ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব ২৪

#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন

পর্ব— ২৪

রোদেলা সোফায় একপাশ হয়ে শোয়ে এক ধ্যানে হাসনাতকেই দেখছে!!! আর হাসনাত পরম নিশ্চিন্তে ঘুৃমাচ্ছে। রোদোলার বড্ড রাগ হলো তার ওপর.. এতো কিসের ঘুম এই ছেলের!! তারসামনে যে একটা সুন্দর মেয়ে সাদাপরী সেজে শুয়ে আছে সেদিকে যেন তার কোন খেয়াল নেই!! বুড়ো একটা…এইবলে রোদেলা মুখ বাকালো.. শেষপর্যন্ত একটা রসকসছাড়া দামড়া ছেলের সাথে প্রেম হয়েগেল তার!! চরম হতাশা নিয়ে রোদেলা আস্তে আস্তে চাদর সরিয়ে ফ্লোরে পা রাখলো… তারপর পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে হাসনাতের কাছে গেল.. তার যে বড্ড হাসনাতকে জড়িয়ে ধরে ঘুৃমানোর লোভ হচ্ছে.. সে বিরবিরিয়ে বলল– হেই হিটলার,, আমি চকলেট খুব ভালোবাসি.. আর তোমাকে দেখলেই চকলেট মনে হয় আমার!! বড্ড লোভ হয় আর সে লোভ সামলাতেই পারি না আমি… আমি আমার লোভ নিভারন করবো আপাতত!!যা হয় হোক!
এইবলে সে গুটিশুটি মেরে হাসনাতের বুকের ওপর গিয়ে শুয়ে পড়লো.. হাসনাত একপাশ হয়ে শুয়ে ছিল.. রোদেলা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল.. তারপর হাসনাতের বুকে মাথা গুঁজলো.. নাক ঘসলো তার লোমশবুকে.. অদ্ভুত মাতালমিশ্রিত অনুভূতিতে কেপে ওঠলো সে এতে!! পরম আবেশে চোখ বুজলো সে.. আর মুহুর্তেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো তার চোখে …
অন্যদিকে হাসনাত!! যে এতোক্ষন শুধু ঘুমানোর ই এক্টিং করেছে!! তার অবস্হা কতোটা খারাপ সেইটা শুধু সেই ধারনা করতে পারে.. মেয়েটা ঘুৃমোতেই জোরে নিশ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল সে..
—এই মেয়েটা কি নিজের কাণ্ডজ্ঞানগুলোও ফুচকার ভিতর পুরে খেয়ে ফেলেছে?? মেয়েটার চটপটির কম পড়লে আমাকে বলতে পারতো আমি কিনে দিতাম.. নিজের কান্ডজ্ঞান গুলো কেন খেতে গেল….
এইসব ভাবতে সে আবার নিজেকে জোড়ে ধমকে দিল.. কি সব বলিস তুই হাসনাত!!! তোর এইসব উদ্ভট চিন্তাধারার দেখে কেউই বলবে না তুই একটা প্রফেসর….এইসব ভাবতে ভাবতে সে আস্তে আস্তে রোদেলার দিকে তাকালো… একদম বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে শোয়ে আছে তার বুকে!!!. রোদেলার গরম নিশ্বাস হাসনাতের বুকে পড়ছে আর তাতে শিহরিত হচ্ছে সে বারবার.. সে রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল– আমাকে এতো এলোমেলো কেন করেদিস তুই.. এইভাবে কোন ছেলেকে ধরে নাকি… আমাকে কি টেরিবেয়ার পেয়েছিস?? মানুষ আমি.. রক্ত চলাচল করে আমার শরীরে.. সাথে হরমোনও..
তারপর বড় একটা নিশ্বাস ফেলে রোদেলার কপালে গভীর চুমু একে দিল সে.. তারপর বুকের সাথে মিশিয়ে নিজেও ঘুৃমিয়ে পড়লো…

তামান্না রুমে এসে রোদেলাকে খুজতে লাগলো.. মেয়েটাকি কাপুরের মতো উবে গেল… সে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা কাগজ পেল.. যেখানে রোদেলা লিখে গেছে.. আমি অন্যদের সাথে ঘুমাতে যাচ্ছি… এইটা পড়তেই তামান্নার মধ্যে হালকা অপরাধবোধ কাজ করলো। কাজটা সে ঠিক করলো না.. মেয়েটাকে এভাবে একা রেখে চলে গেলসে . ইশ কোথায় ঘুমিয়েছে কে জানে.. এইসব ভাবতে ভাবতে সে ও ঘুমিয়ে পড়লো….

সকালের স্নিগ্ধ আলো পর্দার পাশ গলিয়ে হাসনাতের মুখের ওপর এসে পড়লো..মূহুর্তেই হাসনাতের ঘুম ভেঙ্গে গেল.. তার অন্ধকারে ঘুৃমানোর অভ্যাস… সে আলতো করে চোখ খুলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল.. নাকের কাছে মিষ্টি একটা স্মেলের সাথে বুকের ওপর ভারী ভারী অনুভব হতে লাগলো তার… সে অবাক হয়ে নিজের বুকের ওপর তাকালো!! আর তাকানোর সাথে সাথে তার পুরো মনটা মুগ্ধতায় বিরজিত হলো.. সূর্যের আলোয় রোদেলার কালোচুলগুলো চিকচিক করছে আর একগুচ্ছ চুল তার মুখের ওপর ছেয়ে আছে.. কালো সাদা মিক্স হলে যে এতো সুন্দর কম্ভিনেশন হয় তা এখন ওকে না দেখলে কেউ বোঝতেই পারবে না… সাদা কামিজে আরো বেশি শুভ্রতা বিরাজ করছে তার মাঝে.. এতোটা মায়াবী কেন এই মেয়েটা!! এইসব ভাবতে ভাবতে সে আনমনে পলকহীন দৃষ্টিতে রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো…

রোদেলা হঠাৎ চোখ খুলে অবাক হয়ে গেল.. সে অাচমকা চিৎকার করে বলল– আপনি আমার সাথে কি করছেন? আমার রূমে?? কেউ দেখলে কি ভাববে??
হাসনাত যেন মুহুর্তেই বেকুব বনে গেল!! এই মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে তার জানা কথা কিন্তু এতো বেশি সেইটা তো সে জানতোই না.. সে তাড়াতাড়ি রোদেলার মুখ চেপে ধরলো.. রোদেলা পিটপিট করে হাসনাতের দিকে তাকালো..
—- হাসনাত ভাইটা এতো সুন্দর কেন!! এইযে ব্রু কুঁচকে আমার দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে.. আর সাথে তার লম্বা নাকটার কিছু অংশ আমার গালের সাথে লাগছে তাতেও তাকে কতোটা ভালো লাগছে তা কি সে জানে!!!! নাকি সবটাই এই হ্যান্ডসাম ছেলের অজানা…
যখন রোদেলা এসব ভাবতে ব্যাস্ত সেইখানে হাসনাত ব্রু কুঁচকে বলল– এইভাবে স্কেন করছিস কেন আমাকে?? ছেলে কি আগে দেখিস নি কখনো…
রোদেলা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল..ইশ্ কি লজ্জা!! এইভাবে কি কেউ কাউকে বলে.. ছেলেটার মুখে যে কিছুই আটকাই না.. রোদেলার মুখ ভার করে বলল– আমি কাউকে স্কেন করছি না.. আর আমি এই বিছানায় কিভাবে এলাম??
হাসনাত কোমড়ে হাত গুঁজে রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল– এইজন্যই তোকে বলি বেশি বেশি বাদাম খা, স্মৃতিশক্তি বাড়বে.. তুই তো শুনিসই না. এইযে এখন তুই নিজে নিজে হাটি হাটি পা পা করে আমার বিছানায় এসে আমাকে অজগর সাপের মতো পেঁচিয়ে কুম্ভকর্নের মতো ঘুৃমিয়ে ছিলি আমি কি কিছু বলেছি?? ওল্টা এখন সে আমাকে শুনাচ্ছে…
রোদেলা জিব্হা কেটে নিচের দিকে তাকালো.. তার যে লজ্জা লাগছে এইসব শুনে.. বড্ড লজ্জা!! আর হাসনাত অবাক হয়ে তার মায়াবতীর লাজুক মুখখানার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে.. এতোটা মায়া কেন এই মায়াবতীর মায়াবী সেই মুখটিতে,, কাজলবিহীন সেই চোখে,, গোলাপের পাপড়ির মতো সেই ঠোটে…!!!!!
হঠাৎ রোদেলা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল– কে কাকে স্কেন করছে.. খুব জানি আমি.. দেখছি আমিও.. হাসনাত আমাতাআমাতা করে বলল– আসলে.. না মানে..চোখের সামনে আসমানের হুর দেখলে কে বা না তাকিয়ে রই??
হাসনাতের এমন কথা যেন রোদেলা লজ্জায় রাঙ্গা হতে লাগলো। সে আনমনে ভাবলো— আজ যে এই কিউট হিটলারের কি হলো শুধু তাকে লজ্জায় রাঙ্গা করছে!!! । আর হাসনাত সেদিকে তাকিয়ে রোদেলার সেই লজ্জা রাঙ্গা চেহারার প্রেমে বারবার পড়তে লাগলো.. লজ্জাবতী গাছের মতো যেন লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে মেয়েটি.. হাসনাত পরম আবেশে একপা দুপা করে সামনে এগুতে লাগলো… আর রোদেলা পিছুতে পিছুতে দরজার সাথে মিশে গেল.. তার হার্টবিট হঠাৎ অতিরিক্ত বাড়তে আরম্ভ করলো..এতোটা যেন বেরিয়ে চলে আসবে.. আচমকা সে দরজাটা খুলে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল.. আর হাসনাত নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে লাজুক হাসি দিল…

হোটেলের রেস্তুরা শাখায় তারা সবাই খেতে বসেছে.. সকালটা বুফে তাদের.. যার যা ইচ্ছা নিয়ে খাওয়া.. এইটা হোটেলের পক্ষ থেকেই.. রোদেলা গরম নান আর হালকা ভেজিটেবল নিল.. চিকেনটা বড্ড খেতে ইচ্ছে করছে তার.. মনে হচ্ছে চিকেন তাকে “”” একবার আজা আজা “” গান গেয়ে ডাকছে.. কি অদ্ভূত রোদোলার কানেও সেই গানটাই বাজছে.. সে পরপর কয়েকটা ঢুক গিলল.. না সে খাবে না এইসব.. অনেক তেল এই ফ্রাই এ.. আর রোদেলা শুধু ওয়েটলস করতে চাই হাসনাতের হয়তো এমন ওয়েটের মেয়ে পছন্দ না.. এইসব ভাবতে যেই সে টেবিলে বসতে যাবে হাসনাত হঠাৎ তার সামনে এসে প্লেটে একটা চিকেনফ্রাই আর একবাটি গোলাপজামোন ধরিয়ে দিল.. রোদেলা অসহায় দৃষ্টিতে হাসনাতের দিকে তাকালো… হাসনাত মুচকি হেসে বলল– কারো জন্য নিজেকে পাল্টানোর দরকার নেই.. যে তোমাকে এইভাবে প্রছন্দ করে.. তাকে পছন্দ করবে তুমি.. কারন ভালবাসাটা শর্তহীন.. কোন কিছুর বিনিময়ে যদি ভালোবাসাটা চাওয়া হয় তাহলে সেইটা ভালোবাসা নয় এডজাস্টমেন্ট…
এই বলে হাসনাত হেসে বেরিয়ে গেল আর রোদেলা আনমনে তাকিয়ে রইলো তার যাবার পানে.. সে আনমনে বিড়বিড়িয়ে বলল– তোমাকে ভালোবাসি আমি,,, ভালোবাসি তোমার অস্তিত্বকে.. আর তোমার জন্য হালকা পাল্টানোটা আমার কাছে এডজাস্টমেন্ট না বরং সেইটাই আমার কাছে বড় প্রাপ্তির অভিরক্তি!!!

খাওয়া দওয়া শেষ করে সবাই ঘুরতে বেরিয়ে গেল.. তারা প্রথম গেল রাজবাড়িতে.. বাড়িটা অদ্ভূত সুন্দর.একতলা একটা বাড়ি যার ভিতরটা অনেক পরিপাট.. আর রাজপরিবারের সদস্যদের ছবি দিয়ে ভরা.. তাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র আছে এতে.. সুন্দর গাছে ঘেরা জায়গাটা সত্যি মনরোম.. মন ভালো হওয়ার অসুধ যেন পুরোটা.. হঠাৎ মাহিয়া কোথা থেকে এসে হাসনাতের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল.. উদ্দেশ্য সেলফি তুলবে সে.. রোদেলা কটমটিয়ে সেদিকে তাকালো.. এই মেয়েটাকে কি করতে মন চায় তার সে নিজেই বোঝতে পারছে না.. সেদিকে হনহনিয়ে গিয়ে মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলল– মাহিয়া,, আমি দেখতে সুন্দর না??
মাহিয়া অবাক হয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করে — হুম আপু তুমি তো অন্যনা.. ইচ্ছে করে শুধু তাকিয়ে থাকি..
রোদেলা ওর কথা শুনে মাথা হালকা ঝাঁকিয়ে মেকি হেসে প্রবল ঝাঝের সাথে বলল– তাহলে আমাকে ফেলে এই বান্দরটার সাথে সেলফি তুলছো কেন??
হাসনাত বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল– কি?? আমি বানর!! এতো বড় অপমানী!! তুইকি রে উদবিড়াল..
রোদেলা হাসনাতের হাত ধরে ওর সামনে থেকে টানতে টানতে নিয়ে এলো. হাসনাত অবাক হয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো— তাকে কি আজকে গরু বাজারে তোলা হবে?? এমন গরু টানা টানছে কেন তাকে??
রোদেলা হাসনাতকে একটা কর্নারে দাড় করিয়ে দিয়ে বুকের ওপর হাত গুজে বলল– ওই মেয়ের সাথে তোমাকে আর একবার দেখলে হাত পা কেটে বাসায় বসিয়ে রাখবো আমি.. কথাটা মনে থাকে যেন তোমার..এই বলে পরম ঝাঝের সাথে প্রস্তান করলো সেখান থেকে..আর হাসনাত তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে…

হাসনাত বিরবিরিয়ে বলল– সাইক্লোনটা মাহিয়ার দিকে যেতে যেতে ইউটার্ন নিয়ে আমার কাছে চলে এলো কেন.. ইয়া আল্লাহ ঝামেলার সাথে আমার কোন দিনের বন্ধুত্ব যে আমাকে ছাড়তেই চায় না সে…

ইফ্ফাত সবটা খেয়াল করেছে.. এইসব দেখে তারমনে হঠাৎ ভয়ের আগমন হতে শুরু করলো!!সে মনে মনে বলল– বাড়ি পৌছে রোদেলা হাসনাতের জন্য যে সাইক্লোন অপেক্ষা করছে সেইটা জেনে তাদের রিয়েকশনটা কি হবে.. সত্যিই কি সব ঠিক হবে নাকি…. ইফ্ফাত যেন আর চিন্তাকরতে চায় না.. খারাপ কিছুই চিন্তা করা ঠিক না সে নিজে নিজেকে বকে দিল.. কিন্তু তাও মনের কোনায় হালকা খচখচ থেকেই গেলতার . হয়তো এইটা তার অতিরিক্ত চিন্তার জন্য হচ্ছে…. এইসব ভাবতে ভাবতে সে ইফতির কাছে যাওয়ার জন্য মন স্হির করে সেইদিকে হাটা ধরলো….

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here