, বরং অদ্ভুত স্বস্তি’ই পায়। এমনি তো একটা ছোট্ট সংসার চেয়েছিলো, আর খব কম সময়ে পেয়েও গেছে যেন।
আর কলেজে যায় নি রূপা, নিচেও বেশিক্ষণ থাকে নি। এই তিনটে মাস সুস্থ থাকলেও গত কয়েকদিনে বেশ শরীর খারাপ লাগছে তার। বলে নি কাউকে, বুঝতে দিতেও চায় নি। তাসফি বার কয়েক ‘শরীর ঠিক আছে তো?’ জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে গেছে। ভেবেছে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে আজকে যেন একটু বেশি’ই খারাপ লাগছে মেয়েটার। রেহেনা কে তেমন কিছু না বলেই উপরে এসেছে, রুমে টুকটাক কাজের সাথে বিশ্রামও নিচ্ছে।
মনে মনে ‘ঠিক আছি, কিছু হয় নি’ বললেও এবার আর ঠিক রইলো না রূপা। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসতেই কেমন জানি ঘুরতে লাগলো চারপাশ’টা। ধপ করে বিছানায় বলে মাথা চেপে ধরলো রূপা, মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে ধাতস্থ করলো নিজেকে। চোখ মেলে তাকাতেই আবারও ঝাপসা লাগলো চোখের সামনে। এবার বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মাথা চেপে শুয়ে পড়লো রূপা, ভাবতে লাগলো হঠাৎ এমনটা হওয়ার কারণ। মনে মনে বলে উঠলো,
“উফ্! এই মানুষটা এতটাই বদঅভ্যাস হয়েছে আমার, সে খেয়াল না রাখলে নিজের যত্ন’টাও নেওয়া হয় না।”
তাসফির কথা ভাবতেই চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় হাসি ফুটে উঠলো রূপার ঠোঁটে। তবে সেই হাসিটা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী করতে পারলো না, মুহুর্তেই যেন ভেতর থেকে গা গুলিয়ে আসলো। আর শুয়েও থাকতে পারলো না। হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো রূপা।
.
.
চলবে…..