নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -১৮+১৯

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৮

বধূর বেশভূষায় আনজুমা তার বাচ্চা আশফিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেঁদে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলছে। তাকে শান্ত্বনা দিতেও নিষেধ করেছে আরভীক। তার মেজাজ তিক্ষ্ণের চেয়েও তিক্ষ্ণতর হয়ে আছে। তাও অন্য কোনো কারণে নয়। বরঞ্চ মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার মূল ব্যক্তিই আনজুমা।
বিকালে যখন তার চেতনশক্তি ফিরে আসে তখন আরাজ সাহেবকে রুমে বসা অবস্থায় পায়। তিনি মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘কেমন আছো মা!’

‘ভালো আছি বাবা না মানে আঙ্কেল।’

‘আগের শব্দটাই বেটার ছিল। এখন থেকে বাবা ডেকে অভ্যাস করে ফেলো।’

ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো তার। প্রশ্নাত্মক নজরে আরাজ সাহেবের দিকে অবুঝ চাহনী নিক্ষেপ করে। তিনি ঠোঁট কামড়ে আলতো করে দূর ঘেঁষে বসে। আনজুমার একহাত ধরে অনুনয়ভরা গলায় বলে,

‘মা আমার কোনো মেয়ে নেই! তোমার মা আরভীক হওয়ার পরই মারা যায়। তখন তার বয়স আনুমানিক বিশ-একুশ হবে। খুব ছোটবেলায় তোমার মাকে বিয়ে করেছিলাম। যখন তার নাইন-টেনের পড়ার বয়স ছিল। কি করব বলো পছন্দের বউ আমার! ছাড় দেয়নি আগলে নিয়ে ছিলাম। শান্তির নীড় এক দমকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারিনী আরভীকের জম্মের সময় কমপ্লিকেশন ছিল। তখন জানলে সন্তান নিতাম না। তবে তার প্রতি মায়াবোধ,স্নেহ পরশ্রীকাতরতা তৈরি হয়ে গিয়ে ছিল। আজীবও দ্বিতীয় ভাই পাবে বলে খুশিতে মেতে থাকতো। তোমার মা পারেনি সকলের খুশি বিসর্জন দিয়ে সন্তান ত্যাগ করতে। তাই আমিও বিনা দ্বিধায় অশ্রু ঝরিয়ে বিদায় জানিয়ে ছিলাম স্ত্রীকে ডেলিভারির দিন।’

কিছু পরম প্রণয়ী স্মৃতি মনে আসায় আরাজ সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। তিনি চোখ মুছে না। বরং অশ্রুসিক্ত চোখে আনজুমার হাতের উপর দ্বিতীয় হাত রেখে আকুতিপূর্ণ গলায় শুধায়।

‘মা আমার মেয়ে হবে! আমার ছেলেকে বিয়ে করবে। আশফিকে তার বাবার অধিকারটা দেবে।’

উৎকণ্ঠায় থমকে গেল আনজুমা। তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে দৃষ্টিকোণ চোরাবালির মত নুয়ে নিল। যেন এ এক অসম্ভব বিষয়! আরাজ সাহেব প্রথম প্রস্তাবে হতাশা পেল। দৃষ্টি মেঝের উপর রেখে আনজুমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘কোনো ভাবে সংকোচ বা জড়তা নিয়ে থেকো না মা। নিজের বাবা ভেবে সিদ্ধান্ত জানাবে।’

‘আইম সরি আঙ্কেল আমি পারব না আরভীক স্যারকে বিয়ে করতে। আমার কাছ থেকে স্বামীর হাত চার বছর আগে সরে গিয়ে ছিল। আরভীক স্যারকে স্বামী বানালে আমি তাকেও খেয়ে যাব। ছোটবেলায় মুরব্বিগণ আমাকে দেখে অপয়া,মুখপুরি বলে ক্ষ্যাত করে ছিল। সুয়াইব মানে আমার স্বামীর মৃত্যুর পর মুরব্বিগণ গ্রামে আমার নামে রটায় যে আমি নাকি স্বামীর ঠিকাদারি করতে পারি না। একদমে বিয়ের বছর না পেরুতেই খেয়ে ফেলেছি। অথচ আমি ছিলাম মরণদশায় জর্জরিত। গর্ভে ছিল দশমাসের সন্তান। হাসপাতালের বেডে কাতরে কাতরে স্বামীর অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম। সত্যি আমি খেয়ে ফেলেছি তাকে। তাই আমার জন্য আপনার সন্তান,আপনার কোল শূন্য,খালি হোক এক জীবনে বেঁচে থেকে এ দুদর্শাময় কথা শুনতে চাই না। আপনি দয়া করে বলুন, আশফি কি বাসায় আছে!’

গভীর মনযোগ সহকারে আরাজ সাহেব মেয়ের মনভাব শুনে ও বুঝল। আড়ালে মৃদু হেসে দেয়। আনজুমার কথার প্রেক্ষিতে গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়।

‘আরভীক তাকে নিয়ে উঠানে হাঁটতে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।’

বাক্যধারা থামিয়ে উঠে দাঁড়ায় তিনি। আনজুমাও ভদ্রতার সহিতে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। হিজাব, আবাইয়া সটান করে সালাম আদায় করে নিল। তিনিও বিনিময়ে সালামের জবাব দিয়ে বলে,

‘মা আমার কথায় ভেবে দেখিও।’

উত্তরের দিক থেকে মৌন রইল আনজুমা। সে জানে না আদৌ বিয়েতে রাজি হবে কিনা তার মন! আরভীক এর প্রেমে পড়েনি তবে ভালো লাগে তার দুষ্টুমি কথাবার্তা! কোনো খুঁত নেই তার মাঝে। কিন্তু পারবে না সে আগলে নিতে! সুয়াইবের বিস্তৃত ছোঁয়ার মাঝে আরভীকের ছোঁয়া নতুনত্বের মত প্রভাবিত করবে। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার অন্তর থেকে। আচমকা হাতে টান পড়ায় চমকে উঠে সে। চোখ তুলে ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠে। আরভীক তার হাত এতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন হাত ছাড়লেই পালিয়ে যাবে! তার চোখ-মুখ রাগের কারণে রগরগে ফুলে আছে। ঢোক গিলল আনজুমা তার ভয়াবহ বর্বর রুপ দেখে। হাত ছাড়ানোর জন্য কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘দে দেখুন হা হাত ছা ছাড়েন।’

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আরভীক এর। তার বাবার কথা অমান্য করেছে এ মেয়েটা। দুপুরবেলায় যাও আদর করে ছিল বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় যেন তার মাথা ক্রোধে ফেটেই যাবে। মেয়ের সাহস কতখানী হলো দেখে সে নিজে অবাক! না মেয়েটাকে আর ছাড় দেবে না। অনেক হলো ‘না না না’ এর খেলা! এবার সে যা বলবে তাই হবে। বিবেচনাহীন আনজুমার ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ওষ্ঠ মিলিয়ে দিল আরভীক। হৃদয়ের ধুকপুক তেজ হয়ে গেল আনজুমার। ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরভীক ক্রোধের ঠেলায় ওষ্ঠে স্পর্শের চেয়ে বেশি কামড়ে লাল করে দিচ্ছে। আনজুমা ছাড়া পেতে তার পিঠ,বুকে ঘু’ষি,চ’ট’কানি দিচ্ছে। যার মা’ই’র মোটেও আরভীক এর শরীরে অনুভব হচ্ছে না। হিতে বিপরীত নিয়ন্ত্রণহীন করে দিচ্ছে আনজুমার আদুরীয় মা’ই’রগুলো। আড়চোখে আনজুমার বন্ধ চোখ হতে অশ্রু ঝরতে দেখে ছেড়ে দিল। তবুও হাত ছাড়ল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল মেয়েটি। ভ্রুক্ষেপ নেই আরভীক এর। তাকে আলমারির সামনে এনে ঘেঁটেঘুটে লাল বেনারসি শাড়ি বের করে দেয়। টেনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে সে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল। একমুর্হুতে কি হয়ে গেল ভেবেই আনজুমার মাথা ঝিম খেয়ে যাচ্ছে। দরজা ধাকিয়ে চিৎকার করে বলে,

‘এসব কি স্যার আপনি বিয়ের শাড়ি কেন দিয়েছেন! প্লিজ দরজা খুলন। আমি আশফির কাছে যাব।’

‘দিজ ইজ ইউর পানিশ্চমেন্ট মিসেস ফাওয়াজ।’

‘ওয়াট কিসের মিসেস ফাওয়াজ! আমি মিস আবান।’

‘কিছুক্ষণের জন্য! বিয়ের পর মিসেস ফাওয়াজ হয়ে যাবে।’

‘আমি আপনাকে বিয়ে করব না শুনছেন আপনি! যত যাই করুন আমি আশফিকে নিয়ে পালিয়ে যাব।’

বলতে থেকে ক্ষোভে ওয়াশরুমের বেসিনে থাকা সাবান,শ্যাম্পু দরজার দিকে ছু’ড়ে মারছে। অতিষ্ঠ হয়ে আরভীক দরজায় জোরালো এক ঘু’ষি দেয়। ভয়ের চটে কাঁপুনি ধরে যায় আনজুমার। আরভীক দাঁতে দাঁত চেপে দরজার নিকট মুখ এনে শান্ত কণ্ঠে হু’ম’কি দেয়।

‘যদি এখনি বিয়ের শাড়ি পরে বাহিরে না আসছো। মনে রেখো ভেতরে এসে আমিই পরিয়ে দেব। এর ফলে আমি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কিছু করে বসলে। তার দায়ে থাকবে তুমি।’

‘আরে বেক্কল নাকি আমি বিয়ে করব না মানে বাংলা বুঝেন না।’

আনজুমার কথায় পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশনহীন কণ্ঠে ‘এক’ বলে গণনা শুরু করে। আনজুমা শুকনো ভীতি মনভাবে ঢোক গিলল। মুখ খুলে নিম্নকণ্ঠে ‘প্লিজ’ বলে। তার বলার কারণে আরভীক ‘দুই’ বলে উঠে। ব্যস! আনজুমা বাক্যহীন পরণের জামা পাল্টে নেয়। পরণে পেটিকোট ও ব্লাউজ পরে শাড়ি পরতে হিমশিম খেয়ে যায়। ওয়াশরুমের ফ্লোর ভেজাভেজা হয়ে আছে। শাড়ি ভিজে থাকলে হাঁটতে,চলতে অস্বস্তি হবে। এটুকু ভেবে আমতা আমতা করে দরজায় নক করে। আরভীক দরজার মধ্যে হেলান দিয়ে ফোন টিপাটিপি করছিল। দরজায় কড়াঘাত শুনে বলে,

‘বলো রেডি!’

‘না আ আসলে আপ আপনি বাহিরে যান।’

সন্দেহের গলায় আরভীক শুধায়।

‘পালানোর জন্য।’

‘দূর বেক্কল গরুমার্কা বলদ! শাড়ি এখানে পরতে পারছি না। পেটিকোট ও ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছি।’

হুতুম পেঁচার মত মুখ করে ফেলে আরভীক। মনে মনে বলে, ‘এ কথা সুন্দর করেও তো বলা যেতো বাঘিনী কোনকার’। গলা ঝেরে গাম্ভীর্য ভরা গলায় ‘ওকে’ বলে সে বেরিয়ে যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন আনজুমা। শাড়িটি নিয়ে রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে পরতে আরম্ভ করে।

৩৬.
আরাজ সাহেব তাজ্জব চাহনী নিয়ে টিভি দেখছে। একপলক টিভি তো আরেক পলক ছেলের দিকে নিবিঘ্নে চেয়ে যাচ্ছে। বাবার প্রশ্নাত্মক চাহনী দেখেও না দেখার ভান ধরে বসে রইল। আরাজ সাহেব মাথা নেড়েচেড়ে টিভির চ্যানেলে তাজা খবর শুনতে থাকে।
রিপোর্টিং করছে আরভীক এর বন্ধু সায়াজ। সে তার ধন্যমান্য গলায় তিক্ত সত্য শুনাচ্ছে সকল দর্শকদের।

‘আজকের তাজা খবর হিসেবে নিয়ে এসেছি আরো দুজন নতুন ক্রিমিনালের মৃত্যু রহস্য। ডক্টর ডেভিড নিশ্চয় নামের লোকটাকে চেনেন। তিনি অন্য কেউ নন মেন্টাল আইসোলেশনের ডক্টর। তিনি মেন্টাল পেশেন্টদের ট্রিটমেন্ট করিয়ে লাভবান হোন। তবে এমন ভালোমানুষির পিছে যে ভয়ংকর এক রুপ চুপিয়ে আছে সেটা কি জানেন আপনারা! নিশ্চয় জানেন না! তবে শুনুন আমি বলছি। ডক্টর ডেভিড মৃত্যু অপরাধী ক্লেভের স্টেপ ব্রাদার। তিনি দেশে ছিল ভাইয়ের জন্য। তার মৃত্যুর ঘটনা শুনে তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে যায়। বলাবাহুল্য প্রতিশোধের নেশায় তিনি এক মেয়েকে অপহরণ করে এক ভুয়া পুলিশের দ্বারা মেয়েটিকে অপমান ও লাঞ্চিত করে। পরবর্তীতে তার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অপনীত হয়। কিন্তু তাদের পরিকল্পনায় সফল হতে দেয়নি জনমান্য সেবক,প্রতিরক্ষক আমাদের সিআইডি অফিসার ফাহাদ আকবার।’

সায়াজ হোস্টিং করার মাঝে ফাহাদ গাড়ি নিয়ে থানায় হাজির হয়। থানায় লাশগুলো পোস্টমোটার্ম করে দাফন করা হবে। অবশ্য এসব লাশের কোনো পোস্টমোটার্ম করতে হতো না। ফর্মালিটির কারণে সিনিয়র অফিসার আজ্ঞা করেছে। ফলে বাধ্য হয়ে ফাহাদ কাজটা নিজের হাতে নিল। সায়াজ এগিয়ে এলো ফাহাদের সন্নিকটে। সকলের চুক্ষগোচরে একে অপরকে দেখে রহস্যময় হাসি দিল তারা। সায়াজ কুটির হেসে পুনরায় বলে,

‘সো স্যার আপনি কি দর্শকবৃন্দকে লাশগুলোর মৃত্যু সম্পর্কে বলতে পারবেন!’

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে ফাহাদ সায়াজের এগিয়ে দেওয়া মাইকের কাছে মুখ এনে বলে,

‘যেহেতু আপনারা জানেন অপরাধ কি তাদের সেহেতু বলছি তাদের থামতে বলায়ও থামেনি, আমার বারণ উপেক্ষা করে গু’লি চালিয়ে তিন-চারজন পুলিশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ফলে এ কাজ গর্হিত অপরাধ হওয়ায় সোজা এনকাউন্টারের রুলস মানতে বাধ্য হয় আমি। অপধারীর শাস্তি মৃত্যু বা ক্ষমা। মৃত্যু তখন যখন সে গর্হিত অপরাধ করে আবারো অপরাধ করতে থাকে উৎকণ্ঠা অনুভব করে না। আর ক্ষমা তখন যখন অপরাধ করে শোধরে নতুন জীবনের প্রত্যাশা করে। ধন্যবাদ আমার কথার সমাপ্তি টেনে কাজে যাচ্ছি। আসসালামুয়ালাইকুম।’

সময় বিলম্ব না করে ফাহাদ থানায় ঢুকে পড়ে। সায়াজ তার মনমত রিপোর্টিংয়ে হোস্টিং শেষ করে নেয়। ক্যামেরাগুলো সাথে নিয়ে গাড়িতে বসে। তৎক্ষণাৎ কল দেয় আরভীক। বাসায় বসে আয়েশে দু’বন্ধুর কারনামা দেখছিল। একবন্ধুর কাজ শেষ হয়েছে দেখে তাকে প্রথম কল দেয়।

‘হেই ডুড কাম খাতাম।’

‘তোর স্বপ্ন এটা।’

কথাটি শুনে বোবা,গর্দভের মত মুখ হলো সায়াজের। তার বন্ধু,বন্ধু না, বন্ধু নামে মারাত্মক চিজ একটা! আরভীক পাশে থাকা বাদামের বোয়াল থেকে। একটুকরো করে বাদাম নিয়ে মুখে পুরে আর চাবিয়ে চাবিয়ে বলে,

‘বিয়ে খাইতে আর রিপোটিং করতে আয়।’

থতমত খেল সায়াজ। ফোনের লাইনে কি আসলে তার বন্ধু নাকি অন্য কোনো ছেলে বোঝার তাগিদে ফোনের স্ক্রিনে নাম দেখে নিল! বেকুব গলায় শুধায়।

‘তুই কি আরভীক!’

‘না আমি তার আত্মা বলছি।’

‘তুই মরলি কবে!’

‘এখনো মরিনী আরেকবার মদনের মত কথা বললে তোকে মেরে কেস ধামাচাপা দেব।’

‘ধুর হা’লা’র পুত! শান্তির জীবন তেজপাতা বানিয়ে ছাড়লি।’

‘জীবন তেজপাতা বানানো বউদের কাজ বিয়ের পর বুঝবি।’

‘চুপ করে বল কারে ধরেটরে বিয়ে করতে যাচ্ছিস।’

‘যারে গতরাতে উদ্ধার করছি তারে। বুঝস না বেশি দয়ালু মানুষ আমি। একদেখায় পছন্দ হয়ছে, বেচারী পাগল একটা। বাচ্চা সামলাতেও পারে না। তার চেয়ে বড় কথা আমার থেকে বাচ্চাটার বাবা হওয়ার শখও জাগছে।’

‘মিয়া তুমি চালাকি অন্য কাউরে মারিও! তোর ডুড লাগি আমি। বুঝি সব খাই কি আর সুজি!’

‘বুঝলে অবুঝের মত প্রশ্ন করস কেন মদন!’

হ্যাবলার বনে ফোন কেটে দেয় সায়াজ। ভেবে ছিল এবার বুঝি আরভীক জব্দ হলো তার হাতে। না পরিণতিতে সেই জব্দ হয়ে হ্যাবলা বনে গেল। আরভীক তার বাবার কাছে গিয়ে ঠেলেঠুলে রুমে ঢুকিয়ে দেয়। আরাজ সাহেব ছেলের আকস্মিক কাজে অবুঝের মত তাকায়। আরভীক লাজুক হেসে বলে,

‘ড্যড রেডি হয়ে নাও। তোমার বউমা এখনি বিয়ের শাড়িতে নিচে নামবে।’

ছেলের কথায় তাজ্জব বিস্ময়ে বিষম খেলো। রুমে ঢুকে আরভীক দরজা ভিড়িয়ে দেয়। আরাজ সাহেব মূর্তির মত ছেলের কথায় রেডি হতে লাগে। আরভীক ফোন বের করে অঞ্জয়কে কল লাগায়।

‘ইয়েস বস।’

‘কাজি আন।’

বিব্রতে মুখ ফুসকে কফিগুলো উগলে দেয় তার সামনে বসা পরম সুন্দরী রমণীর উপর। সেই রমণী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। অঞ্জয় কফিগুলো রমণীর শার্টে জুবুথুবু দেখে নিবিষ্ট হয়ে হাত লাগিয়ে মুছতে গেলে। রমণী মাত্রাতিরিক্ত ক্ষেপে কষে এক চড় লাগায়। বেচারা অঞ্জয় ঠোঁট কাঁপিয়ে ‘উম উম’ করে জবাব দেয়। আরভীক কপাল চুলকে সন্দেহের বাণী আওড়ায়।

‘তোর কি হয়ছে, প্যান্ট ভিজাইছস নাকি!’

বসের কথা শুনে কফির মগই হাত থেকে পড়ে গেল তার। ইজ্জত যেমন ছিল সব কুয়ায় ডুব দিছে। এমুর্হুত যা আছে তাও যদি চলে যায়। রমণী আর পটানো লাগবে না তার। আমতা আমতা করে ‘ওকে বস আনতেছি’ বলে কল রেখে দেয়।
কাজির ব্যবস্থা হয়ে গেলে সব মেইডসকে আদেশ দেয় আরভীক। বাসাটা তিনঘণ্টার মধ্যে যেন বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়।

৩৭.
আনজুমা আয়নার মাধ্যমে নিজেকে ঘুরেটুরে দেখছে। তার রুপ,যৌবনতা যেন পুনরায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। চারবছর আগে যা ক্ষয় হয়ছিল তা যেন নতুনত্ব প্রকাশ করছে। পরণের লাল শাড়ি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, গলায় ভারী গহনা, মুখের সামান্য ফাউন্ডেশন লাগিয়ে নিজেকে অপরুপ করেছে। স্বেচ্ছায় নাকি অনিচ্ছায় তা অজানা তার! ব্যস মন চেয়েছে আরভীক এর কথায় সায় দিতে। কিঞ্চিৎ পূর্বে দুজন ফিমেইল মেইড এসে মেহেদি পরিয়ে দিয়েছে হাতে-পায়ে। আশফিকে খোঁজ ছিল সে কিন্তু তাকে নাকি আরভীক কোলে নিয়ে বসে আছে। দুজনকে দেখতে নাকি হুবুহু বাবা-ছেলের মত লাগছে। কথাটি শুনে চমকিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিল। পরক্ষণে আয়নায় নিজের সাজসজ্জিত বধূর রুপ দেখে মনেমনে আওড়ায়।

‘খুব কি বেশি ক্ষতি হতো যদি আরভীকের জায়গায় আপনি হতেন সুয়াইব। বড্ড বেশি যে ভালোবাসি আপনাকে। সে হয়তো আমার ভালোলাগা। কিন্তু আপনি আমার পরম হৃদয়ের প্রণয়রাজ।’

চোখ বুজে অপেক্ষারত রইল বিয়ের ডাকের। সে জানেও না অগোচরে কথাগুলো আরভীক শুনে নিয়েছে। সে এসেছিল খোশমনে আনজুমাকে নিতে। তবে যে কথাগুলো আনজুমা মনে বলছে ভাবল। তা স্বল্পস্বরে রুমের মধ্যেই বিরাজিত হয়েছে। যার খেয়াল ছিল না আনজুমার। আরভীক এর হৃদপিন্ডে যেন কেউ ছুড়ি বসিয়েছে। তার চোখে অতীব কষ্টের ন্যায় অশ্রু জমা হয়েছে। মুছে ফেলার জোঁ নেই। দরজা ভিড়ানো অবস্থায় প্রাণেশ্রয়ী নারীর দিকে চেয়ে রইল। কি হতো আল্লাহ্! যদি পূর্বেই তাদের মিলন করাতো। সুয়াইবের জায়গায় কেনো সে হলো না। হলে কখনো দূর হতে দিতো না তার প্রণয়োণীকে। আনজুমা হয়তো বিয়েটা মেনে নিতে না পারে, সমস্যা নেই। হাসিল করতে জানে আরভীক। ভালোবাসায় এটুকু স্বার্থপর সে হবে। তার মনদিলে সুয়াইব হলেও সে থাকুক! আরভীক না হয় সুপ্ত এক মনবাসনা তৈরি করে দেবে। যেটা শুধুই তার নাম গুঞ্জন করবে। আনজুমা যে শুধুই তার এক প্রাণের প্রণয়োণী। ভাবনার পরিচ্ছেদ দূর করে শক্তপোক্ত মুখ করে ভেতরে প্রবেশ করে। আচমকা কারো প্রবেশে বেশ ঘাবড়ে যায় আনজুমা। আরভীক এর রাগান্বিত চেহারা দেখে শঙ্কিত কণ্ঠে বলে,

‘প্লিজ আ আবার বলছি য যেতে দিন।’

আরভীক গম্ভীর মুখে এসেছে। কেননা আনজুমার প্রথমে আওড়ানো কথাগুলো তার হৃদয় ছন্নছাড়া করে দিল। তথাপি ‘যেতে দিন’ শব্দ দুটি যেন তার মাথায় রাগের অগ্নিকুণ্ড ধেবে দিয়েছে। দাঁতে দাঁত মিলিয়ে তিক্ষ্ণ শব্দ বের করে আনজুমার কথার বিপরীতে হাত শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড় করায়। তার মুখোমুখি এসে বলে,

‘যেতে দিন তাই না! এখনি তোমার যাওয়া বের করছি আমি।’

আনজুমা ভাবেনি তার কথার প্রভাবে আরভীক কপাট রেগে তৎপর হয়ে উঠবে। টেনে আনতে নিলে যখন দেখল বউয়ের কষ্ট হচ্ছে। সে কোনো ভদ্রতা,লাজলজ্জার পরোয়া না করে বউকে ঘনিষ্ঠভাবে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। ফাহাদ,সায়াজ,অঞ্জয়,সাইবা,আরাজ সাহেব,কাজি ও এক পুরু পরিবার দাঁড়িয়ে আছে।
সকলে তাদের দৃষ্টি সংযত করে নিল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) জামাই-বউ পারস্পরিক ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করতেই পারে। কাজির সামনে এনে দাঁড় করায় আনজুমাকে। কাজি সাহেব মেয়েকে রাজি আছে কিনা জিজ্ঞেস করে। ফুঁপানো কণ্ঠে সে ‘না’ শব্দ বের করে। যা শুনে ঢোক গিলে কাজি। আরভীক এর রাগ যেন সীমা লঙ্ঘন করে দেবে। কোনো কথ্যহীন আনজুমার হাতে কলম চেপে কাগজে সই করিয়ে নেই। সে তো বাচ্চাদের মত বিয়ে না করার জন্য কেঁদেকুটে নাজেহাল দশা বানিয়ে ফেলছে নিজের। এতে পরিপূর্ণ গা-ছাড়া ভাব নিল আরভীক। তার বন্ধুগণ দেখেও অসহায় নজরে তাদের ভাবীকে শান্ত্বনা দেয়। কেননা আরভীক কড়া ধমকে বলেছে এ মেয়ের শায়েস্তা হওয়া দরকার! তোদের কাউকে যেন একে শান্ত্বনা দিতে না দেখি। বেচারারা আরভীক এর কথার খেলাফ হতে পারবে না। কথার খেলাফ মানেই জীবন অথৈ সাগরে তলিয়ে যাওয়া।

বিয়ের সুন্দর ঘটনা মনে করে হেসে দেয় আরভীক। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ক্রন্দনরুপী বধূর কানে অথাৎ আনজুমার কানে ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে,

‘ফ্যাসফ্যাসানি বন্ধ কর। না হলে বাসর রাতে কিন্তু আমি গরম না হয়ে সরাসরি আগুন ধরিয়ে দেব। তাও কোথায় কোথায় ধরাতে পারি! নিশ্চিত তুমি বুঝদার, বুঝে গেছো।’

কথাগুলো শুনে আনজুমা ড্যাবড্যাব করে তাকায় আরভীক এর দিকে। আকস্মিক কারো ভরাটপূর্ণ গলায় ‘আনজু মা’ শুনে হৃদস্পন্দন শীতল হয়ে যায় তার। এ কণ্ঠধারীর মালিক কি সেই যে তাকে পৃথিবীর মায়া দেখিয়েছে! যাকে দেখে জীবন কি বুঝতে শিখে ছিল।#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৯

আনজুমার চোখ বেয়ে শীতল অশ্রুসিক্ত হচ্ছে। এই কাকে দেখছে সে! অপরপ্রান্তের ব্যক্তিদ্বয়ের চোখজোড়াও অশ্রুে ভরপুর। তবুও তার কাছে এদের চোখের পানি স্নেহ-মায়ার নয়, ন্যাকার লাগছে। আরভীক এর হাত শক্ত করে চেপে ধরে মুখ লুকিয়ে বলে,

‘কেনো এসেছো তোমরা আমি মরে গেছি, না বেঁটে আছি সেটা দেখতে এসেছো!’

আরভীক মিছামিছি রাগের কণ্ঠে শুধায়।

‘এটা কেমন বিহেভর মিসেস ফাওয়াজ! নিজের বাবা-মায়ের সাথে এরুপ বিহেভর বেমানান।’

‘মা আমার এভাবে বলিস না। তোর বাবা-মায়ের ভুল হয়েছে। মাফ করে দেয় মা।’

‘এই মাফ চাওয়ার ভাবনাটা তোমাদের ভুল আব্বুআম্মু। যারা নিজ সন্তানকে পরগাছা ভাবে তারা মন থেকে ভালোবাসার হক যাতায় না। নিশ্চয় জরুরি উদ্দেশ্যে এসেছেন। যাই হোক আমার ভালো লাগছে না। আপনারা আসছেন এসে সুন্দর করে চলেও যাবেন।’

তিক্ত কথাগুলো বলে কাঁপুনি ধরা শরীর নিয়ে আরভীক এর রুমে চলে যায় আনজুমা। ইতিমধ্যে সে দেখল তার ছোট বাচ্চাটি ঘুমানোর জন্য ঝিমুচ্ছে। আশফিকে বিছানার উপর রেখে তার পাশ ঘেঁষে হেলান দিয়ে বসে। মনে মনে দীর্ঘ ছক কাটে। সুয়াইবের সঙ্গে বিয়ের পর পুরুপুরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছিল তার পরিবার। কালের বিবর্তনে চার বছর পর দেখল সে তার বাবা-মাকে। সচল,স্বচ্ছ লাগছে সবার মুখশ্রী। অথচ যখন সে ছিল তখন তাদের মুখে ছিল অসহায়,বিরক্তির ছাপ। যেন আপদ হিসেবে সে পৃথিবীতে জম্মে ছিল। কই সে তো কখনো আফসোস করেনি! পড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তার বাবার। তাই বলে সেও পড়ার প্রতি ভীষণ জোঁক থাকলেও দূরে সরে এলো। বিয়ে না হয় ভাগ্যের জোরে দিয়ে ছিল সুয়াইবের সঙ্গে। পুলিশের চাকরী করার সত্ত্বে ধনাঢ্য ভেবে দিয়ে ফেলে দিল। একটুখানি খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করেনি তারা। কেমন বাবা-মা তারা! জম্ম দিলেই কি দায়িত্ব শেষ। সে তো প্রতিটা মোনাজাতে আল্লাহর কাছে মানত করেছে তার বাবা-মায়ের সুস্থতার কাতিরে। কিন্তু এর বিন্দুমাত্র স্নেহের পরশ হয়তো দেয়নি তার বাবা-মা। সে বোঝা ছিল যা ঘাড় থেকে নামতেই দায়িত্ব শেষ। সে তো অমানুষ নয়! সে চিরঞ্জীব দোয়া করবে তার বাবা-মায়ের জন্য। বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত স্নেহ পায়নি বাবা-মায়ের,প্রারম্ভীক বয়সে যেখানে বাচ্চারা মায়ের আঁচল গুজে লুকিয়ে স্নেহ চাই সেখানে সে বালিশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো! শুধু একটুখানি প্রণয় পাওয়ার লোভে। আল্লাহ্ প্রণয়রাজ হিসেবে সুয়াইবকে প্রেরণ করে ছিল ঠিকি। তবে বেশিদিন তার কপালে স্থায়ী রাখেনি। লিখে রেখেছিল চলে যাওয়ার আক্ষেপন! চোখ বুজে থাকা অবস্থায় আনজুমার আঁধারে ঘনিত নয়নে সুয়াইবের হাস্যমুখশ্রী ফুটে উঠেছে। আকস্মিক সুয়াইবের চেহারার মাঝে অন্য রুপ ভেসে এলো। আরভীক এর রুপে পরিণত হলো চেহারার অবয়বটি।
আরভীক এর চেহারা দেখে চট করে চোখ খুলে সে। সামনে দেখতেই ভূত দেখার মত চিৎকার দিয়ে উঠে। আরভীক বেচারা বউয়ের কাছে এসে ছিল ফাস্ট নাইটের স্টোরি নিয়ে আলাপ করতে। অন্যথায় চিৎকারের সম্মুখীন হয়ে বেকুব বনে গেল। বিনাবাক্যে চিৎকার বন্ধ করতে মেয়ের ওষ্ঠজোড় চেপে ধরে সে। চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল, পরিবেশ নির্জীবতা পালনে ব্যস্ত হলো। গাড় হলো পারস্পরিক শ্বাসপ্রশ্বাস, হাতে হাত রাখা হলো ঘনিষ্ঠভাবে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

‘উম পাপ্পা।’

আচমকা ছেলের কণ্ঠ পেয়ে ছিটকে সরে যায় আনজুমা। ঘুমের ঘোরে আশফি কথা বলে উঠেছে। নিজের চেহারা চোরের মত লুকানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে আনজুমা। দিগিদ্বিক না পেয়ে সুতির থ্রিপিচ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। তার লুকানোর লাজুক আচরণ দেখে মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল আরভীক এর হৃদয়। অনুভূতিপ্রবণ ছিল এ ওষ্ঠের মিলনে। তার কাছে ওষ্ঠের এ স্বাদ অমৃত পানসুধা মনে হলো। কত বছর যেন এ স্বাদ থেকে সে বঞ্চিত হয়ে এসে ছিল!
আজ পেয়ে ছাড়বে না কখনো। আশফির নাকে ওষ্ঠ ছুঁয়ে চুলগুলো শুদ্ধভাবে টেনে দেয় সে। ফিসফিসিয়ে বলে,

‘পাপ্পার রোমান্সে ডিস্টার্ব করতে নেই চ্যাম্প! না হলে বোন বা ভাই তোমার সাথে রাগ করবে হুম।’

‘বাচ্চাকে এসব বলতে লজ্জা লাগে না আপনার।’

আনজুমার কণ্ঠ পেয়ে সূক্ষ্ম নেশাবুদ দৃষ্টিতে তাকায়। ভড়কে যায় সে। হৃদয়ের ধুকপুক তেজ হলো। আরভীক এর নেশালো চাহনী হৃদয় ঘায়েলকারক। এ চাহনী থেকে বাঁচা দুষ্কর। বিধেয় তার মাঝে আমতা ভাব এলো। আশফির পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে নিল কিন্তু বে’হা’য়া চোখজোড়ায় আরভীক এর রিয়েকশন কেমন সেটা দেখার কৌতূহলে অভিপ্রায় জম্মেছে। পিটপিট করে আড়চোখে দেখে সামনে কেউ নেই। মাথা উঠিয়ে চর্তুপাশ্ব নজর বুলিয়ে তাকে না দেখে বিনা দ্বিধায় বালিশে মাথা গুজে নুয়ে পড়ে। অতঃপর শীতল শক্ত পুরুষের ছোঁয়া কোমরে পড়তেই সে নিজেকে শক্তভাবে এঁটে রাখে। ভেবে ছিল আরভীক এতে সহজে তাকে কাছে টেনে নেবে না। হিতে বিপরীত হলো হেঁচকা টান দেওয়ার অভিভূতে সে তার স্বামীর বাঁপাশে বুকের পাজোঁরের উপর পড়ে মাথা রাখে। ভয়ে কেঁপে এলো শরীরের রক্তপ্রবাহ শিরা। নড়বড়ে হলো তার মনের কোণায় জমে থাকা তীব্র অনুভূতির প্রজাপতির ঘুমন্ত স্বপ্ন। জেগে গেলে যেন তারা ডানা ঝাপ্টে উড়াল দিতে চাইবে। তখন কি সে পারবে তার আবেগ,অনুভূতি দমিয়ে রাখতে, যা দীর্ঘ চারবছর ধরে আগলে রেখে ছিল। সেগুলোর মাঝে তার সঙ্গীর অভিমূর্তি প্রদান করতে। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায় তার গালে। আরভীক সূক্ষ্ম হেসে অশ্রুগুলো চুষে নেই। তার ওষ্ঠের উপর মৃদু স্পর্শের ছোঁয়া দিয়ে বলে,

‘জানি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমার। আমাকে সুয়াইবের স্থানে বসাতে। তবে আমি বলব না এত জলদি আমাকে আগলে নাও। শুধু বলব পাশে থেকো। এই বুকে মাথা রেখো। এই হৃদয়ের আগুন শীতল করার দুটি পরম শান্তিময় ব্যক্তি তুমি আর আশফি। ব্যস এটুকু চাওয়া! ভালো তখনি বেসো যখন তুমি বুঝবে আমি তোমার সুয়াইব প্রণয়োণী।’

শেষ শব্দটি বলার সময় আরভীক এর ঘোর লেগে এসে ছিল আনজুমার গোলাপী ভেজা ওষ্ঠ দেখে। মন চেয়েছে মন বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় এই ওষ্ঠজোড়া। যদি শিহরণ জাগে এই প্রণয়োণীর প্রতি! তাহলে মন্দ কোথায়! তার আর আনজুমার ওষ্ঠজোড়া প্রায় কাছাকাছি ছিল। ছুঁই ছুঁই দশায় এসে আনজুমা তার শার্টের কলার টেনে বোতাম খুলে দেয়। ঘাড়ের মধ্যে কিছু পায় কিনা বারংবার খোঁজতে থাকে। আরভীক থতমত খেয়ে যায়। সে বিমূঢ়তায় অবাক! মেয়েটার হলো কি, বাঘিনীর মত ঘাড়ে কি খোঁজে যাচ্ছে! আনজুমাকে টেনে দূর করতে চেয়েও পারছে না। সে ক্ষেপে কি যেন খোঁজেই চলেছে। কাঙ্ক্ষিত খুঁতটি না পেয়ে হতাশ হয়ে সরে এলো। তার কানের মধ্যে ঝংকার তুলে দিয়ে ছিল ‘প্রণয়োণী’ শব্দটি। এই শব্দ সুয়াইবের মুখেই মানানসই। বিয়ের প্রথম মধুররাত্রির ডাকে তার হাস্যমুখশ্রীর হতে এই শব্দ বের করে ছিল। তাহলে আজও ব্যতিক্রম নয়। বিয়ের প্রথম মধুরাত্রি। সে আছে, তার স্বামী আছে। তবে মানুষটার রুপ ভিন্ন। আহ্লাদী চোখে তাকায় আরভীক এর প্রশ্নাত্মক চাহনীর দিকে। মানুষটার রুপ অমায়িক ফর্সা না হলেও হলুদে ফর্সা, চোখের গাড় বাদামী আইব্রু ও মণিজোড়া জ্বলমল করছে, মুখের মধ্যে কোনো রুপ ব্রুনের ছাপ নেই, তবে একটি ঘন কালো দাগ আছে কানের নিচে, দাগটি কিসের অজানা তার, জামকালো ওষ্ঠের মিলনে চেহারার উপর আফিম মিশিয়ে রেখেছে সে। আনজুমা সেদিক ভ্রুক্ষেপ না করে রুপের চেয়ে মায়া বেশি জম্মিয়েছে আরভীক এর প্রতি তার মনে। সে তার কানের নিচে আলতো ছোঁয়া দেয়। বিব্রতবোধ করে আরভীক। আনজুমা যে তার কানের নিচের দাগে হাত বুলাচ্ছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার। আলতো ছোঁয়ার মধ্যে আনমনে বলে,

‘আপনার এ দাগ কিসের!’

গম্ভীর মুখশ্রী ভাব চলে এলো আরভীক এর মাঝে। নিরুত্তরে চোখ বুজে নেয়। ভাবলেশনপূর্ণ রুপ এমন যে, প্রয়োজন নেই এ প্রশ্নের উত্তর জানার। আনজুমা ক্ষণিক সময়ের মত চেয়ে রইল উত্তর পাওয়ার আশায়। নিরাশাপূর্ণ হলো সে। নিশ্চুপে আরভীক এর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
সে ঘুমালেও জেগে ছিল আরভীক। তার নিদ্রা উড়ান ছুঁ। কেননা সে বুঝেছে তার প্রাণপাখি সত্য জানার পিছু নেবে। সে বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না। অনেক হলো খেলা! এবার যাকে তার স্থান বুঝাতে হবে। আজ সে উপলব্ধি করেছে আনজুমার চোখে তার বাবা-মায়ের প্রতি তীব্র অভিমান!
সেই ছিল যে আনজুমার বাবা-মায়ের তথ্য জেনে, তাদের খোঁজে এনে ছিল আনজুমাকে সারপ্রাইজ হিসেবে দেবে বলে! ভেবেছিল সে খুশিতে আপ্লুত হবে। কিন্তু হলো বিপরীত প্রতিক্রিয়া। আনজুমা অভিমানিত্ব বজায় রেখে কথাহীন রুমে চলে গেল। তার রুক্ষ ব্যবহারে তার বাবা-মার হৃদয় ব্যতীত হলেও আরভীক আশ্বস্ত করে যে, সে সুখী রাখবে তাদের মেয়েকে! তাদের অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া মিথ্যে বলছিল না! তারাও প্রায় চারবছর ধরে যে কাতর ছিল তা বুঝতে পেরেছে। বউয়ের পারিবারিক দ্বন্দ্বতায় সে জড়াবে না। তবে বুদ্ধি দিবে যেন সরল মনে কথা ফলে সব জেনে তারপর বিচার ন্যায় করে কথা বলবে কি বলবে না এর সিদ্ধান্ত নিতে! তাই আরভীক তার বাবা-মা ও বোনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দেয় তার ফার্মহাউজে। সায়াজ তাদেরকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আছে। প্রয়োজন স্বরুন কনটাক্ট নাম্বার দিয়ে গেল। তপ্ত দহনহীন শ্বাস ফেলে
আনজুমার ঘনিষ্ঠত্বে তার পিঠে হাত রেখে শক্ত করে জড়িয়ে নেই।
ভোরে ফজরের আযান হতেই জেগে উঠে আরভীক। আনজুমা গভীর নিদ্রামগ্ন ছিল। তার শান্তির ঘুম ভাঙ্গতে মন চাইনি আরভীক এর। সে বেরুতেই সামনে পেল পাঞ্জাবী পরিহিত পুরুষ হিসেবে তার বাবাকে। সেও মৃদু হেসে পাঞ্জাবী পরে বের হলো বাবার সঙ্গে মসজিদে রওনা দিতে।
নামাজ শেষে ফিরতি পথে আরাজ সাহেব বলে,

‘বাবা বউমাকে কি বলবি তুই!’

‘জানিনা ড্যাড।’

‘লুকিয়ে লাভ নেই কখনো না কখনো জেনে যাবে। তখন অভিমান হলেও সামান্য হবে। এখন তুই লুকিয়ে রেখে পরে সে অন্যকারো থেকে জেনে গেলে তখন তোর উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে বউমার।’

‘কি করব ড্যাড বিশ্বাস চলে গেলেও তার আমার কাছেই থাকতে হবে!’

‘তুই বললে ক্ষমা পেয়ে যাবি।’

‘বলতে পারব না ড্যাড। যতদিন সত্যটা আড়ালে থাকবে ততদিন শত্রুপক্ষ নিজেকে মুক্তপাখির ন্যায় ডানা ঝাপ্টে যাবে। মোক্ষম সুযোগে আমিও হাতছানি করব না। ডানা কেটে খাল খনন করে পুঁতে দেব।’

‘তোর কবে মনে পড়ছে সব!’

মুচকি হেসে আরভীক। আরাজ সাহেবের দৃষ্টিকোণে প্রশ্নাত্মক চাহনী নিয়ে দেখছে। তিনি জানার তাগিদ প্রকাশ করছে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্তের জন্য। কেননা তিনি শ্রেয়া মেয়েটার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে জড়িত করতে চেয়ে ছিল আরভীক এর। যদিও তিনি জানতো না আরভীক এর আজও কোনো পরিবার,বউ-বাচ্চা ছিল কিনা। আরভীক তার বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘আপনি হচ্ছেন আমার ড্যাড! জানি কি চলছে আপনার মনে। এই ‘কবে’ প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় এখনো আসেনি। আজ না হয় কাল আমি বিস্তৃত এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চলেছি। এবার শেষ দুজনকে আমি হাতের মুঠোয় এনে নাচাব। যে রাত্রি আমার জন্য কাল হয়ে ছিল ঠিক সেই রাত্রির মত হত্যাকান্ডের ধুম বাজাব।’

আরাজ সাহেব অশ্রুসিক্ত চোখে জিজ্ঞেস করে।

‘তুইও কি পরে আমাকে একা করে চলে যাবি।’

‘আপনাকে কখনো ছেড়ে যেতে পারি নাকি ড্যাড!’

‘যাস নে বাবা, তোদের ছাড়া আর কেউ নেই আমার। সন্তানহীন বাবা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে তোদের বাবা হয়ে বেঁচে থাকা শতগুণ ভালো বটে।’

‘হুঁশ ড্যাড নো মোর ক্রাই!’

আরভীক আরাজ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বাসার ভেতর প্রবেশ করে।

৩৮.
রাজিব আমতা আমতা করে চোরা চোখে তাকিয়ে আছে শ্রেয়ার দিকে। সে ক্ষেপেছে, মারাত্মক ক্ষেপেছে। এর কারণের মূলবিন্দু অন্য কেউ নয় বরং সে নিজেই অথাৎ রাজিব। শ্রেয়া গোসল করতে ঢুকে ছিল ওয়াশরুমে। তখন রাজিব ইচ্ছেকৃত রুমের মধ্যে এসে বিছানায় বসে নিবিড়ভাবে ফোন টিপাটিপি করে। চল্লিশ মিনিট পর শ্রেয়া শরীরে তাওয়াল বিহীন মাথা মুছতে থেকে বের হলো। কোনো দিক না তাকিয়ে বস্ত্রহীন হয়ে দাঁড়ায় আলমারির সম্মুখে। রাজিব বেচারা ‘থ’ হয়ে গেল। কামুকতা চওড়া ভাবে শরীরে নাড়া দিচ্ছে। সে বে’হা’য়া চোখজোড়া সরিয়ে নিতে চেয়েও পারছে না। পা বাহিরের দিকে এগোচ্ছে না। বারংবার নজর যেন ঐ বিবস্ত্র রমণীর উপর পড়ছে। শ্রেয়া আলমারির থেকে শর্ট স্কার্ট ও টিশার্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু আয়নার প্রতিবিম্বে দ্বিতীয় ব্যক্তির অবয়ব দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। পিছু ঘুরে চমকে উঠে। রাজিব হা করে তাকে দেখে চলেছে। সে ভাবে হা করে তাকানোর কি হলো! পরক্ষণে তার মনের কোণায় প্রশ্নের ভীড় জমলো। রাজিব কবে থেকে তার রুমে বসে আছে! সে তো ওয়াশরুম থেকে তাওয়াল বিহীন বেরিয়েছে। তবে কি…..!
রাগে চোয়াল শক্ত করে রাজিবের মুখোমুখি হলো। বেচারার ভয়ে জান কবজ বেরিয়ে আসার উপক্রম। মেয়ের কটমট চাহনীতে যেন সে ভস্ম হয়ে যাবে। হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘হেই আমি ত তো তোমার সা সাথেই দেখা করত করতে আসছি।’

‘কখন থেকে বসে আছিস তুই!’

পরিণতিতে কপালে বিন্দু ঘাম জমে এলো রাজিবের। পালানোর পথধারা বন্ধ করে রেখেছে শ্রেয়া। বিনা বাক্য ব্যয় করে ড্রয়ার থেকে পি’স্ত’ল হাতে নেই সে। দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে যায় রাজিবের। তিক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘গার্ন নিয়েছো কেনো!’

‘সহজ প্রশ্ন আমাকে ন্যাকেড দেখেছিস নাকি না!’

ঢোক গিলল রাজিব। গার্নটি শ্রেয়া তার কপাল বরাবর রেখেছে কিঞ্চি ফাঁক রেখে দাঁড়িয়েছে। যদি হ্যাঁ বলে নিশ্চিত তার হায়াতকে মরণে পরিণত করে দেবে! শ্রেয়া উত্তর না পেয়ে গার্নটি ঠেকাল রাজিবের কপালে। তবুও সে নিরুত্তরে শান্ত করল নিজেকে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে শ্রেয়ার চোখের পলকে চেয়ে থাকে। শ্রেয়ার আকস্মিক হাত কাঁপছে পি’স্তল চালাতে। অথচ কত বুলেট বের করে কার না কার প্রাণ ছিনিয়েছে অগণিত হিসেব নেই! রাজিবকে মা’রতে পারছে না সে। কিছুক্ষণ আগেও তার হাত কাঁপছিল না। অথচ এখন যেন সে বশবর্তী হয়ে পড়ছে রাজিবের। তার শিহরণময় চোখের নয়নে যেন শ্রেয়ার ঘোর লেগে আসছে। ডুবে যাবে সে এই চাহনীর মাঝে। পি’স্ত’ল চালাতে না দেখে রাজিব মৃদু হেসে শ্রেয়ার কনুই চেপে তার ঘনিষ্ঠত্বের জন্য টেনে আনে। বিন্দুমাত্র ফাঁকা নেই তাদের মাঝে। দুজনে লেপ্টে থাকার মত দাঁড়িয়ে আছে। অথচ হাত দিয়ে পারস্পরিক জড়ানো বাদে! রাজিব আফিমময় কণ্ঠে শুধায়।

‘তুই আমাকে মা’রতে চেয়েও পারবি না। আমি এমনি তোর রগরগে বসবাস করি।’

কথাটি বলে অপ্রতিভ আচরণ করে বসে সে। শ্রেয়ার ওষ্ঠের উপর মৃদু স্পর্শ দিয়ে তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করে তার রুম থেকে। মন কাঠিন্যময় নারীর হৃদয় দোলছে আজ! রাজিবের আজকের ছোঁয়ায় সে অন্যরকম অনুভূতি পেয়েছে। জাফর সাহেব কোথার থেকে এসে মেয়েকে শুধায়।

‘শুনো মামুনি আমাদের এখনি ফাওয়াজ ম্যাশন যেতে হবে।’

শ্রেয়ার ভাবনার সুতো কেটে পড়ে তার বাবার কথার বদৌলতে। প্রশ্নাতীত চোখে দাঁড়িয়ে রইল। তার বাবা রুমের মধ্যে পায়চারী করে আলমারী থেকে শাড়ি ও বোরকা বের করে বিছানার উপর রাখে। আনমনে বাবার কার্যসিদ্ধি পরখ করে গেল সে। জাফর সাহেব মেয়ের বিছানায় রাখা কাপড়গুলো ঠিক আছে কিনা ভালো করে পরখ করে নেই। শুদ্ধভাবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘তোর জম্মদিনে কিছু করা হয়নি বলে আফসোস করিস না মামুনি। আরভীকের বাসায় যাব। সেখান থেকে পাক্কা খবর নিয়েই পার্টি করবি।’

সন্দেহ কাটিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল শ্রেয়া। তার হবু স্বামী হবে শুধু আরভীক! রাজিব মাত্রই বডিগার্ড! বাবার তাড়াহুড়ো করে দেখে জিজ্ঞেস করে।

‘আমার কি করা উচিৎ এখন!’

‘ড্রেস রেখেছি ফিমেইল মেইড এসে শাড়ি পরিয়ে দেবে। তুই গহনাগাটিঁ পরে সেজেগুজে রেডি হয়ে ডাকিস আমাকে। বোরকাও পরে নিস কিন্তু।’

চটজলদি কথার প্রেক্ষাপট শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল জাফর সাহেব। নিজ রুমে এসে লিয়াকত সাহেবকে কল দেয়। তার ঘরে সে প’তি’তা মেয়ে এনে সময় কাটিয়ে শান্তির ঘুম দিয়ে ছিল পুরু রাত। কলের শব্দে সে জেগে উঠে। দেখে তার পাশে বস্ত্রহীন কালো বর্ণের রমণী পড়ে পড়ে ঘুম মারছে। সে টাকা নিয়ে ছু’ড়ে দেয় তার শরীরে। রমণী জেগে উঠে। টাকা পেয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে বস্ত্র উঠিয়ে চলে যায়। লিয়াকত তার লুঙ্গি ঠিকঠাক করতে থেকে কলটি উঠায়।

‘শুন লিয়াকত জলদি রেডি হয়ে বাসার সামনে আয়। আজই শ্রেয়ার সাথে আরভীক এর বিয়ে পাকাপাকি করতে হবে।’

চটে গেল সে। কর্কশ গলায় শুধায়।

‘ওত জলদি কেন করতে যাবি!’

‘হা’লার বলদ জানস না কি হয়ছে! আরভীক খবরাখবরে এসে এক আনজুমা নামের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে রচিয়ে ফেলছে। শ্রেয়া জানেও না। আমি গতকাল রাতেই খবরে দেখছি। এখনো খবরটা চলছে। তুই এখনি আয়। আজকে ফায়সালা করেই ছাড়ব।’

কল কেটে দেয় অপরপ্রান্ত থেকে। কথাগুলো শুনে মস্তি করা রাতের কান্ড ভুলেই গেল লিয়াকত সাহেব। এ মুর্হুতে তার মেজাজ আগুনের লাভা মত ফুলে ফেঁপে উঠছে। এত দিনের বানানো খেলায় পানি ঢেলে দিল ঐ আরভীক এর বাচ্চা! সেও সটান মনে পণ নিল আনজুমা মেয়েটাকে স্বামীহারা করে দেবে। ফোঁস ফোঁস করে রেডি হতে গেল।
রাজিব ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। জাফর সাহেবের গাড়ি সুন্দরভাবে মুছে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। হয়তো কোথাও যাবে সে! নজর‍দারি গাড়তাপূর্ণ করতে এগিয়ে গেল। জাফর সাহেব তখনি বাসার দরজা দিয়ে বের হলো। সঙ্গে শ্রেয়াও।
শ্রেয়া দেখে দুনিয়ার কোনো কিছুই নজরে এলো তার। সর্বোচ্চ হুঁশ হারিয়ে ফেলে রাজিব। প্রথমবার সে বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্যে মোড়ানো শ্রেয়ার মত নারীকে দেখছে। মেয়েটা মর্ডান রুপে যতটুকু আবেদনময়ী লাগে বাঙালি সাজে ততই মায়াবিনী লাগে। রাজিব পলকহীন তাকিয়ে রইল। শ্রেয়া ভ্রু কুঁচকে একপলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিল। যেন সে পাত্তাই দেয় না তাকে। ব্যাপারটা হজম হলো না রাজিবের। সে শ্রেয়ার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। কেননা জাফর সাহেব গাড়ির মধ্যে কি যেন কাজ করছে।
রাজিব ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘আপনারা কই যাচ্ছেন!’

‘আমার হবু স্বামী আরভীকের বাসায়।’

অনড় হয়ে গেল রাজিবের আচরণ। অস্বাচ্ছন্দ্যের দৃষ্টিপাতে শ্রেয়ার নেত্রপল্লবের দিকে রক্তিম চাহনী নিক্ষেপ করে। শ্রেয়া অসম আচরণে রীতিমত কেঁপে উঠে। রাজিবের দৃষ্টি উপেক্ষা করে তার বাবার গাড়িতে উঠে বসে। তিনি আজ রাজিবকে সঙ্গে নিল না। কেননা সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে আজ অনেকে অনুপস্থিত। রাজিব মনমরা হয়ে গাড়ির চলে যাওয়া দেখল।
ঠোঁট পাঁকিয়ে বাঁকা হেসে ফোন বের করে কল লিস্ট চেক করে সে। কাঙ্ক্ষিত পুরুষের নাম্বার পেয়ে কল দেয়। অপরপ্রান্তে দুবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। দু’ব্যক্তি নিশ্চুপ পারিপার্শ্বিক অক্ষমতায়। অপরপ্রান্তের ব্যক্তি তার কার্যের নৈমিত্তিক সময় বিলম্ব না করে জিজ্ঞেস করে।

‘জরুরি তলব আছে কি!’

‘বিয়ের পাকাপাকি হবে মনে হচ্ছে!’

‘দিজ ইজ জাস্ট এ ড্রিম!’

‘থ্যাংকস!’

‘নো থ্যাংকিউ !’

কথাটি বলে অপরপ্রান্তের ব্যক্তি তৃপ্তির হাসি দেয়। কলটি কেটে রেখে দেয়।
রাজিব তার ঠোঁটের কোণায় শয়তানি হাসি বজায় রেখে ফোনটি পকেটে গুঁজে নেই। মনে মনে জাফর সাহেবের নীতি ভেবে বলে,

‘সে অপছন্দ হলেও মিত্র হিসেবে মন্দ নয়।’

চলবে….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here