#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(১০)
লাবিবা ওয়াহিদ
আজ রায়াফ সাড়ে ৪টার আগেই ঘুম থেকে উঠে বুকে হাত গুঁজে বসে আছে। এই কয়েকদিন সাড়ে চারটায় আফনা তাকে সেইদিনের মতোই ঘুম থেকে জাগিয়েছে। ব্যাপারটা আসলেই বিরক্তিকর। তাই আজ রায়াফ নিজেই উঠে বসে আছে। কিন্তু সাড়ে চারটার বেশি বেজে ফজরের আযান অবধি দিয়ে দিলো, আফনার খবর নেই। রায়াফ কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো। আজ আফনা এলো না কেন? রায়াফ আফনার কথা ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এভাবে দুইদিন কেটে গেলো। আফনা তাকে জ্বালাতন করে না ইনফেক্ট রায়াফের আশেপাশেও ঘেঁষে না। রায়াফ কেন যেন বারবার আফনার বিরক্তগুলো চাইছে, কিন্তু কেন? রায়াফকে আফনা বিরক্ত করছে না, এতে তো তার খুশি হওয়ার কথা। তাও কেন সে মানতে পারছে না? আজ হলুদের প্রোগ্রাম। রায়াফ মুখে মাস্ক পরে হলুদের ডেকোরেশন দেখছে। রায়াফের আসার মূল কারণ ডেকোরেশন নয়, আফনা। রায়াফ আশেপাশে আফনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গত ২দিন এই মেয়েটাকে না দেখে থেকেছে। রায়াফ জানে না মেয়েটার প্রতি তার দুর্বলতা ঠিক কোথায়? জানতেও চায় না শুধু একপলক আফনাকে দেখতে চায়। তৃষ্ণার্ত আঁখিপল্লব শুধু আফনাকেই খুঁজছে। দখিনা হাওয়ার মতো আফনা রায়াফের সামনে আবির্ভূত হলো। আফনা আর কলি হাসতে হাসতে হাতে ফুলে ডালা নিয়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছে। আফনার এই মনকাড়া হাসি দেখে রায়াফ সেখানেই জমে গেলো। মিনিট পাঁচেকের মতো থেকে রায়াফ পুকুরের ঘাটে চলে গেলো। এই জায়গাটা রায়াফের ভিষণ প্রিয়। তবে সেদিনের পর থেকে এখন চোখ-কান খোলা রেখেই সে ঘাটের সিঁড়িতে বসে। গ্রামে আসার প্রথম দিকটা বিরক্তি লাগলেও কয়েকটা দিন তার ভিষণ ভালো যাচ্ছে। ভালো যাওয়ার কারণটা হয়তো আফনা, নয়তো আশেপাশের মানুষগুলোর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ!
এসবই একপলকে সে পুকুরের অপরপ্রান্তে তাকিয়ে রয়েছে, সেখানে ইয়া বড় একটা কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। কী সুন্দর লাগছে দেখতে যেন আমার দেশের পতাকাকেই গাছটি স্মরণ করিয়ে দেয়। সবুজ পাতার ভাঁজে ভাঁজে রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার মিলনমেলা! বাতাসের তালে তালে উড়ছে যেন বৃষ্টির পূর্বাভাস। রায়াফের মস্তিষ্কে আবারও সেই গানটি উঁকি দিলো। রায়াফ দেরী না করে ফোন বের করে গানটি প্লে করে আবারও পকেটে ফোনটি ঢুকিয়ে নিলো।
“কিছু কথার পিঠে কথা..
তুমি ছুঁয়ে দিলে মুখরতা।
হাসি বিনিময় চোখে চোখে,
মনে মনে রয় বেকুলতা!”
এই ৪টি লাইন আজ মনের গহীন হতে অনুভব করলো রায়াফ। সে চোখ বুজে বাঁকা হাসি দিলো। আফনার বাঁদরামি ভেবে সে বড্ড আনন্দ পাচ্ছে আবার এসব হারিয়ে সামান্য কষ্টও হচ্ছে। তখনই নামলো বৃষ্টি। রায়াফ চোখ মেলে আকাশের পানে তাকালো। বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখশ্রী ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। আজ বৃষ্টিতে ভিঁজতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। তখনই কেউ জোরে বলে উঠলো,
-“ওয়াও বৃষ্টি! আদু, কলি ভিঁজতে চাইলে জলদি আয়!”
পরিচিত কন্ঠস্বর পেয়ে রায়াফ ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে তাকালো। আফনা দৌড়ে, লাফিয়ে বৃষ্টিতে ভিঁজছে। রায়াফ নিজের অজান্তেই হেসে উঠলো। মেয়েটা আসলেই পাগলি, সবসময় বাচ্চামো। রায়াফ মন ভরে আফনার বৃষ্টিতে ভেঁজা দেখলো। নিজেও যে ভিঁজে চুপ চুপা হয়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। রায়াফের এখন চিৎকার করে বলতে মন চাইছে, কেন এই বর্ষণ ক্ষণে ক্ষণে আসতে পারে না? কেন জীবনের বেদনা গুলোকে ধুঁয়ে দিয়ে জীবনটা রাঙিয়ে দেয় না? কেন এই বৃষ্টিবিলাসীর সাথে এই বর্ষণে এতটা তৃপ্তি পায়? কেন বর্ষণ? পারবো কী, এই বৃষ্টিবিলাসীর মতো নিজের জীবনকে নানান রঙে রাঙিয়ে তুলতে?
কিছুক্ষণ বাদে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলো। দুজনেই ভিঁজে কাকভেঁজা হয়ে গেছে। তবে আফনার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করতেই রায়াফ চোখ সরিয়ে নিলো। বৃষ্টিতে আফনার নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেলো। আফনা ততক্ষণে তার ওড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো। রায়াফ কোণা চোখে আফনার দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠিকাছে কি না। হ্যাঁ! রায়াফ আশেপাশে তাকালো, নাহ কেউ নেই। রায়াফ হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
বিকালের দিকে রায়াফ এতিমখানার উদ্দেশ্যে বের হলো। পকেটে দু’হাত গুঁজে এতিমখানায় গিয়ে দেখলো আফনা সেখানে বাচ্চাদের সাথে খেলছে এবং খিলখিলিয়ে হাসছে। আফনাকে দেখে রায়াফ ভেতরে প্রবেশ করলো না, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রায়াফ বেশ অবাক হলো এই ভেবে, কিছুক্ষণ বাদে ইসহাকের হলুদের অনুষ্ঠান, সেখানে সাজগোছ করতে না বসে মেয়েটা এতিমখানার এই বাচ্চাগুলোকে সময় দিচ্ছে? রায়াফের ভাবনায় ছেদ ঘটলো আফনার কথায়,
-“আজ আমার ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠান তোমরা আসবে তো?”
-“আমাদের সবার তো সুন্দর জামা নাই বুবু, কেমনে জামু?”
আফনা ম্লান হেসে বলে,”তোমাদের অন্তর কিন্তু আয়নার মতো স্বচ্ছ। তাই পোশাকে কী আসে যায়? তোমাদের স্বচ্ছ অন্তর যে সব পোশাককেই হার মানায়। পোশাক দ্বারা কাউকে জাজ করা বোকামি ছাড়া কিছু না।”
-“তোমার কথা সব মাথার উপর দিয়া গেছে বুবু।”
আফনা এবারও হাসলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“নতুন জামা দিলে আসবে তো?”
কয়েকটা বাচ্চা মাথা নাড়ালো। আফনা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। আফনা সকলকে বিদায় দেয়ার আগেই রায়াফ লুকিয়ে পরলো। তার ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। আফনা ওদের বিদায় জানিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো। আফনার পিছে রায়াফও গেলো। রায়াফ জানতে চায় আফনা এইমুহূর্তে ঠিক কী করতে চাইছে। রায়াফ আফনার পিছু নিতে নিতে বাসা পর্যন্ত চলে আসলো।
আফনা তার ঘরে এসে তার লাগেজ থেকে মিনি ব্যাংকটা বের করলো। মিনি ব্যাংকটায় তার ঘড়ি কেনার টাকা ছিলো। আফনার বরাবরই দামী ব্র্যান্ডেড ঘড়ি পরার ইচ্ছে ছিলো। ব্যান্ডেড ঘড়ির দাম কম তো নয়। তাও প্রায় তিন হাজারের মতো জমিয়েছিলো। যেই ঘড়িটা পছন্দ ছিলো সেটা সাড়ে চার হাজারের মতো দাম ছিলো। আফনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টাকাগুলো হাতে নিলো। তখনই তার মনে হলো ইসহাকের বাসর থেকে তো সে টাকা কামাতে পারবে তাই ভেবেই নিজেকে সামান্য সান্ত্বনা দিলো। তখনই আদনান রুম প্রবেশ করলো। আফনার হাতে টাকা আর ব্যাংক দেখে আদনানের বুঝতে বাকি রইলো না টাকাগুলো আফনা ব্যাংক থেকে বের করেছে। আদনান অবাক হয়ে বললো,
-“ব্যাংক থেকে টাকাগুলো বের করেছিস?”
-“হ্যাঁ! এতিমখানার কয়েকটা বাচ্চার জন্য জামা কিনবো!”
-“তাই বলে নিজের উইশ…”
-“আরে ধুর, টাকা গেলে আবার আসবে। তুই থাক আমি যাই ব্যবস্থা করে আসি!”
বলেই আফনা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আড়ালে এবারও সবটা শুনলো রায়াফ। কিসের উইশের কথা বললো ছেলেটা? আদনান রুম থেকে বের হতেই রায়াফ আদনানকে ডাকলো। আদনান রায়াফকে দেখে খুব খুশি হলো।
-“আরে ভাইয়া আপনি?”
-“হু আমি। তোমার আপু কোথায় গেছে?”
নিমিষেই আদনানের হাসিমুখটা উধাও হয়ে গেলো।
-“এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য জামা কিনতে গিয়েছে। জানেন ভাইয়া আপুর ওই ব্র্যান্ডেড ঘড়ির খুব সখ ছিলো, সেটা কেনার জন্য না খেয়ে খেয়ে টাকা জমিয়েছে। আজ সেই টাকা দিয়ে ওদের জামা কিনে দিচ্ছে৷ আপু এমন কেন?”
রায়াফ নির্বাক হয়ে আদনানের কথাগুলো শুনলো। আদনান যে বকবক করে সব বলে দিয়েছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। অতঃপর রায়াফের সাথে গল্প জুড়তে যেতেই রায়াফ সিঁড়ির দিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো।
সন্ধ্যার পর বিকট শব্দে গানবাজনা শুরু হয়ে গেলো। শুরু হলো বাচ্চাদের মাতামাতি। এতিমখানার বাচ্চাগুলোও এসেছে। সকলের গায়ে নতুন জামা, কয়েকজনের পরিহিত জামা আফনার কিনে দেয়া। আফনা দূর থেকে বাচ্চাগুলোর হাসি দেখে অনেকটা শান্তি পেলো। তার ঘড়ির কথা ভুলে রেডি হতে চলে গেলো।
আফনা রেডি হয়ে বের হতেই আফনার মা আফনাকে ডাকলো। আফনা তার হলুদ লেহেঙ্গার ওড়না ঠিক করতে করতে মায়ের দিকে চলে গেলো।
-“হু বলো কি বলবা?”
-“ফাহানের কোন বন্ধু আছে না সে তো আসলো না, ওরে গিয়ে দেখ তো কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা!”
আফনা বিরক্তি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। বাসার কয়েকজন বাদে আর কেউই জানে না রায়াফের সম্পর্কে এমনকি আফনার মা-ও না। আফনার মা জানলে যে কী হতো তাই ভাবছে আফনা। আফনা বিরক্তি নিয়ে বলে,
-“আর কাউকে পাও নাই ওনার খোঁজ নিতে? আমি কী ওই ছেলের সেবা করতে আসছি?”
-“এমন করে বলিস কেন? কাউকে আশেপাশে পেলাম না তাই তোকে বললাম। এখন কথা না বাড়িয়ে যা বলছি তা কর গিয়ে, এখনই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে!”
আফনা তার মাকে ভেংচি কেটে তার দাদীর বাড়ির দিকে চলে গেলো।#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(১১)
লাবিবা ওয়াহিদ
সেদিন পানিতে চুবাচুবির পর ওরা আরও লেগেছে। আফনা যখন বুঝলো ওদের লড়াই দিনদিন আরও বেশি হচ্ছে তখনই আফনা সরে আসে। কারণ, সে এখানে লড়াই করতে নয় ভাইয়ের বিয়ে খেতে আসছে। একমাত্র বড় ভাইয়ের বিয়েতে বলে কথা আর কতো স্বপ্নও দেখেছে বিয়েতে মজা করার। সেসব তো আফনা জলে যেতে দিতে পারে না। তাই সে নিজেই চুপ মেরে গেছে। লড়াই করার জন্য বাকি জীবন পরে আছে কিন্তু ইসহাক বিয়ে তো মাসে মাসে করছে না?
এসব ভাবতে ভাবতেই আফনা রায়াফের রুমের সামনে চলে আসলো। দরজায় নক করার জন্য এগোতেই কারো সাথে দুম করে ধাক্কা খেলো। আফনা পরে যাওয়ার আগেই কেউ তার কোমড় জড়িয়ে বুকে আবদ্ধ করে ফেললো। আফনা কিছুক্ষণ চোখ-মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো। আর রায়াফ বেক্কলের মতো আফনার দিকে তাকিয়ে রইলো। আফনার মাথা রায়াফের বুকে ঠেকে আছে।রায়াফের মিশ্র অনুভূতি চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে। এ কেমন প্রশান্তি রায়াফ বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন এই মেয়েটা তার বুকে মাথা রাখলেই তার সমস্ত সুখ দরজার চৌকাঠে এসে নাড়া দিচ্ছে।
আফনার ধ্যান ভাঙতেই সে ধাক্কা দিয়ে রায়াফকে সরিয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। আফনার কেন যেন দম আটকে আসছে। কখনো কোনো ছেলের এতো কাছে যায়নি আর আজ… কী হলো এটা? রায়াফ বৃষ্টিবিলাসীর দিকে তাকাতেই রায়াফের মাথা আরেকবার হ্যাঙ হয়ে গেলো। হলুদ লেহেঙ্গা, হালকা মেকআপ, চুল ছেড়ে দুপাশে এসে রাখা, মাঝে দিয়ে সিঁথি করে সেখানে একটি টিকলি ঝুলানো, বলা চলে অসম্ভব সুন্দর লাগছে বৃষ্টিবিলাসীকে। রায়াফের ধ্যানে ছেদ ঘটলো আফনার কঠিন কন্ঠে,
-“আপনার সাহস তো কম না আপনি আমায় টাচ করেন!!”
-“লিসেন! তোমার তো স্টুপিডকে টাচ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। আমি যদি না ধরতাম তাহলে তো কোমড় ভেঙ্গে পরে থাকতা!”
-“তো আপনি খাম্বার মতো আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ছিলেন কেন? চোখে কী দেখেন না নাকি আকাশে তাকিয়ে হাঁটেন?”
-“আমি নাহয় দেখলাম না, তা তুমি চোখ কী স্টেজে রেখে আসছিলা? পাশ কেটে দাঁড়াতে পারলা না? আমার মতো ফেমাস মানুষকে দেখলে তো মেয়েদের টুকটাক ধাক্কা দেয়া লাগেই!” নিজের কলার কিছুটা ঝাকিয়ে বললো রায়াফ। মুখে তার দুষ্টু হাসি। অনেকদিন পর ঝগড়া করে তার যে কী আনন্দ হচ্ছে সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না!
-“এক্সকিউজ মি! মেয়েরা নয় ছেলেরা মেয়েদের গায়ে ঢলে পরে ওকে। আর আমি ওসব ছ্যাঁসড়া মানসিকতার মেয়ে নই, সো যা বলবেন ভেবে বলবেন!”
-“ভেবে বলার সময় নেই, এখন তুমি কি-জন্য এসেছো সেটা বলো!”
-“ওইতো…”
বলেই আফনা থেমে গেলো এবং চোখ বড় বড় করে রায়াফের দিকে তাকিয়ে রইলো। এতদিনে এই প্রথম আফনা রায়াফকে পাঞ্জাবিতে দেখলো। পার্পল পাঞ্জাবি, কালো পাজামা, চুল কোনোরকম আঁচড়ানো যার মধ্যে কিছু চুল কপালে এসে ঠেকেছে। এককথায় অপূর্ব লাগছে রায়াফকে। আফনা রায়াফকে দেখে মনে মনে ভাবলো,
-“স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি কলি, ইরার ক্রাশ হিসেবে রায়াফ পারফেক্ট। আজ তাকে দেখে আমারই তো ক্রাশ খাওয়ার মতো অবস্থা। ছিঃ না না, কিসব ভাবছি আমি! রায়াফ সানভি সবার ক্রাশ হলেও নট মাইন! হে আল্লাহ আমার দৃষ্টি-ভঙ্গি হেফাজত করো এই মানবটির দিক থেকে!”
রায়াফ মুচকি মুচকি হাসছে আফনার এভাবে তাকানো দেখে। যাক এতদিনে সূর্য তার দিকে ফিরলো! রায়াফ সামান্য কেশে স-শব্দে বলে উঠলো,
-“আমি জানি আমি সুন্দর, এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার কোনো মানে হয় না!”
রায়াফের কথায় আফনা গাল ফুলিয়ে বললো,
-“ঠ্যাকা পরে নাই আপনার মতো তালগাছের দিকে তাকিয়ে থাকার!” বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো। আর রায়াফ সেখানে দাঁড়িয়েই নিশব্দে হাসলো।
ইসহাককে স্টেজে বসিয়ে হলুদ দেয়া হচ্ছে। মেয়েপক্ষের অনেকেই এসেছে। আফনা তো সকলের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত আর দূর থেকে রায়াফ মুখে মাস্ক পরে আফনাকে দেখছে। আফনা যখন হাসিমুখে কথা বলে অন্যদিকে যাচ্ছিলো তখনই একটা ছেলে এসে আফনার পথ আটকালো। রায়াফ নেড়ে চেড়ে দাঁড়ালো এবং আফনার দিকে এগিয়ে গেলো। আফনা কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো,
-“কিছু বলবেন?”
-“তুমি কী ছেলেপক্ষের?”
-“তো আমাকে কী রাস্তার ভিখারি মনে হচ্ছে?” দাঁতে দাঁত চেপে বললো আফনা! ছেলেটা মাথা চুলকে বললো,
-“সরি, তোমাদের মেয়েদের পোশাক দেখে বোঝার উচিত ছিলো তোমরা ছেলে পক্ষের। মেয়েরা তো হলুদ শাড়ি/লেহেঙ্গা পরেছে।”
-“এসব বাকওয়াজ ছাড়া প্রয়োজনীয় কিছু বলতে চাইলে বলুন নয়তো চোখের সামনে থেকে সরুন!”
ছেলেটার আশার বাতি নিমিষেই ফুঁস। সে বুঝতে পারেনি মেয়েটির ব্যবহার এমন হবে? আফনা ছেলেটার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আফনা চলে যেতেই রায়াফ ছেলেটির সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটি মাথা উঁচু করে রায়াফের দিকে তাকায়। রায়াফ কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে বললো,
-“শি ইজ মাইন, তার আশেপাশে ঘেঁষার চেষ্টা পর্যন্ত করলে ইউ উইল ডাই!” বলেই রায়াফও অন্যদিকে চলে গেলো। ছেলেটি সেখানে বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলো,
-“নির্ঘাত মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড হবে। বাবাগো, দুটোই ডেঞ্জারাস! কে ঘেঁষে এই মেয়ের দিকে? না বাবা, নিজে বাঁচলে বাপের নাম!” ভেবেই রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো এবং অন্যদিকে চলে গেলো।
রায়াফ অন্যদিকে দাঁড়িয়ে নিশব্দে হাসলো। সে তার উত্তর পেয়ে গেছে। নিজের জিনিসের হেফাজত সে ভালোভাবেই করে।
এভাবেই হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। সকলে ক্লান্ত হয়ে যে যার বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। পরেরদিন সকলেই দেরী করে ঘুম থেকে উঠলো। গতকাল ছেলেদের বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান হলেও আজ হবে মেয়েদের বাড়িতে। আগামীকাল বিয়ে। তাই এই বাড়ির তেমন কোনো কাজ নেই। সন্ধ্যার পরে এ-বড়ি থেকে কয়েকজন যাবে। নাস্তা সারতে সারতেই যোহরের আযান দিয়ে দেয়। আফনা সুখের ঢেঁকুর তুলে ডাইনিং টেবিল থেকে উঠতেই দেখলো ইসহাক পরিপাটি হয়ে বের হচ্ছে। আফনা ইসহাকের পথ আটকে বললো,
-“কিরেহ, শুক্রবার ছাড়া তো নামাজে এতো পরিপাটি হয়ে যাস না? আজ কী হলো?”
-“নামাজের পর মিলাদ হবে।”
-“মিলাদ? কিসের মিলাদ?”
-“খেলোয়াড় রায়াফের বাবার মৃত্যুবার্ষিকী আজ!”
আফনা যেন সেখানেই জমে গেলো। তার মানে কী রায়াফের বাবা নেই? আফনা নির্বাক হয়ে বললো,
-“ওনার বাবা মারা গেছে?”
ইসহাক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। আফনার কেন যেন খারাপ লাগছে। তাই সে গোসল সেরে নামাজ পড়ে এতিমখানার দিকে চলে গেলো। কেন যেন এখন বাচ্চাগুলোর সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে।
সেখানে গিয়ে আফনা আরও অবাক হলো। রায়াফ পরিপাটি হয়ে বাচ্চাদের জামা-কাপড় সহ অনেককিছু বিতরণ করছে। রায়াফকে সাহায্য করছে দুজন গার্ড এবং এতিমখানার দায়িত্বে থাকা একজন মহিলা। বাচ্চাগুলোর হাসিটা জাস্ট দেখার মতো। আফনা গেটের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ দেখছে। তার মাথায় এখনো ঘোমটা আছে। রায়াফ সব বিতরণ করে সকলের আড়ালে চোখের কোণ মুছে নিলো। বিষয়টি সকলের দৃষ্টি এড়ালেও আফনার দৃষ্টি এড়ায়নি কারণ, সে একমনে রায়াফকেই দেখছিলো। রায়াফ গার্ডদের কিছু বুঝিয়ে দিয়ে হনহন করে আফনার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। রায়াফ এভাবে বের হচ্ছে দেখে ফাহানও রায়াফের পিছে ছুটলো। গেট দিয়ে বের হতেই ফাহান আফনাকে খেয়াল করে দাঁড়িয়ে গেলো এবং বললো,
-“আফনা, তুমি এখানে?”
-“উনি এভাবে চলে গেলেন কেন?”
ফাহান কোনোরকম উত্তর না দিয়ে রায়াফের পিছে ছুটলো। আফনাও কিছু না ভেবে ফাহানের পিছে ছুটলো।
রায়াফ একমনে দূরের কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর ফাহান, আফনা তার থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে। আফনা ফাহানের উদ্দেশ্যে বললো,
-“উনি কেন কখনী কোনো শোতে তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলতেন না?”
ফাহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “কারণ, রায়াফ চায় না তার সম্পর্কে কেউ জেনে তার উপর দয়া দেখাক!”
-“মানে?” অবাক হয়ে বললো আফনা। ফাহান আফনার দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,
-“রায়াফ এতিম!”
আফনা স্তব্ধ হয়ে যায় এমন একটি কথা শুনে। সে মোটেই এমন একটা কথা কল্পনায়ও চিন্তা করতে পারেনি।
-“তার মানে ওনার বাবা-মা দুজনেই মৃত?”
-“নাহ। ওর মা আরেকজনের সংসার করতে ব্যস্ত। তার যে একটা ছেলে আছে সে কোনোদিনও খবর নেয়নি। ইভেন আমার জেঠুর মৃত্যুর কারণ আমারই জেম্মা ওরফে রায়াফের মা!”
~চলবে।