#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ৩
সামনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া লাগে আয়াশের। আশেপাশে তাকায় সে। গাছের পাতা মৃদু নড়ছে। মনের মাঝে দম বন্ধকর অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে তার। কোনো চেনা অনুভূতি হৃদয়ে কড়া নাড়িয়ে চলেছে। থামা পা আবার চলতে শুরু করে। গাড়ির সামনে থাকা ড্রাইভারের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে…..
–“কামাল দা, তুমি এখানে? তোমার না আংকেলের নতুন কাজে যারা ইনভেস্ট করবে তাদের নিয়ে আসার কথা ছিল?”
কামাল ঘুরে দাঁড়ান আয়াশের কথা শুনে। পান খাওয়া লাল দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে…..
–“ওই আসলে হইছে কি, গাড়িতে কি যেন সমস্যা হইছে।”
–“সেকি! তাহলে তো মেকানিক ডাকতে হবে। আমি ডেকে দেব?”
খানিকটা অস্থির শোনায় আয়াশের স্বর। কামাল এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বলেন…..
–“না লাগবে না স্যার। আমি পারব। হালকা সমস্যা।”
আয়াশ ঘড়ির দিকে তাকায়। ব্যস্ত সুরে বলে….
–“তবে আমি আসি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার কাজ আছে।”
কথাটা বলে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে। ফোনে মেসেজের টোন বাজে। আয়াশ সাদা শার্টের হাতা জড়িয়ে পকেটে হাত দেয়।
আয়াশের অভ্যেস যেই ম্যাসেজ না কলই আসুক না কেন সে তৎক্ষনাৎই চেক করে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। পকেটে হাত দিতেই ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি জেগে উঠল। ভ্রু যুগল কুঁচকে যায় তার। পকেটে একটা কাগজ ছিল আর সেখানে তো ওই কল্পনার রানির ছবি নিজ হাতে আঁকা ছিল। মূহুর্তেই আয়াশের অস্বস্তি শুরু হয়। একটা সামান্য স্কেচের কারণে কি কারণে অস্থির লাগছে জানা নেই তার। তবে সে জানে ওটা না পেলে ওর বুকের আগুন নিভবে না।
রাস্তায় আশেপাশে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে সে। কাগজটা পাওয়ার বৃথা খোঁজ যেন লাগিয়ে যাচ্ছে।
সামনে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটা দূরে একজনকে দেখে থেমে যায় ওর পা। মেয়েটার পরনে কালো শাড়ি। আঁচল উড়ছে। ঘাড় নিচ দিকে করা। চুলগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সে। কারণ মেয়েটা সামনে দিকে ঘুরে আছে। এই মূহুর্তে গলা শুকিয়ে আসছে আয়াশের। এক ফোঁটা পানি পেলে কি ভালো হত না?
স্কেচের প্রশ্নটা মেয়েটাকে করা যেতে পারে। এই কথা ভেবে থেমে থেমে পা ফেলে এগোয় সে। দূর থেকে মেয়েটার সুগন্ধি তার চোখজোড়া ক্রমশ শীতল করে তুলছে। মনে দৃঢ় প্রশ্ন ঘিরে ধরছে। কে এই মেয়ে?
মেয়েটার কাছ থেকে এক হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়ায় আয়াশ। গলায় তার শব্দ আটকে গেছে। জোর করে মুখ খুলে নির্বিকার কন্ঠে বলে ওঠে….
–“এক্সকিউজ মি!”
মৃদু কাঁপতে দেখা যায় মেয়েটাকে। মেয়েটা ঘুরেও দাঁড়ায় না। আয়াশেরও পা এগোয় না। আয়াশ আবারও বলে ওঠে….
–“আমার একটা জিনিস হারিয়ে গেছে। আপনি সেটা দেখেছেন?”
–“কি হারিয়ে গেছে আপনার?”
মেয়েটার চাপা সুর। আয়াশ এক পা এগোতে চাইলেও দমে যায়। মেয়েটার কন্ঠ আয়াশের শরীর হীম করে তোলে।
–“একটা স্কেচ। একটা মেয়ের স্কেচ।”
অস্বস্তি নিয়ে বলে আয়াশ।
–“আমাদের সবার জীবনেই হয়ত কিছু না কিছু হারিয়ে গেছে। আমরা সেটা খোঁজার জন্য ছুটে চলেছি।”
মেয়েটার রিনরিনে কন্ঠ। আয়াশ বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তখনই মেয়েটা ডান হাত দিয়ে এগিয়ে দেয় স্কেচটা। আয়াশের মনের মরুভূমিতে বৃষ্টি নামে। এই কল্পনার রানিকে পাওয়া দরকার ছিল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিতে নেয় আয়াশ। মেয়েটার হাতের সঙ্গে ছোঁয়া লাগে তার। বিদ্যুৎ চমকায় তার শরীরে। এই ছোঁয়া এতো চেনা ছিল কেন? সে কি এমনি ভাবছে এসব? নাকি আসলেই চেনা এই ছোঁয়া? আর্কষণের সঙ্গে তাকায় মেয়েটার দিকে আয়াশ আগ্রহ নিয়ে বলে….
–“আপনার কি হারিয়ে গেছে?”
–“আমার ভালোবাসা। যেই #ভালোবাসাটা_ঘৃণার ছিল একসময়। সেই ভালোবাসা থেকের যখন ঘৃণা নির্বিশেষ হয়ে গেল। তখনই হারিয়ে গেল সে।”
মেয়েটার কন্ঠ ভেজা। এমন কেন লাগছে আয়াশের? এবার কাঁপা কাঁপা পায়ে ধাপ ফেলতেই মেয়েটা দ্রুত গতিতে এদিকে ফিরে দৌড়ে চলে গেল অন্যদিকে। আয়াশ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকল। বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি ঘটল যে আয়াশ মেয়েটার মুখ পর্যন্ত দেখতে পারেনি। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ সে। বান্দরবানের বাঁকা পথে মিলিয়ে গেল মেয়েটা। এটা কেমন আর্কষণ ছিল?
গাড়িতে ঝড়ের গতিতে উঠে বসলাম। ডুকরে কেঁদে ফেললাম এবার। কান্নামাখা গলায় উচ্চারণ করে বললাম….
–“আল্লাহ! এ কেমন শাস্তি?”
বুকের ভেতরটা পুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। যেটা ক্রমশ দাবানলে পরিণত হচ্ছে। দুই বার বড় বড় শ্বাস নিলাম। বড় আশা নিয়ে প্রিয় মানুষটাকে দেখে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। আমার মনে শুরু হয়েছিল বর্ষণ। ভালোবাসার বর্ষণ। যখন আমার আঁকানো স্কেচটা হাতে পড়েছিল তখন থমকেছিলাম। হুবহু যেন আমি ছবিতে। যখন সামনে তাকাই মনে হলো হাজার বছর পর সেই প্রিয় মানুষটির দেখা পেয়ে চোখ ভরে উঠল।
পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলাম। জানতাম যে উনি আমার কন্ঠ শুনে আমাকে চিনে ফেলবেন। দ্রুততার সঙ্গে ভালোবাসা নিয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরবেন। আমি ভুল ছিলাম। কেন উনি আমায় চিনলেন না? হলো অন্তত অভিমান। বুক ফেটে বেরিয়ে এলো কান্না। দাঁড়িয়ে থাকিনি ছুটে এসেছি।
আমাকে এভাবে গাড়িতে বসতে দেখে পেছনের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে এলো অহনা। সঙ্গে আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে এলো। আমার চোখজোড়া তখনও অশ্রুসিক্ত। গাড়িতে উঠে বসে আমাকে দেখে উত্তেজনা নিয়ে বলল….
–“কি হয়েছে তোমার? এভাবে কাঁদছো কেন?”
আমি হেঁচকি তুলতে তুলতে বললাম….
–“উনি আমাকে চিনতে পারেন নি। পারেন নি চিনতে।”
অহনা হয়ত কিছু বুঝল না। আকাশ ভাইয়াও এসে বসলেন। আমাকে দেখে চিন্তিত হলেন। আমি হঠাৎ শান্ত হলাম। চোখের পানির মুছে ফেললাম। নাক টানতেই আদ্রিতা আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি ওকে ধরতেই দুহাতে আমার গালে লেগে থাকা ভিজে অবিশিষ্ট কিছু পানি মুছে দিতে থাকল। আধো আধো কন্ঠে বলল….
–“কাদচো কেন মাম্মা? তুমি তো বলো, চাহচী মেয়েলা কাঁদে না। তুমি তো আমাল চাহচী মাম্মা।”
আদ্রিতার কথা শুনে হাসি ফুটল আমার। টলটল চোখ নিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটল। আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললাম….
–“ঠিক তো। সাহসী মেয়েরা কাঁদে না। আমি তো আমার আদ্রিতার সাহসী মাম্মা।”
আদ্রিতা মাথা নাড়াতেই অহনা প্রশ্ন ছুঁড়ল।
–“কে এসেছিল?”
আমি এবার র্নিদ্বিধায় বললাম….
–“আয়াশ। উনি এসেছিলেন। আমাকে চিনতে পারেননি।”
–“তবে কি ও তোমাকে ভুলে গেছে।”
সরাসরি কথা আকাশ ভাইয়ার।
আমি নাবোধক মাথা নাড়ালাম। একদিকে তাকিয়ে বললাম….
–“এটা অসম্ভব। কিছু হয়েছে হয়ত উনার সঙ্গে। সেটা তো ওই বাড়িতে ঢোকার পরই জানতে পারব।”
আকাশ ভাইয়া এবার সামনে তাকায়। আমি আদ্রিতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি….
–“ভালো আংকেল কে কি বলে ডাকতে বলেছিলাম বলো তো?”
আদ্রিতা মুখ থেকে নখ সরিয়ে আকাশ ভাইয়ার দিকে তাকালো। তারপর চট করে উত্তর দিল…..
–“বাবা।”
শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। এটা একমাত্র রাস্তা সবার সন্দেহ থেকে বাঁচার। ড্রাইভার এসে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল….
–“হয়ে গেছে। এখন আমরা যেতে পারব।”
আকাশ ভাইয়া স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। আমি এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম।
———————-
কতদিন পর এই রায়জাদা বাড়িতে আমার পায়ের ধুলো পড়ল। আমার এই আগমন রায়জাদা দের ধ্বংস ডেকে আনবে। আনবেই।
আমাদের জন্যই যেন দৃঢ় অপেক্ষা নিয়ে বসে ছিল মাহতাব রায়জাদা আর রিক রায়জাদা। তাদের চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হলো না। হাত মুঠো করে নিলাম। মাথা পুরোনো ক্রোধে ফেটে যাচ্ছে। আমি রয়েছি লম্বা আকাশ ভাইয়ার পেছনে। আকাশ ভাইয়া গিয়ে দাঁড়াতেই এগিয়ে এলো ওরা দুজন। রিক রায়জাদা বলল….
–“আসুন। ভেতরে আসুন। রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
আকাশ ভাইয়া খানিকটা ভাবের সঙ্গে বলে উঠলেন….
–“তা একটু হয়েছে। আপনাদের গাড়ি বোধহয় খুব পুরোনো। তাই মাঝরাস্তায় ড্যাম হয়ে গেছিল।”
আমি সামনে এসে দাঁড়ালাম। রিক রায়জাদার মুখ অপমানে থমথম করে উঠল। আকাশ ভাইয়া ভাব নিয়ে কথা বলার লোক মোটেও না। উনি বলছেন কারণ উনি এখন নামি-দামি বিজনেসম্যানের পরিচয়ে এসেছেন। ভাব নিতেই হবে। যখনই থমথমে ছিল রিক রায়জাদার মুখ সেই সঙ্গে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মাহতাব রায়জাদা। আমাকে দেখে চোখজোড়া যেন কপালে উঠে গেল তার।
রিক রায়জাদা তার বাবার দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে গেলো। ফিসফিস করে বললো কিছু। আকাশ ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বলল….
–“এক্সকিউজ মি?”
আকাশ ভাইয়ার জবাব না দিয়ে মাহতাব রায়জাদা আমার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের কারণে জোরে বলে উঠল….
–“আনিশা?”
আমি কপাল ভাঁজ করে আশেপাশে তাকালাম। নিখুঁত ভাবে অভিনয় করার চেষ্টা করলাম। নিজেকে দেখিয়ে বললাম….
–“সরি আমাকে বলছেন?”
রিক রায়জাদা উচ্চস্বরে বলল….
–“তুই ফিরে এসেছিস? কি করে? কিভাবে? তুই তো পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছিলি।”
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম….
–“সরি টু সে বাট আপনারা কি বলছেন আমি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারছি না। আর আপনি(মাহতাব রায়জাদার দিকে তাকিয়ে) আপনি আমাকে কি যেন নামে সম্বোধন করলেন! হ্যাঁ আনিশা। আমার নাম আনিশা নয়। আমি মায়াবিনী রেজওয়ান। আমার হাজবেন্ড আকাশ রেজওয়ান।”
কথাটা বলে আকাশ ভাইয়ার হাত চেপে ধরলাম আমি।
শেষ কথাতে গলা হালকা কাঁপল আমার। অন্যজনকে স্বামীর জায়গায় বসানোর কোনো মানে নেই আমার কাছে। আমি শুধু একজনকেই মনেপ্রাণে স্বামী মানি! আমার প্রত্যেকটা কথা যেন তাদের দুজনের কাছে অবিশ্বাস্য হয়ে ঠেকল। ওরা দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। তারা বোধহয় ভাবতে ব্যস্ত যে দুজন মানুষের চেহারা এতোটা নিখুঁত মিল কি করে থাকতে পারে। আকাশ ভাইয়াকে ইশারা করলাম। আকাশ ভাইয়া গলা খাঁকারি দিয়ে কঠোর গলায় বললেন….
–“মি. রায়জাদা, এবার বুঝতে পারছি আপনাদের বিজনেসের অবস্থা এতো খারাপ কেন! আসলে আপনারা নিজেদের ক্লায়েন্ট দের এভাবে অসম্মান করেন আর অযৌক্তিক কথা বলেন। সি ইজ মাই ওয়াইফ।”
মাহতাব আর রিক রায়জাদা থতমত খায়। কি করবে বুঝতে পারে না। তারা এই ক্লায়েন্ট হারাতে পারবে না তারা খুব ভালো করে জানে। তাই দ্রুত এগিয়ে এসে বলল….
–“দুঃখিত। আপনারা ভেতরে আসুন। আচ্ছা আপনার ওয়াইফকে কি কোনো এক্সিডেন্টের মাধ্যমে আপনারা পেয়েছিলেন?”
রিক রায়জাদার সোজা প্রশ্ন। আমি বাঁকা উত্তর দিয়ে বললাম….
–“কি বলতে চাইছেন আপনারা? আমার কখনো কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি।”
মাহতাব রায়জাদা রিকের দিকে চোখ রাঙিয়ে থামতে বলেন। আমি অহনাকে ভেতরে আসতে ইশারা করি। অহনার কোলে ঘুমন্ত আদ্রিতা। আমি জানি ওরা এখনো সিউর নয় আমার সম্পর্কে। মাহতাব রায়জাদা মুখে প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে বলল….
–“সরি। আমরা আপনার মুখ দেখে আমাদের এক পরিচিত জনের মুখের সঙ্গে মিল পেয়েছি। তাই রিক মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছে।”
আমি ব্যাগ থেকে কিছু একটা ঘেঁটে বের করতে ব্যস্ত। হাতে জিনিসটা আসতেই বের করে ওদের মুখের সামনে তুলে ধরলাম আমি। গমগমে আওয়াজে বললাম…..
–“এটা পাসপোর্ট। দেখুন নাম আর চেহারা সব করে দেখুন। এতো সন্দেহ যখন। তাও যদি ব্যাপারটা নয় হয় তাহলে আইডেন্টিটি কার্ডও দেখাবো।”
–“না না। আর লাগবে না।”
–“আকাশ, কেন যে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ডিল করতে চাও কে জানে! আমার তো এক্ষুনি চলে যেতে ইচ্ছে করছে।”
আমার কথায় ভয় পায় দুজনেই। রিক ভয়ার্ত কন্ঠে বলে….
–“না না। এমনটা করবেন না। ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়।”
আমি কোনো রিয়েকশন না দিয়ে বসে থাকলাম। নানানরকম কথাবার্তা চলল আমাদের মাঝে। শেষমেশ ঠিক হলো আমরা এই বাড়িতেই থাকব আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ব্যাপারটাই খুশি হলাম আমি। এটাই তো চেয়েছিলাম!
আমাদের ঘর দেখিয়ে দেওয়া হলো। ঘরটা তিন তালায়। তিন তালা নতুন করেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সব চকচকে। আমাকে আর আকাশ ভাইয়াকে একটা ঘর দেখিয়ে দেওয়া হলো আর অহনাকে আরেকটা ঘর। আদ্রিতাকে আস্তেধীরে শুইয়ে দিলাম আমি। আকাশ ভাইয়া দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমি হাফ ছেড়ে বললাম….
–“থ্যাংক ইউ ভাইয়া। তুমি না থাকলে কি যে হতো…!”
–“তুমি আর অহনা আমার বোনের মতো মায়া। ভাই-বোনের মাঝে ফর্মালিটি দিয়ে ছোট করো না।”
আমি মাথা নাড়ালাম।
হাতে টাওয়াল আর শাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। তিন তালা নতুন করা হয়েছে। পানির লাইন এখনো দেওয়া হয়নি। কালকে দেবে। তাই বলা হয়েছে দোতালার বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে নিতে। দোতালার একটা রুমে ঢুকে গেলাম আমি। রুমটা আমার ছিল। রুমে ঢুকতেই একটা গন্ধ এসে নাকে ঠেকল। শিউরে উঠলাম আমি। এই গন্ধ আমার চেনা। এই মানুষটার গন্ধ এই বাড়ির ঘর থেকে পাচ্ছি কেন আমি?
রুমটা দেখতে লাগলাম। রুমের কিছুই আগের মতো নেই। রুম জুড়ে আমার ছবি ছিল। তা নেই। রুমের কালার পাল্টে সাদা করা হয়েছে। কিছুই আগের মতো নেই। বিছানায় বসলাম।
কিছুক্ষণ বসে থাকতেই পুরোনো স্মৃতি তরতাজা হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম আমি। বেশিক্ষণ বসে থাকলে ভেঙে পড়ব আমি। তাই উঠে এলাম। আজ না হয় এই ঘরের ওয়াশরুমেই যাওয়া যাক! যেই ভাবা সেই কাজ। আমার ওয়াশরুম আর ঘর অন্যদের থেকে ভিন্ন ছিল। ঘরের পাশে সবুজে মাখানো একটা ছোটোখাটো ঘর ছিল। সেখানে ছিল ওয়াশরুম। ওয়াশরুমের দরজায় হাত দিলাম। খোলার চেষ্টা করতেও খুলল না। চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। ওয়াশরুমে কি কেউ আছে তাহলে? আরেকবার চেষ্টা করে শক্তি দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে পা চলে গেল। ঝরনার পড়া পানিতে কাকভেজা হতে শুরু করলাম। কোমড়ে পেলাম কারো ঠান্ডা স্পর্শ। জমে গেলাম সেখানেই। ভেজা চোখমুখ নিয়ে তাকালাম। এই স্পর্শ চিনতে ভুল হতে পারে না!
#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ৪
–“কে তুমি?”
আয়াশের কথা শুনে নড়ে উঠলাম। কিন্তু সরতে পারলাম না একবিন্দুও। উনার মুখ থেকে বেয়ে পড়া পানি আমার চোখমুখে পড়ছে। উনার তৃষ্ণার্ত চোখ আমার মনে ঝড়ের সৃষ্টি করছে। সেই সঙ্গে চোখে টলটল করছে পানি। আমি ঠেকে আছি আয়াশের উদাম বুকের সঙ্গে। একফোঁটাও দূরত্ব নেই আমাদের। কতবছর পর যেন আমরা এতো কাছাকাছি! চোখের পানি ঝরনার পানির শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিজের অনুভূতি আর চাপা দিতে পারলাম না। কম্পিত গলায় বললাম….
–“সত্যিই চিনতে পারছেন না?”
আয়াশের চোখের গভীরতা আরো দৃঢ় হয়। উনি একহাতে আমার পিঠে আরেক হাতে আমার কোমড়ে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথা ঝাঁকালেন উনি। আমার আশার আলো দেখতে পেলাম। অশান্ত কন্ঠে বললেন….
–“আমার শয়নেস্বপনে তুমি ঘুরে বেড়াও। বাস্তব জীবনেও শান্তি দাও না। চোখটা খানিক মূহুর্তের জন্য বন্ধ করলেই তোমার এই সমুদ্রের গভীরতার মতো চোখজোড়া ভেসে ওঠে। আজ কি না বাস্তবেই এসেছো। আমি কি সত্যিই বাস্তবে তোমায় দেখছি? নাকি এটাও কল্পনা?”
আশার আলো মূহুর্তেই নিভে গেল। এই ভালোবাসার মানুষটি যে আমাকে ভুলে যাবে সেটা আমার কাছে আশাতীত ছিল। ভেতরে কিছু ভাঙার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। উনার ভালোবাসা আর আমার ভালোবাসা এতোটা ঠুনকো ছিল মানতে পারছি না। তৎক্ষনাৎ শক্ত হলাম। উনার বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলাম সরানোর জন্য। লোকটা সরানোর বদলে আরো আমাকে মিইয়ে নিলেন নিজের সঙ্গে। রাগে কটমট করে ধাক্কা মারলাম আমি। উনি ওয়াশরুমের দেওয়ালের সঙ্গে ঠেকে গেলেন। আমিও পিছিয়ে এলাম।
কয়েকটা ধাপ পিছাতেই পায়ের সঙ্গে প্যারা লাগলো শক্ত কিছুর। আয়াশ আমাকে ধরার জন্য উদ্যত হলেন। কিন্তু পারলেন না। পেছন দিকে পড়েই গেলাম। সোজা পড়লাম বাথটাবে। সেখানে ছিল পানি ভর্তি। পানিতে হাবুডুবু খেলাম একপ্রকার! উঠে বসলাম ধড়ফড় করে। বড় বড় শ্বাস নিতেই দেখলাম আয়াশ আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। মুখ ফুটে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন….
–“আজ তাহলে সত্যিই তুমি এসেছো!”
আমি নিরুত্তর। উনি আমাকে কি সত্যিই চিনতে পারছেন না? নাকি চিনতে চাইছেন না? আর সব থেকে অবাক করা বিষয় হচ্ছে উনি এই রায়জাদা বাড়িতে কেন?
আনমনে হয়ে সেটাই ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভুলেই গেলাম আমি এখন কোথায় আছি! চুটকির শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। আয়াশ হাত বাড়িয়ে দিলেন। মানতে হবে কয়েক বছরে উনার সৌন্দর্য একটুও নষ্ট হয়নি। শুধু একটু শুকিয়ে গেছেন। শান্ত গলায় বললেন…..
–“উঠে পড়ো হাতটা ধরে।”
আয়াশের হাত ধরলাম না সরিয়ে দিলাম। উনি আমাকে চেনেন না! উনার হাত ধরব না। একা একা উঠে দাঁড়ালাম। তখনই ওয়াশরুমের বাইরে থেকে আওয়াজ এলো। রিক রায়জাদার আওয়াজ চিনতে ভুল হলো না।
–“আয়াশ ভেতরে আছিস?”
রিক রায়জাদার কথা শুনে বাইরে যেতে নিলাম আমি। আমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরলেন আয়াশ পেছন থেকেই। রাগে ফুঁসে পেছনে তাকালাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম….
–“আপনি নাকি আমাকে চেনেন না! তাহলে এটা কেমন অসভ্যতা? ছাড়ুন আমার শাড়ির আঁচল।”
উনি শাড়ি ধরতে ধরতে আমার কাছে এলেন। আমার মুখটা আবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললেন….
–“আমি তোমাকে চিনি না ঠিকই। কিন্তু মনে হয় তোমার স্থান আমার পুরো শরীর জুড়ে। হয়ত তোমাকে আমি চিনতাম। যখন সব ভুলে গিয়েছি তোমাকেও ভুলে গিয়েছি।”
কথাটা বলে মাথায় হাত দেন আয়াশ। আমার চোখজোড়া ছোট ছোট হয়ে যায়। কি বললেন উনি? সব ভুলে গিয়েছেন? মাথায় চাপল কিছু প্রশ্ন। সেটা করতে চাইলাম কিন্তু হলো না। আবারও বাইরে থেকে ডাক পড়ল।
–“আয়াশ, ভেতরে তোর সঙ্গে কেউ আছে? কার সঙ্গে কথা বলছিস?”
আয়াশ নিজের আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন….
–“এক সেকেন্ড!”
উনি আমাকে আড়াল করে ওয়াশরুমের দরজা হালকা ফাঁক করে রিকের উদ্দেশ্যে বললেন….
–“টাওয়াল টা দে তো।”
রিক রায়জাদা কোনো প্রশ্ন না করেই টাওয়াল এগিয়ে দিতে দিতে ওয়াশরুমে উঁকি দিতে দিতে বলল….
–“কার সঙ্গে কথা বলছিলি?”
আয়াশ জবাব না দিয়ে আমার দিকে ঘুরে আমার গায়ে টাওয়াল জড়িয়ে দিলেন। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। উনি আমার দৃষ্টি বুঝে মৃদু হেসে বললেন….
–“শাড়ি ভিজে গিয়েছিল তোমার মিস. বাঘিনী! দেখতে বাজে….. না না বাজে তো লাগছিল না। তবে এই অবস্থায় কোনো পুরুষের সামনে যাওয়া যাবে না। প্রবলেম হয়ে যাবে।”
উনার প্রত্যেকটা কথা হৃদয়ে দোলা দিয়ে দিল। উনি আমাকে চিনেন না তাহলে মিস. বাঘিনী বললেন কেন? এটা তো উনার দাওয়া নাম!
আমি কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে এলাম কারণ সামনে রিক রায়জাদা রয়েছে। আমাকে দেখে চমকে তাকাল সে। জোরে বলে উঠল….
–“একি, মিসেস. রেজওয়ান! আপনি আর আয়াশ এক ওয়াশরুমে?”
নিজের চোয়াল শক্ত করলাম। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। আয়াশই নিজের মাথা মুছতে মুছতে বলে উঠলেন….
–“তেমন কিছুই নয়। আমি ওয়াশরুমে যখন আসি শাওয়ার নেবার সময় দেখি টাওয়ালই আনিনি। তাই ওয়াশরুমের দরজা খুলি। তখন বোধহয় ইনিও(আমাকে দেখিয়ে) ওয়াশরুম খোলার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।”
–“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। আপনাদের তিন তালায় তো পানির লাইন নেই। তাই দোতালার ঘরের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হতে বলা হয়েছিল। কেন যে এই বাড়িতে এলাম। আর থাকতে গেলাম কে জানে!”
প্রথম কথা গুলো ঝাঁঝালো এবং শেষ কথাগুলো আক্ষেপের সুরে বলে উঠলাম আমি। রিক রায়জাদা আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল….
–“সরি। কাল থেকে পানির লাইন দেওয়া হবে। আপনি বরণ এই ঘরের পাশের ঘরে ফ্রেশ হয়ে নিন।”
–“ফ্রেশ হওয়ার ইচ্ছে ঘুচে গেছে মি. রিক রায়জাদা!”
কথাটা বলে রাগের ভঙ্গিতে বাইরে বেড়িয়ে এলাম আমি। এসেও দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেলাম। এতো রাগ আর দেমাগ মার্কা আচরণ দেখাতে হচ্ছে আমি যে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ সেটা দেখানোর জন্য।
ঘরের ভেতরে তাকালাম আমি। আয়াশ আর রিক রায়জাদা কথা বলছে।
–“মেয়েটা কে ছিল বল তো?”
মাথা মুছতে মুছতে প্রশ্নটা রিকের দিকে ছুঁড়ে দেন আয়াশ। রিক থতমত খেয়ে বলে ওঠেন….
–“তোকে তো পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় হয়নি। আমাদের বাড়িতে নিউ ইনভেস্টার এসেছে। ওরা আমাদের সঙ্গে ডিল করতে চায়। তাই যতদিন না কাজ শেষ হবে আমাদের বাড়তেই থাকতে বলেছে বাবা।”
আয়াশ ছোট্ট করে জবাব দেন….
–“ওহ।”
তারপর কিছুক্ষণ স্তব্ধতা বিরাজ করে। আয়াশ আবারও আনমনে বলেন….
–“মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগে।”
রিক প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করে….
–“কি যে বলিস! মেয়েটা বিবাহিত। ওকে কেন চেনা চেনা লাগবে?”
–“জানি না।”
আয়াশের নির্বিকার কন্ঠ। আমার বুকে আগের ক্ষোভ-কষ্ট সব জেগে উঠছে। এদের দেখার পর থেকে আগের ক্ষত জ্বালা করতে শুরু করেছে। নিজ হাতে কুপিয়ে হত্যা করার জন্য হাত উশখুশ করছে। কিন্তু না! এই কয়েকবছরে যা যা পরিবর্তন হয়েছে সব জানতে হবে। জানতেই হবে।
ঘরের মধ্যেখানি পায়চারি করছি আমি। আদ্রিতা খেলছে। ও একবার খেলতে শুরু করলে কোনো কিছুর দিকে খেয়াল থাকে না। কে কি বলল, কে কি করল সেটার দিকে খেয়াল রাখে না। আকাশ ভাইয়া গলায় টাওয়াল পেঁচিয়ে ঘরে ঢুকল। তারই অপেক্ষায় ছিলাম আমি। পেছনে উঁকি দিয়ে বললাম….
–“অহনা আসেনি?”
–“সে তো অলওয়েজ লেটলতিফ। আসতে একটু দেরি হবে।”
বিরক্তির শ্বাস ফেললাম। আলোচনা করা প্রয়োজন। কিছুক্ষণের মাঝেই দরজা ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ে কেউ। আমি চকিত নজরে তাকায়। চোখজোড়া বলে আয়াশ এসেছে তারপরই চোখজোড়া স্থির হতেই মনে হয় নাহ এটা আয়াশ নয় অহনা। এই মেয়েটাকে এক নজর দেখলেই মনে হয় আয়াশ দাঁড়িয়ে আছে। কি একটা অসম্ভব ব্যাপার বুঝি না আমি। আসলে কি অহনাকেই আয়াশের মতো দেখতে নাকি আমিই লোকটার প্রেমে এতোটাই মাতোয়ারা যে বুঝতেই পারি না সে আয়াশ আর কে অহনা সেটাও জানি না!
আমি স্থির হয়ে বসলাম। সিরিয়াস হয়ে বসল সোফায় আকাশ ভাইয়া আর আমার পাশে অহনা। আমি নিজে থেকে বললাম….
–“আয়াশ বলেছেন উনার কিছু মনে নেই।”
–“কি বলো? মনে থাকবে না কেন?”
অহনার অবাক করা কন্ঠ। আমি ভাবুক হয়ে বললাম….
–“সেটা জানলে তো হতোই। একটা বিষয়! সেটা হচ্ছে আয়াশ এই বাড়িতে থাকে। নিজের পরম শত্রুর বাড়িতে থাকে। উনার কথাবার্তা শুনলে মনে হয় এই শত্রুগুলোই উনার আপনজন। ব্যাপারটাই পরিষ্কার যে উনার কিছুই মনে নেই। যদি থাকত উনি স্বপ্নেও এদের সঙ্গে বসবাস করার কথা ভাবত না।”
আকাশ ভাইয়া হালকা কাশল। গম্ভীর গলায় বলে উঠল….
–“আচ্ছা এমনটা নয়ত? যে আয়াশের সব কিছু ভুলে যাওয়ার পেছনে এই রিক রায়জাদা আর মাহতাব রায়জাদারই হাত আছে!”
–“হতে পারে আকাশ ভাইয়া। এরা পারে না এমন কিচ্ছু নেই। দুনিয়ার সব থেকে জঘন্য কীট নামে পরিচিত। এমনকি আয়াশের আমাকেও মনে নেই।”
কথাটা বলতে চোখজোড়া ভরে গেল আমার। অহনা বুঝতে পেরে আমার কাছে হাত রাখল। আমি মাথা নাড়িয়ে ঢক গিলে বললাম….
–“উনি আমাকে পুরোপুরি ভুলেও যাননি। আজকের ঘটনা সেটা প্রমাণ করে। কিন্তু একটা কথা আমাদের সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। এমন কোনো কেউ করবে না যাতে ওরা সন্দেহ। আমাকে দেখে অলরেডি ওরা আমাদের সন্দেহের কাতারে ফেলেছে। আমি এটা জানি ওরা বিশ্বাস করেনি এখনো যে আমি অন্য একজন মানুষ। ওরা পেছনে আঠার মতো লেগে থাকবে। তাই আমাদেরও ওদের পেছনে নজর রাখতে হবে।”
আকাশ ভাইয়া আর অহনা দুজনেই সম্মতি জানায়। আমি আবারও বললাম….
–“আর হ্যাঁ আয়াশের সঙ্গে কি হয়েছে সেটাও জানতে হবে। অহনা, তুমি আমার আদ্রিতাকে দেখে রেখো শুধু। আর আকাশ ভাইয়া, তুমি আমাকে সাহায্য করবে।”
অহনা মাথা নাড়াতেই আকাশ ভাইয়া জোর দিয়ে বলে উঠল….
–“অবশ্যই। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
আমি হালকা হাসলাম। তারপর হাসি নিভে গেল। উঠে দাঁড়ালাম আমি। আশেপাশে তাকিয়ে বললাম….
–“সবাই আছে। সেঁজুতি মা কোথায়? আয়াশ যদি এখানে থাকে তাহলে সেঁজুতি মাও এখানে আছে আর নয়ত ওরা তাকে…..”
কথাটা বলে থেমে গেলাম। সেঁজুতি মাকে হারানোর আঁকড়ে ধরল। অহনা দাঁড়িয়ে বলল….
–“বি পজিটিভ।”
আমি মুঠো শক্ত করে বেডে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখজোড়া অস্থির হয়ে উঠল।
আশেপাশে তাকিয়ে আদ্রিতাকে পেলাম না। শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠে বললাম….
–“আদ্রিতা কোথায় গেল?”
আমার সাথে ওরাও আশেপাশে তাকাল। রুমে আদ্রিতা নেই। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে আমার। আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি চাই না বলেই এতোবছর লুকিয়ে দিন যাপন করেছি। আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছে অবধি আসিনি। ছটফট করতে করতে বেরিয় এলাম ঘর থেকে। পিছু পিছু এলো আকাশ ভাইয়া আর অহনা।
দোতালা করিডোর দিয়ে পায়ের ছোট ছোট ধাপ ফেলে হাঁটছে আদ্রিতা। নিজে নিজেই কিছু একটা বলে চলেছে সে। তার আধো আধো গলার ভাষা বোঝা বেশ কঠিন বটে। কথা বলা আর হাঁটার তালে তালে গাল নড়ছে তার। মাঝে মাঝে একা হেসে উঠছে সে।
মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য রেডি হতে ব্যস্ত ছিল আয়াশ। তার ব্যস্ততা ভাঙে এক মিষ্টি হাসির সুরে। দরজার দিকে তাকায় সে। আবার হাসি শুনতে পায়। এমন হাসি তো বড়দের হতে পারে না। এমন হাসি ছোট বাচ্চাদের হয়। কৌতুহলী হয়ে দ্রুত পায়ে বাইরে বের হয় আয়াশ। সামনে তাকাতেই ওর চোখ জুড়িয়ে যায়।
আদ্রিতাকে দেখে এক অজানা টান বুঝতে পারে আয়াশ। অথচ বাচ্চাটাকে এর আগে কখনো দেখেই নি সে। আদ্রিতার হাসি দেখে আয়াশের মুখে হাসি ফোটে। ওর কাছে ছুটে যায় আয়াশ। মেয়েটার কাছে না গিয়ে যেন থামতেই পারছে না। আদ্রিতার সামনে আয়াশ দাঁড়াতেই ওর ছোট্ট মনটা হকচকিয়ে ওঠে। তার ওপর ছোট্ট বাচ্চার পেশি এখনো শক্তপোক্ত হয়নি। আদ্রিতা হকচকিয়ে পড়তে নেয়। আয়াশ তাকে ধরে ফেলে সোজা করে দাঁড় করায়। কি সুন্দর চাঁদের মতো মুখশ্রী মেয়েটার। আয়াশের প্রাণে যেন পানি সঞ্চার হয়।
আয়াশ হাঁটু গেঁড়ে বসে। আদ্রিতা চোখ গোল গোল করে তাকায় আয়াশের দিকে। তারপর সে তার অজান্তেই হেসে ওঠে। হাসির শব্দে মুখরিত হয় পরিবেশ। এইটুকু মেয়ের হাসি যে এতোটা আয়াশের মনে প্রভাব ফেলবে সেটা সে নিজেই জানত না। আদ্রিতার ছোট্ট হাত জোড়া কোমল ভাবে ধরে হাসিমুখে বলে ওঠে….
–“কি নিয়ে এতো হাসি পিচ্চি? আমাকেও বলো। আমিও হাসি।”
আদ্রিতা কিছু বলে না। শুধু চেয়ে থাকে। তারপর পায়ের ধাপ ফেলে এগিয়ে আসে আয়াশের দিকে। ছোট হাতের স্পর্শ সে লাগায় আয়াশের গালে। অন্যহাত দেয় কপালে। মুখ সরু করে আধো আধো কন্ঠে বলে ওঠে….
–“তুমি থুব চুন্দর।”
আয়াশ আদ্রিতার পুরো কথা বোঝে না। তাই আন্দাজ করে বলে…..
–“আমি খুব সুন্দর?”
আদ্রিতা মাথা ঝাঁকায়। আয়াশ চমৎকার হেসে ওঠে এতোটুকু মেয়ের কথা শুনে। আদ্রিতা আবারও বলে…
–“তুমি কে?”
–“আমি এই বাড়িতে থাকি তো। এখন বলো তো তোমার নাম কি?”
আদ্রিতা চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। মুখ ঘুরিয়ে বলে….
–“আ..আমি তাউকে নাম বলি না। মাম্মা মানা কলছে। তুমি অতেনা।”
আয়াশ একটু হেসে ভাবুক কন্ঠে বলে….
–“তাই তো। আমি অচেনা। আচ্ছা আমার নাম বলি? আমার নাম আয়াশ চৌধুরী। এখন তোমার নাম বলো।”
আদ্রিতা নিজের গাল ধরে বলে….
–“আমি আদ্দিতা।”
–“আদ্দিতা?”
আয়াশ ভাবে। মেয়েটা তো এখনো সঠিক ভাবে কথা বলতে জানে না। তারপর অনেক ভেবে বলে…
–“ইয়েস, আদ্রিতা।”
আদ্রিতা কিছু বলে না। নিজের আঙ্গুল মুখে ঢুকিয়ে দেয়। আয়াশের খুব ভালো লাগছে। এমন ভালো যেন কখনো লাগেনি। নিজের হাত বাড়িয়ে বলে….
–“আসবে আমার কোলে?”
আদ্রিতা কোলে উঠে যায়। আয়াশের ভালো লাগা বাড়ে। নিজের ঘরের ভেতরে ঢুকে যায় আদ্রিতাকে নিয়ে।
সব কিছু এক কর্ণারে দেখতে থাকলাম আমি। আমার চোখের কার্নিশে পানি আর ঠোঁটে আসি। কি সুন্দর ছিল বাবা আর মেয়ের মূহুর্ত। আমার চোখ যেন সার্থক হয়েছে। আকাশ ভাইয়া আর অহনাও দেখেছে। অহনা হাসোজ্জল গলায় বলল….
–“দেখেছো? আমাদের আদ্রিতা তো অন্য কারো কোলে ওঠে না সহজে। অচেনা কারোর কোলে তো না ই। আজ আয়াশ ভাইয়াকে একবার দেখেই উঠে গেল।”
আমি টান টেনে বললাম….
–“বাবা আর মেয়ের সম্পর্ক টাই হয়তো এমন। এতোদিন পর নিজের মেয়েকে কাছে পেয়েছেন। কিছুক্ষণ না হয় থাক উনার কাছে। সময় কাটাক। এতোদিন তো বঞ্চিত করেছি আয়াশকে। আর কতো?”
রিক রেগেমেগে বসে আছে। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেন মাহতাব। ছেলের পাশে এসে বসেন উনি। রিকের কপালের রগ রাগে ফুলে উঠেছে। নিজের বাবার উপস্থিতি পেয়ে বলে উঠল….
–“বাবা, তুমি কেন ওদের এই বাড়িতে রাখলে বলো তো? ওই যেই মেয়ে নিজেকে মায়াবিনী রেজওয়ান বলে পরিচয় দিচ্ছে। সে একেবারে আনিশার মতো দেখতে। হতে পারে ও আনিশা। আমার ধারণা ঠিক হলে কতটা বড় বিপদ হতে পারে আঁচ করতে পারছো?”
মাহতাব ছেলের কথায় কয়েকটা দম নিলেন। তারপর বললেন….
–“আরে বকা ছেলে! বিপদের আঁচ করতে পারছি জন্যই এই বাড়িতে রেখেছি।”
–“মানে?” (বড় বড় করে তাকিয়ে)
মাহতাব পা তুলে বসতে বসতে আয়েশের সঙ্গে বলে….
–“শত্রুদের পরিকল্পনা কিভাবে জানা যায় জানিস? শত্রু যখন কাছে থাকে তখন। ওরা আমাদের বাড়িতে আছে। ওদের ওপর নজর রাখলে আমরা পরিকল্পনা জানতে পারব। ওই মেয়েটা আনিশা কি না বুঝতে পারব। ওরা দূরে থাকলে সেটা তো হবে না। আবার ব্যবসার দিকটাও দেখতে হবে। নয়ত দেউলিয়া হয়ে যাব।”
রিক দমলো না। দ্রুততার সঙ্গে বলল….
–“কিন্তু আয়াশ? ভুলে যেও না বাবা। আয়াশের স্মৃতিশক্তি কিন্তু বেশিক্ষণ ভুলিয়ে রাখা যাবে না। আনিশার মতো মেয়েটা সামনে থাকলে ও এমনি এমনি সব মনে পড়তে শুরু করবে।”
–“ততদিনে প্রোপার্টি সব লিখে নেব চিন্তা করিস না তুই। তুই শুধু ওদের ওপর নজর রাখ। দিন রাত নজর রাখ। আর নজর রাখার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরাও লাগিয়ে দে পারলে।”
রিক বড় শ্বাস নেয়। তবুও কোনো অজানা আশঙ্কা করছে সে। ভয় পাচ্ছে!
চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।