প্রেম পায়রা ২ পর্ব ১৫

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____১৫

‘আপনি এখনো ঘুমাননি?’

তিথির বিস্ফারিত কন্ঠের কোনো প্রতিত্তর করলো না সম্পদ। তার নাছোড়বান্দার মতো অবস্থা দেখে তিথির মন মেজাজ বিগড়ে যেতে লাগলো। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। ওড়নায় টান মেরে বলল,

‘সমস্যা কি? কি চান?’

সম্পদ শান্ত অথচ প্রখর দৃষ্টি মেলে তাকালো। সে দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা তিথিকে ভাবিয়ে তুলল। বহুদিন পর শিরায় শিরায় প্রবাহিত হওয়া রক্তের অস্তিত্ব টের পেল। ভেতরে চাপা আতংক ছড়িয়ে পড়লো। তবুও নিজের শক্ত-সামর্থ্য আর চটপটে ভাব বজায় রাখার জন্য বলল,

‘আপনাকে ঘুমাতে বলেছি না?’

‘আই কান্ট স্লিপ!’

‘ব্যাপার নাহ! আমি বাল্ব বন্ধ করে দিচ্ছি। তীব্র আলোর জন্য ঘুম হচ্ছে না।’

তিথি সম্পদের বাহুর দিকে ইশারা করে ওড়না ছাড়তে বলল। সম্পদের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে আগের থেকে আরো সৃদঢ় ভঙ্গিতে ওড়নার অংশটা চেপে ধরলো। তার দৃঢ়তা দেখে মনে হচ্ছে এ জনমে সে আর মুঠোর ওড়না ছাড়বে না। তিথি প্রচন্ড রকম হোঁচট গেল। নিজের বিক্ষুব্ধ মনের আবছায়াতে দিব্যদৃষ্টির একটা সূর্য উঁকি দিতে দেখলো। নতুন সূর্য, নতুন ভোরের, নতুন প্রেরণার।

‘তিথি! আই ওয়ান্ট টু স্টাডি মোর এবাউট ইয়্যুরসেল্ফ। লাইক তোমার পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা না লাগা, তোমার কিসে মন খারাপ হয়, কি পেলে আনন্দ পাও। তোমার মন পড়তে চাই আমি। তোমায় সম্পূর্ণ রূপে বুঝতে চাই। তোমার মনের অতলস্পর্শ করতে চাই।’

সম্পদ গভীর আবেগ মিশিয়ে বলল। অস্থির চিত্তের তিথি ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল। সম্পদের মনের অবস্থা সে যেন হুট করে সম্পূর্ণ বুঝতে পারলো। বুঝতে সক্ষম হলো সম্পদের না বলা অনুভূতি। অনায়াসে মানুষটার লুকোনো অনুভুতির নাগাল পেয়ে গেল। সম্পদ তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। তার সাথে প্রণয় বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছে। এটা ক্ষণিকের মোহ। ক্ষণিকের প্রণয়। এই প্রণয়ের ফলাফল ভেবে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। সে বিড়বিড় করে বলল,

‘মি. প্রোপার্টি! আপনি আবোল তাবোল কথা বলছেন। ঘুমিয়ে পড়ুন।’

‘তিথি, আ’ম সিরিয়াস। তোমার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না। আমি তোমাকে সম্পূর্ণ রূপে জানতে চাই। বুঝতে চাই।’

‘আমার মধ্যে বুঝার মতো, জানার মতো কিছুই নেই। আমি নিজেই নিজেকে বুঝতে পারি না।’

‘তোমার তুমিকে বুঝতে হবে না। তোমাকে বোঝার দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু আমাকে বুঝার একটু চেষ্টা করো। আমি তোমার আকাশে রামধানু এনে দিবো। গিভ মি অ্যা চান্স!’

তিথি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,

‘আমার রামধনুর প্রয়োজন নেই!’

‘তোমার পছন্দ, অপছন্দ?’

‘পছন্দের অনেক কিছু আছে৷ কিন্তু এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে অপছন্দের হলো পুরুষ মানুষ।’

সম্পদের কপাল কুঁচকে গেল। চোখ দুটো ছোট্ট ছোট্ট হয়ে এলো। দু বার চিন্তা না করেই ওড়না ধরে এক টানে তিথিকে কাছে নিয়ে এলো। হাত চেপে ধরে তাকে এক ঝটকায় নিজের পাশে শুইয়ে দিল। এত আচমকা সব ঘটলো যে তিথি বাঁধা দেওয়ার ফুরসত পেল না। সম্পদের বাহুর উপর মাথা নেতিয়ে সে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো। আস্তে আস্তে চোখের মণি দুটো জ্বলে উঠলো। উঠার চেষ্টা করতে সম্পদ বাহু চেপে ধরে গতি রোধ করলো। তার বাহু বন্ধনের মধ্যে ছটফট করতে করতে তিথি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

‘ছাড়ুন বলছি। কি হয়েছে আপনার? এমন বিহেভ করছেন কেন?’

সম্পদ নেশাক্ত চোখে তিথির দিকে চেয়ে রইলো। তিথির ডান হাতটা মুঠোয় পুড়লো। হাতের তালুতে দৃশ্যমান কৃষ্ণকায় তিলটার দিকে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। এক পলক তিথির অগ্নিদাহের মতো দৃষ্টির দিকে চেয়ে হাতের তিলে চুমু খেল। ঘোরযুক্ত কন্ঠে বলল,

‘আমি বোধ হয় তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি তিথি। হয়তো শরীর অসুস্থ বলে বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছি। শরীরের সাথে মনের কানেকশন যে! না হলে এতটা দূর্বল হয়ে পড়তাম না। আমার মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি।’

বলে সম্পদ আর অপেক্ষা করলো না। তিথির পেটের উপর আলতো স্পর্শ করে মাথা রাখলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল তিথি। হাত পা অসাড় হয়ে আসলো। ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো তার। সম্পদ বন্ধ চোখে গভীরভাবে তিথির পেটে মুখ গুঁজতে হুশ ফিরলো তার। ভেতর থেকে তিঁতকুটে ঢেঁকুর উঠলো। মুখ উপচে বমি পেয়ে গেল। ডান হাতে মুখ চেপে ধরে সম্পদকে সরানোর চেষ্টা করলো। সম্পদ মাথা তুলে তাকালো। তিথির ঝাপসা চোখ দেখে চমকে গেল। হুড়মুড় করে বলল,

‘কি হয়েছে? মুখে হাত দিয়ে রেখেছ কেন? দেখি কি হয়েছে? কোথাও কষ্ট হচ্ছে?’

তিথি উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতিতে নেই। সম্পদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে বিছানা ছেড়ে নামলো। অগোছালো ভাবে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। বেসিনে মুখ রাখার আগেই বমি করে ওয়াশরুমের ফ্লোর ভাসিয়ে দিল।

সম্পদ রুম থেকে তিথির ভমিটিং এর ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। উঁচু স্বরে জিগ্যেস করলো,

‘তিথি? তিথি তুমি ঠিক আছো?’

উত্তর এলো না। সে বিছানা ছেড়ে নামার চেষ্টা করলো। ব্যান্ডেজ করা পা টা ফ্লোরে রাখতে চোখ মুখ খিঁচে এলো যন্ত্রণায়। সহ্য করে নিল। বিছানায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দেয়াল স্পর্শ করলো। দেয়ালে ভর দিয়ে ওয়াশরুমের সামনে গেল। দরজা ঠেলে সরাতে দেখলো ফ্লোরের দিকে নজর গেল। চোখ তুলে তিথির দিকে চেয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘তিথি কি হয়েছে? আর ইউ অলরাইট?’

তিথি মাথা ঘুরিয়ে রক্তলাল চোখে তার দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ট্যাপ ছেড়ে কুলি করতে লাগলো। সম্পদের চেহারায় অপরাধ বোধ ফুটে উঠলো। পরক্ষণে নিজের পরণের টিশার্টটা শুঁকে দেখলো। কিন্নর কন্ঠে বলল,

‘মাত্র দুদিন হলো শাওয়ার নেই না। গা দিয়ে গন্ধও বের হয়নি। তাহলে তোমার ভমিটিং এর রহস্য কি? শুঁকে দেখো, আমার গায়ে গন্ধ নেই।’

সম্পদ টিশার্ট উঁচু করে তিথির দিকে এগিয়ে দিল৷ তিথি তার দিকে ফিরেও তাকালো না। চুপচাপ ফ্লোরে পানি ঢেলে দিল। চোখে মুখে আবার পানি দিয়ে দরজা দিয়ে বের হতে নিল। সম্পদ দরজা জুড়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তিথি সরতে বলল না। মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সম্পদ হাত বাড়িয়ে তার ভেজা মুখ স্পর্শ করতে নিতে সে মাথা সরিয়ে ফেলল। সম্পদের আর এগোনোর সাহস মিলল না। একটু সাইড হয়ে বলল,

‘হাতটা একটু ধরো তো। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বো। অনেক রাত হয়ে গেছে। তোমারও রেস্টের প্রয়োজন।’

তিথি ধীর পায়ে একা সরে গেল। ক্লান্ত দের মতো হেঁটে রুমের বাইরে চলে গেল। ভয়ংকর চিন্তায় পড়ে গেল সম্পদ। বুঝতে পারছে তিথি আজ আর এ রুমে ঘুমাবে না। ঠাস করে নিজের গালে একটা চড় মারলো। এত এডভান্স হতে বলেছিল কে তাকে? এখন তিথি রাতে এখানে থাকবে না। কিন্তু সে তো ইচ্ছে কৃত ভাবে কিছু করেনি। ইমপালসের উপর করে ফেলেছে। ব্যথাতুর আর্তনাদ করতে করতে সে বিছানা অবধি এলো৷ উৎসুক দৃষ্টি মেলে দরজার দিকে চেয়ে রইলো। তার ব্যথাতুর শব্দ শুনে তিথি অন্তত দৌঁড়ে রুমে আসবে। কিন্তু আসলো না।

ব্যথিত হৃদয় নিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মনের খচখচানি কমলো না। তিথি এখন একটু বেটার ফিল করছে তো? সে কি একবার ও রুমে যাবে? কিন্তু অসুস্থ পা নিয়ে এতদূর হাঁটার সাহসে কুলাল না। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা হাতে নিল। তিথির নাম্বারটা ‘হেডঅ্যাক’ দিয়ে সেভ করেছিল। তখন মেয়েটার কথা ভাবলেই তার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যেতো। সেটা আর পরিবর্তন করা হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল দিল। রিং হলো কিন্তু তিথি ফোন তুলল না। সত্যি সত্যি টেনশন হতে লাগলো এবার। এক-দেড় মিনিট ব্যবধান নিয়ে সে ক্রমাগত ফোন দিতে থাকলো। এগারো বারের মতো নাম্বারে কল দিতে এক নারীকন্ঠ শোনা গেল। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হাতের ফোনটা ছুঁড়ে রাখলো সে। দুশ্চিন্তা গ্রস্থ চোখে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলো।

১৮.

ভেজা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে সম্পদ। গ্রিল দিয়ে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। মিনিট দশেক আগে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছিল। এখন আকাশ পরিষ্কার, মেঘমুক্ত। সূর্যের মুখও দেখা দিয়েছে। রোদের ঝলকানি দেখে মনে হয় না কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। সে ভেজা শহর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তিথির রুমের জানালার দিকে তাকালো। মেয়েটা তার উপর বড্ড অভিমান করেছে।

ইতোমধ্যে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। সে মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে। গতকাল হসপিটালে গিয়ে পায়ের ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করে এনেছে। একা একা হাঁটাচলা করতে পারে এখন। তবুও ডাক্তার আরো কিছুদিন রেস্ট নিতে বলেছে। শ্বাস ফেলল সম্পদ। সেদিনের পর থেকে তিথির সাথে আলাদা একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তার। সে চাইতেও দূরত্বটা ঘুচাতে পারছে না। তিথি তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। একেবারে বন্ধ করেনি, কিন্তু প্রয়োজনীয় ছাড়া দুটো শব্দ বেশি ব্যবহার করে না। তার তো মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটা দাঁড়ি পাল্লা দিয়ে মেপে মেপে কথা বলে।

তিথির রুমের জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে আবার সামনে তাকালো। হুট করে তার চোখ গেল অপজিটের কান্তা ভিলার দিকে। ভুড়িওয়ালা এক লোককে দেখতে পেল। লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠলো তার। গ্রিল চেপে রাখা হাত শক্ত হয়ে এলো। গলার রগ ফুটে উঠলো। এই কালপ্রিটটা কবে থেকে তিথির উপর নজর রাখছে? মেজাজ খিঁচিয়ে উঠলো তার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিথির রুমের দিকে পা বাড়ালো।

(চলবে)

আসসালামু আলাইকুম। গল্পের সম্পদকে তিথি মাঝে মধ্যে ‘মি. প্রোপার্টি’ বলে ডাকে। এটা ‘সম্পদ’ শব্দটার ইংরেজি শব্দ এমন নয় বিষয়টা। সম্পদ শব্দের ইংরেজি শব্দ resources, wealth, treasure ইত্যাদি যেটা আমরা সবাই জানি। প্রোপার্টি শব্দের অর্থ হলো সম্পত্তি। ধন, সম্পদ, টাকা-পয়সা কারো নির্দিষ্ট নামে অতটা প্রকট ভাবে থাকে না। সবাই ব্যবহার করে। যে কাউকে সহজে দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সম্পত্তির ক্ষেত্রে একজন নির্দিষ্ট মানুষের নাম উল্লেখ থাকে। সেই ধারণা থেকে তিথি সম্পদকে ‘মি. প্রোপার্টি’ বলে ডাকে। তার পার্সোনাল প্রোপার্টি বলে ডাকে। যার উপর শুধুমাত্র তার অধিকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যাত্রাপথে কোনো ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার চাইলে তাকে কিছু টাকা দেওয়া যায়। কিন্তু নিজের নামে সংরক্ষিত ফ্ল্যাটটা দিয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া সম্পদ, সম্পত্তি অনেকটা সিমিলার শব্দ। অর্থগত দিক দিয়ে একই! আবার শ্রুতিমাধূর্যতার জন্য প্রোপার্টি শব্দটা পার্ফেক্ট। সবদিক বিবেচনা করে এটা ব্যবহার করা হয়েছে। দু-একজনকে কমেন্ট বক্সে বিষয়টা বলতে দেখলাম। সেজন্য বললাম। তবুও ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। 🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here