#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|২১তম পর্ব|
– শাশুড়ি আম্মা, ও শাশুড়ি আম্মা।
– কি?
-ঘুমিয়ে গিয়েছ নাকি?
– এই নিয়ে ঊনিশবারের মত জিজ্ঞেস করলি। কিছু বললে বল নয়তো আমাকে ঘুমাতে দে।
সাদা বিলাইয়ের কাক্ষে যাওয়ার জন্য মন উসখুস করছে। না পারছি শাশুড়ি মাকে বলতে না পারছি সাদা বিলাইকে ছাড়া থাকতে। তাই এখন শাশুড়ি মায়ের সাথে বকবক করছি। এই পর্যন্ত কত যে প্রশ্ন করেছি হিসেব নাই। অবশেষে শাশুড়ি মা আমার বিরক্ত হয়ে গেল। কিন্তু তাতে কি মা তো মা’ই হয়। যার কাছে হাজারটা প্রশ্ন করা যায়। শাশুড়ি মায়ের পাশে শুয়ে প্রশ্ন করছিলাম এতক্ষণ কিন্তু এখন যেই প্রশ্নটা করব তা অনেক জরুরী তাই শোয়া থেকে উঠে বসে শাশুড়ি মাকে প্রশ্ন করলাম,
– আচ্ছা শাশুড়ি আম্মা, ভাত যখন বসানো হয় তখন সব চাল একসাথে দেয়া হয় কেন?
আমার প্রশ্ন শুনে শাশুড়ি মা শোয়া থেকে উঠে আমার দিকে ফিরে বসল। শাশুড়ি মার চোখে এখন একশত ডিগ্রি রাগ বিদ্যমান। আমার পানে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
– কারন একসাথে চাল দিলে একসাথে সিদ্ধ হবে আর সিদ্ধ হলেই তোর মত মাথামোটারা তা গিলতে পারবে।
বুঝতে পারলাম, আজ শাশুড়ি মা শ্বশুর আব্বার সাথে ঝগড়া করে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন করা তো শেষ হয়নি। অগত্যা হি হি করে হেসে শাশুড়ি মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম,
– আরে আমার সুন্দরী মা, ঐ ভুঁড়ি ওয়ালা চকচকে টাক মাথার জন্য নিজের মুড খারাপ করছো কেন? আমার আরেকটা কথা আছে শুনো না!
– আচ্ছা বল শুনি।
শাশুড়ি মা যতই বিরক্ত হোক না কেন। আমার শাশুড়ি মা লাক্ষে এক। খুবই ভালো। শাশুড়ি মায়ের অনুমতি পেয়ে দাঁত কেলিয়ে বললাম,
– পানি ফোঁটানোর সময় মানুষ যে কেন চাল একসাথে দেয়! আমি থাকলে পানি ফোঁটার পর এক মুঠো চাল দিতাম এরপর সেই চাল সিদ্ধ হলে আরেক মুঠো। এভাবে করতে করতে ভাত রান্না করতাম। ইশ কত মজা হতো কি বলো শাশুড়ি আম্মা!
হাত,পা, মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলে শাশুড়ি মায়ের পানে তাকালাম। ওমা! আমার শাশুড়ি মা দেখি বোম্বাইমরিচ আকার ধারণ করেছেন। মুখমণ্ডল রক্তিম রং ধারন করেছে। শাশুড়ি মা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কি যেন খুঁজে যাচ্ছেন। শাশুড়ি মায়ের চাহুনি অনুসরণ করে আমিও নজর ঘুরালাম কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। অগত্যা শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
– হে গো সুন্দরী, কি খোঁজো?
শাশুড়ি মা আমার কথায় কপাল চাপড়ে উওর দিলেন,
– তোকে কি দিয়ে মারব তা খুঁজি। বজ্জাত মেয়ে! সারাক্ষণ মাথায় উল্টা পাল্টা প্রশ্ন ঘুরে তাই না? আরে গাঁধী! এক মুঠো চাল সিদ্ধ হওয়ার পর আরেক মুঠো চাল দিলে ঐ চাল ভাত হবে না! খিচুড়ি ভাত হবে! আর সেটা খাবারের যোগ্য হবে কি না সন্দেহ।
বিছানার নিচ থেকে বিছানা শলার ঝাড়ু হাতে নিয়ে মা আমাকে বকছে আর দৌঁড়াচ্ছে। আমি যে আজ উদ্ভট প্রশ্ন করে খুব বিপদে পড়েছি তা এখন বুঝতে পারছি। শাশুড়ি মাকে থামানোর জন্য বললাম,
” ও সুন্দরী!
ক্ষেপো কেন এত কি?
বলেছি আমি আর কতোই বা কি!
তুমি না আমার আদরি!”
আমার ছন্দ শুনে শাশুড়ি মায়ের মাথা ঠান্ডা সবার বদলে আরো গরম হয়ে গেল। মনে মনে শ্বশুর আব্বাকে বকছি কেন এত বছরে সুন্দরী ঠিক করতে পারেনি এই বলে। মা হাতের ঝাড়ু ফেলে বিছানা থেকে বালিশ উঠিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললেন,
– ভেবেছিলাম তুই আমার পক্ষে আছিস। কিন্তু না! বাপের মেয়ে বাপের মতোই। থাক তোরা একজোট হয়ে আমি চললাম রান্নাঘরে।
শাশুড়ি মা হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আর আমি ক্যাবলাকান্তের ন্যায় থম মেরে দাঁড়িয়ে আছি।
গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে আমার ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। ঘরে প্রবেশ করে দেখি দুইভাই মিলে লুডু খেলছে খুব মনোযোগ সহকারে। আমার আগমনের আভাস পেয়ে সাদা বিলাই ছয়ের ঘরে গুটি উঠিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলল,
– আসতে এত দেরি হলো যে আয়মান? মাকে কি করে এসেছো? মা ঠিক আছে তো!
সাদা বিলাইয়ের কথায় কটমট চোখে তাকালাম। আমার এখন ইচ্ছে করছে সাদা বিলাইকে কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখিয়ে কচকচ করে খেয়ে ফেলতে। একে তো আমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সাদা বিলাই নিরীহ প্রাণী সেজে বসেছিল আর এখন রিলেক্সে লুডু খেলছে।
– আপনি জানতেন আমি এই ঘরে আসবো?
– হ্যাঁ অবশ্যই জানতাম! আমার বউয়ের সবকিছুই আমার জানা আছে। যেকোন একটা কান্ড করে এখানে চলে আসবে। এখন বলো তো লক্ষ্মীটি কি আকাম করে এসেছো?
সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে একে একে মায়ের সাথে করা কান্ডগুলো বলতে লাগলাম। আমার কথা শুনে রাদ, হামি লুডু খেলা বাদ দিয়ে হো হা করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে দুইভাই এক পর্যায়ে লুডুর ছকের উপর শুয়ে পড়ল ।আর তাদের খেলা চান্দে উড়ে গেল।
– মিষ্টিপরী, সত্যি তুমি জিনিয়াস। মাকে কি জ্বালানোই না জ্বালালে। মা আর কখনো কোনদিন তোমার কাছে আসবে না।
– আমি জ্বালালাম কোথায়? আমি তো জাস্ট জিজ্ঞেস করেছি আমার মনে যে প্রশ্ন এসেছে তাই। কিন্তু আমার শাশুড়ি মা যে এভাবে ক্ষেপে যাবে তা তো জানতাম না। এখন বালিশ নিয়ে শাশুড়ি মা কোথায় গিয়েছে কে জানে!
সাদা বিলাই আমার হাত ধরে বিছানায় পাশে বসিয়ে বলল,
– মা এখন সঠিক জায়গায় আছে। আমার হামি আর তোমার কাছে পাত্তা না পেয়ে বাবার ঘরে চলে গিয়েছে। চিন্তা করিওনা আজ সারারাত বাবা’ মার এই মান ভাঙ্গাবে। চলো আমরা ঘুমিয়ে যাই।
———–
– পনেরো বছর আগের সেই পুলিশ হামলায় আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে তো কি হয়েছে! আমার প্ল্যান এবার পূরন হবেই। এই সামাদকে আঘাত করার জন্য ঐ মেয়েকে আগে শাস্তি দিবো। ঐ মেয়ের বাবার জন্য আমাদের যেমন লোকসান হয়েছিল ঠিক তেমন ঐ মেয়েটির জন্য আমাদের প্ল্যান ফ্লপ হয়েছিল। ঐ মেয়ে যদি অপারেশনের পরপর বাড়িতে প্রবেন না করতো তো আমি আমার ভাই সাফিকে আহত অবস্থায় বাহিরে নিয়ে আসতে পারতাম। আমরা ভাইটা নিজের গোত্রের ভালোর কথা ভেবে আংটিতে রাখা বিশ পান করে মৃত্যুবরণ করে। আমি ঐ মেয়েকে এবার মেরেই ফেলব।
তিন জঙ্গিদের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। সামাদ নামক লোকটি পনেরো বছর আগে সেদিন তুবা মাথার পেছনে আঘাত করে রাগের বশে। সেদিন গ্রেনেড হামলায় হালকা পায়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল সামাদ।সামাদ ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিল বিধায় তার জন্য এই আঘাত কিছুই ছিল না। সে অতি সহজেই তার ভাই সাফিকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারতো পিছনের দরজা দিয়ে। কিন্তু আমাদের ধারণার মধ্যে এই মেয়েটা এসে আমাদের সকল পরিকল্পনার উপর পানি ঢেলে দেয়। এজন্য তুবার প্রতি আমার ক্ষোভ।
সামাদের কথা শুনে মাসুদ নামের লোকটি এবার বলল,
– গতবার তোমাদের মতো ইডিয়েটদের পাঠিয়ে আমি সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম। আমার পরিকল্পনা আমার সবকিছু তোমাদের না পাঠিয়ে যদি আমি নিজে আসতাম তাহলে এতদিনে পুরো শহর ধ্বংস হয়ে যেত।
মাসুদের কথা শুনে আলফাজ নামক ব্যক্তিটি বলল,
– ঐ দিন তো হাসপাতালে বড় হামলা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সামাদ সেই মেয়েটিকে দেখে ফেলে ৩০৩ নাম্বার কেবিনে। সামাদ উপরে উঠেছিল রোগী সেজে কিন্তু ওই মেয়েটিকে দেখে সামাদ ই তো ছোট বোমা ফাটিয়ে দেয়।
সামাদ নামের লোকটি এবার ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
– ঐ মেয়ের রক্ত দিয়ে আমি গোসল করব । ঐ মেয়েকে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি মারছি আমি ক্ষান্ত হবো না। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন ঐ মেয়েকে খুঁজে বের করবই করব।
তিনজন লোক একসাথে জঘন্য পরিকল্পনা করে যাচ্ছে একসাথে বসে। না জানি রাদ এবং তুবার জীবনে আবার কোন ঝড় চলে আসে।
——–
আজ আমি খুবই ব্যস্ত। খুবই মানে খুবই! কারণ সামনের,সপ্তাহে আমার পরীক্ষা। আমি এখন মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করছি। না সাদা বিলাইয়ের সাথে কথা বলছি না আমি হামিকে ঘরে প্রবেশ করতে দিচ্ছি।
কিডন্যাপ, বিয়ে-সংসার, ভুল বুঝাবুঝি, আহত নিহত হবার চক্করে একদম পড়াশোনা করতে পারিনি। সাদা বিলাই তো বলেই দিয়েছে পরীক্ষায় যদি লাড্ডু মারি তাহলে আমাকে কাজের বেটি রহিমা বানিয়ে ফেলবে। যা আমি চাই না। কারণ আমি মনে করি কাজের বেটি রহিমা হওয়া মানে রিক্সাওয়ালার ঘরে যাওয়া আর আমি আমার সাদি বিলাইকে অনেক ভালোবাসি যার জন্য সাদা বিলাইকে ছেড়ে কোন রিক্সাওয়ালার ঘরে যেতে পারব না। এজন্য মনে প্রানে আপ্রাণ চেষ্টা করছি যেন পরীক্ষার অন্ততপক্ষে পাশ মার্ক আসে।
আমার সেরকম পড়াশোনার মাঝেই আমার শাশুড়ি মা এক গ্লাস দুধ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। দুধ ডিম আমার খুবই অপছন্দ। এক গ্লাস দুধ এখন আমার কাছে এক বালতি পরিমাণ মনে হচ্ছে। শাশুড়ি মায়ের পানে করুন চোখে তাকালে শাশুড়ি মা আমার চেয়েও করুন চোখে আমাকে বলল,
– আমাকে বলে লাভ নেই। রাদকে আমাকে অফিসে যাওয়ার আগে বারবার বলে গিয়েছে যেন তোকে এক গ্লাস দুধ দেই। এখন ঝটপট একগ্লাস দুধ শেষ করে ফেল তো! আমার অনেক কাজ আছে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ তোমরা তো এটা ছাড়া আর কি পারো, তোমার ছেলে আমাকে সারাদিন জ্বালাবে আর এ করবে না সে করবে না বলে যাবে। আর তুমি সারাদিন তোমার ছেলের যা করবে তার মধ্যে সায় দিবে। আমাকে কেউ ভালবাসে না।
শাশুড়ি মাকে পাম দিয়ে যাচ্ছি। আমার শাশুড়ি মা আবার খুবই ইমোশনাল মানুষ। একটু কান্নাকাটি করে কথা বললেই সে গলে মোম হয়ে যাবে। আর তার মেয়ের ব্যাপারে তো আরো বেশি দুর্বল। আমার চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। আমি যদি এখন কান্না করে দেই তাহলে নিশ্চিত শাশুড়ি মা দুধ দূরে নিয়ে চলে যাবে।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল। শাশুড়ি মা কিছু বলবে তার আগেই হামি হাতে ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে আমার টেবিলের উপর সেট করে রাখে। যার ভেতরে সাদা বিলাই চোখ গরম করে আমার পানে তাকিয়ে আছে। মানে সাদা বিলাই ভিডিও কলে আছে আর কি।
– আয়মান দ্রুত গ্লাসের দুধটুকু ফিনিশ করো। আমার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মিটিং এটেন্ড করতে হবে। সো জলদি!
সাদা বিলের কথা শুনে ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে। মা আর হামির পানে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছি। আমার তাকানো দেখে মা আর হামি মাথা নাড়া দিয়ে বলছে যে তারা কিছুই করতে পারবে না।
অগত্যা মুখে গ্লাস কামড় দিয়ে ধরে রেখে টিপে টিপে দুধ পান করছি। আর সাদা বিলাইকে মনে মনে বকে যাচ্ছি আচ্ছা মত,
“সাদা বিলাই একটা গাধা বিলাই,
বকে আমাকে রাত দিন।
ঘাড় মটকে দিবে রাত বিরাতে,
তুবা নামক পরী জ্বীনে।
চলবে……..
[ গঠনমূলক মন্তব্যের আশা করছি। কেমন আছেন সবাই? আস্সালামু আলাইকুম।]