ভালোবাসার প্রজাপতি পর্ব -০৭+৮

#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ৭
#মাহিয়া_মুন

নিহা এবং মেঘা চৌধুরি বাড়িতে প্রবেশ করে বুজতে পারলো তাদের আসতে অনেকটাই দেরি হয়েছে।
শাড়ি পরা নিহার পছন্দের হলেও আজ এইখানে শাড়ি পরে আসার ইচ্ছে ছিল না তার।
মেঘা শাড়ি পড়ায় তাকেও জোরপূর্বক পরতে হলো।
চারিদিকে তাকিয়ে বুজতে পারলো অনেকেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা বিব্রতবোধ করলো নিহা।
মেঘা মেঘকে তার বন্ধুদের সাথে দেখতে পেয়ে নিহাকে নিয়ে মেঘের আড়ালে দাড়ালো।
মেঘ তার বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল।
হটাৎ কেউ তার চোখ ধরায় প্রথমে খানিকটা চমকালেও পরবর্তীতে হেসে মেঘার হাত ধরে তাকে সামনে নিয়ে আসে।
নিহা সহ মেঘের বন্ধুরাও হেসে উঠলো।
মেঘ বলে উঠলো,
“এতো দেরি কেনো করলে তোমরা বলোতো ?”
মেঘা হতাশ কণ্ঠে বললো,
“বাসা থেকে ঠিক সময়ে বের হয়েছিলাম কিন্তু রাস্তায় জ্যামে আটকে গেলাম। আদ্রিজ ভাইয়া কি পার্টি তে চলে এসেছে ?”
“হ্যা , একটু আগেই এসেছে। আরে নিহা কেমন আছো?”
নিহা হালকা হেসে বললো,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া আপনি কেমন আছেন?”
“তোমার বোন এর প্যারায় আর ভালো থাকা। আচ্ছা চল মা আর বড় আম্মু তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল।”
এই বলে মেঘ নিহা এবং মেঘাকে নিয়ে প্রস্থান করলো।

আদ্রিজ দূর থেকে সবটাই লক্ষ্য করেছিল।
আদ্রিজের বুঝতে অসুবিধা হল না যে কালো শাড়ি পরা মেয়েটার নাম নিহা এবং মেঘের চোখ ধরা মেয়েটা মেঘা।কাল শুনেছিলো কয়েকবার তার মা এর কাছ থেকে।
আদ্রিজ নিজের মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করছে।
চোখের পাতায় বার বার এলোকেশী মায়াবতীর সেই লম্বা চুল , হৃদয় নিংড়ানো মায়াময় মুখশ্রী হানা দিচ্ছে। হৃদয়ের অনুভূতিগুলো বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলছে যেন।
এ কেমন মোহিনী…..!

আদ্রিজ নিজেই নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে পড়ল।
আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে দেখে তার মাঝে এইরকম অদ্ভুত অনুভূতি হয় নি।
কিছুক্ষন থম মেরে দাড়িয়ে থেকে সে দাদুর কাছে চলে গেলো।
আদ্রিজের বন্ধুরা তার যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মেঘের সাথে দাড়িয়ে থাকা কালো শাড়ি পরা মেয়েটার দিকে আদ্রিজের ঐভাবে তাকিয়ে থাকা , সবটাই তারা এতক্ষন লক্ষ্য করেছিল।
তাদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তাদের বন্ধু কোনো মেয়ের দিকে এইভাবে তাকিয়ে ছিলো। যেই ছেলের কাছে মেয়েদেরকে এলার্জি মনে হয় সে কিনা……..
জিসান হেসে বলে উঠলো ,
“আমাদের গম্ভীর বন্ধুটার জীবনেও কেউ আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি।”

নিহা এবং মেঘা আশা চৌধুরী এবং অনুপমা চৌধুরীর সাথে কথা বলছে।
নিহা মেঘার দিকে তাঁকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো ,
“এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না। যেই পরিবারে কিছুদিন পর বউ হয়ে আসবে সেই পরিবারের দাদুর খবরই এখনো জিজ্ঞেস করে নি। ”
হতাশা পূর্ণ নিঃশ্বাস ফেলে নিহা শান্ত গলায় বলে উঠলো,
“আন্টি দাদুকে দেখছিনা কেনো? দাদু কোথায়?”
আশা চৌধুরী নিহার দিকে তাঁকিয়ে হালকা হেসে বলে উঠলেন,
“মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো না। তোমরা আসার আগেই উপড়ে চলে গেছেন। তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল । তুমি আর মেঘা মেঘের সাথে গিয়ে দেখা করে আসো।”
নিহা এবং মেঘা চলে যেতেই অনুপমা চৌধুরী বলে উঠলেন,
“ভাবী , মেঘা এবং নিহাকে খুব তাড়াতাড়ি বউ করে নিয়ে আসা উচিত। আমার তো খুব ভালো লাগে এই দুজনকে।”
আশা চৌধুরী হতাশ কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“সেইটা তো আমিও চাই ছোট । কিন্তু আদ্রিজ কেমন ছেলে জানিস তো। কারো কথা শুনবেনা। ”

মেঘ নিহা এবং মেঘাকে নিয়ে দাদুর রুমের দিকেই যাচ্ছে। তবে তার এখন মেঘার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে ইচ্ছে হচ্ছে।
মেঘা খুব একটা শাড়ি পরে নাহ। আজকে মেঘের অনেকবার করে বলায় শাড়ি পরেছে , নিহাকেও পড়িয়েছে।
মেঘ নিহাকে ডেকে বলে উঠলো,
” নিহা তুমি যাও দাদুর কাছে। আমি আর মেঘা একটু পর আসছি।”
নিহা হেসে দাদুর রুমের সামনে গিয়ে দরজায় হাত দিয়ে খোলার আগেই কেউ একজন দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো।
নিহা তার বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই সামনে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটি তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
নিহা নিজের কোমড়ে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে যেন বরফের নেয় জমে গেছে।
অবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে আদ্রিজকে দেখতে পেয়ে আরো অবাক হয়ে গেলো।
আদ্রিজ অপলক তাকিয়ে রইলো নিহার দিকে।
অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়ে। মায়াবী চোখের মায়ায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টির অতল গভীরে। কপাল এর ছোট কালো টিপটা যেন মায়া বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে তার এলোকেশী মায়াবতীর।
নিহা অবাক হওয়ার থেকেও এখন ভয় হচ্ছে যদি না আবারো চড় মারে তাকে।
আশেপাশে আরো কয়েকজনের চোখ যেন বেড়িয়ে আসবে।
মেঘা এবং মেঘ মাত্রই ছাদের দিকে যাচ্ছিল তবে নিহার হালকা চিৎকারে পিছে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে যেন তাদের চোখ বেড়িয়ে আসবে।
জিসান এসেছিল আদ্রিজকে ডেকে নিয়ে যেতে।
তার চোখের সামনে ঘটা দৃশ্য দেখে সে বিশ্বাস করতে পারছেনা নিহার কোমড় জড়িয়ে রাখা ছেলেটা তার বন্ধু আদ্রিজ।
নিহা বুজতে পারলো অনেকেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আদ্রিজকে সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে ফেললো।
আদ্রিজেরও এতক্ষনে হুস এসেছে যে সে কি করেছে।
সবার দিকে একবার তাকিয়ে বাঁকা হেসে নিহার দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়লো।
নিহা ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো । অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আদ্রিজের দিকে।
সবাইকে আরো অবাক করে দিয়ে নিহার সামনে চলে আসা চুলগুলো কানে গুঁজে দিল। মুখে ফু দিয়ে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো,
” এইভাবে প্রত্যেকবার বাঁচানোর জন্য কি আমি থাকবো?”
নিহা যেন জমে বরফ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হচ্ছে নাহ। আদ্রিজ তার অনেকটা কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় আদ্রিজের নিঃশ্বাস তার মুখে পড়ছে।
আদ্রিজ হেসে নিহার নাক টেনে দিয়ে সেই স্থান প্রস্থান করলো।
আদ্রিজের যাওয়ার দিকে মেঘা, মেঘ এবং জিসান বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।
মেঘ হটাৎ বুকে হাত দিয়ে বললো,
“পানি পানি…………..
জিসান পানি নিয়ে এসে মেঘকে দিয়ে হাসতে লাগলো।
মেঘ পানি খেয়ে বলে উঠলো,
“এইটা কি ছিলো ভাই। আমি যা দেখসি তোমরাও কি তাই দেখছো ? ওইটা আদ্রিজ ভাই ছিলো তো……..”
জিসান হাসতে হাসতে বললো,
“হ্যা, আদ্রিজই ছিলো। তুমি এইটুকু দেখেই অবাক হয়ে যাচ্ছো। বাকিটা শুনলে কি করবে ?”
“মানে?”
জিসান রাস্তায় ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং পার্টি ফ্লোরে আদ্রিজের নিহার দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকা সবটাই বললো।
সব শুনে মেঘের চোয়াল ঝুলে পরার মতো অবস্থা হয়েছে।
জিসান নিহার দিকে তাঁকিয়ে মেঘ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“তোমার শালীকা তোমার ওই গম্ভীর ভাই এর হৃদয়ে ভালবাসার অনুভূতির বীজ রোপণ করে দিয়েছে নিজের অজান্তেই। এখন শুধু #ভালবাসার_প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ানোর অপেক্ষা।”
*
*
*
রাত পেরিয়ে সকালের মিষ্টি রোদের আলোয় সম্পূর্ণ রুম আলোকিত হয়ে উঠলো।
আড়মোড়া শোয়া থেকে উঠে বসলো নিহা। পাশেই মেঘা ঘুমাচ্ছে। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে এখনো কলেজ যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় আছে।
নিহা ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় দাড়ালো। শেষ রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে আছে।
কাল রাতে মেঘ তাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছিলো।
সেইখানে থাকতে ডিনার এর সময় আরো একবার আদ্রিজের মুখাপেক্ষী হয়েছিল।
লোকটা তার দিকে অদ্ভুত স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।
নিহা সেই দৃষ্টির মানে অল্প হলেও বুজতে পেরেছে। কিন্তু সে চায়না এরকম কিছু হোক। তার মতো পিতামাতাহীন মেয়ের কারো সাথে নিজেকে জড়ানোর কথা চিন্তা করাও বৃথা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলায় হাত দিয়ে একটি লকেট নিয়ে চোখের সামনে ধরলো।
লকেট টাতে এক পাশে একটি ছোটো দুই বছরের বাচ্চা ছেলের ছবি এবং অন্য পাশে ছেলেটার মতো দেখতেই একটি মেয়ের ছবি।
মেয়েটির ছবির উপরে লেখা নিহা এবং ছেলেটির ছবির উপরে লেখা নিহান।
এতিমখানার মাদার তাকে বলেছিল একদিন ভোরবেলা এতিমখানার দারোয়ান বাজারে গিয়ে লোকজনের মাধ্যমে শুনতে পায় একটি বাচ্চা মেয়ে নদীর পাশে পাওয়া গেছে এবং মেয়েটির পাশে ছিলো অনেক রক্ত ।
লোকজন অনুমান করে ছিলো যে সেইখানে কাউকে মারা হয়েছে এবং তা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে কারণ লোকজন অনেক খুঁজেও আশেপাশে কাউকে পায় নি।
দারোয়ান মাদার কে এসে বলার পর মাদার তাকে সেইখান থেকে এতিমখানায় নিয়ে আসে।
নিহা জানেনা সেইদিন কার রক্ত ছিলো তবে মনে হয় আপন কেউ ছিলো তার।
চোখের কার্নিশ এ জমে থাকা জল মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না ঘরে চলে গেলো সকালের নাস্তা তৈরি করার জন্য।

মেঘ, মেঘা এবং নিহা ক্যান্টিনে বসে আছে।
মেঘ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
“নিহা ভাবী হবে আমার।”
নিহা চমকে মেঘের মুখের দিকে তাকালো।
“মানে……”
“মানে আমার ভাই এর বউ আমার ভাবী হবে?”
নিহা গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো,
“মজা নিচ্ছেন ভাইয়া।”
“নাহ , একদম নাহ কোনো মজা নিচ্ছি না।”
“দেখুন ভাইয়া আপনার ভাই এবং আমার সাথে যা হয়েছে সবটাই আমাদের অজান্তে কাকতালীয় ভাবে। তারপরও যদি আপনার ভাই আমায় পছন্দ করে ফেলে আমি বলবো সেইটা ক্ষণিকের ভালোলাগা, মোহ। আপনার ভাই এর সাথে আমার কোনো দিক দিয়েই যায় না। আপনার ভাই এর জন্য কত শত মেয়ে পাগল আর সেই জায়গায় আমি কি ? ”
এইটা বলে নিহা উঠে ক্লাস এর দিকে চলে গেল।
মেঘ হেসে বলে উঠলো,
“আমার ভাই এই প্রথম কোন মেয়ের দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। তুমি তার প্রথম ভালো লাগা, মোহ।তার ভালবাসায় তোমায় পরাজিত হতেই হবে নিহা।”
*
*#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ8
#মাহিয়া_মুন

“আমার জীবনে প্রিয় মানুষ, প্রিয় জিনিস বেশিদিন টিকেনি। প্রিয় সবকিছু হারিয়ে কত বাচ্চা মানুষের মতো হাউমাউ করে কান্না করছি হিসেব নেই।
এই হারিয়ে ফেলার নিয়মটা আমার ছোট বেলা থেকেই হয়ে এসেছে। বাবা-মা কে হারিয়ে নিঃস্ব হলাম।
কাঁচের চুড়ির মতো ভেঙে চুরমার হয়েছি আবার সুপারগ্লু আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়েছি নিজেকে।
আমিই আমার অভিভাবক হয়ে গোল টেবিলে বসে বুঝিয়েছি,
_জীবন এতো ছোট না, জীবন কেবল মাত্র শুরু।
করুণা আমার মোটেও পছন্দ না। এজন্য নতুন কারো সাথে পরিচয় হয়ে মায়ায় জড়াতে চাই না।
মায়া জিনিসটা খুব খারাপ। মায়া কাটিয়ে উঠতে পারি না আমি।
পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলে ভেঙে পরি আমি। কষ্ট হয় খুব।
একা থাকতে থাকতে রোবটের মত হয়ে গেছি আমি। সুদর্শন অবহেলিত রোবট।
সব পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়লেও , চিল কিন্তু একাকী উড়ে। চিলের মতো নিঃসঙ্গ জীবন আমার।
একাকীত্ব দেহের আষ্টেপৃষ্ঠে নিয়ে হাসতে পারলেই জীবন অদ্ভূত সুন্দর।”
কথাগুলো বলে হালকা হাসলো নিহা।
নিহাল অপলক তাকিয়ে রইলো নিহার সেই বিষাদময় হাসি যুক্ত মুখমণ্ডলের দিকে।
নিহা আবারো মলিন হেসে বলে উঠলো,
“তোমাকে আমার পথ চলার সঙ্গী করতে চেয়েছিলাম,
রাতের অন্ধকারে চাঁদের আলোয় আলোকিত নির্জন রাস্তায় তোমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে চেয়েছিলাম।
আমার চক্ষুদ্বয়ের শান্তি, আমার সকালের মিষ্টি হাসির কারণটা তোমায় বানাতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু আফসোস আমার জীবনে প্রিয় শব্দটাই থাকতে চায় না। তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না শুধু একটা প্রশ্নই রয়ে গেল আমার মনের অন্তরালে,
আমাকে আগে কেনো জানালে না?
জানো যেইদিন গ্রামের বাড়িতে মেঘার কাজিন এর বিয়েতে বর সেজে লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে থাকা কনের পাশে তোমায় দেখেছিলাম,
আমি থমকে গিয়েছিলাম, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো, চারদিকে অন্ধকার দেখছিলাম।
আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। যাকে আমি বর সেজে আমার জন্য দেখতে চেয়েছিলাম, সে বর ঠিকই সাজলো তবে সেইটা অন্যের জন্যে ।
আমি এখন ভাল আছি। জীবনে আরো ভাল থাকার চেষ্টা করবো। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।

…… নিজেকে বদলাও….!
…… ভাগ্য নিজেই বদলে যাবে….!

নিহাল কিছু বলতে পারলো না। পার্কের পশ্চিম পাশে বেঞ্চের দুই প্রান্তে দুজন নীরব রইলো। নিহালের ফোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো দুজনেরই।
নিহাল হাতে ফোন নিয়ে দেখলো তার নববধূর নামটি জ্বলজ্বল করছে ফোনের স্কিনে।
নিহাল কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিহা বলে উঠলো,
“ভাল থেকো। বিয়ে হয়ে গেছে তোমার, বউকে সময় দেও। আমার সাথে বেইমানি করেছো কিন্তু তার সাথে কইরো না। আমাদের দেখা হবে হয়তো কোনো গলির মোরে, ব্যাস্তময় নগরের কোন এক যানজটময় রাস্তায়। তবে আমরা আজ থেকে একদমই অপরিচিত।
তোমার বৈবাহিক জীবন হয়ে উঠুক সুন্দরময়।”
নিহাল কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো নিহার দিকে, কিছু না বলে বের হয়ে গেল পার্ক থেকে।

নিহালের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো।
আজ ঐশীকে পড়ানোর পর ঐশীর মা পুরো মাসের বেতনটা দিয়ে বলেছিল ঐশীকে আর পড়াতে না যেতে। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিল ঐশীর স্কুল টিচার রাখবে তার জন্য।
হয়তো তিনি জানতে পেরেছেন নিহালের সাথে সম্পর্কের মারপ্যাঁচটা।
নিহা নিজেও চাইছিল না ঐশীকে পড়াতে।
কিন্তু তার পড়ালেখার খরচ এবং এই ব্যাস্ত ঢাকা শহরে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে টিউশন গুলো খুবই দরকার ছিল তার।
যদিও মেঘার বাবা মা না বলে এসব করতে, কিন্তু নিহা চায়না আর্থিকভাবে কেউ তাকে সাহায্য করুক।
মেঘার বাবা মা তাকে যতটা ভালোবাসে সেটাই অনেক তার জন্য।
এই শহরে প্রয়োজন ছাড়া কেউ প্রিয়জন হতে চায়না।
মেঘার পরিবারটায় আছে যারা তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে নিজের দ্বিতীয় মেয়ের স্থানে বসিয়েছেন ।
নিহা ঐশীকে পড়িয়ে পার্কে এসেছিল একটু একাকী সময় কাটানোর জন্য। তখনি নিহালের সাথে দেখা হয়ে যায়।
আবহাওয়া খুবই খারাপ। যেকোনো সময় চলে আসবে বারিশ। পার্কের সবাই বের হয়ে যাচ্ছে।
নিহা আজ চাইছে বৃষ্টিতে নিজেকে ভেজাতে, নিজের মনে গাঁথা চাপা কষ্টগুলো বৃষ্টির পানিতে বিলিয়ে দিতে।
বলতে না বলতেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টির ফোয়ারা নামতে লাগল। পরিবেশ যেনো এক নিমিষেই শান্ত হয়ে গেল।
নিহা খোলা আকাশের দিকে তাঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির পানিতে নিজের কষ্টগুলো বিলিয়ে দিতে লাগলো।
কিছুক্ষন পর অনুভব করলো বৃষ্টির পানি তার শরীলে পড়ছে না , কপাল কুঁচকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার মাথার উপরে ছাতা। পাশে তাকাতেই চোখ যেন স্থির হয়ে গেল।
একজোড়া গভীর কালো স্নিগ্ধ শীতল চোখ অদ্ভূত মোহনীয় দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
এই সময় এই অবস্থায় আদ্রিজকে তার পাশে দেখে অনেকটাই চমকালো যা তাঁর দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে।
হটাৎ আদ্রিজের রাশভারী কণ্ঠ কানে আসলো,
“বৃষ্টিতে কেনো ভিজছেন মিস নিহা? অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজে শরীল খারাপ করার ইচ্ছে আছে নাকি।”
নিহা শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীল ভালোভাবে ঢেকে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
“নাহ্ আসলে হটাৎ বৃষ্টি চলে আসবে বুঝতে পারি নি। আপনি এইখানে…………”
“হ্যা, অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম এই রাস্তা দিয়েই। বৃষ্টির তীব্রতায় গাড়ি পার্ক এর পাশে দাঁড় করিয়ে ছিলাম । তখনি পার্ক এর পশ্চিম পাশে বেঞ্চে বসে থাকা বৃষ্টিতে ভেজা এলোকেশী আমার নজর কাড়লো। যে গতকাল এক দেখতেই আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। গাড়ির মধ্যে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।”
নিহা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। কেন যেন রাগ দেখাতে পারছে না, লজ্জা অনুভূত হচ্ছে।
আদ্রিজ চারদিকে তাকিয়ে দেখলো পার্কের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছেলে বাজে দৃষ্টিতে নিহার দিকে তাঁকিয়ে আছে। আদ্রিজ নিহার দিকে তাঁকিয়ে বুঝতে পারলো ছেলেগুলোর ঐভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ।
নিহা বৃষ্টিতে ভিজায় কলা পাতা রঙের শাড়িটি লেপ্টে আছে শরীলে।
আদ্রিজ চোখ বন্ধ করে রাগকে নিয়ন্ত্রন করে নিজের কোর্টটা নিহার গাঁয়ে জড়িয়ে দিল।
নিহা চমকে আদ্রিজের দিকে তাকালো। আদ্রিজ রাগি চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
নিহা ভাবলো,
“আমি আবার কি করলাম যে রেগে তাকিয়ে আছে। আবার থাপ্পড় মারবে নাকি।”
আদ্রিজ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“বৃষ্টিতে ভিজে পার্কে ছেলেদের নিজের দেহ দেখানোর ইচ্ছে হয়েছে নাকি?”
নিহা কিছুই বুঝতে পারলো না। হটাৎ পার্কের পাশে থাকা ছেলেগুলোর দিকে নজর পড়তেই বুজতে বাকী রইল না আদ্রিজের বলা কথাটি। আদ্রিজের এইভাবে বলায় কেন যেন অভিমান হলো।
আদ্রিজ বুজতে পারল এইভাবে বলায় তার এলোকেশীর অভিমান হয়েছে। কিছুক্ষন চুপ থেকে হটাৎ করেই নিহাকে কোলে তুলে নিলো।
নিহা যেন অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। সারা শরীল শিরশির করে উঠলো। ও কল্পনা করতে পারেনি এরকম কিছু হবে।
আদ্রিজ গাড়ির কাছে এসে নিহাকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো। নিহার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে এখনো তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। নিহার অবাকতা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে আদ্রিজ কিছুটা নিহার দিকে ঝুঁকে পড়লো।
নিহা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
আদ্রিজ অপলক তাকিয়ে রইলো নিহার বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ মায়াবী মুখের দিকে। নিহাকে ভয় পেতে দেখে হালকা হেসে তার মুখে ফুঁ দিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে সরে আসলো।
নিহার অবাকটা যেন কাটছেই না। আদ্রিজের দেওয়া কোর্ট থেকে মাতাল করা ঘ্রান যেন নিহার মস্তিষ্ক অচল করে দিচ্ছে। আদ্রিজ নিহার কার্যকলাপ দেখে বাঁকা হাসলো।
নিহাদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে নিহার দিকে তাকালো। নিহাও তাকাতেই দুজন চোখাচোখি হয়ে গেল। নিহা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ভাবতে লাগল ,
“লোকটাকে সাদবো নাকি, যতই হোক মেঘ ভাইয়ার বড় ভাই।”
আদ্রিজ মুচকি হেসে বলে উঠলো,
“কি ভাবছেন মিস, আমায় সাদবেন নাকি তাইতো।”
নিহা অবাক হয়ে বললো,
“নাহ্ মানে হ্যা , আসলে ….. আপনি বুজলেন কিভাবে?”
আদ্রিজ নিহার কানের কাছে এসে ঠান্ডা শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো,
“যাকে এক দেখাতেই হৃদস্পন্দন বেরে গেল, মনের অনুভূতি গুলো উন্মুক্ত হয়ে গেল তাকে তো বুঝতেই হবে তাইনা।”
নিহা চোখ বন্ধ অবস্থায় হালকা কেপে উঠলো। আদ্রিজের নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে পড়ছে।
আদ্রিজ নিহার কাছ থেকে সরে বলে উঠলো,
“আজ যাবো না, অন্য কোন সময় স্থায়ী হয়ে যাবো। যান বাসায় গিয়ে চেঞ্জ করে নিন তাড়াতাড়ি ।”
নিহা কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। কিছুদূর গিয়ে কিছু একটা ভেবে পিছে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিজ এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হালকা হেসে ধন্যবাদ দিয়ে বাসার ভিতরে চলে গেলো।

মেঘা নিহাকে দেখে রেগে বলে উঠলো,
“এই তোর কাছে ফোন নামে যে একটা বস্তু আছে সেইটা কি মনে থাকে না। কতবার ফোন দিয়েছি, চিন্তা হয়না বুঝি আমার। আর এতক্ষন কই ছি……..এই এই তোর গায়ে এই কোর্ট, এই কোর্ট তো ছেলেদের, আর তুই বৃষ্টিতে ভিজেছিস কেন?”
নিহা হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
“এক সাথে এতো প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর দিবো বলতো। আমি চেঞ্জ করে এসে বলছি।”
এই বলে নিহা নিজের রুমে চলে গেল । মেঘা নিহার যাওয়ার দিকে বোকার মত তাকিয়ে রইলো।

সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে রাতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিজ । কল্পনায় বিচরণ করছে তার স্নিগ্ধ এলোকেশী মায়াবতী। ইচ্ছে করছে সামনে বসিয়ে রেখে অপলক তাকিয়ে থাকতে।
তবে সে বুজতে পারছে না কি করবে। আজকে পার্কে নিহার মুখটা খুব বিষাদময় লাগছিল তার কাছে। কিন্তু কেনো?”
আদ্রিজের নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে। কাধে কারো ছোঁয়া পেয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে মেঘ বসে আছে।
মেঘ বলে উঠলো,
“কি ভাবছো ভাইয়া, কখন আসলাম কিন্তু তুমি তোমার ভাবনায় বিভোর ।”
আদ্রিজ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“কিছুনা”।
“ভাই মিথ্যে কেনো বলছো। তোমায় কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট মনে হচ্ছে।”
আদ্রিজ মেঘের দিকে তাঁকিয়ে বললো,
“আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কি হয়েছে আমার। যেদিকে তাকাই মনে হয় তাকেই দেখি। কল্পনা জুড়ে তার বিচরণ, ঘুমোতে পারছিনা।”
মেঘ যেনো 480 বোল্টের শক খেয়েছে তার ভাই এর মুখে প্রেমময় কথা শুনে। মেঘ চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
“কাকে ভাইয়া, নাহ মানে কে সে যে কিনা আমার ভাই এর রাতের ঘুম কেড়ে নিল?”
আদ্রিজ কিছুটা আমতা আমতা করতে লাগলো। যতই হোক মেঘ তার ছোট ভাই । তবে মেঘের কাছ থেকেই নিহা সম্পর্কে জানতে হবে।
আদ্রিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোর শালীকা মিস নিহা , আমার এলোকেশী মায়াবতী।”
মেঘ শুনামাত্রই ঠাস করে সুইমিংপুলে পরে গেল।
আদ্রিজ জানত এরকম কিছুই হবে, বিরক্ত চোখে তাঁকিয়ে রইলো মেঘের দিকে।
মেঘ হাসতে হাসতে বললো,
“সরি ভাই , এতো বড় শকটা নিতে পারলাম না । আমিতো সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে শালীকাকে ভাবী ডাকতে হবে ভাবি নি। কিন্তু আমি খুব খুশি।”
আদ্রিজ গম্ভীর হয়ে বললো,
“মজা নিচ্ছিস ‘”
“না না ভাইয়া আমিতো অতিরিক্ত খুশি হয়ে গেছি।”
আদ্রিজ চোখ রাঙিয়ে বললো,
“মিস নিহার সম্পর্কে আমায় সবটা বল। ”
মেঘের মুখের হাসিটা কিছুটা মলিন হয়ে গেল। এরপর বলতে লাগল নিহার সম্পর্কে সে যতটা জানে। সবটা শুনে আদ্রিজের চোখ লাল হয়ে গেল। মেঘ তার ভাই এর মনের অবস্থা বুজতে পারলো।
মেঘ তার ভাই এর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
“ভাইয়া নিহাকে আমি আমার বোন ভাবি, বোনের মতো ভালোবাসি। ওর ভাই হয়ে তোমায় বলছি , নিহার মনের চাপা কষ্টগুলো যদি তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে দূর করতে পারো তাহলে বলবো তাকে আমার ভাবি বানিও। আর নাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে আনিও।”
এই বলে মেঘ চলে গেলো ।
আদ্রিজ মেঘের যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হাসলো। তার ভাই এর নিহার প্রতি এতটা ভাই এর মত ভালোবাসা দেখে সে অনেকটাই খুশি হলো।
ফোনের স্কিনে নিহার পার্টি তে তোলা একটি পিক এর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
_আমার এলোকেশী, তোমায় আমি জোর করে নিজের করবোনা। আমার ভালবাসা দিয়ে তোমার মন জয় করবো। তোমার ইচ্ছায় তোমাকে নিজের করে নিবো। এক দেখাতে তোমার মায়ায় জড়িয়ে ফেললে আমায়। এতটা মায়াবিনী কেনো হলে? হুমায়ূন স্যার এর একটা কথা না খুব মনে পড়ছে।
_তোমার যদি কাউকে মনে পড়ে……
_ তাহলে তুমি তাকে কল করো…….
_তোমার যদি কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে……
_তাহলে তুমি তাকে জানাও…….
_তুমি যদি কাউকে ভালোবেসে থাকো……
_তাহলে তাকে বলে দেও…………!
_কারণ 5 মিনিট বাঁচবে কিনা……..
_সেটা তুমি জানো না……….
_অপূর্ণতা নিয়ে কখনো দুনিয়া ছেড়ো না …..

#চলবে
*
(আসলামু আলাইকুম)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here