‘প্রেম প্রাঙ্গণ’🍂
|পর্ব-১২|
~সুনেহরা শামস
.
.
“আইজা কে সাহিল??”
প্রেমের মুখে আইজার নাম শুনে সাহিলের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।মূলত তারা সবাই ছাদে এসেছিল,,সবাই বলতে সাহিল,সুহা,প্রেম আর শম্পা,,সুহার ঘুম পাওয়ায় সে নিচে চলে যায় আর শম্পা তার কাজে।বাকী ছিল প্রেম আর শাহিল,,সাধারণ কথার মাঝে হুট করে এরকম একটা প্রশ্ন অবাক হওয়ার বিষয়ই বটে!
সাহিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না,,আমতা আমটা করে কিছু একটা বলার আগেই প্রেম বলে উঠে,,
“যা বলবেন সত্যি বলবেন সাহিল”
সাহিল এবার আর কি বলবে?প্রেম আগেই তো নিষেধ করে দিল মিথ্যা বলার,,সাহিল কিছুক্ষন বাদে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে শান্তসুরে বলে উঠে,,
“প্রাঙ্গণের ভালোবাসা”
প্রেমের চোখ স্বাভাবীক এর তুলনায় বড় হয়ে যায়,,ভেতরে ভেতরে মনে হচ্ছে কিছু একটা তার নয়,,কেমন যেন শূন্যতা বিরাজ করছে তার মাঝে।তার কারণ কি?সে জানেনা।জানার কথাও নয়,,প্রেম আকাশের দিকে চেয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে বলে উঠে,,
“দেখতে আমার থেকেও সুন্দরী তাই না??”
“সে যে হুবুহু তোমার মতোই দেখতে প্রেম,,,”
প্রেম চট করে সাহিলের দিকে তাকায়,,সাহিলের দৃষ্টিও তার দিকেই নিবদ্ধ।প্রেম দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলে,,তার মানে এই জন্য তাকে বিয়ে করেছে প্রাঙ্গণ।রাগে-দুঃখে চোখের কোনে পানি জমা শুরু করে তার।সে তার প্রেমিকার মতো দেখতে তাই তাকে এভাবে বিয়ে করল প্রাঙ্গণ??কিন্ত আরেকটা প্রশ্নও উদয় হয় প্রেমের মনে।যদি তার প্রেমিকা থেকেই থাকে তাহলে তাকে কেন বিয়ে করল প্রাঙ্গণ।মনের প্রশ্ন মনে না রেখে প্রেম প্রশ্ন করেই ফেলে,,
“আচ্ছা সেই মেয়ে এখন কোথায়??সে থাকতে আমাকে কেন বিয়ে করলেন প্রাঙ্গণ??”
“সে যে আর এই দুনিয়াতেই নেই প্রেম,,”
প্রেম শুনল!দুই মিনিট সময় নিয়ে বুঝল,,নেই মানে কী??স্তব্ধ হয়ে বসে আছে প্রেম।কেন জানি বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।আড়ষ্ট গলায় বলে উঠে,,
“কীভাবে মারা গেল সে?”
“পয়সনের কারণে”
“মানে?”
সাহিল দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,,
“প্রাঙ্গণের মা তাকে পয়সন দিয়ে মেরে ফেলেছিল”
প্রেমের এবার দমবন্ধ হয়ে আসে,,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার,,মনে হচ্ছে কে জানি গলা চেপে ধরেছে।
“পানি খাবে?”
সাহিল পানি এগিয়ে দিলে প্রেম একনিশ্বাসে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নেয়।কেন জানি বিশ্বাস করতে পারছে না প্রেম।একজন মা সবসময় ছেলের যেমন ভালো চায় তেমনি তার খুশি,,তার হাসিটাও মুখে দেখতে চায়।সেখানে প্রাঙ্গণের মা তার ছেলের খুশিটাই কেড়ে নিল??
“কেন করল এমন সে??”
সাহিলের কেন জানি বলতে মন চাচ্ছে সব সত্যিগুলো,,সে কিছু না বলে উঠে যেতে নিলে প্রেম হাত চেপে ধরে সাহিলের।সাহিল পিছনে ঘুরে তাকায়,,প্রেমের নাক-মুখ লাল হয়ে আছে,,এত শক্ত করে হাতের কব্জি ধরেছে যে প্রেমের নখগুলো তার হাতে দেবে যাচ্ছে,,সাহিল ব্যথা পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।হাত ছুটিয়ে চলে যেতে নিলে প্রেম ভেজাকন্ঠে বলে উঠে,,
“এখন এখান থেকে এক পা নড়লে কিন্তু ভালো হবে না সাহিল,,আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই।”
সাহিল প্রেমের মুখোমুখি হয়,,একদম তার চোখে নিজের চোখ রাখে,,প্রেমের চোখে এখন অনেক প্রশ্ন,,অনেক ব্যাথা,,অনেকগুলো অজানা কষ্ট বিরাজমান।সাহিল হালকা স্বরে বলে উঠে,,
“তোমার কি কষ্ট হচ্ছে প্রেম??আর কষ্ট হলেও কার জন্য?? আইজার জন্য নাকি প্রাঙ্গণের জন্য??”
প্রেম থমকে যায়।আসলেই কার জন্য কষ্ট হচ্ছে তার?আইজার এমন নির্মম মৃত্যুর জন্য?নাকি তাদের বিচ্ছেদের জন্য? নাকি প্রাঙ্গণের জন্য?মাথায় প্রশ্নগুলো জটলা পেকে যাচ্ছে।প্রেম সাহিলের দিকে চেয়ে বলে উঠে,,
“আমার প্রশ্ন এড়িয়ে নিজে প্রশ্ন করছেন??আগে আমার উত্তরগুলো চাই সাহিল।”
সাহিল গিয়ে ছাদের কর্ণারে দাঁড়ায়,,প্রেমও তার পিছুপিছু যায়।রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সাহিল।আকাশ হলুদ-কমলা রঙ ধারণ করেছে,,সূর্য ডুবুডুবু ভাব!আকাশ দেখে মনে হচ্ছে কোনো শিল্পী তার রঙ-তুলি দিয়ে সুন্দর করে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এই সুন্দর মনোরম পরিবেশটি তৈরী করেছে।।
“আশ্রমে বড় হয়েছে আইজা আর বোর্ডিং এ প্রাঙ্গণ।মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও প্রাঙ্গণের বোর্ডিং এ থাকার ব্যপারটা একদমই আশ্চর্যজনক!তার মা-বাবা অনেক ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে,,তাই তারা ছেলেকে মানুষ করার সেই সময়টুকুও পেত না।এদিকে প্রাঙ্গণ ছোট থেকে একদম চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ ছিল,,কখনো হাসি তার মুখে দেখা যেত না।বোর্ডিং স্কুলেও কারো সাথে বেশী মিশত না।আমার মা-বাবা ছিল না,,আমাকে বোর্ডিং স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল সেই স্কুলেরই এক মিস।কিভাবে কিভাবে যেন আমি প্রাঙ্গণের বন্ধু হয়ে গেলাম,,একদম কাছের বন্ধু।(কথাটুকু বলেই হালকা হাসে সাহিল)একসাথে আমরা চলাফেরা করতাম কিন্তু কখনোই প্রাঙ্গণের মুখে হাসির রেখাও দেখতাম না।পড়ালেখায় বেশ শার্প ছিল প্রাঙ্গণ,,কিন্তু বোর্ডিং এর ছেলেমেয়েগুলোর সাথে তার ঝগড়া মারামারি বেশী হত।একসময় সেখানের টিচারস-স্যাররা না পেরে প্রাঙ্গণের মা-বাবার কাছে বিচার দেয় আর বোর্ডিং থেকে বের করে দেয়।জানো,,বের করে দেওয়ায় প্রাঙ্গণকে দুইদিন ঘর বন্দি রাখে তার বাবা”
প্রেম এতক্ষন সবই শুনলো।কেন জানি তখনকার ছোট্ট প্রাঙ্গণের জন্য মন ভীষণ খারাপ হচ্ছে প্রেমের।আর প্রাঙ্গণের মা-বাবাই বা কেমন?নিজেদের ছেলেকে কেউ এভাবে মানুষ করে নাকি?তাও আবার একটা মাত্র ছেলেকে?
“তারপর??”
প্রেমের বলা উক্ত শব্দটি শুনে সাহিল আবার বলতে শুরু করে।
“প্রাঙ্গণে বাবার সোসাইটিতে অনেক নাম-ডাক আছে,,তার ছেলেকে এভাবে পড়াশুনা বন্ধ করে ঘরে বন্দি রাখলে তারই নাম খারাপ হবে।তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে আবার ভর্তি করাবে তবে অন্য বোর্ডিং-এ।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাঙ্গণকে অন্য একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।প্রাঙ্গণ ছাড়া আমার ভীষণ একা একা লাগত,,তাই আমিও এসে পড়ি সেই স্কুলে,,আমার খরচ তখন সম্পূর্ণ সেই মিস চালাতো কারণ তার কোনো সন্তান ছিল না।আমাদের পড়ালেখা চলতে থাকে সেই নতুন বোর্ডিং স্কুলে।আমাদের প্লে-গ্রাউন্ড এর পাশেই ছিল একটা অনাথ আশ্রম।সেখানে অনেক অনাথ ছেলে-মেয়ে থাকত,,কাউকে সেখানে রাস্তা থেকে তুলে আনা হতো,,কাউকে মা-বাবা দায়িত্ব নিতে না পারলে রেখে যেত,,আবার কেউ অস্তিত্ববিহীন ও ছিল।তাদের মধ্যে একজন ছিল আইজা।আইজা জন্মের পর থেকে এই আশ্রমেই থাকত।গোলগাল,পিচ্ছি মেয়েটাকে একদেখায় যে কেউ ভালোবেসে ফেলত সেখানে প্রাঙ্গণ তো কিছুই না…মজার হলেও সত্যি যে তাদের বন্ধুত্বটা একমাসও লাগেনি জমতে।তাদের একসাথে চলার পথে অনেকবার হাসোজ্জল চেহারা দেখেছি আমি প্রাঙনের।হাসি,মজায় দিন কাটতো আমাদের তিনজনের।কিন্তু আইজাকে পেয়ে আমাকে কখনো প্রাঙ্গণ অবহেলা করেনি।এভাবেই একসাথে আমাদের তিনজনের ৩ বছর কেটে যায়,,তখন আমরা স্কুল গন্ডি পার করে কলেজে জীবনে পা রাখি।”
প্রেমের কথাগুলো শুনে কেন জানি ভেতরে ঈর্ষা কাজ করছে একপ্রকারের।মন চাচ্ছে আইজার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দিতে,,প্রাঙ্গণের কত কাছাকাছি ছিল আইজা,, সে থাকলে ব্যপারটা মন্দ হতো না।কিছু বলতে নিব্র তখনই নিচ থেকে শম্পার গলা শোনা যায়,,
“সাহিল ভাইইই,,প্রাঙ্গণ ভাইয়ে আফনেরে ডাকতাছে,,ফ্রেম আফারে নিয়া জলদি নিচে আহেন।”
~~~
সুহা সোফায় বসে বসে প্রিঙ্গেলস চিবুচ্ছে আর টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখছে।এমন সময় সাহিলের আগমন ঘটে,,এসেই সুহার পাশে বসে পড়ে।সুহার হাত থেকে দুটো চিপস নিয়ে মুখে পুড়ে নেয়,,চিবুতে চিবুতে সুহাকে আঙুল দিয়ে গুতো মারে,,সুহা বিরক্তি নিয়ে সাহিলের দিকে তাকায়,,
“কি হয়েছে??”
“দেখ টিভিতে আমাদের দেখাচ্ছে”
সুহা ভ্রু-কুচকে বলে উঠে,,
“কোথায়?”
“ঐযে ছোট ইদূর মানে জেরিটা আমি আর টম তুমি,,হাউ কিউট!!”
সুহা ভ্রু-কুচকে ঠোঁট উলটে আরেকটা চিপস মুখে পুড়ে দেয়,,মনোযোগ সহকারে কার্টুন দেখতে থাকে।এদিকে সাহিলের ভালো লাগছে না,,এই কার্টুন দেখার বয়স তার আছে নাকি??কিছুক্ষন বসে পা ঝুলায় সাহিল,,সময় এখন আর তার কাটছে না।কি করবে ভাবতে ভাবতে চোখ যায় রিমোটের উপর,,হ্যা এখন সে এই রিমোটটা নিয়ে নিবে,,তাহলে অন্তত সুহা তাকে এটেনশিন দিবে।
যেই ভাবা সেই কাজ,,টুক করে রিমোটটা কেড়ে নিয়ে টিভি অফ করে দেয় সে।এদিকে সুহা মুখে থাকা চিপসটা চাবানো অফ করে বিরক্তি নিয়ে তাকায় সাহিলের দিকে।সাহিল দাত কেলিয়ে বলে উঠে,,
“সুহাবেবি,,চলো কোথাও ঘুরে আসি”
“আমি যাব না,,রিমোট দাও”
কাঠকাঠ জবাবে সাহিল প্রথমে চুপ হয়ে গেলেও আবার বলে উঠে,,
“তাহলে চলো আমরা আইসক্রিম খেতে যাই,,তোমার তো ফেবরেট তাই না?”
“না আমি খাব না,,রিমোট ফেরত দাও আমার।”
সাহিল এবার বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,,
“দিব না মানে দিব না,,কি করবে তুমি?”
সুহাও এবার তেজী কন্ঠে বলে উঠে,,
“দিবে না তুমি?”
“না”
“দিবে না?”
“না মানে না”
সুহা আশেপাশে তাকায়,,বেড থেকে কুশন নিয়ে ছুড়ে মারে সাহিলের দিকে।হুট করে ছুড়ে মারায় সাহিল ধরতে না পারায় নিচু হয়ে যায়।বালিশ গিয়ে লাগে শম্পার মুখে!দরজার সামনে শম্পা দাঁড়িয়ে ছিল তা কেউ লক্ষ্য করেনি।সুহা জিভ কেটে ঘুরে যায় পিছনের দিকে,,সাহিল উঠে দেখে কাদোকাদো চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে শম্পা।সাহিল কিছু বলতে নিবে তার আগে শম্পা বলে উঠে,,
“সাহিল ভাই,,এইডা কোনো কাম করল আপনের বউ?আজকেই মুহে ডাইল বাইট্টা দিছিলাম,,আর হেয় আমার চেহারায় এই কুসুম মারল?এহন যদি আমার চেহারায় কিছু উডে?”
সুহা পিছনে ঘুরেই বলে উঠল,,
“ঐটা কুসুম না,,কুশন বলে।আর কুশন কি এমন জিনিস যে তোমার মুখে কোনো দাগ হবে?”
“আফনে চুপই থাহেন,,নিজে তো সুন্দরী এর লেইগা আফনের তো কিছু না,,যত্তসব”
~~~
গভীর রাত!নিস্তব্ধ সব কিছু!বাইরের ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলো ব্যতীত কোনো আলো নেই।আবছা আলোর জানালার পাশে বসে আছে প্রেম,,৬ তলার নিচের জনবহুল রাস্তা দেখা যাচ্ছে,,তাতে সারি সারি কত যানবাহন যাচ্ছে,,এই রাতেও রাস্তায় এমন গাড়ির চলাফেরা দেখে একটু অবাকই হয় প্রেম!
সে এখনো জেগে আছে মূলত প্রাঙ্গণের আশায়,,কিন্তু প্রাঙ্গণের কোনো খোজ-খবর নেই।আজকে বিকালের দিকে বাড়িতে আসলেও শুধুমাত্র সাহিলের সাথে কথা বলেই চলে গেল,,তার কোনো খোজও নিল না।মনের কোনে সূক্ষ্ম অভিমান জমে আছে তার,,কিন্তু যখনই সাহিলের বিকালের বলা কথাগুলো মনে পড়ে,,তখনই অভিমানগুলো কীভাবে যেন ঝরে যায়।আচ্ছা আইজা নামের মেয়েটা তার মতো দেখতে কেন ছিল?তার সাথে তো কোনো জন্মসূত্রও নেই প্রেমের,,যতটুকু জানে তার পরিবারে তার মতো দেখতে কেউ নেই,,শুধু তার মায়ের সাথেই তার চেহারার মিল আছে।আচ্ছা তার কি কোনো বোন ছিল?কিন্তু থাকলে নিশ্চয়ই বাবা-মা তাকে জানাতো।প্রশ্নের গোলকধাঁধায় যেন নিজেই ফেসে যাচ্ছে প্রেম।দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বাইরের তাকিয়ে থাকে প্রেম।
“প্রেম!”
পিছনে ঘুরে তাকায় প্রেম!দেখে সুহা দাঁড়িয়ে।
“তুই?এই সময়?”
“কেন বাড়ি কি তোর একার নাকি?”
প্রেম সুহার মাথায় আস্তে চাটি মেরে বলে উঠে,,
“এই বাড়ি আমার কবে থেকে হলো আবার?”
“বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই মেয়েদের আসল ঠিকানা।”
“ইশ একদম মুরুব্বি নানী-দাদীদের মতো জ্ঞান দেয়া হচ্ছে?নিজেও তো এই বাড়ির বউই এখন”
“এহহ,,এখন আমাকে জ্ঞান দিবি না কোনো।এভাবেই আমি প্রচুর জ্ঞানী!”
প্রেমের এই মুহূর্তে হাসি পাচ্ছে না কেন জানি।আজকের সাহিলের বলা কথাগুলো,,প্রাঙ্গণের এমন এড়িয়ে চলা কেন জানি মাথার ভেতর ঘুরছে তার,,মনের ভিতর কথাগুলো,,প্রাঙ্গনের ব্যবহার এখনো গেথে আছে।প্রেম জানালার দিকে চোখ রাখে…
প্রেমকে এমন অন্যমনষ্ক দেখে সুহা প্রেমের কাধে হাত রাখে,,,
“কিছু কি হয়েছে প্রেম?”
প্রেম বাইরে তাকিয়েই উত্তর দেয়,,
“না রে,কি হবে?”
সুহা এবার আসামগিরি করে প্রেমের সামনে বসে পড়ে,,প্রেমকে নিজের দিকে ঘুরায়,,
“সত্যি করে বল কি হয়েছে??আমাকে বলবি না?”
প্রেম আস্তে করে সুহাকে জড়িয়ে ধরে,,সুহা বুঝতে পারে যে প্রেমের মন খারাপ।সে প্রেমের পিঠে হাত বুলায়,,
“কি হয়েছে প্রেম?প্রাঙ্গণ ভাই কিছু বলেছে তোকে?”
“সাহিল যদি কখনো তোকে এড়িয়ে চলে,,তুই তখন কি করতি?”
সুহা প্রথমে অবাক হলেও পরে দাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,,
“ওকে তো আমি হলুদের মতো পাটার নিচে পিষে দিতাম”
“ওহ,,”
“কেন জিজ্ঞেস করলি এই কথা বলতো?প্রাঙ্গণ ভাইও কি তোকে এড়িয়ে চলছে নাকি?”
আজকের ঘটনার সবটুকু বলল প্রেম সুহাকে শুধু সাহিলের বলা কথাগুলো বাদে।সুহা সব শুনে কিছুক্ষন চুপ থাকলেও পরবর্তীতে প্রেমকে হালকা স্বরে বলে উঠে,,
“তুই কি প্রাঙ্গণ ভাইকে ভালোবাসিস প্রেম?”
প্রেম থমকে যায়!এক মুহূর্ত ভাবে!আচ্ছা এই প্রশ্ন কি কখনো নিজে করেছে প্রেম?না করা হয়নি।এমন কোনো কারণ বা পরিস্থিতির এখনো সম্মুখীন হয়নি সে।কিন্তু আজকের প্রশ্নটা তাকে ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে।
উত্তর এর অপেক্ষায় থাকায় যখন কোনো উত্তর পেল না সুহা তখন প্রেমকে একবার ঝাকিয়ে বলে উঠে,,
“কিরে বল,,ভালোবাসিস প্রাঙ্গণ ভাইকে?”
“হয়তো!!!”
‘প্রেম প্রাঙ্গণ’🍂
|পর্ব-১৩|
~সুনেহরা শামস
.
.
আজকে প্রেম আর প্রাঙ্গণ ঘুরতে বের হয়েছে।তেমন কোনো যৌক্তিত কারণ ছিল না,,প্রেম জোড় করে টেনেটুনে নিয়ে এসেছে প্রাঙ্গণকে বাইরে।প্রাঙ্গণও আর মানা করেনি।
বাইরে ভীষণ ঠান্ডা,,চারপাশে কুয়াশারা যেন খেলা করছে,,শীতের প্রকোপ বেশি না থাকলেও একটা জ্যাকেট সইতে পারে এমন শীত।প্রাঙ্গণ প্রথমে গাড়ি নিয়ে বের হতে চাইলেও প্রেমে উদ্ভট বায়নার কাছে তার হার মানতে হয়।তার আবদার ছিল এরকম যে,,আজ তারা সারাদিন হাটবে আর ঘুরে বেড়াবে,,যদি তার বেশী কষ্ট হয় হাটতে তাহলে রিকশায় উঠবে।প্রাঙ্গণ জানে যে বেশী হাটতে পারবে না প্রেম,,রিকশা তাকে নিতেই হবে।তাই আর না করেনি।এখন তারা পাশাপাশি হাটছে।প্রাঙ্গণের গায়ে ব্ল্যাক টি-শার্ট,চকলেট ডেনিম জ্যাকেট,ব্ল্যাক জিন্স,কানে ইয়ারপড, চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস আর হাতে চকলেট কালারের রিস্টওয়াচের সাথে ব্ল্যাক কনভার্স।আর সেই চিরচেনা মন-মাতানো পারফিউম!প্রেমের গায়ে কুর্তির সাথে লেদার ব্ল্যাক জ্যাকেট আর চুল পনিটেইল করে বাধা।এককথায় দুজনকে ‘পারফেক্ট পেয়ার’ লাগছে।
প্রেম বারবার লাফ দিচ্ছে সেই বিষয়টা ভালোভাবে লক্ষ্য করছে প্রাঙ্গণ।রাস্তায় এমনভাবে লাফানোর কোনো কারণ দেখছে না প্রাঙ্গণ,,এদিকে মানুষও তার দিকে তাকিয়ে আছে।প্রাঙ্গণ বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?এমন ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছো কেন রাস্তার মাঝে?”
প্রেম লাফানো বন্ধ করে প্রাঙ্গণের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বলে উঠে,,
“আমি ব্যাঙ??”
“না,,ব্যাঙাচির মা!”
“কি বললেন?আমি ব্যাঙাচির মা?”
কপট রাগ নিয়ে প্রেমের বলা এই কথাটি প্রাঙ্গণের উপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলল না।প্রেম মুখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে থাকে,,কঠিন অবরোধ!আজ সে এখান থেকে প্রাঙ্গনের সরি না বলা পর্যন্ত নড়বে না,,নড়বে না মানে নড়বে না!
প্রাঙ্গণ হাটতে হাটতে নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব লক্ষ্য না করায় পিছে ঘুর তাকায়,,প্রেম দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গায়,,তার চেহারা দেখে কিছুটা একটা আন্দাজ করতে পারে প্রাঙ্গণ।পিছু ঘুরে এগিয়ে যায় প্রেমের কাছে,,সামনে তুরি বাজিয়ে বলে উঠে,,
“না যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছ নাকি?”
প্রেম মুখ ঘুরিয়ে নেয়,,প্রাঙ্গণ বুঝে!প্রেমের রাগ সহজে ভাঙা যাবে না।প্রাঙ্গণের প্রেমের হাত ধরে টান দেয়,,প্রেম শক্ত হয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে,,যেন আজ সে শপথ করেছে এখান থেকে একপাও নড়বে না।প্রাঙ্গণ আরো জোরে টান দেয়,,কিন্তু এখনও প্রেমকে নড়াতে পারে নি।নিজের সর্বশক্তি দিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে প্রেম।প্রাঙ্গণ হাত ছেড়ে দেয়,,সেদিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নেয় প্রেম।হুট করে প্রেমকে কোলে তুলে নেয়,,বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় হয়ে আসে প্রেমের,,চোখ তুলে তাকায় প্রাঙ্গণের দিকে,,যে এখন সামনের দিকে তাকিয়ে হাটছে।এত সহজে গলে গেলে চলবে না,,প্রেম এবার মোচড়ানো শুরু করে।প্রাঙ্গণ বিরক্ত হয়,,
“এনি প্রবলেম??”
প্রেম মোচড়াতে মোচড়াতে বলে উঠে,,
“আমাকে নিচে নামিয়ে দিন,,যাব না আপনার সাথে আমি,,নিষ্ঠুর লোক একটা!”
“সত্যিই নামিয়ে দিব?”
“হ্যাঁ,,ছাড়ুন আমাকে।”
এবার প্রাঙ্গণ যা করল তাতে অবাক প্রেম!কারণ এখন সে রাস্তার মাঝে পড়ে আছে।প্রাঙ্গণ তাকে ছেড়ে দিয়েছে,,প্রেম ঠোট উলটে প্রাঙ্গণের দিকে চোখ তুলে তাকায়।প্রাঙ্গণের দৃষ্টি সামনের দিকে নিবদ্ধ,, আদেও সামনে চেয়ে আছে নাকি প্রেম জানে না কারণ এখনো প্রাঙ্গণের চোখে সানগ্লাস।
কিছুক্ষন পর প্রাঙ্গণ হাটুগেড়ে তার সামনে বসে পড়ে,,
“ছেড়ে দিলাম,,ওকে??”
ছলছল চোখে প্রাঙ্গণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,,
“নিষ্ঠুর ব্যাক্তি একটা!”
প্রাঙ্গণ শুনে,,উঠে দাঁড়ায়।হাটা ধরে সামনের দিকে,,প্রেম ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠে,,
“এই আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
প্রাঙ্গণ পিছনে না ঘুরেই বলে উঠে,,
“নিষ্ঠুর ব্যক্তির সাথে কোথাও যাওয়া লাগবে না,,স্টে হেয়ার!”
প্রেম উঠে দাঁড়ায়,,জামা-কাপড় ঝাড়া দেয়।গটগট করে হেটে পাশে যায় প্রাঙ্গণের।প্রাঙ্গণের দৃষ্টি এখনো সামনের দিকে,,প্রেম বুঝে না এ লোক এমন কেন?
.
প্রেম আর প্রাঙ্গণ এখন আইস্ক্রিম পার্লারের সামনে দাঁড়িয়ে।হাটতে হাটতে প্রেমের গলা শুকিয়ে গেছে,,তাই এখন তারা আইস্ক্রিম পার্লারের সামনে দাড়িয়ে।এই পর্যন্ত দুটো আইস্ক্রিম শেষ,,তিনবারটাও শেষের দিকে,প্রেম একাধারে খেয়েই যাচ্ছে।এদিকে প্রাঙ্গণের ভীষণ গরম লাগছে!কতক্ষন যাবত এখানে দাঁড়িয়ে তারা,,প্রেম ধীরগতিতে আইসক্রিম খেয়েই যাচ্ছে।প্রাঙ্গণ জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,,উপরের শার্টের দুটো বোতাম খোলা,,তবুও ঘামগুলো যেন শরীর বেয়ে বেয়ে পড়ছে।প্রাঙ্গণকে অনেকবার খাওয়ার জন্য জোড় করেছিল প্রেম কিন্তু সে খায় নি।
প্রেম খেতে খেতে লক্ষ্য করে প্রাঙ্গণকে,,দেখে মনে হচ্ছে তার অবস্থা খারাপ।কে জানত??সকালের এই ঠান্ডা দুপুরে কাঠফাটা রোদে পরিণত হবে??কিন্তু সে তো প্রাঙ্গণকে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বলেছিলই কিন্তু সে খায়নি।তাতে তার কি করার?প্রেম আবার নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দেয়,,কিন্তু আমার মায়া লাগে প্রাঙ্গণের জন্য,,বেচারার ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা।প্রেমের চোখ যায় তার হাতে থাকা টিস্যুটার উপর,,আইসক্রিম রেখে মুখোমুখি দাঁড়ায় প্রাঙ্গণের,,প্রাঙ্গণ এক ভ্রু উচু করে তাকায় প্রেমের দিকে।প্রেম আস্তে করে টিস্যু দিয়ে প্রাঙ্গণের কপালের ঘামগুলো মুছে দেয়।প্রাঙ্গণ নিরব চোখে প্রেমের দিকে তাকায়,,কপালের ঘাম মুছে প্রাঙ্গণের গলা মুছে দেয় প্রেম।যত সামনের দিকে যাচ্ছে ততই ঘন ঘন শুকনো ঢোক গিলছে প্রেম।তার কাজ শেষ হলে সরে যেতে নিলে প্রাঙ্গণ হাত টেনে ধরে,,
“বুকটাও মুছে দাও,,”
প্রেম বড়সড় শুকনো ঢোক গিলে,,নজর দেয় প্রাঙ্গণের বুকে।আসলেই লোমশ বুকেও ঘাম বেয়ে পড়ছে।প্রেম আমতা আমতা করে বলে উঠে,,
“আপনিই মুছে নিন,,এই যে টিস্যু।”
প্রেম টিস্যু দিয়ে সড়ে যেতে নিলে প্রাঙ্গণ প্রেমের হাত শক্ত করে আকড়ে ধরে,,প্রেমের দেওয়া টিস্যুটি আবার প্রেমের হাতেই ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠে,,
“এখনই কাজটুকু শেষ না করলে এখানে দাড় করিয়ে দশটা আইসক্রিম ফিনিশ করতে হবে।চয়েজ ইজ ইউরস”
প্রেম হা করে প্রাঙ্গণের বলা কথাটুকি শুধু গিলল,,কিন্তু আদেও তার বলা কথাটুকু সত্যি নাকি মজা করল প্রেম বুঝল না।
“আপনি মজা করছেন তাই না??”
“আমি তোমার সাথে কখনোই মজা করি না প্রেম,,ইজ দ্যাট ক্লিয়াল?”
প্রেম শুকনো ঢোক গিলল,,সে জানে প্রাঙ্গণ কখনো মিথ্যা বা মজা করে না।তবুও মনকে শান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেছিল,,প্রেম কিছু বলতে নেয় তার আগেই প্রাঙ্গণ বলে উঠে,,
“আর দশটা আইসক্রিম প্লিজ,,”
প্রেম এবার হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠে,,
“এই না না,,করছি”
প্রেম কাপাকাপা হাতে প্রাঙ্গণের বুকে হাত রাখে,,চোখ আপনায়াপনি বন্ধ হয়ে যায় তার।প্রাঙ্গণ একদৃষ্টে লক্ষ্য করে প্রেমের চেহারা,,চোখ-মুখ কুচকে আছে,,হাত কাপছে,,ভ্রু-গুলোও হালকা কুচকে আছে,,গালগুলো হালকা লাল হয়ে আছে।প্রাঙ্গণ হাসে!অবিকল আইজা এই মেয়ে,,সাধারণ ছোটখাটো বিষয়ে লজ্জা পাওয়া যেন তার নিজের ব্যক্তিত্ব ছিল,,যদিও প্রাঙ্গণের ভালো লাগত তার সেই ভয়ার্ত-লজ্জামাখা চেহারা।তাইতো ইচ্ছাকৃতভাবে কতবার লজ্জা পাইয়েছে আইজাকে তা হাতে গণার বাইরে।
প্রাঙ্গণের সম্মতি ফিরে,,বুঝতে পারে,এই মেয়ে য়ার আইজা না,,আইজাকে সে যতটা ভালোবাসতো আদেও কি প্রেমকে সেভাবে আগলে রাখা সম্ভব?
হাতের এপার-ওপার হয়ে যায় একটি গুলি,,প্রাঙ্গণ ব্যথায় চোখ বুজে নেয়।এদিকে প্রেম ভয় পেয়ে যায়,,মুখে দুইহাত চেপে ধরে।প্রাঙ্গণের হাত দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত হাত বেয়ে পড়ছে,,প্রেমের মস্তিষ্ক এখনো ধারণ করতে পারছে না এই ঘটনাটি।এগিয়ে যায় প্রাঙ্গণের কাছে,,কালো শার্টে যদিও রক্তগুলো বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু হাত বেয়ে রক্তগুলো পড়ছে তা বেশ দেখা যাচ্ছে।
প্রাঙ্গণ চোখ তুলে উপরে তাকায়।কালো গাড়ি,,গ্লাসও কালো,,ভেতরের কিছু দেখা যাচ্ছে না।তার মানে শুট করেই গ্লাস লাগিয়ে দিয়েছে তারা,,গাড়ির সামনের দিকে চোখ যায় প্রাঙ্গণের।এবার সবকিছু ক্রিস্টাল ক্লিয়ার প্রেমের কাছে,,বাকা হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়,,হাত অবশ হয়ে আসছে তার।প্রেমের দিকে চোখ যায় প্রাঙ্গণের,,চোখ ছলছল করছে,,ভীত দৃষ্টি নিয়ে তার হাতের দিকে চেয়ে আছে।প্রেমকে আরেকহাত দিয়ে আগলে ধরে প্রেমকে,,
“ভয়ের কিছু নেই প্রেম,,রিলেক্স!”
“আপনার হাত থেকে রক্ত ঝরছে প্রাঙ্গণ,,”
প্রেমের মুখে প্রথমবার নিজের নাম শুনল প্রাঙ্গণ,,না,মন্দ না।ভালো লাগছে তার কাছে,,ভীষণ রকমের ভালো।প্রাঙ্গণ প্রেমকে আরো একটু কাছে টেনে নেয়,,বুকের মাঝে চেপে ধরে,,
“আমার কিছু হলে কষ্ট লাগবে তোমার?”
প্রেম মাথা উচু করে প্রাঙ্গণের দিকে তাকায়।আসলেই কি তার কষ্ট লাগবে তার?আচ্ছা কাদের জন্য কষ্ট লাগে মানুষের?যাদেরকে তারা ভালোবাসে।কিন্তু প্রেম কী তাকে ভালোবাসে?আচ্ছা প্রেম তাকে ভালোবাসলেও প্রাঙ্গণকী তাকে ভালোবাসে?নাকি এখনো আইজাই আছে তার মনে?ভাবনাগুলোর মাঝেই শব্দ আসে,,
“স্যার আপনার আইসক্রিম গুলো…”
~~~
প্রেম আর প্রাঙ্গণ মাত্রই ঘরে ঢুকল।সেখান থেকে বের হওয়ার পর তারা ডাক্তার এর কাছ থেকে প্রাঙ্গণের হাতের ড্রেসিং সেড়ে বাড়ি ফেরে।
বাড়িতে এসেই লক্ষ্য করে সোফায় কেউ একজন বসে আছে।ষাটোর্ধ ও স্মার্ট একজন মহিলা!প্রেমের তাই মনে হচ্ছে।সাহিল আর সুহা তার সাথে কথা বলছিল কিন্তু প্রাঙ্গণকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় সে।কাছে এসে জড়িয়ে ধরে,,প্রাঙ্গণও হাসি মুখে তাকে জড়িয়ে ধরে,,
“হাউ আর ইউ মাই সন”
“ফাইন মিস,,তুমি কেমন আছো?”
“এইতো ভালোই আছি”
এদের কথপোকথন শুনে প্রেম এতটুকু আন্দাজ করতে পারে যে এরা পরিচিত।সুহা কিচেনে গিয়েছে,,পাশেই সাহিল দাঁড়িয়ে।প্রেম সাহিলকে খোচা মেরে বলে উঠে,,
“এই সাহিল,,ইনি কে?”
“ঐ যে তোমাকে বলেছিলাম না?আমাকে একজন বোর্ডিং এ নিয়ে গিয়েছিল আর আমার সব খরচ সেই বহন করত।ইনি সেই মিসই”
প্রেম “ওহ” বলে মহিলার দিকে তাকায়।মহিলার চেহারায় কেমন যেন একটা পুরুষ পুরুষ ভাব আছে।কিন্তু এমন কেন লাগছে প্রেম বুঝতে পারল না।মনে হয় আজকের ঘটনায় তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।অবশ্য মাথা খারাপ করার মতোই ঘটনা।এরকমভাবে কেউ কাউকে কেন শুট করবে প্রেম বুঝল না,,কিন্তু এ ব্যপারে প্রাঙ্গণের মাথা ব্যথা নেই বললেই চলে।কি সুন্দর হেসে-খেলে কথা বলছে।যেন সে জানে,এই কাজ কে করেছে।
প্রেমের ভালোলাগছে না,,ফ্রেশ হওয়ার জন্য উপরে যেতে নিলে সেই মিস তাকে ডাক দেয়,,
“আমার সাথে পরিচিত হবে না প্রেম ডিয়ার?”
প্রেম পিছনে ঘুরে তাকায়,,গলার মধ্যেও এই মহিলার পুরুষ পুরুষ একটা ভাব আছে।কিন্তু এমন কেন?প্রেম একটু হেসে বলে উঠে,,
“কেন হবো না??আসলে ফ্রেশ হতে যাচ্ছিলাম”
“ফ্রেশ পরে হবে,,চল তো একটু কিচেনে যাই”
প্রেম একটু অবাকই হয় বটে।পরিচিত হওয়ার জন্য কিচেনে কেন যাবে?প্রেম কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্রাঙ্গণ বলে উঠে,,
“মিসের সাথে যাও,,আমি রুমে যাচ্ছি।ফ্রেশ হয়ে এসে যেন তোমাকে রুমে পাই”
প্রেম বুঝল না প্রাঙ্গণ কি তাকে আদেশ দিল নাকি হুমকি দিয়ে গেল।প্রেম আর কিছু না ভেবে মিসে পিছু পিছু যায়।
.
সুহা কিচেনে বসে বসে একের পর এক পাস্তা খেয়েই যাচ্ছে।মূলত ওই মিসের জন্যই এসবের আয়োজন করা হয়েছিল কিন্তু সে বেশী কিছু খায়নি।আর এখানে সে খেয়েই সব শেষ করছে,,মিস আর প্রেমকে দেখে সুহা মুখ বন্ধ করে ফেলে।এদিকে প্রেম মিটিমিটি হাসছে,,সুহার পুরনো অভ্যাস,,বাড়িতে কারো জন্য কিছু তৈরী করা হলে যদি কিছু বেচে যায়,সেগুলো সব সুহার পেটেই যাবে।
সুহা জানত না যে মিস এদিকে এসে পড়বে।এখন যদি দেখে যে এভাবে পেটুকের মতো সুহা খেয়েই যাচ্ছে তাও আবার তার জন্য বানানো খাবারগুলো।তাহলে কি ভাববে?সুহা মুখভর্তি খাবার এখন ফালাবে কোথায়?মিস হেসে বলে উঠে,,
“খাবার নিয়ে ঘরে চলে যাও,,এভাবে লুকিয়ে খেতে হবে না।”
সুহা লজ্জায় লাল-নীল হয়ে যায়।খাবারের ট্রে নিয়ে সুরসুর করে ড্রইংরুমের দিকে রওনা দেয়।
প্রেম লক্ষ্য করে মিস আশেপাশে তাকাচ্ছে যেন কিছু খুজতেছে সে।প্রেম জিজ্ঞেস করে,,
“আপনি কি কিছু খুজছেন মিস?”
মিস খুজতে খুজতে বলে উঠে,,
“পেয়ে গেছি”
মিস গিয়ে কফির দুটো মগ,কফি পাউডার আর ফ্রিজ থেকে দুধ নিয়ে আসে।এখন কি উনি কফি বানাবেন নাকি?
“আপনি কি কফি বানাবেন মিস?আমি শম্পাকে বলে দেই,,ও বানিয়ে দিক”
“না না,আমি তোমাকে আমার স্পেশাল কফি খাওয়াবো,,জাস্ট ওয়েট”
প্রেম দেখতে থাকে,,নিজের মতো কফি বানিয়েই যাচ্ছেন।বানাতে বানাতে বলে উঠেন,,
“আমার নাম জানো তুমি প্রেম?”
“হ্যা জানি তো,,আপনার নাম মিস”
এদিকে তিনি কফি বানাতে বানাতেই হো হো করে হেসে উঠেন,,হাসতে হাসতেই জবাব দেন,,
“আমার নাম পূর্বা,,পূর্বা দত্ত”
“আপনি হিন্দু?”
প্রেমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলে উঠেন,,
“আমার আরো একটা পরিচয় আছে”
“কি??”
“আমি একজন ট্রান্স জেন্ডার!!”
প্রেম বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে পূর্বা নামক মানুষটির দিকে তাকায়।এতক্ষন যাবত যা যা দেখছে তা আসলেই ভুল নয়।প্রেম তাকে লক্ষ্য করে,,নিজ মনে তিনি কফি বানিয়েই যাচ্ছেন,,যেন তার নিজের বলা কথাগুলো তার উপর কোনো প্রভাবই ফেলেনি,,তিনি স্বাভাবিক,,একদম স্বাভাবিক!
“আপনার পরিবার কোথায়??”
প্রেমের প্রশ্নে পূর্বার চেহারায় মলিনতারা এসে ধরা দেয়।
“ছোটকালে এইসব বুঝতাম না,,জানো?মা-বাবা সবসময় এড়িয়েই চলত আমাকে।একসময় যখন বড় হই,,বুঝতে শিখি,তখন তাদের আমাকে এড়িয়ে চলার কারণটাও বুঝতে পারতাম।সময় যায় তারা আমাকে দূরে ঠেলে দেন,,বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন,,কিন্তু আমাদের মতো মানুষ দেখলে অন্য সবাই এমনেই বুঝতে পারে।বিয়ে হয় না দেখে তারা একসময় আমাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেন।তখন তো পড়াশুনা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল।ভেবেছিলাম অন্যসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সাথে বসবাস শুরু করব।কিন্তু পরবর্তী আমার দেখা হয় একজন ব্যাক্তির সাথে যিনি আমাকে পদে পদে সাহায্য করেছিলেন।আমাকে পড়াশুনা করিয়েছেন,,নিজের একটা জায়গা তৈরী করার সুযোগ দিয়েছিলেন।সে অনেক কাহিনী,,যেখানে মা-বাবা ভালোবেসে আপন করেনি সেখানে তিনি আমাকে বন্ধুত্বর হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে দাড় করাতে সাহায্য করেন।পরবর্তীতে জানতে পারি,,তিনি আমার প্রতি দুর্বল ছিলেন,,কিন্তু এসব কি আমাদের দ্বারা হবে?সরে গিয়েছিলেন আমার প্রত্যাখানের পর।নিজে প্রতিষ্ঠিত হই,,কিন্তু সেই মানুষটিকে আর পাশে পাই নি।কেন জানো?কারণ তিনি আমাকে নয় এই পৃথিবী ছেড়েই চলে গিয়েছিলেন।”
কথাটুকু শেষ করেই পূর্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।প্রেমের চোখে পানি টলমল করছে।কতটা লড়াই করে আজকে এই জায়গায় এসেছেন তিনি,,তাও আবার একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হয়ে।
“জানো?যখন আমি এই জবে ঢুকি তখন বাচ্চাদেরকে দেখলে মন চাইতো মাতৃত্বর সাধ অনুভব করতে।কিন্তু আমার কাছে কেউই আসত না,,হয়তো তারা ভয় পেত নয়তো মা-বাবাই শিখিয়ে দিত যেন আমার কাছে না আসে।আমিও আর তাদের কাছে যেতাম না,,কি দরকার?তাদেরকে ভয় দেখানোর?কিন্তু একদিন দেখা হয় সাহিলের সাথে,,তখন সাহিল রাস্তায় থাকত,মা-বাবার খবর সাহিলের জানা ছিল না।সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল,সাহিল আমাকে কখনো ভয় পেত না।সাহিলকে আমি নিয়ে যাই ঐ স্কুলে,,সাহিলের ব্রেইন তত ভালো না হলেও মোটামুটি ভালো রকমের ছিল,,আর দেখো সেই সাহিল আজ কত্ত বড়, এমনকি বিয়েও করে ফেলেছে।কয়দিন পর আমার ছোট্ট সাহিলেরও ঘরে ছোট আরো একটা সাহিল এসে পড়বে।”
প্রেম লক্ষ্য করে পূর্বার চোখে পানি টলমল করছে। কিসের পানি এগুলো?কষ্টের নাকি সুখের?প্রেম আদেও জানেনা।মানুষ এর জীবন বৈচিত্রময়।তাইতো,সকলে জীবন একভাবে উপভোগ করতে পারেনা।
“এই নাও আমার হাতের স্পেশাল কফি”
প্রেম কফিমগ হাতে তুলে নেয়।চুমুক দেয় কফিতে,,আসলেই আলাদা একটা টেস্ট আছে এই কফিতে।
“জানো,মামুনও আমার হাতের কফি খেতে ভীষণ ভালোবাসতো”
প্রেম বুঝতে পারে যে ঐ মানুষটির নাম মামুন।পূর্বা এগিয়ে আসে প্রেমের দিকে।প্রেমের কাধে হাত রাখে আর শান্তসুরে বলে উঠে,,
“দাত থাকতে দাতের মর্ম করতে শিখ প্রেম,,হয়তো আইজার কথা জানো তুমি।প্রাঙ্গণের প্রাণ ছিল আইজা কিন্তু এখন সে অনেক দূরে।প্রাঙণকে আপন করে নাও,,দেখবে প্রাঙ্গণ তোমাকে অনেক ভালো রাখবে ও ভালোবাসবে।জীবনকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত তাই না?”
প্রেম শুনে,,আদেও কি সে পারবে প্রাঙ্গণের আপন হতে?যেখানে এখনো তার মনে আইজার বসবাস,,তা প্রকাশ না করলেও সহজেই বোঝা যায়।প্রেমকে কেন প্রাঙ্গণ বিয়ে করেছে তা আজও জানতে পারেনি প্রেম।শুধুই কি এর কারণ সে আইজার মতো দেখতে?আর কিছু ভাবার আগেই শোনা যায় পূর্বার দুষ্টুমিমাখা কন্ঠ,,
“এর পর এসে কিন্তু ছোট প্রাঙ্গণকে দেখতে চাই”
চলবে…
[ভুল-ত্রুটি আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আজকের পর্ব সম্পর্কে একলাইনের একটি মন্তব্য ছেড়ে যাবেন।ধন্যবাদ।]
চলবে…
[ভুল-ত্রুটি আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আজকের পর্ব সম্পর্কে একলাইনের একটি মন্তব্য ছেড়ে যাবেন।ধন্যবাদ।]