#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৪
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“নবাব, নবাব?” পিছন থেকে মিষ্টি নবাবকে ডেকে ডেকে কান্না জুড়ে দিলো কিন্তু অগ্নিমূর্তি ধারণ করা নবাব দাঁড়ালো না একটিবারের জন্য।
মুখে হাত চেপে ক্রন্দনরত মিষ্টি বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। ওর কান্না কেবল বেড়ে চলেছে। তাই বালিশে মুখ গুঁজে ডান হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরলো। অস্ফুটে কন্ঠে বলে উঠলো, “কেন এমন পাগলামি করছো নবাব?”
.
“মিষ্টি এসো আমার সাথে।”
কেঁদে কেঁদে চোখ বুঁজে মিষ্টির পাড়ি দিয়েছিল ঘুমের দেশে। গতকাল থেকে অনাহারে আছে বলে শরীরেও দূর্বল হয়ে পড়েছে। বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল সে। নবাব রুমে এসে ওকে ডেকে তুলতে এবার সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি। নবাবের দিকে দৃষ্টিপাত না করে গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইলো, “কোথায়?”
“কাজি এসেছে।”
কাজির কথা জানতে পেরে গম্ভীর মিষ্টি এবার মূর্তি রূপ ধারণ করলো। ওর মাঝে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “চুপ করে বসে আছো কেন? চলো।”
কাঠ গলায় মিষ্টির জবাব, “বাসায় যাবো আমি।”
আবারও একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলো মিষ্টি আর এতে ক্ষুব্ধ হলো নবাব। মিষ্টির দিকে ঝুঁকে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “বারবার এককথা বলে আমার মাথা খারাপ করো না।”
ফুঁসে উঠলো মিষ্টি, “তাহলে তুমিও এসব বিয়ের কথা বলা বন্ধ করো৷ আমি কস্মিনকালেও তোমাকে বিয়ে করবো না।”
“কেন করবে না? হ্যাঁ? কেন করবে না বিয়ে?” নবাবের গর্জনে যেন চার দেয়াল কেঁপে উঠলো। এতে কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে মিষ্টি ধীর গলায় জবাব দিলো, “কারণ তোমার মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারবো না।” মিষ্টির কথায় উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো নবাব। শরীর দুলিয়ে উঠা হাসি থামিয়ে বললো, “হাসালে আমায় মিষ্টি, হাসালে… মৃত্যু দেখতে পারবে না অথচ মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা একটা জীবন্ত লাশ দেখতে পারবে। বাহ!”
ছলছল নয়নে তাকিয়ে মিষ্টি অনুনয়ের সুরে বললো, “একটু বুঝার চেষ্টা…” হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলো নবাব মিষ্টিকে, “আমার বোধশক্তি এখন অকেজো। তাই বলছি, ভালোয় ভালোয় চলো নয়ত আমি জোর করতে বাধ্য হবো।”
চোখ নামিয়ে চুপ করে রইলো মিষ্টি। নিশ্চুপ মিষ্টির মুখপানে তাকিয়ে নবাব জানতে চাইলো, “যাবে না?”
প্রতুত্তরে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালো মিষ্টি। এতে চোয়াল শক্ত করলো নবাব, “ঠিক আছে।” নবাবের গম্ভীর কন্ঠে মিষ্টি মনে হয়েছিল, নবাব যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করবে। কিন্তু মিষ্টির ভাবনার মাঝে নবাব রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শাড়ির আঁচল পিঠ মুড়িয়ে সামনে টেনে আনলো। চোখ বুঁজে বিছানার কাঠে হেলান দিতে নবাবের কন্ঠ ভেসে এলো, “ভেতরে আসুন। তোরাও আয়।”
নবাব নিজে রুমে প্রবেশ করতে আরও দুইজন ওর সমবয়সী ছেলে রুমে প্রবেশ করলো। সবার পিছনে মওলানার মতো কাউকে দেখতে পেয়ে মিষ্টি আঁতকে উঠলো। টুপি আর পাঞ্জাবি পরহিত মাঝ বয়সী লোকটার হাতে খাতাপত্র দেখে মিষ্টি শতভাগ নিশ্চিত হলো উনি বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে এসেছেন।
বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে নবাব বাকি দুইজন ছেলেদের বললো, “যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো।”
সুঠাম দেহ এবং মুখ ভর্তি দাড়িওয়ালা ছেলেটা বলে উঠলো, “একটু সময় তো লাগবেই। তা কাগজপত্র সব আছে তো?”
“হ্যাঁ, আমি নিয়ে আসছি।” এই বলে নবাব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কাজী সাহেব বিছানার এক কোণে বসে খাতা মেলে কলম চালাতে লাগলেন। এদিকে চোখের সামনে এতোকিছু হতে দেখে স্তম্ভিত মিষ্টি চোখের জল এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে আটকানোর জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
বেশ কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো নবাব। দাড়িওয়ালা ছেলেটার দিকে সব কাগজপত্র বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “নিলয়, এই নেয়।”
নিলয় হাত বাড়িয়ে কাগজ নিয়ে কাজী সাহেবকে দিলে৷ কাজী সাহেব সেগুলো থেকে দরকারী তথ্য নিজের খাতায় টুকতে শুরু করলেন। অন্যদিকে মিষ্টি নিজের পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য কাগজ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।
“আমার কাগজপত্র নবাব পেল কোথায়?” মনে মনে প্রশ্ন করে নবাবের দিকে তাকালো কিন্তু চিন্তিত নবাবের মিষ্টির দিকে দেখবার সময় নেই। খুব বেশি অস্থিরতা সে ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর কাজী সাহেব নবাবকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রাখলেন, “দেনমোহর কত লিখবো?”
দেনমোহরের কথা নবাব একদম ভুলে গেছে। চটজলদি প্যান্টের পিছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সেটা নাড়াচাড়া করলো। মুখ ভর্তি হতাশায় বলে উঠলো, “দুই হাজার একশো টাকা লেখেন।”
নিলয়ের পাশের ছেলে বলে উঠলো, “এত কম?”
“আপাতত আমার কাছে দুই হাজার একশো টাকাই নগদ আছে।”
শার্টের পকেটে হাত দিয়ে নিলয় বললো, “আমরা দেই?”
নিচু দৃষ্টি আর শক্ত চোয়ালে নবাব বললো, “নাহ।”
নিলয় আবার বললো, “আহা! ধার হিসেবে নেয়। পরে শোধ করে দিবি, সিম্পল।”
“না, দেনমোহর নিয়ে ছেলেখেলা করতে চাই না আর আমি সম্পূর্ণ পরিশোধ করেই বিয়ে করবো।”
নিলয়ের পাশের ছেলেটি এবার নবাবের কাছে এসে দাঁড়ালো। নবাবের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলো, “তোর বিষয়টা ঠিক আছে কিন্তু যাকে বিয়ে করছিস তারও তো ইচ্ছে থাকতে পারে দেনমোহর নিয়ে।”
নবাব এবার মিষ্টির দিকে তাকালো। ছলছল চোখে মিষ্টি নবাবের দিকেই তাকিয়ে আছে। মিষ্টির বৃষ্টিস্নাত চোখে চোখ রেখে নবাব জবাব দিলো, “ও কখনও দেনমোহর নিয়ে আপত্তি করবে না। আমি যদি দুই টাকা দিয়েও বিয়ে করি তখনও মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলবে না।” সামান্য দুই বাক্যে মিষ্টি অনুভব করলো তার প্রতি নবাবের তীব্র বিশ্বাস। একটা তৃপ্তির খুশি এই মূহুর্তে তার হৃদয় থেকে যেন উপচে পড়ছে। সেটা সামলে নিতে মিষ্টি চোখ সরিয়ে নিলো।
“ঠিক আছে, তাহলে তাই করা হোক।” নিলয় বলে উঠলো।
সবকিছু ঠিকঠাক মতো লেখার পর কাজী সাহেব জানতে চাইলো, “মা, তোমার কি বিয়েতে মত আছে? থাকলে কবুল বলো।”
গম্ভীর মুখে মাথা নুইয়ে রেখেছে মিষ্টি এদিকে ওর জবাব শোনবার জন্য চার চারটা মুখ মুখিয়ে আছে ওর দিকে। ঘরে পাঁচজন মানুষ থাকা সত্বেও পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। কিছুটা চঞ্চল স্বভাবের নীলয় এই নীরবতার চাদর সরিয়ে দিলো, “ভাবী, বলে ফেলেন কবুল।”
ভাবী শব্দ মিষ্টির কানে পৌঁছানো মাত্র চাপা রাগে যেন ফেটে পড়লো মিষ্টি। রাগের দরুন সবার অগোচরে দুই হাত অহেতুক কচলাতে শুরু করলো কোলের উপরে। এতক্ষণ ধরে চুপ থাকা নবাব জানতে চাইলো, “চুপ করে আছো কেন?”
“বাসায় যাবো আমি।” গতকাল থেকে এই এক বাক্য শুনতে শুনতে নবাবের কান যেন বিষিয়ে তুলেছে মিষ্টি। রাগের দরুন নবাবের চোখ বুঁজে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে মিষ্টির কাছে এসে গর্জে উঠলো, “তোমাকে কবুল বলতে বলেছি। এসব ভিত্তিহীন কথা শোনাতে বলিনি।”
মিষ্টি ভয়ে ভেতরে কাঁপছে। ভয়ে চঞ্চল হওয়া চোখ আর কাঁপা কন্ঠে বললো, “আমি বহুবার বলেছি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।” এবার নবাবের পক্ষে রাগ দমিয়ে রাখা সম্ভব হলো না। শার্টের তলায় থাকা পিস্তল বের করে বলে উঠলো, “তুমি কেন তোমার আত্মাও আমায় বিয়ে করতে রাজি হবে।”
ভয়ে চোখ বুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো মিষ্টি। নিলয় নবাবের কাছে এসে বললো, “নবাব, পাগলামি করিস না। সময় দেয় বলার জন্য।” নবাব নিলয়ের কথায় কোনও পাত্তা দিলো না।
মিষ্টির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে রাগে ফুঁসে উঠলো নবাব, “ভালোয় ভালোয় কবুল বলো নয়ত বুলেট একটাও পিস্তলে থাকবে না, সবকটা দিয়ে তোমার মাথা ঝাঁজরা করে দিবো। এরপর তোমার লাশকে বিয়ে করে না হয় বাকি জীবন কাটাবো।”
“কী বলছিস তুই?” এবারও নিলয়ের কথা কানে তুললো না নবাব। চিৎকার করে বলে উঠলো, “আমার তোমাকে চাই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমাকেই চাই হোক সেটা জীবিত কি’বা মৃত।”
মিষ্টির মুখে কোনও কথা নেই। কেবল ছলছল করা চোখে তাকিয়ে সে দেখছে মানুষটাকে আর মনে মনে আত্মচিৎকার করে জানতে চাইছে, “ভালোবাসার মানুষগুলো কেন এমন হয়ে যায়?”
“আমার হাতে সময় কম আর তোমার চোখের জল এখন আমার কাছে মূল্যহীন। তাই জলদি জলদি কবুল বলো।”
চোখ সরিয়ে নিলো মিষ্টি কারণ নবাবের এমন রূপ সে আগে কখনও দেখেনি। এতটা উন্মাদ হতে পারে নবাব সেটাও মিষ্টির অজানা। সে কেবল মনে মনে বলছে, “তোমার ভালোর জন্য আমি বিয়ে করতে বারণ করছি আর সেই তুমি আমার মাথায় পিস্তল রাখলে?”
“জিসান তুই কি নাটক দেখছিস? কিছু বলছিস না কেন?” নিলয় অপর ছেলেটিকে প্রশ্ন করতে সে বিব্রত হয়ে বললো, “নাটক আর চলচ্চিত্রের চেয়ে তো কম মনে হচ্ছে না। আমার তো মাথা ঘুরছে।”
“ভাবী, প্লিজ কবুল বলেন।” জিসান মিষ্টিকে অনুরোদ করলো।
মিষ্টি হঠাৎ করে কান্না থামিয়ে দিলো। চোখের জল মুছে নিজেকে শক্ত করলো আর স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলো, “কবুল।”
কবুল শব্দে নবাব এতটা চমকে গেল যে, নিজের রাগ মূহুর্তে বিলীন হয়ে গেল। ধীরে ধীরে পিস্তল বন্দী হাত নিচে নেমে এলো। বিস্মিত চোখ জোড়া ক্রন্দন রমনীর মুখে আবদ্ধ হলো আর চিত্ত পুনরায় কবুল শুনতে ব্যাকুল হলো।
“আবার বলো মা।” কাজী সাহেব মিষ্টিকে আরও দুইবার কবুল উচ্চারণ করতে বললেন আর মিষ্টিও বাধ্য মেয়ের মতো কবুল বলে নবাবকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলো।
বেশ সাদামাটা পরিস্থিতিতে নবাব এবং মিষ্টির বিয়ে শেষ হতে সবাই মিষ্টির রুম ত্যাগ করলো। কাজী সাহেবকে যথাযথভাবে বিদায় শেষে জিসান নবাবকে জিজ্ঞেস করলো, “জোরজবরদস্তি করে বিয়ে তো হলো। এবার কী করবি?”
মজার ছলে নিলয় বলে উঠলো, “হানিমুন।”
নবাব নিলয়কে চাপড় মারতে জিসান বলে উঠলো, “ধুর শালা, এই বাঘিনী নিয়ে হানিমুনের স্বপ্ন দেখাও ফাঁসির সমতুল্য।”
“অসময়ে রসিকতা ভালো লাগছে না।” বিরক্তি প্রকাশ করলো নবাব আর পরক্ষণে নিলয়কে বলে উঠলো, “আমি আজকে বিকালের আগে এখান থেকে চলে যাবো। এই জায়গাও নিরাপদ মনে হচ্ছে না।”
জিসান অবাক হলো, “এত জার্নি আর ঝামেলার পর আজকেই বের হবি?”
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তো বিশ্রাম নিতে বাঁধা থাকবে না। এটা নিলয়ের কাকার বাসা। আমার পরিবার নিলয়কে ভালো করে চেনে। যদি খবর পায় বুঝতে পারছিস কী হবে?”
পাশ থেকে নিলয় বললো, “কিন্তু আজকের রাতটা থেকে যা।”
“নাহ, দেরি করার মানে বিপদকে নিজে ডেকে আনা।” ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে নবাব আবার বললো, “এখনও বারোটা বাজেনি। হাতে বেশ সময় আছে।”
“কিন্তু যাবি কোথায়?” নিলয়ের প্রশ্ন।
…চলবে কি?
(এটা কাল্পনিক এবং সিনেম্যাটিক লেখা। তাই সেভাবে গ্রহণ করার আশা রাখছি। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)