মন ময়ূরী পর্ব -০৫

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

৫.

-ফর গড সেইক, জব্বার তুমি তোমার আজব কথাগুলো বলা বন্ধ করবে, কখন?

ফায়েজ দাঁতে দাঁত চেপে বললো।কিন্তু, জব্বারকে দেখে মনে হলো না, যে সে ফায়েজের কথায় গুরত্ব দিয়েছে।

-স্যার,কলেজ জীবনে একটা প্রেম করেছিলাম খাঁন বাড়ির মেয়ের সঙ্গে। সারাদিন খালি গিফট গিফট করে মাথা আউলা ঝাউলা করে ফেলতো। আমার জমানো টাকা দিয়ে ওর শখ-আহ্লাদ পূরণ করেছি কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সে কি করলো জানেন, মোল্লা বাড়ির ছেলের সাথে পালিয়ে গেলো আমাকে ছ্যাকা দিয়ে। জানেন, স্যার আমি দু’দিন পর্যন্ত নায়ক বাপ্পারাজের গানগুলো শুনেছি। সে থেকে আমাদের গ্রামের সবাই আমাকে বাপ্পারাজ টু বলে ডাকে।

ফায়েজ খেয়াল করে দেখলো শেষের কথাগুলো বলার সময় জব্বারের চেহেরায় আলাদা এক দাম্ভিকতা ফুটে উঠেছে।

-জব্বার,তুমি তোমার এই প্রেমকাহিনী আমাকে একশবার শুনিয়েছো আর একদিন যদি তোমার এই গল্প আমার সামনে রিপিট করেছো দেন আই উইল ফায়ার ইউ,মাইন্ড ইট। এখন যাও খবর নিয়ে দেখো খেয়ার চুলে যে ছেলেটা হাত দিয়েছে সে কি হয় খেয়ার?

জব্বার ভয় পাওয়া চেহারা নিয়ে ফায়েজের সামনে দিয়ে হেটে চলে গেলো স্টেইজের দিকে।

এদিকে ফায়েজ মোবাইল বের করে তার মায়ের কাছে কল দিলো।কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফায়েজের মা বললো,

-ফায়েজ তুই চলে এসেছিস?

-এসেছি প্রায় দশমিনিট হবে। তোমরা আছো কোথায়?

-তুই দাঁড়া আমি আর ফাহিম আসছি।

কল কেটে দিলো ফায়েজ এরপর ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্টেইজের দিকে যেখানটায় খেয়া তার বান্ধবীদের সাথে হেঁসে কথা বলছে।

ফায়েজ খেয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

-শুভ জন্মদিন, খেয়া। তুমি আজ এইদিনে পৃথিবীর আলো দেখেছিলে বলে আজ এইখানটায় দাঁড়িয়ে তোমার মনভোলানো হাসিতে মুগ্ধ আমি।

খেয়া অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মাস্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুরুষটির দিকে। কন্ঠস্বর আর চোখ দেখে মনে হচ্ছে আগেও তাদের দেখা হয়েছে।

খেয়ার অভিব্যক্তি দেখে ফায়েজ হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে, যে খেয়া ওকে দেখে চিনতে পারেনি। তাই ফায়েজ মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে দিলো।

খেয়া ফায়েজ দেখে যতটা অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে এই পার্টিতে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকেই বিশেষ করে মেয়েরা।

মেয়েরা ফায়েজ চৌধুরী বলে একপ্রকার হুমড়ি খেয়ে ফায়েজের সামনে ভিড় জমাতে লাগলো।
ফায়েজ এখন বুঝতে পারছে আসলে সে খেয়ার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে গিয়ে নিজের অবস্থা এখন বেহাল বানিয়ে ফেলেছে।

এমন সময়ে কোত্থেকে জব্বার আর ফায়েজের দুজন দেহরক্ষী এসে ফায়েজকে আড়াল করে ফেললো।জব্বার প্রত্যেক মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আপনারা প্লিজ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ফায়েজ স্যার সবাইকে অটোগ্রাফ দিবেন এবং ছবিও তুলবেন।

পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে এলো।কিন্তু, ঘুরেফিরে মেয়েরা বারবার ফায়েজের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়েজের এমন অবস্থা হয়েছে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
ততক্ষণে, ফায়েজের মা, বাবা, ফাহিম সবাই চলে এসেছে সাথে খেয়ার মা,বাবা এবং দাদি।

নিধি,খেয়া আর রওশান খেয়াকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না, যে হিরো ফায়েজ চৌধুরীর সাথে ওর পরিচয় হলো কি করে?

আর খেয়া সে তো একবার ফায়েজের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার কয়েকটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

-আমি কি আর সাধে বলি, সামনের দাত দেখিয়ে কিভাবে ছবি তুলে!দেখো মেয়েরা কিভাবে তাকিয়ে আছে নায়ক সাহেবের দিকে? এই জন্যই তো হিরোদের এত ডিমান্ড বেড়ে যায়।

এমন সময় স্টেইজ থেকে এনাউন্সমেন্ট এলো,মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে খেয়ার বাবা কবির খাঁন।
উপস্থিত সকল মেহমানরা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত আসন গ্রহন করলো।

খেয়া, খেয়ার মা আর দাদি প্রথম সাড়িতে বসে পড়লো আর তাদের পিছনের সারিতে ফায়েজ, ওর মা, বাবা আর ফাহিম।ফায়েজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জব্বার আর দুজন দেহরক্ষী।

-লেডিস এন্ড জেন্টালম্যান, আজকের এই ক্ষণে আপনাদের উপস্থিতি আরও আনন্দদায়ক মূহুর্তের সৃষ্টি করেছে আমাদের মাঝে। সকলেই হয়তো জানেন আমার একমাত্র মেয়ে নুজহাত খান খেয়ার জন্মদিন।আপনারা সকলে আজ জন্মদিনের অনুষ্ঠান যোগ দিয়েছেন এতে আমাদের পরিবারের সকলের কাছে থেকে জানাই আপনাদের আন্তরিক অভিনন্দন।
আমার মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের বাইরেও আজ আরও একটি সুসংবাদ আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।
আমার মেয়ের সব আনন্দ, চাওয়া-পাওয়া আমি আমার সাধ্যমতো পূরণ করে এসেছি। আজকের জন্মদিন উপলক্ষে হয়তো আমার মেয়ে আমার কাছ থেকে উপহার প্রাপ্য কিন্তু আমি তাকে দিব না। কারণ, এবার আমার মেয়ের কাছ থেকে আমি উপহার চাই।

মা, খেয়া দিবি তো তোর বাবাকে উপহার, আমি যা চাই?

খেয়া তার বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিয়ম করলো। চোখের ইশারায় তার বাবাকে বুঝিয়ে দিলো, তার বাবা তার কাছ থেকে যা চাইবে তাই সে দিবে।

-আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় জনাব মাহমুদ চৌধুরীর বড়ো ছেলে সুপারস্টার ফায়েজ চৌধুরীর সাথে আমার একমাত্র মেয়ে নুজহাত খাঁন খেয়ার বিয়ের মতো একটি গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।
আজকের এই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে খেয়ার আর ফায়েজের এঙ্গেইজমেন্ট সর্ম্পূন করা হবে।

সকলের করতালিতে মুখরিত পুরো ক্লাব জুড়ে। ফায়েজ নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। জব্বার এগিয়ে এসে যখন অভিনন্দন জানালো ঠিক তখনি ফায়েজের বিশ্বাস হয়েছে যা সে শুনেছে সবই সত্য।

ফায়েজের বাবা, মা ফাহিম এসে ফায়েজকে একে একে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাতে লাগলো।ফায়েজ তার মা’কে জড়িয়ে ধরার পর মাথা উচু করে তাকাতেই দেখতে পেলো খেয়াকে। যার দুচোখ পানিতে টলমল করছে। যেকোনো মূহুর্তে অঝোর ধারায় বর্ষিত হবে।

ফায়েজ তার মা’কে ছেড়ে খেয়ার কাছে যাবার আগেই খেয়া এক দৌঁড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে কোথাও চলে যাচ্ছে? ফায়েজ যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখলো খেয়ার মা, দাদি আর বাবা খেয়ার পিছনে ছুটে গেলো।

********************

ক্লাবের একটি কক্ষে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে খেয়া। আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওর মা,বাবা আর দাদি। খেয়ার বাবা মুখ কালো করে বললো,

-খেয়া, ফায়েজকে বিয়ে করতে রাজি নয়। এই কথা আগে কেন জানাওনি?

-আমরা ভেবেছিলাম তুমি বাংলাদেশে এলে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করবো। কিন্তু, তুমি আমাদের না জানিয়ে এরকম সিদ্ধান্ত নিবে আমরাও ভাবতে পারিনি।

-এখন, আমি কি করবো? একদিকে মিডিয়ার লোক অন্যদিকে বড়ো বড়ো মন্ত্রী দু’জন, জড়িয়ে আছে ফায়েজের মানসম্মান, ক্যারিয়ার। আর জড়িয়ে আছে আমার মেয়ের জীবন।এখন আমি কি করবো মা?

মাথায় হাত দিয়ে রুমের ফ্লোরে বসে পড়লেন কবির। খেয়ার মা আর দাদি অজানা শঙ্কায় কাঁপতে লাগলেন। খেয়ার মনে কি চলছে বোঝা গেলো না?

এমন সময় খেয়ার বাবার মোবাইল বেজে উঠলো। খেয়ার বাবা পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো,উনার কলিগ কল করছেন। উনি কল রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উনার কলিগ বলেন,

-আপনি কোথায় মিস্টার কবির? আপনার এবং আপনার মেয়ের জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করছি, কিছু কি হয়েছে?

-না না কিছুই হয়নি।আমি আসছি আপনারা প্লিজ অপেক্ষা করুন।

-জি, আপনি জলদি আসুন।

কল কেটে দিলেন খেয়ার বাবা।খেয়ার মা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

-এখন কি করবেন? একদিকে নিজের সম্মান অন্যদিকে আমাদের খেয়া?

-শুনো রেহনুমা, আগে আমার মেয়ে এরপর অন্যকিছু৷ দরকার হলে আমি সবার কাছে মাফ চাইবো তবুও আমার মেয়ের অমত যেখানে সেখানে আমার মেয়েকে বিয়ে দিবো না। তোমরা পিছনের গেইট দিয়ে গাড়িতে চড়ে বাড়িতে চলে যাও। কেউ কল করলে রিসিভ করবে না। আর দারোয়ানকে বলবে মিডিয়ার লোক যেন বাড়িতে কোনোভাবে প্রবেশ করতে না পারে। নয়তো, তোমাদের নানান প্রশ্ন করবে।

কবির খাঁন দরজা খুলে বের হবার আগ মুহূর্তে খেয়ার কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরলেন।

-বাবা, আমি ফায়েজ চৌধুরীকে বিয়ে করতে রাজি।

খেয়ার কাছ থেকে এমন কথা শুনে খেয়ার মা আর দাদি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কারণ, তারা তো জানে খেয়া ঠিক কতটা অপছন্দ করে ফায়েজকে আর তার কর্মকে।

আজ বুঝি তার বাবার মান-সম্মানের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা নিজের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে বলি দেবার চিন্তা করছে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here