#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৩৮,,
সকালবেলাটায় তিলোর মিষ্টি কন্ঠের ডাকে অরিকের ঘুম ভাঙে। নিজের উপরই অরিক হেসে ওঠে, এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে সাথে সাথে একটা আসক্তি। খুব ধীরে সেটা কখনোই না। এতো দ্রুত যে অভ্যাস পরিবর্তন হতে পারে অরিকের জানা ছিলোনা। ও জানতো অন্তত একুশ দিনের নিয়মিত কর্মকান্ডের প্রয়োজন হয় একটা কাজকে অভ্যাসে পরিণত করতে।
আর তিলোর কন্ঠ! ভার্সিটিতে প্রথমদিন শোনা গানটাতেও এমনটা শোনা যায়নি৷ তিলো ঠিকই বলেছিলো, তাদের কন্ঠ পাল্টে যাচ্ছে। কারণটা তাদের প্রকাশভঙ্গিমা এবং আলাদা আবেগ মিশিয়ে ফেলা কথাগুলোতে। তিলোর কন্ঠটা অরিকের কানে গানের ধুয়া৷ সমতল রেখা থেকে আলতো করে উঠিয়ে নেওয়ার মতো, যেন পুকুরের পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটা পাথরের টুকরা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে।
অরিক সাড়া না দিয়ে ওর ডাক শোনায় মনোযোগী হলো। তিলো কয়েকবার ডেকে ওর সাড়া না পেয়ে বিরক্তিতে জোরে এক ধাক্কা দিতেই অরিক ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। বিষয়টা যে একটু বাড়াবাড়ি ছিলো অরিক সেটা বুঝতে পেরে অপরাধীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালে তিলো রুক্ষ কন্ঠে বললো,
-তোমার কফি নাও। খবিশ কোথাকার!
অরিক প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-খবিশ বললে কেন?
-কি ভয়ংকর! মুখ না ধুয়ে খাও কি করে? ছিহঃ!
অরিক মৃদু হেসে বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে কফি মগটা তুলে একচুমুক খেয়ে তিলোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-এবার তুমি খেয়ে দেখো।
-জি না। এসমস্ত নোংরামি তুমিই করো। আমি তোমার এঁটো খাবো না।
-আমি জানতাম, এতে প্রেম উসকে ওঠে।
-তোমার কি মনে হয় না, এটা যথেষ্ট।
অরিক কাঁধ নাড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ‘কি জানি’ ধরনের একটা ভঙ্গিমা করলো কেবল। তিলো মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সকালের নাস্তা তৈরির উদ্দেশ্যে।
সকালবেলা আকাশটা মেঘলা দেখে সানজিদ কফি হাতে ছাদে এসেছিলো। ওর কাছে বৃষ্টির থেকেও মেঘলা আকাশ আর ঝড়ো হাওয়াটা বেশি ভালো লাগে। প্রকৃতি এখন নিজের মর্জিতে স্বাধীনতা অর্জন করে নিয়েছে। এই সময়ে এমন বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই। তবে এখন মানুষই নিজের কাজ দিয়ে তার নিয়মের বধ্য শিকলটা ভেঙে দিয়েছে। হুট করেই সকাল থেকে আকাশটা গম্ভীর, একজন গম্ভীর প্রফেসরের মতো যার নাকের ডগায় মোটা ফ্রেমের চশমা থাকলেও সে তার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকা স্টুডেন্টদের দিকে চশমার ওপর থেকেই তাকায়। মেঘ ডাকছে।
সানজিদ রাস্তার দিকে তাকাতেই বাড়ির সামনে একটা অটো এসে থামতে দেখলো। উপর থেকে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও তাদের চলার ভঙ্গিমায় বোঝা যাচ্ছে এরা কারা। পাঁচ তলার এ ব্লকে বাস করা দম্পতির গতমাসেই একটা ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছে। এরা যে সেই ফ্ল্যাটেরই অতিথি সেটা সানজিদের বোধগম্য হলো। সবাই নেমে গেলে একজন ভাড়া দিতে দাঁড়িয়েছে। হয়তো খুচরা নেই। অটোওয়ালার সাথে বাকবিতন্ডা হচ্ছে।
-মেয়েটা তো দারুণ দেখতে!
আচমকা কন্ঠটা শুনে সানজিদ পাশে তাকিয়ে রোৎশীকে আবিষ্কার করলো। রোৎশী এই এলাকার কিছু চেনে না। নিজের ভারী শরীরের উপর বিরক্ত হয়ে সে নিয়মিত সকালে হাঁটাহাঁটি করে। কিন্তু এখানে এসে হচ্ছে না। তাই ছাদেই এসেছিলো হাঁটতে। সানজিদকে এখানে দেখে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিচে তাকালো। তখনই সেই ঝলমলে লাল সাটিনের সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটাকে দেখতে পেলো। তার গায়ের উজ্জ্বল বর্ণ এখান থেকেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। হাই হিল পড়া, খুব উগ্র লিপস্টিক দেওয়া, দুহাত ভর্তি সস্তা চুড়ি, পায়ে রূপার নূপুর। তার হেলেদুলে হেঁটে চলা আর ঝকমকি ভাবটা রোৎশীর এই বয়সের রঙিন চশমার ভেতর থাকা চোখজোড়ায় গিয়ে বিঁধেছিলো। মেয়েটা দেখতে আসলে খুবই সুন্দর।
সানজিদ ওর কথায় মৃদু হাসলো। এখনো রোৎশী মানুষ চেনে না। রোৎশী সানজিদের কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলো,
-সে কি এখানেই থাকে?
রোৎশী খানিকটা আতঙ্কিত। সানজিদ এমনভাবে নিচে তাকিয়ে ছিলো যেন, সে মেয়েটাকে চেনে বা হয়তো তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে। রোৎশীর বিষয়টা ভালো লাগেনি। সে সানজিদকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলো কোনোপ্রকার পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই।
সানজিদ ওর দিকে না ফিরে বললো,
-সে আসলে গল্পের চরিত্রগুলোর মাঝে জগাখিচুরি পাকিয়ে দেয়।
রোৎশী ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কেন?
-সে মজনু হলেও লায়লা হতে পারে। রোমিও আসলে জুলিয়েটও হতে পারে। অ্যান্টনি হতে পারে ক্লিওপেট্রা।
রোৎশী সেভাবেই সানজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। সানজিদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একপেশে হেসে বললো,
-সে বৃহন্নলা। আপনি তাকে মেইল বা ফিমেইল যেকোনো চরিত্র দিতে পারেন।
রোৎশী চোখ বড় বড় করে বললো,
-সে হিজড়া?
সানজিদ ওর এই কথার কোনো উত্তর দিলো না। রোৎশীর এখন নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। সত্যিই একটা বোকামি করেছে সে। পাশাপাশি স্বস্তিও পেলো এটা ভেবে যে, সানজিদ তখন আসলে মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছিলো না।
-কিন্তু তার মেয়ে রূপটা খুব সুন্দর।
রোৎশী মুগ্ধ কন্ঠে বললো।
সানজিদ রেলিঙের উপর হেলে দাঁড়িয়ে বললো,
-তা ঠিক। সে আসলেই সুন্দর। আসলেই মেয়ে হলে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি বেঁধে যেতো কিছু পুরুষের মাঝে।
রোৎশী হয়তো সানজিদের এমন কথায় খানিকটা ব্যথিত হলো। কিন্তু তারপরও স্বস্তি যে সে মেয়ে নয়। মাথা থেকে বিষয়টা ঝেড়ে ফেলে রোৎশী সানজিদের সাথে ভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করলো। তার আর হাঁটা হলোনা। ওদের কথার মাঝেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। সানজিদ দ্রুত দৌড়ে ছাদের মাঝে থাকা দোলনার ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। রোৎশী গেলোনা। বাড়িতে থাকলে ওর মা ওকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় না। এখানে সেই বাঁধা নেই। সে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে মুক্ত পাখির ভঙ্গিমায় বৃষ্টির ফোঁটা গুলো অনুভব করছে চোখ বুজে। তার প্রসস্থ শরীরটাকে ধন্যবাদ। একটু বেশি বৃষ্টির পানি তার শরীরে লাগছে। বাকি ফোঁটাগুলো যেন অপচয় হচ্ছে। সানজিদ ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওকে ডাকলো। ওর ঠান্ডা লেগে যাবে, জ্বর আসবে, বিভিন্ন কথা বলে চলেছে। রোৎশীর সেদিকে খেয়াল নেই। এখন সে বৃষ্টিবিলাসে মগ্ন। সে তো আর পথ হারিয়ে ফেলার ভয়ে নেই।
সানজিদ বিরক্ত হয়ে নিজেই ভিজে এসে ওর হাত ধরে টেনে ছাউনির নিচে নিতে গেলে রোৎশী চমকে ওঠে কারো স্পর্শ পেয়ে। সে অবাক হয়ে গিয়েছে বিধায় ওকে যে বৃষ্টির থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেটা টের পেয়েও প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। ছাউনির নিচে পৌঁছে সানজিদ ওর হাত ছেড়ে বললো,
-নিচে চলুন। ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলবেন তো।
রোৎশী একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার সামনে দাঁড়ানো শ্যামবর্ণের উঁচোলম্বা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বলিষ্ঠ পেশিবহুল হাতে টিশার্টটা সেঁটে আছে। ভিজে গিয়েছে কিছুটা। খাড়া খাড়া কদমফুলের মতো চুলগুলোতে পানির ফোঁটা চিকচিক করছে। সানজিদ কিছুটা ‘ডার্ক হ্যান্ডসাম’ যাকে বলে সেরকম। রোৎশী নিজের দৃষ্টি সংযত করলো। তার মতো ভারী শরীরের মেয়েদের আসলে স্বপ্ন দেখায় বাঁধা আছে।
সানজিদ তখনও ওর হাতটা ধরেছিলো। রোৎশীর ফর্সা গোটা গোটা হাতটায় সানজিদের কৃষ্ণ বর্ণের হাতটা একটা তফাৎ সৃষ্টি করেছে যেটা চোখে লাগার মতো। অনেকটা সাদা কাগজে কালো কালির লেখা। তবে সানজিদ এতোটাও কালো নয়। চাপা শ্যামলা। পড়াশোনা শেষ করে সবে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো একটা পদে ঢুকেছে।
রোৎশী নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-কিছু হবে না। আমার অভ্যাস আছে। বাড়িতে আম্মু না থাকলে প্রায়ই ভিজি।
-এসব হঠাৎ বৃষ্টিতে ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
-তাও। জ্বর হলে ভাইয়াকে বলে ডাক্তারের কাছে যাবো। ভাইয়া কিছু বলে না। এখন আসছি।
কথাটা বলে রোৎশী আবারও ছাউনির বাইরে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলো। তার ভেতর আজ অন্যরকম আনন্দ। বৃষ্টিবিলাসের আনন্দ ছাপিয়ে সেটা ওর সারা শরীর মন গ্রাস করে ফেললো। বৃষ্টির প্রতি ফোঁটার সাথে সেই শিহরণ বয়ে চলেছে প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
সানজিদ হতাশ হয়ে ছাউনির ছাদ থেকে স্টেইনলেস স্টিলের শিকল সমেত ঝুলতে থাকা দু তিনজন বসার উপযোগী দোলনাটায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসলো। কোন আকর্ষণে সে ঘরে ফিরে যাচ্ছে না, সেটা ওর নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়। পকেটে ফোনটা কম্পন সৃষ্টি করতেই সানজিদ সেটা বের করে স্ক্রিনে সোহা নামটা ভাসতে দেখেও আজ রিসিভ করার কোনো তাড়না অনুভব করছে না। একটা সময় ছিলো যখন রাতের পর রাত এই ফোনটার জন্য সে নির্ঘুমে কাটিয়েছে। কিন্তু আজ সেটা যেন বড়ই বিরক্তিকর! নিজের এই আমূল পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সানজিদ। পরক্ষণেই কিছু একটা বুঝতে পেরে সোহার ফোনটা কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে সামনের দৃশ্যে চোখ রাখলো। মোটাসোটা সাদা একটা মেয়েকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখাটা দৃষ্টিকটু নয়!
সানজিদ জোরে বলে উঠলো,
-আর কয়দিন থাকবেন এখানে?
রোৎশী রেলিঙে হাত রেখে উল্টো ঘুরে থেকেই উত্তর দিলো,
-আজ বিকালে চলে যাবো।
সানজিদের মনটা সকালের আকাশটার মতোই কালো মেঘে ছেঁয়ে গেলো। তারপরও কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললো,
-শহরটা ঘুরে দেখবেন না? আর কয়েকদিন থাকুন।
-আরেহ্। পরেরবার এসে দেখবো। সামনেই সেমিস্টার ফাইনাল। এমনিতে ভাইয়ার বিয়ের জন্য ফাঁকি দিয়েছি। আর সম্ভব না।
সানজিদ মৃদুকণ্ঠে ‘ও আচ্ছা’ বলে আর কিছু বললো না। রোৎশী চাচ্ছিলো সে কিছু বলুক। কিন্তু তাদের মাঝে আর কথা হলোনা। রোৎশী নিজেও কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না বলার জন্য। আর লজ্জায় নিজে থেকে বলতে পারছে না। সানজিদও বললো না।
ভিজে গিয়ে লেপ্টে থাকা ওড়নাটা সে বারবার নামিয়ে নিচ্ছে। এরপরও স্বস্তি পাচ্ছে না। তাই খুব তাড়াতাড়িই নেমে এলো নিচে। দুজনের মাঝেই একটা অতৃপ্তি থেকে গেলো। সে তৃপ্তময়তার রাস্তা খুঁজতে মরিয়া দুটো সত্তা। হয়তো অতৃপ্তিতে ক্লান্তিব্যঞ্জকতা গ্রাস করে ফেললেই রাস্তার মাথায় সরু আলোকরেখার দেখা পাওয়া যাবে।
তিলো টেবিলে নাস্তা সাজাতে সাজাতেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। রাফি গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেজা কাপড় দ্রুত ঘরে ঢুকে রোৎশী নিজের জন্য অস্থায়ী রুমটায় ঢুকে গেলো। রাফি ও যেতে যেতেই বললো,
-আবার ভিজলি তুই, মুটি। জ্বর হলে বুঝিস কেমন লাগে! আমি আর তোকে ডাক্তার দেখাবো না।
রোৎশী একবার থেমে গিয়ে মুখ ভেংচিয়ে বললো,
-লাগবে না আমার।
বলে আবারও রুমে ঢুকতে উদ্যোত হলো। রাফি দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে দরজা আটকে দেওয়ার আগেই একটা অল্পবয়সী ছেলে এসে একটা পার্সেল বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। রাফি সেটা হাতে নিয়ে দেখলো, অরিকের নেইম-প্লেট সেটা। ওর পূর্ণ পরিচয় যেটা ও দরজার পাশে বেলের উপরে লাগাবে। সেদিন এটা ছিলোনা বলেই তিলোর আবারও নিচে গিয়ে খোঁজ করা লেগেছিলো। তিনতলার কোনো ফ্ল্যাটেই একটাও লাগানো নেই। সেই ঘোরেই অরিকও এতোদিন লাগানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। তবে এখন মনে হয়, প্রয়োজন।
বিকালে প্রায় সবাই যে যার নিজস্ব অবস্থানে ফিরে গেলো। গমগমে ফ্ল্যাটটা এখন পুরো ফাঁকা। অরিকও বাইরে গিয়েছে। তিলো সারা বাড়ি গড়াগড়ি খাওয়ার যোগাড়। বিরক্ত হয়ে গিয়েছে ও একা হয়ে গিয়ে। নাসীরা পারভীনকে ফোন করলে ওনি অভিমানে ঠিকমতো কথাও বললেন না। অগত্যা নিজের বন্ধুদের একে একে ফোন করে সময় কাটিয়ে দিলো।
#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৩৯,,
দুপুরে খেতে বসে আনিস সাহেব গম্ভীর কন্ঠে খাবার টেবিলে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
-গতকাল সন্ধ্যায় ইমনের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি।
ওনার কথাটা শুনে উপস্থিত সকলের মাঝেই নিরবতা। এর আগে একসাথে কাউকে ওনি পাননি৷ গতকাল রাতে এবং আজ সকালেও ওনি একা একাই ছিলেন। নাসীরা পারভীন রান্না করে রেখে চলে যেতেন। রাগে কাউকে তুলে খাওয়াননি। তুলিও নিজের মতো খেয়ে চলে যায়। তুষারও তাই। এই মূহুর্তে সকলকে একসাথে পেয়ে ওনি বলেই ফেললেন কথাটা। নাসীরা পারভীন আর অভিমান টেনে রাখলেন না। কৌতুহলী কন্ঠে বললেন,
-তুমি কেন দেখা করতে গেলে?
আনিস সাহেব গাল নাড়িয়ে গালে থাকা খাবারটুকু গিলে নিয়ে বললেন,
-সবকিছু পরিষ্কার হতে একবার তো অন্তত দেখা করা লাগতো।
তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-কী বললো ও?
আনিস সাহেব হঠাৎই কন্ঠ পাল্টে রুক্ষ গলায় বললেন,
-ওই হারা** সাথে আর তোর ফিরতে হবে না। এখন নিজের ক্যারিয়ার তৈরি কর।
তুলি কিছু বলার আগে নাসীরা পারভীন তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,
-কেন? কি হয়েছে?
-ও তুলিকে ইচ্ছা করেই তালাক দিয়েছে। একবারও কি নিজের ছেলেকে সত্যিই মনে হয়নি নিজের? এতো মিল বাপ ছেলের মধ্যে! ডিএনএ টেস্ট করতে পারতো না হলে। ছেলে নিজের না, এটা হলো অযুহাত। নিজের চরিত্রও তো ঠিক ছিলোনা। আমার মেয়ে অন্যায় করেছে সুযোগ দিতে পারতো। আমাদের, ওর মাকে বলে একটা বোঝাপড়া করতে পারতো। কিছু করেনি। ওই বদমাশটা আসলে আরেকটা বিয়ে করবে বলেই এসব করেছে। ওই অফিসের কলিগ মেয়েটাকেই বিয়ে করবে। তুলিকে আর ঘরে তুলবে না। ইশানকে ফেরত চেয়েছে। আমি একদম মানা করে দিয়েছি। যে ছেলের জন্ম নিয়ে ওর মনে সন্দেহ, ছেলে ফেরত নিয়ে কি যত্ন করবে নাকি? নতুন বউ নিয়ে থাকবে আর আমার নাতিটার কপাল পুড়বে।
কথাগুলো শুনে তুলির চোখজোড়া ছলছল করছে। তুলি সেখানে বসলো না আর। ছুটে চলে এলো নিজের রুমে। তবে এখানে এসেও শান্তি নেই। ইশান ঘুমাচ্ছে। ও জোরে কাঁদতেও পারবে না। আনিস সাহেব ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নাসীরা পারভীনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-ওকে বোঝাও। পড়াশোনা শেষ করুক, তারপর দেখা যাবে। ওই নোংরা ছেলেটার পায়ে ধরতে পারবোনা আমি আমার মেয়েকে নেওয়ার জন্য। আর আমার মেয়েকেও দেবোনা।
নাসীরা পারভীন কিছু বললেন না। চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন।
বিকালে তিলো এবং অরিক আশাকুঞ্জ এ আসে বিবাহ পরবর্তী মেয়ের বাড়ি ফেরার নিয়মে। নাসীরা পারভীন মুখে একটা হাসি নিয়ে সবদিক দেখলেও তিলোর সাথে ঠিকমতো কথা বলছেন না।
নাসীরা পারভীন রান্নাঘরে ঢুকলে তিলো পেছন থেকে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে। নাসীরা পারভীন বিরক্তি নিয়ে ওকে ছাড়তে বললেও ও বরং আরো শক্ত করে ওনাকে জড়িয়ে ধরে। তিলো আদুরে কন্ঠে বললো,
-রেগে আছো? কত্তোগুলো দিন পর আসলাম। আর তুমি আমার সাথে কথাও বলছো না?
-কতোদিন পর কোথায়? দুদিন হলো এবাড়ি ছেড়ে গেলি।
-ওই হলো। আমার কাছে সেটাই অনেক বছর! জানো, আমার কতো কষ্ট হয়েছে তোমাদের ছেড়ে থাকতে?
নাসীরা পারভীন ওকে আবারও ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও পারলেন না। আরো বিরক্ত হয়ে বললেন,
-ঢং যতো! ন্যাকামি বন্ধ কর। আমার কথা তো তোর মনেও পড়েনা। নিজের সংসারে এতো ব্যস্ত! কথা বলিস কতোটুকু আমার সাথে?
-আরেহহ্। কি মিথ্যা কথা! আমি তোমাকে ফোন দিলে তুমি ঠিকমতো কথা বলো? এখন সব দোষ আমার?
-এখন তো বলবিই! একটা রাঙামূলা সামনে থাকলে কি আমার মতো বুড়ির কথা তোর মনে পড়ে?
তিলো মুচকি হেসে দুষ্টুমির সুরে বললো,
-এই মহিলা, তুমি অরিককে হিংসা করো নাকি?
নাসীরা পারভীন কিছু বললেন না। তিলো ওনার কাঁধ থেকে মুখ তুলে ওনার গোলগাল গালে একটা চুম্বন করে বললো,
-বলো বলো। তুমি ওকে হিংসা করো নাকি? এটা তো দারুণ! কেউ আমাকে নিয়ে কাউকে হিংসা করছে!! আমাকে কল্পনা করতে দাও, তোমার আর ওর মাঝে যুদ্ধ লেগেছে। তোমার অস্ত্র তোমার কাঠের খুন্তি আর ওর অস্ত্র বেতের লাঠি। কি দারুণ! আমরা সরাসরি একটা গৃহযুদ্ধ দেখতে পারবো। ডোন্ট ওয়ারি নায়িকা। আমি তোমার পক্ষ নেবো। সবাই নেবে। সত্যি বলছি।
নাসীরা পারভীন তিলোকে ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বললেন,
-ফাজিল কোথাকার! এখন আমাকে পটাতে এসেছিস সারাদিন কোনো খোঁজ না নিয়ে। যা এখান থেকে। জ্বালাবি না আমাকে একদম। তোর জামাই নিয়ে থাক তুই।
তিলো খানিকটা ব্যথিত হলো ওনার কথায়। আদুরে চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে মেকি কেঁদে বললো,
-যাচ্ছি চলে। বাড়ি থেকেই চলে যাচ্ছি। ভুলে যেও না, এখন আমার যাওয়ার জায়গা আছে। আগের মতো বলে কয়ে বাড়িতেই থাকবো না। অরিকের সাথে সারাদিন থাকি বলে তোমার হিংসা হয় তো। আরো হিংসা করো। হিংসায় জ্বলে যাও৷ পটকা মাছের মতো ফুলতে ফুলতে ফেটে যাও৷ আমি আর আসবো না। ওখেই বাই।
তিলো সত্যি সত্যি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে এসে অরিকের হাত ধরে বললো,
-চলো এখান থেকে। আমি আর আসবো না।
তিলোর কথায় আনিস সাহেব ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক করলেন বলে বোধ হলো। বিয়ের পরপর মেয়ের এতোটা পরিবর্তন!! আনিস সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
-কি হয়েছে ছোটমা? এখনি চলে যাচ্ছিস কেন?
তিলো নাক টেনে বললো,
-তোমার বউকে জিজ্ঞাসা করো কেন? অরিক চলো।
নাসীরা পারভীনও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন।
অরিক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
-বাবাজানা, কি হয়েছে বলবে তো?
কথাটা বলেই অরিক নিজের জিহ্বা কামড়ে ধরলো। তিলো চোখ রাঙিয়ে তাকালো ওর দিকে। আনিস সাহেব আর নাসীরা পারভীন বেশ বিব্রতবোধ করলেন। সবার সামনে এভাবে ডাকাটা একটু অস্বস্তিকর। তিলো কোনো কথা না বলে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নাসীরা পারভীন পেছন থেকে বললেন,
-যাও। চলে যাও। এখন তো এখানে তোমার মনই টিকবে না। আবার ন্যাকা ন্যাকা কথা। নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ পেয়ে সব ভুলে যাচ্ছে। আসবে তো নাই। আসলেও সাথে সাথেই চলে যাবে।
আনিস সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এখন এ বাড়ি থেকে কেউ বেরিয়ে গেলে কিন্তু সে যেন আর ফিরে না আসে। আসলেও আমি আর রান্না করে খাওয়াবো না। যত্তসব, একটু সুস্থ হয়ে বসতেও পারে না।
নাসীরা পারভীন আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তিলো পেছনে ফিরে আনিস সাহেবকে বললো,
-তুমি কি বাইরে থেকে খাবার আনতে পারবে না?
নাসীরা পারভীন রান্নাঘর থেকেই চিৎকার করে বললেন,
-এবাড়িতে বাইরের খাবার ঢুকবে না।
তিলো নিষ্পাপ একটা ভঙ্গিমা করে বললো,
-আব্বু, আমি কি চলে যাবো?
আনিস সাহেব হতাশ দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুই কেন যাবি? যে ঝগড়া বাঁধিয়েছে সে যা…।
কথাটা শেষ করলেন না। নাসীরা পারভীনের কানে গেলে আরেক কান্ড বাঁধবে।
তিলো মুখ ভার করে সোফায় বসলো৷ অরিক আর আনিস সাহেব তা দেখে মুখ টিপে হেসে দিলো।
খাওয়ার সময় তিলোকে ডাকতেই সে উপস্থিত। সে আবার ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। অরিকের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে নাসীরা পারভীন তিলোর ঘরে গিয়ে দেখতে পান সে ফোনে কথা বলছে। নাসীরা পারভীন এমনিতে ওর উপর হিংসায় জর্জরিত। ওনি বাজখাই গলায় বলে উঠলেন,
-এই ছ্যামড়া, তোকে কি আলাদা করে নিমন্ত্রণ করা লাগবে? খেতে আয়।
অরিক ওনার অধিকার নিয়ে এমন ভঙ্গিতে ডাকায় হতভম্ব হয়ে গেলো। তিলোর সেদিনের মন খারাপ নিয়ে ওকে হুমকি দিয়ে ফোন করার পর নাসীরা পারভীন ওর সাথে ঠিকমতো কথা বলেননি। তিনি কি ভুলে গিয়েছেন, যে অরিক এখন কেবল তাঁর ভাসুরের ছেলে না। তাঁর মেয়ের জামাই। অরিকের মনে পড়ে না, নাসীরা পারভীন ওকে শেষ কবে ছ্যামড়া বলে ডেকেছেন। তবে এটুকু মনে আছে, অরিক যখন দশ বছরের ছিলো তখন খুব দূরন্ত ছিলো। কথা শুনতো না একদম। দাদাবাড়ীতে বেড়াতে গেলে, ওকে আর অভ্রকে রেখে ওর মা গিয়েছিলো পাড়া ঘুরতে। ওনার বাবার বাড়িও সেই এলাকায়। অরিকের পুকুরপাড়ে যাওয়া নিষেধ ছিলো। অভ্র আর, তিলো তুলিরও তাই। অরিক তা শোনেনি। বারবার সেখানে গেলে নাসীরা পারভীন কয়েকবার ওকে ধমকেছেন। ওনার রেগে গেলে ডাকের ধরণ, ছ্যামড়া-ছেমড়িতে নেমে যায়। অরিক যখন একদমই শোনেনি, নাসীরা পারভীন ওকে পাঁজা কোলা করে তুলে পানিতে ছুড়ে ফেলার অভিনয় করেন। অরিক আরো হেসে দেয়। নাসীরা পারভীন শেষে ওকে নিয়ে পুকুরে নেমে একসাথে ডুব দেন। বেশ কিছুসময় ডুবে থাকেন। সেটা ছিলো অরিকের প্রথম পুকুরে ডুব। নাকেমুখে পানি ঢুকে ওর অবস্থা খারাপ। পানি থেকে উঠে প্রায় কেঁদে দেয়। নাসীরা পারভীন ওকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আর আসবি এদিকে?’
অরিক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে, ওনি আবারও ওকে ডুব দেওয়ায়। এবার অরিক পুরো কেঁদে দিয়ে মাথা নেড়ে তাকে আশ্বস্ত করে যে, ও আর এদিকে আসবে না।
এরপর আর অরিকের মনে পড়ে না, কখনো নাসীরা পারভীন ওকে এভাবে বকেছেন বলে।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৪০,,
রাতে খাওয়ার সময় তিলো ওর মাকে তুলির বিষয়ে সবার সামনেই জিজ্ঞাসা করলে নাসীরা পারভীন ইশারায় ওকে বলেন যে পরে বলবেন সব। তুলিকে আসার পর থেকে তিলো একবারও দেখেনি। স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল হয়েছিলো। খাওয়া শেষে তিলোকে সব বললেও ও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এমনটা হওয়ারই ছিলো, এমন ভঙ্গিতে সে নিজের রুমে চলে গেলো।
দরজা আটকানোর শব্দ পেয়েও অরিক সেদিকে তাকালো না। সে নিজের ফোনে মুখ গুঁজে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তিলো ওর পাশে উঠে বসে ওর মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে হেলান দিয়ে ওর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে আর মুখ থেকে শব্দ করছে। অরিক খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
-এটা ব্যাড ম্যানার। শব্দ করো না।
তিলো শব্দ বন্ধ করে বললো,
-তুমি আমাকে ম্যানারের কথা বলছো!
-কেন? বলতে পারি না?
-পারো। ঠিক আছে।
-বাড়ি ফিরে ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করবে।
-হুম। তোমার ফোনের স্ক্রিন ফাটলো কি করে?
তিলোর প্রশ্ন শুনে অরিকের নাসীরা পারভীনের দাবড়ের কথা মনে পড়লো। হঠাৎ করে বলায়, অরিকের কান থেকে ফোনটা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো। অরিক পুনরায় ধরতে গিয়েও হাত ফসকে নিচে পড়ে যায়। অরিক দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-তোমার মায়ের দাবড়ে।
তিলো তখন আর কিছু বললো না।
কিছুক্ষণ পর তিলো টের পেলো অরিক ঘন শ্বাস নিচ্ছে। ঘেমে একাকার। তিলো ওর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই বললো,
-শাওয়ার নিয়ে এসো। গরম কম লাগবে।
-সমস্যা হচ্ছে না।
-তোমার ইচ্ছা।
তিলো আর কিছু বললো না। অরিকের কাছে গরমটা সত্যিই অসহনীয় হয়ে এলে সে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিতে শুরু করলো। তিলো মনে মনে হাসতে সক্ষম হলো। কিছুক্ষণ পরই অরিক ভেতর থেকে বলে উঠলো,
-বাবাজানা, আমার সাবান শ্যাম্পুগুলো দাও।
তিলোর তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো সে আনেনি। তিলোও দরজার সামনে গিয়ে বললো,
-ওগুলো তো আনা হয়নি। তুমি আমার জিনিসগুলো ব্যবহার করো।
অরিক খানিকটা নাখোশ হয়ে বললো,
-তোমার এই লেডিস জিনিসগুলো!
-সরি। তাড়াহুড়ায় ভুল হয়ে গিয়েছে। কাল কিনে এনো। এখন প্রয়োজন না হলে ব্যবহার করো না।
অরিক আর কিছু বললো না। তিলোর জিনিসগুলোই ব্যবহার করলো। সাথে দাঁতও ব্রাশ করলো, অবশ্যই তিলোর ব্রাশ দিয়ে। ব্রাশটা রাখতে রাখতে অরিক আপন মনে হেসে দিলো, এটা ভেবে যে, তিলো বিষয়টা জানতে পারলে কি করবে!
অবশেষে অসামান্য দীর্ঘ সময়ব্যাপী শাওয়ার সেরে অরিক বের হলো কেবল কোমড়ে একটা সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে। তিলো একমুহূর্ত ওর দিকে স্থির মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অরিক বেরিয়ে আসার পর তিলো ফ্রেশ হতে ঢুকলো। ততক্ষণে অরিক কাপড় পাল্টে ফেলেছে। বিছানায় বসে সবে ফোনটা হাতে নিয়েছে, তিলো বেরিয়ে এসে ওর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলো,
-ঘুমাবে না?
-হুম।
তিলো শুয়ে পড়ে বললো,
-ব্রাশ করেছো?
অরিক ওর দিকে না ফিরেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-হুম।
-আচ্ছা।
বলে পাশ ফিরে শুতে নিতেই ওর মনে পড়লো অরিকের ব্রাশ তো আনা হয়নি। ও কি দিয়ে ব্রাশ করলো? তিলো চকিতে পাশ ফিরে অরিককে জিজ্ঞাসা করলো,
-কি দিয়ে ব্রাশ করেছো তুমি?
-তোমার ব্রাশ দিয়ে।
কথাটা শুনে তিলোর যেন পুরো শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো। ও আবার সেই ব্রাশ দিয়েই ব্রাশ করেছে! তিলো অরিককে একটা ধাক্কা দিয়ে চোখ মুখ খিঁচে বলে উঠলো,
-দূর হ নোংরা নর্দমার পোলা কোথাকার!
বিদ্যুৎ গতিতে উঠে বসে জোরে জোরে পা নাড়িয়ে প্রায় বমি করে দেওয়ার উপক্রম ওর। অরিক ওর ধাক্কার ঝোঁক সামলিয়ে ওর ভঙ্গিমা দেখে হেসে দিলো। তিলোর রাগ আরো বেড়ে গেলো তাতে। ও বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে কয়েকবার কুলি করে ছলছল চোখে বেরিয়ে চোখ মুখ লাল করে অরিকের পাশে বসলো। অরিক মিটমিট করে হেসে বললো,
-আমি জানতাম না, আমার টিকটিকি ফিডার বউ এতোটা সূচিবাই!
তিলো চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো। অরিক ওর প্রশ্ন বুঝতে পেরে বললো,
-আমার বেডরুমের টিকটিকিটাকে খাওয়ানোর জন্য পোকা মেরে দেওয়ালে টানিয়ে যে রেখেছে, আমি আসলে তাকে চিনি। আফসোস এটা আসলে কোনো চাকরি নয়।
তিলো ধপ করে অরিকের দিকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে পড়লো। অরিক নিজেও ওর পাশে শুয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে ওর শরীরে হাত রাখলে তিলো ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। অরিক এতে দমে না গিয়ে ওর উদর জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-সরি। আমি শুধু মজা করেছি। এভাবে একটা ফালতু বিষয় নিয়ে রাগারাগি করো না। বাজে লাগে ব্যাপারটা। এটা হয়েই থাকে।
তিলো চুপ করে ওর স্পর্শগুলো অনুভব করছে কেবল। কেউই কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষণ নিরবতার পর তিলো বললো,
-তোমার শরীর থেকে বেলি ফুলের ঘ্রাণ আসছে। মেয়েদের মতো।
কথাটা বলে তিলো ফিচ করে হেসে দিলো। অরিক ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর মেরুদণ্ডের পাশের উঁচু পেশির উপর হাত রেখে বললো,
-আমার নিজেকে দোষী দোষী লাগছে। জিনিসগুলো ব্যবহার না করলেই পারতাম।
তিলো মৃদু হেসে বললো,
-তোমাকে দেখাচ্ছেও সেরকম জান।
-আমি কেবল নিজের শরীরের ঘামের দূর্গন্ধ দূর করতে আর জেঁকে বসা ক্লান্তিবোধকে দীর্ঘক্ষণের আতিথেয়তা শেষে বিদায় করেছি।
-এটা ঠিক আছে। ওগুলো খুব বেশি দামী নয় যে, সকাল হতে হতে গন্ধ ছাড়াবে না। বরং আমারই এই গন্ধটা ভালো লাগে।
অরিক আর কিছু বললো না। স্থিরদৃষ্টিতে কয়েক মূহুর্ত তিলোকে পর্যবেক্ষণ করে ওর উন্মুক্ত গলায় মুখ গুঁজে দিলো। তিলো আবেশে চোখ বুজে হঠাৎই বললো,
-তোমার কি কোনোদিনও আফসোস হবে আমাকে বেছে নেওয়ার জন্য?
অরিক থমকে গেলো তিলোর কথায়। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-এমন মনে হওয়ার কারণ?
-তোমার মায়ের সাথে তুমি যোগাযোগ কি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছো?
অরিক দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-আপাতত। কিন্তু বাবাজানা, আমি আমার নেওয়া কোনো পদক্ষেপের জন্য কখনো আফসোস করবোনা। তোমার – আমার এগিয়ে চলতে আরো যা করতে হবে তাতেও কখনো আফসোস হবে না। আর আমরা এগিয়ে যাবো। আর এজন্য তোমাকে হুকুম করছি আমি, আমার সঙ্গ ছেড়ো না কখনো যাই ঘটে যাক।
তিলো স্তব্ধ চোখে অরিকের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চাপদাড়ির ফাঁকে ফাঁকে নিজের আঙুলগুলো ভরে দিলো। ঠোঁট কামড়ে ওকে সম্মতি জানালো। অরিক ওর সম্মতি পেয়ে হেসে দিলো। তিলো এরপর বললো,
-কোনোভাবে তোমার দূর্বলতা হয়ে চলেছি কি আমি? নাকি অপূর্ণতার পূর্ণতা?
অরিক উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। তিলো একপেশে হেসে বললো,
-মানুষ নিজের দূর্বলতাকে বারবার শক্তি হিসাবে জাহির করতে চায়। এটা মনুষ্য প্রকৃতি। সে চেনে তাকে বা চেনে না। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সবচেয়ে বেশি সেটা নিয়ে ভেবেই বা কাজে খাটিয়ে ব্যয় করে। হরর স্টোরি রাইটার স্টিফেন কিং। ওনি হরর লেখার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু জানো, ওনি রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে পারেননা। সেটা যে কারণেই হোক, অন্ধকারভীতি (Nyctophobia or Achluophobia) বা অন্যকিছু। কিন্তু ওনি হরর লিখলেও এটা তাঁর দূর্বলতা। তিনি এমনই ছদ্মবেশে আছেন যে সেটা ঢাকা পড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আবার হয়তো নিজের জীবনের ব্যর্থতা বা অপূর্ণতা হিসাবে ধরে তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে পূর্ণতা চান। তুমি যতোটা আমাকে নিয়ে সংবেদনশীলতা দেখাও বারবার সেটাই মনে হয় আরকি।
-বলতে পারো অনেকটাই। পড়াশোনার জন্য আর বিশেষ করে মায়ের জন্য বয়স থাকতে প্রেম করতে না পারার অপূর্ণতাই তোমার মধ্যে খোঁজর চেষ্টা করি। অবশেষে পরিপূর্ণভাবে।
তিলো অরিকের কথার প্রত্যুত্তর করলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে। ওদের মাঝে এরপর আর মুখে কোনো কথা হলোনা। এরপর কেবলই জুড়ে গেলো একটা এলোমেলো পাজেল প্রথম রাতের ন্যায়। একে অপরের না বলা কথাগুলো নিজেরা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতাটাই হয়তো বোঝাপড়া।
অরিক আর তিলো আরোও একদিন আশাকুঞ্জ এ অবস্থান করলো। সপ্তাহ প্রায় শেষ বিধায় তিলো সিদ্ধান্ত নিলো একবারে পরের সপ্তাহ থেকেই ভার্সিটিতে যাবে। অরিক বাঁধা দেয়নি। এরপরের শুক্রবারের রিসেপশনটা একটা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজন করা হয়েছিলো আকবর সাহেবের দ্বারা। চমকে দেওয়ার মতো দৃশ্য ছিলো, সেখানে ফাহমিদা বেগমের উপস্থিতি। তিনি একটা মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে পুরো অনুষ্ঠানে একদম স্বাভাবিক ছিলেন। নিজের হাতে তিলোকে দুটো রুলি পড়িয়ে দিয়েছেন। তিলো অবাক চোখে ওনার দিকে তাকাতেই ওনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-ভেবো না মেনে নিয়েছি। আমার ছেলে তোমার জন্য আমার সাথে যোগাযোগ রাখছে না। ওদের দুজনের জন্যই আমার জীবনের সব। নিজের ছেলে মেয়ে হোক। তারপর বুঝতে পারবে তারা মায়ের কাছে কি! তোমার জন্য তো আমার ছেলে হারাতে পারবোনা আমি। তাছাড়া পাড়ার মহিলাদের নিয়মিত চর্চায় খলনায়িকা হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
তিলো হতাশ কন্ঠে বললো,
-ছেলে হাতে রাখতে নাটক করছেন?
ফাহমিদা বেগম ওর কথার প্রত্যুত্তর করার প্রয়োজনবোধ করলেন না। তিলো নিজেও বুঝতে পারছে, সমাজের ভয়ে মানুষ কতো কিছুই না করে! শুধু সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে থাকার জন্য! না হলে সমাজ আমাদের আসলে কি দেয়? যদি সামাজিক একটা অবস্থান না থাকে, তো এই সমাজের কেউই ফিরেও তাকায় না।
আজকের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে তুলির পাল্টে ফেলা ঘোরে তিলোই উল্টিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। এই দুতিনদিনে আগের লেশমাত্র নেই। সে সম্পূর্ণ সতেজ একটা ভঙ্গিমায় নবজন্মা তরুণী। তার এই কয়েকদিনের ‘হতশ্রী’ ভাবটা মুছে একজন ভার্সিটি পড়ুয়া সুন্দরী সে। তার কোলে ইশানকে আসলে ছেলে হিসাবে মানাচ্ছে না। তার বয়স হুট করেই কমে গিয়েছে যেন। ইশানের পরিচয় পেয়ে যে এখানে বেশ কিছু অপরিচিত ব্যথিত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। তুলির আকর্ষণীয় রূপ এবং অঙ্গভঙ্গি বেশ কয়েকজন অভিজাত মহিলার হৃদয় কেড়ে নিতেও সক্ষম, তাদের পরিবারের কোনো অবিবাহিত ছেলে বা পুনরায় বিবাহযোগ্য কেউ আছে কিনা সে হিসাব কষে নিতেও আরেকবার বাধ্য করছে।
তুলির হাসির জোয়ারেও যেন আজ ভাটা পড়ছে না। এই কয়েকদিন যতোটা গুমরে থেকেছে, সে হিসাব করে আজ উসুল করে নিচ্ছে। নাসীরা পারভীন যে কি মন্ত্র পড়িয়েছেন ওকে সেই খোঁজ তিলোর অজানা।
আজকে ফাহাদ আর কলিকে একসাথে দেখে অদ্ভুতভাবে তিলো নিজের ভেতর হিংসা অনুভব করেনি। তিলো বরং অরিকের পাশে নিজেকে দেখিয়ে অহংকার প্রকাশ করছিলো কিছুটা গোপনেই। ফাহাদ তার স্ত্রীসমেত তিলোর পাশে বসে কয়েকটা ছবি উঠিয়ে গিয়েছে সেই হাসি মুখে নিয়ে, যে হাসি তিলো আসলে ভালোবাসতো একসময়। হয়তো এখনো ভালো লাগে হাসিটা দেখলে। তিলোকে অভিনন্দন জানাতে ভোলেনি সে।
আজকের পুরো অনুষ্ঠানে প্রশংসার দাবিদার হয়ে উঠেছেন ফাহমিদা বেগম। তিলোকে মন থেকে মেনে নেওয়ার নাটক মঞ্চস্থ করতেই ওনি নায়িকা হিসাবে পদার্পন করেছেন। অরিকের যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা, তার পরিবারের অবস্থান (অবশ্য তিলোও সেই অবস্থানেই রয়েছে), তার ব্যক্তিত্ব, তার সুদর্শন হয়ে ওঠা, বিশেষত ‘সফল’ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কারণে অরিকের সুযোগ ছিলো একাধিক নারীর মধ্যে সবার সেরাকে বাছাই করে নেওয়ার যাদের কেউ কেউ হতে পারতো তিলোর থেকে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন, কেউ কেউ আরো ভালো অভিজাত পরিবারের, কেউ কেউ আরো অনেক বেশি সুন্দরী। কিন্তু অরিক সেটা না করে তিলোকে বেছে নিয়েছে এবং এখানে অধিকাংশ মানুষ জানে, সে কারো দ্বারা বাতিলকৃত। এটা অবশ্যই ফাহমিদা বেগম এবং মরিয়ম রহমান সগর্বে উপস্থাপন করেছেন এখানকার সবচেয়ে বড় বড় বাঘা বাঘা অতিথি, পাড়ার বিবিসি, রয়টার্স এর সাংবাদিক মহিলাদের কাছে। চৌধুরী বাড়ির কর্ত্রী তার বউমাকে নিয়ে এই আলোচনায় সামিল হয়েছেন একটা আমদানিকৃত দামী গাড়ি থেকে নেমেই। শিকদার বাড়ির বউয়েরও একই অবস্থা। তিলো ভেবে অবাক না হলেও হতাশ হয়েছে এটা ভেবে যে, মানুষের সামাজিক অবস্থান যতো উঁচুতেই হোকনা কেন, এই সমস্ত অতি তুচ্ছ বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে হীন প্রমাণ করতে বাঁধে না। বিবেকের দংশন তাদের বরং ছুঁতেও পারে না। তারা হয়তো ভুলে যাবে একসময়। কিন্তু যাকে নিয়ে এতোকিছু বলছে, সে কি কখনো ভুলতে পারবে বা কখনো তাদের মন থেকে সম্মান করতে পারবে, এটা ভেবেও দেখেনি কখনো।
ফাহমিদা বেগম বাহবা পেয়েছেন এজন্য বেশ।
অরিক তিলোর পাশে এসে দাঁড়াতেই তিলো অরিকের দিকে না ফিরে দূরে ফাহমিদা বেগমকে হেসে লুটোপুটি খেতে দেখে মৃদু হেসে বললো,
-এই গল্পের নায়িকা কে অরিক?
অরিক ওর প্রশ্ন বুঝতে না পেরে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজেও হাসলো। তারপর বললো,
-তাতে কিছু যায় আসে?
-নাহ্। এমনিই বলছিলাম আরকি।
-তো, যা বলছিলাম, তোমার বন্ধুরা?
-রিয়া আর অনি ছাড়া সবাই এসেছে। হয়তো খেতে গিয়েছে। তোমার সাথে দেখা হয়নি?
-নাহ্।
-থাক লাগবে না। লজ্জা পাবে তুমি। যতোই হোক, তুমি তাদের শিক্ষক সম্পর্কে পাশাপাশি আবার দুলাভাই।
বলেই তিলো মুচকি হাসলো। অরিক সেখানে আর না দাঁড়িয়ে আবারও অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
রাতের অনুষ্ঠানটা শেষ হলো বেশ রাত করেই, আর শেষ হলে অরিক আর তিলো বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফাহমিদা বেগম অরিকের কাছে এসে আবদার মাখা কন্ঠে ওনাদের সাথে যেতে বললেন। অরিক এতোগুলো দিন মায়ের থেকে দূরে থেকে নিজেও আলাদা মমত্ববোধ অনুভব করছে ওনার প্রতি। অগত্যা ওনাদের সাথেই গেলো। তিলো এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি হিসাবে ‘মায়ানীড়’ এ পা রাখলো। ফাহমিদা বেগম ছেলেকে ধরে রাখতে হোক বা সমাজের ভয়ে, তিলোকে বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ত্রুটি কোনো রাখেননি। তিলোর তো সত্যিই কয়েকবার মনে হয়েছে, ও ফাহমিদা বেগমের অরিককে হারানোর ভয়ের ইশকাপনের টেক্কা নয় বরং ওনি সত্যিই মেনে নিয়েছেন। ওনার মাঝে কোনোকিছু মেকি ছিলোনা হয়তো।
রাতে তিলো ফ্রেশ না হয়েই নিজের শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। অনেক বেশি ক্লান্ত লাগছে। চিৎ হয়ে শুয়ে দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে চোখ বুজে ফেললো। অরিক রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বললো,
-কেমন কাটলো আজকের দিনটা?
তিলো চোখ মেলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বললো,
-এলোমেলো।
অরিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তিলো সেটা না দেখেই ওর নিরবতায় বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। অরিক ওকে তাড়া দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। তিলো অলস ভঙ্গিমায় উঠে বসে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। আদুরে কন্ঠে বললো,
-এভাবেই শুয়ে পড়ি। ইচ্ছা করছে না কিছু করতে।
অরিক নাক শিটকে বললো,
-কেউ একজন আমাকে খুব বেশি সূচিবাইগিরি শেখায় হয়তো। রাতে ব্রাশ না করে মুখের ব্যাকটেরিয়াদের খাবারের ব্যবস্থা করা কোন ধরনের পরিচ্ছন্নতা?
তিলো বিরক্ত হয়ে দপাদপ পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো। অরিক ওর যাওয়ার ভঙ্গি দেখে হেসে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম।
রাতের শেষ প্রহর। কিছুক্ষণ পরই ফজরের আযান দিবে। রাতের নিরবতার মনোযোগ ভঙ্গ হয়ে তিলোর ফোনটা একটা অভদ্র বিড়ালের মতো কথা না শুনে বেজে উঠলো। তিলো ঘুমিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। কাঁচা ঘুমটা নষ্ট হওয়াতে তিলো ভ্রু কুঁচকে ফেললো সাথে সাথে। পাশাপাশি অরিকও। তিলোর হঠাৎ খেয়াল হলো ওর পাশে অরিক ঘুমিয়ে আছে। এই শব্দ বেশিক্ষণ বাজলে ওর ঘুম ভেঙে যাবে। তিলো হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে ফোনটা রিসিভ করার আগে স্ক্রিনের উপর নামটা দেখে দারুণ চমকে উঠলো।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৪১,,
তিলোকে ফোনটা রিয়া করেছে। প্রায় আড়াই মাসের ব্যবধানে রিয়ার ফোন পেয়ে তিলো যেমন অবাক হয়েছে, তেমনি ওর ভেতর অজানা ভয় জেঁকে বসেছে। পাশাপাশি অদ্ভুত একটা অনুভূতি। দমিয়ে রাখা কৌতুহল এবং আবেগ একইসাথে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে একটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির হঠাৎ জেগে ওঠার মতো।
তিলো খুব বেশি না ভেবে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-কেমন আছিস রি…
আর কিছু বলার আগে চুপ করে গেলো। এতো জোরে বলায় অরিকের অসুবিধা হতে পারে ভেবে তিলো বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দার দরজা খুলে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে তিলো নিভে যাওয়া কন্ঠে বললো,
-রিয়া! তুই আছিস?
এবার ভাঙা একটা কন্ঠে ‘হুম’ শব্দটা ক্ষীণভাবে তিলোর কানে এসে পৌঁছালো। এতগুলো দিন পর রিয়ার কন্ঠ শুনতে পেয়ে তিলোর শরীরে অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেলো। গায়ের রোমগুলোকে খাড়া হয়ে যেতে অনুভব করলো সে। তিলো আবেগি কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
-কেমন আছিস তুই? এতোগুলো দিন যোগাযোগ কেন করিসনি। বাড়ি গেলেও দেখা করিস না। আমাদের কেমন লাগে তোর কোনো ধারণা আছে?
রিয়া ওর সম্পূর্ণ কথা অগ্রাহ্য করে মলিন কন্ঠে বললো,
-তুই বিয়ে করেছিস। তাই না?
তিলো দমে গেলো। নিজের অনুভূতিগুলো আড়াল করে বললো,
-হ্যাঁ।
-তোর বর তোর পাশেই ঘুমায়। তাই না?
রিয়ার প্রশ্নে তিলো বিব্রতবোধ করতে শুনতে করেছে। এরপরও ওকে এবিষয়ে কিছু না বলে কেবল ‘হুম’ বললো। রিয়া আবারও বললো,
-তোকে খুব ভালোবাসে সে?
-বাদ দে। আগে তো বল তোর কি অবস্থা?
রিয়া এবারও ওকে একইভাবে অগ্রাহ্য করে বললো,
-সত্যিই খুব ভালোবাসে?
তিলো চুপ করে গেলো। রিয়ার আচরণ ওর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ও আগে কখনো এভাবে কথা বলেনি। ওর কন্ঠে যেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, সেটা কেবলই শূন্যতা। যেন খাঁ খাঁ মরুভূমি। তৃষ্ণার্ত কোনো পথিক পানির সন্ধ্যায় মরিয়া।
তিলোকে চুপ করে থাকতে দেখে রিয়া আবারও বললো,
-বল না। খুব ভালোবাসে তোকে? আদর করে?
তিলো এবার সত্যিই ওর কথায় খুব বেশি বিরক্ত। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,
-আমার ঘুম আসছে। রাখছি আমি।
রিয়া এবার মৃদু হেসে বললো,
-বিরক্ত হচ্ছিস?
তিলো উত্তর দিলো না। তবে ফোনও কাটলো না। রিয়া দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো,
-জানিস তিল, আহান আমাকে বলেছিলো আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না। সস্তা যেসমস্ত প্রমিজ করে থাকে সস্তা সম্পর্কে। আমাদের সম্পর্কটা আসলে সস্তাই ছিলো। দেখ এখন, আমার পাশে এখন ফাঁকাই থাকে। ছেড়ে চলে গেলো। জানিস, ও বলেছিলো, আমাদের পড়াশোনা শেষ করার পর আমাদের বেবি আসুক পৃথিবীতে? কিন্তু আমি কি বলেছিলাম? ওকে বলেছিলাম, আমার এখনই বেবি চাই। আমাদের কোলে তাদের নাতি নাতনি দেখলে ওরা সবাই মেনে নেবে আমাদের।
রিয়া থামলো। তিলো চুপ করে ওর কথা শুনছিলো। রিয়া আবারও বললো,
-সরি। এতো রাতে আমার আজগুবি অমূলক কথাগুলো বলতে তোকে ফোন করে বিরক্ত করলাম। আসলে একটা ব্যাপার আছে, তোর বিবাহিত জীবনের জন্য আমার শুভকামনা। দেখিস, তোর খুব সুইট কিউট একটা বেবি হবে। মেয়ে হবে৷ তোর মতো মিষ্টি দেখতে আর গায়ের রং অরিক স্যারের মতো হবে। আহান বলতো। ও বলতো, আমাদের প্রথম সন্তান একটা মেয়ে হোক। তোর হবে দেখিস। খুব সুন্দর হবে সে।
তিলো এবারও কিছু বললো না। নির্বাক হয়ে ওর কথাগুলো শুনে ছলছল হয়ে ওঠা চোখজোড়ায় জমে যাওয়া পানি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো। রিয়ার কন্ঠ আরেকবার ভেঙে গিয়েছে। সে নাক টেনে বললো,
-ভালো থাকিস। আর ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের কাছে ধরে রাখিস। আঁকড়ে ধরে থাকবি একদম। কোনোদিনও ছাড়বি না যতক্ষণ তোর নিশ্বাস তোকে ছেড়ে না যায়। হারিয়ে ফেলিস না প্লিজ। তোকে খুব ভালোবাসি রে। আমার বন্ধুগুলো সবাইকে খুব ভালোবাসি। আমি চাই না, আর কারো আমার মতো কিছু হোক। আবারও তোর বিবাহিত জীবনের জন্য আমার শুভকামনা। হ্যাপি ম্যারিড লাইফ। আচ্ছা, রাখছি। তুই ঘুমিয়ে পড়। আমারও ঘুমের প্রয়োজন। আল্লাহ হাফেজ।
রিয়া ফোন কেটে দিলো তিলোকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। তিলোর হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভূত হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছে কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। দূরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ও নিজের এই অনুভূতির কোনো মানে খুঁজে পেলোনা।
তিলো বেশি ভাবলো না। আবার নিজের মনের মাঝেও কোনো একটা বিষয় কাঁটার মতো ফুটছে। তিলো রুমে ফিরে এসে অরিকের পাশে শুয়ে পড়লো। আবারও ঘুরে অরিকের দিকে ফিরে মাথার নিচে একটা হাত ভাজ করে পুরে দিলো। অরিক ওর দিকে ফিরেই ঘুমিয়ে আছে। রাস্তা থেকে আসার আলোটা একদম ওর মুখে পড়ছে। তিলো কয়েক মূহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে চোখ বুজে ফেললো। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলোনা। বাকিটা রাত ওর মাঝে অবচেতন একটা অস্থিরতা কাজ করেছে। তিলো ভালো করে ঘুমাতে পারলোনা। ঘুমের মাঝেও একটা সতর্কতা। বারবার জেগে উঠেছে কোনো কারণ ছাড়াই। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ ওর গলা ধরে এসেছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে পারলে খুব শান্তি লাগতো। নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে গলার কাছে শ্বাস আটকে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত বাতাসের অভাব। ক্লান্তিতে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। তিলো যতোবারই চোখ মেলেছে পাশে অরিককে দেখতে পেয়ে স্বস্তি পেয়েছে। রিয়ার কথামতো তাকে আঁকড়ে ধরে থাকা প্রয়োজন। হারিয়ে যেতে দেবে না তিলো ততদিন পর্যন্ত যতদিন ওর হৃৎস্পন্দন থেমে না যায়। শেষবার তিলো চোখ মেলে অরিকের দিকে এগিয়ে এসে ওর বুকের ওপর হাত রেখে ঘুমালো। ক্ষণিকের জন্য নয় বরং বরাবরের মতোই সে কিছু একটা দ্বারা পরাভূত হলো, যেটাকে তার বোধ হলো প্রেম।
পরদিন ভোরে ফাহমিদা বেগমের ডাকাডাকিতে অরিকের ঘুম ভেঙে গেলো। ও চোখ মেলে নিজের পাশে তিলোকে ঘুমাতে দেখে মৃদু হেসে উঠে বসলো। ফাহমিদা বেগম উত্তেজিত হয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। যেন ভেঙে ফেলবেন। অরিক দ্রুত উঠে দরজা খুলে দিতেই ওনি রাগত্ব স্বরে বললেন,
-তোর বউ কোথায়?
অরিক একটু থমকে বললো,
-ও তো এখনও ঘুমাচ্ছে। কিছু হয়েছে আম্মু?
ফাহমিদা বেগম আরো রেগে কর্কশ গলায় বললেন,
-আর হয়েছে! তা তোর বউকেই জিজ্ঞাসা কর। ওর জন্য পুলিশ এসেছে বাড়িতে। কি করেছে জিজ্ঞাসা কর ওকে।
অরিক ওর মায়ের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। ও ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-ও আবার কি করবে? পুলিশ কেন আসলো?
ফাহমিদা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
-এতো কথা না বলে ডাক। কি বলছেন তারা? ওকে কি জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ওর কোন বান্ধবী কি করেছে?
-তুমি যাও। আমি দেখছি।
ফাহমিদা বেগম তবুও গেলেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অরিক কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে মৃদুস্বরে তিলোকে ডাকতে শুরু করলো। তিলো না উঠে বরং আরো আরামে কম্বলটা দিয়ে মুড়ি দিলো। অরিক এবার বেশ জোরেই ডাকলো পাশাপাশি এটাও বললো যে পুলিশ এসেছে। তিলো পুলিশ শব্দটা কানে যেতেই উঠে পড়লো। চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞাসা করলো,
-কে পুলিশ? কোন পুলিশ এসেছে? কেন এসেছে?
অরিক হয়তো ওর ঘুম থেকে উঠে আধো কন্ঠে হেসে দিতো। কিন্তু এখন ও সেই অবস্থায় নেই। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
-তোমাকে চাচ্ছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখা করো।
তিলো চোখ ডলা থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমাকে মানে? আমি কি করেছি? অরিক, বিশ্বাস করো আমি কিচ্ছু করিনি যে পুলিশ আসবে। আমি তো আম্মুর ব্যাগ থেকে দশটা টাকাও কখনো চুরি করিনি।
ফাহমিদা বেগম বিরক্ত হলেন ওদের সম্পূর্ণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। বিরক্ত হয়েই বললেন,
-কি করেছো তুমি তা তো ওনারা আর তুমিই বলতে পারো। এখন সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি নিচে এসো। আর পারি না। আর কতো যে দেখা লাগবে? এবাড়িতে অবশেষে কিনা পুলিশও ঢুকলো।
বলতে বলতে ওনি নিচে চলে গেলেন। অরিক চোখের ইশারায় ওকে দ্রুত আসতে বলে নিজেও নিচে চলে গেলো।
তিলো অবাক হলেও নিজের কৌতুহল মেটানোর তাগিদেই হোক বা বাধ্য হয়ে, দ্রুতই নিচে গেলো। লিভিং রুমে কয়েকজন পুলিশ। সাথে মহিলা কনস্টেবলও আছে। তিলোর ভয় ভয় লাগলেও ও চুপচাপ সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন আকবর সাহেবের সামনাসামনি সোফায় বসে চা পান করছে। অরিক চিন্তিত ভঙ্গিতে সোফার হ্যান্ডেলে কনুই ঠেকিয়ে কপালে আঙুল স্লাইড করে চলেছে। তিলো সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে অভ্র বলে উঠলো,
-এই তো তিল।
সোফায় বসে থাকা পুলিশ অফিসার তিলোর দিকে তাকিয়ে একবার ওকে চোখ দিয়ে মেপে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-আপনি মিস…মিসেস তিলোত্তমা ইয়েসয়ি?
তিলো মৃদু কন্ঠে বললো,
-জ্বি।
-মিসেস রিয়া এহসান আপনার বন্ধু?
-জ্বি।
-কালরাতে আপনাকে ফোন করেছিলেন তিনি?
তিলো এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছে। কম্পিত কণ্ঠে ও হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো। পুলিশ অফিসারটি আবারও বললেন,
-সেটাই হওয়ার কথা, ওনার কল লিস্টে শেষের নাম্বারটা আপনার৷ আমি বলতে দুঃখিত হচ্ছি যে, তিনি আর নেই। ভোরের আগেই ওনার বাবা মায়ের সামনেই ওনি ওনাদের বসবাসরত বারো তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহনন করেছেন।
#চলবে
#চলবে
#চলবে