পথে হলো দেরি পর্ব ১০

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১০

,
,
সকালে সোফায় বসে থাকে ইরা।তার ভালোলাগেনা।ভগ্ন হৃদয়ের ব্যাথায় সে গুড়িয়ে পরেছে।সারারাত তার ঘুম হয়নি।খাটের এদিকওদিক ছটফট করেছে।শুধু মনে হয়েছে সে শৌখিন আর মিতালীর মাঝে এসে গেছে।শৌখিনকে ভুলে যেতে হবে।তাকে নিজের মতো করে জিবনটা গড়তে দিতে হবে।
আর ইরা?তার নিজের কি হবে?
ইরা নিজের কথা ভাবতেই হেসে ওঠে।
তার নিজের আবার জিবন আছে নাকি?তার আবার চাওয়া পাওয়া?
রেহেনা বেগম সিড়ি বেয়ে নিচে নামেন।
ইরাকে একা একা হাসতে দেখে অবাক নয়নে এগিয়ে আসেন।
বলেন,

—একা একা হাসছিস কেনো ইরা?

ইরা চুপ করে যায়।মুখ স্বাভাবিক করে।তার মনের ভেতরের বয়ে চলা ঝড়ের প্রভাব সে ফুপুর উপর পরতে দিতে চায়না।ফুপু এমনিতেও অসুস্থ। কম টেনশন তো করেননা তিনি।
এরমাঝে এসব বিষয় জানলে আরও অসুস্থ হয়ে পরবেন।
কি দরকার তাকে চিন্তায় ফেলার।তারচেয়ে যেমন হচ্ছে হোকনা।ইরা নিজের জিবন নিয়ে তো আর কিছু ভাবেনা।
ফুপুর দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে,

—তেমন কিছু না ফুপু।একটা মজার বিষয় মনে পরলো তাই হাসি পেয়ে গেলো।
তারআগে বলোতো, এতো সকালে তুমি নিচে নামলে কেনো?কিছু দরকার তোমার?

রেহেনা বেগম ইতস্তত করেন।বলেন,
–না মানে একটু চা নিতে এসেছিলাম।

ইরার চোখ আপনাআপনি দেয়ালে টানানো ঘরির দিকে যায়।মাথায় হাত দিয়ে বসে সে।
ভাবনা চিন্তায় এতোটাই মশগুল ছিলো সে যে সময়ের কথা মনেই ছিলো।
বাড়ির সবার জন্য চা না করে এখানে বসে বসে চিন্তা করছে সে?
একলাফে সোফা থেকে উঠে বলে ওঠে,
—আমার একদম মনে ছিলোনা ফুপু।তুমি একটু বসো আমি এক্ষুনি চা করে আনছি।

রেহেনা বেগম বাধা দেন।বলেন,

—এতো ব্যাস্ত হোসনা তো।একটু পরেই না হয় যাস,
এখন আমার পাশে একটু বোস তো।

কথাটা বলেই ইরার হাত টেনে তিনি পাশে বসান।কোমল গলায় বলেন,

—কদিন ধরে তোর মুখটা ওমন ভার দেখাচ্ছে কেনো রে?

ইরা মাথা নিচু করে থাকে।কি বলবে বুঝতে পারেনা।

রেহেনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
–নয়নের ব্যাপারটায় খুব ভয় পেয়েছিলি?তাই তোর মন খারাপ? সেকথা এখনো ভুলতে পারছিস না?

ইরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
ফুপু যা বুঝেছে তাতেই সম্মতি জানায়।
রেহেনা বেগম সস্নেহে ইরার মাথায় হাত বুলায়।
বলে,

—শৌখিন আজকাল ভালো মতো কথা বলে তাইনা?

ইরার থেকে কোন প্রতুত্তর না পেয়ে নিজের মতোই বলেন,
–যাক এতোদিনে গাধাটার হয়তো সুবুদ্ধি হচ্ছে। দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
শৌখিন ঠিক মেনে নেবে তোকে।
তখন আমিও নিশ্চিন্ত হবো।কি যে টেনশনে থাকিনা আমি!শুধু মনে হয় আমার ওই বিয়ের সিদ্ধান্তটার জন্য হয়তো তোদের জিবনটা নষ্ট করে ফেললাম।নিজেকে দোষী মনে হয় সবসময়।
আর যাই হোক,অপরাধবোধ নিয়ে কি শান্তিতে থাকা যায় বল?

ইরার কান্না পায়।কেনো পায় জানেনা।তবে ফুপুর নজর থেকে চোখের জল লুকানোর জন্য সে ফুপুকে হুট করে জড়িয়ে ধরে।
বুকে মাথা রেখে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়।
রেহেনা বেগম মাথায় হাত বুলান।
তিনি বোঝেন,মেয়েটা কোন বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছে,কোন কথা তাকে ভেতরে ভেতরে পু্রিয়ে মারছে।
কিন্তু তা সে প্রকাশ করতে পারছেনা।
মা না হোক তবুও মায়েরই তো মতো।
মেয়ের মনের কথা মুখ দেখেই বোঝার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে যে মায়েদের।

💮💮💮
,

,
শৌখিনের রুমে ঢোকার আগে বেশ কয়েকবার দরজায় টোকা দেয় ইরা।তবে শৌখিনের কোন সারা শব্দ পাওয়া যায়না।
ইরা সাবধানে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে।
ঘর অন্ধকার করে ঘুমাচ্ছে শৌখিন।
কাথা মুড়ি দেওয়া।
ইরা পা টিপেটিপে হাটে।প্রানপনে চেষ্টা করে যাতে আওয়াজ না হয়।
সে শৌখিনের ঘুম ভাঙাতে চায়না।
শৌখিনের মুখোমুখি ও হতে চায়না।
নেহাৎ ফুপু জোর করে পাঠালো তাই এ ঘরে আসতে হলো।
নয়তো কক্ষনো এ মুখো হতোনা ইরা।
সে ঠিক করেছে এখন থেকে শৌখিনের সামনে পরবেনা।তাকে এড়িয়ে চলবে।
সাবধানে সেন্টার টেবিলে চায়ের কাপ রেকে আবার উল্টো পথে হাটা শুরু করে সে।
খাটের দিকে নজর দিয়ে সামনে এগোয়।
হঠাৎ দড়াম করে গুতো লাগে তার।
পেছনে ধপ করে পরে যায়।তবে একা পরেনা।
সামনে হাতড়ে কিছু আকড়ে ধরার চেষ্টা করতেই সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটার জামা আঁকড়ে ধরে।
সেও পরিস্থিতি বুঝে উঠতে না পারায় টাল সামলাতে পারেনা।
দুজনেই মেঝেতে পরে।
ইরার দম আটকে আসে যেনো।
তার উপর আস্ত এক মানুষ পরে আছে যে।
সে দুহাত দিয়ে মানুষটাকে সরানোর চেষ্টা করে।কিন্তু ব্যার্থ হয়।তার মতো চিকনা মানুষের পক্ষে এতোবড় শক্ত সামর্থ ব্যাক্তিকে তোলা সম্ভব নয়।
ইরা শক্তিতে না পেরে চিৎকার করে বলে ওঠে,
—ওরে বাবারে,মরে গেলাম রে।
লোহার মতো শক্ত এক গন্ডার আমার উপর পরে গেছে….

শৌখিন ততক্ষণে উঠে দাড়িয়েছে।
সে কথাটা শোনার সাথে সাথে ইরাকে ছেড়ে সোজা হয়।
রক্ত চক্ষু করে বলে,

—,কি বললি?কি বললি তুই?
আমি লোহার মতো শক্ত? আমি গন্ডার?

ইরা জিভে কামড় দেয়।সে কি জানতো নাকি এটা শৌখিন?জানলে সে কক্ষনো এমন কথা বলতো না।
পরক্ষনেই সে খাটের উপর নজর দেয়।আবার শৌখিনের দিকে তাকায়।ভয়ার্ত গলায় বলে,

—আপনি এখানে?তাহলে খাটে কে?

শৌখিনও ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
–খাটে কে মানে?

বসা থেকে দাড়িয়ে খাটের কাছে এগোয়।কাথা সরিয়ে ইরাকে দেখায়,ওখানে একটা কোলবালিশ।
ইরা বোকা হাসে।
একটুর জন্য সে শৌখিনকেই ভুত ভেবে বসেছিলো।

ইরা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসে।
বলে,

—টেবিলে আপনার চা রেখেছি।

—আচ্ছা।

শৌখিন কিছুক্ষণ মাথা চুলকে ইরাকে পিছু ডাকে।

—ইরা শোন।

–হ্যা বলুন।

শৌখিন আমতাআমতা করে।তবু মনে সাহস আনে।তাকে বলতে হবে।
মিতালীর কথামতো ইরারও বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
যদিও এ ব্যাপারে ভাবলেই শৌখিনের বুক জ্বলছে। ভেতরে দাবানলের শিখা ফুলে ফেপে উঠছে।
তবুও শৌখিন তার সিদ্ধান্তে অনড়।
সে বলে ওঠে,

—তোর কি কাউকে পছন্দ ইরা?

ইরা চোখ ছোট করে।কথাটা তার বোধগম্য হয়না। বলে,

—পছন্দ বলতে?

–না মানে কোন ছেলেকে পছন্দ নাকি?মানে ভালবাসিস কাউকে?

ইরার বুক ধক করে ওঠে।সে ভালবাসবে?কাকে?ভালবাসা বলতে কি বুঝায়,তাইতো জানেনা সে।
শুধু জানে শৌখিন তার স্বামী। তার সুখ দুঃখের অংশীদার সে।
তার পথচলার সাথী।
এই যে সেদিন শৌখিনের হাত কাটা দেখে ভেতরটা ধক করে উঠেছিলো ইরার।শোখিনের সুখের জন্য নিজের সুখকে এক কথায় বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত।
এসব যদি ভালবাসা হয়।তাহলে ইরা ভালবাসে।
সে শৌখিনকে ভালবাসে।কিন্তু এ ভালবাসা যে মূল্যহীন।
একতরফা ভালবাসায় যে শুধু কষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু পাওয়া যায়না।
ইরা তাচ্ছিল্য ভরা হেসে বলে ওঠে,

—আমার মতো মেয়ের আবার ভালবাসা।

কথাটা তীরের মতো ছুটে এসে শৌখিনের বুকে লাগে।
আমার মতো মেয়ে মানে?কি বোঝাতে চাইছে ইরা?
সে বলে,

–তোর মতো মেয়ে মানে?

—মানে আবার কি?এমন চালচুলোহীন অনাথ, অন্যের বাড়ি আশ্রিত মেয়েকে কে ভালবাসবে?

শৌখিন ক্রুদ্ধ হয়।রেগে এগিয়ে এসে ইরার বাহু চেপে ধরে।

—আশ্রিত বলতে কি বুঝাতে চাইছিস তুই?তুই কি এ বাড়িতে আশ্রিত?এটা তোর বাড়ি,তোর স্বামীর বাড়ি।

শেষ কথাটা বলেই থেমে যায় শৌখিন।সে কথার ছলে বলে ফেলেছে কথাটা।
নিজেও হয়তো বুঝতে পারেনি এমন কিছু বলে ফেলবে।
আজকাল কি যে হয়েছে না তার।

ইরাও বুঝতে পারে শৌখিন ভুল করে কথাটা বলেছে।নাহলে যে মানুষ এই বিয়েটাকেই মানেনা সে কি করে এমন কথা বলতে পারে?
তাছাড়া মিতালীর কথাটা তো জানে ইরা।সে তো জানে শৌখিন মিতালিকে এ বাড়ির বউ বানাবে।এটা মিতালীর স্বামীর বাড়ি।তার তো নয়।
ইরা শান্ত গলায় বলে,

—আমি ব্যাথা পাচ্ছি, আমাকে ছাড়ুন।

শৌখিন ফট করে ইরাকে ছেড়ে দাড়ায়।
ইরা সেদিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।মাঝপথে দাড়িয়ে সামনে তাকিয়েই বলে,

—আমি আপনার কথা সিরিয়াস ভাবে নেইনি।আমি জানি আপনি ভুলে কথাটা বলে ফেলেছেন।

কথাটা বলেই সে দাড়ায়না।দ্রুত রুম ছেড়ে বাইরে বেরোয়।

,

💮💮

,

পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে।শাম্মির হাতে মেহেদী পরাচ্ছে তারা।অন্যান্য মেয়েরাও হাতে মেহেদী পরছে।
শাম্মির গায়ে হলুদ আজ।
বিকেলে ছাদে ফাংশন হবে।
সেইসবকিছুর তোড়জোড় চলছে বাড়িতে।
শৌখিন এদিকওদিক ছোটাছুটি করে সবকিছুর তদারকি করছে।
একমিনিট দাড়ানোর মতো সময় তার হাতে নেই।
তাকে সাহায্য করছে রিফাত।
বাড়িতে অলরেডি অনেক মেহমান এসে গেছে।বাড়ি ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে।
সবার কথাবার্তায় মুখোরিত চারিদিক।
ইরাও ছোটাছুটি করছে খুব।
মেহমানদের দেখভালের দায়িত্ব তার ঘারে এসেই বর্তেছে।
শাম্মির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় শাম্মি গলা উঁচিয়ে ডাক দেয়,

—ইরা।
ইরা এগিয়ে আসে।ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মোছে।এতো দৌড়াদৌড়ির ফলে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে সে।

বলে,
–কি হয়েছে?

শাম্মি কপট রাগ দেখায়।মুখ ফুলিয়ে বলে,

—কি হয়েছে মানে?
কাল আমার বিয়ে,তোদের ছেড়ে চলে যাবো,আর আজ থেকেই কিনা তুই আমার থেকে দুরে দুরে থাকছিস?
কোথায় আমার আশেপাশে থাকবি,তা না।

ইরা কৈফিয়তের সুরে বলে,

—রাগ করছিস কেনো?কাজ করছি তো।

—আরে রাখ তোর কাজ।আমার পাশে বোস তো।

ইরার একহাত টেনে পাশে বসায় সে।
মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে,

—এইযে ওকে মেহেদী পরিয়ে দিনতো।

ইরা চমকে উঠে বলে,

—আরে না না।আমি হাতে মেহেদী নেবোনা।

–কেনো কেনো?

–কখনো নেইনি তো।

—আজ নিবি।আমার জন্য নে না একটু।
প্লিজ!

ইরা হেসে ওঠে।বলে,

—ঠিক আছে।

শাম্মিও হাসে।

ইরাকে মেহেদী পরানোর একফাকে শাম্মি ফট করে বলে বসে,

—ওর হাতে এস লিখবেন কিন্তু।

মিতালী পাশে বসে ছিলো।সেও হাতে মেহেদী পরেছে।দুহাত সামনে মেলে ধরে হাত শুকাচ্ছিলো সে।শাম্মির কথায় কপাল কুচকে আসে তার।
বলে,

—এস কেনো?ওর নাম কি এস দিয়ে শুরু?

শাম্মি থতমত খায়।শৌখিনের কথাটা বলতে ইচ্ছে করে খুব।কিন্তু বলতে পারেনা।ভাইয়া ইরা আর তার কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।
সেতো বিয়েটা মানেইনা।
এখন যদি মিতালীকে বলে ফেলে তাহলে শৌখিন নিশ্চয় খুব রেগে যাবে।
শাম্মি ফিচলে হেসে বলে,

—আরে আপু এস দিয়ে তো আমার নাম শুরু হয় তাইনা?আমি ওর এতো কাছের মানুষ, আমার নামতো লিখতেই পারে।

একটু চোখ ছোট করে মিতালীর হাতের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

—কিন্তু তুমি কেনো হাতে এস লিখেছো আপু?
তোমার নাম তো এস দিয়ে নয়?

মিতালী হেসে ওঠে।মুখে লজ্জার আভা দেখা যায়।
বলে,

—আছে একজন এস দিয়ে।

শাম্মি লাফিয়ে ওঠে।এসব বিষয়ে তার আগ্রহ বেশি।বলে,
–ওহ,তাই নাকি আপু?সত্যি?
কে সে?
নাম কি তার?

—নাম বলা যাবেনা।তবে সময় হলে দেখতে পাবে।

—কবে সময় হবে?

মিতালি উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।

—হবে হবে।খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো আমরা।তখন সময় হবে।

কথাগুলো ইরার কানে বিষের মতো লাগে।কেমন গা ঘেমে ওঠে তার।বুকের হৃদ স্পন্দন আটকে আসতে চায়।নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
সে কোনমতে থেমে থেমে কঠোর গলায় বলে,

—আমার হাতে কারো নামের অক্ষর লিখবেন না।

,

,

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here