#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_23
#Writer_TanhaTonu
সিদ্রাত আরশিকে খুঁজে পাগল প্রায়।জোরে জোরে আরশিকে আনাচে-কানাচে নাম ধরে ডাকছে কিন্তু আরশির কোনো নাম-চিহ্নও খুঁজে পাচ্ছে না।চোখের অশ্রুকণাগুলোও শুকিয়ে গিয়েছে।ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু কান্না আসছে না আর…
—”কোথায় চলে গেলে তুমি?আমি আর কোথায় খুঁজব?পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি..একদম পাগল।প্লিজ আরশি ফিরে আসো..প্লিজ..আর মারব না তোমায়,,বকবও না…”
সিদ্রাত মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।মাথাটা চেপে ধরে যন্ত্রণায়।কোনো কিছুই ভালো লাগছে না..
—”নাহ আমায় থেমে থাকলে চলবে না।যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে ওকে..”
সিদ্রাত আবারও খুঁজতে লাগল।খুঁজতে খুঁজতে চা বাগান ছেড়ে মাটির রাস্তায় নেমে এলো।হন্ন হয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল।খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পাশের জঙ্গলে চলে গেলো…
মোবাইলের টর্চের আলোয় সিদ্রাত দেখতে পেলো হাঁটু সমান একটা কাটাওয়ালা গাছে হোয়াইট কালার একটা স্কার্ফ আটকে আছে।সিদ্রাত স্কার্ফটা তুলে নিতেই থমকে গেলো।এটা আরশির স্কার্ফ।স্কার্ফের এক জায়গায় রক্ত লেগে আছে।সিদ্রাতের মাথা যেনো শূন্য হয়ে গিয়েছে।ও প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল..যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে আরশিকে…
দৌড়াতে দৌড়াতে এক জায়গায় এসে সিদ্রাত কোনো কিছুর সাথে হোচট খেয়ে পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়।তাকিয়ে দেখে আরশির পার্স ব্যাগ পড়ে আছে।সিদ্রাত সেটা হাতে নিতেই খুব জোরে পেছন থেকে ধাক্কা অনুভব করে।এক জোরা হাত খুব শক্ত করে ওকে ধরে হাঁপাচ্ছে…
সিদ্রাত সাথে সাথে পেছনে ঘুরে এক টানে সেই হাতের মালিককে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় আর উদ্বিগ্ন হয়ে ধরা গলায় বলে…
—”আরশি কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি?তোমার আন্দাজ আছে আমার অবস্থা কি হয়েছিলো তোমায় না পেয়ে?ঠিক আছো তো তুমি?”
আরশি সিদ্রাতকে খামচে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।
সিদ্রাত আরশিকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।আরশি কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেলেছে।কান্নামিশ্রিত গলায় থেমে থেমে বলতে লাগল…
—”স্যা,,র..আমি,, আমি ম, রে যেতাম..ওই লোক আমার সর্বনাশ,,করে ফেলতে,,নিচ্ছিলো..আপনি, কেন আমার কথা শুনেননি..কেন?আমি,,বাঁচতে চাইনা..এই অপবিত্র শরীর,,নিয়ে,,আমি বাঁচতে চাইনা,,,”
সিদ্রাতের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল আরশির কথায়।ও যেনো কোনো কিছু ভাবতে পারছে না।চোয়াল আর হাতের মুঠি শক্ত হয়ে আসছে ওর।আরশিকে আরও গভীরভাবে আকড়ে ধরে।আরশি কান্নার কারণে কথা বলতে পারছে না।সিদ্রাতের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেই চলেছে।কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে আরশি নিজেই এক সময় থেমে যায় কিন্তু হাঁপাতে থাকে হালকা।সিদ্রাত নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে আরশিকে নিজের সাথে মিশিয়ে হেঁটে যেতে থাকে সামনের দিকে।রাতের অন্ধকারে আরশি না দেখলেও প্রকৃতি ঠিকই সিদ্রাতের নিশব্দ কান্না দেখতে পাচ্ছে..
জঙ্গল পেরিয়ে ওরা হেঁটেই রাস্তায় আসে।আরশি শরীরে শক্তি পাচ্ছে না।বারবার যেনো পড়ে যাচ্ছে।সিদ্রাত আরশিকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাস্তার দূর-দূরান্তে তাকিয়ে আছে।নয়টা বিয়াল্লিশ বাজে এখন।শহরে এই সময়টা তেমন রাত না হলেও এই নিস্তব্দ নগরীতে এখন অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না।বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও সিদ্রাত কোনো যানবাহনই পেলো না।আরশি ক্ষীণ কন্ঠে বলল…
—”পা,,নি..”
সিদ্রাতের এখন জোরে জোরে কাঁদতে মন চাচ্ছে।মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।তারপর আবার একটা গাড়িও পাচ্ছে না।পানিও দিতে পারছে না খেতে।সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশির কপালে চুমু খেলো।আরশি তো প্রায় অর্ধ জ্ঞান আর অর্ধ অজ্ঞান..ওর কি আর দুনিয়ার খবর আছে!
হঠাৎ দূর থেকে একটা আলো আসতে দেখায় সিদ্রাতের ঠোঁটের কোণায় খুশির রেখা ফুটে উঠল।আল্লাহর দরবারে শুক্রিয়া আদায় করে ও আরশিকে নিজের সাথে মিশিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে সেই সিয়েঞ্জিওয়ালাকে থামালো…
—”চাচা রোজ ভিউ হোটেল যাবেন?”
সিএঞ্জি ড্রাইভার জবাব দিলো…
—”যাওয়া তো যায়।কিন্তু টাকা বাড়ায় দেয়া লাগবে।এতো রাতে আমি কোনো ট্রিপ দেইনা।যাইতাছিলাম বাইত।তোমাগো দেইখা মনে হইতাছে বিপদে পড়ছ।তয় উইঠা আয়ো”
সিদ্রাত আরশিকে নিয়ে সিএঞ্জিতে উঠে এলো।বিশ মিনিটের মাথায় ওরা হোটেলের সামনে নামল।সিএঞ্জি ড্রাইভারকে দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে সিদ্রাত আরশিকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো।হঠাৎ করে আগে থেকে বুক না করায় রিসিপসনিস্ট রুম দিতে চাচ্ছিলো না।পরে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে রুম বুক করল সিদ্রাত।যেহেতু সবসময় ডেবিট কার্ড পকেটেই থাকে তাই তেমন অসুবিধা হলোনা সিদ্রাতের..
আরশিকে কোলে নিয়েই রুমের ভিতর এসে বেডে শুইয়ে দিলো।আরশি এখনো পুরোপুরি সেন্সলেস হয়নি।তবে যেটুকু সেন্স আছে সেটাকে সেন্স থাকাও বলা চলে না।সিদ্রাত আরশির কপালে গভীরভাবে চুমু এঁকে দিলো।তারপর ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে হোটেলের ডক্টরকে ফোন দিলো।ডক্টর এসে ইঞ্জেশন দিয়ে যায়।সিদ্রাত স্যালাইন লাগানোর কথা বললে ডক্টর সেন্স ফিরলে স্যালাইন খাওয়াতে বলে চলে গেলো।সিদ্রাত রুম লক করে আরশির পাশে এসে বসে দুই হাত এ মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল।এক সময় ঘুমিয়েও গেলো…
মাঝরাতে কেমন যেনো গোঙানোর আওয়াজ পেয়ে সিদ্রাত ধরফরিয়ে উঠে।পাশে তাকিয়ে দেখে আরশি নেই।সিদ্রাত কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।পরে গোঙানোর আওয়াজ ধরে সোফার দিকে তাকাতেই দেখে আরশি সেখানে হাঁটু মুড়ে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে।সিদ্রাত আরশির পাশে গিয়ে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে বসে।সিদ্রাতকে পেয়ে আরশির কান্নার গতি বেড়ে যায়।সিদ্রাত আরশির মুখটা উঁচু করে ধরে চোখের পানিগুলো মুছে দেয়।আরশি সিদ্রাতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।সিদ্রাত আরশির পিঠে হাতের তালু ঘষতে ঘষতে বলে…
—”আরশি প্লিজ কেঁদো না।কাঁদলে কি কিছু ঠিক হবে বলো?প্লিজ এটাকে একটা দুর্স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাওনা লক্ষীটি..আর তুমি চাও বা না চাও..যে তোমার সাথে এমন জঘন্য কাজ করেছে তাকে আমি সর্বোচ্চ শাস্তি দিবো”
আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলল…
—”আপনি উদ্বিগ্ন,,হবেন না..ওই লোক আমার,,রেইপ করতে পারে,,নি কিন্তু চেষ্টা করেছিলো..”
আরশি কান্নার কারণে আরও কিছু বলতে চাইলেও পারল না।কিন্তু আরশির এই একটা লাইন শুনেই সিদ্রাতের চোখে আনন্দ অশ্রু দেখা দিলো।এ যেনো মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কোনোভাবে বেঁচে গেলো।ও শক্ত করে আরশিকে জড়িয়ে ধরল।আরশি কাঁদতে কাঁদতে আরও কিছু বলার চেষ্টা করতে নিলেই সিদ্রাত থামিয়ে দিলো…
—”হুশ কিছু শুনব না এখন।এখন ঘুমাবে।যা শুনার আগামীকাল সকালে।আর একবার যদি কান্না করো তাহলে আমি চলে যাবো অন্য রুমে..”
আরশি সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠল।সিদ্রাত আরশিকে কোলে তুলে নিয়ে আবারও বেডে এনে শুইয়ে দিয়ে আরশির পাশে অর্ধ হেলান দিয়ে শুয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।সিদ্রাতের হাতের কোমল স্পর্শ পেয়ে আরশিকে একসময় ঘুমিয়ে গেলো।সিদ্রাত আরশির সাথে খারাপ কিছু হয়নি ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও ওর মনের মধ্যে কিছু একটা ভেবে আগুন জ্বলে উঠল।সাথে সাথে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর…
_____________
সকালে এগারোটার দিকে সিদ্রাতের ঘুম ভাঙে।রাতে প্রায় চারটার পর ঘুমানোয় সজাগ পায়নি আর।ঘুম ভাঙতেই সিদ্রাত দেখতে পেলো আরশি সিদ্রাতের একটা পা কোল বালিশের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে।সিদ্রাত হেসে ফেলল।সিদ্রাত অর্ধ হেলান দিয়ে শুয়ে থাকায় আরশি মাথা আর সিদ্রাতের পেট এক জায়গায় ছিলো।আর তাই আরশির অসুবিধা হলো না ঘুমের মধ্যেই সিদ্রাতের পা-কে কোল বালিশ বানিয়ে নিতে..
সিদ্রাত মৃদু হেসে খুব সাবধানে আরশির পাশ থেকে সরে এলো।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আরশির মুখের দিকে একবার তাকালো।রাতে না দেখলেও সিদ্রাত এখন ভালো করেই দেখতে পারল আরশির গালে,গলায় আর হাতে আচড়ের দাগ।যেহেতু প্রায় সব হোটেলেই ফার্স্ট এইড বক্স থাকে তাই সিদ্রাত খুঁজে কাবার্ড থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে স্যাভলন দিয়ে আচড়ের জায়গাগুলো ক্লিন করে দিলো।হাতে কয়েক জায়গায় ছোট ছোট ক্ষতও দেখা যাচ্ছে।সিদ্রাত সেগুলো ক্লিন করে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিলো।তারপর আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুম লক করে বেরিয়ে গেলো…
আরও দেড় ঘন্টা পর আরশির ঘুম ভাঙল।ও চোখ খুলে চারপাশে তাকাতেই গতকাল রাতের কথা সব মনে পড়ল।আরশির ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।বেড থেকে উঠে ও পাশে তাকাতেই দেখল একটা শপিং ব্যাগ রাখা।আরশি শপিং ব্যাগটা খুলতেই দেখল একটা লাল কালার কুর্তি আর একটা চিরকুট যেখানে লিখা…”আমি একটা কাজে একটু বাইরে যাচ্ছি।তোমার ঘুম ভেঙে গেলে ফ্রেশ হয়ে এই ড্রেসটা পড়ে নিও।গতকাল থেকেতো এক ড্রেসই পড়ে আছো”
অন্যদিন হলে হয়ত আরশি খুশিতে,,লজ্জায় মরে যেতো।কিন্তু আজ তেমন কিছুই হলো।আরশি কেমন যেনো নির্লিপ্তভাবে চিরকুটটা পড়ে আগের জায়গায় রেখেই ওয়াশরুমে চলে গেলো।এই মূহুর্তে কেউ ওকে দেখলে ভাববে অনুভূতি শূন্য কোনো জীবন্ত লাশ..
আরশি ঝর্ণা অন করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।কাল রাতের কথা মনে পড়ে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার।জীবনের ভয়ংকর একটা রাত!যা হয়ত কখনো ও ভুলতে পারবে না।সারা শরীরে আরশি ঘষে ঘষে সোপ দিতে লাগল।নিজের শরীরের প্রতিই কেন জানি আজ ঘৃণা হচ্ছে..খুব ঘৃণা হচ্ছে আজ শরীরটার উপর।আরশি কাঁদতে কাঁদতে ঝর্ণার নিচে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল…
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_24
#Writer_TanhaTonu
আরশি শাওয়ার শেষ করে রুমে আসতেই দেখে সিদ্রাত বেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।আরশি জর্জেটের লাল উড়নাটা দিয়ে ভালো করে শরীর ঢেকে নিলো।কারণ সোপ এমনভাবে শরীরে ডলেছে যে শরীরটা একদম লাল হয়ে গিয়েছে।আরশি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।সিদ্রাত মোবাইল রেখে আরশির দিকে তাকালো।আরশির এমন অসহায় মুখ দেখে ওর হৃদয়টা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে।তাও মুখে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে আরশির কাছে এগিয়ে গেলো…
—”কখন উঠেছ ঘুম থেকে?”
আরশি এক পলক সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়…
—”কিছুক্ষণ আগে।আপনি জামা পেলেন কোথায়?আর কোথায় গিয়েছিলেন?”
—”ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে পাশের একটা মলে গিয়েছিলাম।তারপর জামাগুলো বাসায় রেখে একটা কাজে গিয়েছিলাম”
আরশি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে…
—”এই শহরে আপনার কাজ?”
সিদ্রাত স্বাভাবিক কন্ঠেই জবাব দেয়…
—”অপরাধীকে তো পানিশমেন্ট দিতে হবে।এমনি এমনি তো আর ছেড়ে দেয়া যায়না।সেই ব্যবস্থা করে এসেছি”
আরশি অবাক হয় সিদ্রাতের কথায়।সিদ্রাতের হঠাৎ চোখ যায় আরশির গলা,হাত অনেকটা লাল হয়ে যায়।সিদ্রাত ক্ষানিকটা অবাক হয়ে বলে…
—”তোমার শরীর এমন লাল কেন?সকালে তো এমন ছিলো না”
আরশি অস্বস্তিতে পড়ে যায়।পরক্ষণেই ওর দু চোখ ফেটে কান্না চলে আসে।ও শব্দ করে কেঁদে উঠে।সিদ্রাত অপ্রস্তুত হয়ে যায়।কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েই বলে…
—”আবার কাঁদছে কেন আরশি?গত রাতটা ভুলে যাওনা।সবার লাইফেই একটা না একটা এক্সিডেন্ট থাকে।আর ওই লোক তার যথাযোগ্য শাস্তি পাচ্ছে।আর আল্লাহর কাছে অনেক শুক্রিয়া যে খারাপ কিছু হয়নি তোমার সাথে”
আরশি দৌড়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।সিদ্রাতের মনে হচ্ছে ওর বুকে কেউ ছুরি চালাচ্ছে।আরশির কান্নায় ওর এতো কষ্ট হবে ও কোনোদিন ভাবতেও পারেনি
সিদ্রাত বিছানায় গিয়ে আরশির কাঁধে হাত রাখে।কিন্তু তাতে আরশির কোনো হেলদুল নেই।ও কেঁদেই যাচ্ছে।সিদ্রাত আরশিকে টেনে তুলে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে।আরশি সিদ্রাতকে আকড়ে ধরে কাঁদতে
থাকে….
—”আরশি এভাবে কেঁদো না।বোকারা কান্না করে.তুমি তো বোকা না..একদম লক্ষী একটা রাজকুমারি।এভাবে কাঁদলে হয়?”
আরশি থেমে থেমে কাঁদছে।কান্না অনেকটা কমে আসলেও থেমে যায় না।সে অবস্থাতেই আরশি বলে…
—”আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে স্যার..অনেক।আপনি বুঝবেন না আমার ভিতরটায় কেমন লাগছে।এতোটা যন্ত্রণা কখনো হয়নি এর আগে..এতো কষ্ট কেন হচ্ছে আমার? জানেন ওই নোংরা লোকটা আমায় কত খারাপ খারাপ কথা বলেছে?আমাকে আল্লাহ এতোটা অসহায় কেন বানিয়ে দিলো স্যার?কেনো এতোটা অসহায় বানিয়ে দিলো যে নিজের নামে এতো জঘন্য কথা শুনতে হয়েছে কিন্তু কিছু করতে পারিনি…আমার শরীরের প্রতি অনেক ঘৃণা হচ্ছে..”
আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলছে কথাগুলো।সিদ্রাত বাকরুদ্ধ হয়ে শুনেই যাচ্ছে।আরশি কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলতে লাগল…
—”জানেন ওই বাজে লোকটা আমার শরীরের আপত্তিকর স্থানগুলো নিয়ে ডিরেক্ট বিশ্রী বিশ্রী কথা বলেছে।আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলতে পারব আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করছিলাম একটা মিরাকেল করতে..আমার রুহটা বের করে নিতে।একটা মেয়ের কাছে যে এরকম বাজে কথা কতটা অপমানজনক আর যন্ত্রণাময়!!
ছোটবেলায় এই লোকটা আমার সাথে জঘন্য কাজ করতে চেয়েছিলো আর এবার তো সব লিমিটই ক্রস করেছে..আমি কি দোষ করেছি বলেন না স্যার..আমার সাথেই কেন এসব হয়?”
আরশি কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।ঠোঁটগুলো কাঁপছে।রাগে সিদ্রাতের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে।ইচ্ছা করছে সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে…
আরশি আরও কিছুক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত হয়ে নিজেই চুপ হয়ে যায়।বিড়াল ছানার মতো চুপটি মেরে সিদ্রাতের বুকে মাথা রেখে বসে থাকে।সিদ্রাত অনেক্ষণ আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।তারপর অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে বলে…
—”আরশিই কিছু খাবে না?ক্ষুধা লাগেনি?দুপুর হয়ে গিয়েছে তো”
আরশি না সূচক মাথা নাড়ায়…
—”না খেলে হবে?সকালেও তো কিছু খাওনি।আসো আমি খাইয়ে দেই”
আরশি কিছু বলে না।আগের মতোই চুপ মেরে বসে থাকে যা বুঝিয়ে দেয় ও খেতে অনিচ্ছুক। সিদ্রাত আবারও বলে…
—”আমিও কিন্তু সকাল থেকে খাইনি।তুমি না খেলে আমিও খাবো না”
আরশি টলমল চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকায়।পরে নাক ফুলিয়ে বলে..
—”খাবো আমি”
সিদ্রাত মুচকি হাসে।তারপর আরশিকে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে ফোন করে অর্ডার দেয় খাবারের।একটু পরই হোটেল বয় খাবার দিয়ে যায়।সিদ্রাত নিজের প্লেটটা বেডসাইড টেবিলে রেখে আরশির প্লেটটা নেয়।ভাত মেখে আরশির মুখের সামনে ধরে।আরশি টলমল চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে থাকে।সিদ্রাতের দিকে তাকায় না।মনে হচ্ছে সিদ্রাতের দিকে তাকালেই চোখ থেকে পানি ঝরবে।সিদ্রাত আরশিকে খাইয়ে দিয়ে আরশির মুখটা মুছে দেয়।তারপর নিজেও খেয়ে নেয়।একটু পর ওয়েটার এসে প্লেটগুলো নিয়ে যায়।আরশি বলে…
—”স্যার..ঢাকার কি খবর?আম্মু-আব্বু কি চিন্তা করছে না?”
—”না।চিন্তা করবে কেন?তুমি তো আমার সাথেই আছো”
আরশি কিছুটা বিব্রতবোধ করে বলে..
—”না..মানে এটা তো তাদের কাছে স্বাভাবিক না।আমাদের তো সবার সাথে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো”
সিদ্রাত হালকা হেসে বলে…
—”ডোন্ট ওয়ারি।আমি গতরাতেই ফোন দিয়ে সবটা সামলে নিয়েছি।বলে দিয়েছি বাস আমাদের দুজনকে রেখে চলে গিয়েছে।তাই আমরা যেতে পারিনি”
আরশি ছোট্ট করে জবাব দেয়…
—”ওহ”
সিদ্রাত মন খারাপ করে বলে…
—”আরশি প্লিজ এভাবে মনমরা হয়ে থেকো না।তোমাকে হাসিতেই মানায়..মন খারাপে না”
আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তারপর বলে..
—”আমরা কবে বাড়ি যাবো স্যার?”
—”বাড়ি যাওয়ার কথা আপাতত ভুলে যাও।এখন বাড়ি যাচ্ছি না।তোমার আপাতত দুই/তিনদিন সম্পূর্ণ রেস্ট নেয়া দরকার।ঢাকা ফিরে গেলে ব্যস্ত জীবন শুরু হয়ে যাবে।সবকিছু মিলে তুমি ধীরে ধীরে একদম ডিপলি ডিপ্রেসড হয়ে যাবে।কিন্তু এখানে থাকলে..প্রকৃতির মাঝে দুই/একদিন থাকলে মনটা রিফ্রেশ হবে”
আরশি তাচ্ছল্যের হাসি হেসে বলে…
—”প্রকৃতির প্রতি এই ভালোবাসাই তো আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো”
সিদ্রাত আরশির হাতের উপর হাত রাখে।আরশি কেঁপে উঠে।অবাক চাহনীতে সিদ্রাতের দিকে তাকায়।সিদ্রাত আরশির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অত্যন্ত কোমল কন্ঠে বলে…
—”লিসেন আরশি..প্রকৃতি কি তোমার শত্রু বলো?প্রকৃতি..আল্লাহর অপার এক সৃষ্টি।আল্লাহ যে কত সুন্দর তা আমরা ধারণা করতে পারিনা।কিন্তু তবুও যখন আমরা আমদের মহান রবের অপার সৃষ্টি দেখি তখন তা আমাদের ভাবায় যেই রবের সৃষ্টি এতো সুন্দর সেই রব না জানি কত সুন্দর!
আমাদের লাইফে অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে।কিন্তু তাতে প্রকৃতির কোনো ভূমিকা থাকে না..তা তো নির্জীব সৃষ্টি।যেমন ধরো বৃষ্টি..বৃষ্টির কারণে অনেক সময় ফসলের অনেক ক্ষতি হয়।তার মানে কি আমরা বৃষ্টিকে ঘৃণা করব?ভুলে যাবো আমাদের ফসল উৎপাদনে বৃষ্টির ভূমিকা?নাহ..লাইফে যাই ঘটুক অলওয়েজ আল্লাহর কাছে শুক্রিয়া আদায় করতে হবে।কজ আল্লাহ চাইলে এর থেকেও খারাপ কিছু আমার সাথে হতে পারত!আর আল্লাহর সৃষ্টি কোনো কিছুকেই খারাপ বলা যাবে না..হোক তা মানুষের সৌন্দর্য অথবা উদ্ভিদ।
তবে মানুষ নিজেদের কর্মের মাধ্যমে অপর মানুষের কাছে খারাপ হয়।এর জন্য অবশ্যই সে খারাপ..
জীবনটা ছোট কিন্তু সহজ না।মাঝপথে যদি তুমি থেমে যাও তাহলে বাকি পথগুলো তোমার জন্য কাটা হয়ে দাঁড়াবে।জীবনটা নরক হয়ে যাবে।অলওয়েজ মনে রাখবে পাস্ট ইজ পাস্ট..তুমি যদি আমার আজকের কথাগুলো মানো,, ফলো করো..তাহলে আমার বিশ্বাস তুমি লাইফে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারবে”
সিদ্রাত এক দমে কথাগুলো বলে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে।আরশি মুগ্ধ নয়নে সিদ্রাতের কথাগুলো শুনেছে।ওর মাথায় এটাই ঢুকে না একটা মানুষ এতো সুন্দর করে কীভাবে বুঝায়!আর কতগুণ ধরা দিবে তার সামনে এই মহান মানুষটির!!
সিদ্রাত আরশির সামনে তুড়ি বাজায়।আরশি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে এসে মৃদু হেসে সিদ্রাতকে থ্যাংক্স বলে।সিদ্রাতও মুচকি হেসে বলে…
—”ডোন্ট মেনশন..তোমার মন ভালো করাটাই আমার লক্ষ্য।তার জন্য এটুকু স্পিচ তো কিছুই না”
আরশির মনে সিদ্রাতের এই দুইলাইনের কথাটাই অন্যরকম অনুভুতি বইয়ে দেয়।অদ্ভুত শিহরণে ছেয়ে যায় মনটা।বিপরীত মানুষটা ভালোনাসে না জানার পরও যখন সে ছোট ছোট কেয়ার করে..তখন ছোট ছোট সেই কেয়ারগুলোই আকাশ সম মনে হয়।আরশিরও তেমনই মনে হচ্ছে।হঠাৎ অদ্ভুত এক ইচ্ছা আরশির মনে ছেকে বসেছে।ইচ্ছা করছে সিদ্রাতকে জড়িয়ে ধরতে…
আরশির ভাবনার মাঝেই সিদ্রাত মুচকি হেসে আবারও বলে…
—”তো ম্যাম মন ভালো হয়েছে?”
আরশি সামান্য হাসি ঝুলিয়ে বলে…
—”হয়ত এতো সহজে ভালো হবে না।তবে অনেক ফ্রেশ লাগছে..হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে”
সিদ্রাত মুচকি হেসে বলে…
—”নো প্রবলেম ম্যাম..আপাতত এটুকুই এনাফ।তবে বিশ্বাস রাখো তোমার মন ভালো না করে আমি কোথাও যাচ্ছি না।আর আজকে আড়াইটার সময় আমরা বের হবো ওকে?প্রকৃতির সানিধ্যে থাকলে মনের ভিতর চেইঞ্জ আসে..”
—”কিন্তু স্যার..আমার ভয় করছে..বের হতে মন চায়না”
—”ভয়কে জয় করতে হবে।তা না হলে দেখা যাবে তুমি কখনো প্রকৃতির মাঝে আসতেই চাইবে না।একসময় প্রকৃতি তোমার জন্য আতঙ্কে পরিণত হবে”
আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সিদ্রাতের ফোন বেজে উঠে।ও ফোনটা রিসিভ করে বারান্দায় চলে যায়…
চলবে…
চলবে..