গল্পঃ বাক্সবন্দী চিঠি
লেখকঃ Ninika Jaman Noor
পর্বঃ ১৯
ইতুর জ্ঞান ফিরে মধ্যরাতের দিকে। আবির তখনও ইতুর পাশে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই চোখ লেগেছে। ইতু নড়াচড়া করতে না পেরে পাশে তাকিয়ে আবিরকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কিছুক্ষণ সেভাবে চোখ বন্ধ রেখে আবিরকে ডাকতে লাগলো, “আবির ভাই, আবির ভাই।”
আবির ইতুর ডাকে চমকে উঠে বসলো।
“কি হয়েছে ইতু? কোথাও লেগেছে?কিছু লাগবে তোর।”
আবিরের এমন উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে ইতু মুখ ফিরিয়ে নিলো।
” উঠো আমি ওয়াসরুমে যাবো।”
“চল আমি তোকে নিয়ে যাচ্ছি।”
ইতু আবিরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো, “তোমাকে এতো ভাবতে হবে না। আমার শরীরে এখনো এতোটাও দূর্বল নয়। আমি নিজেকে সামলাতে জানি।”
ইতুর এই শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আবির বুঝতে পারছে ইতুটা আবার কঠিন রুপ ধারণ করেছে। তার আর ইতুর মাঝে শক্ত দেয়াল তৈরি করেছে। আবির আর কিছু না বলে উঠে দাড়ালো।
ইতু ওয়াসরুম থেকে এসে আবার শুয়ে পড়লো।আবির ইতুর পাশে শুতে লাগলে ইতু বলে উঠে, “আমি একজন বাইরের মানুষের সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে পারি না। তোমার এখানে থাকাটাও আমার বিষ এর মত লাগছে। আমার একটু শান্তি চাই।”
ইতুর বলা প্রত্যেকটা কথা আবিরের গায়ে কাটার মতো বিঁধলো। কষ্ট গুলো যেনো গলায় দলা পাকিয়ে গেছে। ইতুকে কিছু না বলেই আবির চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। আবিরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ইতু নীরবে চোখের জল মুছে। তার জীবন টা কেনো এমন উল্টে পাল্টে গেছে। কেনো সে আবিরকে পেয়েও হারায়?
আবির কেবিনের সামনে রাখা সিট গুলোতে বসে পড়লো। বাকি রাত এখানে বসেই কাটিয়ে দিবে।
সকাল ৯টায় ডাক্তার আদিত্য আহমেদ এলো ইতু কে দেখতে।
ইতু তখনও ঘুম। আদিত্য কিছুক্ষণ ইতুর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কতোদিন পর দেখছে তার মনের মানুষকে।
ইতু যে মেডিকেলে পড়তো আদিত্য ছিলো সেখানের সিনিয়র। ইতু পড়ালেখায় ভালো হওয়ার সুবাদে তার নাম সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ইতুর প্রফেসর আবদুস সাত্তার ইতুকে আদিত্যর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পড়ায় কোন সমস্যা বা নোট যেন সে আদিত্য থেকে নেয়। আদিত্য ছিলো সেখানের টপার। ইতুকে সেদিন দেখেই পছন্দ করে ফেলে। প্রতিদিন ইতুকে সাহায্য করার বাহানা দিয়ে ইতুর সাথে বন্ধু মতো মিশে যায়। আদিত্য দুনিয়া হয়ে পড়ে ইতুময়। ইতু বেশির ভাগই চুপচাপ থাকতো। আদিত্যকে একজন সিনিয়র আর ভাই এর চোখে দেখতো বিদায় আদিত্য তাকে নিয়ে কি ভাবে কেনো তাকে এতো সাহায্য করে সেসব নিয়ে আর ভাবা হয়নি কখনো। আদিত্য যখন ইন্টার্নশীপ করতে যায় তখন থেকে আদিত্যর সাথে ইতুর যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একটা সময় পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আদিত্য তখন অস্থির হয়ে পড়ে ইতুর সাথে কথা বলার জন্য। ইতুকে কল দিয়েও পায় না। ইন্টার্নশীপের জন্য ইতুর কাছে ছুটে যেতে পারে না। উপায় না পেয়ে মেডিকেলের ছোট ভাইকে দিয়ে ইতুর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ইতু ছুটি তে তার বাসায় ফিরে গেছে। তখনই আদিত্য মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় ডাক্তার হয়ে ইতুর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে একেবারে বউ করে ঘরে তুলবে তাকে।
কিন্তু কাল যখন যানতে পারে ইতু অন্য কারোর হয়ে গেছে আদিত্য কিছুতেই মানতে পারছে না। কাল বাসায় ভাংচুর করে তবে গিয়ে নিজের রাগ কমিয়েছে। রাতভর জেগে সে একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যতকিছু হোক ইতু তার। দরকারে ইতুর স্বামীকে খুন করে হলেও ইতুকে নিজের কাছে রাখবে।
____________
আদিত্য একদৃষ্টিতে ইতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। হাত বাড়িয়ে ইতুকে ছুতে গেলে ইতু নড়ে উঠতেই আদিত্য সরে দাঁড়ায়।
ইতু নড়েচড়ে চোখ মেলে তাকায়। পাশ ফিরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
ইতুর এমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকা দেখে আদিত্য একগাল হাসে।
ইতু অবাক হয়ে বলল, ” আদিত্য দা! তুমি এখানে?”
আদিত্য মুচকি হেসে ইতুর দিকে এগিয়ে এলো, “আমি এই হসপিটালে জয়েন করেছি কিছুদিন আগে। তোকে আমার রুগি হিসেবে দেখবো ভাবিনি। নিজের এই হাল করলি কি করে?”
ইতু হেসে উঠে বসলো,” আমি তো একদম ঠিক আছি শুধু শুধু তোমারা আমাকে এখানে আটকে রেখেছো।”
ইতুর এই হাসি মুখের পিছনে যে কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে আদিত্য বুঝে নিল। ইতু আগেও নিজের কষ্ট গুলো আড়ালে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে চলতো।
“তা বিয়ে করে এই সিনিয়র বন্ধুটাকে ভুলে গেলি? একটা খোঁজ পযন্ত নিলি না।” আদিত্য নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললো।
“আমার ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি তাই আর যোগাযোগ করতে পারিনি। ভেবেছিলাম ওইখানে গিয়েই তোমার খোঁজ নিব।”
ইতুর উত্তরে প্রসন্ন হয় আদিত্য আবার এটা ভেবেও ভালো লাগছে ইতু তার খোঁজ নিবে চিন্তা করেছে। খুশি হওয়ার জন্য আর কি চাই।
ইতু মুচকি হেসে বলল, “আদিত্য দা তুমি একটু বলে আমাকে রিলিজ করিয়ে দাও আমার আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।”
“তোকে আজকের রাতটাও এখানে থাকতে হবে ইতু।”
” আমি তো এইসব বিষয়ে জানি অনেকটা। আমি তো একদম ঠিক আছি তাও কেনো রেখেছ?”
আদিত্য মনে মনে রাগে ফেটে যাচ্ছে। এতোদিন পর ইতুকে দেখছে ভেবেছিলো আজকে রাতটাও ওকে এখানে রেখে মন ভরে দেখে যাবে। কিন্তু ইতুর জন্য সেটা হবে বলে মনে হচ্ছে। যাই হোক একবার যখন খুঁজে পেয়েছে আর চোখের আড়াল হতে দিবে না।
আদিত্য আর কিছু না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
সেদিকে তাকিয়ে ইতু চিন্তিত হয়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে পড়ল। আদিত্য যে তাকে পছন্দ করে সেটা ইতু ভালো করেই যানে। এখানে আসার আগে শ্রাবণী নামে এক মেয়ে ইতুকে ব্যাপারটা জানায়। মেয়েটা আদিত্যকে পছন্দ করত।আদিত্যই তাকে বলেছে সে ইতুকে ভালোবাসে।
ইতু বুজতে পারছে না এতো বিপদ কেনো তার জীবনে আসছে। আদিত্য ডেস্পারেট টাইপ ছেলে তার যেটা চাই সেটা সে নিয়েই ছাড়ে। ইতু বেশ বুঝতে পারছিল তাকে এখানে রাখার জন্যই রিলিজ দিচ্ছিল না।
ইতু আর কিছু ভাবতে চাইছে না। জীবনটা তার সাথে যেন খেলায় মেতেছে। এতো সহজে সুখের সন্ধান যে সে পাবে না।
রুমে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে ইতু চোখ খুলে দেখে আবির দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো নির্জিব আবিরকে দেখে বুকের ভিতর ধক করে উঠে। লাল লাল চোখ গুলো জানান দিচ্ছে রাতে সে ঘুমায় নি। কেনো ঘুমায় নি? তার ভালোবাসা তো ফিরে এসেছে তার তো এখন সুখের ঘুম দেয়ার কথা।
“আমার ভালোবাসা এখানে কষ্টে শুয়ে আছে আমি কি করে সুখের ঘুম দি?”
ইতু চমকে উঠে এই কথা শুনে। আবির তার মনের কথ শুনে ফেলেছে?
“তোর মনের কথা শুনার জন্য কষ্ট করতে হয় না যেভাবে মুখ নাড়িয়ে কথা বলিস প্রায় সবই শুনা যায়।”
ইতু আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আবির এসে বেডের পাশের টুলে বসলো।
“আমি যানি তুই আমাকে আর কুহুকে দেখে কি ভেবেছিস। কিন্তু যেটা ভাবছিস তেমন কিছু নেই আমাদের মধ্যে।”
ইতু হুহু করে কেদে উঠলো,” কোনো মেয়েই তার স্বামীর বুকে অন্য মেয়েকে সহ্য করবে না আর এটা তো কুহু। তুমি কি করে ওই মেয়েকে তোমার বুকে জায়গা দিলে। ”
আবির বেডে গিয়ে ইতুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে গভীর ভাবে চুমু দিলো। ইতু আবিরের বুকে চটপট করছে থাকবে না সে এই বুকে।
“ছাড় আমাকে একদম ছুবে না আমায়। তোমার এই বুকে আমি থাকবো না। যে বুকে অন্য মেয়ের ছোঁয়া পড়ে ওই বুকে আমি থাকবো না।”
কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
“এই বউ, এমন করছিস কেনো? তাকা আমার দিকে।”
আবির জোর করে ইতুকে তার দিকে ফেরায়। ইতু নিচের দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে। কান্নার চোটে নাকটা রক্ত লাল হয়ে আছে। আবির সে দিকে তাকিয়ে নাকের উপর আলতো করে চুমু খায়। ইতু শান্ত হয়ে বসে থাকে কিছু বলে না।
আবির এক এক করে ইতুর চোখে, কপালে, গালে চুমু খায়।
“আমি যবে থেকে তোকে ভালোবাসতে শিখেছি তবে থেকে শুধু এটাই যানি তুই ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ পা দিতে পারবে না। কুহু ও না।”
ইতু চোখ তুলে আবিরের দিকে তাকায়।
“কুহু আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসার নাম হলেও আমার ভালোবাসার দামতো সে দেয় নি। ঠিক পয়সাওয়ালা ছেলে পেয়ে বিয়ে করে চলে গেছে। তোর বাক্সবন্দী চিঠি গুলা পরে বুঝতে পেরেছি আসল ভালোবাসা কি। কিভাবে একজনকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যায়। আমার প্রতি তোর অনুভূতি গুলোই আমাকে তোর প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। নতুন করে ভালোবাসা শিখায়। জানিস আফসোস করতাম কেনো ভুল বুঝে তোকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। আমি কি করতাম বল, কুহু অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছিলো আমি বার বার বোঝাচ্ছিলাম আমাকে ছেড়ে যেনো না যায়। আমার প্রতি তার ভালোবাসা কি মিথ্যা ছিল? আমাদের এতোদিনের স্মৃতি স্মরণ করাতে থাকি। চিঠির কথা বলতেই বলে কিসের চিঠি সে কোনোদিন চিঠি পায় নি। ওকে যেনো ভালোবাসার দোহায় না দি। মিথ্যে ভালোবাসার নাটক না করি। এইসব শুনেই মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো। হাজার বুঝানোর পরও আমার কথা শুনেনি। তাই সেদিন ওই ভুলটা করে বসি।
আসলে কথাটা সত্যি, আমরা সবসময় ভুল মানুষটাকে ভালোবাসি।
আমি আমার ভুল থেকে শিখেছি তোকে ভালোবেসেছি। তোর মতো করে কেউ কখনো আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমি জানি তুই এখনো আমাকে কতোটা ভালোবাসিস ভুল বুজে আমার থেকে দূরে সরে যাস না ইতু। তোকে ছাড়া সত্যি মরে যাবো।”
ইতু এতোক্ষন চুপ করে সব কথা শুনছিলো শেষ কথাটা শুনে আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আবিরের বুকে মুখ গুজে দেয়। আবির ইতুর চুলের উপর চুমু দিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
কিছুক্ষণ পর ইতু বুক থেকে মাথা তুলে বলে,” কুহু আপু এতোদিন পর কেনো এসেছে?গল্পঃ বাক্সবন্দী চিঠি
লেখকঃ Ninika Jaman Noor
পর্বঃ ২০
কিছুক্ষণ পর ইতু বুক থেকে মাথা তুলে বলে,” কুহু আপু এতোদিন পর কেনো এসেছে? তোমার কাছে কি চায়? তোমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলো কেনো?”
ইতুর ছোট করে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। বউ যে তার জ্বলে ফুরে যাচ্ছে বুঝতেই পারছে।
“হাসছো কেনো? উত্তর দাও।”
“তোর মতো মিনি পটাকা দেখে হাসছি। মুখ ফুটে তো ভালোবাসিস বলতে পারিস না যেই কুহু কে দেখলি ওমনি হিংসায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলি?এতো ভয় আমাকে নিয়ে? ”
ইতু অগ্নিদৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে সরে বসলো।
“একদম বাজে কথা বলবে না। যেটা জিজ্ঞেস করছি সেটার উত্তর দাও।”
আবির ইতুর কোমর ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে ইতুর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ” আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবি। না বুঝে উত্তেজিত হবি না। ভেবে তার পর উত্তর দিবি।”
ইতু ভাবনায় পড়ে গেলো কি এমন কথা বলবে যে তাকে উত্তেজিত হতে মানা করছে? ইতুর ভয়ে বুক ধুরুধুরু করছে। সে যেমন ভাবছে তা যেনো না হয়।
“তুই যেমন ভাবছি তেমন কিছু নয়। কুহু বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছে।
__________________________
সেদিন ইতুকে ওই সাজে দেখে আবিরের বুক শিরশির করে উঠে। অবশেষে তার প্রেয়সীর মনে জায়গা করতে পেরেছিলো। আবির বেশ বুঝতে পারছিল ইতু তার মুখে প্রসংশা শুনতে চায়। কিন্তু আবির চাচ্ছিলো ইতুকে ফুল দিয়ে প্রপোজ করতে। সে এইসব এর প্রিপারেশন নিতে নিজের রুম এ বসে কাজ করছিলো। তখনই রুমে আসে কুহু। ওকে দেখে অবাক হয়ে যায় আবির।
” তুমি এখানে কি করছো? বাসায় কি করে ঢুকলে?”
কুহু এসে আবিরের হাত চেপে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বললো, “প্লিজ আবির আজকে তুমিও আমাকে তাড়িয়ে দিও না আমি মরে যাবো আবির। তুমি ছাড়া আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না।”
আবির এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। রক্তচক্ষু নিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো, “খবরদার আমার ধারের কাছে আসবে না। আর তোমার এই নাটক অন্য কোথাও গিয়ে দেখাও। ভুল জায়গায় এসেছো। আর এক মিনিট ও যেন তোমাকে এখানে না দেখি তাহলে কিন্তু আমি আমার ভদ্রতা ভুলে যাবো।”
কুহু দিশেহারা হয়ে আবিরের পা চেপে ধরে। “আবির কথা শুনো, আমি প্রেগন্যান্ট।”
কথাটা শুনে আবির নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। কুহু তখনো আবিরের পা চেপে ধরে কেদে চলছে।
“কুহু আমার পা ছাড়, তোমার এই অবস্থায় আমি টেনে সরালে হিতের বিপরিত হবে। সরে এসে কথা বলো।”
কুহু উঠে দাড়ালো। মাথা নিচু করে নাক টেনে যাচ্ছে।
আবির তার জানালার দিকে তাকালো, না বন্ধ আছে। মনে মনে একটাই দোয়া করছে ইতু যেন এখন না আসে।
“আবির প্লিজ আমাকে তাড়িয়ে দিও না।” কাঁপা গলায় বললো কুহু।
“যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।”
কুহু এক নজর আবিরকে দেখলো। কুহু বলতে পাগল ছেলেটা কেমন খাপছাড়া কথা বলছে যেন কুহু গেলেই বাঁচে। চোখে তার জন্য সে ভালোবাসা নেই আছে এক আকাশ অসস্তি।
কুহু দম নিয়ে বললো,”সজল আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।”
আবির ভ্রু কুঁচকে বললো,”সজল কে তোমার হাসব্যান্ড?”
কুহু মাথা নিচু করে বলে,”হুম।”
“কেনো?”
কুহু ইতস্তত করে বলে,”বিয়ের পর আমার হাসব্যান্ড সজল বিদেশে চলে যায়। দুই বছর হলো আসার নাম নেই। আমি একাকিত্বে ভুগতে থাকি। কয়েক মাস আগে পাশের ফ্ল্যাটে আসে নয়ন। নয়ন আমার একাকিত্বের সুযোগ নেয়। বার বার আমাকে বুঝাতে থাকে ও আমাকে কতোটা ভালোবাসে। আমি ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। আজ ওর সাথে সময় কাটানোর সময় হঠাৎ করেই সজল বাসায় চলে আসে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে। আমাকে আর নয়নকে ওই অবস্থায় দেখে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। আমি নয়ন এর কাছে আশ্রয় চাইলে ও বলে দেয় অন্যের স্ত্রীকে সে ঘরে তুলতে পারবে না। আমি জানাই আমি ওর বাচ্চার মা হতে চলেছি। ও বলেছে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে। উপায় না পেয়ে বাসায় ফিরে আসি। এখানে এসে জানতে পারি সজল বাবাকে সব বলে দিয়েছে। বাবা কিছুতেই আমাকে বাসায় জায়গা দিবে না। আমার থেকে তার মান সম্মান বড় কিনা।”
কুহু ঢোক গিলে আবার বললো,” আবির আমাকে কিছুদিন এখানে জায়গা দাও আমি নিজের কোনো একটা ব্যবস্থা করেই চলে যাবো। আমার হাতে এখন কোনো টাকাও নেই যে আমি অন্য কোথাও উঠবো।”
আবির শান্ত হয়ে কুহুর কথা শুনলো। চুলে হাত দিয়ে কিছু একটা ভেবে বললো,” নিজের স্বামীকে ফেলে তুমি কি করে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারো? তোমার কি একবার ও বিবেকে বাধলোনা? ছিঃ। এই জন্যই বলে আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। তোমার মতো মেয়ে আমার জীবন থেকে না চলে গেলে আমি বুঝতামই না আসল ভালোবাসা কি। যাই হোক চলো নয়ন ছেলেটার নামে কেস ফাইল করবো। ”
আবিরের কথা শুনে কুহু মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগলো কিন্তু শেষের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলো।
” না আবির প্লিজ আমার সম্মান যে টুকু আছে তাও থাকবে না। প্লিজ আবির আমকে শুধু কিছু দিনের জন্য জায়গা দাও আমি চলে যাবো।”
আবির ভেবে পাচ্ছে না কি করবে। এই অবস্থায় ওকে চলে যেতেও বলতে পারছে না আবার ইতুর কথা চিন্তা করলে কুহু এখানে থাকতে দিতেও ইচ্ছা করছে না।
আবির কিছু একটা ভেবে বললো,” ঠিক আছে থাকতে পারো,,,
আবির পুরো কথা শেষ করার আগেই কুহু এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরে। আর ঠিক তখনই ইতু চলে আসে সেখানে।
_________________________________
“আমি তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে কতটা ভয় পেয়েছিলাম যানো তুমি?
ইতু চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ” কুহু আপুকে কি তুমি সত্যি বাসায় জায়গা দিবে?”
আবির শান্ত গলায় বললো, “আমি ওকে কিছু দিনের জন্য অয়ন এর বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। অয়ন যদি এসে বলে ওকে আর রাখতে পারবে না তাহলে আমাদের বাসায় না এনে তো উপায় নেই। এই অবস্থায় তো ওকে চলে যেতে বলতে পারি না রাস্তায় রাস্তায় ঘুরা লাগবে।”
ইতু কিছু একটা ভেবে চুপ করে গেলো।
আবির প্রাণ ভরে তার প্রেয়সীকে দেখছে। মেয়েটা তার এতো কাছাকাছি তাও মনে হচ্ছে অনেক দূরে।
আবির ইতুর বাম হাত ইতুর চুলে চালিয়ে দিয়ে ডান হাত গালে রেখে মুখটা উঁচু করলো। ইতু এতোক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকায় ব্যাপার টা খেয়াল করেনি। আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে ইতুর পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। আবির কেমন নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
” ভাবুকরানী, কেন এতো দূরে দূরে থাকিস বলতো?”
ইতু শুকনো ঢোক গিলে বললো,” কোথায় দূরে? নিজের সাথেই তো মিশিয়ে রেখেছো।”
আবির নেশা ধরানো গলায় বললো,” তোর আর আমার মাঝে এক সুতোর ফাঁক ও আমার জন্য খুব বেশি দুরত্ব মনে হয়।”
আবিরের কথায় ইতু বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে। আবির ইতুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকের সাথে নাক ঘসলো।
“আবির ভা,,,,”
ইতু কথা শেষ করার আগেই আবির ইতুর ওষ্ঠ জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিলো। ইতু আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। আবির ইচ্ছা মতো নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে।
_______________________
ইতুকে বাসায় নিয়ে আসার পর সবাই দেখতে চলে আসে। ইতুর বান্ধবিরা তো তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ইতু আর আবিরের মা কিচেনে কাজ করছেন একসাথে। বাবারা চলে গেছেন কাজে।
আবির রুমের এক পাশে দাঁড়িয়ে অয়ন আর শ্রাবণ এর সাথে কথা বলছে।
ইতুর আর আবিরের বিয়ের কথা এখনো কেউ যানে না। আবির তাদের বিয়ের কথা বলার পরই যেনো রুমের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। ইতুর বান্ধবিরা হা করে ইতুর দিকে তাকিয়ে আছে। ইতু লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না।
“অসভ্য, কথাটা বলার সময় পায় নি আর? বান্দরগুলো আজ জ্বালিয়ে মারবে তাকে।”
ইতু মনে মনে কথাগুলো বলে আড় চোখে আবিরের দিকে তাকালো। আবির তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে চলছে। ইচ্ছে তো করছে মাথা ফাটিয়ে দিতে পরক্ষণেই বান্ধবিদের দিকে তাকিয়ে ফুস হয়ে গেলো সকল সাহস।
শ্রাবণ চোখ বড় বড় করে ইতুর দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ এর রিয়েকশন দেখেই আবির বেশি শান্তি পাচ্ছে।
সবার প্রথমে মুখ খুললো অয়ন,” শালা এতো আগে বিয়ে করে তুই আজ আমাদের জানাচ্ছিস? বন্ধু নামে কলঙ্ক তুই।”
” আরে আমার কি দোষ ইতু বিয়ের জন্য এমন ভাবে জোর করলো তখনই বিয়ে না করলে নাকি হাত কেটে ফেলবে। তাই বাধ্য হয়ে তখনই বিয়েটা করে ফেলছি।”
ইতুর মাথায় যেন বাজ পড়লো কথাটা শুনে। চেঁচিয়ে উঠে বললো, “মিথ্যুক, আমি কখন জোর করেছি তোমাকে? তুমি উল্টো আব্বু আম্মুকে পটিয়ে জোর করে বিয়ে করেছো।”
“ইসস বললেই হলো নাকি? তোরা জানিস ও তো আমাকে মারার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। এই দেখ গরম কফি ছুড়ে মেরেছে।”
আবির টি-শার্ট গলার পাশে একটু সরিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিলো সেদিনের কফির দাগ। আবির ওষুধ না লাগানোতে দাগ রয়ে গেছে।
সবাই অবাক চোখে ইতুর দিকে তাকিয়ে আছে।
ইতুর রাগে লজ্জায় কথাই বলতে পারছে না। চোখে পানিরা এসে ভীড় করেছে। কান্না করলে আরো লজ্জায় পড়ে যাবে দেখে কাঁদতেও পারছে না।
অর্পিতা মুখ থেকে হাত নামিয়ে ইতুকে খোঁচা দিয়ে বললো,” তুই তো নাকি আবির ভাইয়ের সাথে কথাই বলবি না সেখানে আবার তাকেই জোর করে বিয়ে করে ফেলেছিস? আবির ভাইকে গরম কফিও ছুড়ে মেরেছিস? এই কোন ইতুকে দেখছি আমরা?”
রুপু অবাক গলায় বললো, “ভাই আমার তো এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
অহনা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো, ” এই ইতু তুই না বলেছিলি আবির ভাইকে ভালোবাসিস না? তাহলে তাকে বিয়ে করলি কেনো? তোর কথা শুনে এতোদিন আমি আবির ভাইকে বিয়ে করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন আমার কি হবে?”
অহনাএ কথা শুনে ইতু জ্বলন্ত চোখে তাকালো। আবির মুচকি হেসে ইতুর দিকে তাকিয়ে আছে।
অহনার মাথায় অর্পিতা গাট্টা মেরে বললো,”মুখ খুলেই তোকে সব সময় ফালতু কথা বলতে হবে?”
অহনা মুখ ভার করে চুপ করে রইলো।
অয়ন বললো,” আচ্ছা বিয়ে যখন হয়েই গেছে আবির ট্রিট টাও দিয়ে দে এইবার।”
অয়নের কথা শুনে অর্পিরতা, অনু, রুপু হইহই করে উঠলো।
আবির মাথা চুলকে হেসে বললো,” মহারানী বললে সবাইকে নিয়ে ডিনারে যেতে পারি।”
এইবার ইতুর বান্ধবিরা ইতুকে চেপে ধরলো। ইতু তখনো মুখ ফুলিয়ে আছে। সে কখনো এই অতি মাত্রার অসভ্যর সাথে কোথাও যাবে না।
চলবে।
চলবে।