বিকেলে ভোরের ফুল পর্ব ১০

#বিকেলে_ভোরের_ফুল

#পর্ব_১০

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

স্পর্শ হঠাৎ করেই ফুলের একদম কাছে চলে আসে। এতে ফুলের খানিকটা অস্বস্তি বোধ হলো তাই সে পিছিয়ে গেল। স্পর্শ এক ধ্যানে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিঃশ্বাস ওর আটকে আসছে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। স্পর্শর কেমন জানি সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ও ভাবতেই পারছে না যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ফুল। এতদিন ওর সাথে থেকেছে অথচ ও চিনতে পারল না। স্পর্শ ফুলকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরল। ফুল তো অবাকের পর অবাক হচ্ছে। ও ভেবে পাচ্ছে না যে ও কি এমন বললো যে এই কিডন্যাপারটা এতো ইমোশনাল হয়ে গেলো। পাগল নাকি অগত্যা ফুল নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেছে কিন্তু পারছে না স্পর্শ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ফুলকে। ফুলের দম বন্ধ হয়ে আসছে এভাবে জড়িয়ে ধরাতে। কিছুক্ষণ পর স্পর্শ নিজে থেকেই ফুলকে ছেড়ে দিল। ফুলের গালে আলতো করে হাত দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেল।

এবার ফুলের রাগ সপ্তম আসমানে চড়ে বসে। এতক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিল কিছু বলেনি তাই বলে কি চুমু খেতে হবে??ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় স্পর্শের গালে। তারপর বলল,

–“অসভ্য বেহায়া বদমাশ। আপনার সাহস হলো কিভাবে আমাকে ছোঁয়ার?? আবার আমাকে,,,,,,ছিঃ।

স্পর্শ কিছু বলল না ঠোঁটের কোণে হাঁসি ঝুলিয়ে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক দিন পর আজকে তৃপ্তি মিটিয়ে ফুলকে দেখতেছে। কতগুলা বছর ধরে ফুলের থেকে আলাদা ছিল। তাই আজকে যেন মন ভরছে না ওর। এতদিন তো ফুলের দিকে তেমন ভাবে তাকায়নি। ও ফুলকে পাপড়ি ভেবেছিল। কিন্তু আজকে জানলো ওর ধারনাটা সম্পূর্ন ভুল। এটাই ফুল ওর বিকেলে ভোরের ফুল। স্পর্শ ভালো করে ফুলকে পর্যবেক্ষণ করছে। ছোট্ট ফুলের সাথে এই ফুলের অনেক তফাৎ হয়ে গেছে। শুধু ঠোঁটের নিচের তিলটাই আগের মতো আছে। স্পর্শের এমন চাহনি দেখে ফুল ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,

–“আপনার মতো খারাপ লোক আমি জীবনে দেখেনি। অবশ্য আপনার থেকে তো এর বেশী আশা করাও যায়না। কারণ আপনি কিডন্যাপার। এতদিন যে আমার সাথে কিছু করেননি এটাই তো ঢের। চোখ দিয়ে গিলে খাওয়াটাই তো আপনার স্বভাব তাইনা??”

এবারও স্পর্শের কোন হেলদোল নেই মূল কথা ওর কানে ফুলের কোন কথাই যাচ্ছে না। ফুল ও বুঝতে পারছে না যে স্পর্শ এমন কেন করছে?? ফুলের মনে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। ছেলেটাকে কি ভুতে ধরল নাকি?? তাহলে তো ফুলের ঘাড় মটকাবে নিশ্চিত। ফুল মাটি থেকে শিকলটা হাতে তুলে নিয়ে পিছনে ঘুরে সমুদ্রের তীর বরাবর দৌড় দিলো। ফুল কয়েক কদম এগোতেই স্পর্শের ঘোর কাটলো। ফুল পালাচ্ছে স্পর্শ কি তাহলে আবার ফুলকে হারিয়ে ফেলবে?এতদিন সবটা জানলো,স্পর্শও ফুলের পিছু পিছু দৌড় দিলো। ফুল দৌড়াচ্ছে আর বলছে,

–“ভুত আমার পুত পেতনি আমার ঝি গ্রাম লক্ষণ সঙ্গে আছে করবে আমার কি??”

বলছে আর দৌড়াচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের সাথে কি মেয়েরা দৌড়ে পারে??তাও আবার পায়ে লোহার শিকল পরা। স্পর্শ পিছন থেকে এসে ফুলের হাত ধরে হেঁচকা টান মারে। ফুল সাথে সাথেই স্পর্শর গায়ের উপর এসে পড়লো। স্পর্শ টাল সামলাতে না পেরে ফুলসহ পড়ে যায়। ফলে বালিকাদায় মাখামাখি হয়ে গেল দু’জনেই। ফুল স্পর্শকে ছেড়ে উঠে বসে বলল,

–“প্লিজ প্লিজ প্লিজ আমার ঘাড় মটকাবেন না।”

স্পর্শ অবাক হয়ে বলল,

–“তোমার ঘাড় মটকাবো আমি?? পাগল হলে নাকি??”

ফুল হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,

–“হ্যা আপনি। প্লিজ আমার ঘাড় মটকাবেন না। আমি জানি আপনাকে ভুতে ধরেছে তাই এতক্ষণ ধরে আপনি এমন করছিলেন। কেন যে বিকেলবেলা এখানে আসতে গেলাম??এই নির্জন জায়গায় তো ভুতের বসবাস। আল্লাহ বাঁচাও আমাকে।”

ফুলের কথা শুনে স্পর্শ হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বলল,

–“লাইক সিরিয়াসলি ফুল। তোর ভুতের ভয় এখনো গেল না??”

ফুল অবাক হয়ে বলল,

–“মানে?? আর আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন??”

স্পর্শ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

–“কিভাবে কথা বলছি??”

–“আপনি যেভাবে বলছেন মনে হচ্ছে আপনি আমার আপন কেউ। কাছের কেউ।”

স্পর্শ গায়ের বালু ঝাড়তে লাগলো। ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

–“ওহ আচ্ছা। আমি তোমার কাছের কেউ হতে পারি না??”

–“না আমার আপন কেউ নেই আর যারা আছে তাদের কে আমি ঘৃণা করি। আমার জীবনে আপন বলতে যারা ছিল তারা চলে গেছে।”

–“যদি বলি সবাই চলে যায়নি কেউ একজন তোমার কাছেই আছে।”

ফুল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

–“না নেই। মা তো কবেই চলে গেছে শেষ সম্বল ছিল আপু সেও আকাশের তারা হয়ে গেছে। আর কেউ নেই আমার আপন। আমি আর কাউকেই আপন মনে করি না। যেদিকে তাকাই সেদিকেই কোন না কোন শত্রু আমার জন্য ওত পেতে আছে আমার জীবনটা নরক করে দেওয়ার জন্য। এমনিতেই আমি এতদিন কোন এক নরকেই ছিলাম। এখন শুধু একজনের জন্যই আমি অপেক্ষা করছি।”

ফুলের শেষ কথাটা শুনে স্পর্শ একটু খুশি হলো ভাবলো ফুল এখনো ওর জন্য অপেক্ষা করছে। তাই জিজ্ঞেস করলো,

–“কার জন্য অপেক্ষা করছো??”

–“মৃত্যু। হ্যা মৃত্যু, একমাত্র মৃত্যুই আমাকে এসবের থেকে মুক্তি দিতে পারবে।”

কথাটা বলেই ফুল পা টেনে টেনে চলে যায়। স্পর্শ এখনো ওখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ফুলের কথাগুলো এখন ও ওর কানে বাজতেছে। ফুল কাকে ঘৃণা করে বলল?? তাহলে ফুল কি স্পর্শকেও ঘৃণা করে?? না তা কেন হবে??কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ফুলের সাথে। একসাথে খেলা করা স্কুলে যাওয়া মারামারি করা আরও কত কি?? কিন্তু ফুল একবার ও স্পর্শর কথা বলেনি কেন?? তাহলে কি ফুল সত্যি সত্যি স্পর্শকে ঘৃণা করে। যদি স্পর্শর আসল পরিচয় জানতে পারে তাহলেও কি ঘৃণা করবে??সব প্রশ্নগুলো স্পর্শর মাথায় জেঁকে বসেছে।

ফুল ভাঙ্গা ঘরটাতে ফিরে এসে খড়ের গাদার উপর বসে পড়ল। কাঁদছে খুব সে। ভালোবাসার সব মানুষগুলো ওকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই কষ্টগুলো আবার চাড়া দিয়ে উঠেছে ওর। পিছনের সব কথা ভুলে যেতে চায় কিন্তু পারে না। স্পর্শকে সব কথা বলতে পারেনি তাই একটু বেশি কষ্ট হচ্ছে। লোকে বলে না যে,কষ্টের কথা কারো কাছে শেয়ার করলে কষ্টটা হালকা হয়। কিন্তু ফুল তো পুরো কথা শেয়ার করতে পারেনি। আর শেয়ার করলেই বা কি হবে?? একটা কিডন্যাপার ওর কষ্টের কথা কি বুঝবে??এসব ভাবছে আর চোখের পানি মুছছে ফুল।

সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শ। পানির ঢেউগুলো একটু পর পর এসে স্পর্শর পা দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে। সূর্য ঢলে পড়েছে এখনি সন্ধ্যা নামবে। মনে হচ্ছে সূর্যটা আস্তে আস্তে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। স্পর্শ দুপকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতেছে। একধ্যানে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত সূর্যের দিকে। সূর্যের মতোই ওর বুকটা জ্বলে যাচ্ছে সেটা কেউ দেখছে না। সমুদ্রের সব নোনা পানি যদি ওর বুকে ঢালা হয় তবুও ওর বুকের জ্বালা কমবে না। স্পর্শ চোখ বন্ধ করে ফেলল সাথে সাথেই ছোট্ট ফুলের হাসি মাখা মুখটা ভেসে উঠলো ওর। কি সুন্দর সেই হাসি। সেই হাসি স্পর্শকে আজও মাতাল করে দেয়। না জানি এখন হাসলে ফুলকে কেমন দেখায়??যদি এখন ওর হাসি আরও মারাত্মক সুন্দর হয় তাহলে তো স্পর্শ পাগল হয়ে যাবে। একথা ভেবেই স্পর্শ মুচকি হাসে।

ঘরের জানালা দিয়ে ফুল বাইরে তাকিয়ে আছে। মূলত সূর্য ডোবা দেখতেছে। কি সুন্দর করে সূর্য টা সমুদ্রের বুকে তলিয়ে গেল। ফুল স্পর্শকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। দূর থেকে পিচ্চি দেখা যায় স্পর্শকে। দূরে থাকা কোন কিছুকে ছোটই দেখা যায়। ফুল একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার খড়ের গাদার উপর গিয়ে বসে। সামনে বাঁশের উপর একটা হারিকেন ঝুলছে। হারিকেনের আঁচ কমানো আর চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে তাই ফুল গিয়ে আঁচটা বাড়িয়ে দিতেই ঘরময় আলোতে ভরে যায়। ফুল এই প্রথম হারিকেনের আলোয় বসে আছে। একদম অন্যরকম অনুভূতি। ফুল বসে বসে খড় টেনে টেনে ছিঁড়ছে। স্পর্শ এখনও আসছে না। ফুল বিড়বিড় করে বলল,

–“কিডন্যাপারটা এখনও আসছে না কেন??কি করছে সমুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে??হাঙরে আবার খেয়ে ফেলল না তো??তাতে আমার কি?? অসম্ভব বেয়াদব ছেলেটা। এখানে না আসলেই ভালো।”

ফুল অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে তবুও স্পর্শের দেখা নেই। তাই ঘুমিয়ে পড়ল ফুল। একটু শীত শীত লাগছে ফুলের তাই ওড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল। শীতে জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে ফুল। স্পর্শ এতক্ষণ ধরে ঘরে আসেনি কারণ ওকে দেখলে না জানি ফুল আবার কি বলে বসে। তখন যে ওর কি হয়েছিল?? হঠাৎ করে ফুলকে জড়িয়ে ধরা কপালে চুমু খাওয়া। এসব ভাবতে ভাবতে স্পর্শের মাথায় হাত চলে গেল। নিজের চুল এখন নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কেন যে তখন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। এখন তো ফুল ওকে ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবে না। তাই স্পর্শ বাইরে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে ফুলকে দেখছিল। ফুলের ঘুমিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। ফুল ঘুমিয়ে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর স্পর্শ আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো।

দেখলো ফুল শীতে কুঁকড়িয়ে শুয়ে আছে। স্পর্শ ব্যাগ থেকে কালো রঙের জ্যাকেটটা বের করে ফুলের গায়ে জড়িয়ে দিলো। ফুল একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। মুখের সামনে আসা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিল। তারপর হারিকেনটা হাতে নিয়ে ফুলের সামনে বসে পড়ল। আজকে সারারাত হারিকেনের আলোয় ফুলকে দেখবে সে। নতুন করে আবার নিজের লুকানো অনুভূতি ফিল করবে। হারিকেনের আলোয় একধ্যানে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে স্পর্শ। ঘুমন্ত অবস্থায় আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে দেখেনি সে। ফুলের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না স্পর্শ। পা দুটো ভাঁজ করে গালে হাত দিয়ে বসে বসে ফুলকে দেখছে। ঘুমন্ত অবস্থায় যে ফুলকে এতো সুন্দর লাগে তা যদি স্পর্শ আগে জানতো তাহলে আগে থেকেই রাত জেগে থাকত। কিন্তু কি আর করার??ও তো জানতোই না যে এই মেয়েটাই ওর ফুল।

সকাল বেলা একটা শব্দে ফুলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফুল লাফ দিয়ে উঠে বসে। গায়ে জ্যাকেটটা দেখে ঘাবড়ে যায়। এটা তো স্পর্শের জ্যাকেট। ওর গায়ে কিভাবে এলো??তার মানে স্পর্শ কাল রাতে ওর গায়ে এটা জড়িয়ে দিয়েছে। স্পর্শ কিভাবে জানলো যে ওর শীত করছে??এসব ভাবতে ভাবতে ফুল জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে ওড়না ঠিক করে দাঁড়ালো। তখনও বাইরে থেকে কিছুর শব্দ আসছে। ফুল বুঝতে পারছে না যে বাইরে কি হচ্ছে??তাই ও আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে বের হয়। বাইরে এসেই ফুল হা হয়ে গেল। স্পর্শ এটা কি করছে??পাগল হয়ে গেল নাকি??

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here