#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১৬তম পর্ব |
শীতের সকালে একটু রোদ পাওয়া মানে অকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। দুইদিন পার হয়ে গিয়েছে। সাদা বিলাই আমার সাথে এই বাসায় আছে কিন্তু আমি সাদা বিলাইয়ের সাথে কথা বলি না। আমার উদ্ভট কথা সে পছন্দ করে তাই এখন কোন কথা বলি না। হু হা কিছুই বলি না। এটা সাদা বিলাইয়ের শাস্তি। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি। আমার এমন নিরব হয়ে যাওয়া যে সাদা বিলাইকে অনেক পোড়াচ্ছে তা সাদা বিলাইয়ের অসহায় মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পারি। কিন্তু আমি তো আমিই! মিসেস ফায়রাজ রাদ, আমার রাগ থাকবে ফায়রাজ রাদের মতোই।
আমার রুমের ব্যালকনিতে রোদের মধ্যে বসে সূর্যের দিকে তাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি। এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বড়ো ভাইয়া মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে বলতো,
” তুবামনি, দিন তারা দেখবি! দিন তারা?” ভাইয়ার কথায় তখন লাফিয়ে বলতাম, ” ভাইয়া দেখাও দেখাও। দিন তারা দেখাও। কেমন হয় দেখতে? সাদা নাকি কালা?
প্রত্যুওরে ভাইয়া হাতে ধরে টেনে ছাদে নিয়ে যেত আর বলতো,” ঐ যে সূর্য্যিমামা দেখেছিস সেখানে দুই থেকে তিন মিনিট তাকিয়ে থাকবি। তারপর যখন চোখ বন্ধ করে আবার খুলে আশেপাশে তাকাবি তখনই দিন তারা দেখতে পাবি।” ভাইয়ার কথামত ঠিকই তখন সূর্যের দিকে তাকাতাম এবং চোখ বন্ধ করে খুলে চোখের সামনে তখন সরষে ফুল দেখতাম। আমার এমন বোকা কান্ড দেখে ভাইয়া হাসতে হাসতে বলতো,
– ওরে আমার ভোলাভালা বুড়ি! কবে বড়ো হবি তুই? তোকে বোকা বানালাম রে পিচ্ছি!
ভাইয়ার কথা শুনে ভাইয়াকে সারাবাড়ি দৌঁড়াতাম।
অতীতের কথা মনে করে মুচকি হাসছি। আমার হাসির মাঝেই সাদা বিলাইয়ের আগমন ঘটে। আমাকে হাসতে দেখে দুষ্টুমির স্বরে বলল,
– কি ম্যাডাম, কি ভেবে ভেবে হাসছেন? আমার আদরগুলি মিস করছো নাকি?
সাদা বিলাইয়ের কথায় বিরক্ত হলাম। সবসময় এই মানুষটা রোমান্টিক মুডে থাকে কীভাবে? আমি তো সাদা বিলাইয়ের সাথে কথা বলি না তাই খুঁজে যাচ্ছি কি দিয়ে এই পঁচা লোকটাকে আঘাত করা যায়। আমার এই অবস্থা দেখে সাদা বিলাই কিটকিটিয়ে হাসে। হাতের পাস্তার বাটি আমার পানে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– হয়েছে জান, কিছু খুঁজতে হবে না। আমি জানি, তুমি আমাকে আঘাত করতে পারবেই না। জানেমান, খাবারটা খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে খেতে?
সাদা বিলাইয়ের কথাতে চোখ গরম করে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। এক চামচ মুখে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। আহা! কি মজা করে রান্না করে আমার সাদা বিলাই। ইচ্ছে হচ্ছে এই রান্নার জন্য সাদা বিলাইকে শব্দ করে চুমু খেতে। মাশাআল্লাহ আমিও এতো ভালো রান্না করতে পারি না। সাদা বিলাইয়ের তারিফ না করে পারলাম না। রাগ, অভিমান একপাশে রেখে সাদা বিলাইয়ের উদ্দেশ্যে বললাম,
– খুব ভালো রান্না করেন তো আপনি? তা আগে কি কোন রেস্টুরেন্টে বাবুর্চি ছিলেন নাকি?
আমার কথা শোনায় সাদা বিদায় হাঁ করে আমার পানে তাকিয়ে রইল। চোখমুখ কুঁচকে আমার উদ্দেশ্যে বলল,
– আয়মান, শুধু তুমি বলে আজ আমাকে এই কথা বলে বেঁচে গেলে। নয়তো এই ফায়রাজ রাদকে এমন নিচু কথা বললে তার শাস্তি ভয়ানক হতো। লাইক সিরিয়াসলি আয়মান! তোমার কি মনে হয় যে, আমি কোন রেস্টুরেন্টের বাবুর্চির কাজ করেছি? এই ফায়রাজ রাদ? কখনোই না।
বিদেশে থাকতে টুকটাক নিজে রান্না করে খেতাম। তাই পারি এজন্য যে তুমি আমাকে বাবুর্চি বলবে এটা ঠিক না আয়মান। এবার এই কথার জন্য কি শাস্তি দিবো বলোতো!
খুব মনোযোগ সহকারে সাদা বিলাইয়ের কথা শুনছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, ভবিষ্যতে সাদা বিলাইকে দিয়ে’ই রান্না করাবো। কিন্তু শেষের কথা শুনে বিষম খেলাম। আমার অবস্থা দেখে সাদা বিলাই পানি আনতে চলে গেল।
——–
সোফার রুমে বসে বসে খবর দেখছি। সাদা বিলাই নিচে বসে আমার পায়ে আলতা দিয়ে দিচ্ছে আজকাল সাদা বিলাই একদম রোমিও হয়ে গিয়েছে সারাক্ষণ আমার সাথে লেপ্টে থাকে যে আমার সহ্য হয় না আবার ভালোও লাগে কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করিনা।
সাদা বিলাইয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে টিভির দিকে মনোযোগ দিলাম। খবরের শিরোনামে দেখাচ্ছে একজন সাংবাদিক মহিলা খবর পড়ছেন,
” শহরে আবারো আতঙ্কের ছাপ। দীর্ঘ পনেরো বছর পর শহরের আশেপাশের জঙ্গী ছদ্মবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেই তথ্য পুলিশ কমিশনার আমাদের এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিককে জানিয়েছেন। গোপন সূত্রে জানা গিয়েছে, জঙ্গিরা দুই তিন জায়গায় বোমা হামলা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট দিন সময় জানা যায়নি। পনেরো বছর আগে সেই নির্মমতা আবারো কি দেখা দিবে শহরে? পুলিশের কমিটি জঙ্গিদের কীভাবে প্রতিহত করা যায় তা নিয়ে কয়েকদফা মিটিং করছেন।
জঙ্গিদের কথা শুনে আমার হাত পা অনবরত কাঁপছে। চোখ বেয়ে অবাধ্য অশ্রুকণা অনবরত ঝড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে কালো অতীত ভেসে ওঠছে বারবার। আমার বাবা, ভাই-বোনদের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠছে। বাচার জন্য প্রত্যেকজনের হাহাকার চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। না আর সহ্য করা যাচ্ছে না। চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছি। আর বলে যাচ্ছি,
“বাবাকে ছেড়ে দাও, ভাইয়া ও ভাইয়া কথা বলো! আপু চোখ খুলো?”
আমার আহাজারি দেখে রাদ চমকে গেল, আমার পাশে বসে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে কিন্তু আমি শান্ত হতে পারছি না। চোখের সামনে প্রিয়জনদের হারানোর যন্ত্রণা ভাসমান হচ্ছে। আমার কান্না থামার কোন ভাবগতি না দেখে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসলো। রাদের এহেন কান্ডে কান্না থেমেছে ঠিকই কিন্তু হিচকি কমছে না।
– কি হয়েছে শুভ্রপরী? ভয় পেয়েছো? আমাকে বলো।
– বা,,বা ভাইয়া আপুই কেউ নেই। সবাইকে ওরা মেরে ফেলেছে সাদা বিলাই। ওরা আবারও ফিরে এসেছে। আপনাকে আর মাকেও মেরে ফেলবে।
– কিছু হবে না শুভ্রপরী, আমি আছি তো। তোমার এই সাদা বিলাই সবকিছু ঠিক করে দিবে। তৈরী হয়ে নাও আমরা আজ বাসায় যাবো। তোমার আম্মুও সেখানে।
সন্ধ্যা নামার আগেই আমরা রওনা হলাম শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
——–
অপরাধী নয় দাঁড়িয়ে আছি শ্বশুর শাশুড়ির সামনে। শ্বশুর বাবা হাতে লাঠি নিয়ে ঠকঠক জমিনে আওয়াজ করছে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য। আমিও ভয় পাচ্ছি। ভীষণ ভয় পাচ্ছি। শ্বশুর বাবার অবস্থা দেখে নিজের বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবাও ছোটবেলায় আমাকে এইভাবে শাসন করত। আমার অপর প্রান্তে আমার মা আর সাদা বিলাই বসি বসে পপকর্ন খাচ্ছে যেন এখানে সিনেমা চলছে আর তাঁরা তা উপভোগ করছে। আমার কর্মের জন্য শাস্তি যে কতজনের কাছ থেকে পেতে হবে উপর ওয়ালা’ই জানেন।
– আর কখনও আমাদির না বলে কোথাও বের হবি?
শ্বশুর বাবা কঠোর কন্ঠস্বরে আমার উদ্দেশ্যে বললেন। আমি মাথা নেড়ে না করছি। আমার মুখ থেকে কথা না শুনে বাবা আবারও ধমক দিলেন,
– মুখে বল? আমি মুখের কথায় বিশ্বাসী। মাথা নাড়ালে বুঝবো কীভাবে।
– আর কখনও না বলে কোথাও যাবো না। এবারের মতো মাফ করে দাও ভুঁড়িওয়ালা চকচকে টাক বাবা।
আমার কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে যাচ্ছেন বাবা। হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বসিয়ে দিলেন নিজের পাশে।
– আর কখনও আমাদের না বলে কোথাও যাবি না মা। আমার কোন মেয়ে নেই। তুই’ই আমার মা তুই’ই আমার মেয়ে। এই ছেলেকে রেখে কোথাও যাবি না। কথা দে!
বাবার কথা শুনে মুচকি হেসে বললাম,
– আর কখনও কোথাও যাবো না বাবা।কিন্তু আমার একটা নালিশ আছে একজনের নামে।
_ কার নামে শুনি?
বাবাকে যেই বললাম নালিশের কথা, অমনিই সাদা বিলাই চোখ রাঙিয়ে আমার পানে তাকিয়ে আছে। ভয় পাই নাই আমি ঐ বদ সাদা বিলাইকে! শ্বশুর বাবার কাছে নালিশ করে দিলাম সাদা বিলাইয়ের নামে,
– বাবা, এই সাদা বিলাই আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। মিথ্যা বলে বিয়ে করেছে। আপনার ছেলে বলে যদি ক্ষমা করে দেন তো আমি ভীষণ রাগ করব। অত্যাচারকারীর অত্যাচারের বিচাই চাই চাই চাই।
আমার কথা শুনে শ্বশুর বাবা মুখ গম্ভীর করে সাদা বিলাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
– রাদ, তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি। যেহেতু অপরাধ করেছ শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। আর তোমার শাস্তি হচ্ছে! আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই আবারও তুবা মায়ের সাথে তোমার বিয়ে হবে। আমি বিশাল ধুমধাম করে আমার ছেলে মেয়ের বিয়ে দিতে চাই। বল রাজি তো!
সাদা বিলাই আমার দিকে দাঁত কেলিয়ে হেসে বাবার কথায় উওর দিলো।
– রাজি মানে বাবা! তোমার এই ছেলে তো দু’পায়ে রাজি এমন মিষ্টি শাস্তি গ্রহন করতে।
বাবা ছেলের কথা শুনে কপাল চাপড়ে সেখান থেকে দুমদাড়াম পা ফেলে উপরে চলে আসলাম। আমার এভাবে আসা দেখে পেছনে সবাই উচ্চস্বরে হাসছে শুনতে পেলাম।
– ইশ আবার বিয়ে হবে বললেই হলো! করব না বিয়ে সাদা বিলাইকে। একদম জমের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো পঁচা লোকটাকে। আবার শ্বশুর বাবা আর তার ছেলে একজোট বেঁধেছে। কথা বলব না কারোর সাথে এই আমি বলে দিলাম।
নিজের রুমের দিকে এগোতে এগোতে বাবা ছেলেকে বকে যাচ্ছি এমন সময় কালো বিলাই সামনে এসে দাঁড়াল। কালো বিলাই বলতে লিজা পিজ্জাকে বুঝিয়েছি। যেদিন থেকে এবাড়িতে এসেছে সেদিন থেকেই আমাদের সুখের সংসারে আগুন ধরেছে।
– চলে এসেছো? আমিতো ভেবেছি আপদ বিদেয় হয়েছে। এখন দেখি লোভী কুকুরের ন্যায় আবারও এসে হাজির হয়েছে আমার রাদকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে।
লিজা পিজ্জার কথা শুনে রাগ হচ্ছে খুব। কিন্তু এখন রাগা যাবে না ঠান্ডা মস্তিষ্কে কাজ করতে হবে। লিজার কথার প্রত্যুওরে হাতের নখ দেখতে দেখতে উওর দিলাম,
” কোনদিনও দেখেছো কালা বিলাই রাস্তা কাঁটলে সুখবর আসতে? দিলে তো আমার রাস্তাটা কেঁটে! চিন্তা করছি কীভাবে এই কালা বিলাইকে জীবন থেকে উচ্ছিষ্ট করতে।”
আমার কথা শুনে লিজা পিজ্জা হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলো। লিজার যাওয়া দেখে বাঁকা হেসে বললাম,
“কালা বিলাই হোক বা সাদা বিলাই হোক,
সব বিলাইকেই টেনে সোজা করার যোগ্যতা রাখে এই তুবা।”
চলবে…….
[