প্রীতিকাহন পর্ব ৩৭

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩৭

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“হ্যাঁ, কারণ বিয়ে করার আগে তো হলুদের ছোঁয়া দেওয়ার রেওয়াজ অনেক আগে থেকেই চলে এসেছে। বর হিসেবে যদি সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তবে কি ভালো হবে?” নবাবের কথা শুনে মিষ্টির মনে পড়ল হলুদ সন্ধ্যা অনুষ্ঠানে যখন মিষ্টি চমকে গিয়ে নবাবকে জিজ্ঞেস করেছিল, “নবাব, তুমি এখানে?” তখন রহস্যে ভরপুর হাসি, ক্লান্ত চাহনি আর শীতল কন্ঠে নবাব জবাব দিয়েছিল, “এলাম, হবু বধূকে হলুদ ছুঁয়ে দিতে।” সেদিন নবাব যে মিষ্টিকে নিজের হবু বধূ দাবী করেছিল তা মিষ্টির একবারের জন্যও মনে হয়নি। কিন্তু এখন নবাবের কথায় স্পষ্টত সেটা বুঝতে পেরে আচম্বিতে রেগে গেল মিষ্টি, “নবাব, তোমার যেই সব বিষয় আমি সাধারণ ঘটনা বলে মনে করে এসেছিলাম, সেসব বিষয় এখন অন্য কারণ হিসেবে দাঁড়াচ্ছে।”

“তো? রাগ করছ কেন তাতে? সেদিন তো মাঝরাতে আমাকে দেখে তোমার মাঝে রাগের সৃষ্টি হয়নি বরং আমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিলে।” বলেই ঠোঁট টিপে হাসল নবাব।

“ধ্যাৎ, তোমার সাথে কথা বলাই বৃথা।” বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে আসা মুখে মিষ্টি চুপ করে বসে রইল। এদিকে মৃদু শব্দে হেসে উঠে নবাব চেয়ারে হেলান দিলো আর মিষ্টিকে শুনিয়ে বলল, “এবার বোধহয় ডায়াবেটিস হয়েই যাবে। এত মিষ্টি কি নেওয়া যায়?” মিষ্টি টুঁশব্দও করলে না, কিন্তু তিরতির করে বেড়ে উঠা রাগের ভিড়ে সেই রাতের ঘটনা চোখের সামনে যেন দেখতে পেল।

ঝাঁড় বাতি, বাঁশের ডালা, কুলা, চালুন, মাটির সরা, ঘড়া, মটকা আর বাহারি ফলের ঝুঁড়ি দিয়ে আয়োজন করা হয়েছে মিষ্টির হলুদ সন্ধ্যা অনুষ্ঠান। বিকেলের পর থেকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেল। নিজের রুমে এসে এবার মিষ্টি একটু নিশ্বাস ফেলার সময় পেল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের সজ্জিত, কিন্তু ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল, “এবারও নবাব এলো না। গতবার দেশের বাইরে ছিল, কিন্তু এবার দেশে থেকেও একটিবারের জন্য এলো না।”

“আপু, চলো শিগগির।” হঠাৎ কারোর কন্ঠ শুনে চমকে উঠল মিষ্টি। পিছন ফিরে রুমের দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো লামিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তবে ওকে বেশ অস্থির লাগছে যেন সকল চিন্তার সাথে কথা বলছে।

ডান কানে থাকা ফুলের গহনা খুলে মিষ্টি লামিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, “এত রাতে কোথায় যাব?”

“প্রশ্ন করো না তো। চলো শিগগির তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।” হাত-পা ছুঁড়ে বেশ তাড়াহুড়ো দেখাচ্ছে লামিয়া।

“মানে?” বুঝতে পারল না মিষ্টি।

“আরে, চলো তো।” বলেই একপ্রকার টানতে টানতে মিষ্টিকে নিয়ে ছাদে চলে এলো লামিয়া, কিন্তু ছাদের গেইটের কাছে এসে বলল, “আপু, তুমি ছাদে যাও।”

“আমি একা যাব?” একটু ভয় পেল মিষ্টি।

“আরে, সারপ্রাইজ তোমার জন্য তো তোমাকেই একা যেতে হবে।”

কয়েক সেকেন্ড ভেবে মিষ্টি নিজের মনের বিরুদ্ধে রাজি হলো, “ঠিক আছে।” মিষ্টি লামিয়াকে জোর না করে অগত্যা পা চালাল। মিষ্টি আজ আটপৌরে শাড়ি পরার মতো করে লাল পেড়ের হলুদ শাড়িটা পড়েছে। গাজরা আর লাল টকটকে গোলাপ দিয়ে বানান ফুলের গহনার সাথে আটপৌরে শাড়ি মিষ্টিকে বাঙালি বধূর প্রকৃত রূপ যেন দান করেছে।

ঝাঁড় বাতির কৃপায় ছাদে কৃত্রিম আলোর কোনো দৈন্য নেই আর সেই আলোকে ধার করে পা টিপে হাঁটতে লাগল মিষ্টি। চোখের সামনেই এক যুবকের পিছন দিকটা দেখতে পেয়ে মিষ্টি বুঝতে পারল, এটাই হয়তো তার সারপ্রাইজ।

সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত এই যুবককে চিনতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে বিধায় মিষ্টি কাশির শব্দ করল। কাশির শব্দে যখন যুবক তার দিকে মুখ করে তাকাল, তখন বিস্ময়ে মিষ্টির চোখের আকারের পরিবর্তন হলো সাথে ঠোঁট প্রসারিত হলো হাসিতে। খুশির সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে মিষ্টি ছুটে এসে যুবককে জিজ্ঞেস করল, “নবাব, তুমি এখানে?”

সামনে পিছনে মাথা নাড়িয়ে বেশ আবেগ জড়ানো কন্ঠে নবাব বললো, “এলাম, হবু বধূকে হলুদ ছুঁয়ে দিতে।” বলেই একটা ডালা হাতে নিলো নবাব রেলিঙের ওপর থেকে। ডালায় মিষ্টি কাঁচা হলুদ বাটা, ফল, কেক এবং মিষ্টি দেখতে পেল। এগুলো ওর অনুষ্ঠানে ছিল কিন্তু নবাব এসব পেল কোথায় সেটাই বুঝতে পারছে না সে। মিষ্টিকে ভাবনাগ্রস্ত দেখে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “এই মিষ্টি, কী ভাবছ?”

ডালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিষ্টি নবাবকে দেখলো আর মৃদু হাসল। ওর থেকে কোনো উত্তরের প্রতীক্ষা না করে নবাব বললো, “এসো, বসি।”

সিমেন্ট দিয়ে তৈরি চেয়ারে পাশাপাশি বসেই মিষ্টি জানতে চাইল, “তুমি তো বললে আসবে না। এলে ঠিকই অথচ কত দেরি করে। এটা কি ঠিক হলো?”

মাথা নিচু করে, আঙুল কাঁচা হলুদ বাটায় গড়িয়ে নবাব বললো, “কী করব? আমি তো এমনই।” মিষ্টি কিছু বলল না। মুখ গোমড়া করে শাড়ির একটা অংশ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলে।

ঘরোয়া সাজে সজ্জিত মিষ্টির মুখপানে তাকিয়ে দেখল নবাব। স্নিগ্ধ ঐ মুখে বিষাদের ছাপ প্রখর হয়ে আছে। নবাব জানে মিষ্টির মুখে লেপ্টে থাকা বিষাদের নাম নবাব। কারণ নবাব যে আসতে চায়নি মিষ্টির হলুদ সন্ধ্যা অনুষ্ঠানে আর সেজন্য হয়তো রাত জেগে মিষ্টি অভিমানী হয়েছিল কাল। ক্ষণে ক্ষণে হয়ত বলে উঠেছিল, “নবাব, তুমি আমার সাথে এমন করতে পারবে? আমার কথা ভাববে না? রাখবে না আমার কথা?” এসব ভেবে আনমনে হেসে উঠল নবাব। নিজের মাঝে হাজারও চিন্তা চাপা দিয়েও হৃদয়ে সুখের ঝড় অনুভব করল সে। আর সেই ঝড়ে টালমাটাল হওয়ার আগে নবাব নরম কন্ঠে ডাকল মিষ্টিকে, “এই মিষ্টি, তোমাকে হলুদ ছুঁয়ে দিই?”

“উঁহু।” বারণ করতে গিয়ে কান্না পেল মিষ্টির। তাই নত চোখে শাড়িতে খেলা করাটা হঠাৎ বেড়ে গেল তার। মিষ্টি খেলার ছলে কান্নাটা আড়াল করতে চাইছে যেন নবাব টের না পায়।

“কেন?”

“জানি না।” এবার মিষ্টির কান্নাটা গলা চেপে ধরতে সেটা কিঞ্চিৎ ভেসে উঠল।

“এই মিষ্টি, আমি তো এসেছি তোমার মন রাখতে। দেবে না আমায় তোমাকে হলুদ ছোঁয়াতে?”

মিষ্টি কান্না চেপে রাখতে ব্যর্থ হলো। তাই কেঁদে কেঁদে বললো, “না, দিবো না। সবসময় নিজের মর্জি মতো চলো। আমার কোনো কথা শুনতে চাও না। একবারও আমার কথা ভাবো না তুমি।”

মিষ্টির চোখের জল নবাবকে ব্যথিত করছে কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে নবাব বললো, “ভাবি না কে বলল? না ভাবলে কি এত রাতে আসতাম বলো?”

হেঁচকি তুলে তুলে মিষ্টি বলল, “তোমাকে কেউ জোর করছে না থাকতে৷ এসে আমাকে তো উদ্ধার করলে। তাই এখন তুমি দিব্যি চলে যেতে পারো। কেউ তোমাকে জোর করবে না, ফোন করে ডাকবে না, তোমাকে…” থেমে গিয়ে নিজের কান্নার সাথে যুদ্ধ করতে লাগল মিষ্টি। এতে নবাব নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। হাঁটুর ওপর থাকা ডালাটা চেয়ারের একপাশে রেখে মিষ্টির দিকে মুখ করে বসল। ডান হাতের যেই আঙুলে কাঁচা হলুদ লেগে আছে, সেই আঙুল ব্যাতিরেকে আলতো করে দুই হাতে মিষ্টির একটা হাত আগলে নিয়ে বলল, “এই মিষ্টি, আমি তো জানি এসব তুমি পারবে না। তাহলে কেন এসব বলে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো?” ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে নবাব আবার বলতে শুরু করল, “আমি এই মাঝরাতে তোমাকে কথা দিলাম মিষ্টি, একদিন তোমার কথা আমি ঠিকই রাখব। সেদিন তোমার কথা রাখতে গিয়ে যদি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়। তবে হাসি মুখে সেটাও মেনে নিবো তবুও অমন করে কেঁদে আমাকে কষ্ট দিও না।”

বেশ কিছুক্ষণ পর মিষ্টির কান্না, কিঞ্চিৎ কমে আসতেই নবাব স্বস্তি পেল৷ মিষ্টির হাত খানিকটা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই হলুদ মিষ্টি, তোমাকে হলুদ ছুঁয়ে দিই?”

চলবে…

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here