পূর্ণতা পর্ব ১৩+১৪

#পূর্ণতা🖤
#part_13
#Writer_Megla (মেঘ)

বাইরে নিকষ অন্ধকার। শ্রাবণের আকাশ কোন বাড়ন্ত কিশোরীর অভিমানী মুখের মতোই বিষন্ন,গোমট। এক গাঢ় নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে পুরো আকাশটাকে। এই স্তব্ধতার দেয়াল ভেদ করে মাঝে মাঝেই বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পূর্ণতা নিঃশব্দে শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসলো। ঐ নিস্তব্ধ আকাশটার মতোই এক গাঢ় নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিচ্ছে তাদের বাড়ির প্রতিটি দেয়াল। সারাদিনের কর্মব্যস্ত প্রতিটি প্রাণ ঐ দূর আকাশের তারাগুলোর মতোই এখন সুখ নিদ্রায় পাড়ি জমিয়েছে। শুধু পূর্ণতার চোখে কোন ঘুম নেই। এই মূহুর্তে তার বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।ছোট বেলায় যখন বিদ্যুৎ চমকাতো পূর্ণতা সবসময় তার বাবাকে জাপটে ধরে তার বুকে মুখ লুকিয়ে থাকতো। আর তার বাবা তাকে পরম নিজের আদরে জড়িয়ে নিত। । আর বাবার বুকে মুখ লুকাতেই যেন তার সব ভয়ডর এক নিমিষেই উবে যেত। এসব বিদ্যুৎ চমকানিতে পূর্ণতা এখন আর ভয় পায় না। সে এখন অনেকক্ষত্রেই ভয় কাটাতে শিখে গেছে। সে ইচ্ছা করে শিখেনি বরং পরিস্থিতি তাকে শিখতে বাধ্য করছে। পাগলা গারদের নিস্তব্ধ রুমে যখন বিদ্যুৎ চমকায় তখন বুকে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা সামান্য অভয় দিতেই কেউ এগিয়ে আসে না। আর কেই বা আসবে? তাদের মধ্যে সেই বোধ শক্তি থাকলে তো!! তবে ভালোবাসার গুরুত্বটা তারা খুব ভালো করেই বুঝে। তবুও তারা নিরুপায়। বদ্ধ লোহার শিকল ভেদ করে পূর্ণতাকে সাহায্য করার মতো সাধ্য তাদের নেই।।

পূর্ণতার এই মুহূর্তে অদ্ভুত একটা ইচ্ছা জাগছে। মালিহার কাছে গল্প শোনার ইচ্ছা। কিন্তু এতো রাতে কোন নবদম্পতির দরজায় কড়া নাড়া কারো উচিতের পর্যায়ে পড়ে না….সেটা তার বয়সী সবাই বুঝতে পারলেও পূর্ণতার অবুঝ মন সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো না। সে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে তন্ময়ের রুমের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু দরজার কাছে আসতেই সে থমকে দাঁড়ালো। তার কেমন জানি ভয় করছে। পূর্ণতা মনে মনে ভাবছে,,,,দরজায় কি টোকা দেব? ভাবি আবার রাগ করবে না তো? ভাবিও যদি বড় আম্মুর মতো হয়!যদি আমাকে মারে!! প্রিয় ভাইয়া আছে তো। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না আমার।।

পূর্ণতা ভয়ে ভয়ে বার কয়েক কড়া নাড়তেই দরজাটা খুলে গেল। সে সানন্দে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখের দিকে তাকালো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মালিহা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে ঘুমুঘুম। মনে হচ্ছে তার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল পূর্ণতা। মালিহা হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
——–“পূর্ণতা তুমি?এতো রাতে এখানে ? কিছু হয়েছে?”

পূর্ণতা উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,
———“আসলে আমার ঘুম আসছিল না তো তাই তোমার কাছে গল্প শুনতে আসছিলাম।”

পূর্ণতার কথা শুনে মূহুর্তেই ভ্রু কুঁচকে এলো মালিহার। তার চোখে মুখে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট। সে খানিকটা উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
———“কিই। গল্প শুনবে মানে? এখন গল্প শুনার সময়? অনেক রাত হয়েছে যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। অন্য দিন গল্প শোনাবো নি। হ্যাঁ?”(হাসার চেষ্টা করে)

পূর্ণতা জেদ ধরা গলায় বললো,
——–“না আমি এখনই গল্প শুনবো।”

——–“প্লীজ পূর্ণতা রুমে যাও এখন।”

——–“না আমি যাবো না। গল্প শুনবো।”(মুখ ফুলিয়ে)

মালিহা খানিকটা রাগ দেখিয়ে বললো,
——–“বলছি তো অন্য দিন শোনাবো।”

পূর্ণতা আর কথা বাড়ালো না। কারণ সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে শুধু শুধু জেদ ধরে কোন লাভ নেই। সবাই তো আর তন্ময় কিংবা তূর্য না….যে তার সব আবদার বিনা বাক্য পূরণ করবে। পূর্ণতা প্রত্যাখিত আর ব্যাথিত হৃদয় নিয়ে নিজের রুমের দিকে হাটা দিল। রুমে আসতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। মাথাটা হঠাত করে কেমন জানি ধপ ধপ করছে। এই মূহুর্তে তার ও একটা ঘুম দরকার। পরম শান্তির ঘুম।।

গোলাপি পর্দার আড়ালে একচিলতে সোনালী রোদ এসে চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল পূর্ণতার। সে পাশের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ১২:৩৩ বাজে। পূর্ণতা কখনো এতো দেরি করে ঘুম থেকে উঠে না। কাল রাতে অনেক রাতে ঘুমিয়েছিল বলেই আজকে ঘুম থেকে উঠেতে তার এতো দেরি হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবলো,,,,এতো বেলা হয়ে গেছে? কিন্তু এখনো কেউ তাকে ডাকেনি কেন? কেউ না ডাকলেও তো তার চাচীর ঠিকই ডাকার কথা। অন্ততঃ কাজ করার জন্য হলেও!!

পূর্ণতা দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ালো। পঁচিশ মিনিটের মাথায় ব্রাশ-ট্রাশ করে একেবারে গোসল শেষ করে ওয়াশ রুম থেকে বের হলো সে। পূর্ণতা আজ গাঢ় লাল রঙের একটা সেলোয়ার কামিজ পড়ছে। তার শ্যাম বর্ণের শরীরের লাল রঙটা দারুন মানিয়েছে। সেলোয়ার কামিজটা কাল রাতে তিথি তাকে দিয়েছে। বলছে,,,,আজকে পড়বি। পূর্ণতা রুমে এসে দেখলো তিথি রুমে এসেছে। একদম সেজেগুজে ফিটফাট। তাকে ওয়াশ রুম থেকে বের হতে দেখেই তিথি বললো,

———“এই পূর্ণতা আমাকে দেখতে কেমন লাগছে রে?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে পূর্ণতা বেশ খানিকটা ভরকে গেল। সে বুঝতে পারছে না কালকে থেকে তিথি তার সাথে এতো ভালো ব্যবহার করছে কেন? তার হলোটা কি? প্রতিনিয়ত তিথির এতো ভালো ব্যবহার পূর্ণতা যেন হজম করতে পারছে না। পূর্ণতা তিথির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,
———“খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে তিথি আপু।”

———“সত্যিই?”

———“হুম।”

———“পূর্ণতা সাজবি? আয় তোকে সাজিয়ে দেই।”

পূর্ণতা বাচ্চাদের মতো করে বললো,
——–“না আমি সাজবো না। আমার গরম লাগবে।”

——–“গরম লাগবে কেন? এই মাত্রই তো গোসল করে এলি। আয় এদিকে।”

পূর্ণতার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও যেতে হলো। সাজতেও হলো। খুব বেশি সাজায়নি….হালকাই সাজিয়েছে। হালকা একটু লিপস্টিক আর কাজল। ব্যস এইটুকুই সাজ। এতেই পূর্ণতাকে বেশ সুন্দর লাগছে। চুল গুলো ভিজা তাই খোলা রেখেছে। সাজ কমপ্লিট করে তিথি পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বললো,
——–“চল এখন আমরা এখন নিচে যাই। বৌভাতের স্টেজের ওখানে।”

সিঁড়ি ভেঙে গার্ডেনের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়ালো তিথি। তাদের থেকে একটু ডিসটেন্সে তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য আজ ব্রাউন রঙের একটা শার্ট আর কালো রঙের একটা জিন্স পড়েছে। তার বাম হাতে দাড়ি ব্রান্ডের ঘড়ি। সিল্কি চুলগুলো আজ স্পাইক করা। তিথি যেন আজ আবার নতুন ভাবে তূর্যর প্রেম পড়ছে। কিন্তু কালকে রাতে যে বিশ্রী ঘটনা ঘটলো…. তার জন্য তূর্যর সামনে অবধি যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না সে। আবার সামনে গেলে তূর্য কিভাবে রিয়েক্ট করবে কে জানে? কিন্তু এই মুহূর্তে তূর্যকে সামনে থেকে দেখার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছে না তিথি। হঠাৎ করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল। তার পর সে পূর্ণতার দিকে খানিকটা ঝুকে এসে তার কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো।

———“পাড়বি তো?” তিথি বললো।

পূর্ণতা “হ্যাঁ পাড়বো” বলেই এক দৌড়ে তূর্যর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তূর্য তখন কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। পূর্ণতাকে এভাবে দৌড়ে দৌড়ে তার দিকে আসতে দেখে সে খানিকটা অবাক হলো। তার পর এক পলক পূর্ণতার তাকিয়ে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে উদ্যেশ্য করে বললো,
———“আমি এখন রাখি। পরে কথা বলবো।”

ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি তার কথার প্রতিত্তরে কি বললো তার পূর্ণতার কাছে বোধগম্য হলো না। শুধু সেকেন্ড কয়েক পরেই কল কেটে যাওয়ার টু টু শব্দ ভেসে এলো পূর্ণতার কানে।

পূর্ণতা সরু চোখে তূর্যর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে এখন কথাটা বলবে নাকি? তার হাজারো ভাবনা-চিন্তার দেয়াল ভেঙে পূর্ণতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তূর্য বলে উঠলো,
———“কি হয়েছে পূর্ণ? এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন? কোন সমস্যা? এনি থিং সিরিয়াস?”

পূর্ণতা হঠাৎ করেই বলে উঠলো,
———–“আমাকে কেমন লাগছে ভালো ভাইয়া?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে বেশ খানিকটা ভরকে গেল তূর্য। কারণ পূর্ণতার কাছ থেকে এরকম কোন প্রশ্ন কোন তার দিনই কাম্য নয়। তূর্য ভাবলেশহীন ভাবে একবার পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

———-“সুন্দর লাগছে। খুব সুন্দর লাগছে।”

তূর্যর কথার প্রতিত্তরে পূর্ণতা মিষ্টি হেসে বললো,
———-“তিথি আপু সাজিয়ে দিয়েছে।”

তূর্য বুঝতে পারছে….পূর্ণতা হঠাৎ করে তাকে এমন প্রশ্ন কেন করলো? তার মানে তিথি তাকে শিখিয়ে দিয়েছে! এতোক্ষণে তিথিও পূর্ণতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তূর্য এভাব পূর্ণতার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একবার তিথির মুখের দিকে তাকালো। তূর্যর সাথে একবার চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। বার বার শুধু কালকে রাতের ঘটনাটা মনে পড়ছে তার। তিথি কালকে সত্যিই খুব বাড়াবাড়ি করছে। এভাবে জোর করে ভালোবাসা হয় না। তিথি চোখ নামিয়ে নিলেও তূর্য ভাবলেশহীন! সে এক দৃষ্টে তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বললো,
———-“খুব সুন্দর সাজিয়েছো তিথি। ভাবছি আমার বিয়েতে তোমাকেই বিউটিশিয়ান হিসাবে হায়ার করবো। রাজি আছো তো?”

তিথি কিছুই বলছে না। তার খুব অস্বস্তি লাগছে। আর কিই বা বলবে সে? যেখানে সে নিজেই তূর্যর বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখে!! কালকে রাতে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটানোর পর আর কিছু বলার মুখ নেই তার। সে শুধু মনে মনে একটা কথাই ভাবছে,,,, তূর্য কি করে তার সাথে এতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে? তার কি একটুও অস্বস্তি হচ্ছে না??

পূর্ণতাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল হৃদয়। তার চোখে পূর্ণতাকে আজকাল আগের থেকে খুব বেশিই সুন্দরী লাগে। সে সুন্দরের পূজারি নয় কামনার পূজারি। তার মতে পূর্ণতার মধ্যে এই কয়েক দিনে বেশ আবেদনময়ী ভাবও ফুটে উঠেছে। গায়ে হলুদের দিন বেশ বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল। এখন আর তেমন লাগে না। পূর্ণতাকে দেখে এই মুহূর্তে এক ধরনের বন্য উন্মাদনা কাজ করছে তার মধ্যে। খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে তাকে। একদম নিজের করে নিতে ইচ্ছে করছে। কিছু এতো লোক চক্ষুর ভীড়ে সেটা মোটেও সম্ভব না। কিন্তু নিজের ইচ্ছাটাকে ও কোন ভাবেই চেপে রাখতে পারছে না সে। সে মনে মনে ভাবলো, অন্য কিছু ভাবতে হবে তাকে। এমন কিছু যাতে সাপ ও মরে আর লাঠি ও ভাঙে না।
#পূর্ণতা🖤
#part_14
#Writer_Megla (মেঘ)

রুমে এসে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে আছে তূর্য। আর একটু হলেই কি করতে যাচ্ছিল সে! তার মধ্যে ও যে এরকম একটা পশু প্রকৃতি লুকিয়ে আছে কোন দিন ভাবতেই পারেনি তূর্য। তার এখন নিজের উপর খুব রাগ লাগছে। নিজেকে একদম শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এই পঁচিশ বছরের জীবনে কম মেয়ের আশেপাশে তো যায়নি সে কিন্তু কখনো তো কোন মেয়ের প্রতি এমন অনুভূতি হয়নি!এমনকি রিশার প্রতিও না কিন্তু পূর্ণতাকে দেখলে তার সবসময় এমন কেন হয়?পূর্ণতা কারো সাথে হেসে কথা বললে তার এতো রাগ লাগে কেন? কথাগুলো ভাবতেই পাশের দেয়ালে সজোরে আঘাত করলো তূর্য। যে করেই হোক নিজের মধ্যকার এই পশু প্রকৃতিটাকে সামলে রাখতে হবে। অন্ততঃ পূর্ণতার ঠোঁটের কোণের ওই মৃদু হাসিটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য হলেও!!

ফ্ল্যাশ ব্যাক…..
তিথি আর পূর্ণতা যখন গার্ডেনে তূর্যর সাথে কথা বলছিল তখন পেছন থেকে হৃদয়ও এসে হাজির হলো তাদের সাথে কথা বলতে। হৃদয়কে দেখেই তূর্যর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। গায়ে হলুদের দিন হৃদয় যেভাবে পূর্ণতার বুকের দিকে তাকিয়ে ছিল তাতে তূর্য বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে হৃদয় কোন ধরনের ছেলে। হৃদয় পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

————-“কি নিয়ে এতো গল্প করছো তোমরা? আমাকে বলবে না?”

তূর্য মনে মনে চাইছিল যেন পূর্ণতা হৃদয়ের সাথে কথা না বলে কিন্তু পূর্ণতা তূর্যর এই অপ্রকাশ্য ইচ্ছাকে পাত্তা না দিয়ে হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে গদ গদ কন্ঠে বলে উঠলো,
————-“কেন বলবো না? তুমি তো ওই ভালো ভাইয়াটা। তাই না?”

এইটুকু বলেই এতোক্ষণ ধরে তারা কি নিয়ে কথা বলছিলো সেই হৃদয়কে কাহিনী বর্ণনা করতে শুরু করলো পূর্ণতা। আর কথার তালে তালে পূর্ণতার সেই ঝংকার তুলা হাসি…. ওই মুহূর্তে প্রচন্ড অসহ্য লাগছিল তূর্যর কাছে। তার পূর্ণতাকে একদম খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করেছিল।

পূর্ণতাদের কথার মাঝখান থেকে হঠাৎ তূর্য তাকে সেখান থেকে টানতে টানতে কোথাও একটা নিয়ে যেতে লাগলো। আকস্মিক এই ঘটনায় পূর্ণতা সহ সবাই অবাক। কিন্তু তূর্যর তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে পূর্ণতা কে টানতে টানতে একটা ফাঁকা ঘরে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। তার পর দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
———–” আজকাল তোমার খুব হাসি বেড়েছে তাই না? দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমার এই হাসি কি করে বন্ধ করতে হয়।”

এই বলে তূর্য পূর্ণতার দিকে এগুতো লাগলো। তূর্যর দুটো চোখে আজ পূর্ণতাকে কাছে পাওয়ার তীব্র নেশায় আচ্ছন্ন। তূর্যর সেই তৃষ্ণার্ত চোখের দিকে একবার তাকিয়ে পূর্ণতা ভয়ে তার চোখ বন্ধ করে নিল। তার পর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
————” ক কি করছো তুমি প্রিয় ভাইয়া? প্লীজ একটু সরে দাড়াও। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

এতোক্ষণে তূর্যর খেয়াল হলো সে কি করতে যাচ্ছিল। সে কোন কথা না বলে পূর্ণতার ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে আসলো। আর পূর্ণতা তখনো সেখানে ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবছে,,,, তূর্য তার সাথে এমন করলো কেন?

তূর্য নিজের রুমে বসে বসে কথাগুলো ভাবছিল এমন সময় আকাশ এসে বললো,
————–“তুই এখানে বসে আছিস? আর আমি তোকে সারা বাড়িতে তন্ন তন্ন খুঁজে মরছি। তাড়াতাড়ি নিচে আয়। তন্ময় তোকে ডাকছে। কি জরুরী কথা আছে।”

তূর্য শান্ত কন্ঠে বললো,
—————“তুই যা আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

————–“আচ্ছা ঠিক আছে।তাড়াতাড়ি আয়।”

🍁
তূযদের বাসায় ফেরার কথা ছিল আরো দুই দিন পর কিন্তু তূর্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে কালকে সকালেই তারা চলে যাবে। কাল রাতে এমন একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটার পর তার আর এক মূহুর্ত ও এখানে মন টিকছে না। বড্ড ইনসিকিউর ফিল হচ্ছে। তিথির অস্বস্তিটাও বেশ বুঝতে পারছে সে। গার্ডেনে তখন তিথির অস্বস্তিটা দূর করতেই বিউটিশিয়ানের অফারটা দিয়েছিলো তূর্য কিন্তু হায়! তিথির অস্বস্তি কমার পরিবর্তে আরো একরাশ অস্বস্তি এসে যেন ঘিরে ধরলো তাকে!!
আর দুপুরে তূর্য পূর্ণতার সাথে যেটা করতে যাচ্ছিল সেটা তো যে কারো ধারণার বাইরে। এখানে থাকলে এই ঘটনা আবার ঘটতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে তার চলে যাওয়াই ভালো কিন্তু পূর্ণতাকে তো এভাবে এই জাহান্নামে একা ফেলে যেতে পারে না সে‌।

তন্ময়ের বৌ ভাতের সব কাজ শেষ করে এই মাত্র তার ঘরে ফিরলো তূর্যরা। এই মূহুর্তে তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা সেটা হচ্ছে ‘পূর্ণতা’। সে মনে মনে ভাবছে,,,,পূর্ণতাকে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার কথাটা মামা-মামীকে কিভাবে বলবে সে? আর তারা কি এতো সহজেই রাজি হবে? সেদিন মামা-মামীর সাথে কথা বলে তূর্য যতটা বুঝছে…. তার মনে হচ্ছে এর মাঝে কিছু ঘাপলা আছে। এতো দিন পূর্ণতার চিকিৎসা মোটেও ঠিকঠাক মতো হয়নি। এসব ভাবতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। সে আবারো মনে মনে ভাবলো,,,,এই মুহূর্তেই মামা-মামীকে কথাটা বলা কি ঠিক হবে? নাকি কাল সকালের জন্য অপেক্ষা করবে সে??

তূর্যর জীবনের ‘অপেক্ষা’ শব্দটা বড্ড নির্মম…বড্ড নির্দয়! অপেক্ষারত প্রতিটি প্রহর তার এক বিষাক্ত উন্মাদনার মধ্যে কাটে। শুধু বার বার মনে হয় কবে শেষ হবে অপেক্ষার প্রহর?কবে?? কিন্তু এই মুহূর্তে তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছে পূর্ণতার মলিন মুখটা…. পূর্ণতার ওই উদাসী ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটানোর জন্য এই সামান্য অপেক্ষা তূর্যর কাছে কিছুই না।

পর দিন সকালে তূর্য ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে…. তাদের বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য একেবারে রেডি হয়ে তার রুম থেকে বের হলো। ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখতে পেল তার মামা-মামী, মা সবাই ড্রয়িং রুমেই বসে আছে। সে মনে মনে বেশ খুশি হলো। সে হালকা হেসে বললো,

——–“ভালোই হয়েছে তোমরা সবাই ড্রয়িং রুমেই আছো।”

তূর্যর কথায় মূহুর্তেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার মায়ের। সে হাতে রাখা চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে… তার পর তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
———-“কেন কিছু বললি?”

———-“হুম তোমাদের সবার সাথে আমার একটা ডিশকাশন করার আছে। পূর্ণতার ব্যাপারে….মামা-মামী তোমাদের তো আগেই বলেছিলাম ওর সব ট্রিটমেন্ট দায়িত্ব আমি নিতে চাই। আর তোমরাও তাতে মত দিয়েছিলে। তাই বলছিলাম কি,,,,তোমরা যদি রাজি থাকো তবে আমি ওকে আমাদের সাথে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই। আমাদের বাসায় থেকেই ওর সব ট্রিটমেন্ট হবে। আর চিন্তা করো না ওর সব মেডিকেল রিপোর্ট পাবনা থেকে আমি নিজেই আনিয়ে নেব।”

কথাগুলো শুনে থতমত খেয়ে গেল তূর্যর মামা-মামী। এখন যদি পূর্ণতা তূর্যদের সাথে যায় তাহলে কি হবে? তাদের সব কু-কীর্তি তো নিমিষেই ধরা পড়ে যাবে। তূর্যর মামী আমতা আমতা করে বললো,
———“তুমি চাইলে পূর্ণতাকে তো নিয়েই যেতে পারো কিন্তু….”

তূর্য ভ্রু কুঁচকে বললো,
———“কিন্তু কি মামি?”

———“তূর্য দেখ…তোমার বাবাকে তো তুমি খুব ভালো করেই চিনো। আমাদের সাথে তোমাদের আবার যোগাযোগ শুরু হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমার মনে হয় তোমার বাবা তার সব রাগ অভিমান মন থেকে এখনো মুছে ফেলতে পারেনি। তা না হলে তিনি আমার তন্ময়ের বিয়েতে এলেন‌ না কেন? তাই আমার মনে হয় না তিনি তোমাদের বাড়িতে পূর্ণতার উপস্থিতিটা সে খুব ভালো চোখে দেখবেন কিংবা মেনে নিতে পারবেন।”

তূর্য মুচকি হেসে বললো,
———-“সেটা নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না মামী। আমি নিজে বাবার সাথে কথা বলে নেব।”

———–“দেখ বাবা,,,, একটা কথা বলি কিছু মনে করো না। এতো বছর ধরে তো পূর্ণতার সব দায় ভার আমরাই বহন করে আসছি। কেউ কিন্তু একবার ওর একটা খোঁজও পর্যন্ত নিতে আসেনি।”

———–“মামী সেই জন্য আমরা যথেষ্ট অনুতপ্ত। নিজেদের কর্মব্যস্ততার আড়ালে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম পূর্ণতা নামক ছোট্ট মেয়েটার কথা। কিন্তু এখন যখন সুযোগ পেয়েছি আমার কর্তব্যটা আমি পালন করতে চাই। দরকার পরলে ওকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো তবুও ওকে সুস্থ করে তুলবোই।”

————“সে যাই বলো….আমরা পূর্ণতাকে কারো সাথে ছাড়তে পারবো না। যে যতই আপন জন হোক না কেন আজকালকার যুগে কাউকে এতো সহজে বিশ্বাস করতে নেই। পূর্ণতা কে তোমাদের সাথে পাঠিয়ে পাছে কিছু একটা হয়ে গেলে দোষটা কিন্তু আমাদের ঘাড়েই এসে বর্তাবে। লোকে আমাদেরই ছিঃ ছিঃ করবে। তাই বলছি আমরা পূর্ণতা কে তোমার সাথে কোথাও পাঠাতে পারবো না। তুমি চাইলে মাঝে মাঝে এসে ওকে দেখে যেতে পারো।”

কথাগুলো শুনে তূর্যর খুব রাগ লাগছে। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তার মামী তাকে ঠান্ডা মাথায় অপমান করছেন। তূর্য মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—————“মা তুমি কিছু বলবে না?”

তূর্যর কথা শুনে তিনি শুধু এক পলক ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। আর কিই বা বললে সে? তন্ময়ের মা তো ঠিকই বলছে। সত্যিই তো এতো বছর একবারও পূর্ণতার কোন খোঁজ নিতে আসেনি তারা। আর নিজের স্বামীকেও তিনি খুব ভালো করেই চিনেন। তিনি ভালো করেই জানে যে পূর্ণতার উপস্থিতিটা তার স্বামী কখনোই ভালো চোখে দেখবে না। অযথা পূর্ণতাকে টেনে-হিছড়ে এক জাহান্নাম থেকে আরেক জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। মায়ের নির্বিকার এই রূপ দেখে তূর্যর রাগ যেন আরো দ্বিগুন বেড়ে গেলে। তন্ময় সেটা বুঝতে পেরে তূর্যর কাঁধে হাত রেখে বললো,
————“চিন্তা করিস না তূর্য। আমি তো আছিই। আমি থাকতে আর কেউ আমার বোনের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”

তন্ময়রের কথায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তূর্য। সে জানে তন্ময় যখন তাকে কথা তন্ময় ঠিক রাখবে। সে বেঁচে থাকতে পূর্ণতার আর কোন ক্ষতি তন্ময় হয়ে দিবে না।।

#চলবে…..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আর যে বিষয়গুলো আপনাদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হবে প্লীজ সরাসরি বলবেন।)
#চলবে…..

(আমার মনে হচ্ছে আমরা লেখনীতে আমি আমার পাঠক-পাঠিকাদের মোটেই মুগ্ধ করতে পারছি না। সবাই শুধু ঝোঁকের বসেই গল্পটা পড়ছে। এক মূহুর্তের জন্য ও গল্পের ভাঁজে হারিয়ে যেতে পারেনি কেউ। তাইতো সবার রিয়েকশন এমন শূন্য। কোন গঠন মূলক কমেন্ট নেই। সবাই শুধু Nice,Next এর উপরেই আছে। আসলে দোষটা আমারই। এটা আমারই ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দেয়ালে আড়ষ্ট হয়ে গল্প মাঝে মাঝে গল্প লিখার ইচ্ছাটাই উবে যায়। এনি ওয়ে কালকে গল্প না দেওয়ার জন্য সরি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here