বাক্সবন্দী চিঠি পর্ব -০৩

গল্প: #বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখক: Ninika Jaman Noor
পর্ব: ৩
আবিরের মা কণা আফরোজ ডান ভ্রু কুঁচকে একবার বাবুর্চিদের বকছেন তো আরেকবার পিছনে দাড়িয়ে থাকা ইতুকে।
“এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?পিছন পিছন ঘুরছো কেনো?”
ইতু কাঁচুমাচু হয়ে মিনমিন করে বললো,”মামুনি বকছো কেনো?কতদিন পর এলাম আমি।”
“হ্যাঁ এসে তো উদ্ধার করেছেন আমাদের।তা এলেন কেনো? থেকে যেতেন।কে বলেছে আসতে?আমরা তো আপনার কেউ না।”
কণা আফরোজের ইচ্ছে করছে ইতুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুক ভাসিয়ে কাঁদতে।মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকে খুব আদর করতেন তিনি।অনুর থেকে কম কিছু ভাবতেন না।ইতু সারাদিনই তাদের বাড়িতে থেকে সন্ধ্যার পর তার বাড়িতে যেতো।সেই মেয়ের এমন চলে যাওয়ায় প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছেন তিনি।দুই বছরে একবারো যোগাযোগ রাখেনি ইতু।শারমিন বেগম যখন তার কাছে এসে ইতুর কথা বলে কাঁদতো তখন তিনিও চোখের জল ফেলতেন।তখন ইতুকে তার কাছে স্বার্থপর মেয়ে বলে মনে হয়েছে।এখনো মনের মধ্যে রাগ,অভিমানের পাহাড় জমে আছে।ইতু যাই বলুক না কেনো এই পাহাড় ভাঙ্গবে না।বুকে টেনেও নিবেনা ইতুকে।
কণা আফরোজ শক্ত গলায় বললেন,”এইভাবে চোখের সামনে দাড়িয়ে থাকবে না।যাও এখান থেকে।”
ইতু হুট করে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
কণা আফরোজ মনে মনে গলে জল গেছে ইতুর কাজে।কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না।
“এই মেয়ে ছাড়ো আমাকে।কেনো ধরেছো?ছাড়ো বলছি।”
“উঁহু ছাড়বো না তোমাকে বেবি ডল।আগে মাফ করো তারপর ছাড়বো।”
“এইসব কি অসভ্র নাম।এইসব নামে ডাকবে না আমাকে।তোমাকে কেনো মাফ করতে যাবো আমি?”
“মামনিনিনি তুমি কি করে জানলে বেবি ডল অসভ্য নাম?বড় আব্বুকে বলবো নাকি?”
ইতু ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে।
কণা আফরোজ থতমত খেয়ে গা ঝাড়া দিলো। ইতুর কান টেনে বললো,”ইতু,খুব অসভ্য হয়েছিস।খুব পেকে গেছিস না?তোর মাকে বলছি ধরে বেধে বিয়ে দিয়ে দিতে।”
ইতু কান ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,”তুমিও তো এখনো ফিট আছো।দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছো।কতো ছেলে তোমাকে দেখলে প্রেমে পিছলে পড়ে তোমার ধারনা আছে?দেখবো নাকি একটা?”
কণা আফরোজ নিজের সুনাম শুনতে খুব পছন্দ করেন।ইতুর মুখে এইসব শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন।লাজুক হাসি দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললেন,”যাহ,কি সব বলিস না তুই।”
কণা আফরোজ এর মুখের দিকে তাকিয়ে ইতু অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখেছে।
“কেনো রে ইতু মা আমার সংসারটা ভাঙ্গছিস?”
ইতুর পাশে আবিরের বাবা শফিক হাসান এসে দাড়িয়ে করুন গলায় বললো কথাটা।
ইতু ফিক করে হেসে উঠলো।
শফিক হাসান আরো করুন মুখ করে বললো,”তোর মামুনিকে পটাতে আমাকে প্রচুর খাটতে হয়েছে তারপর এতো বছর তাকে মেন্টেইন করতে করতে পুরো মাথার চুল পড়ে গেছে।এতো কষ্টের পর তুই যদি এসে আমার বউটাকে আরেকজনকে দিয়ে দিবি বলিস তাহলে আমার কি হবে?আমার এতো কষ্টই তো বৃথা।”
ইতু ঠোঁট টিপে হেসে তার মামুনির দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি রাগে ফুস ফুস করছে।যে কোনো মুহূর্তে শফিক হাসানকে ছোবল মারবেন।শফিক হাসান ও স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জ্বিভে কামড় দিলেন।তিনি এতোক্ষনে বুঝতে পারলেন ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছেন।
কণা আফরোজ রাগে ফুসতে ফুসতে বললেন,”আমাকে তোমার মেন্টেইন করতে হয়েছে?মেন্টেইন করতে গিয়ে চুল সব পড়ে গিয়েছে না?আসো তুমি আজ রুমে চুল যা আছে তাও থাকবে না।”
কথা শেষ করেই তিনি হনহন করে চলে গেলেন।শফিক হাসান মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছেন।
“ইতুরে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি।আজ তো আমার উপর তুফান যাবে। কি করি এখন?”
ইতু শফিক হাসনকে দেখে মনে হচ্ছে বেচারা অথৈ সমুদ্রে পড়ছে।ইতু মনে মনে হাসলো।
“তুমি এককাজ করো,আজ রুমে ঢুকে মামুনি কিছু করার আগেই তুমি তাকে প্রপোজ করে দাও।একদম ফিল্মি স্টাইলে।সামনে মেইন রোডের পাশে ফুলের দোকান থেকে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে যাবে সাথে।এমন ভাবে প্রপোজটা করবে যাতে মামুনি রাগ করে থাকতেই না পারে।”
ইতুর আইডিয়া শুনে শফিক হাসানের চোখ চকচক করে উঠলো।
“দারুন আইডিয়া দিয়েছিস তো।আমি ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তোর মামুনির রাগ আগামী এক বছরের জন্য শেষ।ইতু মা তুই তো খুব বুদ্ধীমতি।তুই আজ প্রমাণ করেছিস “Beauti with brain” কথাটা এমনি এমনি বলেনা।তুই কথাটার সাক্ষাত উদাহরণ।”
শফিক হাসান হাসি হাসি মুখ করে বেরিয়ে গেলেন।বোধহয় স্ত্রীর জন্য ফুল আনতে গেলেন।
“বাহ! তুই তো আজকাল খুব বুদ্ধীমতি হয়ে গেছিস।অনেকটা পাল্টে ফেলেছিস নিজেকে।”
ইতু পিছন ঘুরে আবিরকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো।কতোগুলো দিন পর মানুষটাকে দেখছে।খোঁচা খোঁচা দাড়ি থেকে এখন চাপ দাড়ি রেখেছে।বডিও বেড়েছে অনেকটা।সবুজ পান্জাবির হাতা গুটিয়ে পকেটে দুই হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।আগের তুলনায় এখন আরো বেশী সুন্দর লাগছে।
“কিরে এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?আবার প্রেমে পড়লি নাকি?”
ইতু তাচ্ছিল্য নিয়ে হেসে অনুর কাছে চলে গেলো।ইতুর এইভাবে হাসাটা আবিরের বুকে গিয়ে বিঁধলো।ইতুর ওকে ইগ্নোর করাটাও মেনে নিতে পারছেনা।আবির তার বন্ধুদের নিয়ে ছাদের কোনায় গিয়ে দাড়ালো।অয়ন ইতুকে নিয়ে শ্রাবণের সাথে আলোচনা করে যাচ্ছে।আবির একদৃষ্টিতে ইতুকে দেখছে।আজ অনুষ্ঠানের মধ্যমনি ইতু।সবার সাথে কি সহজভাবে খোলামেলা কথা বলছে।অথচ আগে ইতু ছিল চুপচাপ,কথা কম বলতো।পরিচিত ছাড়া কারোর সাথে কথা বলতো না।
আবিরের এখনো মনে আছে ইতু যখন প্রথম কলেজ উঠে তার দুই দিন কাঁদতে কাঁদতে আবিরের কাছে আসে।আবির শত চেষ্টা করেও ওর কান্না থামাতে পারেনি।পরে এক ধমকে চুপ হয়ে যায়।
“এই এমন ফ্যাসফ্যাস করে না কেঁদে বল কাঁদছিস কেনো?কলেজে কেউ ডিস্টার্ব করেছে?কেউ কিছু বলেছে?”
ইতু তখনো ফুঁফিয়ে কাঁদছে।আবির বিরক্ত হয়ে বললো,”এই এমন করে কাঁদবি না তো।নাকের পানি চোখের পানি সব এক করে ফেলছে।বলবি কি হয়েছে? না বলতে চাইলে সামনে দাড়িয়ে এমন করে কাঁদবি না।”
ইতু অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে বললো,”দুটো ছেলে আমাকে এসে বলে আমি অনেক সুন্দর।ওরা আমার সাথে নাকি ফ্রেন্ডশীপ করতে চায়..”
কথাটা বলে আবার কাঁদতে লাগলো।আবির হাসতে হাসতে বললো,”তুই সুন্দর?ওই ছেলে দুইটার চোখ খারাপ নাকি রে?তোর মতো বানুনি আর কানির সাথে ফ্রেন্ডশীপ করে চায়?”
আবিরের কথা শুনে ইতু স্তব্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো।আবার কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো।কিছুক্ষন পর অনু রণমূর্তি রূপ ধরে রুমে এলো।আবিরের দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে বললো,”তুই ইতুকে কি বলেছিস?”
আবির ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,”রাতকানা বলছি।বিচার ও দিয়ে দিছে তোকে?”
অনু দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”ভাইয়া তুই এতো খারাপ হচ্ছিস দিন দিন?”
আবির ধমক দিয়ে উঠলো,”অনু..”
“কি অনু? মিথ্যা বলেছি?তুই জানিস না ইতু তুই ছাড়া আর কোনো ছেলের সাথে মিশতে পারে না।ও ভয় পায় ছেলেদের এটা যানার পর ও তুই ওর সাথে এমন করেছিস?মেয়েটা তোকে ভরসা করে ওর প্রবলেমটা বলতে এসেছিলো আর তুই ওকে এইসব বলেছিস?”
“প্রবলেম মাই ফুট।কিসের প্রবলেম?দুটো ছেলে এসে জাস্ট ফ্রেন্ডশীপ করতে চেয়েছিলো এতে এতো কেঁদে ভাসানোর কি আছে?”
“তুই যদি ওর পুরো কথা শুনতি তাহলে প্রবলেমটা বুঝতে পারতি।আজ ছেলেগুলো ওর চশমা ভেঙ্গে ফেলছে।ওর চুল ধরে টেনেছে।বাড়ি ফেরার পথে ওর জামা ধরে টানাটানি করছিলো।আর তুই বলছিস প্রবলেম নেই?শেম অন ইউ।”
অনু কথাগুলো বলেই চলে গেলো।আবির তখনো থম মেরে বসেছিলো।আবির খোঁজ নিয়ে ওই ছেলেগুলোকে কলেজের পাশে ডেকে আনায়।আবির আর তার বন্ধুদের দেখেই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে।
আবির সামনে গিয়ে একটা ছেলের চুল টেনে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,”এই বয়সে মেয়েদের ডিস্টার্ব করছিস তাদের জামা টানাটানি করছিস বড় হলে কি করবি?বাবা মা এইসব করার জন্য কলেজে পাঠায়?”
পিছন থেকে শ্রাবণ বললো,”কি কথা বলছিস ওর সাথে?কানের নিচে দুটো দিলেই সোজা হয়ে যাবে।এরা ভালো কথার দার ধারে না।”
অয়ন তো এসেই আরেকটা ছেলেকে পর পর দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
আবির যার চুল ধরে ছিলো সে এইসব দেখেই কেঁদে দিলো।
“ভাই প্লিজ মাফ করে দে।স্যরি ভাই স্যরি।আর জীবনেও কিছু করবো না।এইবারের মতো মাফ করে দেন ভাই ভুল হয়ে গেছে।”
আবির বাঁকা হেসে বললো,”ভুল তো তুই করেছিস।কিন্তু এইভুলের ক্ষমা তো আমি তোকে দিতে পারবো না।তুই আমার পিচ্চি ইতুটাকে কাঁদিয়েছিস।ওকে জ্বালাতন করেছিস তোকে যদি আজ ক্ষমা করি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।”
আবির ছেলে দুটোকে সেদিন খুব মেরেছিলো।পরে হাসপাতালে ভর্তি ও করিয়েছে।শ্রাবণকে দিয়ে নতুন চশমা কিনে পাঠিয়েছিলো।কলেজে সব ছেলেদের হুমকি দিয়েছিলো,কেউ ইতুর আশেপাশে গেলে ওকে ডির্স্টাব করলে তাদের ওই ছেলে দুটোর মতো অবস্থা হবে।এইসবে কিছুই ইতু যানে না।আবির সব সময় দূর থেকেই ওকে প্রটেক্ট করে গেছে।কেনো করেছে যানে না হয়ত ইতু একমাত্র তাকেই ভরসা করতো আর সেই ভরসার মান রাখতে করেছে।
অয়নের ডাকেই আবির ভাবনা থেকে বের হলো।
“ভাই চল বাইরে থেকে একটা সিগারেট টেনে আসি।”
“তোরা যা আমি পরে আসছি।”
“ওকে তাড়াতাড়ি আয়।”
অয়ন আর শ্রাবণ চলে গেলে আবির একদৃষ্টিতে ইতুকে দেখছে।সবার সাথে হাসাহাসি করতে করতে মেহেদি লাগাচ্ছে।ইতুর এই হাসিটা আবিরের বুকে গিয়ে লাগছে।কেনো যানি মনে হচ্ছে এই হাসিটা ইতু ওর ওপর হাসছে।আজ আবির নিজেই ইতুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।সারাক্ষন ওর আশেপাশে থাকতে ইচ্ছা করছে।ইতুর ইগ্নোর করাটা আবির গায়ে কাঁটার মতো বিধঁছে।
আবিরের এতো ভাবনার মাঝে অনুর ফ্রেন্ড অহনা ডেকে উঠলো।
“আবির ভাইয়া আমার কিছু পিক তুলে দাও না প্লিজ।এই যে আমি মেহেদি লাগাচ্ছি এই পোজে তুলো দাও।”
অহনার কথায় আবির অসস্তিতে পড়ে গেলো।ইতু সরু চোখে একবার আবিরকে দেখছে তো আরেকবার অহনাকে।এতোকিছুর পর ও কেনো যানি ইতুর গা জ্বলে যাচ্ছে অহনার কথা শুনে।ইতু মনে মনে বলছে,”আবির ভাই প্লিজ তুমি ওর পিক তুলবে না।যাই হয়ে যাক তুমি তুলবে না।”
ইতুর এইভাবে তাকিয়ে থাকাটা আবির বুঝতে পারলো।একগাল হেসে অহনার দিকে তাকিয়ে বললো,”অবশ্যই তুলে দিবো।আমার ফোন দিয়ে তুলে দেই?”
অহনাকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে।সব দাঁত বের করে হেসে বললো,”নো প্রবলেম ভাইয়া তুলে দেন।”
আবির নিজের ফোন বের করে ছবি তুলতে লাগলো।অহনার পাশেই ইতু বসেছিলো।আবির অহনার একটা ছবি তুলে ইতুর ছবি তুলতে লাগলো।ইতু মুখ ফুলিয়ে মেহেদি লাগাচ্ছে।অনুর চোখ রাঙ্গানিতে মেকি হাসতে লাগলো।মনে মনে বললো,”আবির ভাই তুমি আগের মতোই রয়ে গেছো।আস্ত একটা অসভ্য।মেয়ে দেখলেই মাথা ঠিক থাকে না।বেশ হয়েছে কুহু আপু আরেকজন বিয়ে করে নিয়েছে।তোমার মতো অসভ্য,বেয়াদপ সারাজীবন সিঙ্গেলই থাকবে।”
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here