#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-০৮
দিন পনেরো পর, বর্ষার শেষে শরতের প্রারম্ভের কোন এক দিনে যখন শরতের নীল আকাশ জুড়ে খেলা করছিল পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘের দলেরা তেমন একটি দিনে মেহুলরা বিদায় নিলো অভির শহর ছেড়ে। অভি আটকায়নি মেহুলকে, বরং মুচকি হেসে ছেড়ে দিয়েছিল মেহুলের ফর্সা নরম হাতখানা। মেহুল নিজেও আর ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে নি অভির বলিষ্ঠ হাত। বাবার হাত ধরে পাড়ি দিলো অচেনা এক শহরের উদ্দেশ্যে। যেখানে অভি নামের কেউ নেই, নেই অভি নামের কোন স্মৃতি। আছে শুধু অচেনা, অজানা কিছু মানুষের ভিড়।
দুই বছর পর,
সময় সকাল নয়টা বেজে চল্লিশ মিনিট। ভার্সিটির লোহার বড় গেইট দিয়ে দৌড়ে ভিতরে ঢুকছে এক কিশোরী। তার লম্বা রেশমি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ে চলেছে হাওয়ার তোড়ে। দৌড়ের কারনে হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটা তবুও থামার কোন নাম নেই। দৌড়েই চলেছে সে, যেন কোন দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে মেয়েটা। একসময় প্রচন্ড এক ধপাস শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলো মেয়েটা । ধুলো জমে থাকা মেঝেতে গড়াগড়ি খেলো মেয়েটির পুরো দেহ। জামা – কাপড় , হাত-মুখ,পা এমনকি চুলেও লেগে গেলো ধুলোর আস্তরণ। রাগত দৃষ্টিতে মেয়েটা সামনের দিকে তাকালো,যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো এক যুবক। মেয়েটি হাত ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাগত স্বরে বলল,
–” এই ছেলে এই, চোখে দেখো না নাকি?”
ছেলেটি কিছু বলল না বরং মাটিতে পড়ে থাকা কালো রঙের ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বলল,
–” আমার একার কেনো চোখ খারাপ হতে যাবে। তোমার চোখ দুটোই বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে নাহলে এমন হাট্টাকাট্টা হ্যান্ডসাম ছেলেকে তুমি কি না দেখতেই পেলে না।”
–” আমার চোখ খারাপ হয় নি। চোখ খারাপ হয়েছে তোমার। অবশ্য চোখ খারাপ হবে নাই বা কেন? চোখের সামনে হুর পরির মতো এত সুন্দর মেয়ে দেখলে যে কারুরই চোখ ,মাথা এমনি মনও খারাপ হবে । এইটাই স্বাভাবিক।”
মেয়েটি আরো একটু এগিয়ে এসে এক নিঃশ্বাসে বলল কথাগুলো। মেয়েটির কথার প্রতি উত্তরে ছেলেটি ধীর অথচ কাট কাট গলায় বলল,
–” তুমি কি নিজেকে মিস ইউনিভার্স মনে করো নাকি?”
–” কেন? আমি কি দেখতে কম সুন্দর নাকি। যথেষ্ট সুন্দরি আমি, তাই নিজেকে মিস ইউনিভার্স বলে মনে করলে কোন ভুল হবে বলে মনে হয় না ।”
–” লোকে ঠিকই বলে, মেয়েদের বুদ্ধি আসলেই তাদের হাঁটুতে থাকে। যাগ গে , তোমার সাথে ঝগড়া করার সময় নেই এখন আমার। পরে যদি কখনো দেখা হয় তবে আজকের তুলে রাখা ঝগড়াটা সেদিন শুধে আসলে আদায় করে নিবো। আজ চলি মিস ইউনিভার্স।”
কথাগুলো বলেই ছেলেটা তার কাঁধে ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে চলে গেলো ভার্সিটির ভেতরে , নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে। এদিকে মেয়েটি তখনো গলা ফাটিয়ে বলতে লাগলো,
–” এই ছেলে এই, কি বললে তুমি। তোমার এত বড়ো সাহস। ঠিক আছে আবার কখনো দেখা হলে বুঝবে এই মেহুল কি জিনিস। বেয়াদব ছেলে।”
–” এই মেহুল, তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছিস। ওদিকে ক্রাস শুরু হয়ে গেলো যে। আজ কলেজের প্রথম দিন, সে খেয়াল কি আছে তোর।”
পাশ থেকে কথাগুলো শুনে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালো মেহুল তারপর পাশের মেয়েটির হাত ধরে আবারো হুট লাগালো সামনের দিকে।
ক্লাস রুমের মাঝের সারিতে বসে আছে মেহুল। মেহুলের পাশে বসেছে মেহুলের বেস্ট ফ্রেন্ড জ্যোতি। গত দুবছরে মেহুল এক জ্যোতি ছাড়া আর কারো সাথেই বন্ধত্ব গড়ে তুলতে পারে নি। মেহুলের চলা,ফেরা, হাসি কান্না সবকিছু জ্যোতিতেই সীমাবদ্ধ। শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ মেহুলের প্রথম ক্লাস। এইচএসসি পরীক্ষার পর মেহুল নিজেও এই ভার্সিটি ছাড়া আর কোন ভার্সিটিতে ফর্ম উঠায় নি আর না তুলতে দিয়েছে জ্যোতি। ওদের দুজনের কপাল ভালো ছিল বিধায় এই ভার্সিটিতেই চান্স জুটেছে তাদের ,নাহলে কপালে দুঃখ ছিলো ওদের।
মেহুলদের প্রথম ক্লাস শুরু হবার কথা ছিলো দশটায়। এখন বাজে দশটা চল্লিশ। অর্থাৎ ক্লাস শুরুর নির্ধারিত সময়ের থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে তবুও এখনো কোন স্যার আসে নি ক্লাসে। এতে অবশ্য মেহমুদের জন্যই ভালো হয়ে। এমনিতেই আজ মেহুলের ঘুম দেরিতে ভাঙ্গার কারনে কলেজে সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে পারে নি সে। তার ওপর বদ ছেলেটার পাল্লায় পড়ে আরো কিছু সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মেহুলের। তবে এখন বেশ স্বস্তি পাচ্ছে সে। প্রথম দিন ক্লাসে লেইট করে আসলে স্যারের কাছে ওর ইমেজের ফালুদা হয়ে যেতো। মেহুল এদিক সেদিন তাকাতেই ওর বাম দিকের মাঝের সারিতে একটা চেনা মুখের দেখা পেলো। সেই শ্যাম বর্ণ, কপাল বরাবর সিল্কি চুল, সেই হাসি যেগুলোর দর্শন মেহুল কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছিল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মেহুলে রাগে গজগজ করে বলতে লাগলো,
–” আর কোন ডিপার্টমেন্ট জুটলো না তোর বদ ছেলে, শেষমেষ আমার ডিপার্টমেন্টই তোর কপালে জুটলো। হায়, একে চার বছর সহ্য করবো কিভাবে? যে ঝগড়ুটে ছেলে রে বাবা। দেখা হলেই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে চলে আসবে। ইস মেহুল তোর কপালটাই আজ খারাপ। সকালে উঠে প্রথমেই যে কার মুখ দেখেছিলি কে জানে।”
কথাগুলো বলেই হঠাৎ মেহুলের মনে পড়লো আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ও প্রথমেই নিজের মুখখানাই দেখেছিল আয়নায়। কথাটা মনে হতেই তড়তড়িয়ে থিতিয়ে থাকা রাগটা আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মেহুলের। রাগি দৃষ্টিতে তাকালো বাম দিকে। মেহমুদের দৃষ্টিটা বামে ফিরতেই মেহুল দেখলো ঐ অসভ্য ত্যাদোড় বদ ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়েই মিটমিটিয়ে হাসছে। মুখে ঘুরিয়ে নিলো মেহুলো। ছেলেটার হাসি ওর রাগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেহুল ভাবলো বাহিরে বেরিয়ে যাবে কিন্তু এমন সময় ক্লাসে ঢুকল এক বছর চল্লিশের লোক। লোকটাকে ক্লাসে ঢুকতে দেখেই ক্লাসের সবাই উঠি দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো তাকে। লোকটা তা হাতে রাখা বইটা টেবিলে রেখে নতুন মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
–” আমি শফিকুল ইসলাম, তোমাদের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর। আজ যেহেতু তোমাদের সাথে আমার প্রথম ক্লাস সেহেতু আজ তোমাদের সাথে আমি পরিচিত হবো। আগামীকাল থেকে না হয় ক্লাস শুরু করবো। তাহলে তোমরা তোমাদের পরিচয় শুরু করো ।”
স্যারের কথায় ক্লাসের সবাই তাদের পরিচয় দেওয়া শুরু করলো। মেহুল উগ্রিব হয়ে তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে, তার নাম পরিচয় জানার জন্য। ছেলেটাকে খুব পরিচিত মনে হয় ওর। মনে হয় আগে কখনো ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছিল ওর। ছেলেটার তাকানো, বাচন ভঙ্গি সবটাই চেনা লাগে মেহুলের। একসময় এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্যারের কথায় উঠে দাঁড়ালো শ্যাম বর্ণের ছেলেটি। ধীর গলায় বলল,
–” আমি অভি। বাসা ঢাকায় । ”
বলেই আবারো নিজের সিটে বসে পড়ল সে। মেহুল অস্পূট স্বরে বলল,
–” অভি।”
আশ্চর্য নামটা মুখে আনতেই অন্য রকম এক শিহরন বয়ে গেল মেহুলের মাঝে। মেহুলের কেবলই মনে হতে লাগল এই নামটাও ওর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মনে হলো ,এই নামটা ও আগেও কোথায় শুনেছে। একবার নয়, বহুবার বহুবার শুনেছে এ নাম। মনে করার চেষ্টা করলো মেহুল কিন্তু পারলো না। অসহ্য এক যন্ত্রণা এসে ভর করলো মেহুলোর মাথা। মেহুল মাথা ধরে বসে রইল নির্বাক হয়ে। এক সময় পাশ থেকে মৃদু ধাক্কা পেয়ে খেই হারিয়ে ফেলল মেহুল। সামনের দিকে তাকিয়ে একটু অস্বস্তি নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। তারপর একটু অগাছালো স্বরে বলল,
–” নাম মেহুল। সিলেটেই থাকি।”
বলেই আবারো বসে পড়লো সে । তার চঞ্চল চোখের দৃষ্টি চলে গেলো বামে। সেখানে মিনিট খানেক স্থির থেকে আবারো দৃষ্টি চলে গেলো সামনের দিকে। শ্যাম বর্ণের সেই ছেলেটি সবটাই লক্ষ্য করল নিঃশব্দে। মুচকি হেসে তাকিয়ে রইল মেহুলের দিকে। এই উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিটিই তো দেখতে চেয়েছিল সে। এর জন্যেই তো নিজের শহর , নিজের আপনজন ছেড়ে চলে এসে এই নতুন শহরে। এবার আর হাত ছেড়ে দেবে না সে, কিছুতেই না।
চলবে
( ।)