#ভালোবাসি_তোমায়
#A_mysterious_love_story
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_১০
রুম থেকে এক দৌড়ে সিঁড়ির কাছে এসে থামলো হুর।
-“বাব্বাহ কি বাঁচা বাঁচলাম! মনে হচ্ছিলো এতক্ষন বা’ঘের খাঁচায় ছিলাম। ধুরু ভাল্লাগেনা ছাই! আমার চাল আমার উপরে উল্টো পড়লো! ”
-“কিরে আপাই তুই এখানে দাঁড়িয়ে একা একা কি বিড়বিড় করছিস! আর এই দিকে আমরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়’রান হয়ে গেলাম। ”
নিজের কপালের ঘাম মুছার ভান করে বললো হৃদ।
-“তাই তো কই ছিলি তুই। আমরা হুট করে দেখি তুই নেই আমাদের সাথে। আমরা তো একটু ছাদে গিয়েছিলাম। এরপর নেমে তোকে কতো খুজলাম! এই ফ্লোরেও তো তোকে দেখলাম না! ”
বললো লিয়া।
হুর মনে মনে চিন্তা করলো এখন এদের কিছু বললে তাকে নিয়ে হাসা-হাসি করবে। হুর জোড় করে হেসে বললো,
-“আরেহ আমি তো এখানে এই ফ্লোরেই ছিলাম। তোরা হয়তো ঠিকভাবে দেখিস নাই। তাই খুঁজে পাস নি। হেহে। আচ্ছা চল আমরা নিচে যাই। অনেকক্ষণ তো হলো। বাবা-মা নিশ্চই আমাদের খুঁজছে। ”
-“হ্যা ঠিক বলেছিস। চল নিচে যাই আমরা। ”
——————————————————————–
-“ভাইয়া ফাইয়াজ এর সাথে কথা বলেছিলেন আমাদের বাড়িতে থাকার ব্যাপার নিয়ে!”
-“হ্যা আপা কাল রাতে কথা বলেছিলাম ওর সাথে। ছেলে তো আমার মানতেই চাচ্ছিলো না। অনেক বোঝানোর পর রাজী হয়েছে। ”
-“ভাইয়া আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ফাইয়াজ এর কোনো অযত্ন আমি হতে দেবো না। ”
হেসে বললেন মিসেস হেনা।
-“হ্যা আপা আপনাদের কারণেই তো একটু চিন্তা কমলো আমার। আমার ছেলের কোনো অযত্ন আপনারা করবেন না আমি জানি। ”
সবাই নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে লাগলো। মিস্টার হাসান, মিস্টার ফরিদ আর লিয়ার বাবা মিস্টার লাবিব নিজেদের বিসনেস নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। এর মাঝে নিচে নেমে এলো হুর, হৃদ আর লিয়া।
-“কিরে এতক্ষনে তোদের নিচে আসার সময় হলো!”
-“এইতো আম্মু একটু ঘুরে আসলাম। আচ্ছা আঙ্কেল ফাইয়াজ ভাইয়া কোথায়। আসার পর মাত্র একবার দেখেছিলাম। আর দেখলাম না। ”
মুখ টা ছোট করে বললো হৃদ।
-“দেখো তোমার ভাইয়া মনে হয় রুমে বসে কাজ করছে। তার কাজই ঐটা। হয় অফিসে কাজ করা নয়তো বাসায় বসে কাজ করা। ”
জবাব দিলেন ফরিদ সাহেব।
এমন সময় ফাইয়াজ নিচে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি কথা হচ্ছে আমাকে নিয়ে!”
হৃদ গাল ফুলিয়ে বললো,
-“আরেহ ভাইয়া তুমি এসেছো!তোমাকে আসার পর থেকে কতো খুঁজলাম। কিন্তু তোমার দেখা পেলে তো!”
ফাইয়াজ আলতো হেসে বললো,
-“আমার চ্যাম্প টা বুঝি আমাকে অনেক মিস করেছে! ভাইয়া তো একটা জরুরী কাজ করছিলো তাই নিচে আসে নি! এখন সব কাজ কমপ্লিট করে এসেছি। বাকি পুরো টাইম তোমাকে দিবো কেমন!”
হৃদ একগাল হেসে বললো,
-“ওক্কে ভাইয়া। ”
হুর এর গা জ্ব’লে উঠলো হৃদ আর ফাইয়াজ এর কথা শুনে। সে আস্তে আস্তে ভে’ঙ্গ’চি দিয়ে বললো,
-“উউহ পিরিত কতো। ঢং যত্তসব। এমনভাবে ভাইয়া ভাইয়া করছে যেনো তার কয় জনমের ভাইয়া লাগে। এরপর আসিস খালি আপাই এর কাছে!”
মিস্টার ফরিদ এবার উঠে দাঁড়ালেন।
-“তো চলো সবাই। লাঞ্চ টা করে নেয়া যাক। ”
সবাই সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো ডাইনিং টেবিলে যাওয়ার জন্য। হুর দেখলো হৃদ আর লিয়া ফাইয়াজ এর সাথে একেবারে চিপকে আছে। যেনো তাকে চেনেই না। সে রা’গ করে ধূপধাপ পা ফেলে চলে গেলো আগে আগে।
হুরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লিয়া বলে উঠলো,
-“ম্যাডাম মনে হয় রে’গে গেছে রে হৃদ। বাসায় যাওয়ার পর আমাদের দুই জনের পিঠ ঠিক থাকলে হয়। আজকে মনে হয় পিঠের একটা হাড়গোড় ও আসতো থাকবে না।
হৃদ এর মুখটা ভ’য়ে চুপসে গেলো।
-“ঠিক বলেছো লিয়াপি। আমরা ওকে পাত্তা না দিয়ে ফাইয়াজ ভাইয়ার সাথে চিপকে আছি দেখে সেই চেতে’ছে। ”
ফাইয়াজ ওদের মুড ঠিক করার জন্য বললো,
-“আরে পেরা নেই চিল। আজকের মতো কোনোরকম সামলে নাও। কালকে থেকে তোমাদের বাঁচানোর দায়িত্ব আমার। ”
হৃদ আর লিয়া দুইজনই ভীষণ অবাক হলো। লিয়া বললো,
-“কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব ভাইয়া?”
-“কারণ কালকে থেকে আমি হৃদ দের বাড়িতে থাকবো। বাবা এক মাসের জন্য দেশের বাহিরে যাবে।তাই আমাকে বলেছে আমি যেনো এক মাস হৃদদের বাড়িতে থাকি।”
লিয়া আর হৃদ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তারা দুইজনই এই অল্প সময়ে ফাইয়াজ কে অনেক আপন করে নিয়েছে। আর ফাইয়াজও তাঁদের অনেক স্নেহ করে এই ব্যাপারটা তারা লক্ষ্য করেছে। তাইতো তারা এতো টা খুশি। দুইজনই এক্সসাইটেড হয়ে একসাথে বললো,
-“সত্যিই! yeh সেই মজা হবে। ”
ফাইয়াজ ওদের এক্সসাইটমেন্ট দেখে আলতো হাসলো।
-“মিস হুর কে তোমরা বলবে না যে আমি তোমাদের বাড়িতে আসছি কেমন! ঐটা তার জন্য surprise থাকুক। ”
-“ওক্কে ভাইয়া।
-“আচ্ছা চলো লাঞ্চ করতে। ”
———————————————————————
হুররা চলে যাবে এখন। তাদের বাবা-মা বিদায় নিতে ব্যস্ত। হৃদ আর লিয়াও তাদের সাথে আছে। এই ফাঁকে হুর আবার বাগানে চলে এসেছে। লাঞ্চ এর পর একবার এসেছিলো এখানে। এই বাড়ির বাগান টা তার খুব খুব পছন্দ হয়েছে। যদিও তার ছাদেও অনেক গাছ আছে। কিন্ত এতো না। বাহারী বাহারী ফুলের মিষ্টি ঘ্রানে সে মনে হয় পা’গল হয়ে যাবে। এমন সময় হুট করে কানে কেউ ফুঁ দেয়াতে লাফিয়ে উঠলো হুর। বুকে থুঁ’তু দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো ফাইয়াজ। হুর রে’গে গিয়ে বললো,
-“আপনি সবসময় এভাবে হুটহাট এটা’ক করেন কেনো! সমস্যা কি আপনার!”
-“হুটহাট এটা’ক না করলে তো তুমি ভ’য় পেতে না। তোমার ভ’য় পাওয়া ফেস টা দেখতে সেই লাগে। ”
হুর নাকের পাটা ফুলিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
-“হনুমান একটা। ”
ফাইয়াজ কাছাকাছি থাকায় ঠিকই শুনতে পেলো হুর কি বলেছে। সে হুরের নাক ফুলানো দেখে আলতো হাসলো যদিও সেটা হুরের দৃষ্টির অগোচরে।
-“তো মিস রা’ক্ষ’সী চলে যাচ্ছেন তাহলে! দেখা হচ্ছে কিন্ত আবার। ”
হুর যদিও বুঝতে পারলো না দেখা হচ্ছে বলার মানে তারপরও সৌজন্যতা বজায় রাখার জন্য বললো,
-“অবশ্যই দেখা হবে। এবার আমি যাই!”
হুর তার ফামিলির লোকেদের আসতে দেখে তাদের কাছে চলে গেলো। ফরিদ সাহেব কে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। আর ফাইয়াজ সে হুরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ তাদের গাড়ি দৃষ্টির অগোচর না হয়। তারপর মৃদু হেসে মাথা চুলকে বাড়ির দিকে চলে গেলো।
———————————————————————-
ঘুমাতে যাওয়ার আগে হুর ভাবলো,
-“আজকের দিনটা খুবই ভালো কেটেছে। শুধু ওই হনুমানটার সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো ছাড়া। বুঝি না সে সামনে আসলে আমার এতো অদ্ভুত লাগে কেনো! আর তার দৃষ্টি! যাই হোক এইসব বাদ দে হুর। এবার একটা সুন্দর স্লিপ দরকার। ”
লাইট নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো হুর।
————————————————————————–
রাত আড়াইটা। হুরের রুমের বেলকনির দরজা খুলে কেউ একজন রুমে প্রবেশ করলো। ধীর পায়ে হুরের বেড এর কাছে এসে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলো। হুরের মায়াবী মুখটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আরাম পেয়ে হুর আরও গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লো। হুরের বাচ্চামি দেখে নিঃশব্দে হাসলো লোকটা। আলতো স্বরে বললো,
-“তোমার অনেক বি’প’দ হুরপরি। তোমার এই পর্যন্ত কতবার ক্ষ’তি করার চেষ্টা করা হয়েছে তা তুমি ঘুনাক্ষরেও টের পাওনি। আর আমি চাই ও না এইসব হিং’স্রতা তোমার সামনে আসুক। কিন্তু আমার জানা নেই কতক্ষন তোমাকে এভাবে নিরবে বাঁচিয়ে যেতে পারবো। আমার তোমাকে নিয়ে খুব ভয় হয় জানো! যদি তোমার কিছু হয়ে যায়! আমি ম’রেই যাবো বিশ্বাস করো। যেদিন থেকে তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি সেদিন থেকে তুমি আমার জীবন হয়ে গেছো।
অচেনা লোকটা হুরের কপালে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে বললো,
-“তোমার কোনো ক্ষ’তি আমি হতে দেবো না। এরজন্য যতটা হিং’স্র হওয়া লাগে ততটা হবো। নিজের খুশির জন্য, নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য আমার তোমাকে চাই। কারণ তোমাতেই আমার জীবন, তোমাতেই আমার মর’ণ। ভালোবাসি আমার হুর কে। অনেক অনেক ভালোবাসি। ”
লোকটা হুরের কপালে আরেকটা গভীর চুমু খেয়ে সাবধানতার সাথে যেভাবে এসেছিলো সেভাবে চলে গেলো।
#ভালোবাসি_তোমায়
#A_mysterious_love_story
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_১১
সকাল সকাল ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে হুর। আজকে অনেক ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে প্লাস আগের দিন সে আর লিয়া দুইজনই ক্লাস মিস দিয়েছে। সেই পড়া অন্যদের খাতা থেকে তুলে নিতে হবে। তাই সময়ের অনেক আগেই যাবে বলে ঠিক করেছে সে।
হুর রেডি হয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলে চলে আসলো। এসে দেখলো হৃদ খাবার নিয়ে বসে আছে। হয়তো তার অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু হুর হৃদ কে পাত্তা দিলো না। সে নিজের চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ব্রেডে জেলি মাখিয়ে নিজের মতো খেতে লাগলো। আর বেচারা হৃদও মুখ টা ছোট করে খাওয়া শুরু করলো। বেচারার মন টা ভীষণ খারাপ। গতকাল আসার পর থেকে তার আপাই তার সাথে একটা কথাও বলে নি। আর সে নিজেও তার আপাই এর সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না। রাতে সে একবার গিয়েছিলো হুরের রুমে। কিন্তু ততক্ষনে হুর ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই নিজের রুমে চলে এসেছে। নাহলে সে মাই’র ও খেতে রাজী আছে; তারপরও তার আপাই তার উপর রা’গ করে না থাকুক এটাই সে চায়।
হুরের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় হৃদ হুট করে হুর কে জড়িয়ে ধরলো। বললো,
-“আপাই তুই এতো কেনো রা’গ করিস বল তো! তুই না আমার কিউট, সুইট আপাই! আর আমি না তোর একটা মাত্র গুলুগুলু ভাই! ”
হুর অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
-“আমি কারোর আপাই না। আর তুই ও আমার ভাই না। দূরে যা। একদম আমার সাথে কথা বলতে আসবি না। ”
হৃদ হুর কে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
-“সরি তো! আর রা’গ করিস না প্লিজ। তুই জানিস না আমি তোর সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না!”
-“কেনো কালকে তো ভালোই পারছিলি। আমাকে তো তখন চিনতিই না। আর এখন আসছিস এইসব বলতে। ছাড় আমাকে। দূরে গিয়ে বস যাহঃ!”
-“নাহ যাবো না। আমাকে মা’র তাও কথা বল। আর জীবনেও তোরে ইগনোর করমু না। সরি সরি সরি…. ”
হৃদ একাধারে হুরের কানের সামনে সরি বলেই যাচ্ছে। হুরের কানের পর্দা মনে হয় ফে’টেই যাবে। সে আর সহ্য না করতে পেরে চিৎকার করে বললো,
-“থাম! একদম নাটক করবি না। তোর এসব নাটক আমার মুখস্ত আছে। যা এবারের মতো মাফ করে দিলাম। কিন্ত এরপর থেকে যদি এমন করিস আর জীবনেও কথা বলবো না বলে দিলাম। ”
হৃদ বিশ্ব জয় করা হাসি দিলো। হুরের গালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
-“ওক্কে আর কখনো এমন করবো না। আর যদি করিও তাহলে আবার এভাবে রা’গ ভাঙাবো। ”
হৃদ একটা দাঁত কেলানি দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। হুর হেসে ফেললো ভাইয়ের পা’গলামো দেখে।সে খাওয়া শেষ করে মাকে বলে বেরিয়ে পড়লো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আজকে সে লিয়া কে নিয়ে যাবে না। একাই যাবে। তাই লিয়া কে না নিয়েই ভার্সিটি চলে গেলো হুর।
———————————————————————-
ভার্সিটি থেকে ফিরেছে হুর। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে হুরদের বাড়ি ফিরতে। অবশ্য এর জন্য লিয়া দায়ী। সে আজকে সারাদিন হুর কে জ্বা’লিয়েছে কারণ হুর তার উপর রে’গে ছিলো। কথা বলছিলো না। অনেক ক’ষ্টে বেচারি তাকে মানিয়েছে মনে করে মিটিমিটি হাসলো হুর। তারপর দুই বান্ধুবী মিলে প্রিয় পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলো তাই এতো লেট হয়ে গেলো।
হুর শাওয়ার নিয়ে একটু ঘুমিয়েছিলো। সেই ঘুম ভাঙলো রাত আট টায়। অবশ্য সে তার আম্মু কে বলেই ঘুমিয়েছিল যাতে কেউ তাকে বিরক্ত না করে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নিলো হুর। চুলে তোয়ালে পেঁচানো অবস্হায় ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই চুল এখনো ভেজা। তাই চুল ছেড়ে দিয়ে নিচে নামলো হুর। কিন্তু কারোর কোনো সারাশব্দ নেই। হুর বুঝলো তার আম্মু লিয়া দের বাড়িতে গেছে হয়তো আর হৃদ পড়তে বসেছে। সে সোজা কিচেন এ চলে গেলো। এক কাপ কফি করে তা নিয়ে ছাদে চলে আসলো। অসময়ে ঘুমানোর কারণে তার মাথা টা ভার হয়ে আছে। এখন কফি খেলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
ছাদের রেলিং ধরে সামনের রাস্তা দেখতে দেখতে কফি খেতে লাগলো হুর। স্নিগ্ধ পরিবেশ। হালকা বাতাস হচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার থাকায় ছাদ চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। হুট করে কেউ কানে ফুঁ দেয়ায় আঁ’তকে উঠলো হুর। ভ’য়ে হাত থেকে কফির মগ পড়লো তো পড়লো তাও সোজা পায়ে। ধোঁয়া ওঠা গরম কফি নিয়ে ছাদে এসেছিলো হুর। অল্প কিছুটা খাওয়ার পর আরও অর্ধেকের বেশি মগে ছিলো। একেতো এতো উপর থেকে মগ পড়ায় তার উপর গরম কফি পড়ায় পা যেনো জ্ব’লে উঠলো হুরের। ব্য’থায় গুঙিয়ে উঠলো হুর। ভ’য়ের বিষয়টাও মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো। চোঁখ জলে ভরে উঠলো। এমন সময় শুনতে পেলো পরিচিত কণ্ঠস্বর। তার সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা। অস্থির হয়ে তার পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার পা দেখতে লাগলো। তার পা থে’তলে ইতোমধ্যে নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। ব্য’থায় টনটন করছে। চোঁখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে হুর এর। অতিরিক্ত ব্য’থা সে সহ্য করতে পারে না। চোঁখ বন্ধ হওয়ার আগে দেখলো কেউ একজন তাকে পা’গলের মতো ডেকেই চলেছে। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে সে যতো ক’ষ্ট পেয়েছে তার দ্বিগুন ক’ষ্ট সামনের ব্যক্তি পাচ্ছে। আর চোঁখ খুলে রাখতে পারলো না হুর। ঢোলে পড়লো কারোর বুকে।
————————————————————————-
জ্ঞান ফেরার পর হুর দেখলো সবাই খুব চিন্তিত হয়ে বসে আছে। তার একপাশে তার মা, অপর পাশে বাবাই আর পায়ের কাছে হৃদ বসে আছে। সোফার সাইডে নজর যেতেই দেখলো ফাইয়াজ মাথা নিচু করে বসে আছে। হুরের প্রচন্ড চোঁখ জ্ব’লছে। চোঁখ খুলে রাখতে ক’ষ্ট হচ্ছে তার।
হৃদের হুরের দিকে চোঁখ যেতেই সে বলে উঠলো,
-“আপাই তুই উঠেছিস! জানিস আমি কতো ভ’য় পেয়েছিলাম।”
হৃদ এর কথায় সবাই হুরের দিকে তাকালো। হুরের বাবা হাসান সাহেব হুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“এখন কেমন লাগছে আম্মু! ইসস কি ব্যথা পেয়েছে আমার মামুনী টা। এসব কিভাবে হলো মা! আমাকে তো তোর আম্মু ফোন করে বললো দ্রুত আসতে। এসে দেখি তোর আম্মুর কা’ন্নাকা’টি করে অবস্থা খারা’প। ”
হুর দুর্বল কণ্ঠে বললো,
-“ভালো লাগছে বাবাই। আসলে কফির মগ টা আমার পায়ে পড়ে গেছিলো। প্রচন্ড ব্য’থায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম হয়তো। ”
হুরের আম্মু রে’গে গিয়ে বললো,
-“এই মেয়েটা কে নিয়ে আমি পারি না। আজকে ফাইয়াজ না থাকলে কি হতো ওর! ওভাবেই ছাদে পড়ে থাকতো। আমি তো বাসায় ও ছিলাম না। ”
হুর ফাইয়াজ এর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে একদৃষ্টিতে হুরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোঁখ টকটকে লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে র’ক্ত বের হবে। হুর ফাইয়াজ এর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার বাবাই কে জিজ্ঞেস করলো,
-“কয়টা বাজে বাবাই? ”
-“রাত এগারোটা বাজে আম্মু। তোমার প্রায় দুই ঘন্টা কোনো সেন্স ছিলো না। ব্য’থার কারণে তোমার শরীরে জ্বর চলে এসেছিলো। ডক্টর এসে ব্য’থা কমার ইনজে’কশন দিয়ে গেছে তোমাকে। ”
হুরের আম্মু বলে উঠলেন,
-“ফাইয়াজ বাবা তুমি এবার রেস্ট নাও কেমন! আজকে এমনিতেই তোমার অনেক পরিশ্রম হয়েছে সব ঠিকঠাক করতে। তুমি তোমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”
ফাইয়াজ মাথা ঝাকিয়ে একবার হুরের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
———————————————————————
নিজের রুমে এসে স্বজরে দেয়ালে একটা ঘু’ষি মার’লো ফাইয়াজ। হাত ফেটে র’ক্ত গড়াতে লাগলো কিন্তু তাতে তার কোনো হেলদোল নেই। নিজের মাথার চুল খা’মচে ধরে বিড়বিড় করে বললো,
-“আমি কিভাবে এতো টা কেয়ারলেস হতে পারলাম! কিভাবে! আমার ভুলের জন্য কতো টা s’uffer করতে হচ্ছে মেয়ে টাকে। ”
নিজেকে স্বাভাবিক করে ফ্রেস হতে চলে গেলো ফাইয়াজ।
———————————————————————-
মিসেস হেনা খাবার নিয়ে ফাইয়াজ এর রুমে এসে দেখলেন ফাইয়াজ ল্যাপটপ এ কাজ করছে। তিনি ফাইয়াজ এর হাতে ব্যা’ন্ডেজ লক্ষ্য করে অ’স্থির হয়ে উঠলেন। ফাইয়াজ এর হাত ধরে বললেন,
-“বাবা কি হয়েছে তোমার হাতে! কিছুক্ষন আগেও তো দেখলাম না। ”
-“আন্টি অস্থির হবেন না। আসলে হাতে একটু ব্যথা পেয়েছি। ”
-“বুঝলাম না কি হচ্ছে আজকে! প্রথমে মেয়েটা এখন তুমি। আচ্ছা বাবা তুমি তো খেতে পারবে না। আসো আমি খাইয়ে দেই। ”
-“নাহ আন্টি সমস্যা নেই আমি চামচ দিয়ে খেতে পারবো। আপনি প্লিজ হুরের কাছে যান। ”
-“ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি বাবা। আর ডাক্তার একটা ঘুমের ওষুধ ও দিয়েছিলো। তাই গভীর ঘুমে আছে। আর ব্যথাও বলে এখন কিছুটা কম আছে। কোনো সমস্যা হবে না। তুমি আসো। তোমাকে খাইয়ে দেই। ইস কতো ব্যথা পেয়েছো!”
মিসেস হেনা ফাইয়াজ কে যত্ন সহকারে খাওয়াতে লাগলেন। ফাইয়াজ এর মনে হচ্ছে সে নিজের মায়ের হাত থেকে খাবার খাচ্ছে। তার চোঁখ জলে ভরে উঠলো। মায়ের হাতে খাওয়ার সৌভাগ্য তার কখনো হয়ে ওঠে নি। মিসেস হেনা ফাইয়াজ এর চোঁখে জল দেখে উত্তে’জিত হয়ে পড়লেন।
-“কি হয়েছে বাবা! তোমার কি ঝাল লাগছে বা অন্য কোনো সমস্যা হচ্ছে আমাকে বলো!”
-“আন্টি আপনি উত্তে’জিত হবেন না। আসলে কখনো মায়ের হাতে খাওয়ার সৌভাগ্য হয় নি তো তাই একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। আপনার কাছ থেকে একটা মা মা গন্ধ পাচ্ছি।”
-“আমি তো তোমার মায়েরই মতো। আর কি আপনি আপনি করছো এখন থেকে আমাকে মামুনী বলবে আর তুমি করে বলবে। ”
-“তাহলে মামুনী তোমাকেও কিন্তু আমাকে তুই করে বলতে হবে। ”
-“বলবো অবশ্যই বলবো। এবার জলদি খাওয়া শেষ করে একটু রেস্ট কর। অনেক তো কাজ করলি। ”
ফাইয়াজ আলতো হেসে খেতে লাগলো।
———————————————————————
দুইদিন হয়ে গেছে হুর ভার্সিটি যায় না। তার পায়ের ব্য’থা এখন অনেকটা নেই নেই হয়ে গেছে। এই দুইদিনে ফাইয়াজ এর সাথে তার অনেক ভাব হয়েছে। ফাইয়াজ এই দুইদিনে কতো ভাবে যে সরি বলেছে তার হিসাব নেই। আজকে হুর ভার্সিটি যাবে। রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখলো ফাইয়াজ আর লিয়া গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হুর ওদের দেখে মুখ বাঁকা করলো। লিয়ার সামনে এসে বললো,
-“ভার্সিটি যাবি না! চল যাই আর কতো গল্প করবি!”
ফাইয়াজ গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললো,
-“গাড়িতে ওঠো। ”
হুর অবাক হয়ে বললো,
-“আপনার গাড়িতে কেনো উঠবো!? ”
-“কারণ আজকে আমি তোমাদের ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবো। আমার অফিস ঐদিকেই পড়ে। তাহলে একসাথে যেতে সমস্যা কোথায়? সুযোগ পেলে নিয়েও আসবো। লিয়া তোমার কোনো সমস্যা আছে এতে? ”
লিয়া উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
-“নাহ ভাইয়া কি যে বলেন কোনো সমস্যা নেই। আমি তো আরও খুশি। দোস্ত তুইও রাজী হয়ে যা। আমরা গল্প করতে করতে ভার্সিটি যাবো। প্লিজজ প্লিজজ। ”
হুর কিছুক্ষন চিন্তা করে বললো,
-“আচ্ছা ঠিক আছে। এবার তাহলে যাওয়া যাক। ”
হুর আর লিয়া দুইজনই পিছনে বসতে নিলে ফাইয়াজ বললো,
-“দুইজনই পিছনে বসছো! নট ফেয়ার। আমি কি তোমাদের ড্রাইভার নাকি! একজন সামনে এসে বসো।”
লিয়া বললো,
-“দস্ত তুই একটু কষ্ট করে সামনে বস। তুই তো জানিস আমি সামনে বসতে পারি না।”
হুর আর কি করবে! চুপচাপ সামনে গিয়ে বসে পড়লো। গাড়ি ভার্সিটির সামনে থামতেই নেমে পড়লো লিয়া আর হুর। ফাইয়াজ ও সাথে নামলো। হুর আর লিয়া ফাইয়াজ এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনে আগাতেই দেখলো সব মেয়ে হা করে পিছনের দিকে তাকিয়ে আছে। লিয়া হুর কে ধাক্কা দিয়ে বললো,
-“দেখসোস সবগুলা কেমনে লু’চ্চার মতো তাকায় আছে ফাইয়াজ ভাইয়ার দিকে!”
হুর বললো,
-“বাদ দে। চল আমরা ক্লাসে যাই। ”
———————————————————————–
ভার্সিটি ছুটির পর বের হতেই লিয়া বায়না ধরলো তাকে ঝালমুড়ি খাওয়াতে হবে। ঝালমুড়িওয়ালার দোকান রাস্তার অপর সাইডে। হুর বললো,
-“আচ্ছা তুই দারা এখানে। আমি নিয়ে আসছি। ”
হুর দুইদিকে তাকিয়ে রাস্তা ক্রস করতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ করে লিয়ার চিৎ’কার শুনে পাশে তাকাতেই দেখলো একটা গাড়ি সর্বোচ্চ গতিতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। লিয়া বারবার চি’ল্লিয়ে তাকে সরতে বলছে। কিন্তু হুর নড়তে পারছে না। ভ’য়ে হাত-পা জমে গেছে বলে মনে হচ্ছে তার। শেষ বারের মতো লিয়ার দিকে তাকিয়ে চোঁখ বন্ধ করে নিলো হুর। চোঁখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল। আজকেই হয়তো তার জীবনের শেষ দিন। একে একে বন্ধ চোঁখের পাতায় ভেসে উঠলো নিজের বাবা-মা, ছোট ভাই আর সবশেষে নিজের প্রিয় মানুষটার ছবি।
তাহলে কি এখানেই হুরের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে?
চলবে?
(