নিজের জামার দিকে লক্ষ্য করেছ ?ময়লা কাপড় পড়ে আমাদের সাথে খেলতে আসতে তোমার লজ্জা করে না।।বস্তির ছেলে মেয়েরা যে স্কুলে পড়ে তুমিও সে স্কুলে পড়ো।তুমি আমাদের বাড়ির কাজের মহিলার মেয়ে।তোমার আর আমাদের মাঝে আকাশ পাতাল প্রার্থক্য।তাই নেক্সট টাইমে আমাদের সাথে খেলতে বলবে না।
রুহির কথা গুলো শুনে রাদিকা মাথা নিচু করে চলে যায়।এখানে তাকলে তার আরো কটুকথা শুনতে হবে।ছোট টিনের বক্সটা নিয়ে রাদিকা আম গাছের নিচে খেলতে বসল।আমের কড়িগুলো একত্রে করে কুচি কুচি করে কাটল।আম গাছের পাতায় তা রেখে টিনের বাক্স থেকে তার পুরাতন পুতুলগুলো বের করে খেলতে লাগলো।এটাই তার প্রতিদিনের খেলা।বেলকনিতে দাড়িঁয়ে মাহিন রাদিকাকে একলা খেলতে দেখে বেশ অবাক হয়।সে রাদিকাকে আগে দেখে নি।তার মাথায় প্রশ্ন জাগছে কে এই কিশোরী?নিজের মনে প্রশ্ন করতে করতে রাদিকার কাছে আসে।নিজের সব কৌতহল নিয়ে প্রশ্ন করল কে তুমি,আমাদের বাড়িতে কি করছ??
রাদিকা তার পুতুল নিয়ে খেলতে ব্যস্ত ছিল।তার পিছন থেকে এমন প্রশ্ন আসায় সে ভয়ে আস্তে আস্তে পিছনে দৃষ্টি দেয়।মাহিনকে দেখে ভয়ে তার কাপুঁনি এসে যায়।এই বাড়িতে যখন সে এসেছিল তখন মাহিনের মা মাহিনকে দেখিয়ে বলেছিল তার ধারে কাছে যেন না যায়।মাহিন রাদিকাকে চুপ তাকতে দেখে বিরক্তে ভ্রু কুচকে বলল এই মেয়ে কথা কানে যায় না,কখন থেকে বলছি কে তুমি?
মাহিনের শেষের কথাটি ধমক মিশ্রিত ছিল।রাদিকা ভয়ে কেপেঁ ওঠল।মুখে জড়তা নিয়ে বলল আ,,মি রাদিকা।
মাহিন :তা বুজলাম তাহলে তুমি এখানে করছ কি??
রাদিকা তার ওড়নার মাথা আঙ্গুলে পেছাতে পেছাতে বলল আমার আম্মা আপনাদের বাড়িতে কাজ করে।
মাহিন বিরক্তি রেশ কেটে বলল তোমাকে আগে এখানে তো দেখে নি।আজ এসেছ কি??
রাদিকা :পাচঁ দিন হয়েছে এসেছি।
মাহিন:আমি হয়ত লক্ষ্য করেনি।আর একা খেলছ কেনো?রুহি,মিম,রোহানকে নিয়ে খেল।
রাদিকা:এদেরকে আমি বলেছি খেলতে,কিন্তু তারা বলেছে আমার সাথে খেলবে না ।
রাদিকা কথাগুলো কান্না ভেজা কন্ঠে বলল।মাহিন রাদিকার কান্না ভেজা কন্ঠ শুনে তার খারাপ লাগতে লাগল।মাহিন রাদিকার পাশে বসে বলল কি খেলছ?
রাদিকা :পুতুল খেলছি।
মাহিন :তোমার মত মেয়েরা কি এখনও পুতুল খেলে। তোমার বয়সি রুহি সে কবে থেকেই পুতুল খেলে ছেড়ে দিয়েছে।
রাদিকা:আমাদের বাড়িতে আমার বয়সি সবাই পুতুল খেলে।আর রিনা আপা বিয়ে হয়ে যাবার পরও আমার সাথে পুতুল খেলতে আসে।
মাহিন:তোমার বাড়ি কোথায়?দেখে গ্রামের মনে হচ্ছে।
রাদিকা:আড়ালিয়া এটা এখান থেকে অনেক দূর।
মাহিন:জানি আমি
মাহিন বসে বসে রাদিকার খেলা দেখতে লাগলো।রাদিকার মা রাদিকাকে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে দু ‘বেলা পেট ভরে খাওয়ার জন্য।রাদিকার বাবা দুই বছর আগে মারা গিয়েছে।তার মার পক্ষে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে দাড়াঁয়।তাই তিনি গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন।রাদিকার বয়স তেরো।মাহিনদের বাড়িতে আসার পর মাহিনের মা তাকে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করান।মাহিনের বাবা গরিদের প্রতি এত দয়া মায়া নেই।তিনি সর্বদা ব্যবসায় নিয়ে তাকেন।মাহিন তার মা বাবার একমাত্র সন্তান।অনার্সে পড়া শুনা করে।রুহি,রোহান,মিম তার চাচাতো ভাই বোন।মাহিনের চাচারা তাদের সাথে থাকে।
————————————————————————–
রাত দশটায় রাদিকা প্রচন্ড খিদা নিয়ে তার মার কাছে এসে বলল আম্মা খুব খিদা লাগছে।
রাদিকার মা প্লেট মুচতে মুচতে বলল তুই রুমে যা আমি খাবার নিয়ে আসছি।
রাদিকা তার মার কথায় রুমে চলে যায়।মাহিনের রুম থেকে চিৎকারের শব্দ শুনে সে কৌতহল নিয়ে মাহিনের রুমের দিকে যেতে তাকে।রুমের কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখে মাহিন তার মার সাথে রাগারাগি করছে।রাদিকা মনে মনে বলে জিবনে এত রাগি মানুষ দেখেনি।এজন্যই হয়ত ওনার মা ওনার কাছে যেতে বারণ করেছে।আর আমি বিকালের ওনার সাথে কত বকবক করেছি।আর কোনো দিন কথা বলব না।এখান থেকে চলে যায় তা না হলে আমাকে খুব বকা দিবে।রাদিকা নিজের মনে বিরবির করতে করতে তার রুমে চলে আসে।
রাদিকার মা সারা দিনের ক্লান্তিতে চৌকিতে গা এলিয়ে দিয়ে বলল কোথায় গিয়েছিলি আমি কখন থেকে ভাত নিয়ে বসে আছি।
রাদিকা হাত ধুঁয়ে মুখে ভাত দিতে দিতে বলল বাড়িতে আসার পর আন্টি আমাকে যে ছেলের কাছে যেতে বারণ করছিল তার রুমে গিয়েছিলাম।
রাদিকার মা :রুমে গিয়েছিলি কেনো?আপা জানতে পারলে জানিস কি হবে।
রাদিকা:রুমে যায়নি ওনার চিৎকার শুনে রুমে উঁকি দিয়ে দেখি ওনি তার মার সাথে রাগারাগি করছেন।আম্মা জানো কি রাগ ওনার,ওনার রাগ দেখে ভয়ে আমি চলে আসি।
রাদিকার মা:কখন থেকে ওনি ওনি করছিস কেনো?ছেলেটার একটা নাম আছে।মাহিন ভাই বলে ডাকবি পরের বার যেন ওনি শব্দ না শুনি।
রাদিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
রাত তিনটায় রাদিকার পানি পিপাঁসায় ঘুম ভেঙ্গে যায়।কিচেনে পানি পান করতে আসার সময় অন্ধকারে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে রাদিকা ভুত বলে যখন চিৎকার দিবে তখন কেউ তার মুখ চেপে ধরে।
উক্ত ব্যক্তি ধমকের সহিত বলে স্টুপিট আমি মাহিন ভুত না,দেখে চলতে পারনা।
রাদিকা মুখ থেকে মাহিন হাত সরিয়ে আনলে রাদিকা বলে আমাকে মাপ করে দিন আমি দেখতে পায় নি।
মাহিন:ঠিক আছে নেক্সট টাইমে দেখে চলবে।এত রাতে করছ কি এখানে?
রাদিকা:পানি পান করতে আসছি।
মাহিন:পানি পান করে আমার জন্য কফি বানিয়ে ছাদে নিয়ে আসো।
রাদিকা:আমি পারি না কিভাবে বানাতে হয়।আম্মাকে ডেকে আনি ,,,,,
মাহিন রাদিকার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল দরকার নেই ডাকার।চা বানাতে পারলে সেটাই বানিয়ে নিয়ে আসো।
রাদিকা কিচেনে চা বানানোর জন্য চলে গেলো।দশ মিনিট পর চা নিয়ে ছাদে আসে।মাহিন চা কাপটা নিয়ে বলল আমার পাশে বসো।
রাদিকা ভয়ে ভয়ে মাহিনের থেকে অনেক দূরত্ব রেখে বসল।মাহিন চা মুখে দিয়ে সাথে সাথে থুঁ থুঁ করে সবটা ফেলে দিয়ে বলল এটা কি বানিয়েছ?
রাদিকা:চা বানিয়েছি।
মাহিন কাপটা রাদিকার দিকে দিয়ে বলল তুমি খেয়ে বলত কি বানিয়েছ।চা বানিয়েছ না পানিতে চিনি মিশিয়ে শরবত বানিয়েছ।
রাদিকা এক ঢোক খেয়ে বুজতে পারল সে চা নামে শরবত বানিয়েছে।
রাদিকা ভয়ে কেঁদে দিয়ে বলল আমি চা ও বানাতে পারি না।
মাহিন রাদিকার কান্না দেখে অবাক হয়ে বলল সেটা বলতেই হত আমি তোমাকে চা বানাতে পাঠাতাম না।এখানে কান্নার কি আছে।
রাদিকা কাপটা নিয়ে চলে যেতে চাইলে মাহিন বলল চলে যাচ্ছ কেনো এখানে বসে আমাকে তোমার গ্রামের গল্প বলো।
রাদিকা:কেউ আপনার সাথে আমাকে দেখলে বকা দিবে।
মাহিন:বকবে কেনো?
রাদিকা:আন্টি বলছে আপনার কাছে না আসতে,এখন যদি দেখে তাহলে বকা দিবে।
মাহিন:আসতে না করেছে কেনো?
রাদিকা:আমি জানি না।
মাহিন:কেউ কিছু বলবে না তুমি বসো।
রাদিকা পুনরায় পূর্বের জায়গায় বসল।মাহিন :বলো তোমাদের গ্রামে কি আছে?
রাদিকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল আমাদের গ্রামের সাথে মিশে একটা নদী বয়ে গিয়েছে।নদীর পাশে একটা বট গাছ আছে।সবাই বলে এখানে ভুত থাকে।গ্রাম থেকে অনেক দূরে আমাদের স্কুল।স্কুলে যেতে হলে বট গাছের পাশ দিয়ে যেতে হয়।
মাহিন রাদিকার কথার মাঝখানে বলল আমাকে তোমাদের গ্রামে নিয়ে যাবে।
রাদিকা মাহিনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল গ্রামে কি দেখবেন।
মাহিন:এই যে বললে নদী আছে নদী দেখব সাথে ভুতও দেখব।
রাদিকা কৌতহল নিয়ে বলল আপনি ভুত ভয় পাননা?
মাহিন:না ভয় পায় না,বল নিয়ে যাবে।
রাদিকা:আম্মা যদি নিয়ে যাই তাহলে নিয়ে যাব।
মাহিন:তোমার আম্মু আমাকে না নিলে তুমি নিবে না।
রাদিকা :আমি একা যেতেই পারি না তাহলে আপনাকে নিব কিভাবে।
মাহিন:যখন তুমি নিয়ে যেতে পারবে তখন যাব।
রাদিকা:আচ্ছা
মাহিন রাদিকার কথা বলার ধরণ দেখে বেশ অবাক হয়।তার মাথায় প্রশ্ন জাগে গ্রামের হয়ে এত শুদ্ধ ভাষায় কিভাবে কথা বলতে পারছে।মাহিন নিজের মনে প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বলল তুমি গ্রামের হয়ে কিভাবে শুদ্ধ ভাবে কথা বলছ?
রাদিকা আকাশের তারা গুনছিল।মাহিনের প্রশ্নে সে তারা গুনা বাদ দিয়ে বলল আমার বাবা শিখিয়েছে।
মাহিন:তোমার বাবা কি করে?ওনি এখন কোথায়?
রাদিকা :বাবা দুই বছর আগে মারা গিয়েছে।
মাহিন রাদিকার দিকে তাকিয়ে বলল বেঁচে তাকতে কি করতেন?
রাদিকা:এই শহরে চাকরি করতেন।
রাদিকার অনেক দিন পর তার বাবার কথা মনে পরে যাওয়াই তার কান্না এসে যায়।মাহিন বিষয়টি লক্ষ্য করে।সে নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলো।এভাবে সে প্রশ্ন না করলেও হতো।
সকালে রাদিকা পায়ে হেটে স্কুলে যেতে লাগল।তার নতুন স্কুলে যেতে ভালো লাগে না।প্রবাদ এক বাক্য আছে প্রত্যেক নতুনেই মিষ্ট।কিন্তু রাদিকার ক্ষেত্রে প্রবাদ বাক্যটা যেন উল্টো হয়ে গেল।কারণ তার স্কুলের পাশে অনেক ফ্যাক্টরি।এগুলোর শব্দ তার বিরক্ত লাগে।আর স্কুলের দেওয়াল গুলো ভাঙ্গা।সব মিলিয়ে তার এই সব অসহ্য লাগে।রাদিকাকে আপনমনে চলতে দেখে কিছু ছেলে তার কাছে এসে বলল এই পিচ্চি চকলেট খাবি।রাদিকা ছোট ও গ্রামের হওয়াই সে এত কিছু বুজেনা।মাথা নেড়ে বলে খাবে।ছেলেগুলো রাদিকাকে চকলেটগুলো এগিয়ে দিল।একটা চকলেট খেয়েই রাদিকার মাথা ঘুরতে লাগল।চোখে তার অন্ধকার নেমে আসল।সে চোখ বন্ধ করার সময় ছেলেগুলোর ঠোঁটে বিজয়ের হাসি দেখতে পেল।
চলবে,,,,,,,
#ভোরের_শিশির
#সাহিরাহ_আনজুম_ইউশা
পার্ট:১