বৈবাহিক চুক্তি পর্ব -১১-১৫

#বৈবাহিক_চুক্তি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্বঃ( ১১-১৫)

অপরাহ্নের পর এখন গোধুলি লগ্ন চলছে,মাথার উপরের সূর্যটা অস্ত গিয়েছে সেকেন্ড কয়েক আগে তবে তার রেশ এখনো যায়নি। আবছা আলোয় চারপাশ ছেয়ে আছে, তবে পার্কে লাইটগুলো ইতোমধ্যে জলে উঠেছে। জনসমাগম এখন অনেকটা কম, তাই চারদিকে ফাকা বেঞ্চগুলো পড়ে আছে। এই মুহুর্তটা খুব ভালো লাগছে রুশির, না শীত না গরম কেমন একটা নাতিশীতোষ্ণ ভাব। তবে চারপাশে বায়ুপ্রবাহ কম বইলেও হৃদ মাঝারে ঘূর্ণিঝড় সাইক্লোনের ন্যায় জড়োহাওয়া বইছে। একটা নারী নাকি সন্তান জন্ম পারলেই পরিপূর্ণ হয়, আদোও কি তাই! তবে এটা কেন বলে যে স্বামীর ভালোবাসা ছাড়া স্ত্রী অপূর্ণ। ওর সন্তান আছে আর তাকে আকড়ে ধরেই বেচে আছে কিন্তু দিনশেষে একটা মানুষকে তো চাই যে একান্ত নিজের হবে।রুহান ওর কাছে আবদারের ঝুড়ি খুলে বসতে পারে কিন্তু ওরও তো খুব ইচ্ছে করে কারো কাছে আবদার করতে। বাঙালি নারীদের চুড়ি খুব পছন্দের জিনিস, রুশির খুব ইচ্ছে ছিলো ওর সেই মানুষটা ওকে চুড়ি গিফট করবে আর নিজের হাতে পরিয়ে দিবে। মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে সেই মানুষটাকে দেখতে আর যখন খুজে পায়না তখন একরাশ অভিমান জমা হয়। এই অভিমানের ঝুড়ি ভারি হতে হতে এখন মনে সেই মানুষটাকে ও ঘৃণা করে কিন্তু কখনো কি করতে পেরেছে! তাহলে আজোও ভাবে কেন তার কথা।
রুহানের ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে আসলো ও

“মাম্মা, আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই ”

” কি প্রশ্ন বাবা?”

” ওই বাচ্চাটি এত কালো কেন? “পাশের বেঞ্চের সামনে খেলতে থাকা একটা বাচ্চাকে উদ্দেশ্য করে বললো কথাটি, পাশের বেঞ্চের দম্পতি ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, রুশির খুব লজ্জা লাগলো তাদের চাহনিতে সাথে রাগও উঠলো রুহানের উপর, অন্যসময় হলে হয়তো বুঝিয়ে দিতো কিন্তু এখন এমনিতেই মন খারাপ তাই রুহানকে ধমক দিয়ে বললো

” এসব কি কথা রুহান?স্যরি বলে ওকে,বলো…”

” বাট মাম্মা আমি সত্যিই বলছি ওতো কালোই ”
রুশির যেন মেজাজ বিগড়ে গেলো, কি বলছে কি এইসব তাই রুহানকে মারতে নিলেই সুজি হাত ধরে ফেললো তারপর বললো “আমি বুঝাচ্ছি, রিলাক্স ও একটা বাচ্চা ছেলে এতো বুঝে বলে নি।রুহান তুমি আমার কোলে আসো, শুনো সে কালো কেন তা আমি তোমাকে বলছি,
শুনো ও দেখতে কালো কিন্তু সুন্দর দেখো, কালোরঙ ও একটা সুন্দর রঙ। তাই ও সুন্দর এবং শুভ্র। তুমি জানো গড প্রথম কালো রঙের মানুষ বানিয়েছে এবং সে তার এই অসাধারণ সৃষ্টির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। সে তাই একইরকম অনেকজনকে বানিয়েছে যাদের একটা সুন্দর হৃদয় আছে। তাই তাদের গড ভালোবাসে।

” তাহলে মাসি গড কি আমাদের ভালোবাসে না?”

” কেন বাসবে না? আমরাও তো তার সৃষ্টি ”

” তাহলে আমাদের ফর্সা কেন বানিয়েছে? ”

” এইতো ভালো প্রশ্ন করেছো, গড তার সৃষ্টিকে অনেক ভালোবাসতো তাই নিজে তাদের দেখার জন্য পৃথিবীতে আসতো, একদিন গড এই পার্কের মতো একটা পার্কের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। তখন দেখলেন একটা সুন্দর কালো মেয়ে একা একা বসে সাদা মৃত্তিকা দিয়ে পুতুল বানানোর চেষ্টা করছে, সে তার ছোট্ট সুন্দর হাতজোড়া মাটি দিয়ে পুরো একে ফেলেছে, তাই সে ওই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আরো কিছু মানুষ বানানোর কথা ভাবলেন এবং তাদের সাদা পেইন্ট করার চিন্তা করলেন। এভাবেই আমাদের বানিয়েছে, তাই আমরা সবাই একি গড এর ক্রিয়েশন আর বাহিরের রঙ আলাদা হলেও ভেতর থেকে আমরা সবাই কালো। দেখো তোমার মাম্মা তোমার থেকে কম ফর্সা তাই বলে কি সে সুন্দর নয়?”

” নো, মাম্মা ইজ বিউটিফুল ”

” তাহলে ওকে দেখো ও কিন্তু অনেক সুন্দর শুধু রংটা আলাদা, ইটস জাস্ট আ পেইন্ট বেবি কিন্তু সুন্দর সেই যার মনটা সুন্দর। কালো, সাদা, বাদামি সেটা ফ্যাক্ট নয় আর তোমার তো ব্লাক কালার পছন্দ তাইনা? ব্লাক ইজ বিউটিফুল বেবি ”

“ইয়েস মাসি, বুঝতে পেরেছি এটা জাস্ট একটা পেইন্ট কিন্তু আমরা সবাই একি”তারপর পাশে থাকা দম্পতির দিকে তাকিয়ে বললো ” রুহান ইজ স্যরি ”

রুশি তাকিয়ে আছে ওর ছেলের দিকে কত সহজে সব বুঝে গেলো, ও যদি না থাকতো তাহলে কি নিয়ে বাচতো রুশি?

🌸🌸🌸

সুজির ফোন পেয়ে রুশি তাড়াতাড়ি রেস্টুরেন্ট থেকে লিভ নিয়ে বাসায় ফিরে আসে, বাসায় ফিরে এসে সুজিকে কান্নারত অবস্থায় দেখে। ওর কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে, রুহানের কিছু হয়নি তো।

” রুহান… রুহান.. ”

” রুহানকে খুজে পাচ্ছিনা এন”
রুশি ধপ করে মাটিতে বসে পড়েছে, ওর পুরো দুনিয়ায় যেন থমকে গেছে,রুহানকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি।

” এন, আমি যখন চাইল্ড কেয়ারে গিয়েছি তখন তারা বলে রুহানকে নাকি কেউ একজন অলরেডি পিক আপ করতে গেছে। তাই আমি বলেছি যে আপনারা এত ইরেস্পন্সিবল কি করে হতে পারেন? আমরা কেউই তো আসিনি তাহলে কি করে যে কারো হাতে তুলে দিতে পারেন তখন তারা বললো উনি আপনাদের নাম বলেছেন তাই আমি তার সাথে দিয়ে দিয়েছি ”

” কি করে তারা এটা করতে পারে, আমার বাচ্চাটাকে অন্য কারো হাতে তুলে দিবে? আমি কোথায় খুঁজবো এখন ওকে, কি করবো আমি এখন?” রুশি তাড়াতাড়ি উঠে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো, আর সুজি একজনকে মেসেজ করে বললো ” কাজ হয়ে গেছে”

এই ছোট্ট মেসেজ টা দেখে কারো মুখে হাসি ফুটে উঠলো, অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলো ” সি ইউ সুন মিসেস রুশানি আনাম ”

১২.

“হ্যান্ডসাম আংকেল, মাম্মা এখনো আসছেনা কেন? ”

” শুনো, তুমি আমাকে আংকেল বলবেনা, বা..মানে শুধু হ্যান্ডসাম বলবে ওকে??”

” কেন? মাম্মা বলে একটু বড়দের ভাইয়া, আরেকটু বড়দের আংকেল আর আরো বড়দের দাদু বলতে হয়। তো আপনি তো একটু বড়না আরেকটু বড় তাই না তাইতো আংকেলই বলতে হবে ”

” ওহ গড ছেলেকে কি কি যে শেখায় এই মেয়ে! ” বিড়বিড় করে বলে উঠলো লোকটি
” দেখো তোমাকে যেমন কেউ ইংরেজের বাচ্চা বললে ভালো লাগে না তেমনি আমাকেও কেউ আংকেল বললে ভালো লাগেনা”

“কেন প্রেস্টিজে লাগে? ” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো রুহান।

“মানে?”

” আরে সুজি মাসিকে কারো সামনে মাসি বললে তার নাকি প্রেস্টিজে লাগে তেমন আপনাকেও আংকেল বললে প্রেস্টিজে লাগে তাই না?”

” হুম ঠিক তাই, তুমি বরং আমাকে এসকে বলে ডাকো ওকে?”

“ওকে মি. এসকে”

“তো চকলেট খাবে? ”

” নো, মাম্মা বলে চকলেট খেলে কেভিটি হয় আর পরে ডাক্তার এর কাছে গেলে সব দাত ফেলে দিবে আর আমি কিছু খেতে পারবো না”

“ওহ গড তাইতো! তাহলে কি খাবে তুমি ”

“উমম পিজা খাবো তবে মাম্মাকে বলোনা আমি খেয়েছি নাহয় খুনচুন দিয়ে পিটাবে তোমাকেও আমাকেও ”

রুহানের কথা শুনে চোখ বড়বড় করে আছে লোকটি

“খুনচুন কি?”ভ্রু কুচকে বললো

” আরে এটাও জানোনা বুদ্ধু, যেটা দিয়ে রান্না করে ”

“ওহ, রান্নার কাঠি, ভালো কি ভয়ংকর নাম খুনচুন, মনে হচ্ছে চুন খাইয়ে খুন করে দিবে” লোকটি বিড়বিড় করে বলে উঠলো

” পিজা অর্ডার করো ওর জন্য আর হ্যা হেলদি রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করবে”

” ওকে স্যার ”

বাচ্চাটিকে সোফা থেকে নিজের কোলে তুলে নিলো লোকটি তারপর দুজনে মিলে ফোনে গেমস খেলতে শুরু করলো। “লর্ড মোবাইল” খেলছে দুজনে, শত্রুপক্ষকে হারিয়ে দুজনেই একসাথে ইয়েস বলে উঠছে, দুজনের চোখে বিশ্বজয়ের হাসি।






রাস্তার একপাশের বেঞ্চে বসে আছে রুশি, ঠেলে কান্না আসছে ওর কিন্তু ও জানে এই মুহুর্তে কান্না করে কোনকিছুর সমাধান পাওয়া যাবে না তারচেয়ে বরং উপায় খুঁজতে হবে। এতোটা হেল্পলেস কখনো ফিল হয়নি এর আগে, যখন ওই লোকটি ফেলে গিয়েছিলো তখন আর না যখন বাড়িছাড়া হয়ে এই অচেনা শহরে পা রেখেছিল তখন কিন্তু এখন তার কলিজার টুকরোকে হারিয়ে ফেলেছে, কোথায় খুঁজবে ও। কাউকেই ঠিকমতো চিনে না তারউপর পুলিশ ও হেল্প করতে না করে দিয়েছে, চব্বিশ ঘন্টার পুর্বে নাকি নিখোজের এফআইআর লিখা যায় না। ঘড়ির কাটা নয়টার কোটায় অলরেডি পৌছে গেছে, এখন মধ্যরাত্রি বলা চলে, রাস্তার পাশের সোডিয়াম লাইটটা ঠিক জলছে। তখনি ফোনটা আওয়াজ করে কেপে উঠলো যা ধরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা রুশির নেই। ধরবে না ধরবে করেও কি মনে করে ধরলো ফোনটা।অপরপাশ থেকে নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না, ফোনটা রাখতে গিয়েও আবার কানের সাথে লাগালো রুশি, অপরপাশ থেকে বাচ্চার হাসির শব্দ আসছে। রুশি থমকে গেলো, এটা রুহানের আওয়াজ যা খুব চিনা ওর। কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন বলে উঠলো

” একটু পর একটা গাড়ি এসে থামবে তার মধ্যে উঠে পড়বে, যদি ছেলেকে দেখতে চাও তাহলে চলে এসো তাড়াতাড়ি ”

“কে আপনি, আর আমার ছে..”বুঝতে পারলো অপরপাশ থেকে ফোনটা খট করে কেটে গিয়েছে,রুশি থম মেরে বসে রইলো, কে হতে পারে এই লোক?কিছুক্ষণ বাদে একটি বিশাল গাড়ি এসে ওর সামনে থামলো, শো শো করে কয়েকজন কালো পোশাক পরিহিত লোক বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। তার মাঝে একজন বলে উঠলো “মেম, দিস ওয়ে প্লিজ ”

ও আর দেরি না করে গাড়িতে উঠে বসলো, গাড়িটি একটি বিশাল হোটেলেরএর সামনে থামলো, গাড়ি থেকে নেমেই ও বডিগার্ডদের সাথে লিফটে ঢুকলো, বডিগার্ড সর্বোচ্চ নাম্বার ফ্লোরে যাওয়ার জন্য ক্লিক করলো, লিফট এসে থামলো সেই ফ্লোরে তারপর একটা রুমের দিকে নিয়ে গেল তাকে, বডিগার্ড দুজন বাইরে থেকেই ওকে ভেতরে যেতে বললো। ও ভিতরে ঢুকতেই ডাস্টবিনে কয়েকটি পিজার এর খালি পেকেট দেখলো, সামনে তাকিয়ে দেখে একটা লোকের কোলে রুহান বসে গেমস খেলছে আর দুজনের ঠোঁটেই সস লেগে আছে । এমনভাবে বসে আছে যে হঠাত এক দেখায় যে কেউ বাবা ছেলে বলবে এত মিল দুজনের মধ্যে আর সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দুজনের চোখই বাদামি রংয়ের। আর রুহানতো কারো সাথে সহজে মিশে না অথচ কি সুন্দর মিশে গেছে লোকটির সাথে। লোকটিকে খুব পরিচিত মনে হলো ওর, কোথায় যেন দেখেছে! হ্যা এটাতো কালকের পার্কের সেই লোকটি, এখানে কি করছে তাও রুহানের সাথে?

” মাম্মা, তুমি আসতে এতো লেট করলে কেন? জানো কখন থেকে ওয়েট করছি তোমার জন্য? ”

রুহানের কথায় দুজনেরি চোখাচোখি হলো, রুশি চোখ পড়তেই দৃষ্টি অবনত করে ফেললো, কিছুক্ষণ পর আবার তাকালো দেখে লোকটি এখনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। ওর দিকে তাকিয়েই হাতের ইশারা করলো কাউকে আর প্রায় সাথে সাথেই রুহানকে নিয়ে একজন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রুশি কিছু বলবে তার আগেই লোকটি উঠে দাঁড়াল, ওর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বললো

” রুশানি আনাম, দ্যা ফেমাস আরজে আনাম অফ কলকাতা”বলে কিছুটা ঝুকে গেলো ওর দিকে, ও পিছিয়ে যেতেই পারলো না তার আগেই খপ করে হাত ধরে ফেললো লোকটি “ছেলেকে কয়েক ঘন্টা খুজে না পেয়ে কেমন লাগালো তোমার ”

“মানে?” রুশি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো, কিন্তু ওইপক্ষ থেকে উত্তর না আসায় নিজেই বললো ” আপনি আমার ছেলেকে এখানে নিয়ে কেন এসেছেন? আমার যতটুকু মনে পড়ে আমি আপনাকে চিনিনা তাহলে আমাকে রাতবিরাতে এভাবে হেনস্থা করার মানে কি?”

” এই টুকু সময়েই এই অবস্থা? তাহলে চারটি বছর আমার কি অবস্থা হয়েছে সেটা ভেবেছ? তুমি তো তোমার সন্তান নিয়ে বেচে ছিলে আমি কি নিয়ে বেচে ছিলাম সেটা বলবে? আমিতো জানতামই না আমার একটা ছেলে আছে ”

রুশি দুইকদম পিছিয়ে গেলো,”মানে?”

পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো সায়ান, তারপর রুশির হাত টেনে সেটা ওর হাতে দিলো, রুশি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে এটা সেই চেইন আর আংটি যেটা ও বাংলাদেশে হারিয়ে ফেলেছিলো। ওতো ভাবতেই পারেনি এটা আবার ফিরে পাবে।

“এটা আমার মায়ের দেয়া আংটি, নেক্সট টাইম সাবধানে রাখবে যাতে হারিয়ে না যায় ”

রুশি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এটা কি করে হতে পারে, এই আংটিটি ওর স্বামীর দিয়ে যাওয়া স্মৃতি যেটা মনের অজান্তেই আগলে রেখেছিল আর হঠাত করে হারিয়ে যাওয়াতে দুঃখ ও পেয়েছিলো কিন্তু হঠাত একটা লোক সামনে এসে নিজেকে এই আংটির মালিক দাবি করবে ভাবতে পারেনি। এই সামনে থাকা লোকটি আসলেই ওর স্বামী মানে রুহানের বায়োলজিক্যাল ফাদার!! যাকে দেখার জন্য এতোগুলা বছর অপেক্ষায় ছিলো সে আজ ওর সামনে!!

১৩.

“সাইন দিস পেপারস ”
এতক্ষণের নিরবতা ভেংগে বলে উঠলো সায়ান, রুশির দিকে তিনচার পেজের একটি ফাইল এগিয়ে দিয়ে।

“কিসের পেপার এটা? ” ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বললো, এতদিন পর লোকটিকে দেখে প্রথম তরফায় তাকিয়ে থাকলেও এখন ঘোর কেটে গেছে, মনের গহিনে ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছুই আসছেনা।

“এটা একটা চুক্তিনামা যেখানে লিখা আছে রুহানের এটলিস্ট আঠারো বছর হওয়া পর্যন্ত তুমি আমার স্ত্রীর মর্যাদায় আমার পাশে থাকবে, মানে এককথায় এটি একটি #বৈবাহিক_চুক্তি। ”

সায়ানের এহেন কথায় রুশি বেশ চেতে গেলো, এতক্ষণ যথেষ্ট ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি হেন্ডেল করতে চাইলেও এখন ধৈর্যের বাধের সমাপ্তি ঘটেছে, তাই চেঁচিয়ে বলে উঠলো
” আমাকে কি আপনার বোকা মনে হয় না অবলা নারী? আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই শুনতে পাচ্ছেন আপনি?”

” আস্তে কথা বলো বউসোনা, এত চিল্লিয়ে কথা বলে কি লাভ হবে বলো ”

” ডোন্ট ডেয়ার টু কল মি দ্যাট, আপনাকে আমি চিনিনা আর চিনতেও চাইনা, আমাকে আমার মত থাকতে দিন, ভালোয় ভালোয় বলছি আমার ছেলেকে দিয়ে দিন ”

“তুমি আমাকে চিনো না! এত তাড়াতাড়ি আমার ছোঁয়া ভুলে গেলে নাকি ভুলে যাওয়ার ভান করছো? আমি মনে করিয়ে দিবো বউসোনা? ”

সায়ানকে নিজের দিকে ঝুঁকতে দেখে রুশি নিজের রাগ আর কন্ট্রোল করতে না পেরে থাপ্পড় মারতে ধরলেই সায়ান হাত চেপে ধরে যেন এমন পরস্থিতি হবে আগে থেকেই অবগত ছিলো,হাত ধরে পেছন দিকে নিয়ে একহাতে চেপে ধরে আর আরেকহাতে সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজতে গুঁজতে বলে

” গতবারের থাপ্পড় মারার পরিণামের কথা ভুলে গেলে? তুমি যদি সেটাই চাও তাহলে আমার কিন্তু কোন সমস্যা নেই, এতদিন পর বউকে কাছে পেলাম। একটু আদর যত্ন তো করতেই পারি ”

রুশির খুব করে বলতে ইচ্ছা করলো “তোর বউয়ের মায়রে বাপ ” সাথে এমন কিছু গালি দিতে ইচ্ছে করলো যা শুনে বলবে ” ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি “কিন্তু নিজের এই ইচ্ছাকে কোন মতে সংযত করলো। এই মুহুর্তে রাগের মাথায় কিছু বললে হিতে বিপরীত হবে, তার থেকে ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে যাতে নিজে থেকে পিচু হটে যায়

” আপনি এতটা শিওর কি করে হচ্ছেন রুহান আপনার ছেলে, আমি কলকাতা শহরে থাকছি এখানে ওইধরনের সম্পর্ক খুব একটা কঠিন কিছুনা তার উপর একা থাকি আমি ”

রুশিকে ছেড়ে দিয়ে ও বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, রুশি এই দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারলো সে অনেকটা কনভিন্স করে ফেলেছে তাই আবার বললো

” এবার বুঝতে পারছেন তো রুহান আপনার ছেলে নয়, ওকে আমার সাথে যেতে দিন ”

“আমার নাম কি জানো? সায়ান জামিল খান, আমাকে এত বোকা ভাবো তুমি?”

সায়ান জামিল খান, অন্যসব কিছু ভুলে গেলেও এই নামটা এই কয়বছরে স্পষ্ট মনে ছিলো তাইতো রুহানের বার্থডে সার্টিফিকেটেও ওর বাবার এটাই লিখা সাথে ওর নাম রুহান জামিল খান লিখা কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই নামটি লিখিয়ে বড় ভুল করেছে ও।

” আপনি যেই হোন না কেন তাতে আমার কিছু যায় আসেনা, আমার ছেলের বাবা নেই আর না হবে কখনো। ওর মাই ওর জন্য যথেষ্ট, আপনি আমার ছেলেকে দিয়ে দিন আমাকে ”

” জানো রুশি, রুহান যদি আমার ছেলে না হতো তাহলেও আমি তোমাকে ছাড়তাম না সেখানে রুহানতো আমার সন্তান। তুমি কি ভাবছো অন্য হাজবেন্ডদের মতো বলবো ” এই সন্তান কার? ” আমি পাশে ছিলাম না বলে আমার বিশ্বাস এত ঠুনকো নয়, আমি জানি তুমি না বললেও এটা আমার সন্তান আর না হলেও আমার সন্তান হিসেবে রাখতাম ওকে কারণ ও তোমার সন্তান। আমি তো ভেবে অবাক হচ্ছি তুমি আমার থেকে বাচার জন্য নিজের চরিত্র নিয়ে এত জঘন্য কথা বললে? কি করে পারলে এটা। আমি তোমাকে কখনোই আমার থেকে আলাদা হতে দিবো না কখনো না ”

” কেন ভালোবাসেন আমাকে? “তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে

” কি মনে হয় তোমার?

” হাহাহা, আপনি আমাকে ভালোবাসেন!! আর এটা আমাকে বিলিভ করতে বলছেন? তাহলে ওইদিন ওভাবে ছুড়ে ফেলে যেতেন না, হাজবেন্ড হিসেবে না হোক একজন মানুষ হিসেবে হলেও রেস্পন্সিবিলিটি নিতেন”

” আমি তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছি না তুমি গিয়েছো?”

” আমি ছেড়ে গিয়েছি আপনাকে? আপনার মাথা ঠিক আছেতো নাকি?ঘুম থেকে উঠে ওই বিছানায় আমি একা ছিলাম আপনি ছিলেন না, আর দয়া দেখিয়ে খাবার রেখে গেছেন ”

” সাথে একটা চিরকুট ছিলো সেটা চোখে পড়েনি? ”

” পড়েছে তো যেখানে লিখা ছিলো ” খাবারটা খেয়ে নিয়ো এবং নিজের খেয়াল রেখো আর এদিকটা সামলে নিও”

“তাহলে ওইখানে লিখা ছিলো তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছি আমি? ”

” লিখা ছিলো না কিন্তু বুঝতে পারা যায় নাকি যে আপনি সুন্দরমতে কেটে পড়েছেন ”

” তোমাকে এত বুঝতে বলেছে কে? কেউ ঠিকি বলে মেয়েমানুষকে একলাইন বললে তারা তিনলাইন আগবাড়িয়ে বুঝে , আমি ওইটা দ্বারা তোমাকে খাবারটা খেয়ে নিজের খেয়াল রাখতে বলেছি, চলে যেতে বলিনি। যদি চলে যাওয়ার থাকতো তাহলে কিছু না বলেই চলে যেতাম, ওইসব লিখতাম না। তুমি জানো ওইদিন কি হয়েছিলো? ওইদিন তুমি যাদের মারতে দেখেছো না তারা আমাকে মারতে এসেছিলো কিন্তু আমাকে যখন পায়নি তখন নিজের লোককেই মেরে ফেলেছে যা তুমি দেখেছো। ”

” মানুষের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই না আপনাকে সবাই মারতে যাবে?”

” আসলেই তাই কাজ নেই তাদের। ওইখানে একটা কলেজে ফাংশন ছিলো যেখানে আমি এটেন্ড করেছিলাম। আমার বডিগার্ডরা খোজ পায় যে আমার উপর হামলা হতে পারে তাই আমি কালো হুডি আর মাস্ক পড়ে বেরিয়ে ছিলাম কিন্তু তারপরো ওরা টের পেয়ে যায় তাই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম আর তখন দেখি একটা ডাম্বো গান পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নিজে মরার জন্য ওয়েট করছে,তাই তাকে বাচাতে গিয়ে আমার হাত পর্যন্ত কেটে ফেলেছি। কিন্তু উনিতো অজ্ঞান হয়ে আমাকে উদ্ধার করে দিয়েছেন যে তাকে কেরি করতে হয়েছে। আর পারছিলাম না বলে আশেপাশের মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছি কিন্তু তারা হুট করে প্রশ্ন করে বসলো মেয়েটি সম্পর্কে আমার কি হয়, বোন বললে তো আর বিলিভ করবে না তাই বলেছি বউ। কিন্তু ওইলোকগুলো আমাকে বিশ্বাস করলো না আবার কিডন্যাপার বলা শুরু করে দিলো, এখন এমনিতেই পালাতে পালাতে হয়রান তারউপর গণপিটুনি খাওয়ার শখ হয়নি তাই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি ”

” বাই এনি চান্স আপনি কি কথাগুলো আমাকে মিন করে বলছেন? ”

” ওহ খোদা কাকে কি বললাম? সারারাত পড়ালাম রামায়ণ সকালে বলে সীতা কার বাপ।ভাগ্য ভালো আমার ছেলে আমার মতো হয়েছে ”

“তারমানে আমি ডাম্বো? আপনি আমাকে ডাম্বো বলেছেন? ”

” না আমাকে বলেছি, আসলেই আমি একটা ডাম্বো নাহয় ওইদিন লম্বা চৌড়া একটা অনুচ্ছেদ লিখে যেতাম যে দয়া করিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিবেন জনাবা, তুমি জানো সকালবেলা তোমাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য সকাল সাতটায় আমি কত পথ হেটে বিরিয়ানির পেকেট জোগাড় করেছি? রাতের বেলা কান্না করে তুমি ক্লান্ত ছিলে তাই নিজের খেয়াল রাখতে বলেছি আর তোমার যাতে হাটতে না হয় তাই নিজের ফেলেরাখা গাড়ি খুঁজতে বেরিয়েছি সাথে ফোন করার জন্য যাতে বডিগার্ড আসে আর তোমাকে সেফলি ওইখান থেকে নিয়ে যেতে পারি কারণ যেকোন সময় আক্রমণ হতে পারে আমার উপর আর আমি তোমাকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলাম না। তুমি ওই জায়াগায় সেফ ছিলে আর যাইহোক ওই জায়গার খোজ কেউ পেতো না। কিন্তু আমার সব মেনেজ করে আসতে প্রায় নয়টা দশটা বেজে যেতে পারে তাই তোমাকে বলেছি এদিকটা সামলে নিতে। কিন্তু সাড়ে নয়টায় ফিরে এসে তোমাকে আর পায়নি, ওইখানের মানুষকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি, কেউ কিছুই বলতে পারেনি। জানো কত অসহায় মনে হচ্ছিলো নিজেকে?
একবার মনে হচ্ছিলো তোমাকে ওরা ধরে ফেলেছে আরেকবার মনে হচ্ছিলো নাহ তুমি ঠিক আছো। চারটি বছর ঠিক এই ধারণা নিয়ে বেচে আছি আর তোমাকে পাগলের মত খুঁজেছি কিন্তু পায়নি। কারণ যে নিখোঁজ হয় তাকে খুঁজা যায় কিন্তু যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় তাকে খুজা যায়না।”

সায়ান কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার বললো “যাইহোক একবার পালিয়েছ আমার থেকে কিন্তু দ্বিতীয় বার সেই চান্স পাবে না,আর এখনতো আমার কাছে ট্রাম্পকার্ড আছে, তাই দেরি না করে পেপারস সাইন করো কারণ তুমি আবার পালিয়ে যেতে পারো তোমার বিশ্বাস নেই এন্ড আই ওয়ান্ট শিউরিটি যে তুমি আর পালাবে না ”

ফাইল আর পেন এগিয়ে দিলো রুশির দিলো সায়ান আর রুশি শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে আছে, হয়তো কোন বড়সড় ঝড়ের পুর্বলক্ষন এইটা

১৪.

“আপনার কি মনে হয়?এইসব গুছানো মিথ্যে কাহিনী আমাকে শুনাবেন আর আমি বিশ্বাস করে ফেলবো, এটা যদি আরো চারবছর আগে বলতেন হয়তো তখনকার ইমোশনাল রুশি আপনার কথা মেনে নিতো কিন্তু এই বাস্তবতা চিনে সাথে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষের আসল সত্য। আপনি কি বাংলা সিনেমা পেয়েছেন যে হিরোর পেছনে পুরো দুনিয়া পড়ে আছে।বোকা পেয়েছেন আমাকে যে আপনি বলবেন চার বছর ধরে খুঁজছেন আমাকে আর আমি মেনে নিবো!! আপনার সস্তা ভালোবাসা অন্যকারো সামনে দেখাবেন”
তাচ্ছিল্যের সাথে রুশি বললো কথাগুলো,সায়ান হাত মুঠো করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করছে, এইমুহুর্তে রাগের বশে কিছু করা যাবে না বরং ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে।

” আমার ফিলিংসকে তোমার যাই মনে হোক না কেন তা দিয়ে তুমি সত্যিটা ঢেকে ফেলতে পারবে না, আমি তোমাকে কতটা চাই তা শুধু আমি জানি ”

“হুহ, আসলে আপনি এই ভালোবাসার মিথ্যে নাটক কেন করছেন জানেন? কারণ আপনি জানতে পেরেছেন আপনার একটা ছেলে আছে। ছেলেরা যতই খারাপ আর মেয়েবাজ হোকনা কেন নিজের বংশধরকে নিজের কাছে নেয়ার জন্য তারা সবকিছু করতে পারে যা আপনি করছেন। অনেক দেখেছি আপনার মতো বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া সন্তানকে, আসলে আপনাদের মা বাবা টাকাতো ধরিয়ে দিয়েছে আপনাদের হাতে কিন্তু ভদ্রতা শিখায় নি। আর আপনি কতোটা অসভ্য তাতো আমি ওইদিনই বুঝে গিয়েছিলাম আপনার মা কি করে বাসায়? ”

কোন সান্তানই নিজের বাবা মা নিয়ে কথা শুনতে পারেনা সে যত ঠান্ডা মেজাজেরি হোকনা কেন আর সেখানে সায়ানের বাবা মা তো বেচেই নেই। ও কখনওই এতটা এগ্রেসিভ হতো না যদি ওর মা বাবা বেচে থাকতো। তাই ও এই কথাটা সহ্য করতে না পেরে এগ্রেসিভ হয়ে হাত দিয়ে রুশির চুল মুঠো করে ধরে কাছে এনে বললো

” আমার বাবা মাকে নিয়ে আর একটা কথা বললে আমি কি করবো আমি নিজেও জানিনা ”

রুশি মাথায় খুব ব্যথা পাচ্ছে তবুও রাগ দেখিয়ে বললো ” দেখিয়ে দিলেন তো আপনার ঠুনকো ভালোবাসার নমুনা! আপনাকে আমার থেকে ভালো কে চিনবে বলেন?যে নিজের রাগ মিটাতে মেয়েদের আঘাত করতে পারে সে একটা কাপুরুষ ছাড়া আর কিছুই না। আপনারা কোন দায়িত্বই পালন করতে পারেন না শুধু জানেন পালাতে। আমি আমার ছেলেকে আপনার ছায়াতলে কোনদিন বড় হতে দিবো না ”

” চুপ, একদম চুপ তখন থেকে বলে যাচ্ছ আর আমি শুনে যাচ্ছি আর একটা কথা বললে খবর আছে তোমার ”

” কি করবেন আপনি আমাকে? মারবেন!ওইটাই তো বাকি রেখেছেন। মারুন না মারুন এই শখও পুরণ করুন ”

” ছিহ! এসব কি বলছো মারতে যাবো কেন আমি তো আদর করবো আদর ( বাকা হেসে) ট্রাই করে দেখো আর একটা কথা বলে ”

” আপনি ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে?মনে করেন আপনি বলবেন আর আমি ভয়ে চুপ করে আপনার অত্যাচার সহ্য করবো?চে…”

রুশি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, ও ভাবতেই পারেনি এই লোক যা বলেছে তাই করে দেখাবে। কি সাংঘাতিক ঘটনা। কিন্তু এই ছোঁয়া খুব পরিচিত মনে হলো

“ইউউউউউ, তারমানে ওইদিন গলিতে আপনি ছিলেন?”

“হাহাহা এতদিন পরে বুঝতে পারলে, তোমার কি মনে আমার সম্পদে আমি ছাড়া অন্য কারো হাত দেয়ার সাহস আছে? ”

” সেই আমি কি করে ভুলে গেলাম যে আপনার মতো অসভ্য অন্য কেউ কি করে হতে পারে?আমি কারো প্রোপার্টি নই যে আপনি নিজের বলে দাবি করবেন
ছাড়ুন বলছি আমাকে ছাড়ুন ”

” আমি প্রোপার্টি বলিনি ট্রেজার বলেছি মানে সম্পদ যেটা শুধু আমার আর কারো না, আর নিজের বউয়ের কাছে অসভ্য হবো না তো কার কাছে হবো হুম ” আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, এই লোকের থেকে যত ছুটতে চাচ্ছে তত আরো জড়িয়ে ধরছে।

” শুনো এতো কথা বলে লাভ নেই তাড়াতাড়ি এই পেপার সাইন করে দাও, আম ওয়েটিং ”

” আমি মরে গেলেও এই পেপার সাইন করবো না, আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন না কেন ”

” কেউ আসলে ঠিকি বলেছে তুমি প্রচণ্ড জেদি মেয়ে, সোজা কথা শুনবে না।কিন্তু সোজা কথায় ঘি না উঠলে আংগুল কি করে বাকাতে হয় তা আমার জানা আছে। তুমি যদি এই পেপারে সাইন না করো তাহলে ছেলেকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দাও”

” এই কথার মানে কি?”চোয়াল শক্ত করে বললো

“বাংলায় বলেছি আমি চাইনিজে বলিনি যে বুঝবে না ”

এবার অনেকটা রেগে গেছে রুশি, মন চাচ্ছে ধরে কতক্ষণ পিটাতে

“আমার ছেলেকে আপনি নিজের কাছে রাখার কে?”

” কখন থেকে নিজের ছেলে নিজের ছেলে বলে যাচ্ছো ভুলে যেওনা আমি ওর বাবা ”

” বাবা! বাবা হওয়ার একটা দায়িত্ব আজ পর্যন্ত পালন করেছেন?আমার সন্তানকে আমি একা জন্ম দিয়ে আর একাই মানুষ করতে পারবো। ওর জন্য নিজের দেশ পর্যন্ত ছেড়েছি আমি আর এতটাদিন একা মেয়ে হয়ে লড়াই করে গেছি। এই কলকাতা শহরে একা মেয়ে হয়ে বেচে থাকাটা কত টাফ সেটা আপনি কি জানবেন। কাউকে চিনতাম না আমি তবুও নিজের সন্তানের জন্য এতটুকু এসেছি আর আপনি হুট করে এসে বলছেন আপনি ওর বাবা আর অধিকার জামচ্ছেন?কান খুলে শুনে রাখুন আপনি আমার সন্তানের জন্মদাতা কিন্তু বাবা নন”

সায়ান কিছু বলতে চেয়েও পারলো না, রুশির রাগটা সম্পুর্ণ জায়েজ, একা একা কত ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়েছে তবেঁ ওরও কোন দোষ ছিলো না। ও তো কিছুই জানতো না বরং ও খুজে বেড়িয়েছে ওকে। কিন্তু যাকে এত কষ্টে খুজে পেয়েছে তাকে আর কখনো হারাতে দিবে না। ওর রাগ -অভিমানগুলো ও ভাংগাবে কিন্তু তারজন্য পাশে থাকতে হবে ওকে

“তুমি বললেই সত্য, মিথ্যে হয়ে যাবে না।হয়তো কাছে জন্মদাতা ছিলাম কিন্তু এখন বাবা হয়ে দেখাবো। আমার পাওয়ার সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই। তুমি যদি এই পেপার সাইন না করো তাহলে কালকের মধ্যে আমার ছেলেকে নিয়ে আমি দেশে ফিরে যাবো আর তুমি কিছুই করতে পারবে না। তাই ভেবে নাও কোনটা বেছে নিবে নিজের জেদ নাকি ছেলে। চয়েজ ইজ ইউরস এন্ড আই মিন ইট। ইউ হ্যাভ অনলি টু মিনিটস ”

“আপনার মতো জঘন্য মানুষ আমি দেখিনি, নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য কি না করতে পারেন ”

” ইউ হ্যাভ অনলি ফাইভ মিনিটস, তাড়াতাড়ি ডিসিশন নাও নাহয় কাল থেকে ছেলেকে দেখার কথা ভুলে যাও”

রুশি বুঝতে পারলো এর সাথে লড়াই করে লাভ নেই কারণ এ হচ্ছে নাছোড় বান্দা। তারউপর বডিগার্ড অনেক আছে তারমানে রুহানকে নিয়ে যেতে পারে। অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে সাইন করে দিলো। রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে।

” এইতো ভালো মায়ের মত সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমি এটাই আশা করছিলাম। যাইহোক আজ রাত এখানে থাকো রুহানকে নিয়ে। অনেকরাত হয়ে গেছে অলরেডি ”

” জোর করে সবকিছু হাসিল করা গেলেও মন হাসিল করা যায়না, আপনি আমার নজরে আরো নিচে নেমে গেলেন ”

সায়ান কিছু বললো না শুধু তাকিয়ে রইলো, একজন বডিগার্ড রুহানকে এসে শুইয়ে দিয়ে গেলো কারণ ও অনেকক্ষন আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। গার্ডরা চলে গেলে রুশিও পাশে শুয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ চিল্লাচিল্লিতে মাথা ব্যাথা করছে।সায়ান সেটা দেখে বারান্দায় গেলো

জানে আজকের কাজটি ঠিক হয়নি, এতে রুশির রাগ আরো বেড়ে গিয়েছে কিন্তু কিছু করার নেই ওকে কাছে রাখার এইটাই একটা উপায় ছিলো। সিগারেট টানতে টানতে ভাবছে ” ওর বউটাকি জানে তার বিহনে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে ও, শুধু ভেবেছে এখন কেমন দেখতে লাগছে তাকে?সেকি আমার কথা ভাবছে এখন?”
মেসেজের আওয়াজে ফোনের দিকে তাকালো, সুজি মেসেজ দিয়েছে যে রুশির ফ্রেন্ড।

” জিজ ওইদিকে সব ঠিকঠাক? মানাতে পেরেছেন ওকে?”

” না বরং আরো রেগে বম্ব হয়ে গেছে তোমার ফ্রেন্ড। যতটা বলেছো তার থেকে বেশি ঘৃণা করে তোমার ফ্রেন্ড ”
” এতদিনের অভিমান এত সহজে গলবে না জিজু, অনেক এফোর্ট দিতে হবে। শি ইজ আ টাফ গার্ল ”

“তাতো বটেই যাইহোক সাবধানে থেক তুমি”

” ওকে বায় জিজ”

সুজিই সেদিন রুহানকে কিডন্যাপ করার আইডিয়া দিয়েছিলো। ও ওইদিন রুশিদের ফ্লাটে গিয়েছিলো রুশির সাথে দেখা করতে কিন্তু ওকে পায়নি, পেয়েছে সুজাতা আর রুহানকে। ও সুজাতাকে সব খুলে বলে সব শুনে প্রথমে কতক্ষণ বকলেও পরে হেল্প করতে রাজি হয় ও বলে রুশি কখনওই রুহানের বাবার নাম মেনশন করে না আর রুহান বললেও চুপ থাকে। কিন্তু চোখমুখ দেখলে বুঝা যায় অনেক ঘৃণা করে তাকে। তাই ওকে সরাসরি স্যরি বললে কিংবা অনুনয় করলেও ও মানবে না। তাই অন্যভাবে ট্রাই করতে হবে। রুশির উইক পয়েন্ট রুহান তাই রুহানের জন্য রুশি তার সাথে থাকতে বাধ্য হবে। আর তারপর ধীরি ধীরে রাগ ভাংগাতে হবে। তাই প্ল্যান অনুযায়ী এসব করা।

সিগারেট ফেলে ঘরে প্রবেশ করলো সায়ান, রুশি আর রুহান একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। কি মায়াবী চেহারা তার শ্রেয়সীর, রাজ্যের সব মায়া যেন তার মুখে ছেয়ে আছে। আস্তে করে রুহানের পাশে সুয়ে পড়লো সায়ান। চুক্তি হোক আর যেভাবেই হোক ওর বউ আজ ওর পাশে। আর আজীবন পাশে রাখার জন্য যেকোন কিছু করতে প্রস্তুত সায়ান।

১৫.

“এসকে এই ব্যাগগুলোতে কি আছে?” ব্রেকফাস্ট করতে করতে জিজ্ঞেস করলো রুহান,

“রুহান, হোয়াট এসকে?এন্ড খাবার খাওয়ার সময় কথা বলা ব্যাড মেনার্স, বলেছিলাম না তোমাকে?”

” মাম্মা এসকে কে আংকেল বললে তার প্রেস্টিজে লাগে তাইতো এসকে বলেছি ”

” রুহান নো মোর ওয়ার্ডস ”

“ইটস ওকে! একটু কথাই তো বলেছে”

” আমার ছেলেকে আমি কি শিক্ষা দিবো তা আপনাকে বলবো না, আপনি কি না বললেই খুশি হবো ” রাগি চোখে তাকিয়ে বললো রুশি।

“দেখো ও আমারও… ” রুহানের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাটা হজম করে নিলো, রুহানকে যতক্ষণ না ওর মাম্মা বুঝিয়ে বলবে ততক্ষণ ও বুঝবে না তাই রুশির বলাটাই বেটার যে রুহানের বাবা ও।

রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে মিস্টি একটা স্মাইল দিলো “আগে নিজের ছেলেকেতো বলো তুমি ওর বাবা তারপর ভালো বাবা হয়ে দেখিও চান্দু, খুব শখ না জোর করে বাবা হওয়ার ” কথাটা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতেই কাটা চামচ দিয়ে জোরে পাস্তায় আঘাত করলো, সায়ান নিজেকে ওই পাস্তার সাথে কল্পনা করতে করতে একবার রুশির দিকে তাকাচ্ছে তো একবার পাস্তার দিকে।
বেচারার গলা শুকিয়ে গেছে তাই গ্লাসের পানি একনিমিষে শেষ করে ফেললো।

সায়ান গলা ঝেড়ে বলে উঠলো ” আমি তোমাদের সাথে তোমাদের ফ্লাটে থাকতে যাচ্ছি ”
কথাটা শুনতেই রুশির খাবার গলায় আটকে গেলো, কাশতে কাশতে সায়ানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো, ও ভেবেছিল এখান থেকে বেরুতে পারলেই এই লোকের থেকে ছুটকারা পেয়ে যাবে কিন্তু এই গলায় আটকে যাওয়া খাবারের মতো হয়ে গেছে, যা গিলতে পারছে না ফেলতে পারছে।

“ইয়েয়য়য়, এসকে আমাদের সাথে যাচ্ছে,রুহান ইজ সো হ্যাপি ”
রুশি রুহানের সামনে না করতে গিয়েও করলো না, এই প্রথম কাউকে নিয়ে রুহান এত এক্সাইটেড আর এতটা মিশতে দেখলো কারো সাথে।কিন্তু তাই বলে এভাবে নিজেদের ফ্লাটে ছেলেমানুষ নিয়ে যাওয়া যাবে না, আশেপাশের মানুষ কি বলবে!

রুহান আগেই একজন বডিগার্ড এর সাথে বেরিয়ে গেছে, রুশি বেরুতে নিয়েই ওর হাত চেপে ধরলো সায়ান।

“আমি চাই তুমি রুহানকে বলো আমি ওর বাবা, তুমি বললে ও যতোটা ভালো ভাবে বুঝবে অন্যকেউ বললে ওতোটা বুঝবে না ”

“তো এতে আমি কি করতে পারি? আমিতো এমনি চাইনা আমার ছেলে জানুক ওর বাবা আছে। আপনার ইচ্ছা হলে আপনি বলতে পারেন, গো এন্ড টেল হিম ইউ আর হিজ কাওয়ার্ড ফাদার হু লেফট হিজ মম ”

“রুশি ইটস নট আ জোক ওকে??”

“ইটস মিস- আনাম ফর ইউ, আপনি আমার এতোটাও ক্লোজ না যে আমার নিকনেম বলবেন ”

“একটা মেয়ের জন্য তার হাজবেন্ড থেকে ক্লোজ কেউ হয়না ”

” আই ডোন্ট ইভেন রিকোগনাইজ ইউ এজ ফাদার অফ মাই সান লেট এলোন হাজবেন্ড ”

“মানবে মানবে একদিন নিজের ছেলের বাবাতো মানবেই সাথে হাজবেন্ড ও মানবে ”

” ইন ইউর ড্রিমস ”

” আমি ওই সপ্নই দেখি যা পূরণ করার ক্ষমতা আমার আছে ”

“চেলেঞ্জ করেছেন? ”

” নাহ শুধু জানিয়ে দিচ্ছি, নিজের মনকে সামলে রেখো নাহয় কখন আমার প্রেমে পড়ে যাবে বুঝতে পারবে না ”

“হাহ, আমার মন আমার অনুমতি ছাড়া তার দরজা খুলবে না কখনোই ”

“দেখা যাবে ”

সায়ান লাগেজ বের গাড়ির দিকে এগোচ্ছে, রুশি হঠাত সামনে দাঁড়িয়ে বললো

” আপনি সত্যি সত্যি আমাদের সাথে থাকতে যাচ্ছেন? ”

” তো কি মিথ্যে মিথ্যে যাবো? “ভ্রু কুচকে বললো।

“আমাদের ফ্লাটে মাত্র দুটো রুম, আপনার থাকার জায়গা নেই,একটাতে আমি রুহান থাকি, আরেকটাতে সুজি ”

” তো তুমি আর সুজি একটাতে থেক আর আমি আর রুহান একটাতে থাকবো ”

” আমি রুহানকে ছাড়া ঘুমাতে পারিনা ”

” তাহলে ইউ আর অলসো ওয়েলকাম ইন দ্যাট রুম ”
বলেই রুশিকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে গাড়ির দিকে চলে গেলো

” মানে কি আমি এই লোকের সাথে ঘুমাবো! ইম্পসিবল”

গাড়িতে রুহান জেদ ধরে সামনের সিটে বসেছে তাই অগত্যা সায়ান রুশি একসাথে বসেছে। রুশি চুপচাপ বসে ছিলো তখন গানের গুনগুন আওয়াজ শুনলো,
কানখাড়া করে শুনার চেষ্টা করলো

“মনের দরজা খুলোনা ~~
ভালোবাসি বলোনা
তুমি দূরে দূরে আর থেকোনা ~~

রুশি রাগি চোখে সায়ানের দিকে তাকিয়ে কানে হেডফোন গুজে দিলো। সায়ান মুচকি হাসছে ওর কান্ড দেখে

🌸🌸🌸

“বস সায়ান জামিল খান এখন কলকাতায়, দুই সপ্তাহ ধরে সেখানেই আছে কিন্তু ঠিক কি করছে সে এখনো বুঝতে পারছিনা ”

“আচ্ছা ভালোভাবে খোজ লাগাও, আর ওই মেয়েটির খোজ পেয়েছো? ”

” না বস এখনো পায়নি তবে পেয়ে যাবো মনে হচ্ছে আর সায়ান জামিল খানও এখনো পায়নি মনে হচ্ছে ”

” তাড়াতাড়ি খোজ লাগাও ওর আগে আমার জানতে হবে ওই মেয়ে কোথায় আছে ”

তখনি ফোন বেজে উঠে লোকটির, ওইপাশ থেকে একটি তিক্ষ্ম মেয়েলি আওয়াজ ভেসে উঠলো

” হাউ আর ইউ জান? ”

” আম ফাইন, মিসিং ইউ অলরেডি ”

” অহহ আই মিসড ইউ ঠু, তোমার কি অবস্থা এখন? ”

” আগের থেকে বেটার বেবি, কবে আসছো তুমি?”

” মেইবি নেক্সট মান্থ ”

” অকেহ, কাম সুন বাই”

ফোনটা রেখে মুচকি হাসি দিলো লোকটি, এই মেয়ের মধ্যে কিছু একটা আছে যা বাকি মেয়েদের মধ্যে খুজে পায়নি। নাহয় এত মেয়ের সাথে মিলামেশা তার তবে কাউকে নিজের স্ত্রী বানানোর ইচ্ছে জাগে নি তার। বেড পার্টনার অনেকেই হয়েছে তবে এই মেয়েই প্রথম যাকে দেখে মনে হলো এই পবিত্র চেহারার হাসিই দেখাই তার জন্য অনেক তাইতো আজ পর্যন্ত হাত পর্যন্ত ছুয়ে দেখেনি তার। পৃথিবীতে এমন কিছু মেয়ে আছে যারা শুধু ওয়াইফ মেটারিয়াল হয় আর তার মধ্যে ও একজন।

সায়ান নিজের জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছিলো তখনি রুহান এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে আর বললো
“বাবাই ”
এই ছোট্ট শব্দটি যেন ওর ছুঁয়ে গিয়েছে, রুহানকে কোলে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ও। বাবা হওয়ার সুখ ঠিক কতটুকু তা একজন বাবার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।

to be continued…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here