মন পাড়ায় পর্ব ৩১+৩২

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩১
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

প্রভা চিন্তিত সুরে বলল, “দাঁড়াও মা কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি সেখানে গিয়েছে নাকি?” প্রভা যেতে নিলেই সৈকত তাকে থামিয়ে বলল, “না ভাবি আমি ফোন দিয়ে দেখেছি ঝিনুক সেখানেও নেই।”

অর্ক জিজ্ঞেস করল, “ঝিনুককে কল দিয়েছিস?”

সৈকত অর্কের দিকে তাকালো। একটু ইতস্ততভাবে বলল, “ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি।”

আজ অনেক বছর অর্কের সাথে এমন স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে সৈকত, নাহয় তাকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কথাই হয় না সে কতবছর ধরে।

অর্ক সাথে সাথে বিছানা থেকে তার গাড়ির চাবি নিয়ে বলল, “ভার্সিটি যেয়ে আবার খোঁজ নেই চল।”

প্রভা আতঙ্কিত স্বরে বলল, “আমিও আসি।”

“না তুমি বাসায় থাকো। ঝিনুক আসলে কল করবে।” অর্ক বলেই সৈকতের সাথে রওনা দিলো। ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার রাস্তায় দেখলো। ঝিনুকের খালামণি কল দিয়ে জানালো সে ঝিনুকের বান্ধবীদের কাছে খোঁজ নিয়েছে অথচ কোথাও পায় নি। ভার্সিটি দারোয়ানকে দিয়ে সব রুম খুলে দেখল তবুও পেল না। দারোয়ান যখন ঝিনুকদের ডিপার্টমেন্টের টিচারকে কল দিয়ে জানাতে গেল তখন অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করিস না ঝিনুকের কিছু হবে না। আমরা ওকে খুঁজে বের করব। আমি আগে ছিলাম না কিন্তু এইবার আছে তোর কাছ থেকে আবার ঝিনুককে হারাতে দিব না আর।”

সৈকত চোখ তুলে একবার তাকালো। তার চোখে মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। সারাটা রাস্তায় এমন আতঙ্ক তার মুখে বিদ্যমান ছিলো। সৈকত কাঁপছিল বরাবরের মতো। সে এমন এক কাজ করল যার আশা অর্ক বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছিলো। সৈকত আচমকায় অর্ককে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা কন্ঠে বলল, “ভাইয়া আমার প্রচুর ভয় লাগছে। ওর সাথে যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়? এই পৃথিবীর কোনো স্থানেই মেয়েরা সুরক্ষিত নেই। সেখানে আমি কীভাবে না ভয় পাই?”

অর্ক সৈকতের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো তবে কিছু বলতে পারল না। তার মনে পড়লো তাদের ছোট বেলার সে দিনগুলোর একটা ঘটনা,

অর্ক তার বই পড়ছিলো নিজের রুমে। তার টেবিলের সাথেই জানালা। সে জানালা দিকে দেখল সৈকত এক গাছের নিচে বসে আছে তার কনুই ধরে কাঁদছে। সাথে সাথে সে উঠে গেলো। দৌড়ে নিচে যেয়ে সৈকতের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”

ছোট সৈকতটা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ভাইয়া দেখ আমি গলিতে খেলতে গিয়েছিলাম সেখানে ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফালিয়ে দিয়েছে। ব্যাথা পেয়েছি আমি। দেখ কত রক্ত বের হচ্ছে।”

অর্ক সৈকতের কনুই ধরে দেখলো। একটু রক্ত বের হচ্ছে কনুইয়ের সে অংশ থেকে। সে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু তারা এমন করেছে কেন?”

“জানি না তো ভাইয়া। সত্যি আমি কিছু করি নি। তারা বলেছে তাদের মা বলেছে আমার সাথে খেলতে না। আমার মা ভালো না তাই আমিও ভালো না। কিন্তু তারা এমন কেন বলেছে ভাইয়া?”

অর্ক কিছু বলল না। সে সৈকতকে বাসায় নিয়ে কাটা অংশটায় পরিষ্কার করে সেখানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। সৈকত ম্লানমুখে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া কেউ আমার সাথে না খেলতে চাইলে আমি কার সাথে খেলব?”

“আমি আছি না? আমার সাথে খেলবি।” অর্কের উওর শুনে সৈকত প্রথমে উৎসুক দেখালেও পরে মলিন চেহেরা নিয়ে বলল, “কিন্তু বাবা তো বকা দিবে। বাবা বলেছে যেন তোমায় পড়াতে বিরক্ত না করি। বিরক্ত করলেই মাইর দিবে। আর আমাদের বাসা তো ছোট খেলব কীভাবে?”

অর্ক হেসে বলল, “বাবা যখন থাকবে না তখন আমরা খেলব। আর আমরা কালকে ছাদে উঠে ক্রিকেট খেলব এখন আমাদের সবচেয়ে পছন্দের কাজটা করি।” কথাটা শুনতেই সৈকত উঠে দৌড়ে যেয়ে অর্কের ভায়োলিন ও তার খেলনা পিয়ানো নিয়ে এলো। অর্কের দিকে ভায়োলিন এগিয়ে দিলো। অর্ক দাঁড়িয়ে ভায়োলিনটা নিলো এবং সৈকত বসে তার পিয়ানো সামনে রাখল। দুইজনে একসাথে সুর ধরল। বাজাতে শুরু করল। যদিও সৈকতের খেলনা পিয়ানোটার সুরটা অশোভন শুনাচ্ছিল কিন্তু তা ঢেকে যাচ্ছিলো অর্কের মধুর বেহালার সুরে সুরে। সৈকত অর্কের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। ফেরতে অর্কও মৃদু হাসি ফিরিয়ে দিলো।

সৈকত ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাত জেগে পড়তে শুরু করল। এরপর যতদিন না পর্যন্ত সৈকত তার খেলার জন্য অন্যান্য সাথী পেল ততদিন এমনই চলতে থাকলো।

তারপর অনেক বছর কাটলো। সৈকত স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পরলো আর অর্ক তার বাবার ব্যবসায়ে সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অথচ তাদের সম্পর্কে এর বিন্দুমাত্র প্রভাব পরে নি। কিন্তু তখন প্রভাব পড়ল যখন অর্ক তার বিদেশে যাওয়ার কয়দিন আগে বাসায় এলো এবং দেখলো বাসায় ঝামেলা চলছে। তার বাবা সৈকতকে বলছিলেন “তোর মতো বেয়াদব ছেলে থাকা থেকে না থাকা ভালো। তোর বাবার সাথে এত উঁচু স্বরে কথা বলতে লজ্জা লাগে না তোর?” আবার সৈকতের মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “নিজের মতো তো ছেলেটাকে বানিতে চাচ্ছো? নিজে যেমন বস্তি থেকে উঠে আসছো ছেলেকেও তেমন বানাচ্ছো? নিজের বাপেরবাড়িতে ভরে ভরে টাকা পাঠাও আর ছেলের কানে আমার বিপক্ষে কথা দেও? তোমাকে তো এই ঘরেই রাখা উচিত না।”

সৈকতও উঁচু স্বরে বলল, “মা আমাকে কিছু বলে না কিন্তু আমার তো চোখ আছে। আপনি আমার মা’য়ের সাথে কী ব্যবহার করেন দেখি না আমি? উঠতে বসতে সব কিছুতে খোঁটা মারেন। একটু আগে যে মা’য়ের গায়ে হাত তুলেছেন তাও দেখেছি আমি। এমন কাপুরুষের মতো ব্যবহার করতে হলে বিয়ে করলেন কেন আমার মা’কে?”

তখনই অর্ক এসে সৈকতের পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাবার সাথে এমন কথা বলার সাহস কোথায় পেয়েছিস তুই?”

“ভাইয়া তুমি জানো না এই উনি কী করেছে!”

“আমি জানতেও চাই না। তুই এক্ষুণি ক্ষমা চাবি বাবার কাছ থেকে।” সৈকত কথাটা শুনতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি শুনেছ যে উনি আমাদের মা’কে মেরেছে?”

অর্ক একটু সময় চুপ থাকলো। সে তার ভাই ও বাবা দুইজনকে ভালোবাসে কিন্তু এই সময় সে যদি বাবার বিপক্ষে যায় তাহলে পরিবারের প্রধান ও বড় হওয়া সত্ত্বেও কোনো না কোনো জায়গায় হারিয়ে যাবে বাবার সম্মানটা। তাই আলাদাভাবে এই বিষয়ে কথা বলাটা শ্রেয় মনে করল অর্ক। তাই একটু ইতস্ততভাবে বলল, “এইটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোর বা আমি বলার কেউ না।”

সৈকত ভ্রু কুঁচকে বলল, “একজন আমাদের মা মেরেছে আর তুমি বলছ আমি এই বিষয়ে কথাও তুলব না? তুমি সহ্য করতে পারবে যে কেউ আমাদের মা’য়ের সাথে এমন ব্যবহার করছে?”

অর্ক উওর দিলো না। নিচে তাকিয়ে রইলো। সৈকত কিছুক্ষণ কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। তারপর তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “সরি আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের না আমার মা হবে। আর আমি তোমার সৎ ভাই।” অর্ক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এত বছরে তার ও সৈকতের মাঝে এমন কোনো কথাই হয় নি। লোকে বললেও তাদের এতে কিছু আসতো যেত না। তার সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ফাটল আসে নি কখনো। আর আজ এত বড় কথা!

অর্ক কাঁপানো কন্ঠে বলল, “এইসব কী বলছিস তুই সৈকত? তুই আমার ভাই আর আমি তোকে অনেক আদর….” অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রাখতে যেতেই সৈকত পিছিয়ে গেল। কঠিন কন্ঠে বলল, ” আজকের পর থেকে আপনি আমার কেউ না। আমি আপনার মতো মানুষ আমার জীবনের কোনো অংশে চাই না।”

সৈকতের মা তখন বলল, “বাবা এইসব বলতে নেই। ও তোর বড় ভাই।”

“যে তোমাকে নিজের মা হিসেবে সম্মানও দিতে পারে না সে আমার ভাই কীভাবে হয় মা? সে আমার সৎ ভাই এবং আজ তা অনুভব করিয়েও দিলো।” বলেই সৈকত চলে গেল সেখান থেকে। অর্ক তাকিয়েই রইলো সৈকতের যাওয়ার দিকে। তার সে ছোট বেলার সৈকতের কথা মনে পড়ছিল, সবসময় মনে পড়ে, আজও মনে পড়ে। আপন মানুষ জীবন থেকে চলে যেতে পারে মন পাড়া থেকে না।

.

.

ঝিনুক চোখ খুলতেই নিজেকে পায় এক অন্ধকার রুমে। তার মনে আছে সে পরিশের সাথে গাড়িতে উঠেছিলো। অনেকটা রাস্তা তাকে অনুরোধ করল যেন তাকে বাসায় দিয়ে যায়। সে শুনল না। এরপর হঠাৎ কখন সে ঘুমিয়ে গেলো নিজেও বুঝলো না। আর পরিশ ভাইয়া আর আদিল ভাইয়াই বা কোথায়? আর সে নিজেই বা কোথায়? এটা তো তার বাসা না। হঠাৎ আতঙ্কের ছাড়া ঝিনুককে ঘিরে বসলো। দরজা খোলার শব্দে সে আতঙ্ক হাজারোগুণ বেশি বেড়ে গেল।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩২
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

হঠাৎ আতঙ্কের ছাড়া ঝিনুককে ঘিরে বসলো। দরজা খোলার শব্দে সে আতঙ্ক হাজারোগুণ বেশি বেড়ে গেল।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো পরিশ। ঝিনুক তাকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “ও ভাইয়া তুমি আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

পরিশ রুমের ভেতর ঢুকলো এক প্লেট নিয়ে। সে ঝিনুকের দিকে প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “খিদে লাগি নি তোর?”

ঝিনুক সাথে সাথে প্লেটটা হাতে নিয়ে বলল, “লাগে নি মানে? খুব খিদে পেয়েছে।” বার্গারে এক কামড় দিকে সে আবার পরিশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম ভাইয়া তুমি জানলে কীভাবে যে আমি উঠেছি? আমি তো এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম।”

“আমার জন্য এনেছিলাম। আরও আছে আমি খেয়ে নিব।”

“ভাইয়া তুমি কী এখনো আমার সাথে রাগ করে আছো? সত্যি পরিস্থিতি এমন ছিলো যে আমাকে সৈকতের সাথে বিয়ে করতে হয়েছে, নাহলে আমি ওর সাথে কখনো বিয়ে করতাম না। আমরা যাকে ভালোবাসি তার এত বিশ্বাসঘাতকতার পর তার সাথে থাকাটা সবচেয়ে বেশি কষ্টের।”

কথাটা শুনতেই পরিশ তার হাত মুঠোবন্দী করে নিলো। তার চোখ দুটো মেঝেতে আটকে আছে, তার চোয়াল শক্ত, চোখে রাগ পরিপূর্ণ। সে চোখ তুলে তাকালো ঝিনুকের দিকে। তার ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল মুহূর্তের মাঝে। সে মৃদু হেসে বলল, “আমি জানি তুই ওই ছেলেটাকে ভালোবাসিস তাই তোর জন্য ভয় হয়, ভয় হয় তোর অবস্থা না আবার খালামণির মতো হোক যা আমি চাই না।” ঝিনুক খাবারটা মুখের কাছে নিয়েও থেমে গেল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো পরিশের দিকে।

পরিশ উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল। এক হাত পকেটে ভরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আমি তখন ছোট ছিলাম তবুও আমার স্পষ্ট মনে আছে, ভীষণ প্রাণোচ্ছল ছিলো খালামণি। হঠাৎ করে সে পরিবর্তন হয়ে যায়। হয়ে উঠে নিস্তেজ। তাকে আমি তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে কখনো হাসতে দেখি নি। শুধু সে বলতো একটা লোক তার জীবন শেষ করে চলে গেছে। তাকে ছেড়ে গেছে শুধু সমাজের লোকদের কাছে অত্যাচারিত হতে। আমি তার মৃতদেহ নিজের চোখের সামনে দেখেছি কিন্তু সেদিন আমার এত কষ্ট হয় নি যতটা হয়েছে তাকে প্রতিদিন হাজারোবার মরতে দেখে।” পরিশ আবার তাকাল ঝিনুকের দিকে। বলল, “সৈকতও কিন্তু অনেক মেয়ের সাথেই তাই করেছে যা ওই লোকটা তোর মায়ের সঙ্গে করেছে। অনেক ছেলে মেয়ে সে ট্যাগ পেয়েছে যা একসময় তুই পেয়েছিলি…..অবৈধ সন্তানের। আমি যদি অতীতে তোকে না আটকাতাম তাহলে হয়তো আজ তুই তোর মা’য়ের জায়গায় থাকতি আর কোনো এক অবৈধ সন্তান আবার এই পৃথিবীতে এসে লোকের কথা শুনতো।”

ঝিনুক চমকে তাকাল পরিশের দিকে। তার খাবার আবার প্লেটে রেখে তা একটু দূরে ঠেলে দিলো।

পরিশ তীক্ষ্ণ হাসলো এই দৃশ্যটি দেখে। সে খেয়াল করল ঝিনুকের ঠোঁট, হাত, পা সব কাঁপছে। তার চোখে পানি আসতে চাইছে তবুও সে আটকে রাখছে। পরিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলল, “হয়তো আমার উপর তোর অনেক রাগ আমি ছোট থেকে তোকে অনেক কিছুতে বাঁধা দিয়েছি কিন্তু যা করেছি সব শুধু তোর জন্য। যেন তুই কষ্ট না পাস। যেন মানুষের কটু কথায় তুই কষ্ট না পাস শুধুমাত্র এইজন্য। কিন্তু তুই আমার সব চেষ্টা বৃথা করে দিলি ঝিনুক ওই সৈকতের সাথে বিয়ে করে। যেখানে ও এতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে, যেখানে একটি মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করে ছেড়ে দিয়েছে সে এখন কোথায় তা কেউ জানে না সেখানে কী গ্যারান্টি আছে ও তোর সাথে এমন করবে না? তোকে পাওয়ার জেদ আছে ওর। ওর তোকে ভোগ করে ছেড়ে দিবে না এই গ্যারান্টি আছে? আর আমি তো তোর খারাপ চাইব না তাই না? আর বাবা না’কি প্রথমে অন্যকারো সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলো? তাদের না জানানো হলে তার হঠাৎ করেই বা কীভাবে জানলো যে…… আমি এমন কথা বলতে পারব না যা শুনে তুই দুঃখী হবি। তোর মনে হয় নি এইটা আজব?”

ঝিনুক হঠাৎ হাঁটু গুজে মুখে হাত দিয়ে ঢেকে কান্না শুরু করে দিলো। বলল, “প্লিজ ভাইয়া আর কিন্তু বলো না। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।”

পরিশ এসে ঝিনুকের পাশে বসল। ঝিনুকের মাথাটা তার কাঁধে রেখে বলল, “কাঁদিস না। আমি এসে পরেছি তো। সব ঠিক করে দিব। সময় উল্টাতে না পারলেও সবকিছু তার আসল মালিকই পাবে৷ যার যে জিনিস সে সেটাই পাবে।”

সে ঝিনুকের পা থেকে মুখ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিলো।

কেমন যেন সে দৃষ্টি!

ঝিনুক কাঁদছে অনবরত। যখন তার কান্না একটু কমে আসলো তখন সে বলল, “থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। তোমাকে পেয়ে আমি অনেক লাকি। আর অবশ্যই তুমি আমার খারাপ চাইবে না তা আমি তা জানি কারণ তুমি আমাকে অনেক আদর কর। আর আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমাদের হয়তো রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তুমি কখনো আমাকে আপন বোন থেকে কম ভাবো নি। আর আমারও কখনো মনে হয় নি যে আমার আপন কোনো ভাই নেই আমাকে রক্ষা করার জন্য। কারণ তুমি সবসময় আমার পাশে ছিলে।”

পরিশের মুখের রঙ সাথে সাথে উড়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই খাবার খেয়ে নে, আমিও খেয়ে আসি।”

পরিশ যেতে নিলেই ঝিনুক বলল, “ভাইয়া আমরা কোথায়?”

“আদিলের বাসায়। তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলি তাই বলে বাসায় যাই নি। তোর ফোনে চার্জ শেষ দেখে চার্জে দিয়েছি।”

ঝিনুক সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। অস্থির হয়ে বলল, “সবাই তো তাহলে চিন্তায় আছে৷ রাত হয়ে গেছে অথচ আমি বাসায় যাই নি। কাউকে কিছু বলিও নি। প্রভা আপিকে ফোন দেওয়া দরকার।”

“আমি দিয়ে দিব।” বলেই পরিশ দরজার কাছে গেল। দরজা বন্ধ করার পূর্বেই ঝিনুক বলল, “ভাইয়া আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে সৈকতকে ডিভোর্স দিয়ে দিব শুধুমাত্র প্রভা আপু ও অর্ক জিজুর সম্পর্ক একটু মজবুত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। তবে সম্ভবত ভাবছিলামই। ওর সাথের বাঁধনগুলো ভাঙা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। ভালোবাসার বাঁধন, মায়ার বাঁধন আর…….” ঝিনুক থেকে কিছু মুহূর্ত সময় নিলো। আবার বলল, “বিয়ের বাঁধন। হয়তো ভাঙতে পারতাম না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে পারব। হয়তো আমি নিজে ভেঙে পরব কিন্তু আমার অস্তিত্ব বিলীন হওয়া থেকে বেঁচে যাবে।”

পরশ মৃদু হাসলো ঝিনুকের কথা শুনে তারপর চলে গেল।

ঝিনুক বসে পরলো খাটে। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজ অজান্তেই তার চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পরতে শুরু করলো। সে চোখে সব অস্পষ্ট দেখতে পারছিলো। তার মনে পড়তে শুরু করলো তার অতীতের স্মৃতিগুলো। অতীতের স্মৃতির পাতা উল্টে প্রবেশ করল কিছু বছর পূর্বের সে সুন্দর স্মৃতির পাতায়……

রাঙামাটিতে এক রিসোর্টে যেয়ে উঠলো তারা। দুইতলা ও তিনতলা সম্পূর্ণ নিজেরা নিলো। রিসোর্টটা ছিলো সাধারণ বাসার মতোই। আলাদা আলাদা রুম ছিলো না। তিন বেড ও ডাইনিং। সৈকত ও ঝিনুকরা ছিলো তিনতলায়। তাদের বান্ধবীদের সাথে। প্রতিরুমে দুইজন করে থেকেও তিনতলার একরুম খালি থাকলো।

ভোর চারটায় আসায় মোটেও ঘুম আসছিলো না ঝিনুকের। তার বান্ধবী আরামে ঘুমাচ্ছে। আর সে পানি নিতে এসেছে ডাইনিং রুমে। এসে দেখে সৈকত ডাইনিং রুমে বসে কফি খাচ্ছে। ঝিনুক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এত সকালে কফি কোথা থেকে পেলেন?”

সৈকত কারো কন্ঠ শুনে তাকাল। ঝিনুককে দেখে বলল, “তুমি ঘুমাও নি?”

“ঘুম আসছে না। আপনি জেগে আছেন যে?”

“আমার বন্ধুর ঝগড়া চলছে গার্লফ্রেন্ডের সাথে, নাহয় বলা উচিত বকা খাচ্ছে। শালার প্রেম করে গার্লফ্রেন্ডরেও সামলাতে পারে না কচুর প্রেম করে।” কথাটা বলেই জিহ্বা কেটে তাকাল ঝিনুকের দিকে। ঝিনুক হেসে একটি চেয়ারে বসে বলল, “এক্সপিরিয়েন্স আছে আপনার গার্লফ্রেন্ড সামলানোর?”

“কফি নিবে?”

“হলে মন্দ হয় না। কিন্তু গরম পানি কোথায় পাবেন?”

“ইলেকট্রনিক কেতলি এসেছি সাথে কফির প্যাকেট ও সুগার ফ্রী এর প্যাকেট তাই বানানো সহজ।”

“মাথা ব্যাথা অবশ্য আছে। হলে ভালো হয়।” সৈকত হেসে উঠে গেল। রান্নাঘরটা ছোট ভীষণ। সেখানে কিছুই নেই শুধু চারটা প্লেট ও চারটা গ্লাস ছাড়া। সৈকত একটা গ্লাসে কফি বানিয়ে এনে ঝিনুককে দিলো আর তার রুমে ফেরত গেল। ঝিনুক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সৈকতের নিজের যাওয়ার দিকে। কোনো কথা নেই বার্তা নেই রুমে চলে গেল। নিজের কফিটাও নিলো না।

সৈকত ফিরে এলো হাতে একটা গিটার নিয়ে। বলল, “কফি দুইটা নিয়ে আসো।”

“কোথায়?”

সৈকতের উওর না পাওয়ায় সে সৈকতের কথামতো কফি দুইটা নিয়ে গেল তার পিছনে। সৈকত খালি রুমের বারান্দায় যেয়ে নিচে বসলো। ঝিনুককে এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে বলল, “তাকিয়ে আছো কেন? বসো।”

ঝিনুক তার বসলো একটু দূরত্ব বজায় রেখে। সে সৈকতের কফিটা তাকে দিয়ে বলল, “গিটার বাজাতে পারেন?”

“শিখেছিলাম দুইবছর আগে। কোনো মেয়েকে ইম্প্রেস করতে যদি প্রয়োজন পরে।”

ঝিনুক হেসে সৈকতের দিকে তাকিয়ে মশকরা করে জিজ্ঞেস করল, “ওহ তো কয়জনকে ইম্প্রেস করেছেন?”

“তুমিই প্রথম।” উওরটা শুনে ঝিনুক অনেকটা হকচকিয়ে গেল। তার গালদুটো মেখে গেল লজ্জার রঙ্গিমায়। সে মাথা নামিয়ে তার গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি তো বুঝেছি আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিলো। যেভাবে গার্লফ্রেন্ড সামলানোর কথা বললেন।”

“ছিলো না তা তো বলি নি। তবে কাউকে ইম্প্রেশ করার জন্য মন চায় নি।”

ঝিনুক আড়চোখে তাকালো সৈকতের দিকে। আবার সামনের দিকে তাকালো। দেখলো কুয়াশার আপন মনের খেলা। তার হাতের গ্লাসটা নিচে রেখে নিজের চাদর আরও শক্ত জড়িয়ে বলল, “ভীষণ ঠান্ডা পরেছে।”

“তোমার গালের লালিমা কী শীতের না লজ্জার?” কথাটা শুনে তার লজ্জার রঙ আরও বেশি গাঢ় হলো।

সে বলল, “গিটার বাজিয়ে শুনাবেন না আমায়?”

সৈকত কিছু না বলে গিটার হাতে নিলো। বাজানো শুরু করল।

ঝিনুক তার হাঁটুতে মাথা রেখে মুচকি হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। সৈকত হঠাৎ করে গিটার বাজানো বন্ধ করায় ঝিনুক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “বন্ধ করলেন কেন?”

সৈকত এসে ঠিক ঝিনুকের পাশে বসলো। তাকে ঘুরিয়া সামনা-সামনি বসালো। ঝিনুকের কফির গ্লাসে দুইহাত রেখে আবার সে দুইহাত রাখল ঝিনুকের দুই গালে। সৈকতকে এত কাছে পেয়ে এমনিতেই তো ঝিনুকের নিশ্বাস আটকে আসা অবস্থা এর উপর তার স্পর্শে সে যেন সেখানেই শেষ। সে কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কী…কী করছেন?”

সৈকত ঝিনুকের চোখে চোখ রেখে বলল, “দেখছি তোমার গালের লালিমা কি এই হিম জড়ানো আবহাওয়ার না আমার স্পর্শ জড়ানো লজ্জার।”

সে লজ্জামাখা হিম সময়ে সে মানুষটার চোখে ডুব দিয়ে ঝিনুকের বুকে বয়েছিল এক উষ্ণময় অনুভূতি। তার ভয় করছিলো এই হৃদয়ের দ্রুত কম্পন সৈকত না শুনে নেয়। সে এমনিতেই লজ্জায় মাখা আর মাখতে চায় না এই লজ্জায় রঙ।

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here