#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৯
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
“বন্ধুত্বের ৩ বছর, প্রণয়ের ৬ বছর, পরিণয়ের ৩ বছর শেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত (মা হওয়া) ৩য় বর্ষ চলছে। মোটে ১৫ বছর। একটা মানুষের মনে স্থায়িত্ব করে নেওয়ার জন্য ১৫ বছর কি যথেষ্ট নয়? নাকি একজনের মন থেকে উঠে যাওয়ার জন্য ১৫ বছর যথেষ্ট? আমার কলিজা কাঁপে ইদানিং। আশ্চর্য! মাহফুজের চোখ এখন আর আমায় খোঁজে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ নভেম্বর, ২০০৬
“রফিক জানাল, মাহফুজ তাদের কোনো এক ম্যানেজারের মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছে। ভালো কথা, নিতেই পারে। কিন্তু মেয়েটিকে সে অন্য নজরে দেখা শুরু করেছে। আর এই বিষয়টা অত্যন্ত জঘন্য। আমি পদে পদে মাহফুজকে সাবধান করছি। ও খেয়াল করছে না।
কাল রাতে অফিস থেকে ফেরার পর ওকে বললাম,
-‘মাহফুজ, পৃথিবীর সবচেয়ে নরম জিনিস কোনটা জানো?’
মাহফুজ না ভেবে জবাব দিলো,
-‘পানি।’
হেসে দিয়ে বললাম,
-‘ভালো জানো। আরও কিছুটা শোনো। পৃথিবীর সবচেয়ে নাজুক জিনিস হচ্ছে মেয়ে মানুষের মন। একইভাবে সবচেয়ে শক্তও মেয়ে মনই। বুঝেছ?’
-‘হঠাৎ?’
আমি আরও খানিকটা হেসে বললাম,
-‘মেয়ে-হৃদয় এতটাই শক্ত, একবার সেখান থেকে বের হয়ে গেলে পৃথিবীর কারোর সাধ্য নেই সেখানে প্রবেশ করানোর।’
মাহফুজ কী বুঝল, কে জানে?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৩০ এপ্রিল, ২০০৭
“পুরুষ মানুষকে সবটা দিয়ে ভালোবাসা উচিত না। তারা ছেড়ে যায়। তারা হারিয়ে যায়, আমাদের হারিয়ে দেয়। আমি তাকে হারিয়েছি, তবে হেরে যাইনি। আমার মনে কিছুটা ভালোবাসা নিজের জন্য ছিল। মাহফুজ, তুমি কেন মন থেকে সরে যাচ্ছ? এটা তো চাইনি। আমি তো তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমার চোখ কেন অন্যকে চায়?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৩ মে, ২০০৭
“মাহফুজ ভুলে গেছে, আমি চোখ পড়তে জানি। ভার্সিটি লাইফে একদিন ও আমাকে মিথ্যে বলতে গিয়েছিল, প্রথমবারের মতো। বন্ধুদের সাথে মিলে আরেক বন্ধুর বাড়িতে রাত থেকেছিল। সে-রাতে সবাই শখের ড্রিংকস করেছিল। এজন্য সকালে ক্যাম্পাসে আসতে দেরি করেছে, প্রথম দুটো ক্লাস মিসও গেছে।
এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
-‘সরি, আসলে সকালে আব্বা-আম্মার জন্য দেরি..’
আমি ওকে বাকিটা বলতেই দিইনি। তার আগেই বলে উঠি,
-‘আমাকে মিথ্যে বললে তোমারই লস।’
তারপর ও ভীষণ রকমের অনুতপ্ত হয়ে রাতের ঘটনা জানায়। আমি রিয়্যাক্ট করিনি মোটেও। হেসে বলেছিলাম,
-‘নেক্সট টাইম দু’জন মিলে খাব, ওকে?’
তারপর থেকে মাহফুজ আমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকোয়নি। আর এখন? পাকা অভিনেতা হয়ে গেছে। আচ্ছা, ওর বলা প্রতি ১০টি বাক্যের মাঝে যে এখন ৭টা মিথ্যে থাকে, ও কি বুঝতে পারছে না—আমি টের পাই?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৩০ আগস্ট, ২০০৭
“সে ধীরে ধীরে আমার মন থেকে পুরোপুরি উঠে গেল। আমার সংসারে ভাগ হলো। আমার ভালোবাসায় ভাগ হলো। বড়ো সাধের স্বামী তো! মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারছি না।
আমার ইদানিং আর নিজেকে সহ্য হচ্ছে না। কেমন নারী আমি? যে নারী নিজের স্বামীকেই ধরে রাখতে পারলাম না! আমার মাহফুজ আমার মাহফুজ করে যে কত গলাবাজি করলাম, এগুলো গেল কই?
আমি এর শেষ দেখতে চাই। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিক।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৮ জুলাই, ২০০৮
“ইদানিং আর আগের মতো হাসি না, আগের মতো রাগি না। আমার স্বভাব পালটে যাচ্ছে। প্রিয় পুরুষের শরীর থেকে পাচ্ছি অন্য নারীর স্মেল। বুকের ভেতর যে কী চলে! কাকে বোঝাই?
মেজবাহ আমাকে প্রায়ই বলে উঠে,
-‘মামনি, তুমি পালটাইতেছ।’
আমি কিছু বলতে পারি না। সামান্য হেসে উঠতি বয়সী বাচ্চাটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিই। ছেলেটা ক্লাস টেনে, মেয়েটাও এবার ক্লাস টু-তে। বাচ্চাগুলোকে আঁকড়ে ধরেই আছি আমি। নতুন করে নিজেকে ভালোবাসা শুরু করেছি।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২২ জুন, ২০০৯
“নিজেকে সহ্য হয় না। জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্তে এসে এত বড়ো ভুল করে ফেললাম? আমি ভালোবাসা চিনতে ভুল করিনি। মাহফুজ অবশ্যই আমাকে ভালোবাসত। তবে এত জলদি তা মিটল কেন? আমি ধরে রাখতে ব্যর্থ! মাহফুজ, তুমি দোটানায় হাঁসফাঁস করতে করতে মরে যাও। প্রাণ ফিরেও দুই পাশে টান খাও। আমি বাকিটা জীবন তোমার চোখে অনুতাপের জ্বলন্ত অগ্নি দেখতে চাই।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
০৭ আগস্ট, ২০১০
“মাহফুজকে আমার জীবনের গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে থেকে বের করেছি, তার চতুর্থ বর্ষপূর্তি। মেজবাহ ইন্টারমিডিয়েটে, আর আমার মেয়েটা ক্লাস ফোরে। ছেলেটা বড়ো হওয়ার সাথে সাথে অসীম জেদি, শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তেমনই মেয়েটা নাজুক, নির্বিকার। কী অমিল! এদিকে আমি ভেবে পাই না, আমার সোনাই যেন আমারই অনুরূপ! দেখতে গ্রহণ লাগা চন্দ্রের মতন সুন্দর।
শিহাব কীভাবে যে মেয়েটাতে নজর দিলো, ভাবতেই ঘেন্না পাচ্ছে আমার। আজ কাকাইয়ের বর্ষপূর্তিতে ওবাড়িতে ছানা-পোনা নিয়ে গেছিলাম। মেজবাহ দেখল—শিহাব কীভাবে আমার মেয়েকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছিল। ছেলেটা এমনিই রগচটা। তার ওপর যা দেখল, তাতে আর সইতে পারেনি। ওর এত আদরের পুতুলে এরকম কুনজর অবশ্যই সহ্য করার মতো না। তাই মোহকে আড়ালে রেখে এসে রুমবন্দী করে বেধড়ক পেটাতে লাগল শিহাবকে। বাচ্চাবয়সী ছেলের কাছে এমন মার খেয়ে শিহাব যন্ত্রণায় নিজের ঘরে পড়ে কাতরাচ্ছিল। আমি গিয়ে আটকাই। তারপর মেজবাহর কাছে সব শুনি। শেষে গিয়ে ওকে আবার আটকাই। কসম দিয়ে ওকে রুম থেকে বের করি।
মেজবাহ আমার জন্য সেদিন শিহাবের জান নিতে পারেনি। নয়তো খুন হতো! শেষে মেজবাহ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যায়।
তারপর আমি শিহাবের হাত-পা বেঁধে ফেলি। মুখটাও আটকে দিই, যাতে আওয়াজ না বের হয়। এরপর বাকিরাত বিরতিহীনভাবে বেল্ট দিয়ে মারতে থাকি। জানোয়ারের বাচ্চার সাহস অনেক হয়ে গেছিল। লজ্জা থাকলে আর এই সাহসটা ওর হবে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১১
“তার মেয়ে হলো! এতদিন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, এখন আমার মেয়েরও হলো। আম্মুজান, আল্লাহ তোমাকে এই সত্যিটার সাথে পরিচয় না করাক। এত সাহস তো তোমার নেই, সোনাই। আমি মেনে নিতে পারলেও, তুমি হয়ে উঠবে বিধ্বংসী, অপ্রকৃতস্থ। আমারই তো রক্ত। এসব গুন তোমার জন্য অবশ্যম্ভাবী।
আমি মেজবাহর চোখে তোমার জন্য অগাধ আদর দেখেছি। কিন্তু আমি তা বলব না তোমায়। তোমাদের কোনো সিদ্ধান্তই আমি নেব না। এই দেখো! তোমার বাবার চোখেও আমি নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম। অতঃপর ভালোবাসা আমায় ভালো থাকতে দিলো না। আমি চাই না, তোমার বেলায় তা হোক।
মেজবাহ রাজনীতিতে ঝুঁকছে। বিষয়টা ভালো লাগছে না আমার। ও যে-রকম মানুষ, রক্তারক্তি বাঁধিয়ে ফেলবে প্রতি ওয়াক্তে। প্লাসে-মাইনাসে যেমন আকর্ষণ হয়, মেজবাহ আর পলিটিক্স যেন তেমনই কিছু। রক্ত ঝরবে আরও। আমি তা চাইছি না। অবশ্য যা চেয়েছি, তা পেলামই বা কই?
মেজবাহকে আজ গিয়ে বলে উঠলাম,
-“দুটো একসাথে পাবে না।”
মেজবাহ অবাক হয়ে শুধায়,
-“কোনটা?”
আমি শান্ত গলায় বলি,
-“প্যাশনটাকে ছাড়ো, মেয়ে দেবো। নয়তো না।”
আমাদের শাশুড়ি-জামাইয়ের মাঝে কথা-বার্তা তখনই শেষ হয়। মেজবাহকে মোহর কমনীয়তা বোঝানোর পর সে পলিটিক্স ছেড়েছে। তবুও আমি জানি, সে সবটা ছাড়েনি। ততদিনে রাজনীতি ওর রক্তে। প্রকাশ্যে না পারুক, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে চলেছে, নেড়ে যাবে। যাক, সেটুকুতে দোষ নেই। আমার মেয়েটা ভালো থাকলেই হলো।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৬ জুলাই, ২০১১
“পৃথিবীর সবচেয়ে লোমহর্ষক মুহূর্ত হচ্ছে সাধের পুরুষকে বাস্তব জীবনে অভিনেতা হয়ে উঠতে দেখা। আশ্চর্য! ওর এত সুন্দর অভিনয় দেখে আমার গা শিউরে ওঠে।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ আগস্ট, ২০১১
“মাহফুজ অভিনয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে। তবুও কি আমার থেকে লুকোতে পারবে? ওকে চেনার ১৯ বছর তো হলো!
আমার ঘুম হারাম হয়েছে আরও ৪ বছর আগে। ও টের পায়নি। যে পুরুষের হৃদয়ে একাধিক নারী স্থান পায়, সে পুরুষ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রাণীর আওতাধীন। আমি তার বহিঃপ্রকাশ করিনি। তবে ইদানিং একটা জিনিস খুব খেয়াল করছি। মাহফুজ রাতে ঘুমোতে পারে না। যখনই চোখ খুলে ওর দিকে তাকাই, ওর সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টিকে দেখতে পাই। আনন্দে আমার বুকটা ভরে ওঠে। ও টান খাচ্ছে।
মাঝে মাঝে খুব বলতে ইচ্ছে করে,
-‘মাহফুজ, শোনো! তুমি তো ভুল করোনি, করেছ অন্যায়। এই অন্যায়টা না করলেই হতো না? আমি কেন তোমার জন্য যথেষ্ট ছিলাম না?’
আবার ইচ্ছে হয়, বুকে গিয়ে কেঁদে উঠি, অভিযোগগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে বলে উঠি,
-‘কিংবা আমাকে বলেই দেখতে! হাসিমুখে তোমাকে ছেড়ে যেতাম। তখন না হয় আরেকজনে জড়াতে! তোমার শরীর থেকে ভেসে আসা অন্য নারীর স্মেল আমার শরীরে দহন ঘটায়। প্রতিটা লোমকূপ ঘৃণায় তোমাকে শাপ দিয়ে বসতে চায়। আমাদের সেই দিনগুলোর জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিতে পারছি না। ভালোবাসায় যেহেতু ভাগই বসানোর ছিল, তবে শুরুতে কেন আমাকে প্রেম শেখালে?’
আমি কিছুই বলতে পারি না। ওর দিকে তাকিয়ে থাকি শুধু। মানসপটে ভেসে উঠে ভবিতব্য—ওর শান্তির দিনগুলো ক্ষণিকের। ইশ! যদি আমার একার থাকতে, তবে জানতে সুখময় দিনগুলো চিরস্থায়ী।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ অক্টোবর, ২০১১
“ভালোবাসাকে এখন আমার মন্দবাসা ডাকতে ইচ্ছে হয়। শালার ভালোই থাকতে দিলো না!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ মার্চ, ২০১২#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_২০
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
“ভালোবাসাকে এখন আমার মন্দবাসা ডাকতে ইচ্ছে হয়। শালার ভালোই থাকতে দিলো না!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ মার্চ, ২০১২
“আমি ওকে কোনো শাস্তি দেবো না, আর এটাই হবে ওর জন্য সবচেয়ে বড়ো শাস্তি। দুনিয়াতে বেঁচে থাকতেই অনুতপ্ত হওয়ার চেয়ে বড়ো শাস্তি নেই। আফসোস শুধু একটাই! ওর অনুতপ্ততা আমার অন্তর ছুঁতে পারবে না। আমি এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করি—একজন পুরুষ কখনই এক নারীতে আসক্ত হয় না, হতে পারে না।
আর হ্যাঁ! কষ্টের আগুন ভেতরটা স্পর্শ করে ফেললে, যন্ত্রণারা আর গা-ছোঁয়া হয় না। আমি ভীষণ দুঃখিত। তোমার জন্য আর আমার বুক কাঁপে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১ এপ্রিল, ২০১২
“মেজবাহ আজ এক্সাম শেষে সরাসরি এ বাড়িতে চলে এলো। আমাকে দেখে মুখভাব চরম গম্ভীর করে নিল। তারপর বলে উঠল,
-‘মামনি, তোমার মেয়ে আমাকে পাত্তা দেয় না। আমার রাগ ওঠে।’
ওর সিরিয়াস মুখে বলা কথাটিতে আমি না হেসে পারিনি। কেমন গাল ফোলাচ্ছিল! আমি হাসি চেপে নিয়ে বলি,
-‘তো তুমি কি চাইছ—আমি তোমার হয়ে আমার মেয়েকে পটিয়ে দিই?’
মেজবাহ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘নট অ্যা ব্যাড আইডিয়া!’
আমি এবার সশব্দে হেসে উঠি। মেজবাহ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-‘হাসবে না, মামনি!’
-‘আচ্ছা, হাসব না। এরপর বলো।’
-‘এরপর, তোমার মেয়ে আমার দিকে তাকিয়েও দেখে না।’
-‘তারপর?’
-‘তাই আমি নিজেই ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকি।’
-‘এরপর?’
-‘তোমার মেয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘোরাঘুরি করে খুব। প্রাইভেট শেষে বন্ধুদের নিয়ে আমতলায় বসে থাকে ২০-২৫ মিনিট!’
-‘তারপর?’
-‘তারপর আমি ওর বন্ধুদের নিজের ওয়েতে সাবধান করে দিই। এজন্য দেখছ না—এখন কেমন মোহ জলদি জলদি ফিরছে?’
-‘এরপর?’
-‘তোমার মেয়ে আমার পছন্দ-অপছন্দের নূন্যতমও জানে না।’
-‘তারপর?’
-‘আমি লিস্ট করে দিয়ে এসেছি কাল, মুখস্থ করার জন্য। এক্সাম শেষে পড়া ধরব।’
-‘এরপর?’
-‘তোমার মেয়ে এত গম্ভীর!’
-‘তারপর?’
-‘রোজ সকাল-বিকাল নার্গিস আন্টির গান শোনার জন্য সাজেস্ট করে এসেছি।’
আমার তারপর-এরপর এর খেলা শেষ করতে হলো তখনই। সোফায় বসে পড়লাম। হাসলাম প্রচণ্ড! কতদিন পর যে এভাবে হাসলাম! মেজবাহ এবার আর আমার হাসি থামাতে বলল না। সে নিজেও হেসে ফেলল। অবশেষে আমার হাসি যখন থামল, ছেলেটা নরম গলায় বলল,
-‘তোমার হাসি কেউ কেড়ে নিতে না পারুক। সেই কলুষিত অন্তরের মানুষগুলো কি জানে—হাসলে আমার মামনিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর নারী লাগে?’
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। মেজবাহ! তুমি এরকমই থেকো। মানুষ তো পালটায়, প্রকৃতির নিয়ম! তুমি বরঞ্চ পালটে যেয়ো না। একটু-আধটু অনিয়ম করো। বিশ্বাস করো, প্রসঙ্গ যখন প্রকৃতির বিরুদ্ধে, তখন সব ধরনের অনিয়মই জায়েজ।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৭ এপ্রিল, ২০১২
“মাহফুজ নিজের ভুলটা বুঝতে শুরু করেছে। সর্বক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে থাকে। ঠিকঠাক খায় না, কোনো কাজে মন নেই। আমাকে বুঝতে দিতে চায় না, তবুও আমি বুঝি। একটা কথা কি, কারো ঘুম কেড়ে নিয়ে কখনও শান্তিতে ঘুমোনো যায় না।
মাহফুজ, এই অনুতাপটা যদি অন্যায়টা করার আগে আসত! তবে তুমি আমায় হারাতে না। আফসোস! তোমার জন্য আর আমার মন কেমন করে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৯ ডিসেম্বর, ২০১২
“মাহফুজ আর যা-ই করুক, মেয়েটাকে কখনও অবহেলা করেনি। আমি বুঝি, সবদিক থেকে ডিপ্রেসড হয়ে মাহফুজ মোহতে প্রশান্তি খুঁজে পায়। দিনশেষে ওর ভালো থাকার কারণটা হচ্ছে মোহ।
মাহফুজ ইদানিং আন্দাজ করে বসে কিছু একটা। সেদিন আমাকে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল,
-‘শেফা, সব ঠিক আছে?’
আমি চোখে হেসে বললাম,
-‘বেঠিক থাকার মতো কিছু করেছ?’
ও যেন আরও খানিকটা ঘাবড়ে গেল। আমার মজা লাগল। আমি আর ওর দিকে তাকালাম না আর। মুখ ফেরানোটা ও খেয়াল করলেও, আমার মন ফিরিয়ে নেওয়াটা বোধহয় ওর নজরে আসেনি। এলে কী হতো? উম.. ও বিচলিত হতো? নাকি ভেঙে পড়ত?
আমি বলতে পারছি না, এখন আর প্রেডিকশন দিতে পারি না। একসময় নিজের ওপর খুব অহং ছিল। গ্যারান্টি দিয়েছিলাম, মাহফুজ আমার। হাসি পাচ্ছে এখন।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
“পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বোকামি হচ্ছে কাউকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসা। আমি অস্বীকার করে যাব আমৃত্যু, বলে যাব—আমি নিজেকে অত্যাধিক ভালোবাসি। অথচ এটি খুব সুন্দর একটি মিথ্যে।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৩ জুলাই, ২০১৩
“আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিলাম, তারও বেশি বিশ্বাসী ছিলাম স্বীয় কর্মে। অথচ যা পেলাম, তা যেন আমার দুনিয়া এলোমেলো করে দিলো। কী আশ্চর্য! এটা তো হওয়ার কথা ছিল না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৯ নভেম্বর, ২০১৩
“মেয়েটা এলো, গম্ভীরমুখে আমার পাশে বসে বলল,
-‘আম্মু, আমি স্কুল চেঞ্জ করতে চাই।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-‘সামনে তোমার জেএসসি, রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে। এখন কীভাবে?’
অথচ ও ওর কথায় অবিচল,
-‘এক্সাম এই স্কুল থেকেই দেবো, পড়ার ব্যবস্থা অন্য স্কুলে করো।’
আমি নিজেও স্থির হয়ে বললাম,
-‘সমস্যাটা খুলে বলো।’
ও আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলল,
-‘আম্মু, আমাদের ক্লাসের রিফাত আমাকে কারণে-অকারণে খুব জ্বালাচ্ছে, টিজ করছে। এখানে থাকলে হয়তো মেরে-টেরে দিতে পারি।’
আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। আমি দেখছি বলে মোহকে শান্ত করলাম। বিকেল হতেই যখন মেজবাহ মোহকে পড়াতে এলো। আমি ওকে নিজের রুমে ডাকলাম। ছেলে-মেয়ে দুটোই বড়ো হয়ে গেছে। মেজবাহ যখন আমার রুমে এলো। আমি খুব সূক্ষ্মভাবে ওকে অবলোকন করলাম। চেহারা লম্বাটে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। হাইট প্রায় ৬ ফুট ছুঁইছুঁই, বংশগতভাবেই ওরা লম্বা। বয়স ২১, আর সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখটা।
আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে সালাম দিয়ে বলল,
-‘মামনি, কেমন আছ?’
আমি সালামের জবাব দিয়ে বললাম,
-‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। কিন্তু তোমার বিষয়টা মোটেও ঠিক লাগছে না।’
-‘কোন বিষয়ে?’
মেজবাহর প্রশ্নে আমি হাঁপ ছাড়লাম। ও তো ধরতেই পারছে না, ও এক্সাক্টলি কী করেছে। আমি ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,
-‘মোহকে ওর স্কুলের কোন ছেলে যেন ডিস্টার্ব করছে। এতকাল মোহর জানার আগেই তুমি সেসব দেখেছ। আজ কেন দেখছ না?’
এতে হয়তো মেজবাহ মলিনমুখে কোনো বাহানা ধরবে। অথচ আমার ভাবনাকে ভুল বানিয়ে ও হাসল। সেই চমৎকার হাসিটা! আমাকে এক্সপ্লেইন করার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-‘আমি মোহকে ভীষণ স্ট্রং একজন মেয়ে হিসেবে দেখতে চাই। আমি ওকে আত্মনির্ভরশীল বানাতে চাই। আমি চাই ও নিজেকে বুঝুক, ও নিজেকে দেখুক। পৃথিবীর সবকিছুর আগে নিজের ভালোটা ধরতে শিখুক। এতকাল বাচ্চা ছিল, অবুঝ ছিল। তাই আমি দেখেছি। এখন ও আর বাচ্চাটি নেই। ঠিক-ভুল বুঝতে শিখেছে। মামনি, একজন মেয়েকে কখনই কারো ওপর নির্ভরশীল বানানো উচিত নয়। ইন ফিউচার, ধরো আমি-তুমি বা আঙ্কেল—কেউ ওর জন্য রইলাম না। ওর সিচুয়েশনটা তখন ভাবতে পারছ?’
ভীষণ অবাক হয়ে এই ছেলেটাকে দেখলাম আমি। এতটা পূর্ণমনস্ক পুরুষ খুব কমই দেখা হয়েছে আমার। বিস্মিত ভাব না কাটিয়েই শুধালাম,
-‘কী করতে চাইছ?’
মেজবাহ মুচকি হেসে বলল,
-‘মোহকে আমার শক্তি বানাব।’
তখন থেকে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমার আম্মুজানের পরিবর্তন, একই সাথে স্বয়ং মেজবাহর। দুজন পালটাচ্ছে। মেয়েটা হয়ে উঠছে অত্যন্ত শান্ত অথচ গম্ভীর, দায়িত্বশীল। অন্যদিকে ছেলেটা হচ্ছে কর্মবিমুখ, ভবঘুরে!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৭ মার্চ, ২০১৫
“একটা নারীর সৌভাগ্য এসে আটকে থাকে দুটো পাওনাতে। এক. স্বামীর কাছে অমূল্য, অদ্বিতীয়া হওয়া; দুই. সন্তানকে আদর্শবান হতে দেখা। আমি একদিক থেকে হেরেছি, অন্যদিক থেকে জিতেছি। আমার মেয়ে আমার গর্ব। নিজেকে যেভাবে ধরে রাখতে পারিনি, মোহকে সেরূপ গড়েছি আমি।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২ নভেম্বর, ২০১৫
“আজ মাহফুজ আমাকে জিজ্ঞেস করল,
-‘শেফা, আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি কিছুদিনের জন্য। কিছু লাগবে? তোমার জন্য কী আনব?’
খুব বলতে ইচ্ছে করল,
-‘ফেরার পথে আমার একান্ত তুমিটাকে আমার জন্য নিয়ে এসো।’
অথচ আমি তা বলতে পারলাম না। মানুষের একজনমে কত আফসোস থাকে!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ জানুয়ারি, ২০১৬
“আমি নিজের ভাগ্য মেনে নিয়েছি। এখন মাহফুজের পরিণতির অপেক্ষায় আছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, মেয়েটা যদি জেনে যায়? মেয়ে বড়ো হচ্ছে, সব বুঝতে শিখছে। আমি যেমন-তেমন ছিলাম। মেয়েটা হয়েছে ওভার পজেসিভ। বাবার ভাগ তো মানতে পারবে না।
মোহর প্রতি মাহফুজের ভালোবাসা, যত্ন, আহ্লাদ ছিল আমার চেয়েও বেশি। আচ্ছা, মেয়ের চোখে ঘৃণা সহ্য করতে পারবে তো?
আমার মেয়ে! ভালোবাসতে জানে যত্ন করে, ঘৃণাটাও করতে জানে যত্ন সহকারে। মাহফুজ! তোমার জন্য আমার অনুভূতিহীন হৃদয়ে মায়ার সঞ্চার হচ্ছে। কোনো খুনিকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে দেখলে যেমন লাগে না? ওমন! তুমিও তো খুনি। আমার হৃদ-হত্যার অভিযোগে আসামি। তোমার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না, কেবল কারাদণ্ড। তাই আমি চুপটি আছি।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৬ আগস্ট, ২০১৬
“মেয়েটা আজ তার বাবার কাছে বলে বসল,
-‘আব্বু, তোমার সময় হবে?’
মাহফুজ মুচকি হেসে বলল,
-‘তোমার জন্য আমি আমার সবচেয়ে ব্যস্ততম মুহূর্তেও ফ্রি আছি। বলো তুমি।’
মেয়েটা সানন্দে বলে ওঠে,
-‘তুরশিপুরে যেই নতুন পার্কটা হয়েছে, ওখানে যেতে চাই।’
মাহফুজ বিনাবাক্যব্যয়ে রাজি হলো। বিকেলেই তিনজনে মিলে পার্কটিতে গেলাম। ঘন্টাখানেক যেতে না যেতেই মাহফুজ ফিরে আসার তাগিদ দিলো। লক্ষ্য করলাম একই স্থানে মাহফুজের আরও একটি গন্তব্যকে। অগোচরে হাসলাম। আর কত লুকিয়ে চলবে?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬
“অন্যসব নারীর মতো আমার হয়তো উচিত ছিল ঘটনাটা ঘটার আগেই লাগাম টেনে নেওয়া, আটকানো। কিন্তু, কার লাগাম টানব? মাহফুজের? যেই পুরুষ নিজেকে শুদ্ধ রাখতে পারে না, সেই পুরুষকে কতটা বেঁধে রাখা যায়?
অথচ সে ভুলেই গেছে, যা আমার তা আমারই; তাতে বিন্দুমাত্র অন্যের ছোঁয়া পেলে আমার আগ্রহ উঠে যায়। মাহফুজকে আমি ভালোবেসেছি। ভালোবাসা ফুরোয় না, মরে যায়। আমার আগ্রহের সাথে ভালোবাসাটাও পুরোপুরি উঠে গিয়েছে। যে অন্যমুখো একবার হয়েই গিয়েছে, তাকে এমুখো করার ইচ্ছেটা আমার নেই। শুধু একটাই চাওয়া থাকে সর্বদা, কোনো মেয়েই যেন কাউকে সর্বস্ব দিয়ে ভালো না বাসে। অপাত্রে পড়ে গেলে, ভালোবাসা মন্দবাসা হয়ে যায়।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৭ জানুয়ারি, ২০১৭
চলবে..
[নেক্সট পর্বে ডায়েরির টপিকের এন্ডিং হবে। বর্তমানের কাহিনি চলবে..]