#ভালোবাসা রং বদলায়
লেখক — #মাহমুদ
পর্ব — ৬
,
বেশ কিছুক্ষণ ধরে কলিং বেল বেজেই চলেছে। কিন্তু দরজা খুলে দেবার মত কোন মানুষই নেই এই বাড়িতে। আচ্ছা, বাড়িতে এত মানুষ থাকতে তাকেই কেন এসব করতে হবে? সবাই আজ কোথায় গেল? সবাই কী আজ মরে টরে গেল নাকি?
এতক্ষণ ধরে জাহানারা বেগম কথাগুলো মনে মনে ভাবছিলেন। তিনি যে একটু দুদন্ড আরাম করবেন তারও কোনো উপায় নেই। সবকিছুই যেন তাকেই করতে হবে। আর ভালো লাগে না।
– ‘কী হলো? কলিং বেল বাজছে শুনতে পাচ্ছো না?’
– ‘হ্যা হ্যা। সবকিছুই তো আমাকেই শুনতে হয়। বলি, তুমি কী একটু দরজা খুলে দিতে পারো না? আমাকেই কেন খুলতে হয়?’
– ‘কথা বাড়িয়েও না তো। আমার মেয়ে এসেছে বোধয়। তোমার সাথে এখন আমার ঝগড়া করার মত রুচি নেই। যাই! আমিই দরজা খুলে দিচ্ছি।'(লেখক মাহমুদ)
বলেই তিনি দরজার দিকে এগুলেন। জাহানারা বেগম দাতে দাত চেপে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন,
– ‘হুহ, আমার মেয়ে আইছে। ঢং…. যত্তসব ন্যাকামো কথাবার্তা!’
কথাগুলো বলে তিনিও এগুলেন দরজার দিকে। ততক্ষণে মহসিন সাহেব দরজা খুলে দেখতে পেলেন রূপা এবং ফারজানা বেগমকে। মহসিন সাহেব হাসিমুখে ফারজানা বেগম কে সালাম দিলেন। এরপর দেখলেন রূপা কাঁদছে। মেয়েটাকে কাঁদতে দেখতেই তিনি ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– ‘মা কাঁদে না। আমি আছি তো।’
রূপা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
– ‘এই একমাস হলো আপনাকে দেখিনি বাবা। এই একটা মাস কতটা কষ্টে কাটিয়েছি তা শুধু আমিই জানি। জানেন বাবা? মাঝে মাঝে মনে হত ছুটে চলে আসি আপনার কাছে।’
বাবা একরাশ হেসে বললেন,
– ‘পাগলী মেয়ে একটা।’
বলেই তিনি ওর কপালে চুমু একে দিলেন। এরপর ফারজানা বেগমের উদ্দেশ্য বললেন,
– ‘এমা! বাইরে দাড়িয়ে আছেন কেন? আসেন আসেন আপা। ভিতরে আসেন। এই যুথির মা, দাঁড়িয়ে আছো কেন? ওদেরকে চা নাস্তা দাও।’
– ‘হুম।’
ওরা ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো। জাহানারা বেগম ওদের জন্য নাস্তা এনে টেবিলে রেখে দিলেন। তখনি রূপার চোখ পড়লো তার দিকে। রূপা বললো,
– ‘মা কেমন আছেন?’
জাহানারা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
– ‘এতদিন তো ভালোই ছিলাম। কিন্তু আজ….’
মহসিন সাহেব জাহানারা বেগমের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
– ‘আহ! ওদেরকে তো পানিই দাওনি। যাও যাও তাড়াতাড়ি পানি আনো।’
জাহানার বেগম খানিকটা ক্ষোপ দেখিয়ে বললেন,
– ‘হ্যা যাচ্ছি।’
জাহানারা বেগম চলে যেতেই মহসিন সাহেব বললেন,
– ‘আপনাদের আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’
– ‘না না। আল্লাহ রহমতে কোনো সমস্যা হয়নি।’
– ‘ও।’
– ‘বাবা, নিপা কোথায়? ওকে তো দেখছি না।’
– ‘ও তো একটু বাইরে গেছে। এক্ষুনি চলে আসবে।’
– ‘বাইরে কী করতে গেছে?'(লেখক মাহমুদ)
– ‘ওই, তোর মা কী যেন কিনতে পাঠিয়েছে।’
– ‘মা এখন ওকে পাঠাই? আগে তো আমাকে পাঠাতো। আর এখন ওকে…..’
– ‘বাহ বাহ! আসতে না আসতেই বাপের সাথে আমার নামে চুগলি করা শেষ?’
জাহানারা বেগমের কথাটি শুনে চোখ বড় বড় করে ফেললেন মহসিন সাহেব। জাহানারা বেগম ভয়ে পেয়ে বললেন,
– ‘আরে না না। আমি তো রশিকতা করতেছিলাম। বলতেছিলাম কী রূপা ওর বাপরে পাইলেই আমারে ভুইলা যাই।’
– ‘হুম ঠিক বলেছো। আমার মেয়ে আবার মায়ের থেকে বাপের ভক্ত।’
– ‘মোটেই তা না। আমি দুজনকেই সমান সমান ভালোবাসি।’
– ‘সেসব কথা যাজ্ঞে। তা তোরা এ সময় কী মনে কইরা আইলি? না মানে কোনো দরকারে আইছিস নাকি?’
– ‘হ্যা আসলে….’
ফারজানা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– ‘আমি বলছি। আসলে ভাই আপনার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো।’
– ‘জি বলেন।’
– ‘আসলে কথাটা একান্ত ভাবে আপনার সাথেই বলার ছিলো। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে….’
– ‘আরে আপা অবশ্যই বলতে পারেন। এই যুথির মা একটু ওই ঘরে যাও তো।’
– ‘কেন কেন? আমি থাকলে কী এমন ক্ষতি হইবো?’
– ‘এত কথা বলো কেন? যেতে বলেছি যাও।’
-‘হু….’
জাহানারা বেগম প্রলাপ বকতে বকতে ড্রইংরুম ছেড়ে চলে গেলেন। মহসিন সাহেব তৎখানিক বললেন,
– ‘আপা এবার বলুন।’
– ‘আসলে কথাটা বললে আপনি ব্যাপারটা কে কীভাবে নিবেন বুঝতে পারছি না। যদিওবা কথাটা বলা অতি জরুরী।’
– ‘হ্যা বলেন। আমার তরফ থেকে কোনো সমস্যা নেই।’
– ‘আসলে আমি আর রূপা মিলে ভেবে রেখেছি যে আজ থেকে নিপাও আমাদের সাথেই থাকবে।’
– ‘মানে ঠিক বুঝলাম না।’
রূপা বললো,
– ‘আমি বুঝিয়ে বলছি। বাবা, আপনি তো জানেনই নিপা এই বাড়িতে ভালো নেই। আমি তো এ বাড়িতে থেকেছি। সবকিছুই জানি। মা প্রতিনিয়ত কারণেঅকারণে ওকে আর আমাকে মারতেন। কখনো খুন্তির ছ্যাকা দিতেন তো কখনো ঝাড়ু দিয়ে মারতেন। বাবা আপনিই তো সব টা জানেনই? তাহলে কেন জেনেশুনে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন? আমি চাই আজ থেকে ও আমার সাথেই আমাদের বাড়িতে থাকবে। আপনি প্লিজ না করবেন না।’
– ‘কিন্তু জামাইয়ের বাড়িতে থাকলে কেমন একটা খারাপ দেখায় না?’
ফারজানা বেগম বললেন,
– ‘কোনো খারাপ দেখায় না। আমি নিজেই রূপাকে এই কথা বলেছি। আমাদের বাড়ি থেকে এক্কেবারে সবাই রাজী। শুধু বলেন আপনি ওই নিষ্পাপ মেয়েটার মা হবার সুযোগ আমাকে দিবেন?’
– ‘আসলে আমি কথা দিতে পারছি না। আগে ওর মায়ের কাছ থেকে শুনতে হবে। আর তাছাড়া নিপার মতামত নিতে হবে।’
– ‘সে আপনি যা ভালো বোঝেন তাই হবে। কিন্তু এতে আপনি রাজী তো?’
– ‘আমি তো রাজী আছিই। কিন্তু ওদেরও তো একটা মতামত আছেই।’
রূপা বললো,
– ‘বাবা, আপনার মতামত মানেই সবার মতামত। আর তাছাড়া নিপা এটা জানলে বরং খুশি হবে। ও সবসময় আমাকে বলতো,
– ‘আপু তুই খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নে না রে।’
আমি বলেছিলাম,(লেখক মাহমুদ)
– ‘কেন? আমি বিয়ে করলে কী হবে?’
– ‘আরে পাগল তুই বিয়ে করলেই তো আমরা এই জেলখানা থেকে মুক্তি পাবো।’
– ‘কীভাবে?’
– ‘আরে গাধী। তুই বিয়ে করলেই তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। তোর সাথে করে আমাকেও নিয়ে যাবি। তারপর আর মা তোকে আর আমাকে মারতে পারবে না। আমরা তখন মুক্ত হয়ে যাবো আপু। মুক্ত পাখিদের মতো আমরা ডানা মেলে উড়ে বেড়াবো। আহ! তখন কতই না মজা হবে। অত্যন্ত আমরা এই ডাইনীর হাত থেকে বাঁচতে তো পারবো। এইটুকুই যথেষ্ট।’
‘ওর বলা কথাগুলো আমার এখনও কানে বাজে। আমি যে আজ ওর কথা রাখতে পারছি এতে যে আমার কী শান্তি লাগছে বাবা! সেদিন সত্যিই বলেছিল নিপা। আমরা ডানা পাখির মত উড়তে পারবো। আমিও পারছি। তাহলে ও পারবে না কেন?’
বাবা বললো,
– ‘তুই ঠিক বলেছিস রে মা। নিপা আর আগের মত নেই রে। একদম মনমরা হয়ে গেছে তোর বিয়ের পর থেকে! আমাকে শুধু বলে তোর কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমি তোর মায়ের জন্য নিয়ে যেতে পারিনা। এতে করে মেয়েটা খুব কষ্টও পায়। সেদিন ও তোর সাথে দেখা করতেও যাচ্ছিলো। কিন্তু তোর মায়ের জন্য যেতে পারিনি। আমি সেদিন বাড়ি এসে দেখি তোদের মা ওর হাতে খুন্তির ছ্যাকা দিয়েছে। মেয়েটা খুব কেঁদেছিল। না পেরে সেদিন ওই মহিলাটাকে মেরেছিলাম।’
বাবার মুখে খুন্তির ছ্যাকার কথা শুনতেই সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল রূপার। ইশশ! কী নির্মম ভাবেই না ধ্রুব তার হাত গরম তেলে চুবিয়ে দিয়েছিলো। সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও কষ্ট হয় রূপার। আর সেখানে তার ছোট্ট বোনটিকে খুন্তির ছ্যাকা দিয়েছে তাদের মা। আসলে মা বললে ভুল হবে। কোনো মা কী তার সন্তানের সাথে এমনটা করতে পারেন? হ্যা পারে। সৎ মায়েরা সবকিছুই পারে।
– ‘তোদের ভালোর দিকটা ভেবেই এই বিয়েটা করেছিলাম। কিন্তু তোদের ভালো দেখতে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্তটাই নিয়ে ফেললাম আমি। বিয়েটা করে কতবড় ভুল করেছি আপা তা বলে বুঝাতে পারবো না আপনাকে! কথায় আছে না পর কখনও আপন হয় না। সেটাই হয়েছে আমার দুটো মেয়ের সাথে!’
– ‘বাবা পুরোনো কথা বাদ দিন তো। যত তাড়াতাড়ি পুরোনো কথা ভুলে যাবেন ততই সবার জন্য ভালো।’
– ‘হুম।’
তৎখানিক নিপা চলে এল। রূপাকে দেখতে পেয়ে সে দৌড়ে এসে বললো,
– ‘আপুনি কখন এসেছিস?’
– ‘এই তো একটু আগে আসলাম। কেমন আছিস রে বোনটি?’
– ‘খুব খুব ভালো। আর আজ তুই আসাতে আরো দ্বিগুণ ভালো আছি। আর আন্টি সরি সরি… আপনাকে তো সালামই দেয়া হয়নি আন্টি। আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আন্টি?’
– ‘আলাইকুম আসসালাম মা। এই তো মা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
– ‘জি আন্টি আমিও ভালো আছি।’
– ‘কীসে পড়ো এখন?’
– ‘আন্টি এবার এসএসসি পরিক্ষা দেবো।’
– ‘ও। সামনে তো তাহলে বিশাল বড় আকারের পাহাড় আছে। সেটা টপকিয়েই উপরে উঠতে হবে।’
– ‘জি আন্টি দোয়া করবেন।’
– ‘অবশ্যই করবো। মায়ের দোয়া সন্তানদের সাথে সারাজীবন থাকে।’
– ‘জি।’
রূপা বললো,
– ‘নিপা তোকে আমরা নিয়ে যেতে এসেছি! যাবি না আমাদের সাথে?’
– ‘মানে! কোথায় যাবো আমি?’
– ‘কেন? আমার সাথে আমাদের বাড়িতে থাকবি। তুই’ই তো একদিন বলেছিলি আমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার থাকবি। তাই আজ থেকে তুই আমার সাথেই থাকবি।’
– ‘সত্যিই আপু? তুই আমাকে নিয়ে যাবি তোর সাথে?’
– ‘হুম।’
– ‘থ্যাংকইউ আপুনি। তুই খুবউউউ মিষ্টি! যাই! আমি তাহলে সবকিছু গুজগাজ করে আসি।’
মহসিন সাহেব ধীর গলায় বললেন,
– ‘তোর মা যেন বুঝতে না পারে, তুই রূপাদের সাথে সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছিস। বলবি আমি কিছু দিনের জন্য ঘুরতে যাচ্ছি। আর যদি কিছু বলে! তাহলে বলবি বাবা যেতে বলেছে। তারপর সবকিছু আমি সামলে নেবো। বুঝেছিস?’
বেশকিছুক্ষণ হয়েছে ধ্রুব বাসায় এসেছে। আজ কেন যেন অফিসে মনোযোগ দিতে পারছিল না সে। তাই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। কিন্তু বাসায় এসেও তার অস্থিরতা কমলো না। তার মন বলছে কিছু একটা যেন তার আশেপাশে নেই। কিন্তু কী নেই? সবই তো আগের মত আছে। তাহলে মনটা আজ এতটা অস্থিরতা হয়ে পড়েছে কেন? কোনো মতে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে পারছে না সে। কেন এমনটা হচ্ছে তার সাথে? তাহলে কী এর মূল কারণ রূপা? এটা কিভাবে সম্ভব? সে হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলেছে বোধয়। ধ্রুবের মনে তো রূপার জন্য কোনো ফিলিংস ছিলো না। তাহলে আজ কেন রূপা বাসায় না থাকাতে সে এতটা বিচলিত হয়ে পড়ছে? আগে তো এমনটা কখনো হয়নি। তাহলে আজ কেন? সে কী সত্যিই রূপার প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে?
চলবে,,,,,,,,,,,
লেখকের অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ