#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ9
#মাহিয়া_মুন
সকালের মিষ্টি রোদের আলোয় উৎপত্তি হলো নতুন একটি দিনের। বিগত দিনের মতোই ব্যাস্ত যে যার রোজকার কাজে ।
চৌধুরী বাড়ির সবাই নাস্তা করার পাশাপাশি হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। কিছু সময় বাদে আদ্রিজ আসায় সবাই চুপ হয়ে গেলো। আদ্রিজ নাস্তা করার পাশাপাশি লক্ষ্য করলো সবাই তাঁর দিকে তাঁকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে তাকালো। রাগি কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে সবাই এইভাবে হাসছো কেনো?”
আদি বলে উঠলো,
“ভাই বউমনি ………… ‘
মেঘ তাড়াতাড়ি আদির মুখ চেপে ধরলো। আদ্রিজের দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
“না ভাই তেমন কিছুনা তুমি নাস্তা করো।”
আদ্রিজ রাগি চোখে তাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“এইখানে কি সার্কেল চলতেছে। কেউ কিছু বলছোনা কেন? আর কে বউমনি?”
আশা চৌধুরী ছেলের দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
“সব কথায় রেগে যাও কেন বাবা? ওদের কথা বাদ দাও। আমি যা বলবো মন দিয়ে শুনবে। ”
আদ্রিজ বলে উঠলো,
“মা তুমি আমায় মিথ্যে রাগ দেখিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আমি জানি তুমি আগে পরে বিয়ে নিয়েই কথা বলবে।”
আশা চৌধুরীর মুখটা চুপসে গেল। তিনি ভেবেছেন হয়তো একটু রাগ দেখিয়ে ছেলেকে বললে ছেলে রাজী হবে। কিন্তু ছেলে তার বাপের আগে হাঁটে। আশা চৌধুরী অসহায় চোখে তাকালেন আজিজ চৌধুরীর দিকে।
মেঘ তার হাসি চেপে রাখতে না পেরে কাশি উঠে গেছে।
আদ্রিজ খাওয়া শেষে তার মায়ের দিকে তাঁকিয়ে হেসে বলে উঠলো,
“আমি রাজী তবে i need some time. আর তুমি যে মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছো তাকেই বিয়ে করবো।”
এই বলে আদ্রিজ উপরে চলে গেল। আশা চৌধুরী চোখ বড় বড় করে আদ্রিজের যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। মেঘের মা উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
“ভাবী যা শুনলাম সত্যি তো । ”
মেঘ হাসতে হাসতে বললো,
“যা শুনেছো একদম সত্যি। আর একটা কথা আমার শালীকাকে আমার ভাবী বানাতে ভাই এর কোনো আপত্তি নেই। কাল ভাই এর সাথে আমার কথা হয়েছে এই বিষয়ে।”
এই বলে মেঘ কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল।
*
*
কলেজ ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে বসে মেঘ প্রচুর হাসছে। যাকে বলে হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ার মতো অবস্থা। তাফসির অবশেষে রেগে বলে উঠলো,
“হাঁসি থামিয়ে বলবি কি হয়েছে নাকি লাত্থি উষ্টা খাবি।”
মেঘ হাসি থামিয়ে বললো,
“আচ্ছা বলছি আগে ক্লাসে চল।”
আরিয়ান বলে উঠলো,
“নিহা , মেঘা ওরা এখনো আসছে না কেন?”
মেঘ কিছু বলার আগেই ইলমা আরিয়ানের কাঁধে বই দিয়ে বারি দিয়ে কিছুটা সন্দিহান কণ্ঠে বলে উঠলো,
“মেঘ একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস?”
“কি?”
“আরে আমাদের আরিয়ান যখনি শুনলো নিহালের সাথে নিহার সম্পর্ক শেষ, তখন থেকেই নিহার প্রতি আরুর কেয়ারিং ভাবটা একটু বেশিই প্রকাশ পাচ্ছে নয় কি।”
মেঘ সন্দিহান চোখে আরিয়ানের দিকে তাঁকালো।
আরিয়ান কিছু না বলে ক্লাসের দিকে চলে গেলো। ইলমা বললো,
“দেখলি আমি ভুল বলি নি।”
মেঘ রেগে বললো,
“এইটা কখনো সম্ভব না , ক্লাসে চল সবটা বলবো।”
এই বলে সবাই ক্লাসের দিকে চলে গেলো।
*
*
নিহা এবং মেঘা হেঁটে হেঁটে বাসায় যাচ্ছে। সূর্যের প্রখর তাপমাত্রায় দুজন ঘেমে একাকার। মেঘা কপালের ঘাম মুছে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আজ কি সব রিক্সা ওয়ালারা দিন দুপুরে তাদের বউদের নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল নাকি?”
“কিসব বলছিস, এতো দূর আসলাম আর একটু আছে।”
এই বলে নিহা হাঁটতে হাঁটতে হটাৎ দাড়িয়ে গেলো। পিছে তাকিয়ে সন্দেহ করার মত কাউকেই পেল না। মেঘা বললো,
“কিরে কি হলো।”
নিহা ইশারায় কিছুনা বুঝালো তবে তাঁর মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফলো করছে। কিছুদিন ধরেই সে এইরকম অনুভব করছে।
নিহা এবং মেঘা চলে যেতেই গাছের আড়াল থেকে কালো কোর্ট পরা একজন লোক বেড়িয়ে আসলো। কাউকে কল দিয়ে বলে উঠলো,
“স্যার এই মেয়েটাই মিস #নিহা_খান। আমি ভালোভাবে খোঁজ নিয়েই বলছি স্যার।”
………………………………………………
“হ্যা স্যার। ওকে সেখানেই পাওয়া গেছে। আমি কিছু বয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করেছি তারা তাই বললো।”
…………………………………………………..
“এতিমখানার সেই পুরোনো দারোয়ান আমাকে বলেছে বাকিটা। টাকা দেওয়ার পর উনিই মিস নিহাকে চিনতে আমায় সাহায্য করেছেন। ”
…………………………………………………..
“ঠিক আছে স্যার।”
কল কেটে লোকটা আবারো নিহাদের পিছে যাওয়া শুরু করলো।
ফোনের ওপাশে থাকা ব্যাক্তিটি পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে একটি ছোট বাচ্চা মেয়ের বিশাল আকারের ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছবিটির দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“তোমায় পেয়ে গেছি মিস নিহা খান। ঊনিশ বছর আগে যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি আবারো ঘটবে। শুধু আমার কার্য সম্পাদন হওয়ার অপেক্ষা। S.H.O মিষ্টার নোমান খান, না পারলে নিজের বাবাকে বাঁচাতে, না পারলে নিজেকে বাঁচাতে। এইবার তোমার পরিবার কেও আমি ধ্বংস করে দিবো। যেইভাবে আমাকে একা করে দিয়েছো সেইভাবে তোমার মেয়েকেও আমি একা করে দিয়েছি। মেরে ফেলবো তোমার পরিবারকে আমি।”
এই বলে লোকটা বাচ্চা মেয়েটির ছবিটিতে একের পর এক ছুরি চালাতে লাগলো। লোকটিকে এই মুহূর্তে দেখলে যে কেউ বলবে যে লোকটি সাইকো।
*
*
পড়ন্ত বিকেল, সূর্যের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে। নিহা এবং মেঘা তৈরি হচ্ছে। মূলত তারা বই মেলায় যাবে বলেই তৈরি হচ্ছে। মেঘার গল্পের বই অতটাও পছন্দ না। তবে সে এবং মেঘ আজকে কিছু একটা ভেবে রেখেছে। নিহা গল্প পড়তে খুব ভালোবাসে। বই মেলা সে কখনো মিস করে না।
দুজনেই শাড়ি পড়েছে। মেঘা জোর করে নিহার কানে একটি কাঠগোলাপ ফুল গুঁজে দিল। নিহা সন্দিহান চোখে তাঁকিয়ে বললো,
“কি হয়েছে বলতো মেঘু। আমায় হটাৎ এতো সাজানোর কি হলো।”
“সাজালাম কোথায় শুধু অতিরিক্ত কাঠগোলাপ টাই তো দিলাম। তোকে না খুব সুন্দর লাগছে। আজকে তো একজন দেখে পুরো পাগল হয়ে যাবে।”
“কার কথা বলছিস তুই?”
মেঘা আমতা আমতা করে বললো,
“কা.. কার কথা বলবো , কারো কথা না। বলেছি যে আজকে আমার জানকে দেখে ছেলেরা ফিদা হয়ে যাবে।”
নিহা চোখ রাঙিয়ে বললো,
“খুব পেকেছিস মনে হচ্ছে। ভাইয়াকে বলতে হবে। মেঘ ভাইয়া কি এসেছে?”
“হ্যা নিচে দাড়িয়ে আছে।”
নিহা এবং মেঘা বাসার সামনে এসে দেখে মেঘ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ হেসে বললো,
“আরেহ ভাবী আসেন আসেন , আপনার দেবর আপনার অপেক্ষায় এতক্ষন ছিলো।”
নিহা হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
“না এসে পারা যায় দুলাভাই বলেন। যেই দুলাভাই এবং তাঁর হবু বউ বই মেলার আশেপাশেও যায় না তারা কিনা আজ আমায় সেদে নিয়ে যাচ্ছে, যাওয়া তো লাগেই বলেন।”
মেঘ হেসে বললো,
“হুম, রহস্য। আচ্ছা গাড়িতে বসো।”
নিহা পিছের সিটে বসে পাশে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আদ্রিজ বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে নিহার দিকে। নিহা যথাসম্ভব নিজের চোখ নামিয়ে নিল। লোকটার চোখে কিছু একটা আছে যা নিহাকে আকর্ষিত করে। নিহা কিছুটা গুটিয়ে বসলো। কেনো যেন হটাৎ লজ্জা অনুভব হচ্ছে। মেঘা হেসে আদ্রিজের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে লাগলো।
আদ্রিজ নিহার দিকেই তাকিয়ে আছে অপলক। তার প্রিয় কাঠগোলাপ যেনো তার এলোকেশীর মায়া আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিহাকে এই মুহূর্তে তার কাছে বউ বউ লাগছে। ইচ্ছে করছে তার এলোকেশীকে একদম নিজের করে নিতে।কিন্তু সে চাইলেই তো আর হবে না। তার মায়াবিনীর সম্মতিও লাগবে।
আদ্রিজ হেসে নিহার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। নিহা যেনো শিউরে উঠলো।
আদ্রিজ নিহার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারায় বুঝালো খুলে দেখতে।
নিহা কিছুটা আমতা আমতা করে কাগজটা খুললো।
“Will you be Mrs. Adrij Choowdury?”
নিহা যেনো অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। জীবনে প্রথম এইভাবে প্রপোজ করতে দেখেছে কেউ কাউকে। তাও আবার সেই ব্যাক্তিটা মিষ্টার আদ্রিজ চৌধুরী। নিহা কাপা কাপা হাতে কাগজের টুকরোটা আদ্রিজের হাতে দিয়ে দিলো। কাগজের টুকরোটার দিকে তাঁকিয়ে আনমনেই হেসে উঠলো আদ্রিজ। নিজেও ভাবে নি কখনো কাউকে এইভাবে প্রপোজ করবে।
বই মেলার সামনে এসেই মেঘ গাড়ি থামালো। নিহা তাড়াতাড়ি নেমে গেলো যেনো এতক্ষন এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল। আদ্রিজ নামতেই মেঘ নিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“ভাবী ভাইয়াকে সময় দেও। আমি একটু বেয়ানকে নিয়ে ঘুরে আসি।”
নিহা বোকার মতো মেঘের চলে যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। আদ্রিজ নিহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিহা চারপাশে তাকিয়ে দেখে মেয়েরা আদ্রিজের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নিহার হটাৎ কেন যেন রাগ হলো মেয়েগুলোর প্রতি। তবে রাগটাকে প্রশ্রোয় না দিয়ে তাকালো আদ্রিজের দিকে। আদ্রিজ নিহার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি রাগ লাগছে মেয়েগুলোর প্রতি!”
নিহা ভেবে পায় না লোকটা তার মুখ দেখে কিভাবে মনের কথা বলে দিতে পারে।
আদ্রিজ নিহার হাত ধরে মেলার এক প্রান্তে চুড়ির দোকানে নিয়ে গেল। দু মুঠো কাঁচের চুড়ি নিয়ে নিহার হাতে পরিয়ে দিতে লাগলো। নিহা তাকিয়ে রইলো অপলক আদ্রিজের দিকে। কেন যেনো লোকটাকে বাঁধা দিতে পারছে না। তবে না চাইলেও অনেক কিছুই করতে হয়। আদ্রিজের কথায় চোখ নামিয়ে নিল।
“মিস নিহা , কিছু বলছেন না কেন? চুড়ি পছন্দ হয়েছে নাকি চেঞ্জ করে নিবো। আসলে আপনার হাতে মনে হলো চুড়ি খুব মানাবে। আসলেই তাই।”
নিহা কিছু বললো না। আদ্রিজ নিহাকে বই এর দোকানে নিয়ে গেল।
“কি ব্যাপার বলুনতো মিস নিহা, যেইভাবে তাকিয়ে আছেন প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি আমার।”
নিহা চোখ নামিয়ে বললো,
“না…. নাহ্ তেমন কিছুনা। আপনার সাথে কথা আছে আমার।”
“সব শুনবো আগে আপনি আপনার পছন্দের বইগুলো নিয়ে নিন।”
নিহা বুঝতে পারলো এই লোক এখন কিছুই শুনবে না । দীর্ঘশ্বাস ফেলে বই কিনায় মনোযোগী হলো।
নিহা এবং আদ্রিজ বসে আছে একটি কফি শফে।
নিহা বলতে চেয়েও কেনো যেনো কিছুই বলতে পারছে না। সংকোচ নাকি ভয় কিছুই বুঝতে পারছে না।
আদ্রিজ নিহার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো দিলেন নাহ মিস নিহা।”
নিহা নিজেকে সহজ করে বলে উঠলো,
“কেন চাইছেন আমায় বিয়ে করতে?”
“বলবো না ভালোবাসি। কারণ ভালোবাসা শব্দটা চার অক্ষরের হলেও এর মর্মতা অনেক। আমি চাইছিনা আমার অনুভূতি গুলো এতো সহজে প্রকাশ করতে। তবে আপনি যদি বলেন তাহলে আমি অন্যভাবে প্রকাশ করে দেখাতে পারি।”
“নাহ্। আপনার এই অনুভূতি গুলো নিজের করে নেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই মিস্টার চৌধুরী। আপনি হয়তো এতক্ষণে আমার সম্পর্কে সবটা জেনে নিয়েছেন। কোথায় আপনি আর কোথায় আমি। আপনার সাথে আমাকে কখনোই মানাবে না। আপনাকে নিয়ে অনেক রূপবতী, হাই এডুকেটেড, হাই সোসায়টির মেয়েরা সপ্ন দেখে। আমি সেখানে কিছুই না।আপনি ওদের মতোই কাউকেই ডিজার্ব করেন। যদিও আমার আপনার বয়সটা আবেগের না, তবুও বলবো আমার উপর আপনার জাস্ট আবেগ তৈরী হয়েছে। কিছুদিন পর তা এমনিতেই কেটে যাবে। আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার সাথে আমাকে কোনদিক দিয়েই যায় না।”
এই বলে নিহা কফি শফ থেকে বের হয়ে গেল।
আদ্রিজের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। সানগ্লাস হাতের মুঠোয় ভেঙ্গে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই। কানে নিহার বলা কথাগুলোই বাঁজছে। তার অনুভূতি গুলোকে আবেগ বলে চলে গেলো এইটা জেনো সে কিছুতেই মানতে পারছে না। ফোন বাজছে সেদিকেও কোনো খেয়াল নেই।
আদ্রিজের হটাৎ মনে হলো নিহা একা বের হয়ে গেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে অনেক আগেই।
তাড়াতাড়ি কফি শফ থেকে বের হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো নিহাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আদ্রিজ ভাবলো হয়তো নিহা রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে গেছে।
আদ্রিজের তবুও কেনো যেন মনে হচ্ছে নিহা বিপদে পড়েছে। তবে ভাবনাকে ততটা গুরুত্ব দিলো না ।
মেঘকে ফোন দিয়ে সবটা জানিয়ে আদ্রিজ সেই স্থান প্রস্থান করলো।
*
*
কিছুক্ষন হলো নিহার জ্ঞান ফিরেছে। মাথাটা কেমন ঝিম মেরে আছে। হাত পা নাড়িয়ে বুঝতে পারলো তাকে চেয়ার জাতীয় কিছু একটার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ মুখও বেঁধে রাখা হয়েছে। নিহা বুঝতে পারছে কেউ তাকে এইভাবে কেনো বেঁধে রেখেছে।
তার যতদূর মনে আছে সে কফি শফ থেকে বের হয়ে রাস্তায় রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল।
হটাৎ একটা কালো গাড়ি তার সামনে এসে কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ একজন তার মুখে কিছু একটা স্প্রে করে দিয়েছিল।
হটাৎ নিহা শুনতে পেল কেউ একজন গটগট পায়ে তার দিকেই হেঁটে আসছে। ঠিক তাঁর সামনে এসেই পায়ের শব্দ থেমে গেল। নিহা ভয়ে ঘামতে লাগলো ।
কানে ভেসে আসলো পুরুষনালী কণ্ঠস্বর।
“Welcome……Welcome to my home Miss Niha Khan.”#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ১০
#মাহিয়া_মুন
নিহা ভয়ে ঘামতে লাগলো। সে বুঝতে পারছে না সামনে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটি কে। তাকে কেনোই বা এইভাবে নিয়ে আসা হল। তবে মিস নিহা খান বলে যে তাকেই সম্মধন করা হয়েছে এইটা বুঝতে বাকি রইলো না নিহার। তবে বুঝতে পারছে না তাকে খান উপাধিতে কেনো ডাকলো। কারো সাথে এইরকম কোনো শত্রুতা আছে বলেও মনে পড়ছে না নিহার।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটির কথায় নিহা নিজের হাত মুচরাতে লাগল।
“কেমন আছো নিহা মামনি? ভালোই আছো নিশ্চয়ই। ঊনিশ বছর শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরলে, ভালো তো থাকবেই। কষ্ট হচ্ছে এখন, এই তোরা চোখ – মুখ এর বাঁধন খুলে দে মিস নিহা খানের। তার জন্য সারপ্রাইজ আছে।সেইটা দেখতে হবে তো তাঁর।”
নিহা অনুভব করলো কেউ একজন মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে চোখের বাঁধন খুলছে।
হালকা কেশে উঠলো নিহা। চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। শরীর অসাড় হয়ে আসছে যেনো। শরীলে কোনো শক্তি পাচ্ছে নাহ।
তার সামনে দেওয়ালে পাঁচ জন ব্যাক্তির ছবি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে দুটি ছবি নিহার খুবই পরিচিত। যেই ছবি দুটো ছোটো থেকে দেখে আসছে। যেই ছবি দুটো দিয়ে অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়েছে নিহার।
ছোট দুটি বাচ্চার ছবি, যেই ছবি দুটি তার গলায় পরিহিত লকেটে আছে।
নিহা বুঝতে পারলো এইখানে একজন সে এবং বাকিজন তার ভাই যার নাম লকেটে দেওয়া আছে নিহান।
তার পাশেই একজন শ্যামবর্ণা মহিলার ছবি। নিহার চোখ আটকে গেল মহিলার ছবিতে। কেন যেন মনে হচ্ছে সে এই মহিলাকে কোথাও দেখেছে। কিছুক্ষন ভাবতেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অবাধ্য পানি। মুখ দিয়ে অকপটে বেড়িয়ে আসলো একটি শব্দ।
“মা”
নিহা বুঝতে পারলো সে দেখতে তার মা এর মতই হয়েছে।
নিহা নিজেকে সংযত করে পাশের ছবিটিতে তাকালো।
একজন সুদর্শন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তির ছবি।খুশিতে চোখে পানির ঝর্না দেখা দিল যেন। এই ব্যাক্তিটি তার বাবা নিশ্চয়ই। তার ভাই তার মানে বাবার মতোই হয়েছে দেখতে।
নিহা আবারো পাশের সর্বশেষ ছবিটিতে তাকালো। একজন ষাটোর্ধ্ব লোকের ছবি। লোকটাকে অনেকটাই বাবার মত দেখতে। তাহলে কি লোকটা তার দাদা ভাই।
নিহা নির্জীব তাকিয়ে রইলো ছবিগুলোর দিকে। খুশিতে চোখের পানি বাঁধ মানছে না। অবশেষে কি পেয়ে গেল নিজের পরিবারকে। অপেক্ষার প্রহর কি তাহল শেষ হতে চলেছে।
নিহা যখন মগ্ন তার পরিবারের ছবি দেখতে তখনি তার সামনে এসে বসলো সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরিহিত একজন লোক।
লোকটি নিহার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“কি মামনি চিনতে পেরেছো ছবিতে থাকা লোকগুলোকে?”
নিহা লোকটার দিকে তাঁকিয়ে বুঝলো একটু আগে কথা বলা ব্যাক্তিটাই এই লোকটি। লোকটার দৃষ্টি দেখে নিহার রাগে শরীর কাপতে লাগলো।
লোকটি আবারো বলে উঠলো,
“নিশ্চই চিনতে পারো নি। আমিই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। এইযে ছোট কিউট মেয়ে বাচ্চাটা হলে তুমি মানে মিস নিহা খান। এইটা তোমার ভাই মিস্টার নিহান খান। এই সুন্দর মায়াবী মহিলাটি হলো তোমার মা মিসেস প্রার্থনা খান। আর এই পুলিশের পোশাক পরিহিত ব্যাক্তিটি তোমার বাবা, আমার প্রধান শত্রু, S.H.O মিষ্টার নোমান খান। এই বৃদ্ধ তোমার দাদা মিস্টার মইনুল খান। কি চমকে গেলে। আর একটু চমক নেও, আমারতো চমক দিতে ভালই লাগে।”
এই বলে লোকটি পকেট থেকে বন্দুক বের করে পরপর দুটি গুলি করলো নিহার বাবা এবং দাদার ছবিতে।
নিহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।
লোকটি উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বললো,
“কিছুই বুঝতে পারো নি তাইনা, গুলি মারা এই দুটো ছবির মানুষকে এর থেকেও ভয়ঙ্কর মৃত্যু দিয়েছি। রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছি এই দুজনের।”
এই বলে লোকটা হাসতে হাসতে হটাৎ নিহার বাম হাত বরাবর গুলি করে দিলো।
নিহা ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। তবে চিৎকার দিলো না। চোখ মেলে আবারো তাকালো নিজের বাবা এবং দাদার ছবির দিকে। ভাবতে পারছে না এরা আর নেই। একটু আগেই তো কত খুশি হয়েছিল কিন্তু …….
আর কিছু ভাবতে পারলো না। নিহার মনে হচ্ছে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। জ্ঞান হারিয়ে চেয়ার থেকে নিচে পড়ে গেল।
*
*
সকালের মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। প্রতিটি দিনের শুরু হয় কারো হাসি আনন্দ বা কারো দুঃখের মাধ্যমে।
চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে চিন্তিত মুখে বসে আছে সবাই। মেঘা অনুপমা চৌধুরীর বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে। কান্নার ফলে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর। তার বাবা মা এখনো এসে পৌঁছায় নি।
আদ্রিজ নিচের দিকে তাঁকিয়ে বসে আছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। হটাৎ একটি কাঁচের গ্লাস হাতের মুঠোয় নিয়ে ভেঙে ফেললো। হাতে গ্লাস এর কাঁচ ভাঙা ডুকে গেল।
সবাই চমকে তাকালো আদ্রিজের হাতের দিকে। আদ্রিজ এর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তার বুক কাপছে। তার মায়াবতীর এখন কি অবস্হা। কোথায় আছে?
মেঘ দৌঁড়ে এসে আদ্রিজ এর হাত ধরে বললো,
“এসব কি ভাই , তোমায় কতবার বলবো তোমার জন্য হয়নি কিছু।”
আশা চৌধুরী রেগে বলে উঠলেন,
“ওর জন্যই হয়েছে। তোমাদেরকে এতো অতিরিক্ত কে করতে বলেছিল? আমায় জানাতে , আমার কথা কখনোই ফেলতনা নিহা। তোমাদের জন্য এসব হয়েছে। মেয়েটা কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে আল্লাহ্ জানে।”
আদ্রিজ হটাৎ মেঘকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
মেঘ সহ পরিবারের সবাই চমকে উঠলো। তারা ভাবতে পারে নি আদ্রিজ এইভাবে জড়িয়ে যাবে নিহার মায়ায়।
মেঘেরো চোখে পানি চলে আসলো। ছেলেদের কাদতে নেই। মেঘ ভাইকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।I
আজিজ চৌধুরী ছেলেদের কাছে এসে বললেন,
“কান্না করে কিছু হবেনা। পুলিশ এর আশায় থেকে লাভ নেই। যা করার আমাদের করতে হবে। মেঘ আদ্রিজ এর হাতে ব্যান্ডেজ করে দেও। হাত থেকে রক্ত পড়ছে প্রচুর।”
*
*
নিহা আসতে আসতে চোখ মেলে তাকালো। হাতে আর মাথায় ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো হালকা হালকা রক্ত পড়ছে। মাথায় হাত দিয়ে বুঝলো রক্ত জমাট হয়ে আছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল তাকে একটা রুমে আটকে রাখা হয়েছে। তবে হাত-পা বাঁধে নি।
রুমে ছোট একটি জানালা আছে। হালকা হালকা সূর্যের আলো আসছে। নিহা বুঝলো সকাল হয়ে গেছে। রাতের কথা মনে হতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। মানতেই কষ্ট হচ্ছে তাঁর বাবা এবং দাদা কে আর দেখতে পাবে না। নিজেকে সংযত করে ভাবলো,
“লোকটা শুধু বাবা এবং দাদার কথা বলেছে। তার মানে ভাই এবং মা বেচেঁ আছে। তারা কোথায়? আর লোকটাই বা আমার থেকে কি চায়? লোকটার থেকেই সবটা কৌশলে জানতে হবে।”
নিহা আসতে আসতে জানালার কাছে গিয়ে এক হাতে জানালা টা খুলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই পারলো না।
হাতের দিকে তাঁকিয়ে দেখলো আবারো রক্ত পড়ছে। শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে হাতে পেঁচিয়ে নিলো।
নিহা অনুভব করলো তার শরীলের তাপমাত্রা প্রচুর। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। না চাইতেও নিহার চোখ বেয়ে পড়তে লাগল পানি।
মেঘার কথা খুবই মনে পড়ছে। মেয়েটা না জানি কেঁদে কেটে কি অবস্হা করেছে নিজের। আদ্রিজ এর কথা মনে হতেই হাতের দিকে তাকালো। চুড়িগুলো প্রায় ভেঙ্গে গেছে। কিছু চুড়ি এখনো আছে।
আর কি তাদের দেখা পাবে?
নিহা দেখলো রুমের দরজা কেউ খুলছে। গত রাতের সেই লোকটিকে আসতে দেখে নিজেকে ভালোভাবে ডেকে নিল। এই বাপের বয়সী লোকটার নজর যে খুবই খারাপ সেটা নিহা বুঝতে পেরেছে কাল রাতেই। লোকটা যে কিছুটা সাইকো।
লোকটি নিহার সামনে বসে বলে উঠলো,
“গুড মর্নিং মিস নিহা খান। এইটা তো একদম ঠিক কাজ করলে না। সামান্য হাতে গুলি লাগায় অজ্ঞান হয়ে গেলে। আমিতো ভাবলাম কাল রাতে একটু………”
নিহা রেগে তাকিয়ে রইলো বাবার বয়সী এই নিকৃষ্ট লোকটার দিকে।
লোকটি হেসে বললো,
“রেগে যাচ্ছ মামনি। কি বলোতো তোমার নরম তুলতুলে হাত…… ইসস”
“লজ্জা লাগে না নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে এসব বলতে। নিজের মেয়ে হলে কি করতেন?”
নিহা কথাটি বলতেই সামনের লোকটি নিহার গাল চেপে ধরে বললো,
“একদম আমায় জ্ঞান দিতে আসবি না। চুপচাপ এই পেপার্স এ সাইন করে দে।”
এই বলে লোকটি নিহার গাল ছেড়ে দিল। নিহার চোখ পানিতে ভরে উঠলো। পেপার্স এর দিকে তাকিয়ে বুঝলো এইগুলো কোনো প্রপার্টি পেপার্স।
লোকটি আবারো বলে উঠলো,
“কি হল সাইন করো মামনি।”
নিহা তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকিয়ে বললো,
“এইগুলো তো প্রপার্টি পেপার্স। আমি কেনো সাইন করবো?”
“কারণ এই পেপার্স এ লিখিত প্রপার্টি গুলো তোমার। আর সাইন করে তুমি সেইগুলো আমার নামে করে দিবে।”
নিহা কিছুক্ষন চুপ থেকে তাকিয়ে রইলো পেপার্স গুলোর দিকে।
“আমি সেইটা কেনইবা করবো?”
লোকটি হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
“রাইট, তুমি সেইটা কেনো করবে। চলো তোমায় একটা গল্প শুনাই।”
নিহা তাকালো লোকটির দিকে।
#চলবে
#চলবে