#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৯
,
,
—চলুন তো ঘরে চলুন আপনি।
ইরার কথায় বাধ্য ছেলের মতো ঘরে ঢোকে শৌখিন।
ইরা রুমে ঢুকে লাইট অন করে।
শৌখিনকে টেনে খাটে বসায়।
সেন্টার টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে শৌখিনের সামনে ধরে।
শৌখিন পানি খায়।পুরো গ্লাস শেষ করে।
ইরা বলে,
—তাহলে আপনি ঘুমিয়ে পরুন।আমি যাই?
যেতে গিয়েও পারেনা ইরা।তার হাতে টান লাগে।
শৌখিন পেছন থেকে হাত টেনে ধরেছে।
ইরা বেশ অবাক হয়।আজ শৌখিনকে তার কাছে অন্যরকম লাগে।
কেমন অচেনা অচেনা।
এমন অদ্ভুত ব্যবহার শৌখিন আগে কখনো করেনি।
ইরা হাতের দিকে তাকায়।শৌখিনও তার দৃষ্টির অনুসরণ করে তাকায়।ফট করে হাত ছেড়ে দেয় সে।
ভেতরে অপরাধবোধ তৈরী হয়।
কি হচ্ছে তার সাথে সে জানেনা।কিচ্ছু জানেনা।
শুধু জানে তার পাগল পাগল লাগছে।
ইরা বলে ওঠে,
—কিছু বলবেন?
শৌখিন আমতাআমতা করে।সে কি কারনে ইরার হাত ধরেছে সে জানেনা।
তবু এখন তো কিছু একটা বলতে হবে?কি বলবে মনে মনে খোজে।
তবে তেমন কিছুই পায়না।
শৌখিনকে চুপ থাকতে দেখে ইরা আবার বলে,
—আপনি কি আরও পানি খাবেন?
–ওহ,হ্যা হ্যা।
ইরা আরও এক গ্লাস পানি ঢেলে শৌখিনের সামনে এগিয়ে ধরে।
শৌখিন গ্লাস ধরতে যায় কিন্তু তার আগেই ইরা গ্লাস ফিরিয়ে আনে।
হাতের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকায়।বলে,
—আপনার হাতে ব্যান্ডেজ কেনো?
শৌখিন শুকনো কেশে ওঠে।
সে এতক্ষণ যাবত হাতটা লুকিয়ে রাখছিলো ইরার নজর থেকে।কিন্তু এখন আর পারলোনা।
বলে,
—কেটে গেছে।
—কিভাবে?
শৌখিন মাথা চুলকায়।তার হাত কেটেছে নয়নকে মারতে গিয়ে।
ইরার সাথে অসভ্যতামো করার শিক্ষা দিতে গিয়ে বেধড়ক মেরেছে নয়নকে।
তবুও ভেতরের জ্বলুনি কমছিলোনা।
মারামারি করতে গিয়ে হাতে সামান্য লেগেছে তার।
কিন্তু সেকথা তো আর ইরাকে বলা যায়না।
সে আমতাআমতা করে।
ইরা সেদিকে একবার তাকিয়ে পাশের ড্রয়ার থেকে মলম বের করে।
শৌখিনের হাত টেনে কোলের উপর আনে।
হাতে যেন-তেন ভাবে জরানো কাপড়টা খুলে যত্ন সহকারে মলম লাগায়।
মলম লাগানোর মাঝেমাঝে ফু দেয়।
শৌখিন বিমুগ্ধ নয়নে পলকহীন ভাবে ইরাকে দেখে।
ছোটছোট যে চুলগুলো ইরার কপালে এসে চোখ ঢেকে দিচ্ছে সেগুলো ফু দিয়ে সরায় সে।
ইরা চমকে ওঠে।
অবাক নয়নে শৌখিনকে দেখে।
শৌখিনও নিজের কর্মকালাপে অবাক হয়।
মাথা নিচু করে বসে থাকে।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে।
টেবিলের ওপর ফোন রাখা,সেখানে বড়বড় করে লেখা ভেসে ওঠে,
মাই লাভ কলিং।
ইরার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে।
অজান্তেই চোখে অশ্রুরা ভিড় করতে শুরু করে।শৌখিন কাউকে ভালবাসে?অন্য কাউকে?তার জন্যই সে ইরাকে বউ হিসেবে মানেনি।
তাকেই বউ করবে বলে?তার সাথেই কি এতক্ষণ যাবত কথা বলছিলো?
ইরার বিশ্বাস হতে চায়না।
বুক ভার হয়ে আসে কষ্টে।
সে তাড়াহুড়ো করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
———
শপিংমলে এসে একটুও ভালো লাগছেনা ইরার।তার কেনাকাটা হৈ হুল্লোড় করা পছন্দ না।নিরিবিলি থাকতেই পছন্দ করে সে।
কিন্তু এখানে না এসে উপায় ছিলোনা।শাম্মির বিয়ে উপলক্ষে শপিংয়ে এসেছে সবাই।
সবাই বলতে রিফাত,শৌখিন,শাম্মি, মিতালি আর ইরা।
শাম্মি আর মিতালী ঘুরেঘুরে এটাওটা দেখছে।মাঝেমধ্যে চেন্জিং রুমে গিয়ে একেকটা জামা বদলেও দেখছে।
ইরা চুপচাপ তাদের পিছুপিছু হাটছে।
কাল রাতের পর থেকে তার মন বেশি খারাপ হয়ে আছে।
মনের ভেতর শুধু একটা কথাই বাজছে,শৌখিন অন্যকাউকে ভালবাসে।আর সেটা ইরা নয়।
ভাবনা গুলো যতোবার ইরার মনে আসছে ততোবারই হাউমাউ করে কান্না পাচ্ছে তার।
সে শৌখিনকে ভালবাসে কিনা জানেনা,ভালবাসা কাকে বলে তাও জানেনা।শুধু জানে সে সারাটাজিবন শৌখিনের সাথে থাকতে চায়।সুখ দুঃখে হাতে হাত রেখে জিবন পার করতে চায়।
শৌখিনের সাথে বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হলেও ইরা মন থেকে তাকে স্বামী হিসেবে মানে।
তবে শৌখিন কেনো মানেনা?কেনো ভালবাসেনা?কেনো অন্যকাউকে বউ করার স্বপ্ন দেখে সে?
ইরা সতর্কতার সাথে চোখের কোনে জমে ওঠা জল মুছে ফেলে।
কেউ দেখলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তাকে।
তখন যদি কেউ বলে বসে, ইরা কাঁদছে কেনো?তখন কি উত্তর দেবে সে?
শৌখিন রিফাতের সাথে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঘোরে।রিফাত কথা বলে অনর্গল,শৌখিন সেসব না শুনলেও মাঝেমধ্যে হু হা করে।
তার চোখ ক্ষনে ক্ষনে ইরার দিকে যায়।
মেয়েটার চোখমুখ শুঁকনো দেখাচ্ছে। কিন্তু কেনো?সেকি কোন কারনে আপসেট?
শৌখিনের ভেতরে অস্থিরতা কাজ করে।
ইরার গোমড়া মুখ তার সহ্য হয়না।
মনে হয় মেয়েটা একটু হাসুক।শাম্মি, মিতালির মতো ঘুরেঘরে জামাকাপড় দেখুক,কয়েকটা পছন্দ করুক।
শৌখিন নিজের ভাবনা দেখে নিজেই অবাক হয়।সে কেনো এসব ভাবছে?ইরার মুখ গোমড়া তাতে তার কি?তার কেনো অস্থির লাগছে?
ব্যাপারটাতে প্রচন্ড বিরক্ত হয় শৌখিন।
সে আজকাল নিজেকে বুঝতে পারেনা।
কেমন অচেনা লাগে।
নিজের উপরই যেনো সে কন্ট্রোল হারিয়েছে।
শাম্মির কিনারা থেকে মিতালি ইশারা করে।
তার পাশে যাওয়ার জন্য ডাকে।
শৌখিন এগিয়ে যায়।মিতালী কিছুটা আড়ালে এসে দাড়ায়।
হাতে তার লাল বেনারসি।
সামনে দাড়িয়ে কিছু বলে সে তবে সেকথা শৌখিনের কর্নগোচর হয়না।
চোখ যায় দুরে দাঁড়ানো ইরার ওপর।
শাম্মি একটা লাল বেনারসি মাথায় টেনে ঘোমটা দিয়ে দিয়েছে ইরার।ইরা বিরক্ত হয়ে টেনে খোলার চেষ্টা করছে।
মিতালী বলে,
—কেমন লাগছে আমায়?
শৌখিন আনমনে বলে ওঠে,
—একদম বউ বউ।
মিতালী উচ্ছাসিত হয়।খুশিতে আহ্লাদি গলায় বলে,
—সত্যি?
—হুমমম।
মিতালী লজ্জায় লাল হয়।মাথা নুয়ে আসে। হঠাৎ শৌখিনের দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে আসে তার।
শৌখিনের হাত ধরে ঝাকি দেয়।বলে,
—না দেখেই বলছো কিভাবে?তাকাও তো একবার।
শৌখিনের হুশ ফেরে।
সে থতমত খেয়ে মিতালির দিকে তাকায়।মিথিলাও একটা বেনারসি মাথায় ঘোমটা আকারে দিয়েছে।
কি উচ্ছলভাবে হাসছে সে।
শৌখিনের বুক কেঁপে ওঠে।
সেকি কোনভাবে ঠকাচ্ছে মিতালীকে?ভাবতেই নিজের উপর ঘৃণা হয়।এক অপরাধবোধ এসে ঘিরে ধরে তাকে।
সে কোনভাবেই মিতালীকে ঠকাতে পারেনা।এতোবছরের সম্পর্ক তাদের।এক নিমিষে কি করে ভেঙে যেতে পারে?
শৌখিন নিজের চুল খামচে ধরে।
মিতালি এসে শৌখিনকে ধরে।উদ্দীগ্ন গলায় বলে,
—কি হয়েছে তোমার?
এমন করছো কেনো?
শৌখিন অস্থিরভাবে বলে,
—আমি জানিনা কি হয়েছে আমার, আমি সত্যি জানিনা।
শুধু জানি এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।এভাবে চলতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো।
মিতালি ভয় পায়।সে শৌখিনকে এমন রুপে কখনো দেখেনি।
এগিয়ে এসে চুলে মাথায় হাত বুলায়।কোমল গলায় বলে,
—কি হয়েছে?আমায় বলো।
শৌখিন হুট করে মিতালিকে জড়িয়ে ধরে।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।যেনো তাকে ছাড়া যাবেনা।
আশেপাশে তাকিয়ে আবার ছেড়ে দেয়।
বলে,
—আমি খুব শীঘ্রই মাকে তোমার কথা বলবো।
খুব তাড়াতাড়ি আমরা বিয়ে করবো।
এটাই আমার সমস্যার সমাধান।তাছাড়া আর কোন উপায় নেই।
মিতালি খুশি হয় খুব।যদিও শৌখিনের এমন ব্যবহারে সে অবাক হয়েছে তবুও তার খুশি খুশি লাগে।
এতোবছরের ভালবাসার একটা পরিনতি হবে জেনে সে লাফিয়ে ওঠে।
খুশিতে আত্মহারা হয়।
তবে দুরে দাঁড়িয়ে কারো মন ভাঙা নিরব আর্তনাদে ভারী হয় পরিবেশ।
শৌখিন আর মিতালীকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখে ইরার পৃথিবী থমকে দাড়ায়।
যা বোঝার বুঝে ফেলে সে।
শৌখিনের ভালবাসার মানুষটা যে মিতালী এ ব্যাপারে বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়না তার।
নিজের স্বামীকে অন্যকোন মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ দেখলে কারনা বুক কাপে?কার না জিবন অর্থহীন লাগে?
মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় ইরা।সে শৌখিনের জিবন থেকে সরে যাবে।শৌখিন আর মিতালীর মাঝে কাটা হয়ে থাকবেনা সে।শৌখিনের প্রতি তার একতরফা অনুভূতিকেউ গলা টিপে মারবে।যে মানুষটা তার নয়,কখনো হবেওনা,তার প্রতি অনুভূতি পুষে রাখা বোকামি। ইরা বোকা হতে চায়না।
শৌখিনকে মনে প্রানে ভোলার চেষ্টায় উঠেপড়ে লাগে সে।
শাম্মি আর রিফাত অন্যপাশে কেনাকাটায় মত্ত। তারা ইরা বা শৌখিনের জিবনের উথান পতন সম্পর্কে কিছু জানেইনা।
,
,
চলবে…..
(পর্বটা ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। আজ গল্প লেখার সময় পায়নি।তবু তাড়াহুড়ো করে এতটুকু লিখতে পেরেছি।ব্যাক্তিগত জিবনে ব্যস্ততা এসে ভিড় করেছে।তবু চেষ্টা করবো নিয়মিত গল্প দেওয়ার।আর হ্যা, প্রত্যেকের কমেন্টই আমি পড়ি।আমার মতো সাধারন এক মানুষকে এতোটা ভালবাসা দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।ভালবাসা রইলো।)