নীলচে তারার আলো পর্ব -৩৩+৩৪

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩৩

কাজের মেয়েটা হিয়াকে ঘর দেখিয়ে দিলো। হিয়া ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। এই জায়গাটা এতক্ষণ পর্যন্ত খুব ভালো লাগলেও এখন অসহ্য লাগছে তার। হিয়া মুখ কালো করে বিছানায় বসলো। রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা হাতে নিয়ে দিবাকে কল করলো। এতোক্ষণে দিবার বাসায় ফিরে আসার কথা। দিবাকে ফোন দিতেই দিবা ফোন ধরলো। হিয়া আজ কেনো কলেজে যায় নি সেটা প্রথমে বললো। দিবা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,” বাহ্, তাহলে কিছুদিন একসাথে থেকে প্রেম করে ফিরবি।”

” প্রেম? ঐ লোকটার সাথে? তোকে তো এখনো বলিনি
কি হয়েছে? একটা মেয়ে ছোট ছোট জামা পরে থাকে আর সুযোগ পেলেই ওনাকে জড়িয়ে ধরে। আমার ভাল্লাগছে না। আমি থাকবো না এইখানে।”,

” হ্যা, চলে আয়। নিজের বরকে শাকচুন্নির কাছে ফেলে চলে আয়। তারপর দখল করে নিবে তোমার বরকে। তখন বুঝবি কেমন লাগে?”

” ভয় দেখাচ্ছিস কেনো, তুই? আমি এখণ কি করবো?”,

” তোর জায়গায় থাকলে তো আমি বরকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বরের সাথে রোমান্স করতাম। কিন্তু তোকে দিয়ে তো সেসব হবে না। তাই তুই এক বাটি পপকর্ন হাতে নিয়ে এইসব দেখ আর হজম কর।”

” কি করতে হবে আমাকে বল। এইসব আমি হজম করতে পারবো না।”, অনেক সাহস করে প্রশ্নটা করলেও উত্তরে দিবা যা যা বললো সেটা তাকে দিয়ে আসলেই সম্বব না। এতটা নিলজ্জ্ব সে হতে পারবে না। দিবার কথায় অপদত হা মিলিয়ে ফোনটা রেখে দিল হিয়া।

হিয়া চুপচাপ মোহনার পাশে বসে আছে। মোহনা কিছুক্ষণ হলো এসে পৌঁছেছে। সাড়া বাড়ি লোকজনে হৈ হৈ করছে কিন্তু হিয়া অনেকটা মন মরা হয়ে আছে। অনেক্ষন হলো শুভ্রকে আসে পাশে কোথাও সে দেখেনি। ওই মেয়েটাও তো নেই তাহলে কি দুজনে একসাথে আছে? এতোক্ষণে কয়বার জড়িয়ে ধরেছে শুভ্রকে? ভাবতেই রাগে গজগজ করতে লাগলো হিয়া। শুভ্রের তো তার দিকে কোনো খেয়ালই নেই। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। এতো রাত অথচ লোকটার কোনো খবর নেই।

হিয়া মোহনার কাছে নিজের ঘরটা জেনে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। বাইরে সবাই গানের আসর বসিয়েছে, অন্য সময় হলে হিয়া আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতো কিন্তু আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। হিয়া শাড়ির সেফটি পিন গুলো খুলে একপাশে রাখলো। এইখানে থাকতে হবে জানলে জামাকাপড় নিয়ে আসতো। এই শাড়ী পড়ে সে ঘুমাবে কি করে? হিয়া সবে শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলে শাড়ির প্রান্তভাগ কোমড়ে গুঁজে, কোমড়ের দুপাশে হাত দিয়ে দাড়ালো।

অনেক আগের দরজার হওয়ার কারণে একটু ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেলো। শুভ্রকে রুমে ঢুকতে দেখে হিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো।

শুভ্র রূমে ঢুকে এক মুহুর্তের জন্যে থমকে হিয়ার দিকে তাকালো। শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলার কারণে হিয়ার কোমড়ের অনেকটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। হিয়া গম্ভীর গলায় বললো,” আপনি আমার ঘরে কি করছেন?”

হিয়ার এমন প্রশ্নে শুভ্র ভ্রু কুচকে তাকালো তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” তোমার ঘর, আমার ঘর বলতে কিছু নেই। এখন থেকে তোমাকে আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে হবে।”,

” আমি আপনার সাথে থাকবো না।”, কঠিন গলায় বললো হিয়া। শুভ্রের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হলো। সে খাপ ছাড়া গলায় বললো,” ইউ হ্যাভ নো চয়েজ। তোমার কাছে একটাই অপশন আছে আর সেটা হচ্ছে, আমি। এই কথাটা তুমি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে তোমার জন্যেই ভালো।”, শেষের দিকটায় সিরিয়াস হয়ে বললো শুভ্র।

” আপনি আমাকে জোর করবেন?”,একটা ঢোক গিলে বললো হিয়া।

” নাহ্, জোড় করার হলে অনেক আগেই করতে পারতাম। আমি শুধু আমার করা ভুলটা শুধরে নিতে চাইছি।”, বলেই একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেললো।

হিয়ার আরো রাগ হলো। একে তো সারাদিন লোকটার কোনো হদিস ছিলো না। এখন এসেছে, এসেই কড়া কড়া কথা বলছে তাকে। এতোই যখন তাকে নিজের কাছে রাখতে চায় তাহলে তার প্রতি কোনো খেয়াল নেই কেনো লোকটার?

হিয়া গাল ফুলিয়ে বললো,” আমি আপনার সাথে থাকবো না।” বলে বেড়িয়ে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে শীতল দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া রেগে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে, শুভ্র হিয়ার কোমড় জড়িয়ে নিজের সামনে এনে দাড় করাতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র এখনো শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে অকারনেই শিউরে উঠলো সে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার কোমড়ে গুঁজে রাখা আঁচলটা এক টানে খুলে ফেলতেই হিয়া চোখ বুজে শুভ্রের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। শুভ্র খুব স্বাভািকভাবেই বললো,” এবার যাও।”

শুভ্রের কথা কর্নগোচর হতেই হিয়া ফট করে চোখ খুলে তাকালো। তারপর কোমড়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্রের শার্ট ছেড়ে ছিটকে সরে এসে কাধের আঁচলটা নামিয়ে দিলো। এতক্ষণ সে এইভাবে দাড়িয়ে ছিলো ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিবে এমন সময় রিমি ঘরে ঢুকে বললো,” তোমরা উপরে কি করছো? নিচে আসো, নিচে অনেক মজা হচ্ছে।”

হিয়ার এখন রিমিকে দেখলেই রাগ হচ্ছে। একটু যেই দূরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ডাকতে চলে এসেছে। হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া স্বাভাবিক ভাবে বললো,” আমি যাবো না। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

” তুই তো আসবি নাকি তোর ও ঘুম পাচ্ছে।”, বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুই নিচে যা। আমি আসছি।”
শুভ্র যাবে শুনে হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আচ্ছা এতক্ষণ ঘুরে এসেছে তাও শখ মিটেনি। রিমি চলে যেতেই হিয়া শুভ্রের দিকে তাকালো। আজ শুভ্রকে সে কোনোভাবেই নিচে যেতে দিবে না মনে মনে ঠিক করে ফেললো।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে হিয়াকে বিছানায় পা তুলে বসে থাকতে দেখে আড় চোখে তাকালো। এতোক্ষণ রূমে থাকবেনা বলে লাফাচ্ছিলো। এখন আবার বিছানায় ভদ্র বাচ্চা হয়ে বসে আছে। হিয়া কি চায় নিজে জানে কি?

শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হয়ে যাবে এমন সময় হিয়া হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে শুভ্রের সামনে এসে দাড়াতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো। হিয়া শুভ্রের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তো ঠিকই কিন্তু কি বলে আটকাবে এখনো ভেবে পায় নি। শুভ্র একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি সমস্যা?”

হিয়া একটু কেশে বললো,” কোনো সমস্যা নেই।”

” তাহলে এইভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”, বলেতেই হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। তারপর বললো,” কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

” যেখানেই যাই তাতে তোমার কি? তুমি এই ঘরে কি করছো? তোমার রুম খুঁজে পাওনি?”, শুভ্রের প্রশ্নে হিয়া অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর চুপ করে রইলো। শুভ্র হিয়াকে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যেতেই হিয়া এইবার দুই হাত মেলে শুভ্রেরর সামনে এসে দাড়ালো। শুভ্র হিয়ার এমন পথ আটকে দাড়ানোর কারণ খুঁজে পেলো না।

বিরক্তি নিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” আমার খুব খারাপ লাগছে। মাথাটা কেমন করছে।”,বলেই মাথা ঘুরানোর ভান ধরে পিছনে পরে যেতে নিলো। শুভ্র হকচকিয়ে উঠে এগিয়ে এসে হিয়াকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরলো। এতক্ষণ তো ঠিক হটাৎ অজ্ঞান হলো কিভাবে? আসলে কি অজ্ঞান হয়েছে?

শুভ্র চিন্তিত হয়ে হিয়ার মুখের দিকে তাকালো। হিয়া চোখ বন্ধ করে অজ্ঞানের ভান করেi আছে। শুভ্র হিয়ার মুখটা তুলে বললো,” কি হয়েছে তোমার?” হিয়া কোনো সাড়াশব্দ করলো না। শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর ব্যাস্ত হয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো কয়েকবার। হিয়াকে ডাকতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর হিয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাতেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে হিয়ার কাছে এলো। তারপর গাল স্পর্শ করে বললো,” কি হয়েছে তোমার?”

হিয়া মাথাটা ধরে বললো,” জানি না। মাথাটা কেমন জানি করছে।”

শুভ্র অস্থির হয়ে বললো,” আচ্ছা, আমি আসছি।” বলেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে বেরিয়ে যেতেই হিয়া মুখ কালো করে উঠে বসলো। আরে যাকে আটকে রাখতে এতো কষ্ট সে কিনা বেড়িয়ে গেলো। হিয়া বসে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা ওই শাকচুন্নির সামনে পড়লে যদি আটকে দেয়, যদি আসতে না দিলো শুভ্রকে। ভেবেই গাল গাল ফুলিয়ে বসে আছে সে।

শুভ্র পানি আর ওষুধ হাতে ঘরে ঢুকতেই হিয়া হুড়মুড়িয়ে আবার শুয়ে পড়লো। শুভ্র হিয়ার দিকে ওষুধ বাড়িয়ে দিতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। কিছু হয় নি, সে শুধু শুধু ওষুধ খাবে কেনো? হিয়া শুভ্রের দিকে তাকাতেই শুভ্র ওষুধটা হাতে ধরিয়ে হিয়াকে উঠে বসালো তারপর অন্যহাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিল।

কি যন্ত্রণা! এমন ডাক্তার জামাই থাকা যে এত বিপদের সেটা কে জানতো। এবার এই ওষুধ খেতে হবে তাকে। হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি ঠিক আছি তো। ওষুধ খেতে হবে না।”

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই হিয়া বললো,” আচ্ছা খাচ্ছি।” ওষুধ খাওয়ার সময় হিয়া আঙ্গুলের ফাকে ওষুধটা শাড়ির আঁচলে ফেলে দিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসটা শুভ্রকে দিলো। শুভ্র গ্লাস হাতে উঠে যেতেই হিয়া ওষুধটা নিচে ফেলে দিলো। শুভ্র ফিরে আসতেই টেবিলের এক পাশে ওষুধটা চোখে পড়লো তার। তারপর অনেকটা আন্দাজ করে ফেললো সে। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে বসলো তারপর বললো,” এবার কেমন লাগছে তোমার?”

হিয়া ধরা গলায় বললো,” অনেকটা ভালো।”
শুভ্র হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” তাহলে আমি নিচে গেলাম। তুমি চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।” বলে উঠে যাবে এমন সময় হিয়া শুভ্রের হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,” না আপনি যাবেন না।” শুভ্রের কাছে এখন সবটাই পরিষ্কার। কিন্তু হিয়ার এমন অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করার পিছনের কারণটা কি?

শুভ্র আস্তে আস্তে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে অন্যপাশে হাত রেখে বললো,” নিজেকে তুমি খুব চালাক মনে করো তাই না? এইসব কিসের জন্যে করছো? এই অজ্ঞান হওয়ার অভিনয়টা কি আমাকে আটকানোর জন্যে? এতক্ষণ তো আমার সাথে থাকবে না, এক ঘরে থাকবে না। এখন আবার আমাকে আটকানোর জন্যে এতকিছু করছো।”, বলতে বলতে শুভ্র হিয়ার একদম কাছে চলে এলো। শুভ্র এতো তাড়াতাড়ি সবটা ধরে ফেলবে হিয়া ভাবে নি। হিয়া নিজেকে বাঁচাতে কিছু বলতে যাবে এমন সময় শুভ্র হিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললো,” আর কোনো অজুহাত দিতে হবে না। তুমি ঠিক কি চাইছো বলতো?”

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। বুকের ভেতটায় অস্থিরতা বাড়ছে। হাত পা হিম শীতল হয়ে গেছে। হিয়া চুপ করে রইলো। আসলেই তো সে কি চায়? নিজেকে তো কখন এমন প্রস্ন করেনি সে কোনোদিন। উত্তর টা তো তার জানা নেই।

হিয়ার নিরবতায় শুভ্র হাত সরিয়ে এনে বললো,” প্রশ্নের উত্তরটা যেদিন দিতে পারবে সেদিন আমাকে আটকে রেখো।” বলেই হিয়ার ধরে রাখা হাতের বাঁধন খুলে ফেলতে নিলো। কিন্তু হিয়া আরো শক্ত করে শুভ্রের হাত ধরে ফেললো। শুভ্রের বলা এই কথাগুলো কেনো জানি তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কিন্তু তার হাতের বাঁধন শক্ত শুভ্রকে সে যেতে দিবে না। শুভ্র আবারো প্রশ্ন করলো,” কেনো আটকে রাখতে চাও আমাকে, হুম?”

হিয়া নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বললো,” জানি না।”, বলেই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থেকে আবার বললো,” ওই মেয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ভালো লাগে না।”, শুভ্র খেয়াল করলো হিয়ার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা মুক্ত তার গাল বেয়ে গড়িয়ে শাড়ী ভিজিয়ে দিচ্ছে।

[ #চলবে ]

কাজের মেয়েটা হিয়াকে ঘর দেখিয়ে দিলো। হিয়া ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। এই জায়গাটা এতক্ষণ পর্যন্ত খুব ভালো লাগলেও এখন অসহ্য লাগছে তার। হিয়া মুখ কালো করে বিছানায় বসলো। রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা হাতে নিয়ে দিবাকে কল করলো। এতোক্ষণে দিবার বাসায় ফিরে আসার কথা। দিবাকে ফোন দিতেই দিবা ফোন ধরলো। হিয়া আজ কেনো কলেজে যায় নি সেটা প্রথমে বললো। দিবা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,” বাহ্, তাহলে কিছুদিন একসাথে থেকে প্রেম করে ফিরবি।”

” প্রেম? ঐ লোকটার সাথে? তোকে তো এখনো বলিনি
কি হয়েছে? একটা মেয়ে ছোট ছোট জামা পরে থাকে আর সুযোগ পেলেই ওনাকে জড়িয়ে ধরে। আমার ভাল্লাগছে না। আমি থাকবো না এইখানে।”,

” হ্যা, চলে আয়। নিজের বরকে শাকচুন্নির কাছে ফেলে চলে আয়। তারপর দখল করে নিবে তোমার বরকে। তখন বুঝবি কেমন লাগে?”

” ভয় দেখাচ্ছিস কেনো, তুই? আমি এখণ কি করবো?”,

” তোর জায়গায় থাকলে তো আমি বরকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বরের সাথে রোমান্স করতাম। কিন্তু তোকে দিয়ে তো সেসব হবে না। তাই তুই এক বাটি পপকর্ন হাতে নিয়ে এইসব দেখ আর হজম কর।”

” কি করতে হবে আমাকে বল। এইসব আমি হজম করতে পারবো না।”, অনেক সাহস করে প্রশ্নটা করলেও উত্তরে দিবা যা যা বললো সেটা তাকে দিয়ে আসলেই সম্বব না। এতটা নিলজ্জ্ব সে হতে পারবে না। দিবার কথায় অপদত হা মিলিয়ে ফোনটা রেখে দিল হিয়া।

হিয়া চুপচাপ মোহনার পাশে বসে আছে। মোহনা কিছুক্ষণ হলো এসে পৌঁছেছে। সাড়া বাড়ি লোকজনে হৈ হৈ করছে কিন্তু হিয়া অনেকটা মন মরা হয়ে আছে। অনেক্ষন হলো শুভ্রকে আসে পাশে কোথাও সে দেখেনি। ওই মেয়েটাও তো নেই তাহলে কি দুজনে একসাথে আছে? এতোক্ষণে কয়বার জড়িয়ে ধরেছে শুভ্রকে? ভাবতেই রাগে গজগজ করতে লাগলো হিয়া। শুভ্রের তো তার দিকে কোনো খেয়ালই নেই। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। এতো রাত অথচ লোকটার কোনো খবর নেই।

হিয়া মোহনার কাছে নিজের ঘরটা জেনে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। বাইরে সবাই গানের আসর বসিয়েছে, অন্য সময় হলে হিয়া আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতো কিন্তু আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। হিয়া শাড়ির সেফটি পিন গুলো খুলে একপাশে রাখলো। এইখানে থাকতে হবে জানলে জামাকাপড় নিয়ে আসতো। এই শাড়ী পড়ে সে ঘুমাবে কি করে? হিয়া সবে শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলে শাড়ির প্রান্তভাগ কোমড়ে গুঁজে, কোমড়ের দুপাশে হাত দিয়ে দাড়ালো।

অনেক আগের দরজার হওয়ার কারণে একটু ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেলো। শুভ্রকে রুমে ঢুকতে দেখে হিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো।

শুভ্র রূমে ঢুকে এক মুহুর্তের জন্যে থমকে হিয়ার দিকে তাকালো। শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলার কারণে হিয়ার কোমড়ের অনেকটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। হিয়া গম্ভীর গলায় বললো,” আপনি আমার ঘরে কি করছেন?”

হিয়ার এমন প্রশ্নে শুভ্র ভ্রু কুচকে তাকালো তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” তোমার ঘর, আমার ঘর বলতে কিছু নেই। এখন থেকে তোমাকে আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে হবে।”,

” আমি আপনার সাথে থাকবো না।”, কঠিন গলায় বললো হিয়া। শুভ্রের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হলো। সে খাপ ছাড়া গলায় বললো,” ইউ হ্যাভ নো চয়েজ। তোমার কাছে একটাই অপশন আছে আর সেটা হচ্ছে, আমি। এই কথাটা তুমি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে তোমার জন্যেই ভালো।”, শেষের দিকটায় সিরিয়াস হয়ে বললো শুভ্র।

” আপনি আমাকে জোর করবেন?”,একটা ঢোক গিলে বললো হিয়া।

” নাহ্, জোড় করার হলে অনেক আগেই করতে পারতাম। আমি শুধু আমার করা ভুলটা শুধরে নিতে চাইছি।”, বলেই একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেললো।

হিয়ার আরো রাগ হলো। একে তো সারাদিন লোকটার কোনো হদিস ছিলো না। এখন এসেছে, এসেই কড়া কড়া কথা বলছে তাকে। এতোই যখন তাকে নিজের কাছে রাখতে চায় তাহলে তার প্রতি কোনো খেয়াল নেই কেনো লোকটার?

হিয়া গাল ফুলিয়ে বললো,” আমি আপনার সাথে থাকবো না।” বলে বেড়িয়ে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে শীতল দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া রেগে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে, শুভ্র হিয়ার কোমড় জড়িয়ে নিজের সামনে এনে দাড় করাতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র এখনো শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে অকারনেই শিউরে উঠলো সে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার কোমড়ে গুঁজে রাখা আঁচলটা এক টানে খুলে ফেলতেই হিয়া চোখ বুজে শুভ্রের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। শুভ্র খুব স্বাভািকভাবেই বললো,” এবার যাও।”

শুভ্রের কথা কর্নগোচর হতেই হিয়া ফট করে চোখ খুলে তাকালো। তারপর কোমড়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্রের শার্ট ছেড়ে ছিটকে সরে এসে কাধের আঁচলটা নামিয়ে দিলো। এতক্ষণ সে এইভাবে দাড়িয়ে ছিলো ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিবে এমন সময় রিমি ঘরে ঢুকে বললো,” তোমরা উপরে কি করছো? নিচে আসো, নিচে অনেক মজা হচ্ছে।”

হিয়ার এখন রিমিকে দেখলেই রাগ হচ্ছে। একটু যেই দূরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ডাকতে চলে এসেছে। হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া স্বাভাবিক ভাবে বললো,” আমি যাবো না। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

” তুই তো আসবি নাকি তোর ও ঘুম পাচ্ছে।”, বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুই নিচে যা। আমি আসছি।”
শুভ্র যাবে শুনে হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আচ্ছা এতক্ষণ ঘুরে এসেছে তাও শখ মিটেনি। রিমি চলে যেতেই হিয়া শুভ্রের দিকে তাকালো। আজ শুভ্রকে সে কোনোভাবেই নিচে যেতে দিবে না মনে মনে ঠিক করে ফেললো।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে হিয়াকে বিছানায় পা তুলে বসে থাকতে দেখে আড় চোখে তাকালো। এতোক্ষণ রূমে থাকবেনা বলে লাফাচ্ছিলো। এখন আবার বিছানায় ভদ্র বাচ্চা হয়ে বসে আছে। হিয়া কি চায় নিজে জানে কি?

শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হয়ে যাবে এমন সময় হিয়া হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে শুভ্রের সামনে এসে দাড়াতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো। হিয়া শুভ্রের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তো ঠিকই কিন্তু কি বলে আটকাবে এখনো ভেবে পায় নি। শুভ্র একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি সমস্যা?”

হিয়া একটু কেশে বললো,” কোনো সমস্যা নেই।”

” তাহলে এইভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”, বলেতেই হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। তারপর বললো,” কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

” যেখানেই যাই তাতে তোমার কি? তুমি এই ঘরে কি করছো? তোমার রুম খুঁজে পাওনি?”, শুভ্রের প্রশ্নে হিয়া অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর চুপ করে রইলো। শুভ্র হিয়াকে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যেতেই হিয়া এইবার দুই হাত মেলে শুভ্রেরর সামনে এসে দাড়ালো। শুভ্র হিয়ার এমন পথ আটকে দাড়ানোর কারণ খুঁজে পেলো না।

বিরক্তি নিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” আমার খুব খারাপ লাগছে। মাথাটা কেমন করছে।”,বলেই মাথা ঘুরানোর ভান ধরে পিছনে পরে যেতে নিলো। শুভ্র হকচকিয়ে উঠে এগিয়ে এসে হিয়াকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরলো। এতক্ষণ তো ঠিক হটাৎ অজ্ঞান হলো কিভাবে? আসলে কি অজ্ঞান হয়েছে?

শুভ্র চিন্তিত হয়ে হিয়ার মুখের দিকে তাকালো। হিয়া চোখ বন্ধ করে অজ্ঞানের ভান করেi আছে। শুভ্র হিয়ার মুখটা তুলে বললো,” কি হয়েছে তোমার?” হিয়া কোনো সাড়াশব্দ করলো না। শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর ব্যাস্ত হয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো কয়েকবার। হিয়াকে ডাকতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর হিয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাতেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে হিয়ার কাছে এলো। তারপর গাল স্পর্শ করে বললো,” কি হয়েছে তোমার?”

হিয়া মাথাটা ধরে বললো,” জানি না। মাথাটা কেমন জানি করছে।”

শুভ্র অস্থির হয়ে বললো,” আচ্ছা, আমি আসছি।” বলেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে বেরিয়ে যেতেই হিয়া মুখ কালো করে উঠে বসলো। আরে যাকে আটকে রাখতে এতো কষ্ট সে কিনা বেড়িয়ে গেলো। হিয়া বসে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা ওই শাকচুন্নির সামনে পড়লে যদি আটকে দেয়, যদি আসতে না দিলো শুভ্রকে। ভেবেই গাল গাল ফুলিয়ে বসে আছে সে।

শুভ্র পানি আর ওষুধ হাতে ঘরে ঢুকতেই হিয়া হুড়মুড়িয়ে আবার শুয়ে পড়লো। শুভ্র হিয়ার দিকে ওষুধ বাড়িয়ে দিতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। কিছু হয় নি, সে শুধু শুধু ওষুধ খাবে কেনো? হিয়া শুভ্রের দিকে তাকাতেই শুভ্র ওষুধটা হাতে ধরিয়ে হিয়াকে উঠে বসালো তারপর অন্যহাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিল।

কি যন্ত্রণা! এমন ডাক্তার জামাই থাকা যে এত বিপদের সেটা কে জানতো। এবার এই ওষুধ খেতে হবে তাকে। হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি ঠিক আছি তো। ওষুধ খেতে হবে না।”

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই হিয়া বললো,” আচ্ছা খাচ্ছি।” ওষুধ খাওয়ার সময় হিয়া আঙ্গুলের ফাকে ওষুধটা শাড়ির আঁচলে ফেলে দিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসটা শুভ্রকে দিলো। শুভ্র গ্লাস হাতে উঠে যেতেই হিয়া ওষুধটা নিচে ফেলে দিলো। শুভ্র ফিরে আসতেই টেবিলের এক পাশে ওষুধটা চোখে পড়লো তার। তারপর অনেকটা আন্দাজ করে ফেললো সে। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে বসলো তারপর বললো,” এবার কেমন লাগছে তোমার?”

হিয়া ধরা গলায় বললো,” অনেকটা ভালো।”
শুভ্র হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” তাহলে আমি নিচে গেলাম। তুমি চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।” বলে উঠে যাবে এমন সময় হিয়া শুভ্রের হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,” না আপনি যাবেন না।” শুভ্রের কাছে এখন সবটাই পরিষ্কার। কিন্তু হিয়ার এমন অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করার পিছনের কারণটা কি?

শুভ্র আস্তে আস্তে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে অন্যপাশে হাত রেখে বললো,” নিজেকে তুমি খুব চালাক মনে করো তাই না? এইসব কিসের জন্যে করছো? এই অজ্ঞান হওয়ার অভিনয়টা কি আমাকে আটকানোর জন্যে? এতক্ষণ তো আমার সাথে থাকবে না, এক ঘরে থাকবে না। এখন আবার আমাকে আটকানোর জন্যে এতকিছু করছো।”, বলতে বলতে শুভ্র হিয়ার একদম কাছে চলে এলো। শুভ্র এতো তাড়াতাড়ি সবটা ধরে ফেলবে হিয়া ভাবে নি। হিয়া নিজেকে বাঁচাতে কিছু বলতে যাবে এমন সময় শুভ্র হিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললো,” আর কোনো অজুহাত দিতে হবে না। তুমি ঠিক কি চাইছো বলতো?”

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। বুকের ভেতটায় অস্থিরতা বাড়ছে। হাত পা হিম শীতল হয়ে গেছে। হিয়া চুপ করে রইলো। আসলেই তো সে কি চায়? নিজেকে তো কখন এমন প্রস্ন করেনি সে কোনোদিন। উত্তর টা তো তার জানা নেই।

হিয়ার নিরবতায় শুভ্র হাত সরিয়ে এনে বললো,” প্রশ্নের উত্তরটা যেদিন দিতে পারবে সেদিন আমাকে আটকে রেখো।” বলেই হিয়ার ধরে রাখা হাতের বাঁধন খুলে ফেলতে নিলো। কিন্তু হিয়া আরো শক্ত করে শুভ্রের হাত ধরে ফেললো। শুভ্রের বলা এই কথাগুলো কেনো জানি তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কিন্তু তার হাতের বাঁধন শক্ত শুভ্রকে সে যেতে দিবে না। শুভ্র আবারো প্রশ্ন করলো,” কেনো আটকে রাখতে চাও আমাকে, হুম?”

হিয়া নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বললো,” জানি না।”, বলেই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থেকে আবার বললো,” ওই মেয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ভালো লাগে না।”, শুভ্র খেয়াল করলো হিয়ার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা মুক্ত তার গাল বেয়ে গড়িয়ে শাড়ী ভিজিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রের সামনে নিজের অনুভূতির এমন অভিব্যক্তিতে লজ্জা আর রাগে চোখ ভিজে এসেছে মেয়েটির।
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩৪

হিয়া নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বললো,” জানি না।”, বলেই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থেকে আবার বললো,” ওই মেয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ভালো লাগে না।”, শুভ্র খেয়াল করলো হিয়ার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা মুক্ত তার গাল বেয়ে গড়িয়ে শাড়ী ভিজিয়ে দিচ্ছে। নিজের অনুভূতির এমন বহিঃপ্রকাশে রাগ, ক্ষোভ আর লজ্জায় চোখ ভিজে এসেছে তার। হিয়া পরক্ষনেই চোখের জল মুছে ফেললো। নিজের দুর্বলতা সে কেনো দেখাবে?

শুভ্র হিয়ার কাছে এসে হিয়ার গাল স্পর্শ করার আগেই হিয়া শুভ্রের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,” একদম আমাকে ধরবেন না। আপনি যান, নিচে গিয়ে আপনার ঐ বন্ধুবিকে জড়িয়ে ধরুন। সেও আপনাকে জড়িয়ে ধরুক।”, বলেই রাগী চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো।

শুভ্রের প্রতি হিয়ার এই অভিমানটা তার ভালো লাগছে। কিছু কিছু অভিমান ভাঙাতে ভালোই লাগে। হিয়াকে আপাদত কিছুক্ষণ জ্বালাতে ইচ্ছে করছে তার। শুভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে আরেকটু এগিয়ে এসে হিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো। হিয়ার রাগ আরো বেড়ে গেলো, সকালের রাগ তো জমে ছিলোই এখন আবার লোকটা মজা নিচ্ছে।

” আপনার খুব মজা লাগছে তাই না?”, রাগে ফুলতে ফুলতে বললো হিয়া। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,” নাহ্, একদমই না।” বলেই ঠোঁট চেপে ধরলো কারণ শুভ্রের হাসি পাচ্ছে। শুভ্র রিমিকে নিজের ছোট বোনের মত দেখে। ছোটবেলায় রিমির জন্মের সময় রিমির মা মারা যায় তখন থেকে রিমির বুঝ হওয়ার আগ পর্যন্ত সাহারা খাতুনই রিমিকে বড় করেন। কিন্তু শুভ্রের সাথে রিমির এই সম্পর্টাকে হিয়া ভুল বুঝে বসে আছে। ব্যাপারটা যে খুব খারাপ হয়েছে তা না, রাগটা ভালোই লাগছে তার। তার প্রতি মেয়েটা প্রটেক্টিভ হয়ে উঠেছে।

শুভ্রের এমন খাপছাড়া ভাব দেখে হিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনার খুব হাসি পাচ্ছে, তাই না? ঠিক আছে হাসুন। নিচে গিয়ে হাসুন। ওই মেয়ের সামনে গিয়ে হাসুন।”

শুভ্র বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে বললো,” উহু, নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন।”

লোকটার তাকে নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কি সুন্দর নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়েছে। আর সে এইদিকে কেদে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে এই লোকটার জন্যে। নিলজ্জের মতন বলেও দিয়েছে নিজের কথা। আর ইনি হাসছেন। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেয়।

হিয়া রেগে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,” ঠিক আছে আপনি থাকুন। আমিই যাচ্ছি, আপনার সাথে আমি থাকবো না।” বলে চলে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার হাত ধরে টান দিতেই হিয়া শুভ্রের বুকের উপর এসে পড়লো। হটাৎ শুভ্রের এমন কাজে হিয়া চমকে তাকালো কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

শুভ্র এক হাত হিয়ার কোমড়ের পাশে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,” আমি একা একা কি করবো? আমার তো তোমাকে লাগবে।”

” আমাকে লাগবে মানে?এতক্ষণ একা একা বাইরে ছিলেন না। তখন তো আমাকে প্রয়োজন হয় নি। এখন আমাকে লাগবে কেনো?”, শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। মেয়েটার ভালোই রাগ হয়েছে। হিয়া সরে যাওয়ার জন্যে হাত ছোড়াছুড়ি করতেই শুভ্র হিয়াকে বিছানার সাথে মিশিয়ে দুই হাত চেপে ধরলো। হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। শুভ্রের নিশ্বাস হিয়ার গলায় আছড়ে পড়ছে।

এতক্ষণ শুভ্র যে তার এতো কাছে ছিলো হিয়া ঠিক সেটা খেয়াল করেনি। কিন্তু এখন তার প্রতিটা ইন্দ্রিয় সে ব্যাপারে সজাগ। হৃদ কম্পন যেনো ধীরে ধীরে বাড়ছে। শুভ্র তাকিয়ে আছে শীতল দৃষ্টিতে। তারপর হিয়ার একদম কাছে চলে আসতেই হিয়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। শুভ্র হিয়ার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,” আমার তোমাকে কেনো লাগবে বুঝো না।” কথাটা কর্নগোচর হতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো হিয়া। শুভ্রের তপ্ত নিশ্বাসে তার সাড়া শরীর বারে বারে শিউরে উঠছে।

হিয়া কিছু বলার আগেই শুভ্র হিয়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। হিয়া চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে শুভ্রের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। হটাৎ শুভ্রের এতটা কাছে চলে আসায় সব রাগ গলে যেনো রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তবে অভিমানটা মনের কোণে জমে আছে।

শুভ্র হিয়ার গলা থেকে মুখ সরিয়ে এনে হিয়ার রক্তিম চেহারার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। হিয়া কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে শুভ্রের শীতল দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। শুভ্রের দিকে তাকিয়ে এই হাসি দেখবার সাহস তার নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। লোকটা কি করতে চাইছে? এইভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?

শুভ্র হিয়ার আরো কাছে এগিয়ে আসছে সেটা শুভ্রের দিকে না তাকিয়েও হিয়া বুঝতে পারছে। হিয়া চাদরটা শক্ত করে ধরে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো।

শুভ্র হিয়ার এক হাত ছেড়ে দিয়ে মুখের সামনের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,” তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, তোমার রাগ এখনো কমেনি।তোমার রাগ কমানোর একটা উপায় আমার কাছে।” বলেই আরেকটু কাছে আসতেই হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” মানে? কিসের উপায়।” হিয়ার মনে সন্দেহ হতেই হিয়া বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো।

” কিস মি। ইউ উইল ফীল ব্যাটার।”, ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি দিয়ে বললো শুভ্র। কথাটা কর্নগোচর হতেই হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” আপনি আপনার মত নিলজ্জ নই। সরুন।” বলেই শুভ্রকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়লো। শুভ্র চাইলে আটকে রাখতে পারতো কিন্তু হিয়া কি করে সেটাই সে দেখতে চায়।

হিয়া শাড়িটা ঠিক করতেই দেখলো শুভ্র তার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো। কখন আবার এই লোকের মাথায় কি আসে! বলে কিনা তাকে কিস করতে। সে কি তার মতন বেহায়া নাকি। কিস করলে রাগ কমে এইটা আবার কেমন সাইন্স।

লোকটা প্রসঙ্গটাই ঘুরিয়ে নিয়ে, হুট করে একদম কাছে চলে এলো। যতবার মনে পড়ছে, গা শিউরে উঠছে তার। অসভ্য একটা লোক। তার যা বলার ছিল সবটাই গুলিয়ে ফেলেছে শুভ্রের এমন আচরণে। গাল দুটো দিয়ে তাপ বের হচ্ছে।

হিয়া নিচে নেমে একপাশে দাড়িয়ে আছে। বড়রা বসে আছে বাঁশের তৈরি বেঞ্চে। ছোটরা সবাই গোল হয়ে বসেছে নিচে। বাড়ির এই উঠানটায় আলো জ্বালিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে।

আরমান, শুভ্রের এক কাজিন গিটার হাতে গান গেয়ে যাচ্ছে। গানটা যেনো পুরো পরিবেশটা রোমাঞ্চে ভরিয়ে দিয়েছে। হিয়া একপাশে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গানটা অনুভব করছে। শুভ্র আস্তে করে সিড়ি বেয়ে নামছে। হিয়াকে দেখে থেমে দাড়ালো,

বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দেবো তারই সুরভী।
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো নাকো আমারই ছবি।
আমি মিনতি করে গেলাম

শুভ্র নিশব্দে পা ফেলে হিয়ার কাছে এগিয়ে এসে হিয়ার কানের কাছে ঠোঁট এনে বললো,” সরি। ” শুভ্রের কণ্ঠে হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র তাকে সরি বলছে? হিয়ার মুখ হা হয়ে গেলো। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার গালে কিস করতেই হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। লোকটা সবার সামনে কি করছে। হিয়ার অবিশ্বাস্য লাগছে। গানের সুরে সুর মিলিয়ে শুভ্র ঠোটে হাসি রেখে দুই লাইন হিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে গাইলো,

তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কি বা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম।

হিয়া বিমোহিত হয়ে শুনছে। এই রাগী ডাক্তার গান গাইতেও জানে? তাও আবার এতো সুন্দর! শুভ্র আস্তে আস্তে পা ফেলে সবার মাঝে গিয়ে বসলো আর গানটায় আয়মানের সাথে গলা মেলাতেই চারদিকটা যেনো অসম্ভব এক ভালোলাগায় ভরে গেলো। শুভ্রের প্রতি মুগ্ধতা আরো বেড়ে গেলো তার। লোকটা এতো সুন্দর গাইতে পারে। বাতাসে যেনো সত্যি আজ বকুলের সুগন্ধ পাচ্ছে সে। মুগ্ধ যে আজ একা হিয়া হয়েছে তা না। উপস্থিত সবাই শুভ্রের এইভাবে গান গাওযায় মনোমুগ্ধ। সেই যখন কলেজে থাকতো তখন গাইতো। শুভ্রের মা হটাৎ শুভ্রের এই গান গাওয়ার কারণটা ধরে ফেললেন হিয়াকে একপাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। তার ঠোঁটেও হাসি চলে এলো।

হিয়া একরাশ ভালোলাগা নিয়ে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছুদূরে রিমিকে দেখেই হিয়ার মুখের হাসি চলে গেলো। হিয়া এগিয়ে এসে শুভ্রের পাশে বসে পড়লো। মেয়েটাকে সে শুভ্রের আশেপাশেও আসতে দিবে। এই বদমাইস ডাক্তারের প্রতি এখন তার অধিকারবোধ আরো বেড়ে গেছে। গানের শেষের দিকে ছোট, বড়, বুড়ো সবাই কণ্ঠ মিলিয়ে গাইলেও শুভ্র শেষের দুই লাইন হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে গাইলো। যেনো এই দুই লাইন শুভ্র শুধু হিয়ার জন্যেই গাইছে।

এই মন তোমাকে দিলাম,
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।

হিয়ার মুগ্ধতা আরো বাড়লো। শুভ্র গানের শেষে হিয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিলো। ঠোঁটের কোণে হালকা একটু হাসির ঝিলিক। হিয়ার বুকের ভিতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। অন্যরকম এক আনন্দে চোখ মুখ জল জল করছে হিয়ার। শুভ্র কি তার মনের কথাগুলো গানের লাইনে অভিব্যাক্ত করলো। হিয়া ঠোঁট কামড়ে নিজের অনুভূতিগুলো সকলের আড়াল করতে চাইছে। শুভ্রের এই কাজগুলোর জন্যেই এই চশমা পড়া ছেলেটার প্রতি সে এতো দুর্বল, সব কিছুর মূল্যেই হিয়া এই শুভ্রনীল আহমেদকেই চায়।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here