মন দিয়েছে ধরা পর্ব -০৪

#মন_দিয়েছে_ধরা
#পর্বঃ৪
লেখনীতে#পুষ্পিতা_প্রিমা

খাঁচায় বন্দি পাখিটা যেন বাড়ির সকলের মধ্যে চলতে থাকা মনোমালিন্য টের পেয়েছে তাই সেও আজকাল তেমন কথা বলেনা, ডানা ঝাপটায় না, চেঁচামেচি করে না। রেহান তার যত্ন করে। খাওয়ায়। গোসল করায়। মাঝেমধ্যে চাচ্চু বাড়িতে থাকলে সে আর চাচ্চু মিনির সাথে সময় কাটায়। আজ তার ঘরে কাকিয়াকে দেখে তার মন খুশি হয়ে গেল। বলল

কাকিয়া তুমি মিনিকে নেবে?

ইশা মাথা নাড়ালো। রেহান মিনিকে দিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে বলল,

কাকিয়া একটা কথা বলি?

বলো সোনা।

পরী কেন এখানে আসে না? বেবিরা তো পেরেন্টসের সাথে থাকে।

ইশা মলিন হাসলো। ওর গালে হাত বুলিয়ে বলল,

পরী বেবির আরও চারটে পেরেন্টস আছে ওইখানে। তাই আসেনা।

চাচ্চু কাল পরীর কথা বলছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো পরীকে মিস করি কিনা। পরীকে তো আমি খুব মিস করি। আমার চাইতেও বেশি মিস করে চাচ্চু। পরী আর কবে আসবে?

খুব শীঘ্রই আসবে।

পরী এবার এলে আমি আর চাচ্চু ওকে যেতে দেব না। তুমি জানো মিনিও পরীকে মিস করে তাই না মিনি?

মিনি ডানা ঝাপটে মিনমিন করে ডেকে উঠলো

পরীইইই!

ইশা বলল

তুমি পড়ো সোনা। কাকিয়া মিনিকে নিয়ে যাই।

আচ্ছা।

রেহানের ঘর থেকে চলে এল ইশা। আদি হসপিটালে। রাইনার সাথে রান্নাবান্না ছাড়া বাকি সময়টা তার একা একা কাটে। শ্বাশুড়ি মাঝেমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তাকে দেখে যায় কিন্তু সে কথা বলে না। আজ তাদের জন্য এই পরিস্থিতি। একা থাকলে পরীর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে ইশার। নিজের জন্য না হলেও ডক্টরের জন্য তার কষ্ট হয়। মানুষটাকে সে হাসতে দেখেনা অনেকদিন।

টেবিলের উপর বসিয়ে দিল সে মিনিকে। মিনি পালক খোঁচাচ্ছে ঠোঁট দিয়ে। ইশা টেবিলে মাথা ফেলে রাখলো। মিনি ডেকে উঠলো

মিসটি মিসটি।

ইশা মৃদু হাসলো। বলল

তোমার মনিবের মন খারাপ। আদির।

আদিইই আদিইই।

ইশা বলল

মিনি তুমি পরীর কাছে যেতে পারবে?

মিনি জবাব দিল না। ইশা আবারও জিজ্ঞেস করলো মিনি তোমার মনিব কখন আসবে বলতে পারো?

মিনি এবারও জবাব দিল না। ইশা মাথা ফেলে রেখে চোখ বুঁজে থাকলো চুপটি করে। কল্পনায় পরীকে ভাবলো। মেয়েটাকে কতদিন দেখেনা সে।

এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। পরীকে এবার সে নিয়ে আসবে।

ভাবতে ভাবতে সে রিপের ফোনে ফোন দিল। ভেবেছে রিপদা তাকে খুব বকবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রিপ ফোন তুলে বলল

ইশু! কেমন আছিস? তোকে তো ফোনে পাওয়ায় যাচ্ছে না। কি অবস্থা ওখানে?

ইশা ভারাক্রান্ত মনে বলল

একটুও ভালো নেই। পরী কেমন আছে? ওকে একটু নিয়ে আসবে তুমি?

কি হয়েছে? কোনো কিছু কি হয়েছে? আমাকে বল।

তুমি তো জানো উনি সারাক্ষণ পরীর নাম জপ করছে। যতক্ষন হসপিটালে থাকে ততক্ষণ সব ঠিক থাকে। বাড়িতে আসার পরপরই পাগলামি করে। তুমি একটু ওকে দিয়ে যাবে বড়দাকে বুঝিয়ে।

এভাবে বলছিস কেন? কথা তো এমনই ছিল। আমি সন্ধ্যায় নিয়ে যাব। কিন্তু বাড়িতে যাব না। তোর শ্বশুরের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছেনা আপাতত।

সত্যি নিয়ে আসবে?

হ্যা। তুই কি কাঁদছিস?

না আর কাঁদছি না। সবাই কেমন আছে বাড়িতে?

সবাই ভালো আছে।

নীরা?

ভালো আছে।

আমার পরী।

কালকেই তোর কথা বলছিল। আমি নিয়ে যাচ্ছি।

ইশা উৎফুল্ল মনে রাইনার কাছে গেল। বলল

বড় আপা আজ পরী আসছে।

এমা কি বলিস? সত্যি?

হুমম।

আদি এবার একটু শান্তি হবে।

তাই ভাবছি।

আপা শোনো না পরী খাবে এমন কিছু বানিয়ে দাও না প্লিজ। আমি ডক্টরকে বলে আসি।

এই নাহ। বলিস না।

কেন?

ওকে সারপ্রাইজ দিবি। পরীকে দেখে ও চমকে যাবে।

ঠিক বলেছ।

আচ্ছা তুমি তো খুব ভালো পায়েস রান্না করো। পরীও পায়েস পছন্দ করে। একটু পায়েস করবে?

আচ্ছা সে করব। কিন্তু ওকে নিয়ে আসবে কে?

রিপদা নিয়ে আসবে বললো। কিন্তু বাড়িতে আসবে না।

তাহলে দারোয়ান কাকাকে বলে রাখিস।

ইশা মাথা নেড়ে চলে গেল। পরী কি সত্যিই আসছে? তার এত আনন্দ হচ্ছে। আর তর সইছেনা।

সন্ধ্যা নাগাদ পরীকে নিয়ে এল রিপ। মুনার অবশ্য মন খারাপ ছিল আদি পরীকে আর আসতে দেবে কিনা এ নিয়ে। রিপ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলেছে। তাই আসতে দিয়েছে।
সম্পর্ক ঠিক হোক বাকি ঝামেলা আপনাআপনি দূর হয়ে যাবে এটা তার বিশ্বাস। দিনশেষে সবাই সবার। দুই বাড়ির মানুষ একে অপরের সাথে মিত্র হয়ে উঠুক এটাই তার চাওয়া।

ইশা গেইটের কাছাকাছি ছুটে যেতেই রিপকে দেখতে পেল। রিপের কোলে পরী। সাদা ফ্রক পড়েছে। চুলে সাদা ফুল লাগিয়েছে। সাদা জুতো। রিপের কাঁধে মাথা ফেলে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে।
কান্নাচোখে তাকিয়ে থাকলো ইশা। রিপ তাকে দেখে হাসলো। এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

কেমন শুকিয়ে গিয়েছিস ইশু। তোর ডক্টর কি তোর যত্ন করে না? কোথায় সে?

হসপিটালে। সারাক্ষণ পরী পরী করে। তুমি এভাবে চলে যাবে? আমার এটা মোটেও ভালো লাগছে না।

একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে তখন যাব। তুই কবে আসবি? মা বাবা তোর কথা বলছে।

ডক্টর যেতে দেয় না। পরীকে পেয়ে যদি মন ভালো হয়ে যায় তাহলে কথাটা বলে দেখব।

আচ্ছা। নে তোর মেয়েকে। মা এটা কে দেখো।

পরী মাথা তুললো না। ইশা পিঠ ছুঁয়ে ডাকলো,

পরী।

পরী মাথা তুলে এদিকওদিক তাকিয়ে ইশাকে দেখার সাথে সাথে দাঁত দেখিয়ে হেসে উঠলো। হাত মুঠি করে উপরে তুলে ডাকলো

আমমা।

ইশা আর কোনো কথা বলতে পারলো না। কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ। রিপ মা মেয়ের কান্ড দেখে হেসে বলল

আচ্ছা আমি আসি।

পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দুটো পাঁচশো টাকার নোট ইশার হাতের ভেতর গুঁজে দিয়ে বলল

পথে দোকানপাটে তোর জন্য আনার মতো কিছু পেলাম না। এগুলো রাখ। নিজের ইচ্ছেমতো কিছু কিনে নিস।

ইশা আবেগি হয়ে বলল,

তুমি আমাকে এখনো ছোট বানিয়ে রাখবে?

তুই আর বড় হলি কোথায়?
ভালো থাকিস হ্যা? আর হ্যা তোর পাগল বরকে বলবি রাগ কমাতে। ভাইরাসটা তার মেয়েকে পেয়েছে। কাল কামড়ে দাঁত ফুটিয়ে দিল বাবার হাতে।

ইশা পরীকে জিজ্ঞেস করলো

তাই? দাদাভাইকে দাঁত ফুটিয়ে দিয়েছ?

পরী গোলগোল চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল

নানানা।

ইশা আর রিপ হেসে উঠলো।

পরীর গালে আদর করে রিপ বলল

আচ্ছা আসি। সাবধানে রাখিস ওকে। আসি মা।

রিপ কিছুদূর যেতেই পরী ঠোঁট উল্টালো। ডেকে বলল,

রিইই নাই?

রিপ পেছনে ফিরে হাত নেড়ে টা টা দিল। পরী টা টা দিতে দিতে ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠলো। ওর গালের সাথে গাল চেপে ইশাও কেঁদে উঠলো। ডাকলো

আমার পরী।

__________________

আদি হসপিটাল থেকে ফিরে লিভিংরুমে আজ কাউকে দেখতে পেল না। সোজা ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ইশা এসে পথ আটকালো। হাসলো। আদি তার দিকে কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে বলল

কি সমস্যা?

কোনো সমস্যা না। আপনার চোখ বন্ধ করুন।

কেন?

আরেহ করুন না।

আদি চোখ বন্ধ করলো। ইশা তাকে ধরে ঘরের দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল

এবার চোখ খুলুন।

আদি চট করে চোখ খুলতেই শক খেল যেন। বিছানার উপর বসে আছে একটি বাচ্চা মেয়ে। পড়নে তার কেনা সাদা হলুদ রঙের টিশার্ট। মাথার দুপাশে দুটো ছোট ছোট ঝুঁটি করা। গালফুলিয়ে খেলনা নিয়ে খেলছে।

ইশার দিকে তাকালো আদি। ইশা হেসে বলল

কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?

আদির এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। এপ্রোন, ব্যাগ সব ফেলে পরীর কাছে গিয়ে বসে মাথা নামিয়ে ডাকলো

আম্মা!

পরী চোখ তুলে চাইলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর খিকখিক করে হেসে উঠে মুখটা আদির গালে ঠেকিয়ে ডাকলো

আববা।

আদি হেসে উঠে কোলে তুলে নিয়ে গালে আদর বসিয়ে বুকের উপর টেনে নিল। জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে ।
পরী হাসতে হাসতে তার চুল টেনে ধরলো। বাবা মেয়ে একসাথে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে আদির চোখে জল নেমে গেল। ইশার দিকে তাকিয়ে হাসি থামিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে বলল

থ্যাংকিউ মিষ্টি।

ইশা হাসলো। পাশে শুইয়ে পরীর গালে চুমু দিল। আদি ওকে আর পরীকে একসাথে দেখে বলল

মিষ্টি উই আর সো কিউট ফ্যামিলি। এম আই রাইট?

ইশা তাকে কতদিন পর প্রাণখুলে হাসতে দেখলো!

মিষ্টি হেসে বলল

হুম। মা মিননির কাছে যাবেন?

আদি পরীকে বুকের সাথে ধরে রেখে বলল

কোথাও যাবে না ও। তুমি মিনিকে নিয়ে এসো এখানে।

ইশা মিনিকে নিয়ে আসার জন্য যাচ্ছিলো। আদি ডাকলো

মিষ্টি!

হুম।

কে দিয়ে গেল পরীকে?

রিপদা।

রিপ?

হুম। আপনি আমার রিপদার উপর রেগে আছেন? আপনি জানেন আমার রিপদার মতো মানুষই হয় না। ওয়ান পিস।

আদি কিছু বলল না আর। পরীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। পরী তার নাক কামড়ে দিতে চাইছে আদি হেসে লুটোপুটি।

_____________________

নীরা অন্তুন বানালো বিকেলের নাশতায় খাওয়ার জন্য। কিন্তু খাওয়ার পর দেখলো সে লবণ কম দিয়েছে। মুখে দিতেই পানসা পানসা ঠেকছে। বিকেলের নাশতা সবার একসাথে খাওয়া হয় মাগরিবের নামাজের পর। রিপ আর জহির সাহেব নামাজ থেকে এসে চা খেতে বসেছেন। রিক অফিস থেকে ফিরেছে সবে। মুখহাত ধুুঁয়ে সেও নীচে এসে নাশতার টেবিলে যোগ দিল। আজ পরী নেই তাই অফিস থেকে আসার সাথে সাথে কেউ কোলে ঝাপ দেয়নি। পরীর কথা তেমন তোলাও যাবেনা। মুনার মন খারাপ হবে। সে থাকুক ওই বাড়িতে কিছুদিন।
নাশতা খেতে বসে সবার মুখ দেখতে নাশতার মতো পানসা পানসা ঠেকলো নীরার। তারপরও তারা খেয়েই যাচ্ছে। সেও চুপ থাকলো। রিপ রেজওয়ান খান এখনো মুখে দেয়নি। যেই মুখে দিল নীরা দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করলো। নীরা সবার চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখছে। রিপ গালের ভেতর দেয়ামাত্রই নীরার দিকে তাকালো। লজ্জায় জান বেরিয়ে আসার উপক্রম নীরার। ইচ্ছে হলো মাটিতে ঢুকে পড়তে। রিপ ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চিবোতে লাগলো। রিক খেতে খেতে বলল

নীরু তুই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস রে।

নীরা বিস্মিত চোখে তাকালো। বলল

হ্যা?

মানে চমৎকার হয়েছে। রিপের মতো।

রিপ গোলগোল চোখে রিকের দিকে তাকালো। জহির মিয়া খেতে খেতে বললেন

হু ভালো ভালো।

নীরা বলল

ভালো হয়নি নাহ? আমার মনে হয়েছিল লবণ বেশি হয়ে যাবে তাই আর দিইনি।

কিরে তুই কিছু বলছিস না কেন? ভালো হয়েছে না?

মুনা হেসে উঠে বলল

আরেহ পানসা হয়েছে এটা বলে দিলেই তো হয়।

তালহা বেগম বললেন

মায়ে বাপে আদরে আদরে বড় করছে। কোনো কাজকাম শেখায়নি। ইশুরে তো আমি ধরে শেখাইছিলাম সব। বড় বউরেও শেখাইছি। তাই না?

মুনা মাথা দুলালো। নীরা মন খারাপ করে থাকলো। রিপের সাথে চোখাচোখি হতেই চেহারা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। এবং খেয়াল করলো রিপ নাশতাটা না খেয়ে রেখে দেয়নি। পুরোটা খেয়েছে। নীরাকে এটাই বেশি সান্ত্বনা দিয়েছে। তার বুঝদার স্বামী। প্রিয় পুরুষ। তার মন খারাপ দূর হয়ে গেল মুহূর্তেই।

________

পরীকে ছাড়া একদম ভালো লাগছে না আপা। কেমন খালি খালি লাগছে। মুনার তো ক্ষণেক্ষণে মনে পড়ে তাকে এখন আরও বেশি করে মনে পড়ে গেল। সে কিছুই বলল না।

নীরা বলল

ভাবছি ইশুও কি করে থাকে? আমি তো বাবা চোখের আড়াল করব না আমার বাচ্চাকে। জানো আপা আমার না অনেক শখ। আমার এত্তগুলা বাচ্চা থাকবে। সারাক্ষণ বাড়িতে হৈচৈ করবে, মারামারি করবে, তারপর সবাই একসাথে বসে কাঁদতে থাকবে আমি তাদের মাঝখানে বসে হি হি করে হাসতে থাকবো। বলেই সে হাসতে লাগলো।

মুনা ফিক করে হেসে উঠে বলল

তাই? রিপকে বলব এটা?

নীরা জিহ্বায় কামড় দিল।

মুনা মাথা নামিয়ে মিনমিন করে বলল

পেছনে দেখ।

নীরা চট করে পেছনে ফিরে দেখলো রিপ ফ্রিজে কি যেন খুঁজছে। সে কপালে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় বসিয়ে বলল

খোদা খোদা এ মুখ আমি কি করে দেখাবো?

মুনা হাসতে হাসতে রিপের কাছে গেল। বলল

কি খুঁজছিস রে?

একটা পেপসির বোতল রেখেছিলাম। কোথায় সেটা?

নীরু জানে। নীরু একটু খুঁজে দে তো। আমাকে তোর বড়দা ডেকেছে।

নীরা মনে মনে বলল

ধুরর যমের সামনে রেখে যায় শুধু আমাকে।

রিপ তাকে জায়গা করে দিয়ে দাঁড়ালো। নীরা ফ্রিজ খুলে দেখতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতেে একসময় বলে উঠলো,

ধুর মরা। খুঁজে পাচ্ছি না। এসব ঝামেলার কাজ আমাকে দিয়ে লাভ আছে? কোনো কাজ নিজেরা করতে পারেনা। এমনিতে বউ লাগেনা কাজের সময় বউ লাগে।

রিপ গলা খাঁকাড়ি দিতেই নীরা চুপ হয়ে গেল। পেপসির বোতল খুঁজে পেতেই মনে পড়লো কাল সে ঢকঢক করে কয়েক চুমুক খেয়ে ফেলেছে। হায় আল্লাহ এখন দেখলে কি বলবে এই এডভোকেট?

পেয়েছ? না পেলে সরে দাঁড়াও। একটা জিনিস ঠিকঠাক খুঁজে দিতে পারেনা সে নাকি একগাদা বাচ্চা কাচ্চা সামলাবে!

নীরা কানটা ঝাঁঝাঁ করে উঠলো। সে পেপসির বোতলটা দিতেই রিপ সেটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। নিয়ে নিতেই নীরা শাড়ির আঁচল ধরে আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল

ইয়ে মানে ওটাতে আমি মুখ বসিয়ে খেয়েছি।

রিপ বিস্মায়াবিষ্ট চোখে তাকিয়ে রইলো।

কি আজব মহিলা! খেয়েছে খেয়েছে আবার বড়মুখ করে বলছে মুখ বসিয়ে খেয়েছে। বড়বড় ডিগ্রিধারী এডভোকেটের সাথে যুক্তিতর্কে জয় চিনিয়ে আনা রিপ রেজওয়ান খান কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না মেয়েটার সাথে কথা বলতে গেলে। কি ধাঁচে গড়া সে?

রিপ বোতলটা নিয়ে চলে গেল এবং নীরাকে সেটাই বেশি অবাক করেছে। সে অখুশি হয়নি বরং খুশিই হয়েছে। খানসাহেবও ওই বোতলে মুখ বসিয়ে পেপসি খাবে। এটা দারুণ। তবে নীরাকে হতাশ করলো যখন সে গিয়ে দেখলো রিপ গ্লাসে ঢেলে পেপসি খাচ্ছে। সে মুখ বাঁকালো। হুহ ঢং।

__________________

নীরা গুনগুন করে গান গাইছে। আজকাল তার ভালো দিন যাচ্ছে। এডভোকেট সাহেব আজকাল তার সাথে কথা বলছে টুকটাক। হোক ঝাল তেঁতো তাতে কি বলছে এটাই অনেক বেশি। এবার মিষ্টিসুরে কি করে কথা বলতে হয় সেটাই শেখাবে নীরা। সে যে গানটি গাইছে সেটা যে সে গান না।

কি দিয়া মন কাড়িলা ও বন্ধুরে
অন্তরে পিরীতির আগুন ধরাইলা

রিপ ঘরে ঢুকতে দেখে শুনতে পেল নীরার মুখে বিচ্ছিরি গানটি। মানুষ এমন বিচ্ছিরিভাবে গান গায়? না এই মেয়ের দ্বারা সব সম্ভব।

তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেও নীরা গান গাওয়া থামালো না। সে গাইতে লাগলো,

নজরে নজরে রাখিয়া আমারে
নয়নের বান মারিলা ও বন্ধুরে
অন্তরে পিরীতির আগুন ধরাইলা

রিপ খুকখুক করে কেশে উঠলো যাতে নীরা টের পায় সে ঘরে এসেছে। নীরা টের পেলেও থামলো না। নিজের কাপড়চোপড় ভাঁজ করে ওয়ারড্রবে রাখতে রাখতে গান গেয়েই চলেছে। মেয়েটার লাজলজ্জা ভেঙে যাচ্ছে। কি শুরু করেছে?

সে ডেকে উঠলো

নীরা!

নীরা ‘ হু’ বলে আবারও গান গাইতে লাগলো। রিপ বলল

তোমার এসব বন্ধ করো। বাইরেও শোনা যাচ্ছে।

তাতে কি?

রিপ দ্বিগুণ অবাক হলো। বলল

তাতে কি মানে? এসব কি গান গাইছো তুমি? কোনো আগামাথা আছে এসবের?

তো কি আপনার মতো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবো। আপনি বোবা তাই বলে আমাকে বোবা হয়ে থাকতে বলবেন?

আমি বোবা?

বোবা সেজে থাকেন।

আমি মোটেও বোবা সেজে থাকিনা।

থাকেন।

থাকিনা।

থাকেন।

রিপ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো। নীরাও। কোমরে হাত রেখে বলল

এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আব্বা বলেছে বৌমা এটা তোমার নিজের বাড়ির মতো। আপনিই বলুন নিজের বাড়িতে আমি নিজের ইচ্ছেমতো চলবো না? গান গাইবো কি গাইবো না এটা আমার স্বাধীনতা। আপনি আইনের লোক হয়ে যদি আপনাকে নতুন করে বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে শেখাতে হয় তাহলে আফসোসের সাথে বলতে হয় লন্ডন থেকে ওকালতি পাস করে আসা স্বনামধন্য সুপরিচিত এডভোকেট রিপ রেজওয়ান খান উনার স্ত্রীর কাছে খুব বিচ্ছিরিভাবে হেরে গেল।

রিপ কোনোকথা না বলে চুপচাপ গম্ভীরমুখে চেয়ে আছে।

নীরা হাঁটতে হাঁটতে হাত নেড়ে নেড়ে বলল

আমি ভেবেই পাচ্ছি না আপনি এত কম কথা বলে কিভাবে এত কেস জিতে যান। জর্জ সাহেবও নিশ্চয়ই আমার মতো পাগলা তাই সহজেই ইমপ্রেস হয়ে যায়।

বলেই সে হাসলো ।

রিপ বলল,

আমি তোমার মতো বকবক করিনা। যেটা বলি সেটা সঠিক বলি।

আমি যা বলি তা ত্যাড়ছাভাবে বলি। যাতে সেটা ঠিকঠাক জায়গায় গিয়ে পড়ে। কারণ বাঁকা ত্যাড়া জিনিস আর মানুষ সবসময়ই আমার আশপাশে থাকে।

রিপ পুনরায় অবাক হলো। আজ মেয়েটার কি হলো?

তুমি কি থামবে?

হেরে গেলেন তো? আরেহ ওই কথা আপনার মনে রাখা উচিত। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।

বলেই হি হি করে হেসে উঠলো সে। রিপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর ঘরে এল না।

ন’টার দিকে নীরা অফিস ঘরের দিকে যেতেই ক্লায়েন্টদের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। একটা মেয়েলী গলাও শুনতে পেল সেখানে। রিপ তার সাথেও কথা বলছে । আচ্ছা আচ্ছা এখানে এসবও চলে তাহলে? রাগে-দুঃখে তার কান্না করতে ইচ্ছে হলো। রাতবিরেতে অন্য মহিলার সাথে কথা বলছে ভালো করে আর তার সামনে এলে মুখে মোয়া গুঁজে রাখে। আজ আসুক। বিছানায় আজ সে আর কোলবালিশ ঘুমাবে শুধু। একদম ঘুমাতে দেবে না।

চলবে……..

কমেন্ট কমেন্ট কমেন্ট চাই

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here