বৈবাহিক চুক্তি পর্ব -০১-৫

#বৈবাহিক_চুক্তি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্বঃ( ১-৫)

অন্ধকারে বিবস্ত্র অবস্থায় ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো রুশি। আবছা আলোয় পাশে থাকা পুরুষালি অবয়বকে দেখতে পাচ্ছে সে তবে মুখখানি স্পষ্ট ঠাউর করতে পারছে না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে সে তার স্বামীকে এখন পর্যন্ত দেখেনি তবে নিজের সবচেয়ে দামি জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছে। তবে এতে কি আদোও পাশে থাকা লোকটির দিকে সে আংগুল তুলতে পারবে সে? সে তার বউ, আল্লাহর পবিত্র কালাম পড়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা। তার তো ওর উপর সম্পুর্ণ অধিকার রয়েছে হোক না পরিচয়টা একরাতের!
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পুরো জীবনের খাতা বদলে গেলো?
সবে মাত্র আঠারোতে পা সদ্য কিশোরী রুশানি আনাম। জন্মের সময় সে তার মাকে খেয়েছে এমনটাই ছোট থেকে শুনে আসছে সে এমনকি তার বাবাও বিশেষ নজর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি। স্ত্রীর মৃত্যুর দায় রুশির ঘাড়ে চাপিয়ে নিজের বাবা নামক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। তাই বাবার আদর কেমন হয় তা জানা হয়ে উঠেনি তার। তবে মনের গভীর এক প্রশ্ন বারবার কড়া নেড়ে যায়, স্ত্রীকে যদি এতই ভালোবাসতেন তবে তার মৃত্যুর একমাসের মাথায় তারই ছোটবোনকে নিজের সহধর্মিণী হিসেবে গ্রহণ করলো কি করে? কি এই প্রশ্নটি করার সাহস আর ইচ্ছে কোনটিই নেই, হয়তো সত্য জানার ভয়ে।
বড় হওয়ার পর থেকে সৎ জিনিসটা খুব ভালো করে বুঝে গেছে সে। বাড়ির সকলের কাজ একা হাতে সামলানোর দায়ভার তারই ছিলো। এইট পাশ কোনমতে বাবার পয়সায় শেষ করতে পারলেও নাইন থেকে আর বাবা আর খরচ চালানোর সাহস দেখাননি। হ্যা সাহস! কারণ ছোট মার কথা ছাড়া তিনি নিঃশ্বাস ছাড়তেও ভয় পান বড় আদরের বউ কিনা! আর পড়াশোনার খরচ বন্ধের কারণ হলো তানহা মানে রুশির সৎ বোন ভালো রেজাল্ট করেনি। সেই থেকে নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে এইচএসসি অবদি এসেছে।তবে একজন ব্যাক্তি খুব সাহায্য করেছে এমনকি টিউশনিও সেই খুজে দিয়েছে।

আজ বিকালে টিউশন করেই বাসায় ফিরছিলো তখনি গুলির শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায়। আর আওয়াজ উৎস খুঁজে সে দিকে তাকাতেই দেখে একটি লোক মাটিতে পড়ে আছে আর রক্তে সাদা ধুলো লাল বর্ণ ধারণ করেছে।আর সামনে একজন লোক গান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি ওকে নোটিশ করতেই দৌড়াতে চাইলো সে কিন্তু অসাড় পা দুটো নড়তে ভুলে গেলো যেন। সামনের লোকটি উপায়ন্তর না দেখে গান তাক করলো ওর দিকে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চোখ বন্ধ করে নিলো তখনি এক বলিষ্ঠ হাতজোড়া খুব দ্রুত তাকে সরিয়ে নিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই বলিষ্ঠ হাতের মালিক তাকে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। কতক্ষণ দৌড়েছে জানেনা তবে হঠাত ওর পা দুটো চলা বন্ধ করে দিলো আর চোখ দুটো বুঝে এলো। তবে পড়ে যাওয়ার আগে ঝলঝল করে উঠা বাদামি চোখ দেখতে পেলো। সেই চোখে কত মায়া! মনে হয় যুগযুগ ধরে তাকিয়ে থাকতে পারবে সেই চোখের গভিরতায়।

…চোখ মেলে নিজেকে জীর্ণশীর্ণ এক তাকিয়ায় দেখতে সে। মাথাটা খুব ভার ভার লাগছে। ঘরে একটা মোমবাতি জলছে সেই আবছা আলোয় ঘরভর্তি কিছু লোক দেখতে পেলো আর সাথে একজন লোককে কয়েকজন লোক ধরে রেখেছে, ঠিক লোক নয় চব্বিশ কি পঁচিশের যুবক বলা চলে। কপালে আর ঠোঁটের কোনে রক্ত জমাট বেধে আছে মনে হচ্ছে কেউ মেরেছে কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো ছেলেটি মাস্ক পরে আছে। তখনি কেউ ধাক্কা দিলো রুশিকে। পাশ ফিরে দেখলো এক মাঝ বয়সী মহিলা কিছু একটা বলছে। কথা ধরতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো ওর। মহিলাটি ওকে কবুল বলতে বলছে কিন্তু কবুল! কিসের কবুল। আহাম্মকের মত তাকিয়ে থেকে রুশি প্রশ্ন করলো

“কবুল? কিসের কবুল বলতে বলছেন আপনি?”

“তোমরা নাকি জামাই বউ তাইলে কবুল বলতে এত তামাসা করতাছো কেলা ”

“জামাই বউ! কিসের জামাই বউয়ের কথা বলছেন আপনি? আমার তো বিয়েই হয়নি তাহলে জা..”

তখনি রুশিকে আর না বলতে দিয়ে মাস্ক পড়া ছেলেটি বললো “আরে কি বলছেন আপ…তুমি মানে কি বলছো তুমি? আমি জানি তুমি রেগে আছো তাই বলে মিথ্যে বলে মার খাওয়াবে আমাকে?”

পাশ থেকে একবলিষ্ঠ পুরুষালি কন্ঠেবলে উঠলো পঞ্চাশউর্ধ এক লোক “মিয়া ভাই এগেই কইছিলাম এই ব্যাটার মধ্যে ঘাপলা আছে, দেহেন না এত মাইর খাওয়ার পরেও ব্যাটা মাস্ক খুলে নাইক্কা আবার বলতাছে এই মাইয়্যা নাহি তার বউ, মনে মাইয়্যারে কিডন্যাপ করছে, এই যে মা জননী বলেন তো এই পোলা আপনার কেঠা লাগে? ”

তাদের কথা শুনে বুঝলাম ছেলেটি আমাকে নিয়ে এসেছে এইখনে কিন্তু কে এই ছেলে, এটা কি সে যে আমাকে বাঁচিয়েছে! ছেলেটা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে কিছু না বলার জন্য মিনতি করছে। আমার কোন জবাব না পেয়ে তারা ধরেই নিয়েছে যে ছেলেটি আমাকে কিডন্যাপ করছে তাই তারা তাকে পুলিশে দেয়ার কথা বলছে। এই ছেলেটি যদি আমাকে বাচিয়ে থাকে তাহলে আমার জন্য সে ফেসে যাবে তা কি করে হতে দেয়

তাই অবশেষে মুখ খুলে বললাম ” জি উনি আমার স্বামী ”
তখনি সাদা পাঞ্জাবি পরা এক লোক বলে উঠলো “আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই। আপনারা দ্বিতীয়বার বিয়ে করতেই পারেন। তাহলে বলেন মা আপনি কি সায়ান জামিল খানকে একশত এক টাকা দেনমোহরে বিবাহ করতে রাজি আছেন? বলেন কবুল ”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, তবে কি আমার ভাগ্যে ছিলো? একটা অচেনা অজানা লোকের সাথে বিবাহ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া? মন এই সম্পর্কের বিরোধিতা করলেও বিবেকের কাছে হেরে গেলাম। আমার জীবন্টাই তো এই লোকের উসিলায় বাচলো তাকে আমি বিপদে ঠেলে দেয় কি করে তাই মনের বিরোধিতা করে কবুল বলে দিলাম। সাথে অজানা ভয় গ্রাস করলো আমায় এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি আর বাবাকেই বা কি জবাব দিবো?

সবাই একে একে ঘর ছেড়ে দিলো আর রয়ে গেলাম আমরা অপরিচিত দুই প্রানী। কি হবে এই সম্পর্কের শেষ? এটি কি আমার জীবনের নতুন ভোর হয়ে আসবে নাকি মেঘে ঢাকা কোন এক কালো রাত হয়ে?

২.

সবাই একে একে ঘর ছেড়ে দিলো, যাওয়ার আগে ওই মাঝ বয়সী মহিলাটি স্বামী নিয়ে কি সব জ্ঞান দিয়ে গেলো যা মাথার কয়েকফুট উপর দিয়ে গেলো রুশির। এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার ওর ভয় করছে খুব। অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষের ভীরে নিজেকে কেমন অগোছালো লাগছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সামনের ছেলেটার সারা রুমজুড়ে পায়চারি করা দেখছে, লোকটিকে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল কিন্তু ভয়ে মুখের দিকে তাকাতে পারছেনা , কে জানি লোকটি মাস্ক খুলেছে কিনা। কিন্তু ছেলেটার সাথে কথা বলা প্রয়োজন ভেবে উঠে দাঁড়ালো, হাত কচলে কিছু বলবে তার আগেই ছেলেটি খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে, আচমকা এমন ঘটনায় ভেবে রাখা কথাগুলো কণ্ঠনালীতেই আটকে গেল বের হওয়ার সুযোগ পায়নি বয়কি। স্তব্ধ হয়ে গেলো সময়, পুরো ঘর জুড়ে ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া বাকি সবটাই স্তব্ধ হয়ে রইল। মাতাল করা ঘ্রাণ নাকে বারি খাচ্ছে আর জীবনের প্রথম কোন ছেলের এতটা কাছে ভাবতেই শরীর কেঁপে উঠলো। চেনা নেই জানা নেই না কথা বলেছে, এই লোকটি আমার নাম মনেও রেখেছে কিনা সন্দেহ আর বিয়ে না হতেই নিজের অধিকার ফলাতে চলে এসেছে?
ভাবতেই রাগে গা রি রি করছে। রুশির গায়ে পড়া লোক একদমি পছন্দ না।
পাশের বাড়ির ছেলে সামাদকে বেশ পিটিয়েছিল একদিন। ওর অপরাধ ছিলো লাভ লেটার দিয়েছিলো আর রুশি উত্তর না দেয়াতে হাত চেপে ধরেছিলো, এতেই রাগ উঠে গিয়েছিল আর সেই কি মার দিয়েছিলো। এই নিয়ে শালিসিও বসে ছিলো আর ছোট মায়ের কাছে মারও খেয়েছিলো । তাই এমন আচমকা আক্রমণ সেই রাগটাকে দিগুণ করে দিলো, গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে খুব জোরে থাপ্পড় মারলো ছেলেটিকে, রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছে। ছেলেটিকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো

” মেয়ে মানুষ দেখলে হুশ থাকে না তাইনা? আপনারা সকল পুরুষরাই এক, মেয়েদের ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু ভাবেন না, আপনাদের কাছে বিয়ে মানে তো শুধু বাহানা, আসলে আপনারদের আর রেপিস্টের মাঝে পার্থক্য কি? বিয়ে নামক সমঝোতা যে মেয়েটা কিছু চাইলেও বলতে পারবে না! এই জন্য ছেলেদের দেখতে পারিনা আমি,ছেলে মানেই ছুকছুকানি স্বভাব, আপনা..”

কথা শেষ করার আগেই কানে ঝনঝন করে কিছু পড়ার আওয়াজ এলো, পাশে ফিরে নিচে তাকাতেই দেখে কাচের মগ টুকরো টুকরো কাচে পরিণত হয়েছে, উপরে তাকাতেই আবছা আলোয় দুটি রক্তচক্ষু দেখতে পেলো। ছেলেদের প্রতি নিজের ক্ষোভ আর বাবার প্রতি আক্ষেপ থেকে খুব বেশিই কথা শুনিয়ে ফেলেছে লোকটিকে,নিজের দিকে এগুতে থাকা লোকটিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে
” দে..দেখুন আমি… ”

“ব্যস অনেক বলেছ আর আমি অনেক শুনেছি, তুমি জানো তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা আমার সামনে উচ্চস্বরে কথা বলে এখনো বেঁচে আছো, তুমি যদি ছেলে হতে I swear আমি তোমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম কিন্তু মেয়ে বলে তুমি পারবে পেয়ে তা ভেবোনা শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। কি যেন বলছিলে ছেলে মানেই ছুকছুকানি স্বভাব, স্বামী আর রেপিস্ট এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এতক্ষণ তো স্বামী হিসেবে ছিলাম এখন রেপিস্ট কি করে তা হারে হারে টের পাবে তুমি ”

রুশিকে হেচকা টানে নিজের একদম কাছে টেনে নেয় ছেলেটি…

“এন আর ইউ অকে?এন এই… তুমি কি কি বাজে স্বপ্ন দেখেছো? ”

” ইয়া সুজি, আই এম অকে, রিলাক্স আমি ঠিক আছি, জাস্ট একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি ”

” তুমিতো প্রায়ই এমন ঘুমের মাঝ থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠো, করবার বললাম ভালো সাইক্রেটিস্ট দেখাও কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে তো।”

” লিসেন এই ফালতু কাজে টাকা নষ্ট করার মানেই হয় না, আমাকে রুহানের ভবিষ্যতের কথাতো ভাবতে হবে তাইনা?তাছাড়া আমি আমি সত্যিই ঠিক আছে এমন নাইটমেয়ার তো অনেকেই দেখে, ইট ডাসেন্ট মেটার সো জাস্ট চিল”

” সেই একি কথা তোমার, আরে আমিও তো আছি তাইনা রুহানের জন্য, এত ভাবো কেন তুমি ”

” আমার মত সিংগেল মাদার হলে বুঝতে ছেলের জন্য টেনশন করা কাকে বলে ”

” অকে মেরি মা আব চুপ হো যা, তাড়াতাড়ি উঠো। নয়টায় শো আর এখন আটটা বাজে ”

” অহ শিট, আমি এখন ফ্রেশ হচ্ছি, তুমি রুহানকে একটু উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দাও ”

এই হলো সুজি পুরো নাম সুজাতা সেন তবে সবাই সুজি বলেই চেনে তাকে। আরজে সুজি আমার অচেনা শহরের একমাত্র সঙ্গী। সেই একরাত আমার জীবনের খাতাই বদলে দিয়েছিলো, বাস্তবতা নামক শব্দাটাকে হারে হারে বুঝিয়েছিলো। প্রায়শই সেই লোকটির কথা মনে যে কি না তার একরাতের স্বামী ছিল যার ভারত্ব এখনো বইছি।
সেইদিন ভোর হয়েছিলো ঠিক তবে নিয়ে এসে তুমুল বহমান ঝড় যা আমার জীবকে লণ্ডভণ্ড করতে যথেষ্ট ছিলো। ভোরের চোখ মেলার পর সেই ছেলের দেখা পায়নি সে তবে অনামিকা আংগুলে তার পরিয়ে দেয়া আংটি ঠিকি ঝুলছিলো। উঠে বসে পাশের টেবিলে বিরিয়ানির পেকেট দেখতে পেয়েছিলো আর সাথে একটি চিরকুট যাতে লিখা ছিলো “খাবারটা খেয়ে নিও এবং নিজের খেয়াল রেখো আর এদিকটা সামলে নিও ”
চিরকুট পড়ে ও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো,লোকটি সত্যিই ওকে ফেলে চলে গেলো?একবারো ভাবলো না আমার কথা?খাবারটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠেছিলো সেদিন তবে তার আহাজারি দেখার মানুষ ছিলো না সেদিন।

“এন, চলে এসেছে নাম। তাড়াতাড়ি যা না হয় ডিটি স্যার বকা দিবে ”
” হুম, অল দ্যা বেস্ট ”
” সেম হেয়ার ”



“গুড মর্নিং কলকাতা, দিস ইজ আরজে আনাম উইথ ইউ, অয়েলকাম বেক টু মাই শো ‘লাইফলাইন’। আপনার লাইফের প্রিয় ব্যাক্তিটিকে নিয়ে যদি কিছু বলার থাকে বা তাকে ইম্পর্টেন্ট কোন মেসেজ দেয়ার থাকে তাহলে এসএমএস করে জানান Mirchi Fm your name আপনার মনের সকল কথাগুলো লিখে পাঠিয়ে দিন এই নম্বরে +91******, এই সংটি সকল ভালোবাসার মানুষকে ডেটিকেট করা,টিল দেন স্টে উইথ মি ”

আমার সকাল হাসে তোমার চিলেকোঠায়
আর একফালি সুখ মনের আঙিনায়
আমি ঘুম হয়ে তাই, তোমার চোখেতে
ভালোবাসার স্বপ্ন এঁকে যাই (x2)

জানি না বুঝিনা কেনো মন মানে না
এই মন শুধু তোমাকে চায় (x2)
আমার সকাল হাসে ..

মন আমার কেন সে দূর অজানায় হারালো
ভালোবেসে তোমায়
তোমাতে বিলীন হয়ে আজ লিখেছি
প্রেমের কবিতা
ওগো বন্ধু আমার,
ওগো বন্ধু আমার তুমি সেই কবিতা
ছন্দে গড়া পুঁতির মালা।

জানি না বুঝিনা কেনো মন মানে না
এই মন শুধু তোমাকে চায় (x2)
আমার সকাল হাসে ..

ইয়াহ মি, আরজে আনাম, কলকাতা শহরের নামকরা আরজে যার কিনা শতশত ফ্যান। প্রতিদিন কম করে হলেও শ খানেক প্রোপোসাল পাই অথচ কেউ হয়তো ভাবতেই পারবে না এই মিষ্টি কন্ঠের পেছনে লুকিয়ে আছে বড্ড অসহায় একটি মেয়ে। এই কলকাতা শহরে আমি ভিন্দেশীয় মানুষ। খুব মিস করি নিজের দেশকে…

🌸🌸🌸

ডেস্কের উপর হাত মুঠো করে বসে আছে সায়ান জামিল খান, তার পেছনে একটি মেয়ে কাধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো
“স্টপ দ্যা মিটিং রাইট নাউ ”
“বাট স্যার দিস ইজ এন ইম্পর্টেন মিটিং ফর আজ, হাউ কেন ইউ… ”
” স্টপ সাহিল, সায়ান জামিল খান যা বলে তাই করে, কয়েককোটি টাকা লস হলে এসকে ইন্ডাস্ট্রি পথে বসবে না ”
বলেই চেয়ার থেকে উঠে গেলো আর বের হওয়ার আগে অই মেয়েকে বললো

” আই ডোন্ট লাইক দোজ কাইন্ড অফ গার্লস হু সিডিউস গাইস ফর আ ব্লাডি কন্ট্রাক্ট, স্টে এওয়ে ফ্রম মি,আই কান্ট বিলিভ মিস্টার হিল কেন হায়ার আ গার্ল লাইক ইউ টু উইন আ কন্ট্রাক্ট ( আমি ওইসব মেয়েদের পছন্দ করিনা যারা একটা সাধারণ চুক্তির জন্য ছেলেদের সিডিউস করে, আমাকে থেকে দূরে থাকুন। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মিস্টার হিল সামান্য চুক্তির জন্য আপনার মত মেয়েকে ভাড়া করবে)”

সায়ান জামিল খান, ময়মনসিংহের বিখ্যাত খান বংশের ছোট সাহেব সে। ঢাকায় বিশাল বিজনেস তাদের, এসকে ইন্ডাস্ট্রি যার ব্রাঞ্চ বিদেশেও রয়েছে। দেশে বিদেশে কম সুন্দরি মেয়ে দেখেনি, বিদেশে পড়াশোনা করাকালীন অনেক মেয়ে স্বেচ্ছায় তার বিছানার সঙ্গী হতে চেয়েছে তবে কারো দিকে বিশেষ নজর দেয়ার সময় পায়নি। নিজের মুসলিম হওয়ার পরিচয় ভুলে যাইনি কিন্তু সেই রাতে…
সেই রাতের কথা মনে হতেই গাড়ির স্টেয়ারিংয়ে জোড়ে ধাক্কা মেরে উঠলো, ডেম ওই মেয়ে…

৩.

যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ড স্ট্যাট বলা হয় ক্যালিফোর্নিয়াকে, সেই রাজ্যের বৃহত্তম শহর হচ্ছে সপ্নের শহর লস এঞ্জেলস যাকে অনেকে সিটি অব এঞ্জেলস হিসেবে চিনে। সেই শহর হলিউডের প্রাণভোমরা হিসেবেও পরিচিত। সেখানে নাইট ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে “এলিভেট লঞ্জ ”

রাত-১.৩০
লস এঞ্জেলসের এলিভেট লঞ্জ নাইট ক্লাবে বসে রেড ওয়াইন ড্রিংক করছে সায়ান। বিজনেস ডিল ক্যান্সেল হওয়ার পর থেকে এখানে এসে একের পর এক ড্রিংক করে যাচ্ছে সে।তার বন্ধু এরেন তাকে বাধা দিয়েও থামাতে পারছে না
” হে এসকে, হোয়াই আর ড্রিংকিং ঠু মাচ টুডে? ”
” বিকজ আই এম মিসিং হার ভেরি মাচ, হোয়াই জাস্ট শি লেফট মি, হোয়াই?”
” লুক ডুড, সো মেনি বিউটিফুল লেডিস আর এরাউন্ড ইউ এন্ড ইউ আর মিসিং দেট দেম গার্ল!”

লস এঞ্জেলসের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় “ইউভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া ” থেকে পড়াশুনা করেছে সে, সবাই তার নাম সায়ান জামিল খান উচ্চারণ করতে পারতো না তাই এসকে হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলো। কত মেয়ে তার দিওয়ানা ছিলো তখন,প্রতিদিন নিজের ডেস্কে লাভ লেটারের মেলা বসতো। দেখতে ফর্সা, হাইট ৬’১” আর কিলার স্মাইল অনেককে ঘায়েল করতো, আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে বাদামি চোখ দুটি। দেখলে কেউ বলবেই না সে বাংলাদেশি, কেমন একটা বিদেশী বিদেশী ভাব।
আর সে কিনা চার বছর ধরে একটা মেয়েকে পাগলের মতো খুজে বেড়াচ্ছে? খুজে বেড়াচ্ছে তার এক রাতের বউকে, সেদিন রাগের মাথায় মেয়েটির সাথে ওমন আচরণ করা উচিৎ হয়নি, সেদিন রাগের মাথা মেয়েটিকে নিজের করে নিলেও এখন বুঝতে পারছে যে ওই পরিস্থিতিতে সবাই এমন রিয়াক্টি করতো। তবে তার ও দোষ ছিলো না। ওইখানের মহিলাটি তাদের জানালা দিয়ে দেখছিল বলেই হুট করে জড়িয়ে ধরেছিল সে কিন্তু ওইটুকুন মেয়ে তাকে চড় মেরেছিল, কি সাহসী তার বউ। মুচকি হেসে গ্লাসে চুমুক দিলো সে।
সেদিন রাতে যখন মেয়েটি যখন ফুফিয়ে কাঁদছিলো তখন তারও বুকে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছিলো, বড্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে। রাগের মাথায় কত বড় ভুলটাই করেছিলো। সকালে মেয়েটির অজান্তেই নিজের কনিষ্ঠা আংগুলের আংটিটি খুলে অনামিকাতে পরিয়ে দিয়েছিল, কারণ দিদানকে বলতে শুনেছে যে প্রথমরাতে মেয়েরা স্বামী থেকে উপহার আশা করে। আচ্ছা তার বউ উঠে যখন আংটিটি দেখেছিলো তখন সে কি আশ্চর্য হয়েছিলো? খুশিতে তার চোখ থেকে দু ফোটা নোনাজল কি বেরিয়েছিল। খুব ইচ্ছে ছিলো তার ঘুমন্ত মুখটি দেখার কিন্তু তার আগেইতো চলে যেতে হলো।
ফোন বের করে কোথাও একটা ফোন করলো সায়ান,
“এনি নিউজ অফ হার?”
অপর পাশ থেকে কিছু একটা বললো তাতেই রেগে দাঁড়িয়ে ফোনটা আছাড় মারলো
“ইউজলেস সবকটা ইউজলেস ”

সায়ানের এইরকম হুটহাট রাগের সাথে বেশ পরিচিত এরেন, ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকে চিনে সায়ানকে কিন্তু কখনো কোন মেয়ের জন্য ডেস্পারেট হতে দেখে নি ওকে, তাও আবার তার জন্য যাকে সে দেখেইনি।
” লেটস গো এস”
” আই এম নট ড্রাংক এরেন, আই কেন গো বাই মাইসেল্ফ ”

কোর্টটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সায়ান, আজকাল রেড ওইয়ান এর নেশাও ধরে না তাকে কারণ সেতো ডুবে আছে তার শ্রেয়সীর নেশায় যা মদের নেশাকেও হার মানায়। সে ভালো করে দেখেনি মেয়েটিকে তবে তার ছোয়া পুরো অংগ জুড়ে ছড়িয়ে আছে, তার বিশ্বাস মেয়েটি তার সামনে আসলে ঠিক চিনতে পারবে তাকে কারণ আবছা আলোয় দেখা চেহারা এখনো ভুলেনি সে। গাড়ি থেকে নেমে সোজা ফ্লাটে ভিতর চলে গেলো, এই ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকার সুবাদে এখানে নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে তার, এই শহরটি তার সেকেন্ড হোম প্রায়শই বিজনেস এর সুবাদে এখানে আসা হয়। কোর্টটা সোফায় ফেলে বিছানায় গিয়ে জুতাসহ শুয়ে পড়লো, আজকে সে থাকলে কি এত রাতে ফিরার জন্য খুব করে বকতো? জানা নেই এই প্রশ্নের জবাব তাকে পেলে পাওয়া যাবে, পালিয়ে বেড়াবে কোথায়? পাখি যতই উড়ে বেড়াক দিনশেষে তাকে নিড়েই ফিরতে হয়, তার পাখিটাকেও যে ফিরতে হবে তার কাছে শুধু মাত্র তার কাছে।

🌸🌸🌸

ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন গভীর রাত হলেও কলকাতা শহরে এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো বলে। বাস জার্নিতে প্রচণ্ড ক্লান্ত শরীরটি যেন আর চলতে চায়না রুশির। তবুও যে চলতে হবে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে গলির শেষ মাথায় চাইল্ড কেয়ার যেখানে তার প্রাণভোমরা রয়েছে। রুহান তার একমাত্র ছেলে, গত মাসে তার তিন বছর শেষ হয়ে চারে পা দিলো, তবে চার বছরের বাচ্চার তুলনায় সে একটু বেশিই মেচিউরড। চোখে চশমা পরে আর এতটুকু বয়সে কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। না চোখে কোন সমস্যা নেই কিন্তু জনাবের স্পষ্ট কথা চশমা পড়তে ভালো লাগে তাই চশমা কিনে দিতে হবে। ব্যস তার কথা ফেলার সাধ্য কি আর আছে!
চাইল্ড কেয়ারে ঢুকতে ছোট দুটি হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুশিকে

“মাম্মা, রুহান মিসড ইউ সো মাচ”
” আই মিসড ইউ ঠু বেবি, আচ্ছা আজকে কি কি শিখলে?”
“অনেক কিছু, আচ্ছা মাম্মা জানো কালকে কুশান এর বাবা তাকে নিতে আসছে তাহলে আমার বাবাই আমাকে নিতে আসে না কেন? তুমি সবসময় আসো কেন? আর বাবাই বাসায় ও কেন আসেনা? ”

এই প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই, কি করে তার বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি। ছোট্ট শিশুটার মনে বাবার প্রতি ঘৃণা জন্মাক সেটা সে চায়না। বড় হলে এমনিই বুঝতে পারবে সব।
*মাকে চুপ থাককে দেখে রুহান বুঝতে পারলো যে তার মা তার প্রশ্নে কষ্ট পেয়েছে তাই সে আর কোন দিন এই প্রশ্ন করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করলো

“মাম্মা, রুহান আইস্ক্রিম খেতে চায়”
” ওকে বেবি, চলো মাম্মা আইস্ক্রিম কিনে দিবে”
“মাম্মাকে বাবাই সম্পর্কে বলা যাবে না আর, বাবাই খুব পচা রুহানকে একটুও মিস করে না, রুহান হেটস বাবাই(মনে মনে)”

আইস্ক্রিম এর দোকানের পাশের দোকানের রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আছে রুহান।প্রতিদিন এই গাড়িটির দিকে তাকায় সে আর কিনার প্রবল বাসনা জাগে তার কিন্তু সে মাম্মাকে বলবে না কারণ মাম্মার কাছে ওতো টাকা নেই আর সে না কিনে দিতে পারলে কষ্ট পাবে। কিন্তু তবুও গাড়িটা কিনার লোভ সামলাতে পারেনা সে। একদিন সে টাকা জমিয়ে গাড়িটি কিনবে বলে প্রতিদিনের মতো আজোও নিজেকে আশ্বাস দিল।

দুই অচেনা শহরে দুইজন মানুষ, কেউ কাউকে খুজে বেড়াচ্ছে আর কেউ বা মনের অজান্তেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার থেকে। কি হবে এই লুকোচুরি খেলার শেষ?

৪.

মোবাইলের আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেলো রুশির, এত সকালে কে আবার ফোন তা ভেবেই বিরক্ত লাগছে ওর।উফফফ মোবাইল না থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। ফোন হাতে নিয়ে বুঝতে পারলো বাংলাদেশি নম্বর, কে ফোন দিয়েছে ওকে তাও এত সকালে? তিশান নয়তো কিন্তু ও নাম্বার কোথায় পেলো! হয়তো দাদিমা থেকে নিয়েছে,যা ভেবেছে তাই ফোন ধরতেই বুঝতে পারলো তিশান ফোন করেছে।

তিশান হচ্ছে ওর সৎ মা মানে ছোট মার ছেলে, তানহা আর তিশান হচ্ছে টুইন। তানহা ওকে দেখতে না পারলেও তিশান সম্পূর্ণ তার বিপরীত, রুশির আদরের ভাই। ছোটবেলায় চকলেটটা ও ভাগ করে খেতে ওর সাথে। ক্লাস এইটে যখন পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিল তখন তিশানই তার বন্ধুদের রুশির কাছে পড়তে বলেছিল,

” তিশান কেমন আছিস ভাই? এতদিন পর মনে পড়লো আমার কথা ”

” ভালো না আপি,দাদিমা খুব অসুস্থ, ডাক্তার বলেছে কয়দিন বাচে ঠিক নেই, দাদিমা বারবার তোমার নাম নিচ্ছে। তুমি কি বাংলাদেশে আসতে পারবে? শেষ দেখাই দেখে যাওনা ”

“আমি এখন কি করে…দাদিমা কি অনেক অসুস্থ? কিন্তু আমি আমার কাছে ফ্লাইট বুক করার মতো টাকা নেই, আমি আসবো কি করে?”

“তুমি একটু ট্রাই করোনা আপি, কয়েকদিন থেকে নাহয় চলে যেও”

“আচ্ছা আমি দেখছি, দাদিমার দিকে খেয়াল রাখিস ”

ফোনটা রেখেই কান্নায় ভেংগে পড়লো রুশি, মা মারা যাওয়ার পর থেকে দাদির হাতেই বড় হয়েছে ও। ছোট মা মারলেও দাদিই বাধা দিতো, হাতখরচ দাদিই দিতো প্রায় সময় এমনকি এসএসসি এক্সামের ফর্ম ফিলাপের টাকা দাদিমাই দিয়েছিলো। সবচেয়ে বড় কথা আজ ও বেচে আছে দাদিমা এর জন্যই নাহয় এই অচেনা শহরে ও কি নিজের আবাস গড়ে তুলতো!

ওইদিন সকালে যখন ছেলেটি ওকে ফেলে চলে গিয়েছিলো তখন ও সেখান থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং বাসায় ফিরে। আসতেই ছোট মা যা নয় তাই শোনায় কিন্তু মারতে নিলে তিশান আর দাদি মিলে বাধা দেয়। ওইদিনের মত সব ঠিক হয়ে গেলেও বাধ সাধে একমাস পর যখন ও রান্নাঘরে হঠাত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো আর পরে ছোট মা জানতে পারে ও মা হতে চলেছে, আমাকে বাজে মেয়ে বলে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো, আমি থাকালে নাকি তানহার বিয়ে হবে না। বাবা একটা কথাও বলে নি শুধু তাকিয়ে ছিলো শিথিল চোখে।
আমি চেয়েও কিছু বলতে পারিনি, কি বলবো? আমার বিয়ে হয়েছে কিন্তু আমার একরাতের স্বামী আমায় ফেলে চলে গেছে! আমার এই মনগড়া কথায় কান দিবে কে? সারাদিন দরজার সামনে বসে ছিলাম, যাবো কোথায়, আমার যে যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

বিকালে দাদিমা লুকিয়ে আমাকে বাগানের কোনে নিয়ে হাতে একটি থলি ধরিয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে বললো এগুলো আমার মায়ের গয়না আর কিছু টাকা।তারপর গলির মাথায় নয়ে আসলেন। আসতেই দেখি তিশান একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাদিমা বললেন আমার মামার সাথে কথা হয়েছে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেদিন দাদিমা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলাম আর বলেছি দাদিমা আমি ভুল কিছু করিনি, সত্যি বলছি।
তারপর তিশানের সাথে নানুবাড়ি চলে আসি। বড় মামা পাসপোর্ট তৈরি করে কলকাতায় ছোট মামার কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে প্রায় একমাস ছিলাম। যখন ছোট মামি প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পারে তখন আমাকে নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচুর ঝগড়া হয় তারপর ওইখানে একটা হোস্টেলে উঠি।
সেই হোস্টেলেই সুজির সাথে দেখা ওই আমাকে রেডিও তে আরজে হতে সাহায্য করেছে আর এখন আমি দ্যা পপুলার আরজে আনাম। এখানে কেউ আমাকে রুশি হিসেবে চিনেনা, শহরের সাথে সাথে নামটাও হারিয়ে গিয়েছে। এখানে বর্তমানে একটা ফ্লাটে আমি আর সুজি মিলে তাকি।
কিন্তু দাদিমা এত অসুস্থ, আমাকে তো যেতেই হবে। যে মানুষটা আমার জন্য এতকিছু করেছে। সে না হলে হয়তো আমি বেচে থাকতাম না আর আমার ছোট্ট সোনাটা হয়তো পৃথিবীর মুখ দেখতো না।

🌸🌸🌸

সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রেডিও স্টেশন থেকে ১সপ্তাহের ছুটি নিলো। সুজির সাহায্যে জরুরি ভিত্তিতে ভিসা তৈরি করে নিয়েছে। রুহানতো সেই সকাল থেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে যদি আমি আমাদের নিজের দেশে যাচ্ছি তাহলে এই দেশ কার? আর যদি আমাদের নিজের দেশ অন্যটা তাহলে আমরা এখানে কেন থাকি, নিজের দেশে কেন থাকিনা?
ওকে যতপ্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি তত নতুন প্রশ্ন জুড়ে দিচ্ছে। কে বলেছিল এত ছোট বয়সে এইরকম ম্যাচিউরড হতে? কই আমিতো এমন ছিলাম না! নির্ঘাত বাবার মতো হয়েছে গম্ভীর আর ওভার ম্যাচিউরড। আচ্ছা ওই লোকটি কেমন দেখতে? রুহানতো দেখতে পুরো ইংরেজ বাচ্চাদের মতো, হেয়ার কালারও বাদামি আবার সুজির সাথে থেকে থেকে ইংরেজিও শিখে গেছে। ওকে দেখলে মনেই হয়না ও আমার ছেলে।

প্লেনে বসে ভাবছি আজ প্রায় চারবছর পর দেশের মাটিতে পা রাখবো, আসলে যে যেখানেই থাকুক না কেন নিজের দেশে যেমন বুক ফুলিয়ে হাটা পরদেশে তো ভিন্দেশী হয়েই থাকতে হয়, আসলে কবি ঠিকি বলেছিলেন

“এমন দেশটি কোথাও খুজে
পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণি সে
যে আমার জন্মভূমি ”

আমি বাঙালি এই শব্দটিতেই যেন পরম সুখ খুজে পাওয়া যায়। আমি গর্বিত কারণ আমি বাঙালি…

***এয়ারপোর্টে নামার সময় রুহানকে জাগিয়ে তুললাম, সারা সময় ও ঘুমিয়েই এসেছে। ওকে কোলে নিয়ে হাটতে হচ্ছে আবার একহাতে ট্রলি। যদি রুহানের বাবা থাকতো তাহলে হয়তো এই কষ্ট হতো না। উফফ কেন যে বারবার ওই লোকটির কথা মাথায় আসে? যে আমাদের ছেড়ে সুখে আছে তাকে ভেবে কি লাভ? সে তো হয়তো বউ বাচ্চা নিয়ে সুখেই আছে।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে টেক্সি নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি তখনি দেখলাম সবাই হঠাত ছুটাছুটি করছে। কি হলো বুঝলাম না কিন্তু মনে হচ্ছে গোলাগুলি হচ্ছে। আমার আত্মা কেপে উঠলো, আমার সাথে রুহান আছে যদি ওর কিছু হয়ে যায়? না আমাকেও পালাতে হবে। যেই ছুটবো তখন বুঝলাম ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, একটা লোক গান হাতে আমাদের দিকেই ছুটে আসছে, সময়টা যেন থমকে গিয়েছে, প্রতিটা সেকেন্ড ঘন্টার মতো মনে হচ্ছে, অনেক চেষ্টা করে পা দুটোকে নাড়াতে পারলাম না। এই পরিস্থিতি খুব পরিচিত, মনে হচ্ছে চার বছর আগের সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। চারবছর আগের মতো সে কি আসবে আমাকে বাঁচাতে? না চাইতেও সেই বলিষ্ঠ হাতের মালিককে খুজছি আমি,

তখনি কেউ হাত টেনে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো, রুহান খুব জোরে চিৎকার করে উঠলো আর আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপছি।একজোড়া হাত খুব শক্ত করে আমাদের জড়িয়ে ধরলো, জানিনা সে কে তবে এই মুহুর্তে এই স্থানটি সবচেয়ে নিরাপদ মনে হচ্ছে, একদমি ভয় করছেনা আমার, একদমি না…

৫.

হসপিটালের বেডের পাশে বসে আছে রুশি তার পাশেই রুহান বেডে ঘুমাচ্ছে, হাতে স্যালাইন লাগানো একটু পুর্বেই ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে গেছে। অনেকদিন ভালো করে খাওয়া দাওয়া হয়নি তাই এই অবস্থা। রেডিও তে কাজ করার সুবাদে বিকাল পর্যন্ত স্টেশনেই থাকতে হতো, তারপর সুজি আর ও একসাথে ফিরতো।এরপর বাসায় এসে রান্না করে রুহানকে চাইল্ড কেয়ার থেকে আনতে যেত। সারাদিন বেচারা কি খেত না খেত কে জানে? নিজের সন্তানের মা যেরুপে খেয়াল রাখে অন্য কেউ সেরুপে রাখতে পারেনা, আর রুহানটাও বড্ড জেদি ওর হাত ছাড়া অন্য কারো হাতে খুব একটা খেতে চায় না। তাই খুব দুর্বল হওয়ার কারণে এখনো ঘুমাচ্ছে। রুশি রুহানের হাত ছেড়ে উঠে দাড়ালো তারপর কেবিন থেকে বের হলো। বর্তমানে স্কয়ার হসপিটালের ভিআইপি কেবিন বুক করেছে সে না ঠিক সে বুক করে নি যে বাচিয়েছে সে বুক করেছে। ছেলের টেনশনে এতক্ষণ এটা মাথায় না আসলেও এখন ওর অস্থির লাগছে, এই হসপিটালের নরমাল কেবিনেটই হয়তো ও এফোর্ড করতে পারবে আর তো ভি আইপি কেবিন। ওইসময় লোকটিকে তাড়াহুড়ায় কিছু বলতেও পারেনি।
হসপিটালের রিসেপশনের দিকে এগুচ্ছিলো তখন পেছন থেকে বলে উঠলো

” রিসেপশনে দিকে কেন যাচ্ছেন আপনি? কিছু লাগলে বলুন আমায়”

” নাহ, কিছু লাগবে না আমি আসলে…বিল কত হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিলাম ”
কিছুটা সংকোচ নিয়েই কথাটা বললো রুশি

“সেকি এখন বিল জেনে কি করবেন? ডক্টর তো বললো আরো একদিন থাকতে হবে, আপনার ছেলেতো পুরোপুরি সুস্থ নয় ”

” জি, সেটা আমি জানি কিন্তু আমার একজাগায় যেতে হবে খুব জরুরি তাই ভাবছি রুহান ঘুম থেকে উঠলেই ডিসচার্জ করিয়ে চলে যাবো ”
রুশি বিনা সংকোচে কথাটা বললো কারণ ওর কাছে এতটাকা নেই তারউপর আরেকদিন থাকা মানে বিল দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া।

” দেখুন আপনার সন্তানের ভালো যদি আপনি না বুঝেন তাহলে আর কে বুঝবে? বাই এনি চান্স আপনি কি বিল নিয়ে টেনশন করছেন? ”

” না…ঠিক তা না আসলে… ” রুশি প্রশ্নটি শুনে একটু ইতস্তত বোধ করলো,

“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আপনি হসপিটাল থেকে বের হওয়ার আগে বিল পে হয়ে যাবে”

“আপনি আমার এত সাহায্য করলেন আর আমি আপনার দয়া আর নিতে পারবো না, বিল আমি নিজে পে করে দিতে পারবো ইনশাহ আল্লাহ ”

” এটা আমার দায়িত্ব ছিলো কোন দয়া নয়, বাই দ্যা ওয়ে বারবার আপনি বলে সম্মধোন করতে আমার কেমন জানি লাগে, তুমি বলতে আপনাকে? ”

” সে নাহয় বলবেন কিন্তু আপনার নামটাই তো জানা হলো না ”

” ওহ আমার নাম সাহিল রেজওয়ান, ইউ ক্যান কল মি সাহিল”

” জি সাহিল, আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন আজ আপনি না হলে তো আমরা বেচেই ফিরতাম না ”

” কিন্তু আমিতো তোমাকে শুধু হসপিটালেই পৌঁছে দিয়েছি সেফলি তাহলে… ”

” মানে! যদি আপনি আমাদের বাচান নাই? তাহলে ওইযে কালো হুডি পরা লোকটি… ওয়েট আপনি তো ফরমাল ড্রেসে তাইলে ওই লোকটি কে ছিলো?” অস্থিরতায় একটু জোরেই বলে ফেললো

” রিলাক্স, প্যানিক করোনা আমার বস তোমাকে বাচিয়েছে, আমাকে বলেছে যেহেতু তোমার ছেলে অজ্ঞান হয়ে গেছে তাই হসপিটালে নিয়ে যেতে”

” ওই লোকটি আপনার বস ছিলো?যে আমাকে গান পয়েন্ট থেকে বাঁচিয়েছিল? “জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুশি,তার চাহনি দেখে হ্যা বোধক ইশারা করলো সাহিল। রুশি চিন্তায় পড়ে গেলো

চার বছর আগের সেদিনের মত আজোও একটি লোক ওকে বাচিয়েছে, সে হাত সেই ছোঁয়া খুব কাছের মনে হয়েছিলো লোকটিকে ওর। এয়ারপোর্টের বাইরে যখন লোকটি ওকে টেনে সরিয়ে নিয়েছিল তখন রুহান চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো ভয়ে তাই কালো হুডি পরা লোকটি ওকে টেনে কোলে নিয়ে নিয়েছিল আর ওর হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করেছিলো তারপর সামনের গাড়ির গেট খুলে রুহানকে ভেতরে রেখে ওকে ভেতরে বসিয়ে দিয়েছিলো, রুশি রুহানকে নিয়ে অনেক প্যানিক ছিলো তাই সামনের সিটে কে বসেছে খেয়ালি করেনি। কে ওই লোকটি যাকে এত পরিচিত মনে হচ্ছিলো!! তবে কি সে রুহানের বাব? যদি সে হয় তাহলে তার চেহারাও আমি দেখতে চাই না, ঘৃণা করি আমি ওই লোকটিকে যার জন্য আমার পুরো জীবন নষ্ট হয়ে গেছে, যেখানে বড় হয়ে কিছু একটা হওয়ার সপ্ন দেখতাম, এত কষ্ট করে পড়াশুনার খরচ চালিয়েছি সেখানে লোকটির কারণে আমি আর পড়াশুনা করতে পারিনি, ঘর ছাড়া হয়েছি আমি নিজ দেশ ছেড়ে এত দূরে ছিলাম এতদিন আমার তারুণ্য শেষ হয়ে গেছে, আমি বিবাহিত হয়েও কাউকে বলতে পারিনি আমি বিবাহিত ।আমি চাইনা ওই লোকটি কখনো আমার সামনে আসুক কখনো না!

🌸🌸🌸

হাতে গান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সায়ান, তার সামনেই চেয়ারে বাধা একটি লোক যাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে এতক্ষণ বেদরম পেটানো হয়েছে

” শেষ বারের মত বলছি বল তোকে কে পাঠিয়েছে? তোদের ওই গোলাগুলির উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে মারা তাইনা?তাহলে আমার সাথে লড়াই করতি নিরিহ মানুষ গুলোকে কেন মারছিস? বল কেন? ”

” আমাকে মেরে ফেললেও আমি বলবো না, কারণ তুই আমার শত্রু, আমি তোর হার দেখতে চাই ”

” মরার যখন এতই শখ তাহলে মর”
বলেই গুলিতে ঝাঁজরা করে ফেললো লোকটির বুক,কপালে আংগুল ঘষছে রাগে তখনি ফোন বেজে উঠলো, সবাই কার ফোন বাজছে তা খুঁজতে লাগলো কারণ তাদের বস অনেক রেগে আছে নেক্সট টার্গেট কে হয় কে জানে! সবাই খুঁজে যখন বুঝতে পারলো তাদের না তখন একজন গিয়ে মৃত ব্যাক্তির বডি খোজা শুরু করলো এবং একটা মোবাইল পেয়েও গেলো। কলটি ধরে লাউডস্পিকারে রাখতেই একটা পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনা গেলো

” অলরেডি মেরে ফেলেছিস? তুই কি ভাবছিস আমার লোককে তোকে ধরা খেতে কেন দিয়েছি? যাতে তোকে এই মেসেজ দিতে পারি যে আমিই তোকে মারতে পাঠিয়েছি ”
” কে তুই, আমার পেছনে কেন লেগেছিস? তুই জানিস আমি কে?কুকুরের মত পেছন থেকে ঘেউঘেউ করেছিস কেন ? সাহস থাকলে সামনে আয় ”
” ইশশ এতো বছরেও তোর স্বভাব বদদালো না, সময় হলেই সামনে আসবো তখন দেখবি কে কুকুর আর কে বাঘ, ওহ তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি যাকে চারবছর ধরব খুজছিস পেয়েছিস তাকে? আমি কিন্তু পেয়ে গেছি,সেই দেখতে আমার তো নেশা ধরে গেছে”
” মুখ সামলে কথা বল, কোথায় দেখেছিস ওকে? হ্যালো, হ্যালো… ডেম ইট ফোন কেটে দিসে আবার প্রাইভেট নাম্বার দিয়ে ফোন করেছে যাতে ট্রেস করতে না পারে ”

সায়ান ভাবছে কে এই শত্রু কথা শুনে মনে হচ্ছে খুব ভালো করে চিনে।নাহ তাড়াতাড়ি খুজে বের করতে হবে ওকে আর বউ…নাহ তাড়াতাড়ি খুজে বের করতে হবে ওকে যদি কোন ক্ষতি করে?

হসপিটালের কেবিনে রুশি আর রুহান ঘুমিয়ে আছে আর তাদের খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে কেউ, ঠোটের কোনে তার হাসি ঝুলছে রহস্যময় হাসি। আচমকা রুশির ঘুম ভেংগে গেলো, ওর মনে হচ্ছিলো ওকে কেউ দেখছে কিন্তু চোখ খুলে কাউকে দেখতে পেলো না। আশপাশটা ভালো করে দেখে রুহানকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলো, নাহ কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবে ও।

to bcontinued…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here