প্রিয় প্রেমাসক্তা পর্ব -০৫

#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০৫
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
রাঙা গোধূলির চকচকে আলোয় সায়াহ্নের হাতের মুঠোয় থাকা লাল রাঙা কাগজ টা রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে যেন। সাদা দেয়ালের বদ্ধ রুমে লাল রাঙা কাগজ টা যেন রুমের চারকোনে লাল রঙের পসরা বসালো। সায়াহ্ন ভীষণ রকমের আশ্চর্য!
সে কাগজ টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আবারো হাওয়ার তালে দুলতে থাকা পর্দার দিকে তাকালো। না,লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ভারি অদ্ভুত! সায়াহ্ন কৌতুহল দমিয়ে রেখেছে বেশ খানেক সময় পার হলো। বিছানায় রাখা কাগজ টা দমকা হাওয়ায় উড়ে যাবার জন্য ছুটোছুটি করতেই সায়াহ্ন আবারো হাতে তুলে নিলো। লম্বা শ্বাস টেনে কাগজ টা খুলবে কি’না ভাবতে ভাবতেই আনমনে কাগজের ভাজ খুলে চোখের সামনে ধরলো সে। গোটা গোটা অক্ষরে সেখানে সুস্পষ্ট ভাবে লাল কালিতে লেখা,

‘মিস.লাল শাড়িওয়ালীর জন্য লাল রাঙা কাগজে লাল কালীর রক্তিম শুভেচ্ছা বার্তা। কৃষ্ণচূড়ার লালের মতো লালাভ হোক আপনার জীবন। দ্রুত নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে লাল গোলাপ সমেত আমাকে খুজে আপনার পাওনা লাল রাঙা শাড়িটি নিয়ে যাবার বিশেষ অনুরোধ করা হলো।’
ইতি
লাল রঙের শুভেচ্ছা বাহক

চিঠিটা পড়ে সায়াহ্ন কিয়ৎমুহূর্ট ঝিম মেরে বসে রইলো। সে তার পূর্বপাশে লাল রঙের ছড়াছড়ি দেখতে পারছে। লোকটা মস্ত বড় পাগল। এমন ধরণের শুভেচ্ছা বার্তা কেউ লেখতে পারে আজ জানলো সায়াহ্ন। সে মূর্তির ন্যায় চিঠিটা দেখেই চলেছে। এমন ধাঁচের অদ্ভুত চিঠি উনার মতো অদ্ভুত মানুষের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব।
সায়াহ্ন যত্রতত্র ভেবে নিজ মনেই হেসে উঠলো। তবে তার হাসিটা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হবার বদৌলতে মিলিয়ে গেলো বাবাকে বেডের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
জামিল সাহেব মেয়ের এহেন আচরণে বেশ মনঃক্ষুণ্ণ করলেন। তবুও সে মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মান অভিমানের পালা যেন আজ আকাশ ভেঙে ও পড়ছে। মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে চোখ ভেঙে কান্না করে দিলেন জামিল সাহেব। নিঃশব্দ হাসি যতোটা সুন্দর মানায় মুখে তার থেকে বেশি ভয়ানক মনে হয় নিঃশব্দ এই কান্নার।
তবুও জামিল সাহেবের কান্না ওপাশ ফিরেই উপলব্ধি করতে পারলো সায়াহ্ন ।জামিল সাহেব কান্নাভেজা গলায় বললেন,

‘কেন এমন করিস আম্মা?’

সায়াহ্ন উত্তর দিলো না। তার মতো সন্তানের অধিকার নেই বাবা-মায়ের সাথে হেসেখেলে কথা বলার। তার বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে । সেদিন ছাদ থেকে লাফানোর পরেও এতো কষ্ট অনুভব হয় নি যতোটা আজ বাবার করা কান্নাগুলো তাকে দিচ্ছে। তবুও সে পাষাণহৃদয় নিয়ে বলল,

‘আপনি চলে যান এখান থেকে। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।’

সায়াহ্নের প্রত্যুত্তরে জামিল সাহেবের মুখ ভার হয়ে এলো। মেয়ের সাথে দূরত্ব কবে ঘুচবে সে জানে না। তবুও সে হার না মেনে মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘তোমার বাবা তোমাকে কখনো ফেলে যাবে না আফরা। বাবারা কখনো সন্তানকে ফেলে যেতে পারে না।’

‘আপনি যাবেন। এবং আপনি পারবেন।’

সায়াহ্ন মুখ চেপে বলল। জামিল সাহেব হতাশ হলেন। দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই ডাক্তার.আহরার বারণ করলেন আর কিছু বলতে। জামিল সাহেব আহরারের কথা শুনে উঠে গেলেন। ফেলে গেলেন আবারো মেয়েকে। সায়াহ্ন মুখ ঘুরিয়ে আবারো বাবাকে দেখতে না পেয়ে সশব্দে কান্না করে দিয়ে বলল,

‘ওইদিন ও আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে বাবা। আজকেও চলে গেলে। একটু পেছন ফিরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেই তো পারতে বাবা।’

তীব্র কষ্টের বাক্য গুলো ৩০৪ নাম্বার কেবিনের চারদেয়ালে চাপা পড়ে। সায়াহ্ন আবারো পাশ ফিরে শুয়ে রইলো। কেউ নেই….তার আশেপাশে কেউ নেই।

_________________

সন্ধ্যার আলো নিভে যেতেই ঘোর অন্ধকার জাপটে ধরতেই রাওনাফ ঘরে ঢুকলো। গা ঝেড়ে ড্রয়িং রুমে দাঁড়াতেই মায়ের চিৎকার ভেসে এলো রান্নাঘর থেকে। রাওনাফ মায়ের বাড়াবাড়ি রকমের চিল্লাচিল্লি শুনেও উত্তর দিলো না। মায়ের কাছে গিয়ে আচল টেনে মাথা মুছতে মুছতে বলল,

‘এই কেস টা বড্ড জটিল মা।’

‘সারাদিন পাগলের সাথে থেকে থেকে তুমিও জটিল হয়ে যাচ্ছো।’

রাওনাফ মায়ের ত্যাড়া কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠলো। তার পেশাটাকে মা পূর্ব থেকেই একদম না পছন্দের খাতায় এন্ট্রি করে রেখেছে সেটা রাওনাফ জানে। তবুও মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল,

‘এই কেসটা সলভ করতে গেলে তোমার ছেলেকে আরো জটিলতর হতে হবে।’

‘জটিলতর হও আর সহজতর এর আগে খাবার টা খেয়ে নিও।তোমাদের দুই ভাইয়ের কাজ ছাড়া কোনো দিকে খেয়াল নেই।’

‘খেয়াল করার জন্য তুমি আছো তো আম্মা।’ রায়হান ও গা ঝাড়তে ঝাড়তে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো। দুই ছেলেকে এমন কাক ভেজা দেখে উনি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। ছেলেরা কোনোকালেই তার কথা শুনবে বলে মনে হয় না। রাওনাফের থেকে আচল টান দিয়ে নিজ মনে বকতে বকতে রান্না ঘরের উদ্দেশ্য পা বাড়ানোর পূর্বে ঘুরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘তোদের খেয়াল রাখার কাজ আমি আর করতে পারবো না। বিয়ে করে ঘরে বউ আনো। আমি আর এইসবে নেই।’

মায়ের কথা শুনে দুই ভাই সশব্দে হেসে উঠলো। ছেলেদের এমন উদাসীন ভাব রাওনাফের মায়ের রাগ যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো । সে রাগ প্রকাশ করেই রান্না ঘরে গিয়ে কাজের মেয়েটার সাথে অহেতুক চিল্লাচিল্লি করে ক্ষান্ত হলেন
মায়ের নিত্যদিনের এইসব রাগে অভ্যস্ত রাওনাফ আর রায়হান। হাসি থামিয়ে রাওনাফ রাফহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ভাই শাড়িটা এনেছিস?’

রায়হান ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টামির ভঙ্গিতে বলল,

‘মায়ের কথামতো বউ আনতে যাবি বুঝি?’

রাওনাফ স্বভাব সুলভ হাসি হাসলো। রায়হান ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করতেই রাওনাফ হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল,

‘লাল বউ আনবো। সব লালে লালে লালাভ হবে।’

প্রভাতের নম্রতা উষ্ণতা ছড়িতে দিতেই ফোনের আওয়াজে ঘুম কিছুটা ছুটে এলো সায়াহ্নের। ঘুমের রেশ তখনো তীক্ষ্ণ। হসপিটালের ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগতেই বিরক্তি নিয়ে মোবাইল হাতড়ে খুজে পেয়ে চোখ খুললো সে। ফোনের স্ক্রিনে অচেনা নাম্বারের পদাপর্ণ দেখেই ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটাকে গালি দিয়েও ক্ষান্ত হলো না সায়াহ্ন । ফোন ধরেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘সময় জ্ঞান নেই আপনার?এতো ভোরবেলা মানুষ নিজের প্রেমিকাকেও ফোন দেয় না।’

‘আপনি তো আমার বউ। বউকে মানুষ সকাল,সন্ধ্যা,রাত তিন বেলা..উঁহু মিস্টেক দশ বেলাও ফোন দেয়।’

হুট করে এমন একটা উত্তর পাবে সায়াহ্ন কল্পনাতেও ভাবে নি। ঘুম থেকে উঠার ফলপ্রসূতে তার মেজাজ সপ্তম আকাশে উঠে আছে। ফোনের ওপাশের ব্যক্তির রসিকতা সায়াহ্নের পছন্দ হলো না মোটেও। সে গলায় জোর এনে কড়া কিছু কথা শোনাতে উদ্যত হতেই লোকটা আবার বলল,

‘এতো রাগ দেখায় না বউ। রাগ শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। আর বউ আপনার শরীর তো আগে থেকেই ভেঙ্গেচুরে আছে।’

‘ফাজলামো করেন। এই ছেলে এই,কে আপনি?’

‘আপনি আমার বউ হলে আমি আপনার জামাই। সমীকরণ তো এটাই বলে।’

লোকটার কন্ঠে যেন অধিকার বোধ প্রকাশ পাচ্ছে। তবে সায়াহ্নের রাগ আকাশচুম্বী হচ্ছে। সে রাগে কাঁপছে । সকাল সকাল তার মেজাজ খারাপ করার জন্য এই লোকটাকে সামনে পেলে কষে দু’টো থাপ্পড় মারতেও পিছপা হবে না সে। কাল বিকেল থেকে ওই লোকের আজগুবি কথাবার্তা আর একটা উদ্ভট চিঠি তার মস্তিষ্কের প্রতিটা কোণায় বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। আর সকাল সকাল আরেক পাগল এসে তাকে বউ দাবি করছে।
হচ্ছে টা কি তার সাথে! সায়াহ্ন ভাবনার জগৎ এর ইতি ঘটলো তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ করার মাধ্যমে। সে কোনো ভণিতা না করেই বলল,

‘আপনি মিস্টার.আতিক। এম আই রাইট?’

‘পর পুরুষের নাম নেওয়া মস্ত বড় পাপ বউ।’ লোকটা উদাস স্বরে বলল। সায়াহ্নের এবার মেজাজ ক্ষণে ক্ষণে উচ্চপর্যায়ে পৌছে গিয়েছে। রাগের তোড়ে সে কোনো কথা উচ্চারণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে। তবে লোকটা যে আতিক নয় সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝে গেলো সায়াহ্ন । সায়াহ্ন ক্ষিপ্র কন্ঠেই বলল,

‘এই ধরণের ফাজলামোর জন্য আপনার কি ধরণের পরিণতি হতে পারে ধারণা আছে?’

‘পরিণতি যেটাই হোক সমাপ্তিতে আপনাকেই চাই।’

মেঘ মিশ্রিত আকাশে একফালি রৌদ্দুর যেমন উৎফুল্লতা ছড়ায়। তেমনি এই একটা বাক্য সায়াহ্নের মন কুঠরে জমে থাকা মেঘের রাশি গুলোকে নিমিষেই বৃষ্টিস্নাত করাতে সক্ষম হলো। সমস্ত রাগ কিংবা উৎকন্ঠা মিইয়ে গিয়ে বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে কাদার তীব্র ইচ্ছারা উঁকি দিতেই সায়াহ্ন নিজেকে সামলিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। অপর পাশেও পিনপতন নীরবতা। ওইপাশের মানুষ যেন সায়াহ্নের এই রুপ কল্পনার জগৎ-এ নিজ মনে সাজিয়ে হেঁসে উঠলো। যে হাসির শব্দ নেই। নিঃশব্দ যে হাসির দমকে সায়াহ্ন খানেক কেঁপে উঠলো। তার মন বলছে,লোকটা এমন শ্রুতিমধুর বাক্য শোনাক তার সব কলঙ্ক ধুঁয়ে মুছে দিক। তবে বিবেক শাসিয়ে বলছে,

‘সব পুরুষ মানুষ এক। এরা কখনো প্রেমিক হতে পারে না সায়াহ্ন । না পারে মেয়েদের সম্মান দিতে। সব পুরষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ভয়ানক চেহারা। এদের বিশ্বাস করিস না সায়াহ্ন। দিনশেষে তোকে নিঃস্ব করে আবার চলে যাবে।’

সায়াহ্ন বিবেকের দুয়ারে হার মেনে ফোন কান থেকে নামিয়ে কলটা কেটে দিয়ে নাম্বার টা ব্লকলিস্টে ফেলে দিয়ে নিজ মনেই নিজেকে বারবার শাসিয়ে বলল,

‘এদের ভেতরে পশু লুকায়িত রয়েছে তুই কি সেটা ভুলে গিয়েছিস সায়াহ্ন ? এতো সহজে ভুলে গেলি সেই পুরুষ নামক পশুর কথা। যে তোকে আজও শেষ করে দিচ্ছে। ওই একটা দিনের পর থেকে প্রতিনিয়ত মেরে দিচ্ছে। ভুলিস না সায়াহ্ন সব পুরুষ এক। কেউ ভালো হয় না..কেউ না।’

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here