বৈবাহিক চুক্তি পর্ব -০৬-১০

#বৈবাহিক_চুক্তি
#লিখাঃ
#পর্বঃ (৬-১০)

৬.

কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে একজন খুব কষ্টে নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে, এতক্ষণ আটকাতে পারলেও এবার শব্দ করে হেসে ফেললো, তখনি ভেতর থেকে কম্পিত কন্ঠে আওয়াজ এলো “কে? বাইরে কি কেউ আছেন?”
উচ্চস্বরে হাহা করে হাসতে যাবে তখনি কেউ একজন টেনে নিয়ে গেলো ব্যাক্তিটিকে

“হা হা হা, এত ভিতু যে বুঝতে পারছে কেবিনে কেউ ছিলো তবুও উঠে চেক না করে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করছে, আবার এখন হাসির আওয়াজ শুনেছে তবুও ভয়ে বেরিয়ে আসছে না। ভিতুর ডিম কোথাকার! এই মেয়ে নাকি আবার ছেলেটিকে বাচানোর জন্য গান পয়েন্টে উল্টো দিকে দাঁড়িয়েছে!”

“বস আপনি ঠিক আছেন? না মানে আপনি কি ড্রিংক বেশি করে ফেলেছেন? আর ইউ ড্রাংক? ”

” শাট আপ সাহিল, আমি ড্রিংক করলেও আমার নেশা হয়না আর আজতো টাচ পর্যন্ত করিনি ”

” না মানে আপনাকে এই প্রথম হাসতে দেখলাম, আপনি এত সুন্দর করে হাসতেও পারেন জানা ছিলো না, ছেলে হওয়েই ক্রাশ খেয়েছি, মেয়ে হলেতো ডিরেক্ট প্রেমে পরতাম ”

সাহিলের কথা শুনে সায়ান ভ্রু কুচকে তাকালো ” বাই এনি চান্স তোমার কোন সমস্যা নেই তো? দেখ তাহলে কিন্তু সাবধান, আমি কিন্তু মোটেও ওই টাইপ নই ”

” ছি ছি তওবা তওবা এসব কি বলেন, আমার গার্লফ্রেন্ড আছে ”

” থাকলেই ভালো ” বলে ভ্রু কুচকে গাড়ির দিকে হাটা শুরু করলো।

“আচ্ছা শুনো এই যে এই মেয়েটির সব ইনফরমেশন চাই আমার, আগে কোথায় ছিলো, কোন দেশ থেকে এসেছে যাবতীয় সব ডিটেইলস ”

” ইয়েস বস, কিন্তু বস আপনি এই মেয়েটাকে নিয়ে এত ইন্টারেস্টেড কেন? আই মিন মেয়েটার অলরেডি একটা ছেলে আছে দেখে মনে হচ্ছে বিবাহিত তাহলে… না মানে দাদাজি এত বছর আপনাকে বিয়ে করানোর জন্য এত সুন্দরি মেয়ে দেখালো আর আপনি কিনা এই বিবাহিত মেয়ের দিকে… ”

পরের অংশ মিনমিনে কন্ঠে বললেও সায়ান স্পষ্ট শুনতে পেলো
” তোমাকে যতটুকু বলা হয়েছে ততটুকু করো আর ওদের দিকে খেয়াল রেখো এক মিনিটের জন্যও যেন এদিক সেদিক না হয়”

” জি বস” সাহিল এই প্রথম নিজের বসকে কোন মেয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে দেখে সত্যিই অবাক হলো।

সায়ান ড্রাইভ করছে আর ভাবছে যে ওর যতটুকু খেয়াল রাখা দরকার তার থেকে বেশিই কি রাখছে। ও ক্যালিফোর্নিয়া থেকে যে ফ্লাইটে ল্যান্ড করেছে সেটা একটু ডিলে হওয়ার কারনে কলকাতা থেকে আগত ফ্লাইটের দশমিনিট আগে ল্যান্ড করেছে সেটি। প্লেন থেকে নেমে ফোন অন করতেই ওর ফোনে সাহিলের ফোন আসে যে ও খবর পেয়েছে সায়ান কে মারার জন্য কয়েকজন ওত পেতে আছে। ও অলরেডি সকল বডি গার্ডদের খবর দিয়েছে কিন্তু তাদের আসতে আধঘণ্টা সময় লাগবে তাই ও যেন ওর কাপড় চেঞ্জ করে নেই। এমন ঘটনার সাথে সায়ান পরিচিত, বিজনেসের যত ব্রাঞ্চ বেড়েছে শত্রু সংখ্যা যেন দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। ওকে হারিয়ে টপে যাওয়ার জন্য অনেকেই এমন প্ল্যানিং করছে। তাই কালো হুডি পরে নিলো সাথে মাস্ক, কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে ডান দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো একটা লোক গান পয়েন্ট করে আছে, লোকটির দৃষ্টি লক্ষ করে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল একটা মেয়ে বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটা কি পাগল নাকি! তখনি ওর নিজের প্রিয়তমার কথা মনে পড়লো, ওতো এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো, আচ্ছা পৃথিবীর সব মেয়েগুলো বোকা নাকি এই দুজনই স্পেসিফিক বোকা ভেবে পায়না ও। তারপর দ্রুত গিয়ে নিজে বাচালো মেয়েটিকে, বাচ্চাটি ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে তাই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো গাড়ির দিকে। ততক্ষণে ওই লোকেরা ওদের নোটিস করেছে তাই তাদের মাইন্ড ডাইভার্ট করতে অন্যদিকে ছুটলো তাদের গাড়িতে বসিয়ে।আজ হসপিটালে গিয়ে যখন দেখলো মেয়েটি তার ছেলেকে আগলে রেখে শুয়ে আছে তখন ওর নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।

সায়ানের বয়স যখন দশ বছর আর ওর বোনের বয়স আট তখন ওরা ভেকেশনে নিজেদের ফার্মহাউজে বেড়াতে যাচ্ছিল কিন্তু গাড়ির ব্রেক ফেইল হয়ে যায় তাই ওর বাবা মা ওদের দুইভাই বোনকে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ও রাস্তায় পড়ার কারনে হাত পা কেটে গিয়েছিল কিন্তু ওর বোন হাতে খুব জোরে ব্যাথা পায়। ট্রিটমেন্ট করার কারনে অনেকটা ঠিক হলেও পুরোপুরি হয়নি, ডক্টর বলেছে আকস্মিক শক খাওয়াতে মাইনর স্ট্রক করেছিলো ওর বোন তাই সাময়িক প্যারালাইজড হয়ে গেছে হাত।হয়তো ঠিক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। ওর বোনের নাম সামায়রা তবে ও সামু বলে ডাকে। সামু আর ও দাদার আর চাচা চাচির কাছেই বড় হয়েছে। তারা সবাই ময়মনসিংহে থাকে আর ও বছরে একবার ওইখানে যায়।ও হয়তো মেয়েটিকে সাহায্য ওই পর্যন্তই করতো কিন্তু কথা হচ্ছে ওকে যারা মারতে এসেছে তারা এই মেয়েটিকেও কেন টার্গেট করেছে, কি শত্রুতা আছে মেয়েটির ওদের সাথে? তাই মেয়েটির ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে বললো যাতে ওর শত্রু সম্পর্কে আরো ধারণা হয়।

“কিন্তু মেয়েটি সত্যিই ভিতু হাহা, আজ বছর বহু বছর পর এভাবে হাসলাম, থ্যাংকস টু দেট গার্ল”

🌸🌸🌸

“হাহা হাহা মাম্মা তুমি… ”
” এই এভাবে হাসছিস কেন? পাগলে ধরেছে তোকে রুহান? ”
“মাম্মা তোমার ছেলেদের মত দাড়ি গজিয়েছে ”
“কি বলতেছিস আবোল তাবোল ” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থ হয়ে গেলো রুশি। কি সুন্দর কলম দিয়ে মুছ আকা, ওই জন্যই কালরাতে ঘুম ভেংগে গিয়েছিলো, আর ওই হাসির শব্দ!যেটা শুনে যত দুয়া মনে ছিলো সব পড়া শুরু করে দিয়েছিলো। এর মানে এখানে সত্যিই কেউ ছিলো সামনে পেলে তাকে… রাগে রুশির শরির থরথর করে কাঁপছে।

সকাল-১০টা
সায়ান ঘুম থেকে উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে অফিসে ছুটছে। অফিসে ঢুকেই নিজের কেবিনে একজন মেয়েকে বসে থাকতে দেখলো, একটু আগেই ওর বডিগার্ড জানালো সে নাকি তার বউকে খুজে পেয়েছে তাই একপ্রকার দৌড়ে এসেছে এখানে।সাড়ে নয়টা নাগাত নাকি একটা মেয়ে ওর অফিসে এসেছে আর বলেছে ও সায়ানকে দেখতে চায়, বডিগার্ডরা পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বলে যাকে সায়ান এত বছর ধরে খুজছে সে। সায়ান এটা শুনে খুব দ্রুত এখানে ছুটে এসেছে, হয়তো তার শ্রেয়সীর মান ভেংগেছে তাই নিজেই ধরা দিতে এসেছে।

” নাম কি আপনার? ”
” আমাকে তুমি করে বলো ডিয়ার, আর নিজের বউয়ের নাম জানোনা তুমি? ওহ ওইদিনতো নাম বলিনি তোমাকে তাই না? আজ বলছি আমার নাম আনিকা ইউ ক্যান কল মি এনি, তোমাকে কত মিস করছি জানো? কেন চলে গিয়েছিলে আমাকে ফেলে? তোমাকে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। প্রমিস মি আর কোনদিন ছেড়ে যাবে না ” মেয়েটি কথা বলতে বলতে কান্না করে দিয়েছে যা দেখে সায়ানের খুব মায়া হলো। সায়ান মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিছুটা কাছে গিয়ে গালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো তারপর…

৭.

কান্নারত মেয়েটিকে দেখে সায়ানের খুব মায়া হলো যাকে অন্তরের অন্তস্থঃতল থেকে মায়া, মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়েও কিছুটা দমিয়ে বলে উঠলো

“তোমাকে যে কি দেখে চুজ করলো আমি ভেবে পাচ্ছিনা, আই ফিল স্যাড ফর ইউ রিয়ালি স্যাড”

“মা..মানে?কি বলতে চাইছো তুমি? ” বলেই সায়ানের দিকে হাত বাড়াতেই ও কয়েকপা সরে গেলো।

“তোমরা মেয়েরা বুঝো না তাই না যে আমি তোমাদের মত গায়ে পড়া মেয়েদের দেখতে পারিনা, আমার বউ আর যাইহোক তোমার মতো ছেঁচড়া না।এক মিনিট সময় দিচ্ছি নিজের সবকিছু নিয়ে চলে যাও। তোমার ভাগ্য ভালো তুমি মেয়ে আর মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না, নাহয় তোমাকে সায়ান জামিল খানের সামনে দাঁড়িয়ে নাটক করার সাহস গুচিয়ে দিতাম ”

মেয়েটি দ্রুত বেরিয়ে যেতে নিলে সায়ান পেছন থেকে বলে উঠে ” তোমার ওই কাপুরুষ বস কে বলে দিও খুব শিগ্রই আমাদের সামনা সামনি দেখা হচ্ছে, টেল হিম টু বি প্রিপেয়ার্ড আদারওয়াইজ…” ভিলেনমার্কা হাসি দিয়ে বললো।

মেয়েটি চলে যেতেই সাহিল ভেতরে ঢুকে বললো ” বস মেয়েটি চলে গেলো যে? ”

“ও আমার বউ না সাহিল, আমার বউ আর যাইহোক এমন না”

” এতো শিওর হলেন কি করে? মেয়েটি ওইদিন রাতের অনেক কিছুই জানে”

” এক্সেকলি অনেক কিছু জানে তাইতো ওভার কনফিডেন্স হয়ে ভুল করেছে।প্রথমত, আমার বউ ওর মতো গায়ে পড়া না, প্রথম দিনেই বুঝে গেছি যে ও অন্য মেয়েদের মত আমার সাথে ওইভাবে কথা বলবে না। দ্বিতীয়ত, আমি ওর কণ্ঠ খুব ভালো করে চিনি যেটা এই মেয়ের মতো না।আর শেষ মতে ও আনিকা নয় ওর নাম হচ্ছে রু.শা.নি, ওর নাম রুশানি। কাজি যখন নাম বলেছিলো আমার এই নাম মনে গেঁথে গেছে তাই আমার বউয়ের নাম ভুলে যাবো এটা কখনো হবে না আর এক্টিং লেভেল যা বাজে যে কেউ ধরতে পারবে ”

” কিন্তু বস ফোনে ওই লোকটি যে বললো ও ম্যাডাম কে চিনে ”

” আমাকে ভয় দেখানোর জন্য ভুল বলেছে, যেখানে আমিই খুজে পায়নি সেখানে তার খুজে পাওয়ার প্রশ্নই আসে না, সে চায় আমি যাতে রুশানিকে খুজে বের করার জন্য মরিয়া হই আর খুজে পেলে সে আমার দূর্বলতার সুযোগ নিবে যেমন ভিলেন রা নেয় , হাহা হাহা ব্লাডি থার্ডক্লাশ প্ল্যান ও তো জানে না যে আমি কোন হিরো নই। আমি এই গল্পের ভিলেন যে খেলার রুলস তৈরি নিজে আর জিতেও। এন্ড আই উইল উইন ইন দিস গেম ফর শিউর ”

” ইয়েস বস, আমি আপনার পাশে আছি ”

“তাইতো ভরসা পাই সাহিল, তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক ” কাধে হাত রেখে, চলো ম্যাডামকে দেখে আসি, না জানি সকালে মুখ দেখে কি করেছে হাহা

” বস আপনি তাহলে ওই মুস একে দিসেন? সকালে সেই লেভেলের চেতে গেছিলো পরে আমাকে দেখে ওয়াশরুমে চলে গেছে হাহা ”

” মেয়েটাকে দেখলে রাগি মনে হয় কিছুটা রুশানির মতো ” রুশানির কথা মনে পড়লেই বুক চিরে দীর্ঘনিঃশ্বাসেরা বের হয়, কবে ফিরে তার শ্রেয়সী তার বুকে! বড্ড মন খারাপ হয় তাকে ছাড়া।এই মন খারাপটা বড্ড কঠিন একটা অসুখ। যখন মন খারাপেরা হানা দেয় তখন বিরক্তি নামক শব্দটিও যেন আস্ত বিরক্তিতে পরিণত হয়, এই বিরক্তি দূর কোন স্বচ্ছ হাসিতে যে হাসিটা সে চার বছর ধরে খুজে বেড়াচ্ছে। এই আঠাশ বছর জীবনে প্রাপ্তির শেষ নেই তবে দিনশেষে সে শুন্য আর একা বড্ড একা।

কয়েকদিন পর, রুশি রুহানকে ডিসচার্জ করে পরেরদিন কিছু না বলেই চলে এসেছিলো কিন্তু এভাবে চলে আসটা ওর ভালো লাগেনি। এটলিস্ট উপকারের জন্য থ্যাংকস বলা উচিৎ তার। আর খালি হাতে থ্যাংকস বলা যায় না তাই একটা চাবির থোকা কিনেছে কে জানে পছন্দ হবে কিনা! সাহিল থেকে ঠিকানা নিয়ে সায়ানের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলো রুশি।

৮.

পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে সোফার উপর বসে আছে রুশি, এতক্ষণ বসে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে কিন্তু লোকটি আসছে না, সেই নয়টা থেকে বসে আছে এখানে। সামনে নানান ধরনের খাবার আর ফ্রুট সাজানো কিন্তু মুখে দেয়া তো দূরের কথা বিরক্তির কারণে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না।

লোকটি নাকি এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি, সারারাত কি চুরি করে নাকি যে সকাল নয়টা পঁয়তাল্লিশ বাজে এখনো ঘুম থেকে উঠছে না। আর সার্ভেন্টদেরো বলি হারি লোকটি কি বাঘ না ভাল্লুক যে ডাকতে ভয় পাচ্ছে, নিজে আগবাড়িয়ে গিয়ে ডাকতেও পারছেনা যদি অভদ্র মনে করে। একা একটা ছেলের ঘরে নক করা যুক্তিসংগত নয় বিধায় এতক্ষণ দম ধরে বসে আছে কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না।
আজকে যদি ধন্যবাদ না দিতে পারে তাহলে হয়তো আর কখনো দেয়া হবেনা, রুহানকে ছোট মার বাসায় একা রেখে এসেছে, না জানি ছোট মা কি বলে যাতে ছোট্ট বাচ্চাটির মনঃক্ষুণ্ণ হয়। নাহ আর থাকা যাবে না আর যাইহোক রুহান যদি জানতে পারে ও বাবাবিহীন সন্তান তাহলে অনেক কষ্ট পাবে। একজন সার্ভেন্টকে একটা পেপার আর পেন এনে দিতে বললো ও আর সেখানে কিছু একটা লিখে নিয়ে আসা গিফট সহ সার্ভেন্টদের কাছে রেখে বেরিয়ে পড়লো। লোকটিকে দেখার খুব কৌতুহল ছিলো ওর কিন্তু সেই কৌতুহল মনের মাঝেই দমিয়ে রেখে নিজ গন্তব্যে ছুটলো ও।

ছোট মার বাসায় ফিরে এসে ঘড়িতে দেখলো ১০টা বেজে ২০ মিনিট, দাদিমার ঘরের দিকে যাওয়ার পথে ছোটমার কটাক্ষের দৃষ্টি অগোচর হয়নি, এই বাড়িটা যে আস্ত ছোটমার রাজ্যে পরিণত হয়েছে তার কথাই শেষ কথা। তিশানটা ছোটমার ভয়ে অনেকটা লুকিয়ে কথা বলে আমার সাথে। আর বাবা তাকেতো আমি আসার পর থেকে চোখের দেখাও দেখিনি, হয়তো সে জানেইনা আমি এসেছি, তানহার আগের থেকেও উৎশৃংখল হয়ে গেছে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরনের কাপড় সংকির্ণ হয়ে এসেছে, ছোটমার বদৌলতে হয়তো। দাদিমার ঘরে রুহানকে গুটিসুটি মেরে সুয়ে থাকতে দেখলাম, রুহান আজকাল কথা খুব কম বলে আগের থেকেও আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে। সেইদিককার ঘটনার পর থেকে কেমন জানি ভয়ে ভয়ে থাকে। ওকে স্বাভাবিক করতে হলে আগের পরিবেশে নিয়ে যেতে হবে। দাদিমা এখন কিছুটা সুস্থ তাই আজই কলকাতা ফিরে যাচ্ছি আমরা, দুপুর দুইটায় ফ্লাইট। আর ছোটমার চাহনি সহ্য হচ্ছে না তাই একদিন আগেই ফিরে যাচ্ছি।

হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হয়ে হোটেলে উঠে ছিলাম কালকে দাদিমার অনুরোধে এখানে উঠেছি যদিও এখানকার অনেকেরি তা পছন্দ হয়নি কিন্তু আমার আর এখন কিছু যায় আসেনা, আমি স্বাবলম্বী কারো বোঝা নই যে চুপচাপ মুখ বুজে হজম করে যাবো সব। সবকিছু গুছানো হয়ে গেছে অলরেডি, এই ঘরের কিছু মুখে দেয়ার ইচ্ছা নাই তাই আগেই বেরিয়ে পড়েছি এয়ারপোর্টের উদ্দ্যেশ্যে। আসার সময় দাদিমা বাধা দেয়নি কেন দিবে?এই ঘরের কর্তী যে অন্য কেউ তারতো কিছু বলার অধিকার নেই। সত্যিই ওইসব ছেলেদের প্রতি ঘৃণা হয় যারা বউয়ের জন্য মাকে অবহেলা করে। প্রতিটা ছেলের জীবনে প্রথম নারী হচ্ছে তার মা আর প্রথম ভালোবাসাও। যে নিজের মাকে ভালোবাসতে পারেনা সে আর কাউকেই ভালোবাসতে সক্ষম নয়।

🌸🌸🌸

দুপুর বারোটায় ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে সায়ান, আজকাল ঘুমের ঔষুধ ছাড়া ঘুম আসেনা তার, বুকটা বড্ড ফাকা ফাকা লাগে। কালরাতে একটা খাওয়ার পরোও ঘুম আসছিলো না তাই দুটো ঘুমের ঔষুধ একসাথে খেয়েছে যারফলে কিচ্ছুক্ষণ আগে ঘুম ভেংগেছে ওর। উফফফ এতক্ষণ যে কিভাবে ঘুমালো আল্লাহ জানে। খাবার ফিনিশ করে সোফায় বসতেই মনে হলো কিছু একটার উপর বসেছে, হাতে নিতেই দেখে একটি চেইন যার থেকে কিছু একটা নিচে পড়ে গেছে, নিচে নেমে খুঁজতেই সোফার নিচে গোল কিছু পড়ে থাকতে দেখলো হাতে নিতেই দেখে একটা আংটি। আংটিটি দেখেই ওর চোখ চড়াগাছ, এটাতো সেই আংটি যে ও ওর বউকে পরিয়ে দিয়েছিলো কারণ এই আংটিটি ওর মায়ের ছিলো যেটা ও ওর বউকে দিয়েছে।কে এসেছিলো তা গার্ডদের জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনি পেছন থেকে একজন সার্ভেন্ট বলে উঠলো

” স্যার একটা মেয়ে এসেছিলো আপনার কাছে ”

” মেয়ে, কেমন দেখতে? লম্বা, চিকন? ”

” জি স্যার ফর্সাও দেখতে ”

” তুমি আমায় উঠাওনি কেন ডেমেট? “চিল্লিয়ে উঠে কথাটা বললো সায়ান

” স্যার আপনি ঘুমের মাঝে কারো ডিস্টার্ভেন্স পছন্দ করেন না তাই ডাকি নি, উনি অনেকক্ষণ বসে ছিলো আর যাওয়ার আগে এই জিনিসগুলো দিয়ে গেছে ”

সায়ান হাতে নিয়ে দেখে একটা ছোট বক্স আর চিরকুট যাতে লিখা

” অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের সেইদিন বাচানোর জন্য, আপনি না থাকলে হয়তো বেচে থাকতাম না। সামনা সামনি ধন্যবাদ দেয়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু তাতো আর হয়ে উঠলো না। যাইহোক থ্যাংকস ওয়ান্স এগেইন, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক”
ইতি
রুশানি আনাম

নামটা কয়েকবার ছুঁয়ে দিলো ও, এতো কাছে ছিলো ওর বউটা অথচ ও বুঝতেই পারেনি, চিনতেই পারেনি ওকে।সাহিলকে ফোন করে ঠিকানা জোগাড় করতে বললো ওর।
সাহিলের পাঠানো ঠিকানাতে গিয়ে জানতে পারলো রুশানি কলকাতা যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে আরো দুঘণ্টা আগে বেরিয়ে পড়েছে, কথাটা শুনে খুব অস্থিরতা কাজ করেছিলো। খুব দ্রুত ড্রাইভ করে এয়ারপোর্টের উদ্দ্যেশ্যে যাচ্ছে। বারবার মনে মনে দোয়া করছে যাতে ফ্লাইট না ছেড়ে যায়। কিন্তু কথায় আছেনা যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। রিসেপশন থেকে জানতে পারলো কলকাতা গামি প্লেন আরো আধাঘণ্টা পুর্বেই গন্তব্যের উদ্দ্যেশ্যে ছেড়ে গেছে।

সায়ান ওইখানে থাকা চেয়ারে বসে পড়লো, চোখজোড়া টলমল করছে পানিতে, তবে কঠোর অনুশাসনের কারণে ক্ষয়ে পড়ার অনুমতি তাদের নেই,ছেলেদের যে কাঁদতে হয়না, কান্না শব্দটা তাদের জন্য নিষিদ্ধ তবে তার যে কান্না পাচ্ছে ভিষন, কোন নিরাপদ আশ্রয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে আমি আবারো তাকে হারিয়ে ফেলেছি যার মুখখানি দেখার জন্য চারটি বছর ধরে মরিয়া হয়ে আছে…

৯.

হুগলি নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত কলকাতা শহর যাকে আনন্দনগরী বলা হয়ে থাকে, এই কলকাতা নামকরণের পেছনে একটি মজার মত হচ্ছে ‘খাল’ ও ‘কাটা’ এই দুইয়ের বিকৃতির ফলে নাকি এর উৎপত্তি। নাটক, রঙ্গ মঞ্চ আর থিয়েটারে রমরমা এই কলিকাতা শহর যাকে অনেকে ক্যালকাটা বলেও চিনে। অনেক কবির সাহিত্যচর্চা এই শহরকে কেন্দ্র করেই হয়েছিলো যার মধ্যে বাংলার কবি ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ ও রয়েছে। সমরেশ মজুমদারের ‘কলকাতা’ রচনায় কলকাতায় নানাধরনের মানুষের বাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, এটিকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। ভারত সম্রাজ্ঞী ‘রাণি ভিক্টোরিয়া’ এর স্মৃতিসৌধ হিসেবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল রয়েছে এই শহরে।এই হল থেকে ১৫ মিনিট দূরত্বে রুশিদের ফ্লাট।

রাত ১০ টার কাছাকাছি সময়, রুশি কাজ শেষে ফ্লাটে ফিরছে। আজ 5 দিন হল কলকাতা ফিরেছে, আবারো আগের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। সেই রেডিওতে কাজের পাশাপাশি তিনদিন ধরে একটি ফাইভ স্টার হোটেলের পারটাইম জব করছে ও।
সুজির বাবার বন্ধুর হোটেল এটি, তাই কাজ পেতে বেগ পেতে হয়নি, বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা৩০মিনিট পর্যন্ত শিফট ওর, যেহেতু রুহান বাসায় তাই ওভারটাইম করেনা ও। বাংলাদেশে যাওয়ার কারণে বেশ কিছুটা ঋণের নিচে আছে ও তাই এই জব বেছে নেয়া যা সেফ।

কিন্তু তিনদিন ধরে বেশ অস্বস্তিতে ভুগছে ও, সবসময় সিক্সথ সেন্স বলে ওকে কেউ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, কেউ ওর পিছু নিচ্ছে কিন্তু পিছনে ফিরতেই যেন সব ঠিকঠাক। এই যে অফিসে, বাসে, বাড়ির পাশে এমনকি রেস্টুরেন্টে থাকাকালীনও এমন হয় ওর সাথে, প্রথমে মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিলেও তিনদিন ধরে মনের ভুল কি করে হতে পারে? কোন ভুতটুত পেছনে লাগলো নাতো? আজকে কেমন জানি একটু ভয় লাগছে তাই ব্যাগটি শক্ত করে ধরে নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো নিজ ছায়া ব্যতীত অন্য একটা ছায়া তার পিছু নিচ্ছে, সে স্থির হতেই ছায়াটিও স্থির হয়ে গেলো। এটা দেখেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো।

ভুতদেরতো ছায়া থাকে না তারমানে আস্ত জলজ্যান্ত মানুষ পিছু নিয়েছে, ভয় আড়ষ্ট হয়ে দ্রুত হাটা শুরু করলো কারণ এত রাতে ছিনতাইকারী ছাড়া আর কে পিছু নিবে! সামনে কয়ফুট লম্বা গলি দেখেই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে পড়লো, সামনে এগোনোর সাহস পাচ্ছে না।এবার ও স্থির হলেও ছায়াটি স্থির হলো না বরং ক্রমশ তার নিকটে আসতে লাগলো,রুশি ভয়ে আটশাট হয়ে গেছে, ছায়া যত নিকটবর্তী হচ্ছে হৃদস্পন্দন যেন তত দ্রুত গতিতে দৌড়াচ্ছে। খুব নিকটবর্তী হতেই ও ব্যাগ খামছে ধরে খিচে দাঁড়াল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ছায়ার মালিক কাছে না এসে পাশ কাটিয়ে গলিতে চলে গেল।ভয়ে লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল, গলিতে ঢুকতে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলো রুশি, না যা ভাবছিল তা নয় কেউ ওর পিছু নিচ্ছিল না।
কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকার সেই গলির ভেতর দিয়া হাটা শুরু করলো, শেষমাথার কাছাকাছি আসতেই হেচকা টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এমন ঘটনায় রীতিমতো হতভম্ব রুশি, মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ও যে ধাক্কা দিবে সেই শক্তিটাও মনে হচ্ছে নেই, ও নিশ্চুপ হয়ে ব্যাক্তিটির লাভ-ডাভের আওয়াজ শুনছে। লোকটি হঠাত তার হাত কিছুটা আলগা করলো, হাত দিয়ে মাথা উচু করে রুশির অধরযুগল নিজ আয়ত্তে নিয়ে নিলো, রুশির কয়েকসেকেন্ড লাগলো বুঝতে যে কি হচ্ছে, বুঝতে পেরেই লোকটিকে ধাক্কা দিতে লাগলো কিন্তু লোকটি যেন এই পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো, লোকটি ওর হাত দুটো ধরে পেছনে নিয়ে আকড়ে ধরলো আর সচেতন ভাবে অধর সুধা পান করতে লাগলো।

রুশি চেয়েও একফোঁটা নড়তে পারেনি, ওর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, এতক্ষণ ছুটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে ও শান্ত হয়ে গায়ের ভার লোকটির গায়ে ছেড়ে দেয়। ও শান্ত হতেই লোকটি ঠোট ছেড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজ করে বলে
“যতই পালিয়ে বেড়াও না কেন তোমার গন্তব্য কিন্তু আমি তাই যেই রাস্তায় তুমি চলো না কেন আমাতেই তোমার সমাপ্তি হবে, সো বি রেডি ফর বিং মাইন ”

তারপর ওকে ছেড়ে দেয় লোকটি, ছেড়ে দিতেই এদিক ওদিক না তাকিয়ে রুশি ছুটে গেলো ফ্লাটের রাস্তায়। গলির শেষমাথায় আসতেই সোডিয়াম লাইটের আলোয় মুখখানি স্পষ্ট হয়ে উঠলো লোকটির, আংগুল দিয়ে ঠোটের কোনা ঘষতে ঘষতে মুচকি হেসে বললো

“আজ তো ছেড়ে দিলাম কিন্তু দ্বিতীয় বার কিন্তু ছাড়বো না বউসোনা, তোমাকে আমার হতেই হবে শুধু আমার আর আমাদের মাঝে যে আসবে তাকে আমি শেষ করে দিবো, মাত্র আর কয়েকঘন্টা তারপর…”

🌸🌸🌸

রুশি ঘরে এসেই রুহানকে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো, ব্যাগটা খাটের কোনায় রেখে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য,ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোট ঘষতে লাগলো, এতক্ষণ যাবত সাবান দিয়ে ঘষার পরও যেন শান্তি লাগছেনা, মনে হচ্ছে ঠোট কেটে ফেলি। লজ্জায় মাথা, নাক, কান সব কাটা যাচ্ছে, একটা ছেলে ওকে কিস করে চলে আর ওকে শায়েস্তা না করে ও পালিয়ে চলে এসেছে ভাবতেই রাগ উঠছে
” এত ভিতু কবে থেকে হলি রে তুই রুশি, একটা লোক ছিনতাই করার পরিবর্তে তোর কিস করে চলে গেলো আর তুই হাবার মত দাঁড়িয়ে ছিলি! যেই ছাড়লো ওমনি পালিয়ে এলি, তোর ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় দেয়া উচিৎ ছিলো।বেয়াদব, অসভ্য ছেলে একা মেয়ে পেয়ে আমার সর্বনাশ করে দিলো, যদি আবার সামনে পাই একদম ঠোট কেটে হাতে ধরিয়ে দিবো খচ্চর কোথাকার ”

চিরুনি শক্ত করে খামচে ধরে রাগি ফেস নিয়ে বললো যেন পেলে এখনি কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে, রুশির এহেন কাজ দেখে শব্দ করে হেসে দিলো সায়ান। ওকি জানে স্বয়ং ওর স্বামী ওকে কিস করেছে! জানলে কি লজ্জা পেতো ও নাকি এমন রাগই দেখাতো? ভেবে পায়না ও

” চ্যালেঞ্জ একসেপ্টেড ওয়াইফি, কাল তোমাকে লুকিয়ে নয় সামনে দেখা দিবো, দেখি কি করে কাটো আমার ঠোট, হাহা আবার বলে এমন ভিতু হলো কবে থেকে! ভিতু তো আগে থেকেই ছিলো নতুন করে হবে কি? তোমার দুষ্টু মিষ্টি চেহারা খুব কাছ থেকে চাই আমি, এই দূরত্ব যে আর প্রাণে সয়না, খুব কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করে তোমায় আর সেই দিন খুব দূরে নয়”

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো সায়ান, এয়ারপোর্টে ও খুব হেল্পলেস হয়ে বসে ছিলো ও তখনি সায়ান এসে বললো “বস আপনার জন্য কলকাতায় যাওয়ার ইমার্জেন্সি ভিসা লাগয়েছি,কয়েকঘন্টায় হাতে পেয়ে যাবেন, আর ওইখানে লোক লাগিয়ে দিয়েছি আপনি পৌঁছানোর আগেই ম্যাডামের খবর পেয়ে যাবেন, আর ওইখানে হোটেল বুক করাও হয়ে গেছে, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ম্যাডামকে শিগ্রই পেয়ে যাবেন ”

সায়ানের তখন খুব ইচ্ছে করেছিলো সাহিলকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু জড়তার কারণে হয়ে উঠিনি। থ্যাংকস বলে প্যাকিং করতে চলে যায় ও বাসায়। কলকাতায় আসার পর রুশিকে এই কয়দিন ধরে ফলো করছে ছায়ার মতো। ওর প্রত্যকটা গতিবিধি লক্ষ্য করছে একমিনিটের জন্য ও চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না তাই রুশিদের পুরো ফ্লাটে ইলেক্ট্রিসিটি চেক করার নামে সিসিটিভি ফুটেজ লাগিয়ে দিয়েছে। এখন বাসায় এসেও ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। চারবছরের নয়ন তৃষ্ণা যেন মিটাচ্ছে ও, উজ্জলশ্যাম বর্নের মুখ, খাড়া নাক, টানা টানা চোখ আর গোলাপি ঠোট সবমিলিয়ে সৃষ্টিকর্তা যেন খুব নিপুণ ভাবে বানিয়েছে তাকে। সবচেয়ে আকর্ষনীয় হচ্ছে ঠোটের উপরে বামপাশের তিলটা যেন এই অপরুপ সৌন্দর্যে কারো নজর না লাগে তাই এই নজরটিকা। আর সুন্দর নারিটিই তার বউ শুধু তার, যার দিকে হয়তো ও হাজার বছর তাকিয়ে থাকতে পারবে। মন আচমকাই যেন গেয়ে উঠলো

” পড়েনা চোখের পলক
কি তোমার রুপের ঝলক
দোহাই লাগে মুখটি তোমার
একটু আচলে ঢাকো
আমি জ্ঞান হারাবো, মরেই যাবো
বাচাতে পারবে নাকো ”

১০.

“দ্যা গড অফ কুকারি” রেস্টুরেন্ট এর প্রধান ফটকের বামপাশের একটি টেবিলের সামনে বসে আছে সায়ান, বারবার ঘড়ি দেখা দেখে একটা মেয়ে ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলো
“স্যার আর ইউ ওয়েটিং ফর সামওয়ান? ”

সায়ান জোর পুর্বক হেসে বললো “নো”

“নো একচুয়ালি, ইউ আর কন্টিনিউয়াসলি লুকিং এট দ্যা ডোর এন্ড এরাউন্ড ইউ, আর ইউ লুকিং ফর সামওয়ান? ”

” নো, নট লাইক দেট ”

মেয়েটি ওর কাছ থেকে সরতেই ফোন বের করে সাহিলকে ফোন দিলো ” এই রেস্টুরেন্ট এ ও কাজ করে তাহলে এখনো আসছেনা কেন? হোয়ার ইজ শি ডেম ইট ”

“স্যার আমি কি করে জানবো, আমিতো বাংলাদেশে আছি”
” আমি কিছু জানিনা, আমি ওকে দেখতে চাই রাইট নাউ”
” সাহিল… আমি জানিনা তুমি কি করবে বাট এখুনি খুজে বের করো ও এখনো আসেনি কেন?”
” ইয়েস বস”

দুপুর তিনটা থেকে পাচটা পর্যন্ত দীর্ঘ দুই ঘন্টা ১৫ মিনিট ধরে ও অপেক্ষা করছে, মেয়েটি এত কেয়ারলেস! ওর জন্য ওয়েট করতে করতে দশ কাপ কফি অলরেডি খেয়ে ফেলছে আর কিছু ডিনারের জন্য পেটে ঢুকাতে পারবে কিনা সেই টেনশনে আছে ও আর এদিকে এই মেয়ের কোন খবর নেই! সায়ান জামিল খান রেস্টুরেন্টে একটা মেয়ের জন্য ওয়েট করছে! দাদাজি এই কথা শুনলে হয়তো তৃতীয়বারের মত স্ট্রোক করবে, গড সায়ান কি দিন আসলো তোর!!

” স্যার একচুয়ালি আজ তো সানডে তাই.. ”

আজ সানডে? ওহ ডেম কি করে ভুলে গেলাম আমি ইন্ডিয়ায় সানডে ইজ হলিডে, এই মেয়ের চক্করে কিনা আমার ভুলনেকি বিমারি শুরু হোগাই, ওয়েট…

” রেস্টুরেন্টে কিসের সানডে? এই দিনেই তো ওয়ার্কার্সরা বেশি বিজি থাকে কজ কাস্টোমার বেশি থাকে, সো হোয়াই শি ইজ নট হেয়ার? এত ইরেস্পন্সিবল মেয়েকে রাখলো কে?”

“বাট স্যার মেয়েটা তো আপনার বউ ”

সাহিলের কথাটা শুনেই হালকা কেশে উঠলো ও, থেকে থেকে নিজের ভেতরে থাকা বিজনেসম্যান জেগে উঠে তবে ও হলে কিন্তু এমন ইরেস্পন্সিবল ওয়ার্কারকে না থাক বউটা তো ওরই। আসলে কেউ ঠিকি বলেছে
“পুরুষ মানুষ যতই বাইরে বাঘ হয়ে বেড়াক ঘরে কিন্তু সে ভিজা বিড়াল হয়েই ফিরে আসে ”
কারণ নারিরা এত শক্তিশালী যে পুরুষকে নিজের বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে বাধ্য করতে পারে, আর ওরতো রাতবিরাতে ঘরে ফিরার অভ্যাস। না জানি কত রাত বাইরে কাটাতে হতো, নাহ এই অভ্যাস অচিরেই পরিবর্তন করতে হবে।

” স্যার মেম আসলে ছুটিতে আছে একদিনের তার ছেলেকে নিয়ে নাকি ঘুরতে যাবে কোন পার্কে এটাই বললো ম্যানেজার ”
” ছেলে? ”
” ইয়াহ ছেলে যাকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন আর ওইযে হসপিটালে ছিলো, ভুলে গেলেন! কিন্তু স্যার আপনি তো মেম এর সাথে ছিলেন না তাহলে কি বেবিটা এডপ্টেড? ”
” ওই বাচ্চার বয়স কত? “কাপা গলায় বললো সায়ান
” স্যার প্রেসক্রিপশনে তো তিন বছর দেখেছিলাম ”

সায়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, নাহ বাচ্চাটি এডোপ্টেড না কি সেটা জানা নেই তবে বাচ্চাটি অন্যকারো নয়, কারণ রুশানিকে ফলো করার আজ পঞ্চম দিন কিন্তু তার সাথে কোন ছেলেকে দেখেনি সে। আর যদি কেউ থেকেও থাকে তাহলে তাকে সরে যেতে হবে নাহয় নিজে মেরে ফেলবে তাকে। ওর বউ শুধু ওর যার এক চিমটি ভাগ ও কাউকে দিবে না, কাউকে না। রুশিতে এতটাই মগ্ন ছিলো যে বাচ্চাটিকে দেখেও দেখে নি ও, ওর দৃষ্টি সর্বদা ওতেই ছিলো যে অন্যসব খেয়ালই করেনি।
তাহলে বাচ্চাটি কি ওর?যদি হয়ে থাকে তাহলে ও নিজেকে কি বলে মনে করবে এই মুহুর্তে?
সুখি মানুষ! যার কিনা বউ বাচ্চা নিয়ে একটা সুন্দর ফ্যামিলি আছে।নাকি সবচেয়ে অভাগা! যে এই মুহুর্তে জানতে পারলো তার তিনবছরের একটা বেবি আছে।ও তাকে জন্মাতে দেখেনি, বড় হতে দেখেনি নাহ এখন পর্যন্ত সরাসরি দেখেছে। রুশিকে দেখার জন্য যতটা না ডেস্পারেট তার থেকে বেশি ওর ছোট্ট বাচ্চাটাকে দেখতে ডেস্পারেট ও। কার মত দেখতে হয়েছে ওর ছেলে? ওর মত নাকি ছোট্ট বউটার মত!

” সাহিল গিভ মি দ্যা পার্কস এড্রেস, আর হ্যা রুশানি এই চারবছর কি করেছে না করেছে আই ওয়ান্ট এভরি পিস অব ইনফরমেশন, কালকের মধ্যে চাই ”

“ইয়েস বস, হয়ে যাবে”

🌸🌸🌸

সাহিলের দেয়া পার্ক এড্রেসে এসে বেঞ্চে বসে আছে ও, চারপাশে অনেক মানুষ সাদা-কালো, বাদামির মিশ্রণে যাদের মিউলেটো বলে, এশিয়া মহাদেশের হয়তো প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশীয় মানুষগুলো মিশ্র প্রকৃতির, তাদের মাঝে সকল দেশের ছোঁয়া পাওয়া যায় যেন আস্ত পৃথিবীটা এখানে বসবাস করে। অনেকগুলো বাচ্চা এখানে খেলা করছে, সবাই পাচের নিচে আর তারপাশে তাদের বাবা মা বসে আছে। চারপাশে তাকাতেই আমগাছের নিচে বসে থাকা ছোট্ট বাচ্চাটির দিকে নজর পড়লো ওর, কোন একদিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে গম্ভীরভাবে, দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই দেখে একটা লোক তার ছেলেকে নিয়ে খেলছে।ছেলেটিকে দেখে নিজের সন্তানের কথা মনে পড়লো সায়ানের, তার ছেলেটিও কি এভাবে অন্যবাবা সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে?ওর খুব কষ্ট হলো এটা ভেবে, এতোগুলা বছর বাবা ছাড়া কি করে কাটিয়েছে ও। বাচ্চাটির দিকে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে পড়লো ও,

” নামকি তোমার বাবু?”

” আমি কোন বাবু নই, অলরেডি থ্রি ইয়ারস ওল্ড। আর মাম্মা বলেছে অচেনা কাউকে নাম বলতে না” গম্ভীর চেহারা নিয়ে বললো বাচ্চাটি, সায়ান মনে মনে ভাবছে বাচ্চাটিতো ওর থেকেও এক লেভেল উপরে, এত ম্যাচিউরড বাচ্চা ও কখনো দেখেনি।

” ওকে বলবো না বাবু, আমি তোমার অপরিচিত তাইতো? তাহলে চেনা হলে তো বলবে তাইনা? ওকে মাই নেম ইজ সায়ান জামিল খান আর তোমার? ” হাত বাড়িয়ে

” নিজের নাম বললেই চেনা হয়ে যায়না, তবে আপনাকে দেখে জেন্টলম্যান মনে তাই বলছি, মাই নেম ইজ রুহান ওকে ” হাত মিলিয়ে হ্যান্ডশেক করে।

” বাহ তুমি খুব স্পষ্ট কথা বলতে পারো এতটুকু বয়সেই ”
” কারণ আমি বড় হয়ে গিয়েছি, আচ্ছা আপনিও তো ফর্সা দেখতে আপনাকে কেউ ইংরেজের বাচ্চা বলে না”

সায়ান ভ্রু কুচকে তাকালো, এই শব্দটা তার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর শব্দ। ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে প্রায় শুনতে হতো এটা এমনকি ওর তখনকার বেস্ট ফ্রেন্ড তো ওকে প্রায় চেতাতো এটা বলে, এখন যে কোথায় আছে কে জানে। তবে জেনে ভালো লাগলো ও একা নয় আরেকজনকেও এটা বলে।

” বলতো তবে এখন বলে না ”
” তারমানে বড় হলে আর বলে না তাইতো ”
” আচ্ছা তুমি কার সাথে এসেছে এখানে?”
” মাম্মা আর মাসির সাথে ”
” বাবা আসে নি?মিস করছো তাকে?”
” নাহ, রুহানের বাবাই তো নেই, কখনো আসে না দেখা করতে তাই রুহান রাগ করেছে বাবাইয়ের উপর, রুহান হেটস বাবাই ”

“রুহান কার সাথে কথা বলছো তুমি? তোমার মাম্মা অচেনা কারো সাথে কথা বলতে হয়না? মাম্মাতো খাবার কিনতে গিয়েছে তাই বলে তুমি অন্যদের সাথে কথা বলবে”

রুহান আর সায়ান দুজনই পেছনে তাকিয়ে বাইশ – তেইশ বছরের মেয়ে দেখতে পেলো, সায়ান কথা বলতে বলতে রুহানকে কোলে বসিয়ে ছিলো তাই রুহান কোল থেকেই তাকিয়েছে, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সায়ান চিন্তায় পড়ে গেলো কোথায় যেন দেখেছে তাকে কিন্তু মনে পড়ছে না

” ইটস ওকে মেম, আমি জাস্ট কথা বলছিলাম”

“আপনি কথা বলছেন তা আমিও দেখছি কিন্তু সবাইতো আর আপনি হবেন না তাইনা, আমাদের তো সচেতন থাকতে হবে ”

” জি আমি আপনার কন্সার্ন বুঝতে পারছি ”

তখনি পেছন থেকে নারি কন্ঠ ভেসে উঠলো,হাতে আইস্ক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুশি, ঠোটের কোনে মুচকি হাসি।
“রুহান… সুজি”

রুশিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেলো সায়ান,ওর কোলের বাচ্চাটি ওর নিজের সন্তান, ওর ছেলে রুহান…
সায়ানের কোল থেকে রুশির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো রুহান।
“মাম্মা,তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ”
” আইস্ক্রিম কিনছিলাম বেবি, নেও এটা তোমার জন্য ইউর ফেভারিট স্ট্রভেরি ফ্লেভার ”

সায়ান রুশির কোলে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়, অজানা গন্তব্যে হাটছে ও। এতোগুলা কো ইন্সিডেন্স, সবথেকে বড় কথা ওর ছেলে ওকে দেখতে পারে না, ছোট্ট শিশুটার মনে বাবার জন্য এতটা আক্ষেপ, ওকি জানে ওর মাকে কতদিন যাবত খুজে বেড়াচ্ছে ও, যদি আগে পেয়ে যেত তাহলে ওর ছেলে ওকে বলতো যে ” রুহান হেটস বাবাই “,
“আম স্যরি বাবা, আমি ভালো বাবা হতে পারিনি না ভালো স্বামী।তবে এরপর থেকে বাবা তার বেস্ট ট্রাই করবে দুটোয় হওয়ার, আই প্রমিস ইউ ”

to be continued…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here